বাংলাদেশের চামড়াশিল্প : চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের রপ্তানি আয়ে যে কয়টি খাতের অবদান রয়েছে তার মধ্যে চামড়া এবং চামড়াজাত দ্রব্য অন্যতম আমদানি নির্ভর বাংলাদেশে দেশীয় কাচামাল নির্ভর এ খাতের মূল্য সংযোজন ৮৫ শতাংশ। একমাত্র কিছু কেমিক্যাল ছাড়া এ শিল্পের সব কাঁচামাল দেশেই পাওয়া যায়। গবাদিপশুর চামড়ার ওপর নির্ভর করেই বিকাশ লাভ করেছে এসব শিল্প।
Table of Contents
বাংলাদেশের চামড়াশিল্প
সরকার চামড়া শিল্পকে ব্লাস্ট সেক্টর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বহুবিধ সমস্যা সত্ত্বেও বর্তমানে চামড়া খাত থেকে বছরে প্রায় ১২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আমদানি নির্ভর জাতীয় অর্থনীতিতে চামড়া শিল্পের সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে এ খাত থেকে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি আর অর্জন করা সম্ভব হবে, যা বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বিশেষ অবদান রাখবে।
বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের ইতিহাস
ব্রিটিশ শাসনামলে এ দেশে কোনো চামড়া শিল্প গড়ে উঠেনি। তখন এ দেশের চামড়া কাঁচামাল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ, কানপুর এবং মাদ্রাজে প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য পাঠানো হতো। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার এ দেশে চামড়া শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল এবং দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছিল একটি ঢাকার হাজারীবাগে অপরটি চট্টগ্রামের কালুরঘাটে।
১৯৪৯ সালে সরকারি পর্যায়ে এ দেশে চামড়া শিল্পের ওপর একটি ইনস্টিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু সে পরিকল্পনা কার্যকরি হয়নি। পরবর্তীতে উন্নতমানের শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৫০ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি-এর গোড়া পত্তন ঘটে।
১৯৫১ সালে আর পি সাহা নারায়ণগঞ্জে একটি ট্যানারি স্থাপন করেন। পরে ১৯৬০ সালে কতিপয় পাকিস্তানি চামড়া ব্যবসায়ীর উদ্যোগে ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় আধুনিক ট্যানারি স্থাপিত হয়। তখন দেশে স্থাপিত মোট ৫৫টি মাঝারি ও বড় আকারের ট্যানারির মধ্যে ৩০টির মালিক ছিলেন তারা।
আধুনিক ট্যানারি বলতে তখন ঐগুলোকেই বোঝাত। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প ধরনের ট্যানারির মালিক ছিলেন কিছু সংখ্যক বাঙালি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ৩০টি বড় ট্যানারি সরকার অধিগ্রহণ করে কিন্তু দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্য লোকসান হওয়ায় সেগুলোকে আবার ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছেড়ে দিতে হয়। বর্তমানে সারা দেশে ট্যানারির সংখ্যা ২০০টির ওপরে, এর মধ্যে ১৭০টি হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত।
সরকারের নীতি
রপ্তানি ক্ষেত্রে এ খাতের ব্যাপক সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে সরকার ১৯৭৭ সালে চামড়াশিল্পের উন্নয়নে মালিকদের উৎসাহ দেয়ার জন্য কিছু ক্যাশ সাবসিডি সুবিধা প্রদানের নীতি প্রবর্তন করেন। এ ব্যবস্থা উদ্যোক্তাদের দারুণভাবে উৎসাহিত করে। ফলে এ সময় দ্রুত এ সেক্টরের বিস্তৃতি ঘটে। সরকার রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ খাতে ঋণ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
এ সুযোগে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ট্রেড লাইসেন্স ও রপ্তানি লাইসেন্স সর্বস্ব সংরক্ষক কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এ ব্যবসায়ের জড়িত হয়। ভ্যালু এডিশন বৃদ্ধির জন্য ১৯৯০ সালের ১ জুলাই থেকে ওয়েট-ব্লু চামড়া রপ্তানি সরকার নিষিদ্ধ করে। এর উদ্দেশ্য হলো কাট ও ফিনিশড চামড়া রপ্তানি করে অধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা। ওয়েট-ব্লু চামড়া রপ্তানি করলে ভ্যালু এডিশন কম হয়।
অপরদিকে সরকার রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য মূলত দুভাবে ইনসেনটিভ (incentive) দেয়ার ব্যবস্থা হাতে নিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে ১. প্রত্যাহারকৃত শুল্ক (duty drawback) এবং ২. রপ্তানি কৃতিত্ব লাইসেন্স (export performence)।
পণ্য বৈচিত্র্য
দেশের অর্থনীতিতে চামড়াশিল্পের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য সামগ্রীর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য সামগ্রী তৈরি হচ্ছে যেমন জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, পার্স, ওয়ালেট, ট্রাভেল কিটস, ফুটওয়ার, জ্যাকেট, ৪ কোয়ার্টাল, ভাই লংকোট ওয়েট কোটি, হাফপ্যান্ট, ফুলপ্যান্ট, সুটকেস ফার্নিচার্স কভার, লেডিস ব্যাগ, মানিব্যাগ, ওয়েট ব্লু, ক্রাস্ট চামড়া, ফিনিশ চামড়া ইত্যাদি।
রপ্তানি প্রবণতার অগ্রগতি
চামড়াশিল্পের কাঁচামাল মূলত অন্যান্য শিল্পের বাই প্রোডাক্ট। ফলে এ শিল্পে ভ্যালু এডিশন অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অনেক বেশি। ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদার রপ্তানি করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব তার থেকে চারগুণ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চামড়াজাত পণ্য ও জুতাশিল্প স্থাপন এবং তা সফলভাবে রপ্তানি করলে অর্জন করা সম্ভব।
চামড়াজাত দ্রব্যের রপ্তানির অগ্রগতি সন্তোষজনক। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রধান প্রধান আমদানিকারক দেশসমূহ হচ্ছে হংকং, ইতালি, স্পেন, জাপান, তাইওয়ান, ফ্রান্স, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য। উল্লিখিত দেশসমূহের অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে আমাদের চামড়া শিল্প অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
রপ্তানি সমস্যা ও বাধাসমূহ
ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ শিল্প এখন বহু সমস্যায় জর্জরিত। চামড়া শিল্পে শুরু থেকে এ পর্যন্ত উদ্ভুত সমস্যাবলীর ধারাবাহিক বর্ণনা করা হলো
- সঠিক ও সময়োপযোগী নীতিমালার অভাব।
- কোটি কোটি বর্গফুট চামড়া পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
- আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আমাদের রপ্তানি ক্ষেত্রে কোনো কিছু পাস করাতে সময় লাগছে বলে আমরা ঠিকমতো শিপমেন্ট দিতে পারি না। তাই বিশ্ববাজারের সাথে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকে থাকতে পারছি না ।
- ব্যাংকগুলোর স্বচ্ছতার অভাব ও অসহযোগিতা এবং ঋণ মিস ব্যবহার হওয়াতে প্রকৃত চামড়া শিল্পের ব্যবসায়ী বা মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
- কাস্টমস সমস্যা
- দক্ষ শ্রমিকের অভাব ।
- ভালো টেকনিশিয়ানের অভাব।
- অনেক অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় প্রকৃত ব্যবসায়ীদেরকে অনেক খেসারত দিতে হচ্ছে। তারা ঘুষ দিয়ে ঋণ নিয়ে ব্যক্তিগত খাতে টাকা খরচ করে ।
- বকেয়া ব্যাংক ঋণ।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
দেশে প্রাপ্ত মোট চামড়ার প্রায় ৯৫ শতাংশ ফিনিসড ও ক্রাস্ট চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, গার্মেন্টস ইত্যাদি রূপে বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। এতে প্রায় ৮৫ ভাগ ভ্যালু এডিশন হয়। চামড়া শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬৫,০০০। সারা দেশে চামড়া আড়তদারের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। সারা দেশে চামড়া সংগ্রহকারী ফড়িয়ার সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ। বাংলাদেশের ভয়াবহ বেকার সমস্যা লাঘব করার ক্ষেত্রে এ শিল্প যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে এবং ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাবে আশা করা যাচ্ছে। চামড়া শিল্পের রপ্তানির বিষয়টি নিচে সারণীতে দেখানো হলো।
কতিপয় সুপারিশ
বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এবং বর্তমানে অত্যন্ত সংকটপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। এ সমস্যাবলীর সমাধানের জন্য বর্তমান অবস্থার নিরিখে কতিপয় সুপারিশ রাখা হলো –
- চামড়া শিল্পের জন্য সম্পূর্ণ আলাদাভাবে চামড়া নীতি প্রণয়ন করে আসল ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করতে হবে।
- হাজারীবাগ চামড়া শিল্প এলাকায় সরকারি উদ্যোগে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা প্রয়োজন ।
- তৈরি পোশাক শিল্পের মতো চামড়া শিল্পে নিয়োজিত রপ্তানিকারক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে নির্দিষ্ট হারে বিকল্প সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে।
- আমদানি ও রপ্তানি ক্ষেত্রে অগ্রিম ট্যাক্স আদায়ের নিয়ম বাতিল করে তাদেরকে কিছু বাড়তি সুবিধা দেয়া যেতে পারে।
- পিক আওয়ারে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল আদায় না করার বা ক্রয় হ্রাসমান হারে আদায়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
- সরাসরি চামড়া রপ্তানি বন্ধ করতে হবে। এতে মূল্য সংযোজন বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে।
- নতুন ট্যানারি স্থাপন না করে সরকারকে বরং বন্ধ ট্যানারিগুলোকে চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
- ক্রাস্ট ও ফিনিসড চামড়ার বাজারে টিকে থাকার লক্ষ্যে অধিক সংখ্যক চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের কারখানা গড়ে তোলা প্রয়োজন
- সরকার ও বিরোধী দলকে সহনশীল হতে হবে। কারণ আইন-শৃঙ্খলা ঠিক না থাকলে বৈদেশিক ক্রেতারা আকৃষ্ট হবে না ।
- গার্মেন্টস শিল্পের মতো চামড়া শিল্পকে উন্নয়ন করতে হলে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে চামড়া বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি রাখা এবং যে কোনো আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে ।
- নুতন নতুন বাজার সৃষ্টির তথা পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
- চামড়া ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ বা মূলধন নির্ভর শিল্প তাই ব্যাংকগুলো যেন সময়মতো চলতি মূলধন বা ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের যোগান দেয় সেদিকে নজর দিতে হবে।
- ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তরিত করে পরিকল্পিতভাবে ও সুবিধাজনক স্থানে চামড়া শিল্প স্থাপন করতে হবে।
- আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে তুলনা করে নীতি গ্রহণ করতে হবে।
- ব্যাংকগুলোকে চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
- চামড়া শিল্পের স্থায়ী ও টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হবে ।
- হাজারীবাগ এলাকা পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার লক্ষ্যে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্রজেক্ট হাতে নিতে হবে।

উপসংহার
আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রপ্তানি আয় বৃদ্ধির বিকল্প কোনো পথ নেই। চামড়া শিল্পকে একটি সম্ভাব্য রপ্তানিমুখী ও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চামড়া উৎপাদন ও বাজারজাত করার কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা একান্ত প্রয়োজন।
যেহেতু চামড়া শিল্প একটি রপ্তানি নির্ভর শিল্প সুতরাং এর আন্তর্জাতিক বিপণন বৃদ্ধির দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য মেলায় উপস্থিত হয়ে আমাদের চামড়ার গুণগতমান প্রদর্শন করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।
আরও দেখুনঃ