বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] বাংলাদেশে বসবাসরত জনগোষ্টির একটি বৃহৎ অংশের ধর্ম। বাংলাদেশকে চিনতে জানতে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মাচার ও সংস্কৃতি জানাটা জরুরী। সেই প্রয়োজন থেকেই এই প্রবন্ধটির অবতারণা। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ০.৪% (প্রায় ৬০০,০০০) খ্রিস্টান। ইহুদি ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের সাথে একসাথে (এছাড়া অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী যেমন নাস্তিকতা, শিখ ধর্ম, বাহাই ধর্ম এবং অন্যান্য), তারা জনসংখ্যার ০.৭%। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ইসলাম দেশের ধর্মের ৯০.৪%%, তারপরে হিন্দু ধর্ম ৮.৫%। বাংলাদেশের সব জেলায় খ্রিস্টধর্ম একটি সংখ্যালঘু ধর্ম।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 2 Patharghatta Roman Catholic Church Chittagong [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/Patharghatta-Roman-Catholic-Church-Chittagong-240x300.jpg)
Table of Contents
খ্রিস্টধর্ম [ Christianity]
বিশ্বের ধর্মগুলির মধ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম অন্যতম এবং সবচেয়ে প্রচারমুখী ধর্ম। খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি নাজারাতের যিশুর জীবন ও বাণীকে ভিত্তি করে। ইসলামের দৃষ্টিতে হজরত ঈশা (আ.) পয়গম্বরদের মধ্যে একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে হজরত ঈশাই (আ.) ক্রাইস্ট এবং তাঁর জন্ম হয়েছে অলৌকিকভাবে, কোন পুরুষের ঔরস থেকে নয়। আল্লাহর নির্দেশে ঈশ্বরের দূত মরিয়মের কাছে শুভবার্তা বহন করে নিয়ে গিয়েছিল এবং বলেছিল : তোমার প্রতিপালক তো আমাকে পাঠিয়েছেন তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য।’
মরিয়ম বলল: কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যাভিচারিণীও নই।
সে বলল : ‘এইভাবেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এ আমার জন্য সহজ, আর আমি তাকে সৃষ্টি করব মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আল্লাহর তরফ থেকে এক আশীর্বাদ হিসেবে। এ তো এক নির্ধারিত সিদ্ধান্ত।’
তারপর মরিয়ম গর্ভে সন্তান ধারণ করল ও তাঁকে নিয়ে দূরে চলে গেল এক জায়গায়। প্রসববেদনা তাঁকে এক খেঁজুরগাছের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। সে বলল, ‘হায়! এর আগে যদি আমার মরণ হত, আর কেউ মনে না রাখত।’
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 3 বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2018/09/Christmas-in-Bangladesh-300x173.jpg)
ফেরেশতা গাছের নিচ থেকে ডেকে বলল : ‘তুমি আমার দিকে খেজুর গাছের ডাল ঝাঁকাও, তোমাকে পাকা-তাজা খেজুর দেবে। সুতরাং খাও, পান করো ও চোখ জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকেও যদি তুমি দেখো, তখন বলো আমি করুণাময়ের উদ্দেশে মৌনতা পালনের মানত করেছি। তাই আমি কিছুতেই কোন মানুষের সঙ্গে কথা বলব না। তারপর সে (মরিয়ম) তাঁকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে হাজির হল। ওরা বলল: মরিয়ম! তুমি তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছে। ওহে হারুণের বোন! তোমার পিতা তো খারাপ লোক ছিল না আর তোমার মা-ও তো ব্যাভিচারিণী ছিল না। তারপর মরিয়ম শিশু ঈশার দিকে ইঙ্গিত করল। ওরা বলল, কোলের শিশুর সঙ্গে আমরা কেমন করে কথা বলব?
সে (শিশু ঈশা) বলল: আমি তো আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে আশিস ভাজন করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন নামাজ ও যাকাত আদায় করতে এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আর তিনি আমাকে উদ্ধৃত ও হতভাগ্য করেননি।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 4 The Armenian Church of the Holy Resurrection, built in 1781, Armanitola, Dhaka [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/The-Armenian-Church-of-the-Holy-Resurrection-built-in-1781-Armanitola-Dhaka-225x300.jpg)
আমার শান্তি ছিল যেদিন আমি জন্মলাভ করেছিলাম ও শান্তি থাকবে যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমার পুনরুত্থান হবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘এই-ই মরিয়ম পুত্র ঈশা, যে বিষয়ে ওরা তর্ক করে।’ (সুরা মরিয়ম ১৬-৩৫) আল্লাহর নির্দেশে হজরত ঈশা (আ.) মৃত ব্যক্তির প্রাণদান করতে পারতেন। মাটির পাখির মধ্যে জীবন সঞ্জার করতে পারতেন। তাছাড়া আল্লাহর কৃপায় তিনি অন্ধকে দৃষ্টিদান ও কুন্ঠগ্রস্ত রোগীদের সুস্থ করে। তুলেছিলেন।
পবিত্র কুরআনে হজরত ঈসা (আ.)-এর নাম পঁচিশ স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ‘ইবনে মরিয়ম’, ‘মসিহ’, ‘আবদুল্লাহ’, ‘রাসূলুল্লাহ’। এছাড়া তাঁকে ‘ঈশ্বরের বাণী’, ‘রুহুল্লাহ’, ‘ঈশ্বরের চিহ্ন’ এবং অন্য নামে ১৫টি বিভিন্ন সুরায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে ‘জেসাস’-কে ‘ঈশা’ বলা হয়েছে। হিব্রু ‘ঈসাও’ থেকে আরবীতে ‘ঈশা’ হয়েছে, লাতিনে হয়েছে ‘জেসাস’ তার ক্ল্যাসিক্যাল নাম ‘জোশুয়া’ থেকে। ‘ইসাও’ হিব্রুদের একটা সাধারণ নাম। এই নামটি ঘাটবারেরও বেশি ব্যবহার করা হয়েছে বাইবেলের প্রথম পুস্তক জেনেসিস-এ হাস্টন স্মিথ বলেন, খ্রিষ্ট ধর্ম মূলত একটি ঐতিহাসিক ধর্ম। খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস যিশুখ্রিষ্টের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটেছে।
খ্রিস্টধর্মের প্রচার:
যিশুর মৃত্যুর ৩০০ (তিনশত) বছর পর রাজা কনস্তান্তিনোপলের পৃষ্ঠপোষকতায় ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে নাইসিয়াতে সম্মেলনের (Nicen Council) মধ্যদিয়ে বর্তমান খ্রিষ্টধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই নাইসিয়া সম্মেলনের মাধ্যমেই রচনা করা হয়। আজকের বাইবেল—এবং এরই মধ্যদিয়ে তারা প্রতিষ্ঠিত করে ‘ত্রিত্ববাদ”।
ত্রিত্ববাদ :
ত্রিত্ববাদ এখন খ্রিষ্টধর্মের বৈশিষ্ট্য; পবিত্র পিতা, পবিত্র পুত্র এবং পবিত্র আত্মা— এই ত্রয়ীর মিলিত রূপই হচ্ছেন ঈশ্বর; তারা হাজির করল, তিনে এক একে তিন তত্ত্ব; এবং এই নোতুন রচিত বাইবেলকেই শাশ্বতজ্ঞান করে দুনিয়ার খ্রিষ্ট অনুসারিদের মান্যপুস্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়; আর পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয় বিগত দিনের সমস্ত গসপেলসমূহ। বাইবেল খ্রিষ্টদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। প্রচলিত বাইবেলের দুটি ভাগ: একটি পূর্ব খণ্ড (Old Testament) অন্যটি অন্তখণ্ড (New Testament)।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 5 The Cathedral of the Immaculate Conception, Dhaka [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/The-Cathedral-of-the-Immaculate-Conception-Dhaka-300x225.jpg)
ভারতে খ্রিষ্টধর্মের প্রচার :
উইলিয়াম কেরী (Dr. William Carey, 1761-1834, ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে শ্রীরামপুর থেকে প্রায় ৪০টি ভাষা ও উপভাষায় খ্রিষ্টধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। কেরী পরবর্তী অনুবাদগুলিতে বাংলা পরিভাষয় নানা বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। এসব অনুবাদে God এর বাংলা পরিভাষা ঈশ্বর থেকে ক্রমশ আল্লাহ, খোদা, ভগবান এবং যিশু খ্রিষ্টের বাংলা পরিভাষায় প্রভু যিশু, ঈসা মাসীহ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। গ্রিক (biblion), ল্যাটিন (biblia) ও ইংরেজি (bible) শব্দটির অর্থ গ্রন্থাবলি বা গ্রন্থমালা।
মূল গ্রিক বাইবেল বা ক্যাথলিক বাইবেলের পুস্তকের সংখ্যা ৭২টি। প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার : (Martin Luther, 1529 AD) ৭টি পূর্ণ বইকে জাল বলে বাতিল করেন। বাকি বইগুলি থেকেও অনেক অধ্যায় ও আয়াত জাল বলে বাতিল করেন। এজন্য প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে বইয়ের সংখ্যা ৬৬টি। ক্যাথলিক বাইবেল বাংলায় ‘পবিত্র বাইবেল : জুবিলী বাইবেল‘ নামে অনূদিত এবং বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী ১৯৯৯, ২০০৬ কর্তৃক প্রকাশিত। বাংলা বাইবেলের কেরির অনুবাদই মূল ইংরেজির নিকটবর্তী, কিন্তু ভাষা দুর্বোধ্য।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 6 বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2018/09/Christmas-in-Bangladesh-3-300x188.jpg)
মুসলমানী অনুবাদগুলিতে মূলত মুসলিমদের ধর্মান্তর করার দিকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি সর্বশেষ বাইবেলকে ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস নামে প্রকাশ করেন। এতে বাইবেলের বইগুলির নামও পরিবর্তন করা হয়। বাংলাদেশে খ্রিষ্টান প্রচারকগণ ‘ইঞ্জিল শরীফ‘ নামের একটি পুস্তক প্রচার করেন। এটি বাইবেলের ‘নতুন নিয়ম’কে ‘ইঞ্জিল’ নামকরণ। ইঞ্জিল শব্দটির ইংরেজি ইভানজেল (evangel)। শব্দটি প্রাচীন গ্রিক (euagglion/ euaggelos) থেকে গৃহীত। এর অর্থ সুসংবাদ।
ইংরেজিতে একে গসপেল (Gospel)ও বলা হয়। খ্রিষ্টান বাইবেলের দ্বিতীয় অংশ ‘নতুন নিয়ম’ (the New Testament) এর মধ্যে মোট ২৭টি পুস্তক বিদ্যমান। এগুলির মধ্যে মাত্র ৪টি পুস্তককে খ্রিষ্টীয়মণ্ডলী ‘ইঞ্জিল’ বলে স্বীকার করেন। মূল গ্রিক বা ইংরেজি বাইবেলে এগুলির নাম হল:
১. The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Matthew / The Gospel According To St. Matthew : সাধু মথির মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল।
2. The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Mark/ The Gospel According To St. Mark : সাধু মার্কের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল।
3. The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Luke / The Gospel According To St. Luke সাধু লুকের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল।
8. The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. John / The Gospel Accroding To St. John : সাধু যোহনের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 7 The Armenian Church of the Holy Resurrection, built in 1781, Armanitola, Dhaka [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/The-Armenian-Church-of-the-Holy-Resurrection-built-in-1781-Armanitola-Dhaka-1-300x225.jpg)
‘খ্রিষ্টান’ বা Christian শব্দটির প্রথম ব্যবহার শুরু হয় এখনকার সিরিয়ার এন্টিয়াক Antioch শহরে ৩৫ থেকে ৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ইহুদি ও অইহুদিদের সমন্বয়ে একটি নতুন ধর্মবিশ্বাসীদের পরিচয় সর্বসমক্ষে উপস্থাপনের মাধ্যমে। যিশুখ্রিষ্টের প্রতি অকৃত্রিম ও পূর্ণ বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই এই খ্রিষ্টান ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ যাত্রা।
গ্রিক ভাষায় Christo খ্রিষ্ট শব্দটি হিব্রু ‘মেসাইয়াহ্’ শব্দের ভাষান্তর। ঈশ্বর কর্তৃক মানবজাতির জন্য প্রদত্ত নির্দেশনাসমূহ পূরণে ঈশ্বরের পছন্দের কোন প্রেরিত পবিত্র ব্যক্তিকে ‘মেসাইয়াহ্’ (Messish) বলা হয়। ইহুদিদের বিশ্বাস ছিল যে তাদের জাতীয় মুক্তিদাতারূপে এক মেসাইয়াহ্’র আগমন ঘটবে। নাজারাথের যিশুকে সেই প্রত্যাশিত আগমনকারী নবী ও পথপ্রদর্শকরূপে গণ্য করে যিশুর মৃত্যুর অব্যবহিত পর থেকেই এই নতুন ধর্ম আন্দোলনটি বিস্তৃত হতে থাকে।
খ্রিষ্টান ধর্ম আন্দোলন যতই বিস্তৃত হতে থাকে যিশুর নামের সঙ্গে ‘খ্রিষ্ট’ উপনামটি ততই জোরালো হয়ে এক পর্যায়ে ‘খ্রিষ্টান ধর্ম’ ও ‘যিশুখ্রিষ্ট’ শব্দ দুটি সমার্থক শব্দে পরিণত হয়। যদিও এই ধর্ম বিশ্বাসে ‘খ্রিষ্ট’ নামটিতেই মূল বিশ্বাস আবর্তিত।
খ্রিষ্টানদের চিহ্নিতকরণে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যে খ্রিষ্টান ধর্ম আন্দোলনের মূল রয়েছে প্রাচীন ইস্রাইলিদের জীবনাচার ও বিশ্বাসে। এখানে শুধুমাত্র হিব্রু ‘মেসাইয়াইহ্’ শব্দটির গ্রিক ভাষায় অনুদিত হয়েই নতুন খ্রিষ্ট শব্দ থেকে খ্রিষ্টানদের উত্থান হয়েছে। এখন পৃথিবীতে খ্রিষ্টান ধর্মের যে বহুমুখীতা দেখা যায় তা মুখ্যত এ কারণে যে, এই আন্দোলনটি যে যে স্থানে পৌছেছে সেখানকার ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সংশ্লেষরূপেই নতুন আবহে পরিচয় বৈচিত্র্য নতুন হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস ব্যঞ্জনায় তা অপরিবর্তনীয় রয়েছে।
খ্রিষ্টধর্মের প্রথম দিকে খ্রিষ্টানরা ছিল ইহুদি। তারা ইহুদি তোরাহ পাঠ ও অনুসরণ করত। অচিরেই খ্রিষ্টধর্ম অইহুদিদের মধ্যে একটি ধর্ম আন্দোলনের রূপ নিলেও খ্রিষ্টানরা ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুসরণ করতে থাকে তাদের ধর্মশিক্ষা ও ধর্মালোচনাকে যৌক্তিক ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে। এভাবেই ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তোরাহর নাম হয় ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ওল্ড কভন্যান্ট—যাকে বাংলায় বলা হয় প্রাক্তন সন্ধি বা পুরাতন নিয়ম। এই অংশে খ্রিষ্ট পূর্ববর্তী সময়কালে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যকার সংলাপই স্থান পেয়েছে।
বাইবেলের প্রথম খণ্ড তথা বৃহত্তর অংশটি হচ্ছে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ, যাতে যিশু পূর্ববর্তী সময়কালে ঈশ্বর ও ইস্রাইল জাতির বিভিন্ন দিকসমূহ স্থান পেয়েছে। হিব্রু ও এ্যারামাইক ভাষায় (এ্যারামাইক ভাষা সিরিয়ার আঞ্চলিক ভাষা) ৩৯টি পুস্তক নিয়ে ওল্ড টেস্টামেন্ট সংকলিত হয়েছে। এই ওল্ড টেস্টামেন্ট সংকলিত বাইবেলের প্রথম খণ্ডটি মূলত ইহুদি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও ইহুদি ধর্মের বিধানাবলী নিয়েই লেখা।
ওল্ড টেস্টামেন্ট ইহুদিদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। নিউ টেস্টামেন্ট তাদের কাছে গ্রাহ্য নয়, তাই খ্রিষ্টানদের দেওয়া ওল্ড টেস্টামেন্ট নামটির তারা বিরোধী। তাদের মতে টেস্টামেন্ট একটি-ই। তাকে ওল্ড এবং নিউ বলে ভাগ করা চলে না, এবং এই (ওল্ড) টেস্টামেন্টই সম্পূর্ণ বাইবেল। তবে খ্রিষ্টানদের বাইবেলের সাথে এর পার্থক্য বোঝাবার জন্য তারা একে ওন্ড টেস্টামেন্টের বদলে হিব্রু বাইলে আখ্যা দিতে আগ্রহী, কারণ হিব্রু জাতি থেকেই ইহুদিদের উৎপত্তি এবং মূল টেস্টামেন্ট হিব্রু ভাষাতেই লিখিত।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 9 Catholic faithful join the celebration of the centennial of the migration of Bhawal Christians in Bangladesh, Photo by Father Bablu Corraya [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/Catholic-faithful-join-the-celebration-of-the-centennial-of-the-migration-of-Bhawal-Christians-in-Bangladesh-Photo-by-Father-Bablu-Corraya-300x200.jpg)
(এ. Ten Commandments/দশ আজ্ঞ নিউ টেস্টামেন্টের ২৭টি পুস্তকের মধ্যে চারটি পুস্তক গোস্পেল নামে পরিচিত। চারটি গোস্পেল লিখেছিলেন মথি, মার্ক, লুক এবং যোহন ৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী ৫০ বছরে। এই চারটি পুস্তকেই যিশু খ্রিষ্টের জীবন ও শিক্ষাসমূহের দালিলিক বিবরণ পাওয়া যায়। গোস্পেল শব্দটির অর্থ হচ্ছে সুসমাচার- যা মূলত গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল। কেননা সেই সময়কার মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ অঞ্চলই ছিল রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন আর সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের ব্যবহৃত অভিন্ন ভাষা ছিল গ্রিক। এই বাইবেলে রয়েছে যিশুখ্রিষ্টের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরূপে পরিচিত অ্যাপস্টালগণের দেয়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রচারিত ধর্মবাণীর সংক্ষিপ্তসারও।
নতুন-পুরাতন টেস্টামেন্ট সমন্বয়ে বাইবেলের প্রতি খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস থাকলেও ইহুদিরা শুধুমাত্র পুরাতন অংশ যেখানে শুধুমাত্র ইস্রাইলি জাতির বিষয়টিই স্থান পেয়েছে সেটুকুতেই বিশ্বাস স্থাপন করে। ইহুদিদের বিশ্বাস বাইবেলের প্রথমখণ্ডই শেষ। অন্যদিকে খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ঈশ্বরের পছন্দের জাতি ইস্রাইলিদের ধর্ম ও আবাসভূমির প্রতিশ্রুতি পূরণে মেসাইয়া যে উল্লেখ রয়েছে, যিশুখ্রিষ্ট সেই প্রতিশ্রুত মহামানব।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 10 বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2018/09/Christmas-in-Bangladesh-2-300x160.jpg)
যিশুকে মানব জাতির ত্রাতা হিসেবে ইহুদিরা মনে করতেন। নাজারথে যিশুর ভক্তদের প্রথমে খ্রিষ্টান নামে অভিহিত করা হয়। যিশু নিজে ইহুদি ছিলেন। তবে তিনি ইহুদি বা হীব্রু ধর্মের অনুষ্ঠান-সর্বস্বতা ও পুরোহিতদের প্রাধান্য পছন্দ করতেন না। যিশু প্রচার করলেন ক্ষমা, প্রেম ও প্রীতির ধর্ম। তাঁর মতে সকল মানুষ এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের পুত্র। যিশু বলেছেন ‘তোমাদের পিতা এক, তোমরা সকলে ভাই’। যিশুর মতে ঈশ্বরই পরম পিতা। তিনিও মনে করতেন, ঈশ্বর অসীম, সর্বশক্তিমান ও করুণাময়। তাঁর করুণা সর্বব্যাপী বিস্তৃত।
খ্রিষ্ট ধর্মের বক্তব্যের মধ্যে ইসলামের একাকত্ববাদের সাদৃশ্য আছে। অন্যদিকে ভ্রাতৃত্ব প্রেম-প্রীতির দিক থেকে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে কিছুটা মিল লক্ষণীয়। তবে বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা, সাম্য ও প্রেম আরও মহৎ এবং ব্যাপক। খ্রিষ্টধর্মে ক্ষুদ্র বৃহৎ সরল মানুষের জীবনসহ অনাগত প্রাণীর সুখ এবং শান্তি কামনা করা হয়েছে।
প্রতিহিংসা বা প্রত্যাঘাতের কথা যিশু বলেননি। বরং তিনি বলেছিলেন “এক গালে চড় মারলে অন্য গালটি পেতে দিও। তবুও আঘাতের প্রতিদানে আঘাত করো না। অপরাধীকে ক্ষমা করো।’ বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রধান পার্থক্য হল : যিশু জগৎ ও সমাজকে অসার বা মিথ্যা বলে স্বীকার করেননি। সামাজিক কর্তব্য, দায়িত্ব এবং সচেতনতাকে তিনি খুব বড় করে। দেখেছেন। যেখানে বৌদ্ধ ধর্ম লৌকিকতা বা সামাজিক মূল্যবোধকে পারমার্থিক ক্ষেত্রে বেশি বড় করে দেখেননি। বুদ্ধের মত তিনি (God) বা ঈশ্বর সম্পর্কে কোনদিন মৌন ছিলেন না বরঞ্চ ঈশ্বরকে জগতের একমাত্র কর্তা বলে স্বীকার করেছেন। যেখানে গৌতম বুদ্ধ চেয়েছেন মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধার করতে।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 11 Baptist church in Rangpur, Bangladesh [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/Baptist-church-in-Rangpur-Bangladesh-300x225.jpg)
ত্রিত্ববাদ (Trinity) খ্রিষ্ট ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই ত্রিত্ববাদের অর্থ হল ঈশ্বরের তিনরূপ পিতা (God the father), পুত্র (God the son) ও পবিত্র আত্মা (God the Holy spirit)। এর মূল কথা হল ‘তিনে এক একে তিন’। খ্রিষ্ট ধর্ম কৃচ্ছতাবাদ সমর্থন করে না। খ্রিষ্ট ধর্ম জড়বাদ, দ্বৈতবাদ এবং উন্মেষবাদের বিরোধী। ‘ঈশ্বরের রাজত্ব খ্রিষ্ট ধর্মের প্রধান আদর্শ’ তথাগত বুদ্ধ যেখানে তাঁর প্রিয় শিষ্য আনন্দকে উপদেশ দিচ্ছেন। ‘হে আনন্দ! তুমি তোমার আলোকবর্তিকা হও, তুমি তোমারি আশ্রয় হও।
বাইরে কোন সাহায্য বা আশ্রয় তুমি কামনা কর না। অন্যদিকে যিশু বলেছেন: ‘হে খ্রিষ্ট পুত্রগণ, যত শ্রান্তভ্রান্তের দল তোমরা আমার আছে এসো, আমি তোমাদের বিশ্রাম দেব।’ এ দুটি উপদেশের মধ্যে রয়েছে বিষম ব্যবধান। বুদ্ধের বাণীতে পাওয়া যাচ্ছে আত্মনির্ভরশীলতার কথা, আর খ্রিষ্ট বাণীতে পাওয়া যাচ্ছে ঈশ্বর নির্ভরশীলতার উপদেশ।
খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল ইহুদি উপজাতিদের উপর রোমান সাম্রাজ্যের বারংবার নৃশংস অত্যাচারের ফলে। সশস্ত্র প্রতিরোধে বারংবার ব্যর্থ হয়ে ইহুদিদের এক অংশ পরলোকে মুক্তির সন্ধান করে। এই পরিস্থিতিতে ডেড সি অঞ্চলে সম্ভবত ইসিন (Essen) সম্প্রদায়ের মধ্যে খ্রিষ্ট ধর্মের জন্ম হয়। ইহুদিদের মধ্যে থেকে এভাবে খ্রিষ্ট ধর্মের উদ্ভবের পেছনে সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল। অশোকের দ্বারা প্রেরিত বৌদ্ধ ধর্মযাজকেরা যে এই অঞ্চলে তৎপর ছিলেন তা ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। তাছাড়া যে অহিংসার তত্ত্ব নিয়ে খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল, তার কোন পুরানো ঐতিহ্য ইহুদিদের মধ্যে ছিল না।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 12 Bangladesh's Church leaders join the celebration of the centennial of the migration of Bhawal Christians, Photo by Father Bablu Corraya [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/Bangladeshs-Church-leaders-join-the-celebration-of-the-centennial-of-the-migration-of-Bhawal-Christians-Photo-by-Father-Bablu-Corraya-1-300x200.jpg)
ডেড সি অঞ্চল থেকে পাওয়া প্যাপিরাস পাণ্ডুলিপিগুলো থেকেও স্পষ্ট হয়েছে যে বৌদ্ধ ধর্মের সংগঠন ও তাত্ত্বিক আদর্শের সংগে আদি খ্রিষ্ট ধর্মের অনেক মিল ছিল। অবশ্য ডেড সি স্ক্রোলগুলো আবিষ্কৃত হবার অনেক আগেই কোন কোন পণ্ডিত এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে ইসিনদের মধ্য থেকে খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল।
খ্রিষ্ট ধর্ম প্রধান দুভাগে বিভক্ত। একটি ক্যাথলিক (Catholic) এবং অন্যটি প্রটেস্ট্যান্ট (Protestant)। ক্যাথলিকরা কুমারী মেরীকে যিশুর মাতা বলে স্বীকার করেন। অন্যদিকে প্রটেস্ট্যান্টরা তা বিশ্বাস করেন না। আধুনিক খ্রিষ্ট ধর্মে আরও কিছু নতুন বিভক্তিকরণ দেখা যাচ্ছে। যিশুর বেশ কয়েকজন শিষ্য ছিলেন যারা তাঁর বাণী প্রচার করেছেন। সেইন্ট পল (St. Paul) তাঁদের মধ্যে প্রধান। অন্যরা হলেন পল, লিউক ও মার্ক। খ্রিষ্ট ধর্মে মোক্ষের কথা থাকলেও সেই মোক্ষ বৌদ্ধ ধর্মের মোক্ষের মত নয়। কারণ সেই মোক্ষ (God) কিংবা পিতার ধারণা সঙ্গে যুক্ত।
উল্লেখ্য যে, মুহম্মদ (সা.)-এর জন্মের ৭৫ বছর পূর্বে পোপ প্রথম গেলাসিয়াস এর সময়ে খারাপ বিশ্বাস ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী গ্রন্থাবলির যে তালিকা তৈরি হয়েছিল ‘ইঞ্জিল বারনাবাস’ ও তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিপূর্বে খ্রিষ্টান গির্জায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত বারনাবাসের ইঞ্জিল প্রচলিত ছিল। একে নিষিদ্ধ করা হয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে।
বাইবেলে যে ৪ খানা ইঞ্জিলগ্রন্থকে আইনসম্মত ও নির্ভরযোগ্য ঘোষণা করে সামিল করা হয়েছে তার মধ্যে একখানা গ্রন্থের লেখকও ঈসা (আ.)-এর কোন সাহাবি। লেখকদের একজনও এই দাবি করেননি যে, তিনি হজরত ঈসা (আর.)-এর সাহাবিদের কাছ থেকে তত্ত্ব ও তথ্য নিজের ইঞ্জিলে সামিল করেছেন। তারা যেসব উপায় ও সূত্র হতে তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন তার পরিচয়ও তারা দেননি। এর মূল বর্ণনাকারী নিজ চোখে যেসব ঘটনা দেখেছেন এবং যেসব কথা নিজের কানে শুনেছেন বলে তিনি বর্ণনা করেছে, কিংবা এক বা একাধিক সূত্রের মাধ্যমে সেই কথাগুলো তার কাছে পৌঁছেছে, এ বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। এটি একটি মৌলিক ত্রুটি।
কিন্তু ‘ইঞ্জিল বারনাবাস’ এই সব দোষ ও ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এই ইঞ্জিল রচয়িতা নিজেই বলেছেন, আমি নিজে হজরত ঈসা মসীহের প্রাথমিক বারোজন হাওয়ারীর একজন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি নিজে হজরত ঈসা মসীহের সঙ্গে রয়েছি। আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনাবলি ও নিজের কানে শোনা কথা এবং বাণীসমূহ আমি এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছি।
![বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ] 13 Bangladesh’s Church leaders join the celebration of the centennial of the migration of Bhawal Christians, Photo by Father Bablu Corraya [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/Bangladeshs-Church-leaders-join-the-celebration-of-the-centennial-of-the-migration-of-Bhawal-Christians-Photo-by-Father-Bablu-Corraya-300x200.jpg)
এই বারনাবাস কে ছিলেন? বাইবেলের কার্যাবলি (প্রেরিতদের কার্য) এ নামের এক ব্যক্তির বার বার উল্লেখ এসেছে। এই ব্যক্তি ছিলেন ইহুদি পরিবারের লোক খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার ও ঈসা মসীহর অনুসারিদের সাহায্য সহযোগিতার করার ব্যাপারে তাঁর অবদানের খুব বেশি প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু সে কবে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল তা কোথাও বলা হয়নি। প্রাথমিক ১২ জনের যে তালিকা তিনখানা ইঞ্জিলে দেওয়া হয়েছে তাতে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়নি। কাজেই এই ইঞ্জিলের লেখক সেই বারনাবাস কিংবা অন্য কেউ তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
মথি ও মার্ক শিষ্যদের যে তালিকা দিয়েছেন, বারনাবাসের দেয়া তালিকার সাথে মাত্র দুটি নামের পার্থক্য। একজনের নাম হল তুমা। এর পরিবর্তে বারনাবাস নিজের নাম উল্লেখ করেছেন। লুক ইঞ্জিলে এই ২য় নামটিও রয়েছে। একারণে এরূপ ধারণা করার যৌক্তিকতা আছে যে, পরবর্তীকালে কোন এক সময় হাওয়ারি শিষ্যদের তালিকা থেকে বারনাবাসকে বহিষ্কৃত করার উদ্দেশ্যে তুমা’র নাম শামিল করা হয়েছে, যেন বারনাবাসের ইঞ্জিল থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা যায়।
উল্লেখ্য যে, ৪টি ইঞ্জিলের অসংলগ্ন কাহিনির তুলনায় এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক বর্ণনাবলি অধিক সুসংবদ্ধ। হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রদত্ত শিক্ষাবলি চার ইঞ্জিলের তুলনায় এই গ্রন্থটিতেই অধিক স্পষ্ট, বিস্তারিত ও মর্মস্পর্শীভাবে বিবৃত হয়েছে। চারটি ইঞ্জিলের উদ্ধৃত তাঁর বহু বাণী ও কথার মধ্যে যে বিরোধ ও অসংগতি সুস্পষ্ট, এই গ্রন্থটিতে তার কোন প্রমাণ চিহ্ন রাখা হয়নি। এই ইঞ্জিলে হজরত ঈসা (আ.)-এর জীবন ও তাঁর শিক্ষাবলি একজন নবীর জীবন ও শিক্ষাবলির মতই পুরাপুরিভাবে মনে হবে। তিনি এতে একজন নবী হিসাবেই নিজেকে উপস্থাপিত করেছেন। বারনাবাসের ইঞ্জিলের নানা স্থানে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর আগমন সম্পর্কে স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী উদ্ধৃত হয়েছে। আর এই কারণেই খ্রিষ্টানরা বারনাবাস প্রণীত ইঞ্জিল গ্রন্থটি প্রত্যাখ্যান করেছে বলে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের অভিমত।
ঈসা (আ.)-এর প্রথম যুগের অনুসারিরা তাকে একজন নবী মাত্র জানতেন। মূসা (আ.)-এর প্রবর্তিত শরিয়ত মেনে চলতেন। আকিদা বিশ্বাস, হুকুম-আহকাম ও ইবাদত-বন্দেগির ব্যাপারে নিজেদেরকে অন্যান্য নবী ইসরাইল হতে কিছু মাত্র ভিন্ন, স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন মনে করতেন না। ইহুদিদের সাথে তাদের মতবিরোধ ছিল শুধু এ ব্যাপারে যে, এরা হজরত ঈসা (আ.) কে মসীহ মানতে অস্বীকার করেছিল। যখন সেন্ট পল এই দলে শামিল হলেন, তখন তিনি রোমান, গ্রিক ও অন্যান্য অ-ইয়াহুদি লোকদেরকে ও অ-ইসরাঈলী লোকদের মধ্যেও এই দ্বীনের প্রচার ও প্রসার শুরু করলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি নতুন দ্বীন রচনা করলেন।
এই দ্বীনের আকিদা-বিশ্বাস, মূলনীতি ও আদেশ-নিষেধ হজরত ঈসা (আ.)-এর পেশ করা দ্বীন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ও অন্যরকম ছিল। এই ব্যক্তি হজরত ঈসা (আ.)-এর কোন সাহচর্য পাননি। বরং তিনি ঈসা(আ.) জীবদ্দশায় তার চরম বিরোধি ছিলেন। তারপর কয়েক বছর পর্যন্ত তার অনুসারীদের শত্রু হয়ে ছিলেন। পরে এই দলে শামিল হয়ে তিনি যখন একটা নতুন ধর্মমত রচনা করতে শুরু করলেন, তখন তিনি হজরত ঈসা (আ.)-এর কোন কথার সনদ পেশ করেননি। তিনি ভিত্তি করেছেন নিজের কাশফ ও ইহলাম এরই উপর।
এই নূতন ধর্ম রূপায়ণে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, ধর্ম এমন হতে হবে যা সাধারণ অ-ইয়াহুদি জগৎ গ্রহণ করবে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, খ্রিষ্টানরা ইয়াহুদি শরীয়তের বাধ্যবাধকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। পানাহারের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের সকল বিধান তিনি খতম করে দিয়েছিলেন। খতনা করার বিধানও তিনি নাকচ করে দেন।
আর এ সকল বিধান অ-ইয়াহুদিদের কাছে অসহ্যের ব্যাপার ছিল। এমনকি তিনি মসীহর ইলাহ হওয়া, খোদার পুত্র হওয়া এবং শূল বিদ্ধ হয়ে প্রাণদান করার মাধ্যমে আদম সন্তানের জন্মগত পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাওয়ার আকিদাও রচনা করেন। কিন্তু যে দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন, তা থেকে অ-ইয়াহুদি খ্রিষ্টানদের একটি বিরাট বন্যা প্রবাহ এই ধর্মে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ লাভ করল। ফলে সেন্ট পল বিরোধি মুষ্টিমেয় লোক এর মোকাবেলায় মুহূর্তের তরেও টিকতে পারল না। এ স্বত্ত্বেও খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর সমাপ্তিকাল পর্যন্ত হজরত ঈসার ইলাহ হওয়ার ধারণাকে অস্বীকার করে এমন বহু লোকই বর্তমান ছিল।
চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে (৩২৪ খ্রি.) নাকিয়ার কাউন্সিল সেন্ট পল প্রবর্তিত আকিদাকে সর্বসম্মত খ্রিষ্টান ধর্মমত রূপে মনোনীত করে নিল। পরে রোমান সম্রাট ও সাম্রাজ্য নিজ থেকেই খ্রিষ্টান হয়ে গেল। এরপর এই ধর্মমতের বিপরীত আকিদা পেশ করার সমস্ত গ্রন্থাদি পরিত্যাক্ত ও ৫ আইনি ঘোষিত হল এবং এই আকিদার অনুকূল সমস্ত গ্রন্থাদি নির্ভরযোগ্যরূপে গৃহীত হল। পরে ৩৮২ খ্রিষ্টাব্দে পোপ ডেমাসিয়াস। (Damasius)-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তার সত্যতা স্বীকার (Ratification) করে নিল।
পঞ্চম শতকের শেষে পোপ গেলাসিয়াস ও গ্রন্থ সমষ্টিকে সর্বসম্মত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে অসমর্থিত গ্রন্থাবলিরও একটি তালিকা রচনা করে দিল। অথচ পল প্রবর্তিত যে সব আকিদা বিশ্বাসকে ভিত্তি রূপে গ্রহণ করে ধর্মীয় গ্রন্থাবলির নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সে সম্পর্কে কোন খ্রিষ্টান পণ্ডিত কখনও এই দাবি করতে পারেনি যে, তার মধ্যে কোন একটি আকিদা-বিশ্বাস ঈসা (আ.) নিজে শিক্ষা দিয়েছিলেন। বরং গ্রহণীয় কিতাবগুলোর মধ্যে যে সকল ইঞ্জিল গণ্য তাতে হজরত ঈসা (আ.)-এর নিজের উক্তি বলে এই সব আকিদার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বারনাবাস এর ইঞ্জিল খ্রিষ্টধর্মের সরকারি আকিদার সম্পূর্ণ বিপরীত আকিদা পেশ করে বিধায়, একে অগ্রহণীয় ও অসমর্থিত গ্রন্থাদির মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। এই গ্রন্থকার গ্রন্থের ভূমিকায় এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেছেন, ‘সেই লোকদের মতাবলির সংশোধন করিতে হইবে, যাহারা শয়তানের প্রতারণায় প্রতারিত হইয়া ঈসা মসীহ’কে খোদার পুত্র মনে করিতে শুরু করিয়াছে, খাতনা করা অপ্রয়োজনীয় মনে করে। সেন্ট পল এই প্রতারিত দলের একজন।’ বলিয়া
তবে যিশু বা ঈসা (আ.)-এর নিজের সঠিক অবস্থা ও তাঁর প্রদত্ত আসল শিক্ষাবলি জানার নির্ভরযোগ্য সূত্র সেই ৪ খানা ইঞ্জিল নয়, যেগুলোকে খ্রিষ্টান গির্জা নির্ভরযোগ্য ও সর্বসমর্থিত ইঞ্জিলরূপে গ্রহণ করে নিয়েছে। বরং তার জন্য সর্বাধিক বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য উপায় হল সেই ‘ইঞ্জিল বারনাবাস’! যাকে গির্জা বেআইনি, সন্দেহজনক ও অপ্রমাণিক বলে চিহ্নিত করেছে। খ্রিষ্টানরা এই ইঞ্জিল লুকিয়ে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা-যত্ন করেছে। শত শত বছর পর্যন্ত তা দুনিয়ায় অপরিচিত ও অপ্রকাশিত হয়ে রয়েছে। ষষ্ঠদশ দশকে এর ইতালীয় অনুবাদের মাত্র একখানা বই এই গ্রন্থাগারে পাওয়া যেত, তা অন্য কারও পাঠ করার অনুমতি ছিল না।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সেটা ডন টোলেও নামক একজন ব্যক্তির হস্তগত হয়। অতএব বিভিন্ন হাত ঘুরে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তা ভিয়েনা ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে পৌঁছে। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ অক্সফোর্ডের ক্লে’রিডন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তা প্রকাশিত হওয়ার পরই খ্রিষ্টান জগত অনুভব করতে পারল, যে ধর্মমতকে হজরত ঈসা (আ.)-এর নামে চালানো হচ্ছে, এই বই সেই ধর্মের মূল শিকড় কেটে ফেলে। এ কারণে ঐ মুদ্রিত বইগুলো বিশেষ ব্যবস্থাপনায় লুকিয়ে ফেলা হয়।
এরপর তা আর কখনও প্রকাশিত হতে পারেনি। অপর একখানা বই এই ইতালিও অনুবাদ হতে স্পেনীয় ভাষায় তা অষ্টাদশ শতকে পাওয়া যেত। জর্জ সেল তার কুরআনের ইংরেজ অনুবাদের ভূমিকায় এর কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাও কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ফলে বর্তমানে সেটারও কোন নাম-চিহ্ন কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত এর ইংরেজি একটা কপি একজন মুসলিম পণ্ডিতের হস্তগত হয় ফলে শতশত বছর ধরে লুকায়িত সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়ে। খ্রিষ্টানদের বই-পুস্তকে যেখানেই এই ইঞ্জিলের উল্লেখ আসে, তখন তাকে এই বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়ে যে, এটা জাল ইঞ্জিল! কিন্তু তাদের এই কথা পরবর্তীকালের গবেষণায় মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে খ্রিষ্টধর্ম প্রায় তিরিশটি সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত। এগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রোমান ক্যাথলিক (Roman Catholic), প্রোটেস্ট্যান্ট (Protestant), বেনিডেকটাইনস (Benedictines), ব্যাপটিস্ট (Baptist), এরিয়ানাবাদ (Arianism), নেস্টেরীয়বাদ (Nestorianism), মনোফাইজিটিজম (Monophysitism), কুয়েকার্স (Quakers), সেভেন্থ অ্যাডভেনটিস্ট (Seventh Adventists) ও মেথডিজম (Methodism)।
ইহুদি ও অইহুদিদের সমন্বয়ে একটি নতুন ধর্মবিশ্বাসীদের পরিচয় সর্বসমক্ষে উপস্থাপনে ‘খ্রিষ্টান’ বা Christian শব্দটির প্রথম ব্যবহার শুরু হয় এখনকার সিরিয়ার ‘এন্টিয়াক’ Antioch শহরে ৩৫ থেকে ৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। যিশুখ্রিষ্টের প্রতি অকৃত্রিম ও পূর্ণ বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই এই খ্রিষ্টান ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ। গ্রিক ভাষার Christo খ্রিষ্ট শব্দটি হিব্রু ‘মেসাইয়াহ্’ শব্দের ভাষান্তর। ঈশ্বরকর্তৃক মানবজাতির জন্য প্রদত্ত নির্দেশনাসমূহ পূরণে ঈশ্বরের পছন্দের কোনো প্রেরিত পবিত্র ব্যক্তিকে ‘মেসাইয়াহ্’ (Messiah) বলা হয়। ইহুদিদের বিশ্বাস ছিল যে তাদের জাতীয় মুক্তিদাতারূপে এক মেসাইয়াহ্’র আগমন ঘটবে। নাজেরাথের যিশুকে সেই প্রত্যাশিত আগমনকারী নবী ও পথপ্রদর্শকরূপে গণ্য করে যিশুর মৃত্যুর অব্যবহিত পর থেকেই এই নতুন ধর্ম আন্দোলনটি বিস্তৃত হতে থাকে।
বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম [ Christianity in Bangladesh ]
ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তন এবং বিকাশ বিভিন্ন দেশ এবং সম্প্রদায়ের সাহায্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সময়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে। খ্রিস্টধর্মের সাথে প্রাচীনতম সংযোগটি হলো প্রথম শতাব্দীতে ৫২ খ্রিস্টাব্দে মালাবার উপকূলে প্রেরিত টমাসের আগমন। তিনি কয়েক হাজার হিন্দু ব্রাহ্মণকে ধর্মান্তরিত করতে পেরেছিলেন, কারণ তারা জীবনধারার প্রতি “আকৃষ্ট” হয়েছিল এবং যীশুর আত্মত্যাগ দ্বারা “মুগ্ধ” হয়েছিল।
আলফোনসো ডি আলবুকার্কের মতো ব্যক্তিত্ব এবং পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারক থাকা সত্বেও ১৫১০ সালে পর্তুগিজদের আগমনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্মের উপস্থিতি ছিল না। আলবুকার্ক স্থানীয় বাঙালি মহিলাদের সাথে আন্তঃবিবাহকে উৎসাহিত করে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন। তাদের বংশধররা খ্রিস্টানদের প্রথম প্রজন্ম। ক্যাথলিক পোপ এবং পর্তুগালের রাজার মধ্যে চুক্তির সুবাদে, ১৫১৪ সালের মধ্যে পর্তুগিজরা বাংলায় অবাধে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অধিকার লাভ করে।
১৬৭২ সালে, ডোম আন্তোনিও দা রোজারি [ একজন তরুণ বাঙালি ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান], ২০,০০০ নিম্নবর্ণের হিন্দুকে খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন। এরপর সপ্তদশ থেকে আঠারো শতকের মধ্যে পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকরা বাংলা ভাষায় ধর্মপ্রচার করেছিলেন। এরপর থেকে ইভাঞ্জেলিক্যাল বই এবং খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব বাংলা ভাষায় লেখা হতে থাকে।
১৭৪০ সালে, প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট, রেভারেন্ড জন জাকারিয়া কিয়ারনন্ডার, বাংলাদেশে আসেন। ১৭৭০ সালে, তিনি পশ্চিমবঙ্গে “মিশন চার্চ” নামে একটি প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চকে অর্থায়ন ও নির্মাণ করেন।
১৮ শতকের মধ্যে, উইলিয়াম কেরির মতো ব্রিটিশ মিশনারিরা আরও গির্জা তৈরি করেছিলেন, বাইবেল এবং অন্যান্য খ্রিস্টান বই অনুবাদ করেছিলেন এবং ধর্মীয় বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ব্রিটিশ মিশনারিরাও সুসমাচার প্রচারের প্রয়াসে খ্রিস্টান সংবাদপত্র (যেমন “দিগদর্শন”, “দ্য গসপেল ম্যাগাজিন” এবং “দ্য খ্রিস্টান মহিলা”) তৈরি করেছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশে খ্রিস্টান ধর্মের উত্থানের কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে পশ্চিমা এনজিও এবং খ্রিস্টান দাতব্য সংস্থাকে, যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর মানবিক কাজে এসেছিলেন। তারপর থেকে, এই এনজিও এবং দাতব্য সংস্থাগুলি বাংলাদেশে শুধুমাত্র জরুরি ত্রাণ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার জন্য সহায়তা করেনি, তারা বাইবেল পড়ার অনুশীলনকেও উত্সাহিত করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক ১৭,০০০ থেকে ২৩,০০০ এনজিও রয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
বাংলাদেশে চার্চের ইতিহাস:
১৬০০ সালের জানুয়ারি মাসে, এদেশে প্রথম গির্জা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। গির্জাটির নামকরণ করা হয়েছিল “যিশুর পবিত্র নামের চার্চ”। ওই চার্চটি জেসুইটদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। তবে শুধুমাত্র প্রার্থনার অনুমতিই নয়, যশোরের রাজা কর্তৃক আর্থিক সহায়তা এবং জমিও দেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় গির্জাটি নির্মান করেন আন্দ্রে বোভস ২৪ জুন, ১৬০০ সালে চট্রগ্রামে। এই চার্চ নির্মানে আরাকানি রাজা আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলেন। গির্জাটির নাম ছিলো “সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট চার্চ”।
১৬০১ সালে তৃতীয় গির্জাটি চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্বে ডোমিনিকানদের দ্বারা নির্মিত হয়। তবে পরে আরাকানিদের আক্রমণে এই গির্জাগুলোর বেশিরভাগ পুড়ে গিয়েছিলো।
সহায়ক গ্রন্থাবলি
- পবিত্র বাইবেল: জুবিলী বাইবেল; বাংলাদেশ ক্যাথলিক সম্মিলনী, ১৯৯৯ পবিত্র বাইবেল (পুরাতন ও নুতন নিয়ম);
- বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা২০০o
- বঙ্গীয় খ্রীষ্টীয় পরিষেবা : অধ্যয়ন ও গবেষণা বিভাগ, সহস্রাব্দের সমীক্ষা (প্রথম খণ্ড) কলকাতা, ২০০১
আরও পড়ুন: