টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি রচনা

টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করা নিরুৎসাহ দেই। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।

টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণায় বিভ্রান্তি আর মাত্রাগত ভিন্নতার শেষ নেই। গতানুগতিক উন্নয়ন তত্ত্বে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের (জিএনপি) প্রবৃদ্ধিকেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে মনে করা হতো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এ ধারণায়ও এসেছে পরিবর্তন।

উন্নয়ন ধারণায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা ও উপাদান। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আজ মাথাপিছু আয়ের একমাত্রিক ধারণা থেকে একটি বহুমাত্রিক প্রপঞ্চে (Multidimensional Phenomenon) রূপান্তরিত হয়েছে।

এ প্রেক্ষিতে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ Meier উন্নয়নকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে যখন বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন এমন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যার দ্বারা দীর্ঘকালীন সময়ে কোনো দেশের জনগোষ্ঠীর মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়। তখন অনেক অর্থনীতিবিদই দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং অসমতাকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রধান সমস্যা বলে চিহ্নিত করে এগুলোর সমাধানকেই উন্নয়ন বলে চিহ্নিত করেন।

১৯৭০-এর দশকে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক, পল স্কিটিন, জেমস গ্রান্ট প্রমুখ মৌলিক চাহিদা (Basic Need) নামে উন্নয়নের নতুন তত্ত্ব নিয়ে আসেন। এর মূলকথা হলো, সব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ।

তারপর ১৯৭৬ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) মৌলিক চাহিদা তত্ত্বের সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে Basic Human Needs Approach নামে উন্নয়নের নতুন ধারণা হাজির করে। এ নতুন তত্ত্বানুযায়ী উন্নয়ন হলো মানুষের জন্য পুষ্টি, মৌলিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, স্যানিটেশন, বিরুদ্ধ পানি সরবরাহ, গৃহায়ন প্রভৃতি সুবিধাদি সৃষ্টি করা ।

কিন্তু পরবর্তী বছর ১৯৭৭ সালে মরিস ডেভিড মরিস উন্নয়নের এক নতুন ধারণা দেন, যা জীবনের ভৌত মানসূচক (Physical Quality of Life Index বা PQLI) নামে পরিচিত। এ তত্ত্বানুযায়ী উন্নয়নের তিনটি সূচক হলো ১. মানুষের গড় জীবন প্রত্যাশা, ২. শিশুমৃত্যুর হার, ৩. শিক্ষার হার ।

তারপর উদ্ভব ঘটে উন্নয়নের মানবীয় ধারণার। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক মানব উন্নয়ন সূচকের (Human Development Index- HDI) নবতর ধারণা দেন। তার বর্ণিত উন্নয়নের সূচকগুলো হলো ১. মানুষের গড় আয়ুকাল, ২. শিক্ষার হার, ৩. ক্রয়ক্ষমতা।

এ ধারণায় ব্যক্তি মানুষের উন্নয়নকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দেয়া হয়। এরই প্রেক্ষাপটে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, উন্নয়ন হলো মানুষের কোনো কিছু করা এবং হওয়ার স্বাধীনতার সম্প্রসারণ। মানুষের স্বাধীনতা সম্প্রসারণের জন্য তিনি আবার দুটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন । এগুলো হলো স্বত্ত্বাধিকার (Entitlement) এবং সক্ষমতা (Capability)।

 

টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

 

উন্নয়নের জন্য প্রথমত ব্যক্তির প্রত্যাশিত বস্তু ও সেবার ওপর তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কিন্তু ব্যক্তির যদি এ সকল বস্তু ও সেবার ব্যবহারের সক্ষমতা না থাকে তাহলে তা নিরর্থক । তাই তার সক্ষমতাও থাকতে হবে।

সুতরাং উন্নয়ন বলতে যদি ব্যক্তির কোনো কিছু করা এবং হওয়ার স্বাধীনতার সম্প্রসারণ বুঝায় তাহলে তার এ স্বাধীনতার কার্যকারিতা নির্ভর করবে তার মালিকানা ও সক্ষমতার ওপর।

কিন্তু উন্নয়ন ধারণায় সম্প্রতি আরেকটি বিষয় বেশ জোরেশোরেই আলোচিত হচ্ছে। বর্তমানে উন্নয়নের পরিবেশগত প্রভাব এবং এর স্থায়িত্ব তথা টেকসই উন্নয়নের বিষয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উন্নয়নবিষয়ক আলোচনায় উঠে এসেছে।

 

টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

 

টেকসই উন্নয়নের ধারণা

উন্নয়ন ধারণার ব্যাপক বিবর্তন প্রক্রিয়ায় দেখা যায়, সরকার এবং সাহায্যদাতা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশগত ভারসাম্যের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে। বরং উন্নয়ন কর্মসূচি কেন্দ্রীকৃত থেকেছে প্রতিকূল শর্তযুক্ত বৈদেশিক ঋণ, নগরায়ন ও শিল্পায়ন এবং এর ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের দ্রুত ক্ষয়সাধন ও পরিবেশের বিপন্নতার মাঝে। ফলে বিশ্ব আজ এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন, যার দায়ভার কেবল বর্তমান প্রজন্মকেই নয়; বরং অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও যুগ যুগ ধরে বহন করতে হবে।

এসব ভাবনার ফলে উন্নয়ন ধারণায় উঠে আসে উন্নয়নের স্থায়িত্ব ও এর পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়টি, যাকে বলা হয় টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) নামক শব্দযুগল প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৮০ সালে IUCN-এর ‘World Conservation Strategy Carrying for the Earth’ শীর্ষক রিপোর্টে। উক্ত রিপোর্টে টেকসই উন্নয়নের ব্যাখ্যায় বলা হয়, Sustainable development means improving the quality of human life while living with in the carrying capacity of the supporting ecosystems. এখানে প্রাকৃতিক তথা বনজ সম্পদের সাথে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি ও ভোগের দ্বন্দ্বকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দেয়া হয়েছে ।

পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে Brundtland Commission টেকসই উন্নয়নকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে, Development that meets the needs of the present without limiting the potential to meet the needs of future generation, অর্থাৎ টেকসই উন্নয়ন হলো এমন উন্নয়ন যেখানে বর্তমান প্রজন্মের ভোগের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনীয় ভোগের সম্ভাব্যতা সীমিত হবে না।

এ সংজ্ঞার মূল বিষয় হলো আন্তঃপ্রজন্য সমতা। তবে সাম্প্রতিককালে আন্তঃজ (Intra generation) সমতার বিষয়টিও সমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। কেননা উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে সংখ্যালঘিষ্ঠের অ-টেকসই ভোগের কারণে বর্তমান প্রজন্মের অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রক্রিয়া যেন বাধাগ্রস্ত না হয় তাও খেয়াল রাখা আবশ্যক ।

 

বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, বাংলাদেশ ক্রমশ উন্নয়নের পথে ধাবিত হচ্ছে। তবে পথ চলার এ গতি কচ্ছপের চেয়েও মন্থর। মাথাপিছু গড় আয় মাত্র ৪৭০ মার্কিন ডলার। প্রবৃদ্ধির হিসেবে উন্নয়নকে পরিমাপ করলে দেখা যায়, ২০০২-০৩ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.২৬ শতাংশ। ২০০১ সালে তা আসে ৬.২৭ শতাংশে এবং ২০০৩-০৪ সালের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৫.৩ শতাংশ।

বলা হয়, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, কিন্তু তার যথার্থতা এখন প্রশ্নের মুখোমুখি। শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির হার এখনো নিম্ন, যা ২০০৩-০৪ সালে ছিল ৭.১০ শতাংশ। অবশ্য ২০০৪-০৫ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে ৮.৪৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের ব্যাপারেও ঢাকঢোল পিটানো হচ্ছে। অথচ ১৯৯৮ সালের পর থেকে বৈদেশিক বিনিয়োগ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

১৯৯৮-৯৯ সালে দেশে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৯২৬ মিলিয়ন ডলার। অথচ ২০০৩-০৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৫৮ মিলিয়ন ডলারে। আবার এ বিনিয়োগের অধিকাংশই এসেছে শক্তিখাতে। তবে ইপিজেড প্রতিষ্ঠার ফলে দেশে জাপানি ও কোরিয়ান বিনিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও তা ধরে রাখা যাচ্ছে না। ইপিজেডগুলোতে ২০০৩-০৪ সালে ১১৫.০৫ মিলিয়ন ডলারে।

তাছাড়া মানব উন্নয়নেও বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। অবশ্য ২০০৩ সালের মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ নিম্ন মানব উন্নয়নভুক্ত দেশের তালিকা থেকে মধ্যম মানব উন্নয়নভুক্ত দেশের তালিকায় উন্নীত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেলেও (৬৫%) শিক্ষার মান এখনো নিম্ন। বাংলাদেশের শিশুরা এখনো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে এ তথ্য দিয়ে বলা হয়, এ দেশে ক্ষুধা কিংবা অপুষ্টিজনিত রোগে প্রতিদিন ৭০০ শিশু মৃত্যুবরণ করে। আর্সেনিকের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যায় দেশের ৬১টি জেলা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত । স্বাস্থ্যসেবার মান দেশে কেবল অল্পতই নয়, জীবন রক্ষায় অনুপযুক্ত। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দেশের ৬ কোটির বেশি মানুষ এখনো ১৮০৫ ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না, যদিও তা প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে কম।

তবে সার্বিক বিবেচনায় নারী সমাজের অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং নগরায়নও কমবেশি হচ্ছে বলা যায়। দারিদ্র্যের হারও কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে। তবে দারিদ্র্য হ্রাসের এ নিম্নগতির অন্যতম বাঁধা অসমতা ৷ এতে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির সুফল জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছতে পারছে না।

 

টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

 

টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশে উন্নয়নের গতিধারা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ধীরগতিতে হলেও বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এমনকি কৃষিতে ব্যাপক সাফল্য, বিপুল পরিমাণ গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা বাংলাদেশের উন্নয়নের ব্যাপারে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের আশাবাদী করেছে সন্দেহ নেই ।

কিন্তু উন্নয়নের এ ধীরগতিকে দ্রুততর করার প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি উন্নয়নের সুফলের সুষম বণ্টন, নীতি ও পদ্ধতি, উন্নয়নের অংশীদারদের ভূমিকা এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে আসছে। সর্বোপরি উন্নয়নের স্থায়িত্ব ও তার পরিবেশগত প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রবণতা জাতিকে দিন দিন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

কেননা কৃষি উন্নয়নে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ এবং জীববৈচিত্র্য নাশ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট, বিনিয়োগের নামে প্রাকৃতিক সম্পদের লুটপাট এবং তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের নামে দেশীয় সংস্কৃতির ধ্বংস সাধন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক বিপজ্জনক স্বদেশ প্রস্তুত করছে।

 

টেকসই কৃষি উন্নয়ন

২০০৩-০৪ সালে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.২৭ শতাংশ, যা ২০০৪-০৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৩৮ শতাংশে। সর্বোপরি ধানের উৎপাদন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদনের এ ব্যাপক বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অনেকেই উন্নতমানের বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক সারসহ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারকে মূল্য দিতে চান। এটা পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশেই সত্য। এখন প্রশ্ন হলো, কৃষি খাতের এ প্রবৃদ্ধি কতটা টেকসই এবং এর পরিবেশগত প্রভাবই বা কি?

প্রথমত, কৃষিতে হঠাৎ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও দীর্ঘ সময় তা ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ অনেক হলেও অন্যতম কারণ হলো, জমিতে ক্রমাগত অধিক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং ফলনও হ্রাস পাচ্ছে। এভাবে কৃষিকে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিকীকরণ করা হলে এক সময় নিশ্চিতভাবে জমি বন্ধ্যা হয়ে পড়তে পারে।

দ্বিতীয়ত, হাইব্রিড ও HYV বীজ জমিতে ব্যবহার করলে অধিক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক অতিরিক্ত খরচ ব্যবহার করতে হয় এবং উৎপাদনের হার বজায় রাখতে হলে প্রতি বছর অধিক হারে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ বাড়াতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং এক পর্যায়ে কৃষক মেটাতে অপারগ হয়ে পড়ে। ফলে দেখা যায়, কৃষক প্রযুক্তির সহায়তায় উন্নতি সাধনের পরিবর্তে এর দাসে পরিণত হয় এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে পৌঁছে যায়। তাতে কৃষক সর্বস্ব হারালেও বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশীয় এজেন্টরা উন্নত বীজ সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

তৃতীয়ত, গত দু দশকে আমরা প্রায় ২৫ হাজার প্রজাতির দেশীয় ধান হারিয়েছি। আমরা যদিও চিরকালের জন্য এ সকল প্রজাতি হারিয়েছি কিন্তু উন্নত দেশে এদের জিনকে জিন ব্যাংকে ঠিকই সংরক্ষণ করা হয়েছে।

চতুর্থত, কৃষিতে ব্যাপক হারে রাসায়নিক বস্তু ব্যবহারের ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবন হুমকির মুখে পড়ছে। অসংখ্য প্রজাতির ফ্লোরা ও ফলা প্রতিদিন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, জমি হারাচ্ছে উর্বরতা এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রকৃতিগত ও পরিবেশগতভাবে আমাদের বিপন্নতা।

পঞ্চমত, চিংড়ি চাষ ও রপ্তানি বেশ লাভজনক বলে দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলীয় জেলাগুলোতে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে। ফলে দেশ কিছু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে সত্য কিন্তু এর ফলে যে নানা প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে, উর্বর জমিগুলো লবণাক্ততার কবলে পড়ে উর্বরতা হারাচ্ছে, কৃষককে তার জমি থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে এবং উপকূলীয় বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অবশ্যই বিবেচনায় আনা উচিত।

 

টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

 

বিদেশী বিনিয়োগ ও গ্যাস

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং প্রাকৃতিক গ্যাস উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশী কোম্পানিগুলো প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিনিয়োগ করতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কিন্তু কেন? অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের জন্য তো তাদের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। ইদানীং আবার গ্যাস রপ্তানির পায়তারা চলছে।

বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে এবং গ্যাস রপ্তানি করলে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে যাবে। এটা ঠিক যে, গ্যাস বিক্রি করলে আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি হয়তো কিছুটা বৃদ্ধি পাবে । কিন্তু এ বৃদ্ধি কতদিন টিকবে? আমাদের ১০ কিংবা ১১ টিসিএফ গ্যাস থেকে রপ্তানি করার পর আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তি চাহিদা মেটানো কতদিন পর্যন্ত সম্ভব হবে এবং রপ্তানির বিকল্প ভালো কিছু হতে পারে কিনা – এসব অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান মজুদ গ্যাস দিয়ে সর্বোচ্চ ৩০ বছর চলতে পারে। এমতাবস্থায় গ্যাস রপ্তানি করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শক্তি চাহিদা কিভাবে মিটবে তা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার।

 

শিল্পায়ন :

শিল্পায়ন বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এবং বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পায়ন জরুরি। কিন্তু অপরিকল্পিত শিল্পায়নের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, কর্ণফুলি, ভৈরবসহ গুরুত্বপূর্ণ নদীর পানিকে ব্যাপকভাবে দূষিত করলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের বিপন্নতা কতটুকু মারাত্মক হবে তা অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। পরিবেশ দূষণের ফলে জনস্বাস্থ্যের অব্যাহত ক্ষতির বিষয়টি পাশ কাটিয়ে কেবল শিল্পায়নের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি অর্জনের নেশায় মাতাল হলে চলবে না।

 

অবকাঠামো উন্নয়ন :

বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও তা একেবারে কম নয়। বাংলাদেশের রয়েছে ৩১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জাতীয় মহাসড়কসহ ৩৬০০০ কিলোমিটারের বিশাল সড়ক নেটওয়ার্ক। যমুনা সেতুর নির্মাণ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে মূল অর্থনৈতিক স্রোতধারার সাথে সংযুক্ত করেছে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগও একেবারে কম নয়। মালামাল পরিবহনের প্রায় ৬৫ শতাংশ এবং আন্তঃজেলা যাত্রী পরিবহনের ৩৮ শতাংশ হয় নৌপথে।

দেশব্যাপী রয়েছে ২৮৫৪.৯৬ কিলোমিটার রেলপথ। এ সকল যোগাযোগ অবকাঠামো জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ নির্মাণ উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। নগরের চাকচিক্য আর বিরাটাকার ইমারত বাড়লেও ভূমিকম্পের ফলে আমাদের জীবনের বিপন্নতার আশঙ্কাকে এড়িয়ে যাওয়া আদৌ উচিত নয় ।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা

শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা সফলতা অর্জন করলেও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিরাজ করছে চরম অরাজকতা । এমনকি শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান তেমন বাড়ছে না। অথচ একুশ শতকের অর্থনীতির মূল সম্পদই হলো জ্ঞান। জ্ঞানকর্মীরাই সৃষ্টি করবেন নয়া জমানার সম্পদ।

সেদিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এ মুহূর্তে নির্ধারিত হচ্ছে আমাদের বিদ্যায়তনগুলোতে। অথচ সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে বলছে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি হচ্ছে কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে তার খবর কে রাখে। আমরা এ সত্যটা অনুধাবন করতে পারছি না যে, শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য, সন্ত্রাস, অবক্ষয় এবং এর নেতিবাচক প্রভাব আগামী দিনের বাংলাদেশের সকল সম্ভাবনাকে গিলে খেতে চাইবে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে পারছে না। তথ্যপ্রযুক্তিকে আজও আমরা শিক্ষার অঙ্গ করে তুলতে পারিনি। সুতরাং শিক্ষিত বেকারের হার বৃদ্ধি করে আজকের নীতিনির্ধারকরা তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের ক্ষমা করবে না ।

 

আমাদের করণীয়

  • আমাদের কৃষিতে দেশীয় বীজ, জৈবসার আর প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে ।
  • অহরহ কীটনাশক ব্যবহার না করে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করতে হবে।
  • বৈদেশিক বিনিয়োগকে স্বাগত জানালেও বিনিয়োগের নামে গ্যাস সম্পদ লুটপাটের সুযোগ দেয়া যাবে না।
  • শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে কিন্তু ঋণখেলাপিদের শিল্পঋণ দিয়ে কৃষকের ভর্তুকি ও ঋণদান বন্ধ করা যাবে না।
  • শিল্পায়নের নামে পানিসম্পদ ও নদ-নদীর জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট করা যাবে না। পরিবেশের প্রয়োজনীয়তাকে পাশ কাটিয়ে শিল্পায়ন কাম্য হতে পারে না।
  • নগরায়ন এবং পরিবহন ব্যবস্থার প্রসার প্রত্যাশিত হলেও কালো ধোঁয়া আর উচ্চ শব্দের কাছে নাগরিক জীবনকে বিপন্ন করা যাবে না।
  • উন্নয়নে এনজিওদের অংশীদারিত্ব এবং দাতাদের সহযোগিতা দরকার। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া কৌশল এবং নীতিকে যেনতেনভাবে মেনে নেয়া যাবে না।

সর্বোপরি আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দর ও উন্নত করে গড়ে তোলার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন বুঞ্চিত না হয় তার প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখতে হবে ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment