বাংলাদেশের উৎসব রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। মানুষ স্বভাবতই আনন্দকামী। এই আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা উৎসব-পার্বণ। বংশপরম্পরায় মানুষের মাঝে চলে এসেছে তাদের এই উৎসব-আনন্দ উদযাপনের ধারা। বাঙালির হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অফুরন্ত উৎসব-আনন্দের উৎস এবং অনাবিল সুখের ধারা।
Table of Contents
বাংলাদেশের উৎসব
প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ আনন্দধারাকে বাংলাদেশের মানুষ সব সময় প্রাণভরে উপভোগ করেছে। কখনো পারিবারিক পরিমণ্ডলে, কখনো ক্ষুদ্র গোত্রের পরিসীমায়, আবার কখনো তা সমাজের সর্বস্তরে হয়েছে জনপ্রিয়। এভাবে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়- আনুষ্ঠানিকতা এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছার ফলে আমরা পেয়েছি অনেক উৎসব, যেগুলোর কিছু কিছু বিকশিত হতে হতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে আনন্দ উপভোগের বিশেষ উপলক্ষ হয়ে আছে।
কিছু কিছু আবার ক্ষয়িষ্ণু দশায় পড়ে বিলুপ্ত প্রায়। কিন্তু তারপরও দেশের নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এখনো বিভিন্ন উৎসব প্রচলিত আছে, যেগুলো আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির পরিচায়ক।
বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসব প্রকৃতি, পরিবেশ, ধর্ম ও জীবনধারার প্রেক্ষাপটে উৎসবেও দেখা যায় নানা বৈচিত্র্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে রয়েছে দুই ঈদ, পূজা, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, বুদ্ধপূর্ণিমা আর পুণ্যাহ, হালখাতার মতো এক কালের ব্যাপকভাবে প্রিয় উৎস।
ঈদুল ফিতর :
বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমানদের ঈদ উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদুল ফিতর আসে রমজানের এক মাস কঠোর সংযমের মধ্য দিয়ে। আগের দিন চাঁদ দেখা থেকে শুরু হয় এ উৎসবের আমেজ। দিনটি শুরু হয় দানের মধ্য দিয়ে। গরিব নিঃস্ব ব্যক্তিদের ফিতরা দেয়ার মাধ্যমে মুসলমানগণ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এবং আনন্দ সমান ভাগে ভাগ করার অনন্য নজির স্থাপন করেন।
ঈদের মাঠে সমবেত জনতার নামাজ শেষে কোলাকুলি করার অপরূপ দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের একত্র হওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ আসে ঐ দিনে। সারা দিন চলে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়ানো এবং বিচ্ছিন্নভাবে ছোটখাট খেলার আয়োজন। ঈদুল ফিতর অনেক সময় ধর্ম-গোত্র পেরিয়ে সমাজের সকল ধর্মের মানুষের অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।
ঈদুল আযহা :
ঈদুল আযহা মুসলমান জনগোষ্ঠীর আর একটি প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং উৎসব। এ উৎসবের মূলে রয়েছে আত্মত্যাগের এক মহান শিক্ষা। আল্লাহর প্রেমে নিজের পুত্রকে কোরবানি দেয়ার যে মানসিকতা দেখিয়েছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ), সেই ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েই মুসলমানগণ ঐ দিনে সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করেন এবং অন্যের প্রতি আতিথ্য প্রদর্শন করে অনাবিল সুখের সন্ধান পান। ভোগ নয় ত্যাগ, সকলের মাঝে একতা ও শান্তি এ মহান আদর্শকে সামনে রেখে এবং এ আদর্শে আমাদের উজ্জীবিত করেই প্রতি বছর আমাদের মাঝে আসে ঈদ উৎসবের এ দিনটি।
মহররম :
বাংলাদেশের আর একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হলো মহররম। ইতিহাসের এক বিষাদময় ঘটনাকে স্মরণ করে দিনটি উদযাপিত হয়। কারবালার ময়দানে নিষ্ঠুর এজিদের ঘৃণ্য কৌশলের কারণে ফোরাত নদীর অববাহিকায় হজরত আলী (রা)-এর পুত্র হজরত হোসেন (রা)-এর নিহত হওয়ার ঘটনাকে স্মরণ করে পালিত হয় এ দিন।
শিয়া জনগোষ্ঠী ঐ দিন মিছিল বের করেন, যাতে থাকে সাজানো তাজিয়া, দুলদুল ঘোড়া, নানা রঙের নিশান। ঐ দিন ঢাকার হোসেনি দালান থেকে এ বিশাল মিছিল বের হয়। তবে ‘সুন্নি’ মুসলমানদের নিকট এটি শুধুই শোকাবহ একটি দিন। এ দিনটি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলাও বসে ।
দুর্গাপূজা :
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। অশুরকে বধ করে জীবজগতকে দুর্গতির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন দুর্গা। তাই হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, তাকে ‘দুর্গা মা’ বলা হয় । বৈদিক যুগে যে শক্তিপূজা করা হতো তা-ই এই দুর্গাপূজা। শ্রী রামচন্দ্রও রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য দুর্গাপূজা করেছিলেন। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা হয় শরৎকালে।
তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এ পূজায় পশুবলি দান, দরিদ্র সেবা, অতিথি সেবা, সাধারণের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। সর্বস্তরের হিন্দু একযোগে দাঁড়িয়ে দুর্গার পায়ে ফুল দিয়ে সাম্যের বাণী প্রচার করেন। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এতে আনন্দ উপভোগ করেন। দুর্গাপূজার উৎসবের আমেজের মধ্যেও সাম্য, মৈত্রী ও শক্তি—এ তিন আদর্শের শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষ।
জন্মাষ্টমী :
জন্মাষ্টমী হিন্দু সম্প্রদায়ের আর একটি প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। শ্রাবণ বা ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এ উপলক্ষে ঐ দিন উপবাসে সাত জনমের পাপ মোচন হয়ে যায়। বলে বিশ্বাস করা হয়। ঐ দিনে মিছিলও বের হতো। তবে তা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মিছিল না থাকলেও বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল হিন্দু এ উৎসবে ভক্তি-আনন্দ এবং আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন।
বুদ্ধপূর্ণিমা :
বুদ্ধপূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বুদ্ধদেবের জন্ম গৃহত্যাগ, বুদ্ধত্ব লাভ, পরিনির্বাণ ও মহাপ্রয়াণ এ দিনেই ঘটেছিল বলে এই দিনটি বৌদ্ধদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র। বুদ্ধের শিক্ষা ও মহাবাণী স্মরণ করে মহাসমারোহে এ দিনটি পালিত হয়। তবে এ সমারোহে বাহ্যিক আড়ম্বরের চেয়ে বুদ্ধের শিক্ষার মাহাত্ম্যের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। বুদ্ধপূর্ণিমা ছাড়াও বৌদ্ধ সমাজের আর একটি বড় উৎসব হলো প্রবারণা ও কঠিন চীবর দান উৎসব।
বড়দিন :
বাংলাদেশের উৎসবের মধ্যে অন্যতম একটি হলো বড়দিন। খ্রিস্টান সমাজের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় এটি। খ্রিস্টের আবির্ভাব উপলক্ষে আনন্দ উপভোগ করাই এ দিনটি উদযাপনের মূল লক্ষ্য। এখন দিনটি ২৫ ডিসেম্বর পালিত হলেও এর আগে অন্যান্য তারিখেও পালিত হয়েছে। এ দিনটির বিশেষ দিকগুলোর মধ্যে রয়ে সাধ্য অনুযায়ী পোশাক পরিধান, প্রার্থনা, পান-ভোজন, উপহার ও শুভেচ্ছা বিনিময় এবং নাচগান। শিশুদের নিকট এ দিনটি বেশ আকর্ণিয়, কারণ সান্তা ক্লোসের মাধ্যমে তারা উপহার লাভ করে।
স্বাধীনতা দিবস :
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রাঙ্গণে উৎসবের আমেজ ফুটে ওঠে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার অনড় দাবিতে যে আন্দোলন পুঞ্জিভূত হয় তারই প্রেক্ষিতে আসে ২৬ মার্চের এক ভয়াল, নিদারুণ, নিষ্ঠুর সময়। ইয়াহিয়া খান পাক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয় সাধারণ জনগোষ্ঠীর ওপর। নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় তারা। ঐ রাতে যে যুদ্ধের সূচনা হয়, তার ফলে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বরের স্বাধীনতা অর্জনের সেই মহেন্দ্রক্ষণটি আমরা পাই। এ দিনটি সরকারি ছুটির দিন।
সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয় পতাকা এবং ব্যানার ফ্যাস্টুন দিয়ে সাজানো হয়। জেলখানা, হাসপাতাল, এতিমখানায় ভালো খাবার পরিবেশিত হয়। বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় বিশেষ সংখ্যা। সব মিলিয়ে স্বাধীনতা দিবসের উৎসব আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করি।
এই দিনটি তাই আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের দিন; ত্যাগ-তিতিক্ষার সৌরভ ছড়ানোর দিন। এই গৌরবান্বিত বিজয়কে স্মরণ করে প্রতি বছর একই দিনে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয় এ দিনটি। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল নিবেদন করে শ্রদ্ধা জানানো হয় মহান শহীদদের। আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ব্যাপকভাবে। দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে যায় উৎসবের আমেজ ।
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস:
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে একই সাথে আনন্দ ও বেদনার স্মৃতি, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অর্জনের ইতিহাস। মাতৃভাষার যথাযথ মর্যাদার দাবিতে ১৯৬২ সালে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত এই দিন বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিজের পরিচয় ও সত্তার মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক এ দিনটি লাভ করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা। ভাই শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হয় এই দিনটি। শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মধ্য দিয়ে দিনটি শুরু হয়ে দিনব্যাপী চলে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শোভাযাত্রা ও মিছিল। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন ।
পহেলা বৈশাখ :
বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎসবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য ও বিকাশমান উৎসব হলো বাংলা নববর্ষ। বাংলা বছরের প্রথম দিনে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মহাসমারোহে ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয় এবং নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া হয় । ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠান এবং এটি ইতিমধ্যেই সর্বজনীন রূপ পেয়েছে।
কৃষিকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে যেসব অনুষ্ঠান আগে প্রচলিত ছিল তারই নতুন এবং ব্যাপকতর রূপ এই পহেলা বৈশাখ। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এটি একটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হলে আরো নতুন মাত্রা যোগ হয় । এ উপলক্ষে ব্যবসায়ী মহল হালখাতা বা হিসাবের নতুন খাতা খোলেন । ভালো খাবারের আয়োজন করা হয় প্রায় সর্বত্রই। বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন স্থানে।
বৈশাখী মেলা বাংলা উৎসবের একটি বিশেষ দিক। এ দিনে রাস্তায় মানুষের ঢল নামে, চারদিকে থাকে উৎসবমুখর পরিবেশ। এতে আবার যুক্ত হয় অঞ্চলভিত্তিক অনুষ্ঠান, যেমন চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলা, রাজশাহীর গম্ভীরা, মুন্সিগঞ্জের গরু দৌড় প্রতিযোগিতা প্রভৃতি।
অন্যান্য উৎসব :
এছাড়াও পৌষপার্বণ উপলক্ষে আরো একবার উৎসবের ছোঁয়া লাগে বাংলাদেশের প্রতিটি আঙিনায়। মূলত পিঠার এ উৎসব বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। তবে এ উৎসব এখন আর ততো জোরালোভাবে পালিত হচ্ছে না। পৌষসংক্রান্তির ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতা রীতিমতো রোমাঞ্চিত করে প্রতিযোগী ও দর্শকদের। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত আছে আরো বহু উৎসব।
উপসংহার :
বাংলাদেশের উৎসবের তালিকা এভাবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে, যা আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরে। এই সমৃদ্ধি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দ ও গর্বের। এবং এগুলোকে রক্ষা করা ও বিশ্বের সামনে তুলে ধরা আমাদের সবার কর্তব্য।
আরও দেখুনঃ