বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা : মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান কৌশল হচ্ছে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ । এজন্য প্রথমেই দরকার একটি দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে মানসম্মত মৌলিক শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষর জনসমাজে পরিণত করা। যেসব উন্নয়নশীল দেশে মানসম্মত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা এখনো সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়নি, সেখানে শুধু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে এ কাজ সম্ভব নয়।

 

বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

 

Table of Contents

বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

 

অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত বিভিন্ন বয়সের বিশাল নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষর করার প্রচেষ্টায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব দেশে বিভিন্ন বয়সের জন্য গৃহীত উপানুষ্ঠানিক সাক্ষরতা কর্মসূচি শিক্ষার দ্বিতীয় সুযোগদানকারী কর্মসূচি (Second Chance) হিসেবে চিহ্নিত। এটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পূরক ও পরিপূরক কর্মসূচি হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশে উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং এ জাতীয় অন্যান্য কর্মসূচি অনেক পূর্বেই গৃহীত হলেও মূলত ১৯৯০ দশকে উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। বিশেষ করে উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পাশাপাশি এনজিওগুলো এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করায় এ প্রসারতা অনেক বৃদ্ধি পায় এবং অনেক সফলতাও অর্জিত হয়। বিশেষ করে বয়স্ক সাক্ষরতা এবং মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনে উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের সার্থকতা প্রশংসনীয়।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার অর্থ

শিক্ষার প্রথম ধারাটি হলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এর দ্বিতীয় ধারাটি হলো উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা। উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষার যে সংজ্ঞাটি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য তা হচ্ছে, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত, নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ উদ্দেশ্য সংগঠিত শিক্ষামূলক কার্যক্রমই উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা। উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা আলাদা ও সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিচালিত হতে পারে।

 

বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

 

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে শিক্ষার দ্বিতীয় সুযোগ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। কেননা যেসব ছেলেমেয়ে ছোট বেলায় শিক্ষার সুযোগ পায় না বা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে না, তাদের পুনর্বার শিক্ষার সুযোগদানের নিমিত্তেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। কেননা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার স্বাভাবিক নিয়মে তাদেরকে এ সুযোগ দান অসম্ভব। তাই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পূরক ও পরিপূরক শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবশ্য পৃথিবীর কোনো দেশেই এটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সামন্তরাল হিসেবে বিবেচিত নয়।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য হলো, এটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মতো অনমনীয় বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ নয়। নীতি ও আইন-কানুনের মধ্যে পরিচালিত হলেও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার অনন্য বৈশিষ্ট্য হলে নমনীয়তা। তাই একে একটি সংগঠিত ও ব্যবস্থা পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত উন্মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা বলা যায়।

বাংলাদেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশ

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার : হয় ১৯১৭-১৮ সালে স্থানীয়ভাবে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে। জানা যায়, ঐ সময়ে অবিভক্ত বাংলায় ১২৬টি নৈশ বিদ্যালয় ও ১৪০টি বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র চালু ছিল। তারপর ১৯৩৯ সালে প্রাদেশিক সরকার পল্লী পুনর্গঠন দপ্তরের কাছে বয়স্ক শিক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করে।

পাকিস্তান আমলে ১৯৫০-এর দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি পর্যায়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রথম প্রচেষ্টা নেয়া হয় ১৯৫৩-৫৫ সালে প্রবর্তিত V-AID কর্মসূচির মাধ্যমে। এরপর ১৯৫৬ সালে এইচ জি এস বিভার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঢাকায় একটি সাক্ষরতা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি কয়েকজন শিক্ষানুরাগীর সহায়তায় ‘পূর্ব পাকিস্তান বয়স্ক শিক্ষা সমবায় সমিতি’ স্থাপন করেন। তারপর ১৯৬০-র দশকে বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করে কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, যা বর্তমানে BARD নামে পরিচিত।

১৯৬৩ সালে সরকার জনশিক্ষা পরিদপ্তরে একটি বয়স্ক শিক্ষা শাখ স্থাপন করে সীমিত আকারে বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা নেয়। প্রথমে এ কর্মসূচিতে ৪টি জেলার ৪টি থানা এবং পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সালে আরো ৪টি থানায় এ কর্মসূচি সম্প্রসারিত করা হয়। ১৯৭৯ সালে কর্মসূচির সর্বশেষ মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৬৩-৭৯ পর্যন্ত মহিলাদের জন্য ৬৯০৪টি কেন্দ্রসহ মোট ১৪৪৭৬টি বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র চালু ছিল।

 

বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচির উদ্যোক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে BRAC (ব্র্যাক)। ১৯৭৩ সালে ব্র্যাক সিলেট জেলার শাল্লা থানায় বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি আরম্ভ করে। ১৯৭৪ সালে ব্র্যাক ওয়ার্ল্ড এডুকেশন সংঘের সহযোগিতায় ব্যবহারিক সাক্ষরতা কর্মসূচি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা নেয়। তাছাড়া ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠাকুরগাঁও থানার কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির উদ্যোগে ১০ জন স্বেচ্ছাসেবীকে সাক্ষরতা শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এদেরই একজন ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ি-কৃট্টগ্রাম গ্রামের মকসেদ আলীর প্রচেষ্টার ১৯৭২ সালে গ্রামটিকে দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয় ।

১৯৭৪ সালে বেসরকারি পর্যায়ে ‘বাংলাদেশ গণশিক্ষা সমিতি’ ১৮টি জেলার ৬৮টি গ্রামে গণশিক্ষা কেন্দ্র সংগঠিত করে। তারপর ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকার দেশব্যাপী গণশিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করে। এর আওতায় ১১-৪৫ বছর বয়সের ৪ কোটি মানুষকে সাক্ষর করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। এজন্য দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ৫১৭ জন শিক্ষা কর্মকর্তা ও ১ লাখ ৬৭ হাজার শিক্ষক কর্মীকে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৮২ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে সরকারি নির্দেশে গণশিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করা হয় এবং এভাবেই এ উদ্যোগের পরিসমাপ্তি ঘটে।

তারপর ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ কর্মসূচি পুনরায় চালু করা হয় । এ কর্মসূচি পাইলট আকারে ২৭টি থানায় প্রবর্তন করা হয় । ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এ কর্মসূচির মাধ্যমে ৫ লাখ ৫০ হাজার লোককে সাক্ষর করা হয়েছে বলে সরকারি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় ১৯৯১ সালে তিন বছর মেয়াদি ‘সমন্বিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম’ (ইনকেপ) নামে পরীক্ষামূলক একটি প্রকল্প চালু করা হয়।

এ কর্মসূচি পরবর্তীতে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। বিস্তৃত পরিসরে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের অধীনে ১৯৯৫ সালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর আরো ব্যাপক আকারে সারা দেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়। এ অধিদপ্তর এখন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচির প্রধান কর্ণধার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

 

বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

 

বাংলাদেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম

বাংলাদেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের কতগুলো স্তর রয়েছে এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা নিজ নিজ কর্মসূচি অনুযায়ী উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে । এ স্তরগুলো হচ্ছে

ক. উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা

বাংলাদেশ সরকার সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ঘোষণা অনেক আগেই দিয়েছে। আর সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের নিমিত্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু তাদের দ্বারা যখন বিশাল নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষর করা দুরূহ হয়ে পড়ল তখন অনেক এনজিও এগিয়ে এলো উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এনজিও হলো ব্র্যাক, প্রশিকা, গণসাহায্য সংস্থা (GSS) প্রভৃতি।

১. ব্র্যাক (BRAC)

ব্র্যাক প্রাথমিক পর্যায়ে ৮-১০ বছর বয়সী শিশুদের শিক্ষার জন্য প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। এরা মূলত গ্রামীণ এলাকার পিছিয়ে পড়া হতদরিদ্র লোকদেরই প্রাধান্য দিয়েছে। ব্র্যাকের এ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের অধীন ২০০০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১০৮২ এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা ১.১০ মিলিয়ন । এদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ মেয়ে।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের দ্বিতীয় পর্যায়ে (এপ্রিল ১৯৯৬ মে ১৯৯৯) ব্র্যাক স্কুলে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী সংযোজন করা হয়। বর্তমানে দেশের ৬১টি জেলার ৩৬৮ থানায় ব্র্যাকের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তছাড়া ব্র্যাক সরকারি সহযোগিতায় ৭৩টি কমিউনিটি স্কুল, ১২০টি School for Hard to Reach Children এবং পোশাক শিল্পের পূর্বতন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের জন্য ৪৩টি স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

২. প্রশিকা

প্রশিকার উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে আট থেকে এগার বছর বয়সী শিশুদের পাঁচটির পরিবর্তে চারটি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করা হয়। প্রশিকার একটি বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় । শিক্ষার্থীরা মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে।

৩. গণসাহায্য সংস্থা

১৯৮৭ সালে ঢাকা ও খুলনার বস্তি এলাকায় ভিন্ন ধাঁচে কয়েকটি ফুল প্রতিষ্ঠা করে গণ সাহায্য সংস্থা। এসব স্কুলে তারা শিশুকেন্দ্রিক (Child Centred) এবং কর্মকেন্দ্রিক (Activity Centred) শিক্ষাপদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে প্রবর্তন করে।

৪. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর

১৯৯১ সালে সরকারি পর্যায়ে গৃহীত ‘সমন্বিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম’ (ইনকেপ) বাস্তবায়নকালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে উপানুষ্ঠানিক মৌলিক শিক্ষাকে চিহ্নিত করা হয়। এ কর্মসূচি আওতায় ১৯৯৬ সালের মধ্যে ৪৯৭০টি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে ১৯৮০ ও ১৯৯০-র দশকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগে বাংলাদেশে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি দ্রুত বিস্তার লাভ করে।

খ. উপানুষ্ঠানিক কিশোর-কিশোরী শিক্ষা

শিশুদের পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের সাক্ষরত অর্জন ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা লাভের নিমিত্তে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। যেমন—

১. ব্র্যাক (BRAC) :

১৯৮৭ সালে ব্র্যাক ১১-১৪ বছর বয়সের মেয়েদের যারা কোনোদিন স্কুলে যায়নি কিংবা যারা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে তাদের জন্য কিশোরী স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্র্যাকের স্কুলগুলোতে কোনো ফি নেয়া হয় না এবং মেয়েদের সব ধরনের শিক্ষাসামগ্রী বিনা পয়সায় দেয়া হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাস পর্যন্ত ১৯১২৮টি কিশোরী স্কুলে ২৭৭২২ জন কিশোরী পড়াশোনায় নিয়োজিত ছিল।

২. বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্র

১৯৭৮ সালে বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্র আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯০ সাল থেকে বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্র মৌলিক স্কুল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কিশোরী স্কুল কর্মসূচি গ্রহণ করে।

৩. ঢাকা আহসানিয়া মিশন

ঢাকা আহসানিয়া মিশনের কিশোর-কিশোরী শিক্ষা কার্যক্রম মূলত তিনটি সাক্ষরতা দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে প্রণীত। এগুলো হচ্ছে লেখা, পড়া এবং সংখ্যাজ্ঞান অর্জন। এতে মোট ৩০০ ঘন্টার শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

৪. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর

আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ধারার বাইরে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষাদানের জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে অধিদপ্তর দু বছর মেয়াদি কোর্স প্রণয়ন করে যা তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত

  • প্রথম পর্যায় মৌলিক সাক্ষরতা ৩০০ ঘন্টা (৮ মাস)
  • দ্বিতীয় পর্যায় স্থিতিশীল সাক্ষরতা ৩০০ ঘণ্টা (৮ মাস)
  • তৃতীয় পর্যায় নৈপুণ্য বিকাশ শিক্ষা ৩০০ ঘণ্টা (৮ মাস)

 

বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

 

গ. বয়স্ক শিক্ষা

বয়স্ক শিক্ষা নিরক্ষরতা দূরীকরণের একটি বিশেষ কার্যক্রম। এ কার্যক্রমে সরকারি- বেসরকারি যৌথ অংশগ্রহণ লক্ষণীয় । যেমন—

১. ব্র্যাক (BRAC)

ব্র্যাক সর্বপ্রথম ১৯৭৩ সালে বয়স্ক সাক্ষরতা কর্মসূচি গ্রহণ করে। পরে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর যখন বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন ব্র্যাক ১৯৯৭ সালে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসে। ১৯৯৯ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায় ব্র্যাকের ৬৭২০টি কেন্দ্রে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের প্রায় ২০,১৬,০০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে এবং এদের ৭৫ শতাংশই মহিলা।

২. এফআইভিডিবি (Friends in Village Development in Bangladesh)

প্রাথমিক পর্যায়ে এফআইভিডিবি কুমিল্লা বার্ড প্রণীত উপকরণ ও কুমিল্লা পদ্ধতির অনুকরণে তাদের বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করত। এ সংস্থার প্যাকেজ কোর্স চারটি পাঠে বিন্যস্ত। এর সাক্ষরতা কর্মসূচির প্রায় ৬৫ শতাংশই মহিলা।

৩. অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ

এটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। এ সংস্থা ১৯৯৪ সালে অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ভিত্তিতে এক সাক্ষরতা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচির নাম প্রথমে ছিল পিআরএ লিটারেসি (PRA Literacy / Numeracy) যা পরবর্তীতে রিফ্লেকট নামে পরিবর্তিত হয়।

৪. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ব্যাঙ্ক সাক্ষরতা কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল ২০০০ সালের মধ্যে বয়স্ক সাক্ষরতার হার (১৫-৩৪ বয়সী) শতকরা ৩৫ থেকে শতকরা ৬২-তে উন্নীত করা। পুনঃনির্ধারিত লক্ষ্য হচ্ছে ২০০৬ সালের মধ্যে তা ১০০ ভাগে উন্নীত করা। অধিদপ্তর নিজে কোনো শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে না। অধিদপ্তর ৮৩টি এনজিওর মাধ্যমে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০০০ সাল পর্যন্ত ৪টি জেলা ৬১৮টি থানাকে নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ কার্যক্রমের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

৫. উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

দেশে ১৯৯২ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বল্পশিক্ষিত জনগণকে উচ্চশিক্ষিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ পরিকল্পনায় এসএসসি কার্যক্রমের মাধ্যমে ঝরে পড়া মেধাশক্তিকে পুনরুজ্জীবনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ঘরে বসেই বেতার টেলিভিশনের মাধ্যমে ২ থেকে ৫ বছর মেয়াদে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব । এ কার্যক্রমও অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে বিবেচিত ও প্রংশসিত হচ্ছে। এভাবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাবলী

বাংলাদেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এক্ষেত্রে এখনো নানাবিধ সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। যেমন-

১. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রকট যে সমস্যা সেটি হলো সমন্বয়হীনতা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি এ শিক্ষা প্রদান করা হলেও উভয়ের মধ্য আদান-প্রদান ও গতিময়তার প্রয়াস খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। তাছাড়া এক্ষেত্রে সরকার ও এনজিওদের মধ্যে এবং এনজিওদের পরস্পরের কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়হীনতা অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়।

২. উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষার সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দলের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ জরুরি। কেননা শিক্ষার্থীদের মাঝে যদি এ ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি করা না যায় তাহলে তাদের শিক্ষিত করে তোলা অসম্ভব । বাংলাদেশে দেখা যায়, অধিকাংশ লোকই অজ্ঞতাবশত শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন করতে জানে না। ফলে এ ধরনের শিক্ষাদান প্রচেষ্টাকে তারা কেবল অবজ্ঞাই করে না বরং অনেক ক্ষেত্রে উপহাসও করে। ফলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মকর্তাদের তেমন সহযোগিতা করতেও তারা এগিয়ে আসে না।

৩. আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যতোটা দক্ষতা, একাগ্রতা, পদ্ধতিগত যথার্থতা লক্ষ্য করা যায় এক্ষেত্রে এমনটা লক্ষ্য করা যায় না। বিশেষ করে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ও শ্রেণীকক্ষে মনোযোগের ক্ষেত্রে খুবই ঢিলেঢালা অবস্থা লক্ষ্য করা যায় ।

৪. সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে চরম দুর্নীতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন ক্লাসে ছাত্র না থাকলেও ছাত্র দেখানো, সাক্ষরতার নামে প্রতারণা, নিরক্ষরমুক্ত জেলা ঘোষণার ছলচাতুরি ইত্যাদি। তাই অনেক সময় মানুষ উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষার মতো কর্মসূচির প্রতি আস্থা ও উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।

করণীয়:

বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে আরো ফলপ্রসূ করতে হলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে নজর দেয়া জরুরি

১. উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপকতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার মান নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা কেবল একটার পর একটা প্রজেক্ট শেষ করে জেলা কিংবা থানাকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করা অথচ কার্যত সাক্ষরতার কিছুই হলো না—এমনটা হলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি।

২. শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে মাঠপর্যায়ে আরো সক্রিয় নজরদারি আবশ্যক।

৩. উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন জরুরি।

৪. উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষাকে কেবল দস্তখত শেখানোর মধ্যে সীমিত না রেখে তাকে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট করতে পারলে এ ক্ষেত্রে সফলতা আসবে নিশ্চিত।

৫. উপা-নুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের সফলতার জন্য জনগণের সচেতনতা আবশ্যক। তাই সরকারি- বেসরকারি প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার, সভা-সমিতি, সেমিনার প্রভৃতির মাধ্যমে একে জনপ্রিয় করতে হবে।

সর্বোপরি শিক্ষাকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে পারলে সকল প্রচেষ্টাই সফল হবে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment