পরিবেশ দূষণ ও বাংলাদেশ রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে পরিবেশগত সমস্যা একটি মারাত্মক সমস্যা। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাই, নিজেদের অবহেলার কারণেই প্রতিদিন আমরা চারপাশে তৈরি করছি বিষাক্ত পরিমণ্ডল এবং নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছি এক নিঃশব্দ বিষক্রিয়ার মধ্যে। ফলে পরিবেশের মারাত্মক অবনতি ঘটছে, যা আমাদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
Table of Contents
পরিবেশ দূষণ ও বাংলাদেশ
বিষাক্ত বাতাস
দেশের জনসংখ্যা যেভাবে দিন দিন বেড়ে চলেছে, ঠিক তেমনিভাবে বাড়তি লোকের চাহিদা মেটানোর জন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে যানবাহন এবং তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কলকারখানা। এসব গাড়ি ও কলকারখানা থেকে উপাত্ত ধোঁয়া বাতাসকে করে তুলছে বিষাক্ত। বিশেষ করে বাস ট্রাকের কালো ধোঁয়া, ইটের ভাটার ধোঁয়া এবং রাস্তার ধুলোবালি পরিবেশকে দ্রুত বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ।
পলিথিন
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ব্যবহারের প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশির দশকের গোড়ার দিকে এ বিপজ্জনক দ্রব্যটি যাত্রা শুরু করে এ দেশে। বর্জ্য হিসেবে পলিথিন এই সভ্যতার এক ভয়াবহ শত্রু। বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সাবধান বাণী থাকা সত্ত্বেও পলিথিন সামগ্রীর ব্যবহার এ দেশে বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
পলিথিন এক অবিনাশী বর্জন, যেখানেই ফেলা হোক না কেন এর শেষ নেই। পোড়ালে এই পলিথিন থেকে যে ধোঁয়া বের হয় তা-ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তবে ২০০২ সালের ১ মার্চ সরকার সারা দেশে পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এতেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
প্লাস্টিক সামগ্রী
পলিথিনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে প্লাস্টিক সামগ্রীরও ব্যবহার। প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্যে বাজার এখন সয়লাব। মাটির জন্য এই প্লান্টিক মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি মাটির জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। প্লাস্টিক পোড়ানোর সময় উৎপন্ন হাইড্রোজেনসায়ানাইট গ্যাস চামড়ার জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।
বন উজাড়
যে কোনো দেশের পরিবেশে বনভূমি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বনভূমির ওপর দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। কোনো দেশে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। দেশের আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। অথচ আমাদের দেশের বনভূমির পরিমাণ ৯ শতাংশেরও কম । বনভূমি উজাড় আমাদের দেশের পরিবেশগত সমস্যার অন্যতম কারণ।
পানিতে আর্সেনিক
দেশের অনেক অঞ্চলে খাবার পানিতে আর্সেনিকের মতো মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তথ্যটি যে কোনো নাগরিকের জন্য উদ্বেগজনক বিষয়। কারণ আর্সেনিক সরাসরি পাকস্থলীতে গেলে সাথে সাথে মৃত্যু ঘটতে পারে।
দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রাপ্ত আর্সেনিকের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ ১.০১ এমজি যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেয়া মাত্রা ০.০৫ চেয়ে ২০ গুণ বেশি। কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য মাটিতে ব্যাপকভাবে মিশে এবং আবাদি জমিতে পারে। পরিমাণে বিষাক্ত সার ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানি এভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। কলে পরিবেশগত বিপর্যয় দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
শব্দদূষণ
শব্দদূষণ বর্তমান সময়ে এক মারাত্মক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা এখন বাস করছি হাইড্রোলিক হর্ন নামে এক ভয়ঙ্কর শত্রুর সঙ্গে, যার উৎকট আওয়াজ প্রতিদিন একটু একটু করে চাপ বাড়াবে আমাদের কানের পর্দার ওপর এবং ক্ষয় করে দিচ্ছে আমাদের শ্রবণ ক্ষমতাকে। এছাড়া আমাদের শুবণযন্ত্রের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য রয়েছে মাইকের আওয়াজ ও কলকারখানার শব্দ। এর ফলে আরো ভয়াবহ শারীরিক মানসিক ব্যাধিরও সৃষ্টি হচ্ছে। এ শব্দদূষণ আমাদের পরিবেশগত বিপর্যয়কে আরো ঘনীভূত করছে।
পানিদূষণ
দেশে পানিদূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠেছে। ক্ষতিকর শিল্পবর্জ্যের কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা, রূপসা প্রভৃতি নদীর পানি ইতোমধ্যেই মারাত্মকভাবে দৃখিত হয়ে পড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এসব নদীর পানি সব ধরনের ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রগুলো নদনদীর পানিদূষণের প্রধান কারণ। হিসেবে শিল্পবর্জ্যের কথা বলেছেন। অন্যদিকে ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দেশের মোট ৭ হাজার ১৮৫টি শিল্পকারখানা জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি কারখানাই পানি ও বায়ুদূষণের জন কমবেশি দায়ী । এর মধ্যে ১১৭৬টি কারখানাকে তীব্র দূষণকারী শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলোর মধ্যে ঢাকায় ৪৫০টি, চট্টগ্রামে ৩৭০টি, খুলনায় ২৯০টি এবং রাজশাহীতে ৬৫টির অবস্থান। এ কারখানাগুলো থেকে তীব্র দূষণকারী শিল্পবর্জ্যের কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, রূপসা প্রভৃতি নদীর পানি ইতোমধ্যে মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে।
রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার
ভালো ও উন্নত জাতের ফসল ফলানোর জন্য এবং বীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য কৃষকরা অপরিকল্পিতভাবে এবং ব্যাপকহারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছে। এগুলো অতিমাত্রায় ব্যবহারের দরুন জীবজগৎ, প্রাণিজগৎ এবং পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
রাসায়নিক দ্রব্য
আমাদের পরিবেশ দূষণকারী অপদ্রব্যগুলোর মধ্যে সিসা, পারদ, সালফার ডাই অক্সাইড, কান্ডন মনোক্সাইড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশ দূষিত করছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি
জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কেননা অপরিকল্পিতভাবে পেলে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশ দূষিত হয়। ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপ একটি লোকালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশকে কতখানি বিনষ্ট করতে পারে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাজধানী ঢাকা।
পরিবেশ সমস্যার সমাধান
পরিবেশ সমস্যা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। তাই এই সমস্যার সমাধান আর প্রয়োজন। নিচে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশ সমস্যার সমাধান আলোচনা করা হলো
বনায়ন :
পরিবেশ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বনায়ন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই পরিবেশ দূষণের মরণ ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বনায়ন করা দেশের সচেতন প্রত্যেকটি নাগরি কর্তব্য। বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ বর্ণনা করে বলেন, ‘সরকার দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমানা বেষ্টনীতে ইটের দেয়ালের পরিবর্তে সবুজ শুগ্ন বেষ্টনী গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছে।
শব্দদূষণ রোধ
হাইড্রোলিক হর্ন এবং যত্রতত্র মাইক বাজানোর বিরুদ্ধে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শব্দদূষণের কবল থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহারের ক্ষেত্রে এরশাদ সরকারের আমলে আইন প্রণয়ন করা হলেও বর্তমানে তা কাগুজে বাঘ হয়ে আছে। সুতরাং বর্তমান সরকারের উচিত জাতীয় স্বার্থে শব্দদূষণ রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
পলিথিন বর্জন
পলিখিন পরিহার করা পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে দেশের প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। নব্বই সালের গোড়ার দিকে দেশে পলিথিন উৎপাদন বন্ধের ব্যাপারে তৎকালীন সরকার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু পরে রাজনৈতিক জটিলতা এবং ভোট নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সিদ্ধান্তটির মৃত্যু ঘটে। সম্প্রতি পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হলেও এর ব্যবহার কমবেশি এখনো চলছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে আরো কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।
পানিদূষণ রোধ
পরিবেশ সমস্যার সমাধান তথা জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পানিদূষণ সমস্যার সমাধান অতীব জরুরি। পানিদূষণ রোধ করে পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনে নদীর আশেপাশে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানাগুলো অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে।
প্রাকৃতিক সার ব্যবহার
রাসায়নিক সারের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে আমাদের পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়ছে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক সারের ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। প্রাকৃতিক সারের ব্যবহার জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং তা পরিবেশের জন্য মোটেও হুমকি নয়। বর্তমান পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদরা প্রাকৃতিক সার ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন ।
পরিবেশ আইনের প্রয়োগ
প্রত্যেক দেশের মতো আমাদের দেশেও পরিবেশ রক্ষার জন্য বেশ কিছু আইন রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর যদি পরিবেশ আইন যথাযথ বাস্তবায়ন করে এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সম্পর্কে অধিক প্রচারণা চালায় ও জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে তাহলে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে আমরা অনেকটা নিরাপদ থাকতে পারব বলে বিশ্বাস।
সচেতনতা বৃদ্ধি
পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সামগ্রিকভাবে একটি দেশের জাতীয় সমস্যা। কাজেই এই সমস্যা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ আইন যথেষ্ট নয়, এজন্য দরকার দেশের সমগ্র জনগণের চেতনাবোধ। দেশের জনগণ যদি পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হন, তাহলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কবল থেকে আমরা অতি সহজেই নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করতে পারব।
পরিশেষে বলা যায়, পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো নিঃশব্দ শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তাই বর্তমান সরকারের উচিত রাজনৈতিক দক্ষতা, সকলের ম্যান্ডেট আর সমন্বিত প্রশাসনিক পদক্ষেপকে কাজে লাগিয়ে বিপন্ন পরিবেশের মরণ ছোবল থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা। এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর স্বদেশভূমি নিশ্চিত করা ।
আরও দেখুনঃ