Site icon Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন : সমস্যা ও প্রতিকার | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন : নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায় নারীর মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিতকরণ। সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের সকল স্তরে তথা পরিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নারীর অংশগ্রহণ ও অধিকার নিশ্চিতকরণ।

 

 

Table of Contents

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন : সমস্যা ও প্রতিকার

 

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে রয়েছে বহুবিধ সীমাবদ্ধতা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে প্রয়োজন নারী ক্ষমতায়নের সীমাবদ্ধতাসমূহের অবসান, সার্বিক নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।

বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশ

নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের পথ প্রতিনিয়ত প্রশস্ত হচ্ছে। উন্নয়ন কর্মক মানবসম্পদের পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে নারীর সত্যিকার উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে। ে বিচারে নারীদের উন্নয়ন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বিশ্বের সব দেশেই সত্তরের দশকে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টি জাতিসংঘের নীতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। তাই ১৯৭৫ সালকে জাতিসংঘে ‘বিশ্ব নারী বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে।

এছাড়া ১৯৭৫-৮৫ এই দশক নী দশক’ হিসেবে পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ প্রক্রিয়া। এ দশক পালনের উদ্দেশ্য ছিল নারী উন্নয়ন পরিবার ও সমাজে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, কর্মক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাপী নারীদে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো।

জাতিসংঘের সহায়তায় ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলন থেকে শুরু করে কোপেনহেগেন, নাইরোবি ও ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ পর পর চারটি বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নারীরা এম সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে নিজ নিজ দেশের সমস্যা ও দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেন।

সর্বশে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পন গৃহীত হয়, যা ‘বেইজিং প্লাটফরম ফর অ্যাকশন’ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সংরক্ষণ ছাড়াই অনুস্বাক্ষর করে। ১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত জনসংখ্যা উন্নয়ন। কর্মপরিকল্পনা এবং ১৯৯৫ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সামাজিক শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত কর্মপরিকল্পনায় নারী ও শিশু উন্নয়ন এবং তাদের অধিকারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়।

 

 

এছাড়া কমনওয়েলথ ১৯৯৫ সালে জেন্ডার ও উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। সার্ক দেশসমূহও নারী উন্নয়নের জন্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, পরিবার ও সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো) গৃহীত হয় ।

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ তিনটি ধারায়।২, ১৩ (ক), ১৬১ (গ) ও (১৬) (১) ৪( সংরক্ষণসহ এ সনদ অনুস্বাক্ষর করে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ দুটি অনুচ্ছেদ নং ১৩ (ক) ও ১৬ (১) ম এর ওপর তার সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে। এসব সনদ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। বর্তমানে সি প্রধান কর্মকর্তা বাংলাদেশেরই নারী সালমা খান। জাতিসংঘের উদ্যোগে এ সকল বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হলো সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি। সিডো/বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের প্রাথমিক দায়িত্ব মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের।

বেইজিং প্লাটফরম ফর অ্যাকশনে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে যেসব ক্ষেত্র বিশেষভাবে চিহ্নিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নারীর ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অসম সুযোগ, স্বাস্থ্য সেবায় অসম সুযোগ, নারী নির্যাতন, সশস্ত্র সংঘর্ষের শিকার, অর্থনৈতিক সম্পদে নারীর সীমিত অধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ক্ষমতায় অংশগ্রহণে অসমতা, নারী উন্নয়নে অপর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক প্রতিফলন ও অগ্রভুল অংশগ্রহণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদে নারীর সীমিত অধিকার এবং মেয়ে শিশুর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি।

এছাড়া ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে গৃহীত পরিবেশ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা, ১৯৯৩ সালে ভিয়েনা মানবাধিকার ঘোষণা, ১৯৯৪ সালে কায়রোতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত জনসংখ্যা ও উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা এবং ১৯৯৫ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সামাজিক শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত কর্মপরিকল্পনায় নারী ও শিশু উন্নয়ন এবং তাদের অধিকারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ সকল সনদ ও কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর এবং এগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করেছে ।

 

 

বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের প্রধান সীমাবদ্ধতাসমূহ

সম্প্রতি জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সার্বিক অর্থে বিশ্বব্যাপী পুরুষদের সমান দক্ষতা অর্জন করতে হলে নারীদের ২৪৯০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশেও নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে রয়েছে বহুবিধ সীমাবদ্ধতা। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো

১. সামাজিক অবস্থা

বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও এখানে নারীর অবস্থা নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জক এবং নারী নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নারী হত্যা, নারী ও মেয়েশিশু অপহরণ ও পাচার, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি এসিড নিক্ষেপ ও অন্যান্য নারী নির্যাতনমূলক অপরাধ অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে ১০১ দোররা মারা, গর্ত করে ঢুকিয়ে পাথর মারা, পুড়িয়ে মারার ঘটনাও এ দেশে ঘটেছে। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে একটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো পুলিশি নির্যাতন। নিকট অতীতেও পুলিশের হাতে বেশ কিছু নারী নির্যাতিত হয়েছে।

এমনকি পুলিশ দ্বারা ধর্ষিত ও নিহত হয়েছে। নারী নির্যাতন মামলাগুলো তদন্তের জন্য যথেষ্ট ফরেনসিক সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। এখনো প্রয়োজনীয় নারী পুলিশ কনস্টেবল, হাবিলদার, এএসআই, এসআই গুলি এবং উচ্চতর পদসোপানে নারী পুলিশ কর্মকর্তা নেই। ফলে নারী বিষয়ের তদন্ত এবং অন্যান্য কাজ পরিচালনায় বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে মামলা দায়ের হয় না এবং বিভিন্ন কারণে বিচারও বিলম্বিত হয়।

২. দারিদ্র্য

প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা Easter Boserup (1970) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Women’s Role in Economic Development’ গ্রন্থে নারীর অন্যতম শত্রু হিসেবে দারিদ্র্যকে নির্দেশ করেন। বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী শতকরা ৪৬ ভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুই- তৃতীয়াংশ নারী। চাকুরি ও স্ব-কর্মসংস্থান উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় নারী অনেক পিছিয়ে আছে।

১৯৯০-৯১ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তি ৫১.২ মিলিয়ন। এর মধ্যে পুরুষ ৩১.১ ও নারী ২০.১ মিলিয়ন। অন্যদিকে, এখনো পর্যন্ত নারীর অনেক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হয়নি। সংসারের পরিসরে নারীর শ্রম বিনিয়োগের কোনো মাপকাঠি এখনো উদ্ভাবন করা যায়নি এবং কৃষি অর্থনীতিতে নারীর অবদানের সঠিক মূল্যায়ন নিরূপিত হয়নি বলেই নারী শ্রমশক্তি হিসেবে এখনো চিহ্নিত হয়নি ।

৩. শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা

জাতিসংঘ চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনার বলা হয়, ‘শিক্ষা একটি মানবিক অধিকার এবং সমতা উন্নয়ন ও শান্তির জন্য অপরিহার্য হাতিয়ার। বৈষম্যহীন শিক্ষা ছেলেমেয়ে উভয়ের উপকার করে। এভাবে শেষ পর্যন্ত নারী-পুরুষের মধ্যে আরে বেশি সমতাভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। অধিক সংখ্যক নারীকে যদি পরিবর্তনের বাহক হয় উঠতে হয় তাহলে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা থাকা প্রয়োজন।

পরিবারের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার জন্য নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীশিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।’ বাংলাদেশে শিক্ষার সর্বস্তরে পুরুষের তুলনায় নারী অনেক পিছিয়ে আছে৷ ১৯৯৬ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার ছিল ৮৩.৬ শতাংশ। এ মধ্যে বালক ও বালিকা ছিল যথাক্রমে ৮৮.৯ ভাগ ও ৭৮ ভাগ। এর মধ্যে মেয়ে শিশু ভর্তি ও ঝরে পড়র হার ছিল ৮৮.৩ ও ১৫.৩।

দেশে এবং বিদেশে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও পেশাগত শিক্ষা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী সমান সুযোগের অভাবে পুরুষের তুলনায় সংখ্যা ও গুণগত দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। টাস্কফোর্স রিপোর্ট ‘৯১-তে বলা হয়, “শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের দেশে যে পরিমাণ অর্থব্যয় হয় তার বিভাজনে মহিলাদের প্রতি বৈষম্য স্পষ্ট। সুষম উন্নয়নের জন্য এই অসমতা দূর করা উচিত। মূলত নারীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসরতাই তাদের ক্ষমতায়নের মূল অন্তরায়।

৪. সচেতনতার অভাব

একজন আদর্শ নারীর ওপর একটি দেশ ও জাতি নির্ভর করে। কেননা ‘আদর্শ মা মানেই আদর্শ সন্তান’ এবং ‘আদর্শ সন্তান মানেই আদর্শ জাতি।’ বিশ্ববিজয়ী বীর নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘Give me a good mother, I will give you a good nation. সুতরাং নারীরা অবলা নয়, তারা মহাশক্তিধর। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী এখন পর্যন্ত এ সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পারেনি। ফলে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হচ্ছে না।

 

 

৫. ধর্মীয় গোঁড়ামি

ইসলাম ধর্মে মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’ বলে নারীর মর্যাদাকে সৰ্বোচ্চ গৌরবে ভূষিত করেছে। হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে, ‘নারীরা শক্তির মূল আধার’, ‘নারীই আদ্যাশক্তি মহামায়া । কিন্তু বাংলাদেশের এক শ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক হীনস্বার্থে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীদের জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছে। তাদের ফতোয়ার বলি হয়েছে বাংলার হাজার হাজার নারী। সাম্প্রতিক কালে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সকল ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

৬. সুশিক্ষার অভাব

ভারতবর্ষীয় নারীদের প্রতি লক্ষ্য করে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আমাে দেশের মেয়েরা শিক্ষিত হোক, সেটা আমি চাই, কিন্তু আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নয়।’ কথাগুলো বাংলাদেশের নারীদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। কেননা বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক নারী তথাকথিত আধুনিক শিক্ষার নামে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকগুলো অনুকরণ করে হাজার বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ বাঙালি সংস্কৃতি ও নারীশিক্ষার অবমাননা করছে। এর প্রভাবে রক্ষণশীল মধ্যবিত পরিবারসমূহ নারীদের উচ্চ শিক্ষায় উৎসাহী হচ্ছে না। ফলে নারী ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।

৭. সুযোগের অভাব :

মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গমাইল বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-দশমাংশ বেকার। এর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও লক্ষধিক। প্রত্যাশিত সুযোগ না থাকায় উচ্চশিক্ষিত, উদামী তরুণরা যেখানে নিজের কর্মনছেলের স্থান করে নিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে মহিলারা শিক্ষা শেষে বিয়ের পিঁড়িে বসতে পারলেই শেষ রক্ষা বলে মনে করে অনেকটা বাস্তবতা ও বাধ্য হয়েই।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নারী:

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুরুষদের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণ অগ্রভুল হলেও এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশ কিছু সময় ধরে কয়েকটি দেশের সরকারপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন নারী। ইন্দিরা গান্ধী মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দু দফায় ১৭ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অবস্থান আশাব্যঞ্জক নয় । অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা রাজনীতিতে পশ্চাৎপদ। তারপরও বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে সরকারি ও বিরোধী দুদলের প্রধান নারী ।

নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে কতিপয় সুপারিশ

নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বাস্তব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব সরকারের। একটি সুসংগঠিত ও সুবিন্যস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমেই এ দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করা সম্ভব। তবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সকল পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন প্রেক্ষিত বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। এ প্রসঙ্গে সম্ভাব্য কতিপয় সুপারিশ তুলে ধরা হলো

 

 

 

১. নারী উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো

নারীর ক্ষমতা উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতীয় অবকাঠামো যেমন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, জাতীয় মহিলা সংস্থা ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। পর্যায়ক্র দেশের সকল বিভাগ, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাঠামো বিস্তৃত করতে হবে এবং নারী উন্নয়নের যাবতীয় কর্মসূচি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের জন্য এ প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

২. জাতীয় মহিলা উন্নয়ন পরিষদ

নারী উন্নয়ন নীতি নির্ধারণ, উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে ৪৪ সদস্যবিশিষ্ট যে মহিলা উন্নয়ন পরিষদ গঠন করা হয়েছে তার কার্যপরিধি নিম্নরূপ হতে পারে

ক. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন ।

খ. মহিলাদের আইনগত অধিকার, মহিলা উন্নয়ন এবং মহিলাদের নির্যাতন প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয়াবলী সম্বন্ধে নীতি প্রণয়ন ।

গ. সকল কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের স্বার্থ সংরক্ষণ, অংশগ্রহণ ও তাদের ভাগ্যোন্নয়ন সম্পর্কে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

৩. সংসদীয় কমিটি :

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক গঠিত নারী উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করতে হবে, যা নারী উন্নয়ন কর্মসূচির পর্যালোচনা করে নারী অগ্রগতির লক্ষ্যে সরকারকে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করার পরামর্শ প্রদান করবে।

৪. নারী উন্নয়ন ফোকাল পয়েন্ট

বিভিন্ন ফোকাল পয়েন্ট যথা— মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির আলোকে কর্মসূচি গ্রহণ, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে এবং এ সকল সংস্থার কার্যক্রমে যাতে জেন্ডার প্রেক্ষিত প্রতিফলিত হয় এবং তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও দলিলসমূহে জেন্ডার বিষয়ে সুস্পষ্ট ও পর্যাপ্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয় সে লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

এছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রীকে সভাপতি এবং নারী উন্নয়নে চিহ্নিত ফোকাল পয়েন্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি বেসরকারি নারী উন্নয়নমূলক সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি নারী উন্নয়ন বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি নারী উন্নয়ন সম্পর্কিত কর্মসূষ্টি পর্যালোচনা, সমন্বয় ও মূল্যায়ন করবে। কমিটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমস্যা চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শ প্রদান করবে।

৫. উপজেলা ও জেলা পর্যায়

নারীর অগ্রগতি এবং ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ের প্রশাসন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, স্থানীয় সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দপ্তর ও এনজিওদের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন ও নারী উন্নয়ন কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে

৬. তৃণমূল পর্যায়ে

তৃণমূল পর্যায়ে গ্রাম ও ইউনিয়নে নারীকে স্বাবলম্বী দল হিসেবে সংগঠিত করতে হবে। এ দলসমূহকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার আওতায় নিবন্ধীকৃত সংগঠন হিসেবে রূপ দেয়া যেতে পারে। সরকারি, বেসরকারি উৎস, ব্যাংক, অন্যান্য আর্থিক সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সম্পদ আহরণ করে এ সংগঠনগুলোর সাথে ইউনিয়ন পরিষন, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসন্ত ও সিটি কর্পোরেশনসমূহের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ও সমন্বয় সাধন করবে এবং তৃণমূল পর্যায়ের সকল সংগঠনের কার্যক্রমের স্থানীয় উন্নয়নের প্রেক্ষিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য উৎসাহিত এবং সহায়তা দান করবে।

৭. নারী উন্নয়নে এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনের সাথে সহযোগিতা

প্রকৃত নারী উন্নয়ন একটি ব্যাপক কাজ। সরকারের একার পক্ষে এ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা কার্যত অসম্ভব। তাই এ কাজে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস নেয়া যেতে পারে, যাতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে নিজস্ব কর্মসূচির অতিরিক্ত Catalyst বা সহায়কের ভূমিকা পালন করাই হবে সরকারের মূল দায়িত্ব ।

এ লক্ষ্যে নারী উন্নয়নের সকল স্তরে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্তকরণ ও তাদের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নারী সংগঠনসমূহের সাথে সহায়তা ও সমন্বয় বিধান করতে হবে।

 

 

 

৮. নারী ও জেন্ডার সমতাবিষয়ক গবেষণা

নারী উন্নয়ন ও সমতা বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা পরিচালনার জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। সকল গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন এবং নারী ও শিশুদের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে গবেষণার জন্য উৎসাহিত করতে হবে এবং পৃথক জেন্ডার গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।

৯. নারী উন্নয়ন প্রশিক্ষণ

প্রতিষ্ঠান ঢাকায় বিদ্যমান নারী উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণসহ বিভাগ, জেলা ও থানায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। এসব কেন্দ্রে বিভিন্ন কারিগরি, বৃত্তিমূলক, নারী অধিকার এবং শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

১০. সামাজিক সচেতনতা

নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা কর্মসূচির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ কর্মসূচিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ১. আইনবিধি ও দলিলাদি থেকে নারীর মর্যাদাহানিকর বক্তব্য ও মন্তব্য অপসারণ, ২. মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কার্যনির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাবৃদ্ধের সচেতনতা এবং ৩. পুরুষের সম্পর্ক, অধিকার ও নারী উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়াবলী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

১১. নারী নির্যাতন প্রতিরোধ

নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কর্মসূচির ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং এসব কর্মসূচিতে সচেতনতা, আইনগত পরামর্শ ও শিক্ষা, শান্তিমূলক ব্যবস্থা তথা মামলা পরিচালনা করা, মামলা পরিচালনার জন্যে নিরাপদ আশ্রয় ও পুনর্বাসন, আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এক্ষেত্রে একটি বিশেষ কৌশল হিসেবে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেলসহ অন্যান্য নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের কর্মপরিধিকে বিস্তৃত ও শক্তিশালী করা যেতে পারে ।

১২. আর্থিক ব্যবস্থা :

তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ ও জেলা পরিষদে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে এবং নারী উন্নয়নে নিয়োজিত মন্ত্রণালয় এবং সংস্থা যেমন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, শ্রম ও জনশক্তি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ে নারী উন্নয়নের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ও কর্মসূচি চিহ্নিত করে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।

১৩. সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা

নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বস্তরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতার যোগসূত্র গড়ে তুলতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহকে যথোপযুক্ত এবং সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান করতে হবে এবং সরকারি- বেসরকারি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে চিন্তাধারা, দক্ষতা ও তথ্যের আদান-প্রদান করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ, বৈঠক, কর্মশালা ইত্যাদির মাধ্যমে এই আদান-প্রদান চলবে। ক্ষেত্র বিশেষে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে নারী উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

১৪. বহুপাক্ষিক সহযোগিতা

নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও উপ- আঞ্চলিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করতে হবে।

চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন

বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা ১৯৯৫ ১৯৫৭ সালে নিউইয়র্কে নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। নিউইয়র্কের পথ ধরে নারী সমাজ মেক্সিকো, কোপেনহেগেন, নাইরোবি ও বেইজিং শহরে মিলিত হয়েছিল নারীর অগ্রগতির লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালের ৪-১৫ সেপ্টেম্বর চীনের রাজধানী বেইজিং-এ চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে।

নাইরোবি সম্মেলনের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে বেইজিং-এ গৃহীত প্লাটফরম ফর অ্যাকশন বিশেষ সমস্যাগুলো তুলে ধরে। এসব বিশেষ জরুরি ক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসূচি। এ উদ্দেশ্যে সরকারসমূহ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, বেসরকারি সংগঠন ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের প্রতি বেইজিং-এ গৃহীত কর্মপরিকল্পনা নিচের সমস্যার গুরুত্বের দিকগুলোর ক্ষেত্রে কৌশলগত লক্ষ্য গ্রহণের আহবান জানাচ্ছে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

নারীর সমতা অর্জনের পথে সমস্যা

নারীর ক্ষমতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এই লক্ষ্য। অর্জনের সাথে নানাবিধ বাধা রয়েছে

১. মহিলাদের ওপর অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের বোঝা;
২. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অসমজ, অপর্যাপ্ততা এবং অসম প্রবেশাধিকার;
৩. স্বাস্থ্য সেবা এবং সংশ্লিষ্ট সেবার ক্ষেত্রে অসমতা এবং অপর্যাপ্ততা;
৪. নারী নির্যাতন;
৫ বিদেশী দখলাধীনে বসবাসকারীসহ নারীর ওপর সশস্ত্র অথবা অন্যান সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া;
৬. অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং নীতি, সকল প্রকার উৎপাদনশীল কার্যাবলী এবং সম্পদের অধিকারে অসমতা;
৭. সকল পর্যায়ে ক্ষমতায় অংশগ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী-পুরুষের মধ্যে অসমতা;
৮. নারীর অগ্রগতি উৎসাহিতকরণের সকল ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত কাঠামো;
৯. নারীদের মানবাধিকারের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধার অভাব এবং অপ্রতুল প্রসার ও সংরক্ষণ;
১০. সকল প্রকার যোগাযোগ বিশেষ করে প্রচার মাধ্যমে নারীর সনাতনী প্রচার, প্রবেশ অধিকার এবং অংশগ্রহণে অসমতা;
১১. প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে নারী-পুরুষের মধ্যে অসমতা;
১২. কন্যাশিশুদের প্রতি অব্যাহত বৈষম্য এবং অধিকার লঙ্ঘন।

উপরোক্ত চিহ্নিত ১২টি সমস্যার আলোকে বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও গৃহীত হয়েছে। বেইজিং কর্মপরিকল্পনা ও বর্তমান সরকারের নারী উন্নয়নের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে মহিলা শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় নীতি ও কর্মপরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন করেছে।

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে এ দুটি মন্ত্রণালয়ের ও সংস্থার ফোকাল পয়েন্ট এনজিও, নারী সংগঠন সম্পৃক্ত ছিল। একটি বিশেষজ্ঞ দল ১২টি মন্ত্রণালয়ের চাহিদা নিরূপণ করে কর্মপরিকল্পনা খসড়া প্রণয়ন করে।

১৮ ফেব্রুয়ারি ৯৭ বিগত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মহিলা উন্নয়ন পরিষদের সভায় জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি অনুমোদিত হয়েছে। গত ৮ মার্চ ১৭ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন।

উপসংহার:

বেইজিং প্লাটফরম ফর অ্যাকশন সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নারী উন্নয়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পন প্রণয়নে পথনির্দেশনা দিয়েছে, যা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীর সার্বিক উন্নয়নে বিটি ভূমিকা রাখবে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার দায়িত্বে নারীর সম অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর মর্যাদা প্রদান অপরিহার্য।

সুশীল সমাজ গঠনে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে মানবিক মূল্যবোধের অনুশীলন করার লক্ষ্যে শুধু সরকারি প্রচেষ্টা নয়, সংস্থাসমূহের দায়দায়িত্বও কম নয়। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় নারী উন্নয়ন নীতি বেসরকারি ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হতে পারে এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭৫-১৯৮৫ সাল জাতিসংঘ ঘোষিত নারী দশকের পর নারীদের মধ্যে গণজাগরণ এসেছে।

নারীরা সরকারি ও বেসরকারিসহ সকল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে। এ কথা সত্য যে, নারী-পুরুষের ক্ষমতার সুষম বণ্টন ছাড়া দেশের তথা সমাজের সার্বিক উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । কাজেই একবিংশ শতাব্দীর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় যে নারীর ক্ষমতায়ন এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version