এশিয়ান হাইওয়ে ও বাংলাদেশ রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।
Table of Contents
এশিয়ান হাইওয়ে ও বাংলাদেশ
এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত পরিকল্পনাধীন একটি নেটওয়ার্ক। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এশিয়ার ৩২টি দেশের মধ্যে সড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যেই এক লাখ চল্লিশ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই নেটওয়ার্ক চুক্তি ২৬-২৮ এপ্রিল ২০০৪ চীনের সাংহাইয়ে স্বাক্ষরিত হয়। এ নেটওয়ার্ক বাস্তবায়িত হলে গোটা এশিয়া মহাদেশের দেশগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত হবে।
পটভূমি
এশিয়ান হাইওয়ে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার এক যুগান্তকারী কর্মপরিকল্পনা। উপমহাদেশে সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। উনিশ শতকে পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্য পর্যন্ত ‘ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
বর্তমান সময়েও এ ধরনের আন্তর্জাতিক হাইওয়ে নির্মাণের চিন্তা-ভাবনা চলে আসছে। এক সময় মহাসড়ক ও মহারেলপথের মাধ্যমে তুরস্ক থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা হয়েছিল। তবে এশিয়া ও প্যাসিফিকের দেশগুলো এশিয়ান হাইওয়ে ধারণা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে ১৯৫৯ সালে। ১৯৬০ সালে গৃহীত হয় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের ধারণা।
এ ধারণার উদ্যোক্তা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ESCAPEconomic and Social Commission for Asia and Pacific)। জাতিসংঘভুক্ত এ সংস্থার লক্ষ্য হচ্ছে এক দেশের সাথে অন্য দেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা যাতে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এ প্রেক্ষিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়ান হাইওয়ে ধারণা জোরদার হয়।
এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টি ছিল গোটা ধারণার মূলে। এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ের সদস্য দেশগুলো এক দেশ যেমন অন্য দেশের রাস্তাঘাট ব্যবহার করবে, তেমনি সেই দেশ তার রাস্তাঘাট অন্য দেশের জন্যও ব্যবহার করতে দেবে।
এশিয়ান হাইওয়ের প্রথম সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এ ব্যাপারে বেশ অগ্রগতি সাধিত হয়, কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধ ও বৈরিতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এশিয়ান হাইওয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি।
১৯৮০’র দশকের শেষ ভাগে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে এবং এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বৈরিতার বদলে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এরই মধ্যে এশিয়া- প্যাসিফিক অঞ্চল হয়ে ওঠে ‘বুমিং’ ও গতিশীল অর্থনীতির কেন্দ্র। গোটা বিশ্বের সাথে এশিয়া-প্যাসিফিকের দেশগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকে দ্রুত। আর এক্ষেত্রে যেসব দেশ স্থলবেষ্টিত তাদের মধ্যে স্থল পথে অর্থাৎ সড়ক ও রেলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন বিকাশের অপূর্ব সম্ভাবনা দেখা দেয়। এশিয়া ও প্যাসিফিকের দেশগুলোর মধ্যে এশিয়ান হাইওয়ে নিয়ে নতুন করে তাগিদ সৃষ্টি হয়।
প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে
এশিয়ার ৩২টি দেশকে যুক্ত করবে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক। এক লাখ চল্লিশ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই নেটওয়ার্কের আওতার প্রতিটি দেশ পরস্পরের সাথে সড়ক পথে যুক্ত হবে। এশিয়ান হাইওয়ের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে পূর্ব দিকে চীন, মঙ্গোলিয়া ও ইন্দোচীনের রাষ্ট্রগুলো এবং পশ্চিম দিকে তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার দেশসমূহ, দক্ষিণ দিকে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, দক্ষিণ- পূর্বদিকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
বাংলাদেশের রুট
বাংলাদেশ প্রথমে ১৯৯৫ সালে এশিয়ান হাইওয়ে সংক্রান্ত দুটি প্রস্তাব পেশ করেছিল। প্রথমত, ভারত থেকে বেনাপোল-যশোর হয়ে ঢাকার ভেতর বা পাশ দিয়ে সিলেট-তামাবিল রাস্তায় পূর্বভারতে অনুপ্রবেশ করা সড়কটির প্রস্তাব করা হয়েছে প্রধান মহাসড়ক হিসেবে। দ্বিতীয় একটি সড়ক ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার- টেকনাফ হয়ে মিয়ানমারে প্রবেশের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।
কিন্তু শেষোক্ত প্রস্তাবটি ভারত ও মিয়ানমারের বিরোধিতার কারণে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেনি। মিয়ানমারের মতে, বর্তমানে ইয়াঙ্গুন থেকে আরাকানের মধ্য দিয়ে তাদের কোনো সংযোগ নেই। তাদের আরাকানের অঞ্চলটি নিম্নভূমি, লোকবসতি কম এবং নদী-নালা বেশি। তাই অর্থনীতিক দিক দিয়ে তাদের জন্য আরাকান দিয়ে সড়ক নির্মাণ লাভজনক হবে না।
তাছাড়া মিয়ানমার চায় বাংলাদেশের উত্তর দিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্য দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের রুট। তাদের মতে, এতে করে একই সঙ্গে তাদের একাধিক দেশের (থাইল্যান্ড, দক্ষিণ চীন, ভারত ও বাংলাদেশ) সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নিকট প্রথমোক্ত রুটটি উন্মুক্ত করার পথ খোলা আছে। তবে বাংলাদেশ দ্বিতীয় রুটটি চালুর ব্যাপারেও মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে।
এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ- মিয়ানমার চুক্তি আওতায় বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারকে ৫৫ কিলোমিটার একটি মহাসড়ক নির্মাণ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি বাংলাদেশ পূর্বেকার দুটির বদলে তিনটি রুট অন্তর্ভুক্ত করে নতুন প্রস্তাব পেশ করেছে।
তৃতীয় রুটটি মিয়ানমার থেকে ভারতের মনিপুরের তামু দিয়ে ঢুকে ডাওকি-তামাবিল-সিলেট-ঢাকা হয়ে বাংলাবান্ধা – শিলিগুড়িকে সরাসরি যুক্ত করেবে নেপালের কাঁকরভিটাকে। বাংলাদেশ এই রুটকে বিবেচনায় রেখেই ১৯৭৬ সালে ট্রানজিট চুক্তি করে নেপালের সঙ্গে প্রস্তাবিত আন্তঃসরকার এএইচ নেটওয়ার্ক চুক্তিতে এএইচ-১১ ক্রমিক থেকে এএইচ-৮৭ হচ্ছে সাব-রুট ।
এসকাপের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এএইচ-৪১ রুটটি দেখানো হয়েছে এরকম ‘টেকনাফ-কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-কাঁচপুর-ঢাকা-হাটিকমরুল (সিরাজগঞ্জ)-যশোর-মংলা’। এখানে আরেকটু সংশোধনী এসেছে। টেকনাফের আগে মিয়ানমার সীমান্ত কথাটি যুক্ত করা হয়েছে সম্প্রতি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একমত হয়েছে, টেকনাফের অদূরে রামু সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের তুয়াংবারু থেকে বুচিডং যাবে।
নাফ নদীতে একটিমাত্র কালভার্ট নির্মাণ করলেই চলবে। সড়কপথে বুচিডং থেকে ইয়াঙ্গুনে পৌঁছানোর দায়িত্ব মিয়ানমারের। এশিয়ান হাইওয়ের মানচিত্রে অবশ্য এই রুট দেখানো হয়নি। মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ২০০৪ সালের ৪-৬ এপ্রিল বাংলাদেশ সফর করেন এবং মিয়ানমার অংশের ৫৫ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
ফলে টেকনাফ- ইয়াঙ্গুন রুটের জন্য এটি একটি মাইলফলক অগ্রগতি। এশিয়ান হাইওয়ে সংক্রান্ত এসকাপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ঢাকা-কাঁচপুর-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটটিকে টেকনাফ থেকে ইয়াঙ্গুন পর্যন্ত সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু যেহেতু বর্তমানে প্রস্তাবিত সড়কের বেহাল অবস্থা ও মিসিং লিঙ্ক রয়েছে তাই এটা পরবর্তীকালে দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ একটি নতুন বিকল্প সংযোগেরও প্রস্তাব দেয়। যুক্তি দেয়া হয়, এর ফলে বিদ্যমান তাইমফাল-নিজপুর-সিলেটের গোয়াইনঘাট থানার তামাবিলের পরিবর্তে যদি সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার সুতারকান্দি/অষ্টগ্রাম-করিমগঞ্জ-ইমফাল রুট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগের দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার কমে যাবে।
এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক চুক্তি
এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক চুক্তি ২০০৪ সালের ২৬-২৮ এপ্রিল চীনের সাংহাইয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন এসকাপ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। প্রস্তাবিত খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত হয় ২০০৪ সালের নভেম্বরে ব্যাংককে এসকাপ বৈঠকে। প্রধানত রাজধানী ও সমুদ্র বন্দরগুলোকে যুক্ত করেছে। এএইচ নেটওয়ার্ক ।
এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষরের সুযোগ ছিল ১ জুন ২০০৪ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০০৫ পর্যন্ত। আগামী মাসে আটটি দেশ চুক্তিটি স্বাক্ষর করার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এটি কার্যকর হবে । তবে এতে স্বাক্ষরের ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক দেশ অন্য দেশের সড়ক ব্যবহারে কোনো অধিকার লাভ করবে না।
এজন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে হবে। চুক্তিতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সুবিধার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রুট সংশোধনীরও সুযোগ রাখা হয়েছে। বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত চুক্তির ১৩ দফায় বলা হয়েছে, বিরোধী পক্ষ নিজেরাই সালিশ নিয়োগ করতে পারবে। তিন মাসের মধ্যে সুরাহায় না পৌঁছলে কোনো পক্ষ জাতিসংঘের মহাসচিবকে একজন সালিশ নিয়োগের জন্য অনুরোধ জানাতে পারবে। এই সালিশের রায় উভয় পক্ষের জন্য মেনে চলা বাধ্যতামূলক হবে।

উপসংহার
এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক বাস্তবায়িত হলে এশিয়ায় যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিপ্লব আসবে। যোগাযোগ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা এশিয়ার দেশগুলো পরস্পরের সাথ সড়ক পথে যুক্ত হবে এবং অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে। এশিয়া হবে অতিষণ অর্থনৈতিক শক্তি ।
আরও দেখুনঃ