বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রচনা

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই সংগ্রাম আর রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলে সিপাহী বিদ্রোহ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ফরায়েজী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদি শেষে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও এ বাংলাদেশের মানুষ পরাধীনতার শিকল ছিড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বরং ব্রিটিশদের হাত থেকে তারা পাকিস্তানিদের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছিল মাত্র।

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা

ব্রিটিশদের ‘ভাগ করে শাসন করা – নীতির শিকার হয়ে বাঙালি জাতি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা ধর্মের অনুশাসনকে অসম্মান করে বাঙালি মুসলমানদের ওপর যে অন্যায় ও অবিচার করে তা ধর্মের পবিত্র বন্ধনকে ক্রমেই শিথিল করতে থাকে।

তারপর একপর্যায়ে তাদের শোষণ এতই ব্যাপক হয় যে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জনতা পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। তারপর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হয় এবং এখানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির একটি অন্যতম মূলনীতি ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ (Secularism)। কিন্তু সংবিধানের এ ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিটি আর পরবর্তীতে টিকে থাকেনি।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশের নতুন সরকার সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিবর্তন করে ‘পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’ স্থাপনকে মূলনীতি হিসেবে প্রতিস্থাপন করে। তারপর এরশাদ সরকার অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এরপরই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়।

 

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা

 

ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ :

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মূলত ইউরোপীয় রেনেসার ফলে সৃষ্ট একটি মতবাদ। এ মতবাদে ধর্মকে সকল বৈশ্বিক বিষয় থেকে আলাদা রাখার কথা বলা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে এমন বিষয়কে বোঝায় যা কোনো ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। আর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলতে ঐ মতবাদকে বুঝায় যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে, মানুষের আইন, শিক্ষা, রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি তথা রাজনীতি হবে প্রকৃত তথা বাস্তব ঘটনা ও বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে নয়।

এ মতবাদ অনুযায়ী ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন থাকবে। ধর্ম ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকবে, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মের কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না। তাছাড়া ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদকে বস্তুবাদী দর্শনেরই ভিন্ন রূপ বলে মনে করা হয়। এতে বলা হয়, ব্যক্তির বস্তুগত স্বার্থ ও বিষয়াদিতে “ধর্ম বা আদর্শগত বিষয়াদি সম্পৃক্ত থাকা অযৌক্তিক। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্ষমতাও সীমিত করা হয়।

ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদে ব্যক্তির ধর্মীয় বিষয়াদির ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার থাকবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে আমরা বোঝাতে পারি এমন রাষ্ট্রকে যেখানে কোনো ধর্মীয় বিষয়, অবস্থান বা নিয়মনীতির সাথে রাষ্ট্রের কোনো দাপ্তরিক সম্পর্ক থাকবে না ।

ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের উদ্দেশ্য হলো বস্তুগত উপাদান এবং বস্তুবাদী নীতি ও পদ্ধতির সাহায্যে মানব জীবনকে উন্নত করা। এ মতবাদের কেন্দ্রবিন্দু সম্পূর্ণ বৈষয়িক এবং এখানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু দৃশ্যমান এবং মানবীয় অনুভূতির আওতাধীন তা-ই বিবেচনাযোগ্য। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে কেবল ঐ জাতীয় জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস রাখা হয় যা ঐশ্বরিক নয়, যা অভিজ্ঞতা ও যুক্তিগ্রাহ্য এবং যাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই করা যায় । এখানে ঐশ্বরিক কোনো কিছুরই স্থান নেই ।

তবে আধুনিককালে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদকে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতর রূপে দেখা যায়। আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের প্রবক্তারা বলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ ধর্মীয় মতবাদ থেকে ভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে কোনো অত্যাবশ্যকীয় বিরোধ নেই। কেননা শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম পালনের সাথে সেকুলারিজমের কোনো বিরোধ নেই। তাদের দৃষ্টিতে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ হলো রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান না করা এবং রাষ্ট্রে সকল ধর্মের সমমর্যাদার অবস্থান নিশ্চিত করা।

 

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা

 

বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার বিবর্তন :

ইউরোপে রেনেসার মাধ্যমে ধর্ম নিরপেক্ষতার যে ধারণাটি জন্মলাভ করেছিল, প্রকৃত অর্থে বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় দখলদারদের শাসনক্ষেত্রে এর প্রভাব নিরঙ্কুশ ছিল না। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসকরা এ অঞ্চলের জনগণের ধর্মীয় চেতনাকে নানাভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।

এ অঞ্চলের দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মুসলিম ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে তাদের শক্তিকে নস্যাৎ করার মাধ্যমে শাসন করার অপকৌশল ব্রিটিশরা সার্বক্ষণিকভাবে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার স্ফুরণ লক্ষ্য করা গেছে।

এক্ষেত্রে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ একটি অন্যতম মাইলফলক। কেননা এ আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকল সিপাহী ইংরেজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একটি অভিন্ন অস্তিত্বের জানান দিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলার তৎকালীন হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী এটিকে একটি মুসলিম ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দিয়ে মিথ্যাচার করছিল।

এমনিভাবে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায় ইংরেজদের ক্ষমতার ভাগ নিতে ব্যতিব্যস্ত ছিল। অন্যদিকে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগও একই কৌশল অবলম্বন করেছিল। এরই প্রেক্ষিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের জনপদ এ পূর্ববাংলাকে আলাদা করার প্রস্তাব আসে এবং ১৯০৫ সালে তা কার্যকরও হয়। কিন্তু হিন্দুদের প্রবল আপত্তির মুখে ১৯১১ সালে তা রদ হয়। তবে ১৯৪৭ সালে বাংলার স্থায়ী বিভাজন নিশ্চিত হয় এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পূর্ববাংলা পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

তারপর পাকিস্তানি শাসকরাও ধর্মের কৌশলটিকে নানাভাবে ব্যবহার করতে থাকে। রাষ্ট্রকে ইসলামীকরণের রাজনৈতিক অপকৌশল হিসেবে শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। কিন্তু পূর্ববাংলার মানুষ এ হীন চক্রান্ত মেনে নিতে পারেনি। ফলে ১৯৫২ সালে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ভাষার দাবিতে আন্দোলন করে তারা তাদের অবস্থান জানান দেয় এবং এর চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটায় ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।

 

BangladeshGurukul.com Logo 252x68 px White Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

 

বাংলাদেশের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতা :

পাকিস্তানি শাসকদের ধর্মের ছদ্মাবরণে ধারাবাহিক অত্যাচার, অবিচার এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহারে অতিষ্ঠ এ দেশের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে এ দেশের জনগণ তাদের এ দাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ দেশের জনগণ বুঝতে পেরেছিল, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের এ দাবি কখনোই মেনে নেবে না। এজন্য তাদের চাই একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, যেখানে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যবহার সীমিত করে একটি সর্বজনীন সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

জনগণের এ প্রাণের দাবিকে পুঁজি করেই ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতারাও জনগণের জন্য সমতা, মানুষের মর্যাদা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদসহ অন্যান্য নেতা এ কথা বার বার বলেছেন যে, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র হবে নবগঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি।

সে অনুযায়ী যুদ্ধ শেষে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর শেখ মুজিবুর রহমানও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা হবে নবগঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মূল ভিত্তি। সে অনুযায়ী ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের যে নতুন সংবিধান রচিত হয় তার প্রস্তাবনায় বলা হয়, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের উচ্চতর আদর্শ, যা স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের বীরজনতাকে আত্মোৎসর্গ করতে এবং আমাদের বীর শহীদদেরকে জীবন বিসর্জন দিতে প্রণোদিত করেছিল, তা-ই সংবিধানের মৌলনীতি।

আবার সংবিধানের ৮(১) ধারায় বলা হয় যে, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি হবে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার মৌলনীতি। ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতিকে কার্যকর করার পন্থা বাতলাতে গিয়ে বলা হয় যে, ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতিটি কার্যকর হবে— সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণের মাধ্যমে; বিশেষ কোনো ধর্মকে রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো প্রকার বিশেষ মর্যাদা না দিয়ে; রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার রোধ করে এবং কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীর প্রতি যে কোনো ধরনের বৈষম্যরোধের মাধ্যমে।

এ উদ্দেশ্যে মূল সংবিধানে সকল প্রকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল যাতে ধর্মকে কোনো প্রকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করা যায়। সংবিধানের ৩৮ ধারায় বলা হয়েছিল যে, কোনো সাম্প্রদায়িক বা অন্য কোনো সংগঠন বা সংঘ যা কোনো ধর্মের নামে বা কোনো ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে লিপ্ত এ ধরনের কোনো সংগঠন বা সংঘ গঠন বা এর সদস্য হওয়া বা এতে অংশগ্রহণের অধিকার কারো থাকবে না। এ ধারার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক সংগঠন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নিজামে ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

 

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা

 

পঞ্চম সংশোধনী ও ধর্মনিরপেক্ষতা :

১৯৭৫ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষতার যে বৈশিষ্ট্য সেটা আক্ষরিক অর্থে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে সামরিক আইন চালু হওয়ায় পর এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে পরিবর্তন সাধিত হয়। বিশেষ করে ক্ষমতা গ্রহণের পর তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের প্রথম থেকেই গুটিকয়েক বামপন্থী সমর্থক থাকলেও দেশের ডানপন্থীদের বৃহদাংশ তার সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার চার বছরের শাসনামলে সংবিধানেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসেন। বিশেষ করে Martial Law Proclamation-এর মাধ্যমে যে সমস্ত পরিবর্তন আনা হয়, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এসবের বৈধতা দেয়া হয়।

সর্বোপরি পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের নিম্নোক্ত মৌলিক পরিবর্তনগুলো আনা হয়

১. বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনার ওপরে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করা হয় ।

২. সংবিধানের চারটি মূলনীতির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ (Secularism)। এ মূলনীতিটিকে বিলুপ্ত করে তার স্থলে ‘পরম করুণাময় আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযুক্ত করা হয় । (অনুচ্ছেদ ৮) সংবিধানের এ পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ করে অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এ পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলতেন যে, দেশের ৮৫% মুসলমানের বিশ্বাসে যে বিষয়টি নিহিত রয়েছে সেটি সংবিধানে সংযোজন অন্যায় কিছু নয়।

অষ্টম সংশোধনী ও ধর্মনিরপেক্ষতা :

অষ্টম সংশোধনী বিল বাংলাদেশের চতুর্থ সংসদের পাস করা আইনগুলোর অন্যতম। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সামরিক শাসক এরশাদ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে নির্ধারণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । এ লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালের ৯ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হয় । এ সংশোধনী অনুযায়ী :

প্রথমত, সংবিধানে ২ (ক) ধারা সংযোজনের মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয়ত, রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইকোর্টের আরো ছয়টি বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার আইনও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী এ জাতীয় পদক্ষেপকে অবৈধ ঘোষণা করলে শেষ পর্যন্ত তা বাতিল হয়ে যায়।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মূল্যায়ন :

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানকে অনেকেই একটি ধর্ম নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক সংবিধান হিসেবে মূল্যায়ন করেন। তারা শহীদ প্রেসিডেন্ট তিউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সংবিধানের এ বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধ্বংস করার দায়ে অভিযুক্ত করেন।

অভিযোগকারীরা বলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বোধকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই তারা এরূপ করেছেন। আর তাদের সমর্থকদের বক্তব্য হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এ দেশে ধর্ম নিরপেক্ষতার স্লোগানও এক ধরনের ভাঁওতাবাজি। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়ার সাথে সঙ্গতি রেখেই এ ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে।

সর্বোপরি দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসেও এর দ্বারা কোনোরূপ আঘাত করা হয়নি বরং তাদের ধর্ম-কর্ম পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত রয়েছে।

আরও দেখুনঃ

 

Leave a Comment