প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ – মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম

প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ : ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনের ফলাফল যে এমন দাঁড়াবে তা কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কখনো ধারণাও করেনি। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর পরই তারা পরিকল্পনা করতে থাকে কীভাবে বাঙালিদের সরকার গঠনে বাধা দেওয়া যায়। পরিশেষে তারা বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই ‘৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অবাঙালি সেনা এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। তারা ভেবেছিল অস্ত্রবলেই তারা বাঙালিদের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিতে পারবে।

প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ - মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম
মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তখন নিরস্ত্র বাঙালিদের কোনো গণনার মধ্যেই ধরেনি। তারা শুধু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সশস্ত্র বাঙালিদের নিয়েই শঙ্কিত ছিল। সেসব সশস্ত্র লোকদের মধ্যে ছিল পাঁচটি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন রেজিমেন্ট। যার সর্বমোট লোকসংখ্যা ছিল খুব বেশি হলে চার হাজার, ইস্ট বেঙ্গল সেন্টারে প্রশিক্ষণরত প্রায় আড়াই হাজার; আট থেকে দশ হাজার ইপিআরের বাঙালি সৈন্য এবং দশ থেকে বারো হাজার পুলিশ। সশস্ত্র বাঙালি বলতে এই ছিল লোকসংখ্যা, যা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে গণনা করা যায়।

এই সশস্ত্র শক্তি তখন যদি কোনো এক জায়গায় থাকত কিংবা একত্রিত করা যেত, তাহলে নিশ্চয়ই সেই শক্তি পাকিস্তানিদের জন্য দারুণ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু এই শক্তিকে তখনই একত্রিত করা সম্ভব ছিল না, কারণ পাকিস্তানিরা প্রত্যেকটি বাঙালি ইউনিটকে ছোটো ছোটো অংশে বিভক্ত করে দূর দূরান্তে নিয়োগ করে রেখেছিল। যাতে করে প্রত্যেকটি ইউনিটই এককভাবে শক্তিশালী থাকতে না পারে।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, 7th March
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, 7th March

একদিকে আমাদেরকে ছোটো ছোটো অংশে বিভক্ত করে নিয়োগ করা হয় আর অন্যদিকে পাকিস্তানিরা তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রত্যেকটি সেনানিবাসে উর্দুভাষী সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে। পাকিস্তানিদের এই প্রস্তুতি শুরু হয় ‘৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই। ইতোমধ্যে আমরা যারা বাঙালি, আমরা তখন উর্দুভাষী পাকিস্তানিদের নিকট বোধহয় বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। কারণ, ঢাকাতে তখন যেসব কনফারেন্স হতো সেসব কনফারেন্সে বাঙালি অফিসারদের ডাকা হতো না। বরঞ্চ আমাদের অধীনস্থ উর্দুভাষী জুনিয়র অফিসারদেরকে সেসব কনফারেন্সে ডাকা হতো।

বাঙালি অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া শুরু হয়। সেই সময় ঢাকা ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর ছিল মেজর খালেদ। খালেদকে ২৫ মার্চের আগেই ব্রিগেড মেজর থেকে সরিয়ে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে থাকার কারণে এই ব্যাটালিয়নটি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

আমি তখন জয়দেবপুরে অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন কমান্ড। ২৭ ফেব্রুয়ারিতেই আমার ব্যাটালিয়নকে ছোটো ছোটো ভাগে ভাগ করা হয়। এই ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানিকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহে। অপর কোম্পানি টাঙ্গাইলে। আমাকে এই দুটি কোম্পানির অধিনায়ক করে টাঙ্গাইলে রাখা হয়। আমার হেড কোয়ার্টার স্থাপিত হয় টাঙ্গাইলে। আমার জন্য নির্দেশ ছিল, ভারত যদি ময়মনসিংহের দিক থেকে আক্রমণ চালায়, তাহলে আমি যেন সেই দুই কোম্পানি নিয়ে ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করতে যাই। দুই কোম্পানি দিয়ে ভারতের আক্রমণ প্রতিহত করা প্রহসন ছাড়া আর কী হতে পারে। পাকিস্তানিরাও আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ে খুশি এবং আমরাও বুঝে নিয়েছি এটি কেন করা হয়েছে।

পাবনায় প্রতিরোধ যুদ্ধ ২
পাবনায় প্রতিরোধ যুদ্ধ

 

দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল অর্থাৎ আমার ব্যাটালিয়ন যাতে একসাথে থাকতে না পারে, সেজন্যই ছিল এ ব্যবস্থা। এই রকম যখন পরিস্থিতি, তখন ১ মার্চ খালেদ ঢাকা সেনানিবাসে আমার বাসায় আসে। খালেদ তখন ঢাকা ব্রিগেডের বিএম (ব্রিগেড মেজর)। সে আমাকে বলতে এসেছিল, বাঙালি সশস্ত্র সৈনিকদের নিরস্ত্র করার এক পরিকল্পনা চলছে, সে আমার কাছে জানতে চায়, তাই যদি হয় তাহলে আমাদের কী করণীয় আছে। আমি তখন তাকে বলেছিলাম অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছি অস্ত্র পরিচালনার জন্য, অস্ত্র সমর্পণের জন্য নয়। আমাকে নিরস্ত্র করতে হলে তাদের বল প্রয়োগ করতে হবে। স্বেচ্ছায় আমি অস্ত্র দিয়ে দিচ্ছি না। সেদিন খালেদ বলেছিল, আমি তোমার কাছ থেকে এই উত্তর পাবো আশা করেই এসেছিলাম, আর আমিও তোমার সাথে একমত।

এর পর পরই আমরা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। এদিনই ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া খানের এই সিদ্ধান্ত জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তাই সমগ্র বাঙালি জাতি প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু সেদিন ইয়াহিয়া খানের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য আহ্বান জানান এবং হুঁশিয়ার করে দেন যে, এর থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতির দায়ভার তাকেই গ্রহণ করতে হবে। ইয়াহিয়ার কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সেই ডাকে সমগ্র বাঙালি জাতি সাড়া দেয়। সেদিন থেকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের একচ্ছত্র সম্রাট। রাষ্ট্র পরিচালনা সেদিন থেকেই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে।

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের আয়ত্তে ছিল শুধু অবাঙালি সেনা ছাউনিগুলো। আমরা যারা তখন সশস্ত্রবাহিনীতে ছিলাম, আমাদের অবস্থা তখন ছিল অত্যন্ত নাজুক। আমরা না পারছিলাম সরকারকে সমর্থন করতে আর না পারছিলাম অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে। সেই একাত্মতা প্রকাশ ছিল। রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। তাই এই নাজুক পরিস্থিতিতে আমরা কোন পথে পা রাখব, এই সিদ্ধান্তে আসতে আমরা ছিলাম দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ, রাষ্ট্রদ্রোহিতার সাজা যে মৃত্যুদণ্ড তা আমাদের অজানা ছিল না।

পাবনার ঐতিহাসিক শানির দিয়াড়ে মুক্তিযুদ্ধ Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

চিন্তা-ভাবনার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, আমরা বিদ্রোহ করব, কিন্তু দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দৃশ্যপটে যে শক্তি কাজ করেছে এবং যার অনুপ্রেরণায় বিদ্রোহ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতেও আমরা দ্বিধাবোধ করিনি, সে শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। আমরা স্থির করেছিলাম যে, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করব এবং সময়মতো আমাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করব। এখানে বলা দরকার, বাঙালি সশস্ত্রবাহিনীর লোকজন কে কোথায়। আমার ব্যাটালিয়নের কথা তো পূর্বেই বলেছি। ১ম ইস্ট বেঙ্গল যশোর থেকে প্রায় ৩০ মাইল বাইরে গ্রীষ্মকালীন Exercise ( সামরিক প্রশিক্ষণ মহড়া) করছিল। ৩য় ইস্ট বেঙ্গল ছিল রংপুরের সৈয়দপুরে। তার একটি কোম্পানি পাঠানো হয় ফুলবাড়ীতে আর এক কোম্পানি ঘোড়াঘাট।

৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল ছিল কুমিল্লাতে, তার দুই কোম্পানি পাঠানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবং পরবর্তী সময়ে আর এক কোম্পানি দিয়ে খালেদকে পাঠানো হয় শমশেরনগরে। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিয়দংশ চলে যায় তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ব্যাটালিয়নটি পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য ষোলশহরে (চট্টগ্রাম) অপেক্ষা করছিল। ইপিআর-এর প্রায় সবাই সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে। অল্প কিছু সৈন্য ছিল ঢাকা হেড কোয়ার্টারে। এই তো ছিল বাঙালি সশস্ত্রবাহিনীর অবস্থা। কিন্তু তার বিপরীতে চিটাগাং ছাড়া প্রত্যেকটি ছাউনিতে উর্দুভাষী সৈনিকদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত ব্যাপক।

২৫ মার্চের মধ্যে প্রত্যেকটি ছাউনিতে বাঙালি-পাকিস্তানি সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে Ratio হয়েছিল। কোথায় ১:৩, কোথাও ১:৪ এবং কোথাও ১:৬, কোথাও ব্যবধান অনেক বেশি। এই Ratio নিয়ে আমরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। যদিও পাকিস্তানিরা সৈন্যসংখ্যায় অস্ত্রশস্ত্রে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু আমাদের মনোবল ছিল তাদের চেয়ে অনেক বেশি এবং জনগণ ছিল আমাদের সাথে। তাই আমরা কখনো তাদের ভয় পাইনি।

৩ মার্চ আমি আমার হেড কোয়ার্টার টাঙ্গাইলে ছিলাম। সেদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা আমার হেড কোয়ার্টারে কালো পতাকা উত্তোলন করতে আসে। যা করতে আমি বাধা দিইনি। আমার হেড কোয়ার্টারে তখন দুজন পাকিস্তানি অফিসার ছিল। তারা এর প্রতিবাদ করে এবং আমার কাছে আসে। আমি তখন তাদের বলেছিলাম, অস্ত্রের দ্বারা বল প্রয়োগ ব্যতিরেকে তোমরা যদি তাদের বাধা দিতে পারো তাহলে দাও, কিন্তু তা হবার ছিল না বলেই তারা আর উচ্চবাচ্য করেনি। এই কোম্পানির বাঙালি সদস্যরা কিন্তু এই পরিস্থিতি আনন্দের সাথে উপভোগ করেছে।

রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ
রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ

 

সেদিন টাঙ্গাইলে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এক জনসমাবেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বলেন যে, আগামী ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং এই পতাকাই হবে সেই স্বাধীন বাংলার পতাকা।

আমরা তাই অপেক্ষা করছিলাম ৭ মার্চের ভাষণের জন্য। ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য খুব কম হলেও ৮ থেকে ৯ লাখ লোকের সমাবেশ হয়েছিল। সেদিন ঢাকা সেনা ছাউনিতেও কম তৎপরতা ছিল না।

টিক্কা খান সেনা ছাউনির এক প্রান্তে বসে সবকিছু পর্যালোচনা করে পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে রাখার পরিকল্পনা করছিল। দুটি ফিল্ড রেজিমেন্টের ৭টা কামান রেসকোর্স ময়দানের দিকে তাক করে বসেছিল। কামানগুলো লোডেড। চারটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন রণসাজে সজ্জিত। ট্যাঙ্কগুলো আক্রমণের জন্য তৈরি। যুদ্ধবিমানগুলো ককপিট রেডিনেসে প্রস্তুত। সবাই নির্দেশের অপেক্ষায়। সেদিন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসেন। খুব কম কথায় তাঁর ভাষণ দেন। কিন্তু তাঁর ভাষণ ছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গে ভরা। প্রত্যেকটি বাক্যের মধ্যে ছিল নির্দেশনা। কিন্তু তাঁর ভাষণ বেভার প্রচারে বাধাগ্রস্ত করা হয়। আমি তখন টাঙ্গাইলে। হঠাৎ করে বেতার প্রচারণা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি।

বঙ্গবন্ধু কি সত্যি সত্যিই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন, আর দিয়ে থাকলে ঢাকার পরিস্থিতি কী? যদি তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা না-ই দিয়ে থাকেন, তাহলে এই প্রচার বন্ধ হলো কেন? এদিকে আমার সৈন্যরা বিদ্রোহ করার জন্য তখনই প্রস্তুত। আমি তাদের এই বলে শান্ত করি যে, ঢাকার খবর না জেনে আমাদের কিছু করা সমীচীন হবে না। তাই অপেক্ষা করি খবরের। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পরের দিন প্রচার হয় এবং সেই প্রচারিত ভাষণেই আমরা সমস্ত নির্দেশনা খুঁজে পাই।

যদিও সেদিন তিনি প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, কিন্তু পরোক্ষভাবে সব কথাই বলেছিলেন। সেদিন তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন—’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি এও বলেছিলেন তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ শুনে এবং সেদিনের গণসমাবেশ দেখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর টনক নড়ে। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানিদের সৈন্য সমাবেশ সম্পূর্ণ হয়নি। তাই ইয়াহিয়া খান তখন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সংলাপের প্রস্তাব দেয়। বঙ্গবন্ধুও তা মেনে নেন। শুরু হয় আলোচনা। কিন্তু পর্দার আড়ালে সৈন্য সমাবেশ দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। চট্টগ্রামে যেখানে পাকিস্তানিদের সৈন্যসংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। ২৫ মার্চের আগেই সেখানেও সমরাস্ত্র বোঝাই এবং অনেক সৈন্য নিয়ে এমডি সোয়াত নোঙর গাড়ে। এই আলাপ-আলোচনাকালে ১৯ মার্চের ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে অংশটি জয়দেবপুরে ছিল, তাদের নিরস্ত্র করার এক প্রয়াস নিয়েছিল।

রংপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু
রংপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু

 

ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেবের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একদল সৈন্য আসছে – এই খবরে সর্ব স্তরের জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দেয়। এসময় গাজীপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অগ্রসরমান পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। জনতা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধকল্পে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রাস্তায় বহু সংখ্যক ব্যারিকেড তৈরি করে। ছাত্র-জনতা জয়দেবপুর লেভেল ক্রসিংয়ে মালগাড়ির ওয়াগন ফেলে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু সেদিন সৈন্যদের মনোভাব ও আমাদের প্রস্তুতি দেখে আর বেশি আগাতে সাহস পায়নি।

সেদিন পরিস্থিতি আর একটু বাড়লেই, সেদিনই হয়ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। তখন বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের আলাপ-আলোচনা চলছিল। যদিও এই আলোচনা ছিল এক প্রহসন, তবুও আমরা চাইনি যে, পাকিস্তানিদের ওপর আঘাত আমাদের তরফ থেকে প্রথম আসুক। ঢাকা ব্রিগেড হয়ত এমনই একটি পরিস্থিতির জন্য উস্কানি দিচ্ছিল যাতে আমরা তাদের ওপর প্রবল আঘাত হানি। যাতে করে তারা তাদের পরবর্তী পরিকল্পনার বৈধতা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারে। আমিও তাদের এই উস্কানিতে সাড়া দিতে ইচ্ছুক ছিলাম না। আমরা চেয়েছি, তারা আমাদের ওপর প্রথম আঘাত হানুক, সেজন্য আমরাও ছিলাম প্রস্তুত।

২৫ মার্চের কালরাত্রিতে মার্শাল রেইস বলে খ্যাত পাকিস্তানি হায়েনারা নিরস্ত্র নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, যশোর ও কুমিল্লাতে দু-তিনদিন ধরে একনাগাড়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাঙালি জাতি প্রথম ধাক্কায় একটু বিভ্রান্ত হলেও নিজেদের সামলিয়ে নেয় এবং প্রতিরোধের ব্যূহ গড়ে তুলতে থাকে। আমরা বাঙালিরা যারা সশস্ত্রবাহিনীতে ছিলাম, আমাদের একে অপরের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, সবাই প্রায় একই সময় বিদ্রোহ করে পক্ষ পরিবর্তন করে বিদ্রোহ করার যে সিদ্ধান্ত, এই সিদ্ধান্ত কিন্তু কেউ হঠাৎ করে নেয়নি। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই। বিদ্রোহের পর আমরা ময়মনসিংহে একত্রিত হই এবং সেখান থেকেই পরবর্তী সময়ে শুরু করি আমাদের কাজকর্ম।

এরপর আমরা যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করি। ময়মনসিংহে পৌঁছার পরেই আমি ঢাকা আক্রমণ করার কথা ভাবি। ঢাকা আক্রমণের প্রধান কারণ ছিল ঢাকায় পাকিস্তানিরা তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পর তারা তাদের সৈন্যদের অন্যত্র পাঠাবার জন্য তৈরি হবে। আমরাও বাঙালি, আমাদের শিরায় ও উপশিরায় বইছে বাঙালি রক্ত। তাই বাঙালি জাতি যখন জেগে উঠেছে, আমরা তো আর ঘুমিয়ে থাকতে পারি না।

যেই লোকটি বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করার উদ্যোগ নিয়েছিল, আজ যদি সেই লোকটির কথা আমরা স্মরণ না করি তাহলে জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ— এই পরিচিতিই আমাদের থাকবে। আমি অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে চাই, সেই মহান নেতা আর কেউ না, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই অনুপ্রেরণায় সেদিন আমরা বিদ্রোহ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধাবোধ করিনি।

[ প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ – মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম ]

আরও পড়ুন:

Leave a Comment