উদার বাণিজ্যনীতি ও বাংলাদেশের শিল্প রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।
Table of Contents
উদার বাণিজ্যনীতি ও বাংলাদেশের শিল্প
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি সালে বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে “জেনারেল এগ্রিমেন্ট অব টেরিফ অ্যান্ড ট্রেড (GATT)-এর জন্ম হয়। একটি বহুপাক্ষিক সংস্থা হিসেবে এটি দ্রব্য, কৃষি, শিল্প ও সেবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য সমঝোতার কাঠামো তৈরি করতো। গ্যাটের সমঝোতা চুক্তিগুলো সাধারণত শুল্ক হ্রাস ও অশুল্ক বাধাগুলো দূর করে বা তা কমানোর মাধ্যমে দ্রব্য ও সেবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে অবাধ করার জন্য পরিচালিত হতো।
জেনেভা রাউন্ড দিয়ে শুরু হয়ে গ্যাট সংক্রান্ত আলোচনা পরবর্তীকালে এনেসি, টরকোয়ে, জেনেভা, দিলন, কেনেডি, টোকিও এবং পরিশেষে উরুগুয়ে রাউন্ড দিয়ে এ আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটে। এ উদ্দেশ্যে ১৯৯৪ সালের ১৫ এপ্রিল মরক্কোর রাজধানী মারাকাশে চার দিনব্যাপী মন্ত্রীপর্যায়ের সম্মেলনে গ্যাট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এ চুক্তির মাধ্যমেই গ্যাটের উত্তরসূরি হিসেবে জন্ম নেয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (World Trade Organisation)।
১ জানুয়ারি ১৯৯৫ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। মূলত বিশ্ব বাণিজ্য অর্থনীতির উদারীকরণ এবং বিশ্বায়নের লক্ষ্যেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) গঠন ও কার্যক্রম শুরু হয় ।
১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নতুন মোড় লাভ করে। স্নায়ুযুদ্ধ ছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সাথে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার দ্বন্দ্ব। বস্তুত স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহা বিজয়।
এর ফলে একমেরুকেন্দ্রিক নতুন বিশ্বব্যবস্থায় পুঁজিবাদী ধারণার রাজনীতি ও অর্থনীতি বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। কিন্তু এর ফলে অর্থনৈতিক উদারীকরণ ও শক্তিশালী উন্নত রাষ্ট্রসমূহের অসম বাণিজ্যনীতিতে উন্নয়নশীল দেশসমূহ অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়।
মূলত নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও উন্নত রাষ্ট্রসমূহের কতিপ অর্থনৈতিক কৌশল উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। এসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি ডাম্পিং অর্ডার, এম এফএ (MFA). ট্রিম (TRIM), ট্রিপস (TRIPS), ভিইআরএস (VERS), তন ও অতন্ত বাণিজ্য বাধা ইত্যাদি।
এছাড়া অর্থনৈতিক উদারীকরণের কারণে ২০০৫ সাল নাগাদ দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে MEN (Most Favoured Nations Principle) এবং GSP (Generalised System of Preference) উঠে যায়, কৃষির ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়া হয় এবং সংরক্ষণবাদী বাণিজ্যিক নীতি প্রত্যাহৃত হয়। অর্থাৎ এতদিনকার প্রতিটি রাষ্ট্রের যে নিজস্ব অস্তিত্ব ছিল, তা বিলুপ্ত হয়ে সর্বজনীন অভিন্ন বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠে।
সেখানে নিজস্ব বাজার বলতে কিছুই থাকবে না। উদ্ভাবনকারী তার ডিজাইন অথবা প্রযুক্তির ওপর নিজস্ব স্বত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হচ্ছে। MEN. MFA, GSP ইত্যাদি উঠে যাওয়ার ফলে বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যা দাঁড়িয়েছে তা হলো সারা বিশ্ব একটি বাজারে পরিণত হয়েছে এবং এ বাজার হচ্ছে প্রতিযোগিতাপূর্ণ। এর ফলে সারা বিশ্বের ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রাণসঞ্চার হচ্ছে সত্য, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহ কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় অর্থনীতি মূল ভূমিকা পালন করে থাকে এবং এ প্রক্রিয়ায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মূল দায়িত্ব হচ্ছে গোটা বিশ্বকে মুক্তবাজার অর্থনীতির আওতাভুক্ত করা। এ লক্ষ্যে স্বণিজ্য অর্থনীতির উদারীকরণ, আমদানি ও অন্যান্য বাণিজ্য শুল্ক বিলোপ, বেসরকারিকরণ, কাঠামোগত সংস্কার, কৃষিতে ভর্তুকি বন্ধ ইত্যাদি পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালায় TRIM (Trade Related Investment Measures) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে এতদিনের প্রচলিত প্রতিটি দেশের বিনিয়োগ সংক্রান্ত নিজস্ব মতবাদ আর থাকবে না। বিনিয়োগ সংক্রান্ত সকল বাধা অপসারিত হবে। তবে এতে প্রকৃত অর্থে লাভবান হবে শিল্পোন্নত বিশ্ব। কারণ যাদের GNP (Gross National Product) উদ্বৃত্ত তারাই পুঁজি বিনিয়োগ করবে। ফলে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত বিশ্ব শুধু বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সুযোগ গ্রহণ করবে।
তাতে উন্নয়নশীল বিশ্বের নিজস্ব উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। শিল্পোন্নত বিশ্বের অনুকূলে ডব্লিউটিও চুক্তির সবচেয়ে বৈষম্যমূলক দিক হলো TRIPS (Trade Related Intellectual Property Rights) বা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ আইন অতীতে মেধাস্বত্ব আইন কোনো সহজাত অধিকাররূপে নয়, বরং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার বিশেষ সুবিধা হিসেবে প্রচলিত ছিল।
কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান কোনো দ্রব্য বা ফর্মুলা আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করলে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত প্যাটেন্ট আইন অনুযায়ী কেবল ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই উৎপাদনের অধিকার সংরক্ষণ করতো। আগে শুধু দ্রব্য বা প্রক্রিয়ার ওপর প্যাটেন্ট আইন প্রযোজ্য হতো। কিন্তু ডব্লিউটিও চুক্তি মোতাবেক এখন দ্রব্য ও প্রক্রিয়া উভয়ের ওপরই Patent Law প্রযোজ্য।
এতে করে সম্পূর্ণ নতুন ও ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কোনো প্রচলিত পণ্য উৎপাদন করা যাবে না। মেধাস্বত্ব আইন দ্বারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা মানুষের মেধাকেও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে।
গ্যাট চুক্তি স্বাক্ষরের পর মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলো ইচ্ছামতো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে এবং প্রতিযোগিতার মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে নতুন আঙ্গিকে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পণ্যের গুণগত মান তদারক করবে।
এর ফলেও অর্থনৈতিক ও কারিগরি দিক থেকে পিছিয়ে পড়া স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ অর্থনৈতিক ও শিল্পায়নের দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে । ডব্লিউটিও চুক্তিতে সেবা খাতকে ‘পণ্য’ হিসেবে পরিগণিত করায় পৃথিবীর সকল দেশকে উন্নত সেবা প্রদান করতে সক্ষম উন্নত দেশসমূহের ওপর নির্ভর করতে হবে। ফলে উন্নত দেশসমূহই অধিক লাভবান হবে। অপরদিকে উন্নয়নশীল অঞ্চল নিজস্ব সেবা খাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে।
ডব্লিউটিও চুক্তি অনুযায়ী কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি উঠে গেলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে উন্নয়নশীল অঞ্চল। কৃষি উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় যে সহযোগিতা প্রদান করা হতো তা বন্ধ হয়ে যাবে। কৃষির ওপর নির্ভরশীল উন্নয়নশীল দেশসমূহে কৃষি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে খাদ্যশস্যের মূল্যও বৃদ্ধি পাবে। সারসহ কৃষিজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে কৃষকরা উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবে। ফলে কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাবে। ফলে নির্ভরশীলতা বাড়বে উন্নত দেশসমূহের ওপর এবং এ সুযোগে তারা অধিক মুনাফা অর্জনে সক্ষম হবে।
অতএব, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে সমগ্র পৃথিবী দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়বে। একটি স্বনির্ভর উন্নত বিশ্ব এবং অপরটি নির্ভরশীল হল্পোন্নত তথা উন্নয়নশীল বিশ্ব। ফলে সার্বিক বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা চলে যাবে উন্নত বিশ্বের হাতে।
তবে বিশ্বে একমেরুকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডব্লিউটিও ব্যবস্থাপনা অনেকটা বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা। তাই বিশ্বকে সচেষ্ট হতে হবে কিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তোলা যায়। যেহেতু সকল ধরনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ওঠে যাবে, তাই তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে পণ্যের মান বৃদ্ধির মাধ্যমে কিভাবে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে সহাবস্থান করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
সার্বিক বিবেচনায় একমেরুকেন্দ্রিক বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনৈতিক উদারীকরণ বর্তমান বাস্তবতা। উন্নত দেশসমূহের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশসমূহকে এ বাস্তবতাকে মেনে না নিয়ে কোনো উপায় নেই।
মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতির ফলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকসমূহ
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মতামত অনুযায়ী মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতির ফলে বাংলাদেশে নিম্নোক্ত সমস্যা হতে পারে:
১. পোশাকশিল্প কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের যে অভাবনীয় অগ্রগতি তা মূলত বাংলাদেশের জন্য সংরক্ষিত কোটানীতির কারণেই সম্ভব হয়েছে । কিন্তু মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতির কারণে ২০০৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জন্য সংরক্ষিত সেই কোটা উঠে যাবে। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ অর্জনকারী তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিবেশী দেশসমূহসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সাথে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে।
২. বহু শিল্পের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে
মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতি প্রবর্তনের ফলে বাংলাদেশের বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানকে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের শুল্কনীতিও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রয়োজনীয় কাঁচামালের তুলনায় ফিনিশড পণ্যের আমদানি শুল্ক হার কম। কিন্তু কাঁচামালের শুল্ক কম হওয়া উচিত। এর ফলে দেশ রুগ্ন ও বন্ধ শিল্পের সংখ্যা বাড়বে।
৩. রপ্তানি আয় হ্রাস পেতে পারে
মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতির ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেতে পারে। গ্যাট চালু হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী শুল্ক হার হ্রাস পাবে। এ শুল্ক কাঁচামাল বা প্রাথমিক পণ্য এবং আধা প্রক্রিয়াজাত পণ্যের তুলনায় ফিনিশড পণ্যের ক্ষেত্রে হ্রাস করা হবে বেশি হারে। ফলে উন্নত দেশগুলোর রপ্তানি স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভুলনায় বাড়বে। গ্যাটের কারণে MFA (Multi Fiber Agreement) এবং GSP উঠে যাওয়ায় শিল্পোন্নত ২৭টি দেশে বাংলাদেশ নামমাত্র অক্ষে পণ্য রপ্তানির সুযোগ হারায় ।
৪. খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে
বাংলাদেশ গম, ভোজ্য তেল, কাপড়, তুলা, পেট্রোলিয়াম, সিমেন্ট, মেশিন ও কাঁচামাল, দুধ, চিনি ও খাদ্যসহ অনেক কৃষিজাত দ্রব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে থাকে ৷ এসব দেশ তাদের কৃষিতে প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে থাকে বলে বাংলাদেশের আমদানিতে খরচ কম হয়। কিন্তু গ্যাটের নীতি অনুসারে আর ভর্তুকি দেয়া যাবে না। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে তার মূল্যও বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের আমদানিকৃত দ্রব্যের দামও বাড়বে, বাংলাদেশে যার লক্ষণ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
৫. পরিবেশের ওপর প্রতিক্রিয়া পড়বে
গ্যাট সংক্রান্ত আলোচনায় আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে সর্বক্ষেত্রে। এর ফলে গাছপালাও প্যাটেন্ট করা হয়েছে। অর্থাৎ প্যাটেন্ট করা গাছ অথবা গাছ থেকে কোনো কিছু নিতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমতি নিতে হবে। প্যাটেন্টের ফলে ঐসব গাছের বীজেরও অধিকারী হবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। ফলে চাষাবাদের নিজস্ব ধারা ব্যাহত হবে এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের সম্ভাব্য করণীয়
সারা বিশ্বে মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতি প্রবর্তনের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পসহ সকল প্রকার শিল্প-কারখানা তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। তবে এর ফলে আগামীতে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে৷ তাই বাংলাদেশকে এরূপ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে টিকে থাকার জন্য বহুবিধ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে । নিচে এসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
১. প্রশাসনিক সংস্কার
বাংলাদেশের মতো দেশের জনপ্রশাসনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনকল্যাণ ও উন্নয়ন। বর্তমানে উন্নয়নের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে অর্থনীতির উদারীকরণ এবং মুক্তবাণিজ্য। সুতরাং জনপ্রশাসনও এ প্রত্যয়সমূহের সাথে পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে উপযোগী অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের জন্য বাংলাদেশে প্রশাসনিক সংস্কার খুবই জরুরি। বাংলাদেশের সিভিল সমাজের পক্ষ থেকে এ দাবি বার বার উচ্চারিত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের প্রচলিত প্রশাসনকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও জবাবদিহি প্রশাসনে রূপান্তর করতে হবে। একই সাথে সম্পদ বাড়ানোর জন্য বিদ্যমান শুল্ক, কর, বিনিয়োগ নীতি এবং ব্যাংক নীতিরও সংস্কার প্রয়োজন।
২. দুর্নীতি নির্মূল করা
দুর্নীতি বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্রের শীর্ষপদ থেকে শুরু করে সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি বিদ্যমান। বেসরকারি হিসাব মতে দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১২০০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পর পর তিনবার শীর্ষস্থানীয় কুখ্যাতি পেয়েছে। তাই দুর্নীতি নির্মূলের জন্য বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদান এবং স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা উচিত। একই সাথে ন্যায়পালের অফিসও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
৩. উৎপাদন বাড়াতে হবে
মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতিকে যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে হলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, বাংলাদেশকে যদি উৎপাদন দিয়ে বাজার দখল করতে হয় তাহলে Technology-এর Diversity Sector-কে বাদ দিয়ে Production Volume বাড়াতে হবে। যেমনিভাবে জাপান অতিক্রম করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের অটোমোবাইল এবং সুইস ঘড়ি কোম্পানিকে।
৪. পণ্যের মান বাড়াতে হবে
অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে পণ্যের মান বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন ও পণ্যের মান ধরে রাখতে না পারলে বাজার হাতছাড়া হয়ে যাবে। বস্তুত বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই গুণগত পণ্য উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই।
৫. অর্থনৈতিক কাঠামো রদবদল করা
মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতির কারণে বর্তমানে কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি খাতও গ্যাটের আওতাধীন। তাই গ্যাট চুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে ব্যাপক রদবদল করতে হবে।
৬. সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ
গ্যাটের ফলে বিশ্ব ব্যবসায়-বাণিজ্য বছরে ২১ হাজার কোটি ডলার থেকে ২৭ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে। এর ভাগ কে কতটা পাবে তা নির্ভর করতে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতি ও পরিকল্পনার ওপর তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে নিজেদের যোগ্য স্থান করে নেয়ার জন্য সরকারের অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাসমূহকে অর্থনীতির নতুন চাহিদায় উপযোগী করে তুলতে হবে।

৭. ডব্লিউটিওর দেয় সহায়তার সর্বোত্তম ব্যবহার
গ্যাট চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে সহজ শর্তে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়া হবে। এ সহায়তার লক্ষ্য হলো এসব দেশের রপ্তানির ভিত্তিকে শক্তিশালী ও জোরদার করা। বাংলাদেশের উচিত হবে ডব্লিউটিওর সদস্য হিসেবে প্রাপ্ত প্রযুক্তিগত সহায়তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, যাতে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হয় ।
৮. সরকারের উদারতা প্রয়োজন
বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব আদায়কেই সবার উপরে স্থান দেয়। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার আগেই সরকার রাজস্ব পেতে চায়, যা শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়। তাই সরকারের এরূপ মানসিকতা পরিবর্তন করে শিল্প বিকাশের ক্ষেত্র সহজ করতে হবে। সরকারের শুল্ক ও করনীতি এমন হওয়া উচিত যেন জনগণ অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে পণ্য পেতে পারে। বিনিয়োগের লক্ষ্যে সরকারকে আরো উদার হতে হবে।
সুতরাং সারা বিশ্বে মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতি প্রবর্তনের ফলে বাংলাদেশের শিল্প ও অর্থনীতি বহু দিক দিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। তবে মুক্ত ও উদার বাণিজ্যনীতির কতিপয় সুখকর দিকও রয়েছে। বাংলাদেশ যদি ধারণক্ষমতা অনুসারে এর মুখোমুখি হতে পারে তবে এ ব্যবস্থাপনা থেকে উপকৃত হতে পারে। এমতাবস্থায় অবাঞ্ছিত ক্ষতি এড়াতে এবং এ ব্যবস্থাপনা থেকে লাভবান হতে এখন থেকেই বাংলাদেশের উল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
আরও দেখুনঃ