পাবনা ও উত্তরাঞ্চলে প্রতিরোধ যুদ্ধ – মো. হাবিবুল্লাহ্

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের মতো পাবনা ও উত্তরাঞ্চলের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল। এই অঞ্চলের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুধু সামরিক শক্তির লড়াই ছিল না, বরং এক নির্ভীক মনোভাব, অটুট সাহস এবং অপরিসীম দেশপ্রেমের প্রতিফলন। মুক্তিযুদ্ধের সেই ঐতিহাসিক সময়ে মো. হাবিবুল্লাহ্-এর লেখনী ও স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে পাবনা ও উত্তরাঞ্চলে সংগঠিত প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র — কিভাবে সাধারণ কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, গড়ে তুলেছিল সংগঠিত প্রতিরোধ।

এই অঞ্চলের প্রতিরোধ যুদ্ধের কাহিনি একদিকে যেমন আমাদের জাতিসত্তার সংগ্রামের অনন্য অধ্যায়, তেমনি অন্যদিকে এটি প্রমাণ করে দেয় — সাহস, একতা ও প্রজ্ঞা থাকলে সামরিকভাবে শক্তিশালী শত্রুকেও প্রতিরোধ করা সম্ভব। মো. হাবিবুল্লাহ্ তাঁর লেখায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কিভাবে স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস, মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলী নেতৃত্ব এবং সময়োপযোগী প্রতিরোধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।

এই প্রবন্ধে আমরা মো. হাবিবুল্লাহ্-এর গবেষণা ও অভিজ্ঞতার আলোকে পাবনা ও উত্তরাঞ্চলের প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, সংগঠন, প্রধান যুদ্ধসমূহ এবং এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাবনা ও উত্তরাঞ্চলে যেসব প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছিল সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন  – মো. হাবিবুল্লাহ্। পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধ, পাবনা জেলার মুক্তিযোদ্ধা।

পাবনা ও উত্তরাঞ্চলে প্রতিরোধ যুদ্ধ

১. পাবনায় প্রতিরোধ যুদ্ধ :

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহরের ন্যায় মুক্তিকামী বাঙালিকে দমন করার লক্ষ্যে ২৫ মার্চ (১৯৭১) দিবাগত রাতে রাজশাহী থেকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি পদাতিক বাহিনী পাবনায় এসে শহরের মাইল চারেক দূরে বর্তমানের বিসিক শিল্পনগরীতে (তৎকালীন ‘ইসপিক’) প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে। এই সৈন্যদের কিছু অংশ শহরের ট্রেজারি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ-এর (বর্তমান টেলিগ্রাম অফিস) মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস দখল করে।

পাবনায় প্রতিরোধ যুদ্ধ ১
পাবনায় প্রতিরোধ যুদ্ধ ১

 

এছাড়াও তারা মোসলেম প্রামাণিকের তে মাথা, পাবনা আলীয়া মাদ্রাসা, সার্কিট হাউস, ওয়াপদার বিদ্যুতের কন্ট্রোলরুম এবং নূরপুর ডাকবাংলোতে ঘাঁটি স্থাপন করে। রাজশাহী থেকে আগত এই কোম্পানির কমান্ডিং অফিসার ছিল ক্যাপ্টেন আসগার এবং ডেপুটি কমান্ডিং অফিসার ছিল লেফটেন্যান্ট রশিদ। এদের সঙ্গে ছিল তিনজন (জেসিও) সুবেদার ও নায়েক সুবেদার র‍্যাঙ্কের সেনাসদস্যসহ মোট ১৩০ জন সৈন্য।

পাবনাতে আর্মি ক্যান্টনমেন্ট এবং ইপিআর ক্যাম্প না থাকাতে এখানে বাঙালি কোনো আর্মি বা ইপিআর সদস্য ছিল না। তাই পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী পাবনায় এসে প্রথমেই আক্রমণ চালায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর। পাকিস্তানি বাহিনী সমগ্র শহরে কারফিউ জারি করে শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের চেষ্টা করে। এই পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান ও পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গাফ্ফার পাবনার আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত ‘জেলা সংগ্রাম কমিটি’র সাথে পরামর্শ করে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এদিকে ২৪ মার্চ দিবাগত রাতে পাবনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুটি ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এবং ছাত্রলীগের মধ্যকার এক সংঘর্ষে রাধানগর ও পৈলানপুরে উভয় সংগঠনের নেতার বাড়িতে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ হয়। এই সংঘর্ষে কৃষ্ণপুরের ভোলা প্রামাণিকের ছেলে আবদুস শুকুর (আওয়ামী লীগ সমর্থক বাস শ্রমিক) গুলিবিদ্ধ হয়ে ঐদিন রাতেই হাসপাতালে মারা যায়। বকুলসহ অন্যান্যরা শুকুরকে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

এ ঘটনায় সমগ্র পাবনা শহরে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ২৫ মার্চ সকালে টেলিফোন ভবনের পেছনে ইছামতি নদীর পাড়ে সিদ্দিকের বাড়ির সামনে বকুলের নেতৃত্বে এক সভা আহবান করা হয়। এ সভা চলাকালেই পাবনা পুলিশের ডিএসপি এক পুলিশ সদস্য মারফত তাঁদের কাছে খবর পাঠান সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনারা নেমে যেতে পারে এবং যে কোনো সময় পাবনাতেও পাকিস্তানি বাহিনী চলে আসতে পারে।

এই খবর পেয়ে সমবেত সকলে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। শুরু হলো অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান এবং সারাদিনে বিভিন্ন ব্যাক্তির নিকট থেকে নানাভাবে প্রায় ১৯-২০টি টুটু-বোর রাইফেল, বন্দুক এবং বেশকিছু গুলি সংগ্রহ করা হলো।

২৫ মার্চ ঢাকায় আমি ক্র্যাকডাউন তথা গণহত্যার খবর পরদিন ২৬ মার্চ সকালেও পাবনাবাসী অধিকাংশ সাধারণ মানুষ জানতে পারেনি। সকাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী আর্মিভ্যান এবং জিপ নিয়ে সারা শহর টহল দিতে থাকে। পাবনা বাজারের পাহারাদারদের তৎকালীন সর্দার উজির খান পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতার জন্য তাদের একটি জিপে উঠে শহরের পথঘাট এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর চিনিয়ে দেয়।

বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে জিপ থামিয়ে তারা বারবার বলতে থাকে, ‘কারফিউ হো গিয়া হ্যায়, সব শালে ভাগ যাও’; ‘কারফিউ, হোগয়া, কই আদমী বাহার মাত আনা, আনেছে হালাক হো যায়েগা। শহরের মানুষজন বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে ওঠার আগেই তারা সাধারণ মানুষের উপর বর্বরোচিতভাবে গুলি চালাতে থাকে।

পাবনায় প্রতিরোধ যুদ্ধ ২
পাবনায় প্রতিরোধ যুদ্ধ ২

 

পাকিস্তানি সেনারা রাস্তায় ফকির, রিকশাওয়ালা, পথচারীসহ যাদেরকে সামনে পায় তাদেরকেই গুলি করে হত্যা করে। এমনকি ভোরে পেশাগত নিজস্ব কাজে হরিজনরা বাড়ি থেকে বের হওয়ায় পাকিস্তানি সেনারা তাদেরকেও গুলি করে হত্যা করে। ভিন্ন ভিন্ন এলাকার এ সকল খবর স্বেচ্ছাসেবক বাহনীর সদস্যদের কাছে পৌঁছে যায়।

এক সময় পাকিস্তানি সেনারা মধ্য শহরের গোপালপুরে প্রবেশ করে। লোকদের প্রচণ্ডভাবে প্রহার করে চলে যাবার পর পাড়ায় থাকা নিরাপদ নয় ভেবে ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা ইছামতি নদী পার হয়ে ‘সাহারা ক্লাব’-এ চলে যায়। এর পর শহরের উপকণ্ঠে পদ্মার চর এলাকায় অবস্থিত নবাব আলী মোল্লার (লবা মোল্লা) বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে।

২৭ মার্চ সকালের মধ্যেই বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অনেক সদস্য সেখানে গিয়ে হাজির হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, যে যেখানে আছে তার সুবিধামতো স্থানে বড় বড় গাছের গুঁড়ি ও অন্যান্য ভারী ধরনের যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই রাস্তা বন্ধ করে রাখবে।

আর যারা পদ্মার চরে আছে তারা সন্ধ্যার পর শহরে প্রবেশ করে ঐসব বেরিকেডের আশেপাশে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বসে থাকবে। পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি যখন ঐসব বেরিকেডের সামনে এসে থামবে এবং রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য গাড়ি থেকে নামবে তখনই প্রতিরোধ যোদ্ধাগণ তাদের টুটু-বোর, রাইফেল, পাইপগান, হাতবোমা, এসিডবাল্ব ইত্যাদি দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে প্রতিরোধ করবে।

পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক আমজাদ হোসেন
পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আমজাদ হোসেন

 

যতদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তারা কোনো নির্দেশ না পাবে ততদিন পর্যন্ত একইভাবে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করে যাবে। সভাশেষে সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীপ্রধান বকুল যার যার এলাকায় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের চলে যেতে বলেন।

এদিকে খবর আসে জেলা প্রশাসক বকুলের সাথে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছেন এবং তিনি নিজেও হেমায়েতপুরে মানসিক হাসপাতালের পাশে পদ্মার চরে মাঝি পাড়ার এক বাড়িতে আত্মগোপন করে আছেন। খবর পেয়ে বকুল কর্মীদের ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর কর্মসূচির কথা জেলা প্রশাসককে অবহিত করেন। এসময় জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ছিলেন জননেতা আবদুর রব বগা মিয়া।

জেলা প্রশাসক বকুল এবং উপস্থিত অন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের দেখে আশ্বস্ত হলেন। বললেন, পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে দেখা করতে বলেছিল কিন্তু দেখা না করায় পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে এবং তিনি কোনোরকমে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে এসেছেন।

জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ পুলিশ বাহিনীকে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সংগ্রাম কমিটির নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেন। সামরিকবাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাঁরা মুক্তিকামী জনতা ও পুলিশ বাহিনীকে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।

পাবনার ঐতিহাসিক শানির দিয়াড়ে মুক্তিযুদ্ধ Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

এদিকে পুলিশের আরআই (আবুল খায়ের) জেলা প্রশাসকের কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত চেয়েছেন পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীকে আর ব্যারাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। এজন্যই জেলা প্রশাসক ননা, বর্তমান স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সঙ্গে সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ব্যস্ত ছিলেন।

জেলা প্রশাসক, আবদুর রব বগা মিয়া, রফিকুল ইসলাম বকুল এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যারা সেসময় উপস্থিত ছিলেন একে অপরের হাতে হাত রেখে মহান আল্লাহকে সাক্ষী রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার শপথ গ্রহণ করে এবং কোনো অবস্থাতেই যেন একে অপরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে সেজন্য সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

অন্যদিকে কারফিউ বলবৎ থাকায় নিহত শুকুরের লাশের সৎকার সারাদিন সম্ভব হয়নি। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় কৃষ্ণপুরের খবির উদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে নিহতের জানাজায় ৫০ গজ উত্তর থেকে ৮/১০ জনের পাকিস্তানি সেনার একটি দল সমবেত জনগণের ওপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলেই মারা যায় একই গ্রামের আবদুস সামাদ।

মারাত্মক আহত হন শেখ বদিউজ্জামান, মওলানা ইব্রাহিম খলিল, ছামেদসহ কয়েকজন। অন্যদিকে ২৭ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সেনারা পাবনার পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দুই দলের মধ্যে সারারাত অনবরত গুলি বিনিময় চলে। এ অবস্থার মধ্যেই পাড়ার দামাল ছেলেরা রাত আড়াইটার দিকে গুলি উপেক্ষা করে শুকুরের মৃতদেহকে বাড়ির উপরেই সৎকার করে।

এদিকে ২৬ মার্চ রাত থেকেই বর্বর পাকিস্তানি সেনারা পাবনা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করতে থাকে। যাদের মধ্যে ছিলেন পাবনা সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আহমেদ এমএনএ, ভাসানীপন্থি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার, পৌরসভার কর্মচারী আবদুল খালেক তালুকদার, আলহাজ কফিল উদ্দিন আহম্মেদ, রাজেম নামে এক পাগল প্রমুখ।

বিসিক এলাকায় আটক করে রেখে তাদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার চালানো হয় এবং পরে পাকিস্তানি পশুদের গুলিতে শহিদ হন অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আহমেদ এমএনএ, ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী, আবু সাঈদ তালুকদার, পাগল রাজেয়সহ কয়েকজন।

 

পুলিশলাইন যুদ্ধ :

২৬ মার্চ পাবনা শহরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলি বর্ষণের সংবাদে পাবনা রিজার্ভ পুলিশলাইনের আর আই আবুল খায়ের পুলিশলাইনের সকল সদস্যকে একত্রিত করে ঢাকার রাজারবাগ ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং সকলের মতামত জানতে চাইলে সকল পুলিশ সদস্য আমৃত্যু সংগ্রাম চালিয়ে যাবার শপথ গ্রহণ করেন।

২৭ মার্চ জেলা প্রশাসক নুরুল কাদেরের কাছে খালেদ মোশাররফের প্রেরিত (We have revolt) বিদ্রোহের টেলিগ্রামটি প্রতিরোধ বাহিনীর মনোবল হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। এদিকে সন্ধ্যার পূর্বেই আর আই আবুল খায়ের পুলিশ সদস্যদের দৃঢ় মনোবল দেখে অস্ত্রাগার খুলে অস্ত্রসন্ত্র ও প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে সকলকে পুলিশলাইনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পজিশন নিতে নির্দেশ দেন।

অন্যদিকে জেলা প্রশাসকও নিশ্চিত ছিলেন যে পুলিশ বাহিনীকে নিরস্ত্র করতে হানাদার বাহিনী পুলিশলাইনে আক্রমণ করবে। এই আশঙ্কা থেকেই জেলা প্রশাসক ও আর আই পূর্ব পরিকল্পনা অনুয়ায়ী একটি দলকে পুলিশলাইনের সামনে জেলা পরিষদ ভবনের ছাদে, একটি দল আর আই সাহেবের বাসার ছদের উপর এবং একটি দলকে পুলিশলাইনের পশ্চিম দিকে অবস্থিত মসজিদের ছাদের উপর অস্ত্রশস্ত্রসহ পজিশন গ্রহণের নির্দেশ দেন।

এদিন রাতে জেলা প্রশাসকের অনুমানই সত্য হলো। মাঝরাতে ২টি ট্রাক ও ১টি জিপ এসে পুলিশলাইনের ডানকোনায় এবং পুলিশলাইন ও জেলা পরিষদ ভবনের মাঝখানে থামার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে পুলিশলাইন লক্ষ্য করে কয়েক রাউণ্ড গুলিবর্ষণের মধ্যে দিয়ে আক্রমণ শুরু করে।

প্রস্তুতি নিয়ে থাকা পুলিশ বাহিনী এবং মুক্তিকামী প্রতিরোধ যোদ্ধাগণ বিভিন্ন অবস্থান থেকে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। চলতে থাকে অবিরাম গুলিবর্ষণ, অবরোধ রূপান্তরিত হলো পাল্টা আক্রমণে। পাকিস্তানি বাহিনী বেকায়দায় পড়ে যায়, কেননা তারা ছিলো খোলা যায়গায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা এম নুরুল কাদের জেলা প্রশাসক পাবনা ১৯৭১ Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

 

আর আই পুলিশলাইনের উপর থেকে হাতমাইক দিয়ে পুলিশ বাহিনীর প্রতি আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতে থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনারা মাইক দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিতে থাকে। পুলিশ সদস্যদের অত্যন্ত সুরক্ষিত ও সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী মেশিনগান ও মর্টার শেলিং করেও পুলিশ বাহিনীর মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়।

এমনকি পুলিশের দৃঢ় প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সেনারা সিভিল সার্জনের অফিসের পাশ দিয়ে ক্রলিং করে পুলিশলাইনের ভিতরে ঢোকার বার বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পুলিশলাইনের এই যুদ্ধে পুলিশ সদস্যগণ আসন্ন বিপদ অনুধাবন করে চতুর্দিক ঘিরে অবস্থান নিয়েছিল। হাবিলদার সিরাজুল ইসলাম ও কনস্টেবল জহির হোসেন পুলিশলাইনের পশ্চিমে ছিলেন।

কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন ও নাসির উদ্দিন ছিলেন ম্যাগজিন গার্ডের সামনে। আর আই আবুল খায়েরের সঙ্গে কনস্টেবল রণজিত কুমার রিজার্ভ অফিসের দোতলা থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কয়েকজন কনস্টেবলসহ পিআরএফ-এর সুবেদার মাহতাব ছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি ক্যান্টিনের সামনে।

পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ মোকাবেলার চেষ্টা করেন পুলিশ হাসপাতালের পেছন এলাকা এবং পুলিশলাইন স্কুলের মধ্যে শক্ত ঘাঁটি নিয়ে। এদের সাথে মুক্তিকামী জনতা জজকোর্ট, পোস্টঅফিস, জেলখানা এলাকা ও জেলা স্কুলের ভিতরে বৃত্তাকারে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করে।

এদিকে মধ্যরাতে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে পদ্মাচরে অবস্থানরত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানি সেনারা পুলিশলাইন আক্রমণ করেছে এবং তারা সবাই শহরের দিকে এগিয়ে আসে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীপ্রধান বকুলও ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে শহরের দিকে ছুটে আসেন।

কাচারিপাড়ায় জামতলা বাঁধের কাছে এসে তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন এবং নিজের টুটু-বোর রাইফেলসহ যার যতটুকু অস্ত্র আছে তাই নিয়ে পেছন দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই তাদের বলে দিলেন, গ্রামের ভেতর গিয়ে খবর দিতে বন্দুক, ফলা, তীর-ধনুক যে যা পারে তাই নিয়ে যেন শহরে এসে শত্রুর মোকাবেলা করে।

গুলিবর্ষণ করেতে করতে বকুল কয়েকজন যোদ্ধাসহ জামতলা থেকে এগিয়ে এসে কোর্ট এলাকায় প্রবেশ করেন। জজকোর্টের পাশেই পাকিস্তানি সেনাদের বহনকারী একটি জিপের কাছে দাঁড়িয়ে দুজন পাকিস্তানি সেনা পুলিশলাইন লক্ষ্য করে গুলি করছে। বকুল তাদের উপর গুলি শুরু করলে পাকিস্তানি সেনা ছুটে পালাতে থাকে।

বকুলের পাশের সহযোদ্ধা ছেলেটি পাকিস্তানি সেনাকে পালাতে দেখে চিৎকার করে তার পিছু ছুটতে থাকে। ছেলেটির কাছে অস্ত্র ছিল তীর-ধনুক। স্বাধীনতার জন্য জীবন আত্মাহুতি দেওয়ার উন্মাদনায় সে এতটাই পাগল ছিল যে বকুলের পিছু ডাক তাঁকে থামাতে পারেনি। কোথা থেকে একটি গুলি এসে তাঁকে আঘাত করলে মুহূর্তেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

সহযোদ্ধার মৃত্যুর দৃশ্য দেখে বকুল রাগে-দুঃখে ও ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ‘ক্রোধ বিপুল শক্তি হয়ে বাহুতে ও বুকে ভর করলো, কণ্ঠ ছিড়ে বেড়িয়ে এলো-আর পিছু হটা নয় তোমরা গুলি ছুড়তে ছঁড়তে ক্রমাগত সামনের দিকে এগোও।

এখান থেকে বকুল জজ সাহেবের বাড়ির পাশের ড্রেনের মধ্য দিয়ে পাকা রাস্তার দিকে চলে গেলেন। তখন সকাল প্রায় আটটা। তিনি দেখতে পান যে, পাকিস্তানি সেনা ভর্তি একটি জিপ পৌরসভা ও আমজাদ হোসেনের বাড়ির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে খুব ধীরগতিতে পাকা রাস্তায় ওঠার জন্য এগিয়ে আসছে।

প্রতিশোধের নেশায় পাকিস্তানি বাহিনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই বকুল ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে গুলি করায় গুলিটা বিদ্ধ হলো ড্রাইভারের মাথায় এবং জিপটি উল্টে পড়লো পৌরসভার বড় ড্রেনে। পাকিস্তানি সেনারা ড্রেনের কাদায় ছিটকে পড়েই এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। কিন্তু একটু পরেই তাদের একজন বাঁশি বাজিয়ে সংকেত দিতেই সবাই উল্টো দিকে জিলাপাড়ার দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বুলগানি Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

ইতোমধ্যে গুলিবর্ষণের শব্দও স্তিমিত হয়ে আসে। পুলিশলাইন থেকে মাঝে মধ্যে দুএকটা গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জনতার প্রচণ্ড চাপের মুখে পাকিস্তানি সেনারা ভীত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পুলিশলাইনের দিকে প্রচণ্ড উল্লাসে মেতে ওঠে স্বাধীনতাকামী জনতা।

পাকিস্তানি সেনারা পালিয়েছে বুঝতে পেরে বকুল ও তাঁর সঙ্গীরা আনন্দে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দিতে দিতে ছুটে চললো পুলিশলাইনের দিকে। বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে সবাই। পুলিশের আর আই ছুটে এসে বকুলসহ প্রতিরোধকারীদের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।

বললেন, ‘সামান্য গুলি দিয়ে ওদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে; বহুকষ্টে বুকে হেঁটে গিয়ে ম্যাগাজিন রুম থেকে এক বাক্স গুলি বের করে এনেছিলাম; তাই দিয়ে কোনো রকমে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম, সময়মতো আপনাদের সহযোগিতা না পেলে আমাদের কপালে যে কি ঘটতো তা আল্লাহই জানেন।’ এই খণ্ডযুদ্ধে একজন প্রতিরোধ যোদ্ধা শহিদ হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন মাত্র কয়েকজন।

পুলিশলাইনের যুদ্ধের কথা ছড়িয়ে পড়তেই পার্শ্ববর্তী চর এলাকা থেকে মুক্তিকামী জনতা পুলিশলাইনের দিকে যেমন ছুটে আসে তেমনি পার্শ্ববর্তী অন্যান্য এলাকা থেকেও হাজার হাজার মানুষ পাবনা শহরের দিকে এগিয়ে আসে। সাঁথিয়া থানার ধোপাদহ, হলুদঘর, তেতুরিয়া, গোপালপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছাত্র, যুবক, জনতা লাঠি, দা, ফলা, ট্যাটা ইত্যাদি নিয়ে পাবনা শহরের উদ্দেশ্যে ‘সকলেই পাবনা ঢলো, পাকিস্তানি বাহিনী খতম কর’ স্লোগান সহকারে পাবনা শহরের দিকে আসতে থাকে।

অন্যদিকে ২৭ মার্চ রাতে ঈশ্বরদীর বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি এবং পেট্রল ডিউটির ব্যবস্থার পর পরবর্তী নির্দেশের জন্য যখন সবাই চিন্তিত সেসময় পাবনা থেকে খবর আসে ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া থানার এমপিএ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিনকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করেছে।

এই পরিস্থিতিতে সন্ধ্যার পরও যখন জেলা শহর পাবনায় বার বার যোগাযোগ করেও কোনো খবর সংগ্রহ করা যাচ্ছে না এমন সময় সিরাজগঞ্জ মহকুমার এসডিও শামসুদ্দিন আহমেদ ঈশ্বরদী থানায় টেলিফোন করে সংবাদ দেন পাবনা শহর পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক অবরুদ্ধ। এসডিও সাহেব ঈশ্বরদী থানার পুলিশ বাহিনী এবং জনসাধারণসহ অন্যান্য প্রতিটি থানার পুলিশ বাহিনীকে শত্রুর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করে দেশমাতৃকাকে হানাদারমুক্ত রাখার আহবান জানান।

সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরদী থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা যে যা হাতের কাছে পেয়েছে তাই নিয়ে প্রায় ১৬ মাইল দূর থেকে ভোর না হতেই চলে আসে পাবনায় পুলিশলাইনের পশ্চিমে ফুটবল খেলার মাঠে। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জ মহকুমা থেকেও নদীপথে চলে আসে ছাত্র-জনতার দল।

পাকিস্তানি সেনাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে আপামর জনতা। এভাবে ২৭ ও ২৮ মার্চ দুদিন ব্যাপী একটানা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে পুলিশ, প্রাক্তন সৈনিক, ছাত্র এবং মুক্তিকামী জনতার যুদ্ধ হয়। আত্মরক্ষার এই জনযুদ্ধে জয়ী জনগণের মনোবল অদ্ভুতভাবে বেড়ে যায়।

 

টেলিফোন এক্সচেঞ্জের যুদ্ধ :

২৮ মার্চ সকাল প্রায় নয়টা। ইতোমধ্যে পুলিশলাইন মুক্ত হয়েছে। বিজয়ের এই খবর দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তেই লোকজন পুলিশলাইনে এসে সমবেত হতে থাকে। আর আই আবুল খায়ের-এর সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যগণ অস্ত্রাগার থেকে ৩০৩ রাইফেল ও গুলি তাদের মধ্যে বিতরণ করেন। জেলাখানার তালা ভেঙে কয়েদিদের মুক্ত করা হয়।

এ সময় খবর আসে পাকিস্তানি সেনারা পুলিশলাইন থেকে পালিয়ে এসে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ভিতরে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি পাকিস্তানি সেনা ২৫ মার্চ রাতে এসেই টেলিফোন এক্সচেঞ্জ তাদের দখলে নিয়েছিল। খবর পেয়েই ছাত্র, যুবক, জনতা, চরের কৃষক, পুলিশ বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যগণ পাকিস্তানি সেনাদের দখলকৃত টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনটি ঘেরাও করে সম্মুখ যুদ্ধে নেমে পড়ে।

এই জনযুদ্ধে গ্রামের হাজারও সাধারণ মানুষ তাদের লাঠিসোটা, বর্শা, বল্লম, তীর-ধনুকসহ বিভিন্ন হাতিয়ার নিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শিক্ষিত-পেশাদার পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ভিতরে সুরক্ষিত অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করে।

সুতরাং সংখ্যায় তারা কম হলেও তাদেরকে পরাস্ত করা কঠিন ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের মেশিনগানের অনবরত গুলিবর্ষণের মধ্যেও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল চরম দুঃসাহসিক কাজ। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ছাদের উপর থেকে পাকিস্তানি সেনারা জনতার গুলিবর্ষণের পাল্টা জবাব দিচ্ছে।

এসময় বকুল পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি করলে একজন পাকিস্তানি সেনা মারা যায় এবং অন্যরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে এক্সচেঞ্জের ভিতরে আশ্রয় নেয়। রহিম নামক বানী সিনেমা হলের একজন কর্মচারী এক্সচেঞ্জের পেছনের আমগাছ দিয়ে ছাদের উপর গিয়ে খুব সহজেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসে।

সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য হাবুল এসকল অস্ত্র চালানো শিখিয়ে দিয়ে তিনি একটি এলএমজি নিয়ে বানী সিনেমা হলের ছাদের উপর উঠে এক্সচেঞ্জ লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। অন্য একটি অস্ত্র দিয়ে অনবরত গুলিবর্ষণ করে চলে।

এদিকে দামাল ছেলেরা পেট্রলবাল্ব ছুড়ে এক্সচেঞ্জের ঘরের দরজা-জানালায় আগুন লাগিয়ে দিলে পাকিস্তানি সেনারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এসময় পাকিস্তানি সেনাদের কিছু গোলাবারুদ বারান্দায় পড়ে থাকায় বকুল অনেক কষ্ট করে একটি টমিগান নিয়ে এসে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ইকবালকে দিয়ে আবার অস্ত্র আনতে যান।

দ্বিতীয়বার অস্ত্র নিয়ে ফিরে আসার সময় পাকিস্তানি সেনারা বুঝতে পেরে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এসময় একটি গুলি তাঁর কাঁধের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ায় কিছুটা চামড়া ছিঁড়ে যায়। তবুও তিনি পিছু না হটে এসএমজিটা নিয়ে এক্সচেঞ্জের পেছনে ঢাকীবাড়ির ছাদে স্থাপন করে গুলিবর্ষণ শুরু করেন।

প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে উভয় পক্ষের মধ্যে এবং সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা। হাজার হাজার লোকের গনবিদারী জয়ধ্বনিতে পাকিস্তানি সেনাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের গুলির শব্দ স্তিমিত হয়ে আসে। উপায়ান্তর না দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি বাহিনী শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

মুক্তিপাগল জনসাধারণ দলে দলে ঢুকে পড়লো টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মধ্যে। পাকিস্তানি সেনাদের টেনে হিচড়ে এনে দাঁড় করালো জনতার কাতারে। যে যার মতো আক্রমণ করে মুহূর্তেই টুকরো টুকরো করে ফেললো তাদের দেহ। কেউ হাত কেটে ফলার সঙ্গে গেঁথে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ পা কেটে, নাক কেটে নিয়ে যাচ্ছে, যার যেমন মনে হয়েছে তেমনি করে উন্মত্ততা দেখাতে লাগলো প্রতিশোধস্পৃহায়।

এভাবে দুপুর ২টা থেকে ২.৩০মি.-এর মধ্যে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। হাজারো কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠলে সমগ্র পাবনা শহর।। যারা রুদ্ধশ্বাসে ঘরে ঘরে বসে ছিল তারা সবাই রাস্তায় নেমে এলো। গৃহবধূরা খিচুড়ি, নাস্তা, ডাব, রুটি, মিষ্টি পাঠাতে লাগলো প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য।

টেলিফোন এক্সচেঞ্জের এই যুদ্ধে প্রায় এক প্লাটুন ২৭/৩৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছিল। জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে অস্ত্রহাতে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। শিরিন বানু মিতিল ছিলেন একমাত্র মহিলা যিনি পুরুষের বেশে এই যুদ্ধে। অংশগ্রহণ করেন।

 

লস্করপুর ময়লাগাড়ির যুদ্ধ :

পাবনা শহরের মূল থেকে ৮/৯ কিলোমিটার পূর্বদিকে ছিল লস্করপুর ময়লাগাড়ির অবস্থান। ঢাকার দিক থেকে এটিই ছিল পাবনা শহরের প্রবেশপথ। পাকিস্তানি বাহিনীর ৪-৮ জন সদস্য এখানে রাস্তার ধারের একটি ছোট্ট দ্বিতল ভবনে চেকপোস্ট বসিয়ে মাঝারি ও হালকা মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে অবস্থান করছিল।

২৮ মার্চ পুলিশলাইন যুদ্ধের কথা ছড়িয়ে পড়তেই মোজাহিত ক্লাব, মহেন্দ্রপুর, ফকিরপুরঘাট, শালগাড়িয়াসহ আশপাশের জনসাধারণ তীর-ধনুক, ফলা-সড়কি ইত্যাদি নিয়ে তাদের ঘেরাও করে রাখে। খবর পেয়ে বুলবুল, মুকু, একদল পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু সদস্য সেখানে ছুটে যায়।

বিকেল চারটা থেকে সমস্ত রাত্রি ধরে চলে যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ছাত্রনেতা শামসুল আলম বুলবুল, আবুল মহসিন বেগ মুকু, আমিরুল ইসলাম ফুনু, ভাটা শ্রমিক আফসারসহ পাঁচজন শহিদ হন। অবশেষে গোলাবারুদ ফুরিয়ে পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে জনসাধারণ কর্তৃক ধৃত ও পরে গণপিটুনিতে নিহত হয়।

 

বালিয়াহালট যুদ্ধ :

পাবনা শহরের ৭/৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বালিয়াহালটের ওয়াপদা ভবনে স্থাপিত পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে ৮/১০জন পাকিস্তানি সেনা ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছিল। ২৮ মার্চ সকাল থেকেই সাধারণ মানুষ ওয়াপদা ভবন ঘেরাও করতে শুরু করে। বেলা যত বাড়তে থাকে মানুষের সংখ্যা ততোই বাড়তে থাকে এবং গগনবিদারী স্লোগান দিতে দিতে তারা চারদিকে থেকে এগুতে থাকে ওয়াপদা ভবনের দিকে।

পাকিস্তানি হানাদাররা এতো মানুষ দেখে আতঙ্কিত হয়ে জনতার উপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিকামী জনতাও নিজেদের টুটু-বোর রাইফেল, গাদা বন্দুক, তীর-ধনুক ইত্যাদি দিয়ে পাল্টা জবাব দিতে থাকে। এভাবেই চলে সারাদিন। সন্ধ্যায় জনতার অবরোধ কিছুটা শিথিল হলে হানাদাররা তাদের অবস্থান থেকে বেরিয়ে গুলিবর্ষণ করে জনতার ব্যূহ ভেঙে বালিয়াহালটের বিস্তৃর্ণ আবাদী জমি পাড়ি দিয়ে বিসিক শিল্পনগরীর প্রধান ঘাঁটিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে।

কিন্তু জনতার প্রতিরোধের মুখে তারা বিসিক শিল্পনগরীর পথ ধরতে ব্যর্থ হয়ে পাশের বালিয়াহালট গোরস্থানের ভিতরে ঢুকে পড়ে। জনতা গোরস্থানও ঘেরাও করে ফেলে। পাকিস্তানি সেনারা অপর্যাপ্ত গোলাবারুদ দিয়ে গোরস্থানের পাকা কবরের ভেতরে অবস্থান নিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে কোনো রকমে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালাতে থাকে।

দিনের আলোয় ধরা পড়ার ভয়ে খুব ভোরে তারা গোরস্থান থেকে বেরিয়ে দৌড়ে বিসিকের দিকে পালানোর চেষ্টা করতে থাকলে জনতা তাদের ধাওয়া করে। উভয়পক্ষে চলে তুমুল গোলাগুলি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৮জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিকামী জনতার এই প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রাণ হারায়।

 

বিসিক শিল্পনগরীর যুদ্ধ :

২৯ মার্চ ভোর থেকেই পাবনার ছাত্র-জনতা, স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ কর্তৃক বিসিক শিল্পনগরীতে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনাদের প্রধান ঘাঁটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাবনা শহরের লড়াইয়ের খবর শহরের বাইরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামাঞ্চল ও আশেপাশের এলাকা থেকে কৃষক-জনতা দলে দলে সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসে।

শহরকে পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। তারা শত্রুপক্ষের মূল ঘাঁটি ঘেরাও করে রাখে সারারাত। মূলত, রাত্রির অন্ধকারে ঘটনাটা এমন দ্রুততার সঙ্গে ঘটে যে, পাকিস্তানি সেনারা কৃষক-জনতার এই অবরোধ থেকে বেরিয়ে পড়ার কোনো সময় বা সুযোগ কোনোটাই পায়নি।

অবরোধকারীদের পরিকল্পনা ছিল, বাইরের সকল যোগাযোগ বিছিন্ন করে পাকিস্তানি সেনাদের না খাইয়ে মারবে। সময়ের সাথে সাথে অবরোধকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিরাট এ সমাবেশের দিকে তাকিয়ে এবং তাদের গগনবিদারী স্লোগান শুনে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে এসে আক্রমণ করতেও সাহস পায়নি। তারা নিশ্চিতভাবে বুঝে গিয়েছিল যে এই সুদৃঢ় প্রতিরোধব্যূহ ভেঙে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

উপায়ান্তর না দেখে তাই তারা বেতারযোগে সাহায্যের জন্য বার্তা পাঠায় ঢাকা ও রাজশাহীর নামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে। পাবনায় সশস্ত্র গণপ্রতিরোধ ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই চরম দুরাবস্থার খবর পেয়ে রাজশাহী থেকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ডেপুটি কমান্ডিং অফিসার মেজর আসলামকে একটি ‘রিকয়েললেস রাইফেল’, একটি মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রসহ ১৮ জন সৈন্য দিয়ে পাঠানো হয় পাবনায় অবশিষ্ট সৈন্যদের উদ্ধার করে রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

উদ্ধারকারী দলটি রাজশাহী থেকে পাকশি হয়ে হেমায়েতপুর মানসিক হাসপাতালের পাশ দিয়ে সাদা পোশাকে ১১টি ট্রাক নিয়ে চলে আসে বিসিক এলাকায়। তখন সকাল ১০/১১টা। একটা ফাইটার প্লেন এসে জনসাধারণের উপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করতে থাকে। বোমারু বিমানের অতর্কিত এই আক্রমণে বেশকিছু জনগণ হতাহত হয়।

হাজার হাজার জনগণের অবরোধের বাঁধ ভেঙে পড়ে। সুযোগ বুঝে মেজর আসলামের উদ্ধারকারী দলটি বিসিবে থাকা এক প্লাটুনের কিছু বেশি অর্থাৎ ৩০-৪০ জন পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে পাবনা-পাকশির কাঁচা রাস্তা দিয়ে রাজশাহীর গোপালপুরের পথে পালিয়ে যায়। তবে যাওয়ার আগে হানাদাররা অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আহমেদ, ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী, আবু সাঈদ তালুকদার, পাগল রাজেমকে নৃশংসভাবে গুলি তরে হত্যা করে ট্রেঞ্চের মধ্যে ফেলে যায়। আকস্মিকভাবে বেঁচে যান আবদুল খালেক তালুকদার।

 

মাধপুরের যুদ্ধ :

পাকিস্তানি সেনাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তেই হিমায়েতপুরের চরের হাজার হাজার জনতা ঈশ্বরদী, পাকশি, রূপপুর অঞ্চলের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে অসংখ্য যুবক অস্ত্র, হাতবোমা ইত্যাদি নিয়ে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হয় মাধপুর নামক স্থানে।

ঈশ্বরদী ও পাবনা সদর থানার সীমান্তবর্তী দাপুরিয়া ইউনিয়নের মাধপুর গ্রামের তিন মাথার মোড়ে জনাব ইউসুফ আলীর (সাবেক চেয়ারম্যান) নেতৃত্বে একটি অসম ও দুঃসাহসিক এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন মনজুর হোসেন বকুল, কাজী সদরুল হক সুধা, জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু, আবদুর রহিম টিনু, আবদুর রাজ্জাক, নবাব আলী, ওহিদুল ইসলাম, আবদুল গফুর, হাবিবুর রহমান রাজু, রবিউল, টুকু, পান্না, ইসহাক, রাসু, গাফ্ফারসহ নাম না জানা অনেকে।

জনতার গুলিবর্ষণের জবাব দেয় পাকিস্তানি সেনারা বেপরোয়াভাবে পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। এই যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রভূমি ছিল মাধপুরের বিশাল বটগাছ। ছাত্রলীগ নেতা রাজু এবং সাহাপুরের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ওহিদ পাকিস্তানি সেনাদের জিপে ককটেল ছুড়ে মারলে জিপে আগুন ধরে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

পাকিস্তানি সেনারা লাশগুলো ট্রাকে তুলে রাস্তার আশেপাশের গ্রামগুলিতে অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে। প্রায় তিন ঘণ্টার প্রচণ্ড এই যুদ্ধে প্রায় ১৭ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধে প্রথম শহিদ ঈশ্বরদী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র হাবিবুর রহমান রাজু।

রাজু ছাড়াও শহিদ হন আবদুর রাজ্জাক, ওহিদুর রহমান, আবদুল গফুর, আলী আহমেদ, নুরুল ইসলাম নুরু, আবদুস সবুর, নবাব আলী, আতাউল হক আতুসহ প্রায় ১০/১১ জন যোদ্ধা। মাধপুরের এই যুদ্ধে জনগণের হাতিয়ার ছিল টুটু-বোর রাইফেল, বন্দুক, ককটেল-হাতবোমা, হলঙ্গা, ফলা, শাবল, লাঠি-শর্কি ইত্যাদি।

বিসিকের ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়েও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা বাঁচতে পারেনি। ঈশ্বরদী থানার বিশেষ করে পাকশি, সাহাপুর, দাশুরিয়া, বাঁশেরবাদা এবং সলিমপুর ইউনিয়নের জনসাধারণ উদ্ভ্রান্ত ও দিশেহারা পলাতক পাকিস্তানি সেনাদের এই দলটিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য দাশুরিয়া ও মুলাডুলিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এই দুই স্থানেই মুক্তিকামী জনতার সাথে পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং পাকিস্তানি সেনাদের অনেকেই নিহত হয়।

বলা যায় পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে মারছিল বীর বাঙালি জনতা। এই যুদ্ধের সময় একটা যুদ্ধবিমান পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। অনবরত মেশিনগানের গুলিবর্ষণের সামনে টিকতে না পেরে জনগণ সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এসময় বিমান থেকে বর্ষিত শেলের আঘাতে রূপপুর গ্রামের মহিউদ্দিন তার দুটি পা হারান, অনেকেই আহত হন। এরপর পাকিস্তানি সেনারা গোপালপুরের দিকে অগ্রসর হলে জনগণও পিছু ধাওয়া করে সেখানে পৌছায়।

এখানে পাকিস্তানি সেনারা একটি বাড়ির ৬ জন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সেই বাড়িতেই আশ্রয় নেয়। জনগণের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সেনারা এ বাড়ি থেকেও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এভাবে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দ্বারা বিভিন্ন স্থানে চরম প্রতিরোধের . সম্মুখীন হয়ে নিহত হতে থাকে এবং তাদের গন্তব্য রাজশাহীর গোপালপুর পৌছে যেতে যেতে একজন পাকিস্তানি সেনাও আর বাঁচতে পারেনি।

প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে (২৭-৩০মার্চ) পাবনাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী ছাত্র-যুবক, স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রায় ১৭টি খণ্ডযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাবনা জেলা সদর ৩০ মার্চ প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। বলা যেতে পারে এইসব যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রায় ১৫০ জন সৈন্য নিহত হয়। শহিদ হন মুক্তিকামী জনসাধারণের অনেকেই।

 

বেসামরিক প্রশাসন চালু :

৩০ মার্চ থেকে পাবনা সম্পূর্ণ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সরকারের নামে পাবনাতেই সর্ব প্রথম বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়। ‘বাংলাদেশ সরকার’ নামে রাবার স্ট্যাম্প প্রস্তুত করা হয়। আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে ৪ এপ্রিল জজকোর্ট ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলেন এমপিএ আব্দুর রব বগা মিয়া। ট্রেজারি, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হলো।

শহরে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসলো। প্রশাসনিক কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। কমিটির সদস্যগণ ছিলেন:

১. জেলা প্রশাসক এম. নুরুল কাদের খান

২ পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গাফ্ফার

৩. এমএনএ আমজাদ হোসেন

৪. এমপিএ আব্দুর রব বগা মিয়া

৫. ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা

৬. আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম আলী কাদেরী

৭. আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াজি উদ্দিন খান

৮ ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল

৯. ছাত্রলীগ নেতা ইকবাল হোসেন।

সরকারি কার্যাদি পরিচালনার জন্য দায়িত্ব বণ্টন করা হলো:

সামগ্রিক কাজের সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান প্রধান জেলা প্রশাসক এম. নুরুল কাদের খান মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ, সমন্বয়, পুলিশ ও প্যারা মিলিটারি নিয়োগ প্রধান পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গাফ্ফার। দপ্তর প্রধান কফিল উদ্দিন আহমেদ। পরিকল্পনা, তত্ত্ববধান এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন উপদেষ্টা-এমপিএ আব্দুর রব বগা মিয়া।

স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল। তত্ত্বাবধানে আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম আলী কাদেরী।

জরুরি খাদ্য সংগ্রহ ও বিতরণ প্রধান-আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফেরদৌস ফেব্রু-ময়া।

জেলখানা ও মানসিক হাসপাতালসহ সামগ্রিক চিকিৎসা ওষুধ বৃন্মস্থাপনা প্রধান ন্যাম নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা।

সরকারি কর্মচারিদের বেতন, অর্থ সরবরাহ, ব্যাংকিং, যোগাযোগ প্রধান—জেলা প্রশাসক এম. নুরুল কাদের খান। পরামর্শক এমএনএ আমজাদ হোসেন ও আমিনুল ইসলাম বাদশা।

লিয়াজো: এমপিএ আব্দুর রব বগা মিয়া।

পাবনার প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই বেসামরিক প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

নগরবাড়ি ঘাটে প্রতিরোধ ও পাকিস্তানি সেনাদের পুনরায় পাবনা দখল:

তৎকালীন সময় পাবনা সদর ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল পাবনা জেলা। ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সেনারা প্রধানত তিনটি পথ দিয়ে পাবনায় প্রবেশ করতে পারত। এক. নগরবাড়ি ঘাট দিয়ে সড়কপথে, দুই বিমানে ঈশ্বরদী বিমানবন্দর দিয়ে এবং তিন, সিরাজগঞ্জ ঘাট দিয়ে রেলপথে। তাই এই তিনটি পথ অবরোধ করা ছিল খুব জরুরি।

সিরাজগঞ্জের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং মহকুমা প্রশাসক দায়িত্ব নিলেন সিরাজগঞ্জ ঘাট রক্ষার। ঈশ্বরদীর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দেওয়া হলো বিমানবন্দরটি অকেজো করে দেওয়ার জন্য। আর নগরবাড়ি ঘাট রক্ষার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশ, আনসার এবং পাবনা, সাঁথিয়া, বেড়া ও সিরাজগঞ্জ মহকুমার উপর। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও নগরবাড়ি ঘাট রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

২ এপ্রিল প্রায় দুশ মুক্তিযোদ্ধা পাবনা শহরে থেকে আটটি জিপ, একটি বড় বাস ও কয়েকটি ট্রাকযোগে নগরবাড়ির ঘাটে এসে অবস্থান নেয়। বেড়ার শক্তিশালী ইউনিটও নগরবাড়ি ঘাটের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিরোধকারীগণ নগরবাড়ি এসে জড়ো হতে থাকে।

নগরবাড়ি ঘাটের আশেপাশে এবং নদীর কূল জুড়ে অসংখ্য বাংকার তৈরি করে এর সামনের দিকে বালির বস্তা ফেলে গড়ে তোলা হলো শক্ত প্রতিরোধ নগরবাড়ি-পাবনা ও নগরবাড়ি বেড়া সড়কের বহু স্থানে গাছের গুঁড়ি ও ব্যারেল ইত্যাদি দিয়ে সৃষ্টি করা হলো অসংখ্য ব্যারিকেড। এমনকি পাকিস্তানি বাহিনীর গতি-বিধি সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য ‘গুপ্তচর’ বাহিনীও গঠন করা হলো।

নগরবাড়ি ঘাটে প্রতিরোধ প্রস্তুতির কথা পাকিস্তানি বাহিনীর কানে পৌঁছে যায়। ৪ এপ্রিল থেকে নগরবাড়ি ঘাটে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর বিমান আক্রমণ। ৯ এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে তাদের চূড়ান্ত অভিযান। এই অভিযানে অংশ নেয় স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী। কয়েকদিন আগেই স্থলবাহিনী ঢাকার দিকে থেকে আরিচায় এসে সমবেত হয়। শেষে ফেরি ও জাহাজ বোঝাই হয়ে ধীরেসুস্থে অগ্রসর হতে থাকে নগরবাড়ি ঘাটের দিকে।

অগ্রগামী দল হিসেবে পাঠানো গানবোটগুলো থেকে বৃষ্টির মতো মর্টার, রকেট এবং ভারী মেশিনগানের গোলাবর্ষণ হতে থাকে। এর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার একযোগে নগরবাড়ি ঘাটে অবস্থানরত প্রতিরোধ যোদ্ধাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে মুক্তিকামী যোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙে পড়ে ১০ এপ্রিল নগরবাড়ি ঘাটের পতন ঘটে এবং পাকিস্তানি বাহিনী পাবনা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৫

৩০ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত থাকার পর পুনরায় পাবনা জেলা সদর পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়। ভেঙে পড়ে পাবনায় গড়ে ওঠা বেসামরিক প্রশাসন। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অনেকেই ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে পাবনায় এসে পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবেলা করে।

 

২. সিরাজগঞ্জে প্রতিরোধ যুদ্ধ :

২৫ মার্চ ঢাকায় সংঘটিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর সিরাজগঞ্জে পৌছিলে মুক্তিকামী জনগণের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন সিরাজগঞ্জকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য প্রতিরোধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ২৫ মার্চ রাত ১টার তিনি আবদুল লতিফ মির্জা ও মোজাফ্ফর হোসেনকে সংগ্রাম পরিষদ অফিসে ডেকে পাঠান এবং পুলিশ, আনসারের সমস্ত অস্ত্র প্রতিরোধের কাজে লাগানোর নির্দেশ দেন।

২৬ মার্চে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। পরিকল্পনা অনুসারে লতিফ মির্জাকে বাঘাবাড়ি ঘাট প্রতিরোধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছুটি ভোগরত সেনাসদস্য, আনসার, পুলিশ, ছাত্র ও আপামর জনসাধারণকে নিয়ে গঠন করা হয় সংগ্রাম পরিষদ।

সিরাজগঞ্জের প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য মহকুমা প্রশাসক শামসুদ্দিন (এসডিও) মোজাফ্ফর হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বগুড়ায় গিয়ে সেখানকার মুক্তিকামী প্রতিরোধ বাহিনীর মধ্যে সমঝোতা করে কিছু অস্ত্র, বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ২০ জন এবং ইপিআর-এ প্রায় ৩০ জন সৈন্যকে সিরাজগঞ্জ নিয়ে আসেন।

এ পর্যায়ে সিরাজগঞ্জের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সংগ্রহকৃত অস্ত্র ছিল চাইনিজ রাইফেল ৭টি, মার্ক-৪৬টি এবং রাইফেল ৫/৬টি। এমনকি সিরাজগঞ্জের প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে যমুনা পাড়ে ৬/৭টি কামান স্থাপন করা হলো। প্রায় ১মাইল কার্যকারিতা সম্পন্ন এই কামানগুলি তৈরি করেছিলেন স্থানীয় আবুল মিস্ত্রি। ১৬

সিরাজগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী জেলা বগুড়ার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন উল্লাপাড়া থানার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর উল্লাপাড়ার ছাত্র ও যুবসমাজ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১২ মার্চ স্থানীয় কৃষকগঞ্জ বাজারে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন জুলফিকার মতিন ও বদরুল ইসলাম বকুল।

প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে মহকুমা প্রশাসক শামসুদ্দিনের নির্দেশে এ থানার ছাত্র-যুবক, শ্রমিক, কৃষকদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়। এই বাহিনীর সঙ্গে পুলিশ সদস্যগণ যোগ দিয়ে গঠন করে প্রতিরোধ বাহিনী। ১৬ মার্চ মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা উল্লাপাড়ার থানা থেকে অস্ত্র লুট করে। এছাড়া উল্লাপাড়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রাক্তন ও চাকুরি থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যগণ বিভিন্ন স্থান থেকে একনলা দোনলা বন্দুক সংগ্রহ করে।

উল্লাপাড়া পার্কে স্থাপন করা হয় প্রশিক্ষণ শিবির। ছুটিতে বাড়িতে আসা সামরিক বাহিনীর সদস্য বাঘুরা গ্রামের আবদুস ছামাদ এই প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রায় দুইশত ছাত্র যুবক ও তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই সলপ উচ্চবিদ্যালয়ে শুরু হয় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।

এখানে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের ল্যান্সনায়েক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, সেনাসদস্য দেওয়ান আজিজুর রহমান এবং দেওয়ান ওবায়দুর রহমান। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এই স্কুলে যুদ্ধাহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা ও আশ্রয়কেন্দ্রও চালু হয়।

২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খবর ২৭ মার্চ উল্লাপাড়ায় পৌছুলে এখানকার ছাত্র-জনতা উত্তেজনায় ফেটে পড়ে এবং এক প্রতিবাদ মিছিল বের করে। এমপিএ গোলাম হাসনায়েনকে সম্পাদক করে উল্লাপাড়া থানা সদরে গঠন করা হয় ‘কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ’।

এই পরিষদের সঙ্গে আরো জড়িত ছিলেন-সাইদুর রহমান পান্নু, মীর জয়নাল আবেদীন, ডা. মফিজ উদ্দিন, খোরশেদ আলম, মো. আবদুস ছামাদ মিয়া, খন্দকার মিজানুর রহমান, রজব আলী, মনজুর রহমান টুকু, আসমত আলী, আবদুল লতিফ মির্জা প্রমুখ। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে উল্লাপাড়ার ১৩টি ইউনিয়নেও গঠন করা হয় ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদ।

গিয়াসউদ্দীন আলমগীর, আবদুস ছাত্তার, জয়দেব সাহা প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত ছাত্রসংগ্রাম পরিষদকে আরো শক্তিশালী করা হয়। বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়। খোরশেদ আলম, জয়দেব সাহা ও গিয়াসউদ্দীনের নেতৃত্বে ২ এপ্রিল উল্লাপাড়া ডাক বাংলা চত্বরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্য এক লঙ্গরখানা খোলা হয়। *

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই শাহজাদপুর থানার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রনেতারা নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে মুক্তিকামী জনসাধারণকে উজ্জীবিত করে রাখে। ৩ মার্চ এখানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। হরতালের সমর্থনে খণ্ড খণ্ড মিছিল সমগ্র থানা শহরকে মুখরিত করে রাখে।

ছাত্র-যুবক, শ্রমিক, কৃষক, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, থানার ওসিসহ (চিত্তরঞ্জন) বেশকিছু সরকারি কর্মচারী এই মিছিলগুলোতে অংশ নেন। এই দিন বিকেলে রবীন্দ্রনাথের কাচারি বাড়ির চত্বরে বকুলতলায় অনুষ্ঠিত সভায় শাহজাদপুর কলেজের তৎকালীন ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক শহিদুজ্জামান হেলাল উপস্থিত জনসাধারণের সমর্থনে পাকিস্তানের পতাকায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন।

সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক শরফুদ্দিন আওয়াল। অন্যদিকে মির্জা আবদুল বাকীকে আহবায়ক করে ‘ছাত্রসংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। ৯ মার্চ রবীন্দ্রকাচারির চত্বরে সৈয়দ হোসেন মনসুরের (জাতীয় পরিষদ সদস্য, থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি, সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রিলে করে শোনানো হয় এবং পরে শহিদুজ্জামান হেলাল ও মির্জা আবদুল বাকী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।

এছাড়া অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই শাহজাদপুর বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্র-যুবকদের যুদ্ধের কলা-কৌশল শিক্ষা দিয়ে একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলা হয়। *

২৫ মার্চের পর শাহজাদপুর থানায় এমপিএ আবদুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিরোধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রথমেই বাঘাবাড়ি ঘাট বুন্ধের সিদ্ধান্ত হয় এবং এর দায়িত্ব দেওয়া হয় আবুল হোসেন চৌধুরীকে।

২৯/৩০ মার্চের দিকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সম্পর্কিত বঙ্গবন্ধুর একটি নির্দেশনা আবদুর রহমানের হাতে আসে। তিনি এটা অনুবাদ করে ছাপানোর দায়িত্ব দেন মওলানা সাইফ উদ্দীন ইয়াহিয়াকে (কনভেনশেন লীগ নেতা ও পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী এবং পরবর্তীকালে জেলা শান্তি কমিটির প্রধান)। প্রথমদিকে সাইফ উদ্দীন ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাটি বিলি করার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেন।

এসময় শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ কর্মী ও সরকারি কিছু কর্মচারীদের সমন্বয়ে ৭ সদস্যবিশিষ্ট ‘শাহজাদপুর স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন এমপিএ আবদুর রহমান এবং কমিটির অন্য সদস্যগণ হলেন আবদুল লতিফ খান, আবুল হোসেন চৌধুরী, অধ্যক্ষ তাহাজ্জুদ হোসেন, ননীগোপাল সাহা, এসআই পুলিশ স্টেশন এবং ওসি পুলিশ স্টেশন।

এছাড়াও জরুরি কয়েকটি বিষয়ে কাজের জন্য একটি উপ-কমিটি গঠন করে তার দায়িত্ব যেভাবে বণ্টন করা হয় তা হলো-আবু মোহাম্মদ ইউনুসকে (১৯৫৪ সালের আওয়ামী লীগ দলীয় এমএলএ) খাদ্য সরবরাহ, বাবু বিনোদ বিহারী জোয়ারদারকে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করা এবং আবদুল গফুর সরবতকে প্রচারকার্যের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এভাবে ২৫ মার্চের পর থেকে সিরাজগঞ্জ জেলার প্রতিটি থানাতেই গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি, শুরু হয় প্রতিরোধ প্রস্তুতি।

 

জয়বাংলা বেতার কেন্দ্র :

স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করে জনগণকে উৎসাহিত করা এবং তাদের মনোবলকে অটুট রাখার প্রতিশ্রুতি নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ২৮ মার্চ সিরাজগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘জয়বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগের ডেমোনেস্ট্রেটন জ্যোতির অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ‘আলফা ইলেকট্রিক্যাল সার্ভিস – এর মালিক আবদুস ছাত্তার এবং ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শেষ বর্ষের ছাত্র বাচ্চুর সহযোগিতা ও নিরলস পরিশ্রমের ফলে শর্টওয়েভের ৭৫ ব্যান্ডে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন এই ‘জয়বাংলা বেতার কেন্দ্র তার সম্প্রচার চালু করে।

মাত্র এক কিলোওয়াট শক্তি সম্পন্ন এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত ছিল সিরাজগঞ্জ শহরের আলফা ইলেকট্রিক্যাল সার্ভিস’-এ। শুরুতে বেতার কেন্দ্রটির ব্যয়তার এই তিন উদ্যোক্তার উপর নির্ভর করত। কিন্তু ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন নিয়মিতভাবে এই বেতার কেন্দ্রটিকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন।

প্রত্যেকটি অধিবেশনের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হতো। বেতার কেন্দ্রে খবর পড়তেন মনিরুল কবীর ও মঞ্জুরুল হক মুন্না। সংবাদ পর্যালোচনা করতেন আমিনুল ইসলাম ও আবদুর রউফ পাতা। রাজনৈতিক ভাষ্যকারের দায়িত্ব পালন করেন মিয়া ফজলুল হক (১২ ডিসেম্বর শহিদ হন)। সংবাদ নিবন্ধ লিখতেন ও পড়তেন দৈনিক আজাদের সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সিকদার।

সাহিত্যের আসন্ন পরিলনা ও আবৃত্তি করতেন খ ম আখতার হোসেন, মোহন রায়হান। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন আনোয়ার হোসেন, ফরিদা ইয়াসমিন সেতারা, খায়রুল কবীর, মঈনুল কবীর, সুরাইয়া বানু স্বপ্না, কুমকুম মির্জা, মাসুদ বেগম, নেহাল, প্রমুখ। দৈনন্দিন অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করতেন খায়রুল কবীর ও আনোয়ার হোসেন সিকদার।

২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করলে স্তব্ধ হয়ে যায় ‘জয়বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর সম্প্রচার। স্বল্প পরিসরে হলেও সিরাজগঞ্জের ‘জয়বাংলা বেতার কেন্দ্র সেদিন মুক্তিকামী মানুষের মনে এক অদ্ভুত সাড়া জাগিয়েছিল। প্রেরণা জুগিয়েছিল প্রতিরোধ যোদ্ধাদের। ২০১

 

বাঘাবাড়ি ঘাটের যুদ্ধ :

২১ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানার বাঘাবাড়ি ঘাটের প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাঘাবাড়ি ঘাট দখল করতে পারলে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সিরাজগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করার পথ সহজ হয়ে যাবে। ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা সড়কপথে সিরাজগঞ্জ প্রবেশের পথে প্রথমেই বাধা পায় বাঘাবাড়ি ঘাটে।

ফলে পাকিস্তানি বাহিনী তার গতিপথ পরিবর্তন করে রেলপথে সিরাজগঞ্জ দখলের চেষ্টা চালায়। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন। পাকিস্তানি সেনারা ১১ এপ্রিলের মধ্যে পাবনা জেলা পুনরায় দখল করে নিলেও তখন পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দখলে ছিল। সিরাজগঞ্জ তথা উত্তরবঙ্গে প্রবেশের একমাত্র প্রধান রাস্তা ছিল আরিচা-নগরবাড়ি ঘাট দিয়ে।

সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা যেন প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য মহকুমা প্রশাসকের নির্দেশে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় মোজাফ্ফর হোসেন, গোলাম কিবরিয়া, সোহরাব হোসেন এবং আবদুল লতিফ মির্জাসহ প্রায় ১৫০ জনের একটি দল প্রায় ১০০টি বিভিন্ন রকমের অস্ত্র নিয়ে বাঘাবাড়িতে বাংকার করে প্রতিরোধ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

পরে মহকুমা প্রশাসক, ইপিআর, আনসার, পুলিশ, বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরো প্রায় ১০০ জন যোদ্ধাকে বাঘাবাড়ি ঘাটে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য পাঠান। এদিকে উল্লাপাড়ার আওয়ামী লীগ নেতা এমপিএ অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন এবং শাহজাদপুরের এমএনএ আবদুর রহমানও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাঘাবাড়ির এই বড়াল নদীর পাড়ে ২০০গজ পর পর পাকা … প্রায় দুই মাইল পর্যন্ত খনন করা হয়।

পাশাপাশি বড়াল নদীর এই ঘাটে সেসময় সেতু না থাকায় স্থানীয় জনসাধারণ সবধরণের নৌকা সরিয়ে ফেলে। যেন প্রত্যন্ত গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা সহজেই প্রবেশ করতে না পারে। ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বাঘাবাড়ি ঘাটের পূর্ব পাড়ে এসে পৌছিলে মহকুমা প্রশাসকের নির্দেশে প্রতিরোধ যোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করে। নদীর পূর্ব পাড় থেকে পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।

কিন্তু প্রতিরোধ যোদ্ধারা সুসংগঠিতভাবে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলায় পাকিস্তানি সেনারা সহজেই নদী পার হতে পারেনি। এই যুদ্ধে প্রায় ২০০ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পরিস্থিতি পাকিস্তানি সেনাদের অনুকূলে না থাকায় একটি অংশ দিক পরিবর্তন করে চলে যায় পাবনাতে। অন্য অংশ শাহজাদপুরকে লক্ষ্য করে শেলিং শুরু করে। ফলে বাঘাবাড়ি ও শাহজাদপুর থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধাগণ পিছু হটতে বাধ্য হয়।

এই পরিস্থিতেতে ২২ এপ্রিল বাঘাবাড়ি ও শাহজাদপুরের পতন ঘটে। ২১

 

ঘাটিনা ব্রিজ প্রতিরোধ যুদ্ধ :

ঘাটিনা ব্রিজ প্রতিরোধ উল্লাপাড়া থানা তথা সিরাজগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ। ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা সড়কপথে সিরাজগঞ্জে প্রবেশের চেষ্টা করলে প্রথমেই বাধা পায় বাঘাবাড়ি ঘাটে। ফলে পাকিস্তানি সেনারা গতিপথ পরিবর্তন করে বাঘাবাড়ি ঘাট থেকে পাবনা হয়ে ঈশ্বরদী রেলস্টেশন থেকে ট্রেনযোগে সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করার পরিকল্পনা করে।

২৩ এপ্রিল গভীর রাতে এই সংবাদটি সিরাজগঞ্জে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা পায়ে হেঁটে প্রায় ২২ কি. মি দূরে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথে করতোয়া নদীর উপর স্থাপিত উল্লাপাড়া থানার ঘাটিনা ব্রিজের পাশে শাহজাহানপুর গ্রামে এসে অবস্থান নেয়।

এই যুদ্ধে মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন এবং লতিফ মির্জা ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন-আবদুস সামাদ (রা.বি.-এর সাবেক জিএস), লুৎফর রহমান অরুণ, মোজাম, সেনাসদস্য হাবিবুল্লাহ, ভূঞাপুরের হাবিব, রবিউল গেরিলা, রহমান, বড়ঠুলের আজহার মাস্টার, আনোয়ার পাহাড়ী, মোস্তফা কামাল, ফজলুল মতিন মুক্তা, ফজলুল হক, নায়েব আলী, নূরুল ইসলাম এবং দশম শ্রেণির ছাত্র শামসুল আলমসহ ছাত্র-জনতা, পুলিশ, ইপিআর এবং বগুড়া ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা

বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর বিদ্রোহী কিছু বাঙালি সৈনিক। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাছে ছিল ৩০৩ রাইফেল, ৩টি চাইনিজ রাইফেল, কয়েকটি পুরাতন স্টেনগান ও একটি এলএমজি। গোলাবারুদের স্বল্পতার জন্য প্রতিরোধ যোদ্ধাগণ বেশ চিন্তিত ছিল।

২৪ এপ্রিল সকাল থেকে সবাই লাইনের অপসারণ, শাহজাহানপুর গ্রাম জুড়ে বাংকার খননসহ প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডে আশেপাশের চরঘাটিনা ঘাটিনা, মাটিকোরা, লক্ষ্মীপুর, কানসোনা, সলপ, রামগাতি এবং শাহজাহানপুরের শত শত উৎসাহী যুবক প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাহায্য করে। বেলা ১২টার দিকে আশেপাশের গ্রামবাসীদের ডেকে মহকুমা প্রশাসক এবং লতিফ মির্জা যেকোনো বিপদ মোকাবেলায় আহবান জানান এবং অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

গ্রামবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা, পরিখা খনন এবং খাবার সরবরাহ করে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাহস অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। শত শত পাকিস্তানি সেনা বহনকারী একটি ট্রেন ২৪ এপ্রিল বিকেল ৩টায় ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ ঘাটিনা ব্রিজের পশ্চিম তীরে এসে থেমে যায়। রেলব্রিজে মাইন বসানো থাকতে পারে ভেবে ইঞ্জিনের সামনে তারা দুটি মালবাহী বগি যুক্ত করে।

এর পর ১০/১২ জন পাকিস্তানি সেনা ব্রিজের অবস্থা দেখার জন্য নিজে নামার সঙ্গে সঙ্গে নদীর অপর তীর থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো একসঙ্গে গুলিবর্ষণ শুরু করে। অতর্কিত গুলিবর্ষণে পাকিস্তানি সেনা হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং প্রায় ১০/১২ জন পাকিস্তানি সেনা গুলিতে নিহত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাদের দিক থেকে শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ।

অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ চলে। কয়েক ঘণ্টার এই গুলিবর্ষণের আতঙ্কে ঘাটিনা ব্রিজের আশেপাশের গ্রামের হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বেলকুচি থানার দিকে রওয়ানা হয়। এসময় ৮/১০ জন শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। এক পর্যায়ে সন্ধ্যার আগেই পাকিস্তানি সেনারা গুলিবর্ষণ বন্ধ করে ফিরে যায় উল্লাপাড়া রেলস্টেশনে।

এদিকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের গোলাবারুদ শেষ হওয়ায় মহকুমা প্রশাসক সিরাজগঞ্জ থেকে রাতের মধ্যে গোলাবারুদ নিয়ে ফিরে আসেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনাদের পরবর্তী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে লতিফ মির্জা দলের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে কার্যক্রম নির্ধারিত করেন।

পরের দিন সকালে যোদ্ধাদের আশা ছিল পাকিস্তানি সেনারা আরো সুসজ্জিত হয়ে ঘাটিনা ব্রিজ দখলের চেষ্টা চালাবে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা উল্লাপাড়া স্টেশন থেকে প্রায় ৫ কি. মি দক্ষিণে গাড়াদহ বাজারে ৬ ইঞ্চি মর্টার শেলের সাহায্যে শেলিং শুরু করে শাহজাহানপুর গ্রামে অবস্থানরত প্রতিরোধ যোদ্ধাদের উপর।

বাংকারে অবস্থানরত প্রতিরোধ যোদ্ধাগণ প্রচণ্ড শেলিং-এর জন্য বেলা ১১টার দিকে নিরুপায় হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য অবস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলে পাকিস্তানি সেনারা ব্রিজে নতুন রেল বসিয়ে ট্রেন নিয়ে চলে আসে পশ্চিম পাড়ে। এ পাড়ে এসেই পাকিস্তানি সেনারা শুরু করে ধ্বংসলীলা।

ব্রিজের আশেপাশের শাহজাহানপুর, কর্মকারপাড়া, মাটিকোড়া, বেতকান্দি, লক্ষ্মীপুর গ্রামগুলিতে আগুন লাগানোর পাশাপাশি চালায় লুটপাট। এভাবে পাকিস্তানি সেনার দল রেললাইনের দুদিকের গ্রাম জ্বালিয়ে শত শত সাধারণ মানুষকে হত্যা করে ২৫ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে।

 

নাটোরে প্রতিরোধ যুদ্ধ :

২৫ মার্চ ঢাকায় সংঘটিত গণহত্যার খবর ২৬ মার্চ সকালে থানার ওয়ারলেসের মাধ্যমে নাটোরে এসে পৌছায়। এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদে স্থানীয় জনগণ হতচকিত হয়ে পড়ে। এদিন বিকেলে ছাত্রলীগের উদ্যোগে নিচাবাজার ছায়াবাণী সিনেমা হলের মোড়ে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে বক্তাগণ জনগণকে সাহসে বুক বেঁধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহবান জানান।

সভাশেষে এক বিরাট মিছিল সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে জনগণের সঙ্গে নিচাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশরাও যোগদান করে। ২৭ মার্চ নাটোর টাউন পার্কে মুক্তিকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন, পুলিশ, আনসারসহ সর্ব স্তরের জনগণের এক বিশাল সমাবেশ। অনুষ্ঠিত হয়।

নাটোরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে জনগণ লাঠি, তীর-ধনুক, ফলা, বল্লম এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে শহরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিল করে এই সমাবেশে যোগদান করে। এসময় অফিস-আদালত, দোকান ও বাড়িঘরে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার পতাকা। এই সমাবেশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

২৮ মার্চ নাটোরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক কামাল উদ্দিন মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলে তাদের মনোবল আরো বৃদ্ধি পায়। এদিনেই আন্দোলনরত নেতা-কর্মীগণ এক সভায় মিলিত হয়ে সর্বসম্মতিক্রমে নাটোর রাজবাড়ির দুটি কামান দিয়ে রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। নাটোর ছায়াবাণী চৌরঙ্গীতেই ব্যারিকেড দেওয়া হয়।

মুক্তিপাগল জনতা ওয়াগন ফেলে নাটোর রেলগেট বন্ধ করে দেয়। রাজশাহী-নাটোর রোডের ঝলমলিয়াতেও গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। ২৯ মার্চ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্পোরাল সাজেদুর রহমান নাটোর ট্রেজারি ভেঙে গোলাবারুদসহ প্রায় ২৫০টি রাইফেল সংগ্রহ করে জনগণ ও আনসারের মধ্যে বণ্টন করেন। ২৩ নাটোর জেলা সদরের বাইরে থানা পর্যায়েও ব্যাপক গণজাগরণ ঘটে।

গুরুদাসপুর থানায় মার্চের শুরু থেকেই ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, গঠন করা হয় সংগ্রাম পরিষদ। সিংড়া, বড়াইগ্রাম, লালপুর বাগাতিপাড়াতেও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য থানা ইউনিয়ন এমনকি কোথাও কোথাও গ্রামভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এভাবেই নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নাটোরের মুক্তিকামী পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২৪

 

ময়নার যুদ্ধ :

৩০ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একটি দল ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজশাহী থেকে নাটোর হয়ে পাবনার দিকে না এসে বানেশ্বর-চারঘাট-বাঘার রাস্তা ধরে অতি গোপনে গোপালপুর অতিক্রম করে মুলাডুলি যাওয়ার পথে লালাপুর থানার ওয়ালিয়ার ময়নার মাঠে জনগণের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।

রাজশাহী থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ভেতর পথে পাবনার দিকে অগ্রসর হয়েছে, এ সংবাদ পেয়ে ময়নার মতো একটি নিভৃত পল্লিতে যার যা আছে তাই নিয়ে মুক্তিকামী জনতা পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে আসে। উত্তর-পূর্ব থেকে নাটোর শহর, বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর; পশ্চিমে বাঘা-চারঘাট এমনকি রাজশাহী থেকেও শত শত জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ময়না প্রান্তরে ছুটে আসে।

ময়নার মাঠে মুক্তিকামী জনতা পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘেরাও করেছে এ খবর পেয়ে নাটোরের মহকুমা প্রশাসক কামাল উদ্দিন অবহিত করেন জননেতা শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরীকে। মহকুমা প্রশাসককে শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধকারীদের সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করেন।

ফলশ্রুতিতে মহকুমা প্রশাসক প্রশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র রেখে সাজেদুর রহমান খান ও মহকুমা খাদ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (অব.) হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে অস্ত্রই শুধু নয়, কিছু সংখ্যক পুলিশ ও আনসার সদস্যকে একটি জিপ ও একটি ট্রাকে করে ময়নায় পাঠান প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য।

নায়েক বাবর আলী, আনসার কমান্ডার মেহের আলী, আনসার কমান্ডার মোজাম্মেল হোসেন, আনসার কমান্ডার গমেজ উদ্দিন, আনসার কমান্ডার জাফর আলী, পুলিশ কর্মকর্তা জাফর আহম্মেদসহ তার বাহিনীর কিছু সদস্য এবং ‘জয়বাংলা বাহিনীর’ বেশকিছু সদস্যকে নিয়ে একটি বিশাল সশস্ত্র বাহিনী ময়নার মাঠে প্রতিরোধকারী জনতার সঙ্গে মিলিত হলে প্রতিরোধ আরো জোরদার হয়ে ওঠে এই প্রতিরোধে ছুটি ভোগ করতে আসা কিছু সেনা সদস্যও অংশগ্রহণ করে। 1

এভাবে চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে প্রথমে কয়েক রাউণ্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ এবং পরে অবরোধকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। অবরোধকারীগণও তাদের গাদা বন্দুক ও জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা গুলিবর্ষণ করে জবাব দিতে থাকে।

পাকিস্তানি সেনারা যাতে পিছু হটতে না পারে, সেজন্য প্রতিরোধকারী একদল জনতা শাবল-কুড়াল-কোদাল ইত্যাদি দিয়ে হানাদারদের পেছনে নদীর উপরের ব্রিজটি ভাঙতে লেগে যায়। ইতোমধ্যে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাদের উদ্ধার করার জন্য আনুমানিক বিকেল তিনটের দিকে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য একটি যুদ্ধবিমান ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকে।

এতে অনেকেই হতাহত হলেও প্রতিরোধকারী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা যায়নি। ফিরে যায় যুদ্ধবিমান। এক সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলি ফুরিয়ে আসে। সারাদিন ও সারারাত্রি হানাদার বাহিনী অবরুদ্ধ থেকে কেউ কেউ ভোরবেলায় আত্মগোপন করে আখ ক্ষেতে। আবার কেউ কেউ আখক্ষেত থেকে পালিয়ে কারো বাড়িতে গিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করে।

এভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সদস্য জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। আর দু-চার জন পাকিস্তানি, যারা তাদের গাড়িতে শেষ পর্যন্ত থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল, তাদের গোলা-গুলি ফুরিয়ে গেলে প্রতিরোধকারীরা সেটা বুঝতে পেরে তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে এবং হাতেনাতে ধরে ফেলে।

এভাবে পাকিস্তানি সেনাদের অধিকাংশ সদস্য জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং জনরোষে মৃত্যুবরণ করে। আর সামান্য সংখ্যক আখক্ষেত-বন-জঙ্গল দিয়ে পালিয়ে রাজশাহী পৌঁছে আত্মরক্ষা করে। ময়নার এই যুদ্ধে ১৩/২১ জন প্রতিরোধ যোদ্ধা শহিদ হন। ২৫ ভিতরভাগ যুদ্ধ ১ এপ্রিল বাগাতিপাড়ার ভিতরভাগ নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দলের সঙ্গে প্রতিরোধকারী বীর জনতার এক সম্মুখ যুদ্ধ হয়।

আওয়ামী লীগ নেতা সাজেদুর রহমান খানের নেতৃত্বে নাটোরের বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীরা এই যুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। এছাড়াও এই যুদ্ধে আনসার কমান্ডার ইউসুফ আলী ও হাজী ওমর আলী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। দীর্ঘক্ষণ লড়াইয়ের পর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে যখন পালাতে ব্যস্ত, এসময় হাজী ওমর আলী তার শেল্টার থেকে মাথা উঁচু করে হানাদারদের অবস্থান দেখতে লাগলে হানাদারদের একজনের ছোঁড়া গুলিতে তিনি শহিদ হন।

এই ঘটনায় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রতিশোধস্পৃহা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায় এবং বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে হানাদারদের পরাজিত করে। ভিতরভাগের এই প্রতিরোধ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনার মৃত্যু ঘটে। অবশিষ্টরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। এতে সাধারণ জনগণের মনোবল অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। ২৫

ঝলমলিয়ার যুদ্ধ ও পাকিস্তানি বাহিনীর নাটোর দখল ১২ এপ্রিল অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল ঝলমলিয়া এসে পৌছিলে সকাল ১১টায় ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে একদল ইপিআর ও মুক্তিকামী জনতা হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী ও আধুনিক অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে প্রতিরোধ যোদ্ধাগণ পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৯জন সদস্য শহিদ হন। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী নাটোর শহর দখল করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৭

আরও পড়ুন:

 

তথ্যনির্দেশ :

১. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র নবম খণ্ড (ঢাকা: তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, জুন ১৯৮৪), পৃ. ৪৯২ (এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র দেখা হবে।); কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৬: জহুরুল ইসলাম বিশু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫% রণেশ মৈত্র, “মুক্তিযুদ্ধে পাবনা জেলা”, স্মৃতি অম্লান (মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তী স্মারক) (পাবনা জেলা প্রশাসন, মহান বিজয় দিবস, ১৯৯৬), পৃ. (নম্বর নাই); বড়ভাই (ছদ্ম নাম, মাহতাব উদ্দিন) (সম্প.), রাজশাহী বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি সমাবেশ-২০০৩: স্মরণিকা (রাজশাহী: কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ২০০৩), পৃ. ৪

২. রফিকুল ইসলাম বকুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪; কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৬-১৩৭, জহুরুল ইসলাম

৩. বিশু, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩-২৪, ৩১ ঐ, পৃ. ৩৫-৩৮, কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৭-১৩৯; রফিকুল ইসলাম বকুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪-৮৫।

8. রবিউল ইসলাম রবি, “পাবনা”, মুনতাসীর মামুন (সম্পা.), একাত্তরের বিজয় শাখা (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯২), পৃ. ১১০, কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯; মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৩), পৃ. ৮০; জহুরুল ইসলাম বিশু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬

৫. ঐ কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯: রবিউল ইসরাম রবি, “পাবনা”, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১: স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ৪৯২

৬. কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০-১৪১; মোহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫-২৬

৭. ঐ; রফিকুল ইসলাম বকুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫-৮৬: জহুরুল ইসলাম বিশু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭-৪০ কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০-১৪৩ ঐ, পৃ. ১৪৩

৮. শ্রী পূ. ১৪৫-১৪৭, রফিকুল ইসলাম বকুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬; জহুরুল ইসলাম বিশ্ব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০-৪২: স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ৪৯৩-৪৯৪; রণেশ মৈত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. (নম্বর নাই); শাহনাজ পারভিন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, পুনর্মুদ্রণ ২০১০), পৃ. ২৬৫ আবুল হোসেন খোকন, জনযুদ্ধের দিনগুলি (ঢাকা: জাগৃতি প্রকাশনী, ২০১২), পৃ. ২৯-৩০

১০. ঐ, পৃ. ৩০-৩১; রণেশ মৈত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. (নম্বর নাই); রফিকুল ইসলাম বকুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০ জহুরুল ইসলাম বিশু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩; কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৭-১৪৮ ১১. আবুল হোসেন খোকন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০-৩১ ১২. ঐ, পৃ. ৩৩-৩৪: স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ৪৯৫-৪৯৬, কামরুন্নাহার, প্রাবক, পূ

১৪৮-১৪৯; রণেশ মৈত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. (নম্বর নাই); রফিকুল ইসলাম বকুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬-৮ জহুরুল ইসলাম বিশু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪

১৩. ঐ, পৃ. ৪৪-৪৫: আবুল কালাম আজাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০-২২: কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৯ — ১৫১; রণেশ মৈত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. (নম্বর নাই); আবুল হোসেন খোকন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪-৩৫ ১৪. বিস্তারিত দেখুন, ঐ, পৃ. ৩৫-৩৯; আবুল কালাম আজাদ, প্রাক্ত, পৃ. ১৬; কামরুন্নাহার, প্রাগুক, পৃ. ১৭০-১৭১; মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮১, রণেশ মৈত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ( নাই); জহুরুল ইসলাম বিশু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯-৫০: রফিকুল ইসলাম বকুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭; মো.

ছাবেদ আলী, “পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর”, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি: ষোড়শ দ্বি-বার্ষিক

জাতীয় সম্মেলন (বগুড়া ২৯-৩০ এপ্রিল ২০১০), পঠিত প্রবন্ধ

১৫. বিস্তারিত দেখুন, ঐ; কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৩-১৭৫; মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি,

প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৯: রণেশ মৈত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. (নম্বর নাই); জহুরুল ইসলাম বিশু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১-৫৭

রফিকুল ইসলাম বকুল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭ ১৬. ঐ, পৃ. ১৫৭-১৫৮; স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ৪৯৭ ১৭. কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৮-১৬০

১৮. ঐ, পৃ. ১৬০-১৬২

১৯, ঐ, পৃ. ১৬১-১৬২; স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ৫০০-৫০১

২০. কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৬-১৫৭: খ ম আখতার হোসেন, “স্মৃতির দর্পনে মোহন”, সলিমুল্লাহ খান (সম্পা.), সাহসী মানুষ (ঢাকা: মিজান পাবলিশার্স, ২০০৮), পৃ.৪৬৪ ২১. কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৯-১৯০; স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ৪৯৭-৫০৩ ২২. কামরুন্নাহার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০-১৯২

২৩. ঐ, পৃ. ২১২-২১৩; রণেন্দ চন্দ্র রায় ও এম. জাহিদুল হক ফরহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮-৪৯ ২৪. বিস্তারিত দেখুন, সুজিত সরকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৬-১৩৮ ২৫. বিস্তারিত দেখুন, ঐ, পৃ. ১৪৩-১৪৮: । চন্দ্র রায় ও এম. জাহিদুল হক ফরহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯

২৬. সুজিত সরকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৮-১৪৯ ২৭. বিস্তারিত দেখুন, সুজিত সরকার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৯-১৭০; রণেন্দ চন্দ্র রায় ও এম. জাহিদুল হক ফরহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯-৫০

Leave a Comment