Site icon Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা রচনা

বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়াগত কার এ দেশে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়ে থাকে। এর মধ্য বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, নদীভাঙন, খরা, মহামারী, টর্নেডো, ভূমিকম্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ সকল দুর্যোগের ফলে ক্ষয়ক্ষতি থেকে উত্তরণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস এবং দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন বহু ব্যবস্থাপনা ও কৌশল গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

 

 

বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা

দুর্যোগ কি

দুর্যোগ হচ্ছে এমন প্রতিকূল অবস্থা যা সমাজের স্বাভাবিক কাজকর্মে প্রচণ্ডভাবে বিঘ্ন ঘটায় বজীবন, সম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ক্ষতিগ্রস্ত সমাজের পক্ষে নিজস্ব সম্পদের দ্বারা এই মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এ আকস্মিক ও চরম বিপর্যয় জীবন ও সম্পদের ওপর প্রতিকূলভাবে আবার করে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এই আকস্মিক বিপর্যয়ই দুর্যোগের সৃষ্টি করে থাকে।

দুর্যোগের প্রকারভেদ

UNITAR (United Nations Institute for Training and Researchi দুর্যোগসমূহকে চারভাগে ভাগ করেছে । যথা

১. প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, নদীভাঙন, ভূমিকম্প ইত্যাদি ।

২. দীর্ঘস্থায়ী দুর্যোগ মহামারী, খরা ইত্যাদি।

৩. মানবসৃষ্ট দুর্যোগ যুদ্ধ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনাঞ্চল ধ্বংস, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি।

৪. দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ ।

বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলই কমবেশি দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানই তাকে নান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি করেছে । নদীমাতৃক ও প্রায় সমতল দেশটির উত্তরে বিশাল হিমালয় পবর্তমাল, দক্ষিণে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর । দক্ষিণাঞ্চলে পাহাড়-পর্বত বা এমন কোনো প্রাকৃতিক বাধা নেই, যা ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।

এ দেশে প্রধান নদীসমূহের উৎস হিমালা পর্বতমালা। আর এ সকল নদীর নিম্ন অববাহিকায় এ দেশের অবস্থান। এছাড়া অতিবর্ষণ ও গ্রিন হাটা প্রতিক্রিয়ার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলে হিমালয়ে পুঞ্জীভূত বরফগলা পানি নিচে নামা শুরু করে, যা এ দেশের বন্যার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে অবস্থিত করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২৭’C-এ থাকাসহ অন্যান্য কারণে সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের কিছু অঞ্চল বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এমন একটি টেকটোনিক প্লেটে অবস্থিত, যা ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল বলে বিবেচিত। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্র অঞ্চলে সংঘটিত কয়েকটি আকস্মিক ভূমিকম্প এ আশঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

এসব প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও মানবসৃষ্ট কিছু বিষয় দুর্যোগ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও রাস্তা নির্মাণ, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বনাঞ্চল ধ্বংস, পরিবেশ দূষণ প্রভৃতি দুর্যোগের ব্যাপকতা ও ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি করে থাকে ।

 

 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে দুর্যোগ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তসমূহের সমষ্টি এবং এগুলোর প্রায়োগিক কাজ, যা প্রশাসনিক সকল স্তরের দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগপরবর্তী পর্যায়সমূহের কার্যক্রমকে বোঝায়।

অন্যভাবে বলা যায়, Disaster management is an applied science which seeks by the systematic observation and analysis of disasters, to improve measurers relating to prevention, mitigation, preparedness, emergency response and recovery অর্থাৎ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এরূপ একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান, যার আওতায় পড়ে যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুর্যোগ প্রতিরোধ, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং দুর্যোগে জরুরি সাড়া দান ও পুনরুদ্ধার ইত্যাদি কার্যক্রম।

দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও দুর্যোগজনিত সকল প্রকার ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উদ্দেশ্যে কাজ করাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য । সম্ভাব্য দুর্যোগ সংঘটন কমানো ও এর ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, আসন্ন দুর্যোগের বিষয়ে সতর্ক সংকেত প্রচারের ব্যবস্থাদি প্রস্তুত রাখা, দুর্যোগপ্রবণ এলাকার অবস্থাদি সর্বদা পরিবীক্ষণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পর্যালোচনা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান উদ্দেশ্য তিনটি। সেগুলো হলো

১. দুর্যোগের সময় জীবন, সম্পদ ও পরিবেশের যে ক্ষতি হয়ে থাকে তা এড়ানোর বা ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করা।

২. প্রয়োজন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের মধ্যে অল্প সময়ে সকল প্রকার ত্রাণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। এবং

৩. দুর্যোগ পরবর্তী পুনরুদ্ধার কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পর্যায়

অতীতে দুর্যোগ সংঘটনের পরপরই ব্যাপক ত্রাণকার্য পরিচালনকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে মনে করা হতো। বস্তুত ত্রাণকার্য সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার একটি উপাদান মাত্র। দুর্যোগপূর্ব কার্যকলাপ যেমন দুর্যোগ প্রতিরোধ, দুর্যোগ প্রশমন ও পূর্বপ্রস্তুতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মুখ্য উপাদান। এর যে কোনো একটি অসম্পন্ন থাকলে গোটা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় দেখা দেয়। তাই দুর্যোগপূর্ণ সময়েই এর ব্যবস্থাপনার বেশি কাজ সম্পন্ন করতে হয়।

দুর্যোগ সংঘটনের পরপরই রয়েছে সাড়াদান, পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন। অতীতে সাড়াদানকেই সম্পূর্ণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে ধরা হতো। সাড়াদান বলতে নিরাপদ স্থানে অপসারণ, তল্লাশি ও উদ্ধার, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমকে বোঝায়।

দুর্যোগে সম্পদ, পরিবেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো ইত্যাদির যে ক্ষতি হয়ে থাকে তা পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে দুর্যোগপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনাকেই পুনরুদ্ধার বোঝায়। সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তিনটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। যথা— ক দুর্যোগপূর্ব পর্যায়, খ. দুর্যোগকালীন পর্যায় ও গ. দুর্যোগপরবর্তী পর্যায় ।

ক. দুর্যোগপূর্ব পর্যায়

যে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুরুর আগে সম্ভাবা সতর্ক ব্যবস্থা অবলম্বন করাই হলো দুর্যোগ পূর্বকালীন ব্যবস্থা। দুর্যোগের প্রকারভেদ অনুসারে প্রস্তুতি কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। যেমন—–

১. দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জনগণ ও প্রশাসনকে সজাগকরণ এবং বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা/কর্মচারী ও জনগণের করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা ।

২. দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য স্থানীয়, বিভাগীয় ও জাতীয়ভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন।

৩. সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণদান।

৪. দুর্যোগকালে উচ্চার, অপসারণ ও ত্রাণ কাজ পরিচালনার জন্য ত্রাণসামগ্রী মজুদকরণ এবং তা তড়িৎ গতিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ ।

৫. আশ্রয়কেন্দ্র সংরক্ষণ।

৬. বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে দুর্যোগ সম্পর্কিত করণীয় বিষয়ে অবহিত করা এবং পূর্বাভাস প্রদান করা।

এছাড়া ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে পূর্বেই বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সনাকের বিপদ সংকেত ও মহাবিপদ সংকেত এবং আবহাওয়া সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি পরিবেশন করা হয়।

 

 

খ. দুর্যোগকালীন পর্যায়

দুর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করার জন্য অপসারণ, তল্লাশি ও উদ্ধার, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ কর হয় । প্রাথমিক চিকিৎসাসহ স্বাস্থা কর্মসূচি পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ ও আশ্রয়স্থল চিহ্নিত করা হয়।

গ. দুর্যোগ-পরবর্তী ব্যবস্থা

দুর্যোগে পরিবেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো ইতাদির যে ক্ষতি হয়ে থাকে তা পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে দুর্যোগপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয় এ পর্যায়ে। এ লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যেমন—কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রণয়ন, কৃষি ঋণের চাহিদা নিরূপণ ও প্রদান, বাসস্থান, শিল্পায়ন, রাস্তাঘাট, বাঁধ নির্মাণ, শিল্প কারখানা পুনর্নির্মাণ প্রভৃতি।

এ সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে তথা জাতীয়, বিভাগ, জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি রয়েছে। এছাড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থা অংশগ্রহণ করে থাকে । জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট ৮টি কমিটি এবং ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে একটি করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের ব্যবস্থা আছে।

এসব কমিটি হলো

১. জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল (NDMC)

২. আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি।

৩. জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা কমিটি।

৪. ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি বাস্তবায়ন বোর্ড ।

৫. দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট ‘ফোকাল পয়েন্ট দের কার্যক্রম সমন্বয়কারী দল।

৬. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্স।

৭. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থাসমূহের সমন্বয় কমিটি ।

৮ দুর্যোগ সংক্রান্ত সংকেতসমূহ দ্রুত প্রচার সম্পর্কিত কমিটি।

জাতীয় পর্যায়ে ৮টি কমিটি ছাড়াও দেশের সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ে অর্থাৎ জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিসমূহ রয়েছে । যথা

১. জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি,

২. যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি,

৩ ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি ।

দুর্যোগপূর্বে, দুর্যোগকালে এ দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে সারা দেশে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটির এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার বহুমুখী বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি স্বয়ংসম্পন্ন সরকারি দপ্তরের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে দীর্ঘদিন ধরে।

১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের বন্যা এবং ১৯৯১ সালের প্রনয়ারী ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বিষয়টি আরো প্রবলভাবে অনুভূত হয়। ফলে বিভিন্ন দুর্যোগ কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন, দুর্যোগ ব্যাপারে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, দুর্যোগ বিষয়ের ওপর তথ্যসংগ্রহ, তথ্য ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রশমন, পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা ও সেবাকার্যের ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো (Disaster Management Bureau) প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে ব্যুরো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অর্পিত দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে পালন করে আসছে।

 

 

দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে দুর্যোগের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পার্থক্য রয়েছে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বা অন্যান্য দ্বীপসমূহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ ও উত্তরাঞ্চল বন্যা কবলিত ও খরাপ্রবণ অঞ্চল। দুর্যোগের প্রকার ভেদে ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন-

১. বন্যা প্রতিরোধ

১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে সর্বনাশা বন্যা সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল সর্বনাশা ও ভয়াবহ। ৬০টি জেলা জুড়ে ১২৯৭৩ বর্গ কিমি এলাকার ৪ কোটি ৬৭ লক্ষ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছিল। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও ভয়াবহতা মানুষ আবার উপলব্ধি করে ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায়। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্যে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যেমন নদী- খাল পুনঃখনন, নদীর (বিপজ্জনক) দুধারে বাঁধ নির্মাণ, নগর রক্ষা বাঁধ, সংকেত প্রদান ব্যবস্থার উন্নয়ন। এ প্রসঙ্গে সরকার FAP (Flood Action Plan) দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল ।।

২. নদীভাঙন প্রতিরোধ ও খরা মোকাবিলা

নদীভাঙন রোদে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলো নদীর তীর জুড়ে বেড়ী বাঁধ নির্মাণ করা, নদীর তীরে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ করা ও নদীশাসন বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। খরা মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলো ব্যাপক বনায়ন, বন উজার বন্ধকরণ এবং পুকুর খনন ও পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণ।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এ দুটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের জীবন ও সম্পদের প্রচুর ক্ষতি করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭০, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালের ২১ এপ্রিলের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এ ঘূর্ণিঝড়ে সরকার যেসব কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে তা হচ্ছে উপকূলীয় এলাকায় দুই হাজার আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন, হেলিপ্যাড নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি ইত্যাদি ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ মোকাবিলার কৌশল বিষয়টি এত ব্যাপক ও কঠিন কাজ, যা কারো একার পক্ষে কোনো একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। এজন্য রয়েছে বিভিন্ন কমিটি, কাউন্সিল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো (DMB), CPP SPARRSO ইত্যাদি ।

সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহায়কের ভূমিকায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (CPP) বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করছে। সংগঠনটি ঘূর্ণিঝড়ে সারা দান, যোগাযোগ রক্ষা, প্রস্তুতি এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে থাকে ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন টর্নেডো, খরা, অভিগ্রী ইত্যাদিকে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সময়মতো আবহাওয়ার তথ্যভিত্তিক পূর্বাভাস প্রদান ও সতর্কীকরণ। এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের জন্য সরকারি পেশাভিত্তিক দপ্তর হিসেবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর কাজ করে থাকে।

মহাকাশ গবেষণাকারী সরকারি সংস্থা ‘SPARRSO ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে দেশটির সরবরাহ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরকে পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণে সহায়তা করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বন্যা সংক্রান্ত পূর্বাভাস দান ও প্রচারের ব্যবস্থা করে থাকে।

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়ার কোনো কলাকৌশল অদ্যাবধি আবিষ্কার হয়নি বটে, তবে রিখটার স্কেকে ভূমিকম্পের তীব্রতা ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়। জরুরি পরিস্থিতিতে আর্তদের চিকিৎসা, উদ্ধার, বাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কাজে সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ বেসামরিক প্রশাসনকে সবরকম সাহায্য ও সহযোগিতা দান করে থাকে ।

বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন দুর্যোগ সংক্রান্ত সংকেতসমূহ প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাসমূহ যেমন—অক্সফাম, ডিজাস্টার ফোরাম, কেয়ার বাংলাদেশ, কারিতাস, প্রশিকা, সিসিডিবি, বিডিপিসি (Bangladesh Disaster Preparation Centre) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সমস্যাসমূহ

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ মোকাবিলার কৌশলগুলো সর্বদা সঠিকভাবে বা দ্রুত কার্যকর করা অসম্ভব হয়ে পড়ে বহুবিধ সমস্যার কারণে। যথা

১. ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি,

২. অপ্রতুল চিকিৎসা সাহায্য,

৩. পুনরুদ্ধার ও পুনঃনির্মাণ ব্যয়সাপেক্ষ,

৪. অবকাঠামোর ক্ষয়-ক্ষতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবার দুষ্প্রাপ্যতা,

৫ জনসচেতনার অভাব,

৬. সময়মতো সতর্কীকরণ সংকেত না দেয়া,

৭. প্রযুক্তির দুর্বলতা ও আধুনিক প্রযুক্তির অপ্রতুলতা,

৮ ত্রাণসামগ্রীর অভাব,

৯. আন্তর্জাতিক সাহায্য নিত প্রভৃতি।

উপসংহার :

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাবে না । তাই এই আকস্মিক দুর্যোগের মোকাবিলা যাতে ভালোভাবে করা যায় তার ব্যবস্থা করাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান উদ্দেশ্য। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সকল স্তরের সকল পর্যায়ের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালিত করতে পারলে দুর্যোগের হাত থেকে জীবন, সম্পদ ও পরিবেশকে বহুলাংশে রক্ষা করা সম্ভব হবে।

দুর্যোগের মানবসৃষ্ট কারণগুলো যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে বেশ সফলতা লাভ করেছে। এসব সম্ভব হয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা দন্তর, সরকারি-বেসর প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং ক্রমবর্ধমান সচেতন জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version