বাংলাদেশের চিংড়ি সম্পদ রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।
Table of Contents
বাংলাদেশের চিংড়ি সম্পদ
চিংড়ি একটি জনপ্রিয় খাদ্য। দেশে ও বিদেশে চিংড়ির ভালো বাজার রয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যসমূহের মধ্যে চিংড়ি অন্যতম। এ থেকে প্রতি বছর আয় হয় বহু কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা এবং কতিপয় ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান চিংড়ি সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানি করে। খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কয়েকটি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চিংড়ি চাষ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
বাংলাদেশে বর্তমান বিশ্বের মোট চিংড়ি উৎপাদনের ২.৫ শতাংশ উৎপাদিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে চিংড়ি খাত বাংলাদেশের দ্বিতীয় রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে ৮ প্রজাতির সামুদ্রিক চিংড়ি ও ১৫ প্রজাতির মিঠা পানির চিংড়ি পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া গেলেও লবণাক্ত পানির বাগদা চিংড়ি এবং মিঠা পানির গলদা চিংড়ি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত হচ্ছে। আর এ দু প্রজাতির চিংড়ি রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ তার রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ পাচ্ছে।
দেশের চিংড়ি খাতে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ জড়িত রয়েছে। গলদা ও বাগদা চিংড়ি রপ্তানি করে বছরে প্রায় ৩০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি আয় হচ্ছে। এর মধ্যে ২৪৩ মিলিয়ন ডলারই আয় হচ্ছে বাগদা রপ্তানি থেকে। দেশের জিডিপির ৪.৭০ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫.৬২ শতাংশ এই খাতের অবদান। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ শতাংশ এই খাতের সাথে সম্পৃক্ত থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে। কিন্তু বার বার এই রপ্তানি খাত সঙ্কটের মুখে পড়ছে।
চিংড়ি চাষ
বর্তমানে এক লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এসব জমি থেকে চিংড়ি উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার টন। অথচ থাইল্যান্ডে ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করে বছরে তিন লাখ ১৫ হাজার টন চিংড়ি উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি উৎপাদন মাত্র ২৫০ টন। অথচ ভারত ও থাইল্যান্ডে হেক্টর প্রতি চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে যথাক্রমে ৮০০ কেজি ও ২৩০০ কেজি। আমাদের দেশে চিংড়ি উৎপাদন স্থবির হয়ে আছে। রপ্তানি বাড়লেও উৎপাদন তেমন বাড়ছে না। গলদার উৎপাদন বাড়লেও বাগদার উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
বর্তমানে দেশে ৩৭ হাজার ৩৯৭ খামারে বাগদা চিংড়ির চাষ হচ্ছে। প্রত্যেক খামারের আয়তন প্রায় সাড়ে চার হেক্টর। এসব খামারে বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার টন। গত ১৫ বছর ধরে দেশে বাগদা উৎপাদন বার্ষিক ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে, বর্তমানে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে গলদা চিংড়ির চাষ হচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার গলদা খামার আছে।
এসব খামারে উৎপাদনের পরিমাণ সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী ১১ হাজার ৯৪২ টন। গলদা চাষ প্রতিবছর ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। দেশের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ চিংড়ি খাতের সাথে জড়িত রয়েছে। দেশে খুলনা ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। তবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, যশোর ও বাগেরহাট অঞ্চলেও ক্রমান্বয়ে চিংড়ি চাষ বাড়ছে।
চিংড়ি চাষ পদ্ধতি
বাংলাদেশে প্রথম ১৯২৯-৩০ সালে সুন্দরবন অঞ্চলে চিংড়ি চাষের সূচনা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় । পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক উপকূলীয় বন্যা প্রতিরোধ ও পানি নিষ্কাশন বাঁধ তৈরির পূর্বে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলে নদী সংলগ্ন এলাকার মাটির দের নিয়ে বা পাড় বেঁধে তৈরি পুকুরে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত খাদ্য থেকে চিংড়ি কয়েক মাসের মধ্যে বড় হলে তা সংগ্রহ করে বাজারজাতকরা হতো।
উপকূলীয় বাঁধ তৈরির পরপরই দেশের সনাতন চিংড়ি চাষ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সত্তর দশকের পর বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধের অভ্যন্তরে পুনরায় চিংড়ি চাষের সূচনা হয়। বস্তুত চিংড়ি চাষ এখনো বিজ্ঞানসম্মতভাবে চালু হয় নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে ঘেরে লালন-পালন করা হয়। খুলনা, বাগেরহাট, পাইকগাছা ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার, মহেষখালী, চকোরিয়া,
সুন্দরবন, কুতুবদিয়া ও টেকনাফে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। পানির লবণাক্ততার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের চিংড়ি চাষকে দুভাগে ভাগ করা হয়। যেমন— অল্পলোনা পানির চিংড়ি চাষ ও স্বাদু পানির চিংড়ি চাষ।
চিংড়ি পোনার হ্যাচারি শিল্প
বিগত ৬/৭ বছর আগেও দেশের চিংড়ি চাষ সাগর থেকে আহরণকৃত পোনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে সমুদ্র থেকে চিংড়ি পোনা আহরণের পাশাপাশি বর্তমানে বেসরকারি খাতে হ্যাচারির মাধ্যমে চিংড়ি পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। কক্সবাজার হচ্ছে হ্যাচারি শিল্পের প্রধান অঞ্চল। এ এলাকায় চিংড়ি পোনা উৎপাদনের জন্য এ পর্যন্ত প্রায় ৫৫টি হ্যাচারি স্থাপিত হয়েছে।
এসব হ্যাচারি থেকে বর্তমানে প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ কোটি চিংড়ি পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। তবে চাহিদার তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ গলদা পোনা হ্যাচারিগুলো সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে। দেশের উপকূলীয় জেলাসমূহ চিংড়ি খামারের অনুকূলে চাহিদাকৃত পোনা এসব হ্যাচারি থেকে যোগান দেয়া হচ্ছে। তবে হ্যাচারিগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ বাগদা পোনা সরবরাহ সত্ত্বেও স্থানীয় চিংড়ি ঘেরগুলো এ সামুদ্রিক চিংড়ি পোনা ব্যবহার করছে।
এর কারণ হচ্ছে সহজে এবং সুলভ মূল্যে এসব পোনা পাওয়া যায়। শিল্প সেক্টর টেকনিক্যাল রিভিউর মতে, কক্সবাজার জেলার ৭৩ শতাংশ ঘের মালিক, সাতক্ষীরা জেলার ২৩ শতাংশ ঘের মালিক, খুলনা জেলার ২৮ শতাংশ ঘের মালিক এবং বাগেরহাট জেলার ৪৫ শতাংশ ঘের মালিক হ্যাচারির পরিবর্তে আহৃত চিংড়ি পোনা ব্যবহার করছে ।
বর্তমানে হ্যাচারিগুলো কতিপয় হ্যাচারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ওই গ্রুপ হ্যাচারিগুলোকে চিংড়ি উৎপাদনের কোটা এবং বিক্রির মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে। ফলে হ্যাচারি শিল্পে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে না। মূল্যও প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে না। এ কারণে বড় সমস্যা হলো সুস্থ পোনা উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ
চিংড়ি রপ্তানিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এ কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৯টি। এর মধ্যে ৬০ ভাগ কারখানা খুলনায় এবং অবশিষ্ট ৪০ ভাগ কারখানা চট্টগ্রামে এবং ঢাকায় অবস্থিত। এ কারখানাগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৬৫টি কারখানা উৎপাদনে আছে। যার মধ্যে ৫৭টি ইউরোপীয় কমিশনের হ্যাসাপ ব্যবস্থা চালু করেছে।
এসব কারখানার প্রক্রিয়াকরণের ক্ষত বার্ষিক ২ লাখ ৬৫ হাজার টন। অথচ কারখানাগুলো প্রক্রিয়াকরণের জন্য বছরে মাত্র ৩০ হাজার টন চিংড়ি কাঁচামাল হিসেবে পায়। ফলে প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো চরম কাঁচামাল সঙ্কটে ভুগছে। কাঁচামালের অভাবে এসব কারখানার অর্ধেকেরও বেশি রুগ্ন হয়ে পড়ছে।
চিংড়ি খাতের সমস্যা পরিকল্পনা
যদিও এ শিল্পটি বর্তমানে অদক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সামাজিক ও পরিবেশগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। চিংড়ি রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও এ খাত লক্ষ্য ও দিক- নির্দেশনার অভাবে ভুগছে। এ শিল্পের জন্য এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এ খাতকে প্রতিযোগী করে তোলার জন্য একটি সমন্বিত কৌশলের। পাশাপাশি এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য এ খাতে ঝুঁকিসমূহ যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা।
বর্তমানে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের মধ্যে চিংড়ির অবদান শতকরা প্রায় ৮৬ ভাগ। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। ১৯৮৪-৮৫ সালে ৬৪ হাজার ২৪৬ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হতো। বর্তমানে এই চাষ এক লাখ ৪১ হাজার হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। চিংড়ি খামারের ওপর প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪ লাখ জনগোষ্ঠী জীবিকা নির্বাহ করছে।
বাংলাদেশে মূলত ষাটের দশকে প্রাকৃতিকভাবে চিংড়ি আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়। আশির দশকে চিংড়িকে ‘সাদা সোনা’ হিসেবে। অভিহিত করে দেশে চিংড়ি চাষকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এবং ১৯৮০-৮৫ সালের মধ্যে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে বার্ষিক চিংড়ি উৎপাদন এক লাখ ৩৬ হাজার টনে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয় ৷
কাঁচামালের এই আশ্বাস পেয়ে দেশে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৭৯-৮০ সালে ২৯টি কারখানা থেকে বর্তমানে ১২৮টি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপিত হয়। কিন্তু চিংড়ি উৎপাদনের সে লক্ষ্যমাত্রা আজও অর্জিত হয়নি। ফলে কাঁচামালের অভাবে বহু কারখানা পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে গেছে।
১৯৭২-৭৩ সালে মাত্র ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা রপ্তানি আয়ের মধ্য দিয়ে হিমায়িত খাদ্য শিল্পের যাত্রা। শুরু হয় এবং বর্তমানে এ খাতের রপ্তানি আয় প্রায় দু হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। চাষের মাধ্যমে বার্ষিক ৬৪ হাজার টন চিংড়ি উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সপ্তম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ খাতে সর্বোচ্চ গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৮ শতাংশ।
ভিশন ২০০৮
আগামী ২০০৮ সাল নাগাদ দেশের হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি ১০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ভিশন ২০০৮ নামে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। চিংড়ির উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিশ্ব বাজারে ব্যাপক রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এ লক্ষ্যে আধুনিক ও পরিবেশ সহায়ক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দু লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি আবাদের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ পরিমাণ জমিতে চিংড়ি আবাদ করে বার্ষিক চিংড়ির উৎপাদন দু লাখ ৫০ হাজার টনে উন্নীত করা হবে।
এজন্য দেশের প্রয়োজনীয় চিংড়ির পোনা বর্তমানে দেশের বিদ্যমান ৫৫টি হ্যাচারিতেই উৎপাদন করা সম্ভব। বর্তমানে দেশের ৫৫টি চিংড়ির হ্যাচারির উৎপাদন ক্ষমতা ৫০০ থেকে ৮০০ কোটি পোনা। এ পোনা দিয়েই বার্ষিক আড়াই লাখ টন চিংড়ি উৎপাদন করে রপ্তানির পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা সম্ভব।
বাংলাদেশ চিংড়ি উন্নয়ন অ্যালায়েন্স
দেশের চিংড়ি খাতকে সুগঠিত করার লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ ‘স্ক্রিম্প ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্স’। হ্যাচারি মালিক, চিংড়ি চাষী, চিংড়ি ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকের সমন্বয়ে এ অ্যালায়েন্স গঠন করা হয়েছে। তবে এখনও চিংড়ির সাথে সম্পৃক্ত সকল গ্রুপ এর সাথে যুক্ত হয়নি। এ সংগঠনের লক্ষ্য হচ্ছে চিংড়ি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবেশসম্মতভাবে চিংড়ি উৎপাদন, প্রসেসিং, প্যাকেজিংয়ের মান উন্নয়ন এবং মূল্য সংযোজন ও ব্রান্ড মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে চিংড়ি খাতকে প্রতিযোগিতামূলক করা এবং ট্রেসিবিলিটি ও হ্যাসাপের মাধ্যমে খাদ্য।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে এ অ্যালায়েন্স নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারের সহযোগিতায় এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু করেছে অ্যালায়েন্স। তবে অ্যালায়েন্সের লক্ষ্য পূরণের জন্য চিংড়ি খাতের সকল গ্রুপকে এ প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াতে হবে।
সবাই একত্রিত না হলে টিকে থাকা যাবে না। ট্রেন্সিবিলিটি না থাকলে ক্রেতাদের আস্থা পাওয়া যাবে না। ক্রেতারা এখন কমপ্লায়েন্স ইস্যুর প্রতি বেশি জোর দিচ্ছে। রপ্তানি ধরে রাখতে হলে এ কমপ্লায়েন্স পূরণ করতে হবে, বাড়াতে হবে রপ্তানিকৃত চিংড়ির খাদ্য নিরাপত্তা ।। এক্ষেত্রে এ অ্যালায়েন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সহজ শর্তে ঋণ
দেশের চিংড়ি চাষীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান প্রয়োজন। রপ্তানিকারকরা ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু যারা চিংড়ি উৎপাদন করছে তারা পাচ্ছে না। চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চাষীদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান প্রয়োজন। পাশাপাশি চাষীদের কমমূলো চিংড়ি পোনা সরবরাহ করতে হবে।
এজন্য হ্যাচারিগুলোকে সুবিধা দিতে হবে, যাতে তারা কম মূল্যে চিংড়ি পোনা বিক্রি করতে পারে। বর্তমান চিংড়ি খামারগুলো চিংড়ি উৎপাদনের জন্য ৯০ কোটি পোনা ব্যবহার করছে। এর মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি পোনার মাছ পাওয়া যাচ্ছে। অবশিষ্ট ৬০ কোটি পোনাই নানা কারণে মারা যাচ্ছে। এর মধ্য থেকে যদি আমরা ৬০ কোটি পোনারও মাছ উৎপাদন করতে পারি, তবেই আমাদের চিংড়ি রপ্তানি সাড়ে আট-নয় হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা অসম্ভব কিছু নয়। আগে যেখানে ইউরোপে শিপমেন্টকৃত কন্টেনারে কন্ট্রামিশন পাওয়া যেত, এখন তা অনেক কমে গেছে।
ফলে রপ্তানি বাড়ছে। এখন প্রয়োজন এ খাতের সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা সকল চাষী, সকল রপ্তানিকারক, সকল হ্যাচারি মালিককে অ্যালায়েন্সের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সকলে সংগঠিত থাকলে এ খাত থেকে বার্ষিক দশ হাজার কোটি টাকা রপ্তানি আয় অসম্ভব কিছু নয়।
পরিবেশগত ও আর্থ-সামাজিক প্রভাব
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিমায়িত চিংড়ি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। উপকূলীয় চিংড়ি চাষের খাত থেকেই পণ্যের সিংহভাগ আহরিত হয়। এতে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি মুক্ত জলাশয় থেকে চিংড়িপোনা ধরার কাজ এবং হিমায়িত চিংড়ি শিল্পগুলো হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের জন্য কোনো আচরণবিধি বা জাতীয় কর্মকৌশল না থাকায় উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি চাষ অনিয়ন্ত্রিত, অসমন্বিত ও অপরিকল্পিতভাবে অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। নিকট অতীতে চিংড়ি চাষের বিস্তৃতি খুবই লক্ষণীয় ১৯৮০ সালে যেখানে স্বল্পলোনা পানির পুকুরগুলোর সর্বমোট আয়তন ছিল ২০,০০০ হেক্টরেরও কম সেখানে ১৯৮৫ সালে আয়তন বেড়েছে 90,000 হেক্টর, ১৯৮৯ সালে ১,১৫,০০০ হেক্টর আর বর্তমানে প্রায় ১,৪৫,০০০ হেক্টর চিংড়ি খামার প্রধানত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত খুলনা ( ২৯%), সাতক্ষীরা (১৯%) ও বাগেরহাট (২৯%) জেলাগুলোতে এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রধানত কক্সবাজার জেলায় এবং বাকিগুলো অন্যান্য সমুদ্রোপকূলীয় জেলাসমূহে।
মানুষের বসতির ওপর প্রভাব
মানুষের বসতির ওপর প্রভাব এ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একই জমিতে গ্রীষ্মকালে (মার্চ-জুন) ও বর্ষাকালে (জুলাই-নভেম্বর) যথাক্রমে মাছচাষ ও ধানচাষ চলে আসছে। প্রভাবশালী ও বিত্তশালীরা দ্রুত চিংড়ি চাষ বাড়ালে স্থানীয় বাসিন্দা, চাষী, তৃণমূল নেতৃবৃন্দ, এতদঞ্চলে কর্মরত এনজিও ও স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা চিংড়ি চাষের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করেন।
চিংড়ি খামারের উদ্যোক্তা ও বড় চিংড়ি-ঘেরের জমির মালিকেরা ঘেরগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, ছোট জমির দরিদ্র মালিকেরা উদ্যোক্তাদের জমি ইজারা দেওয়ার বিনিময়ে অতি সামান্য অর্থ (হারি বলা হয়) লাভ করে । উদ্যোক্তারা একতরফা ইজারার মূল্য স্থির করে, যা সনাতনী পন্থায় এ জমিতে ধানচাষের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের এক ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।
সেখানে জমির অনেক অনুপস্থিত মালিক ‘হারি’র তোয়াক্কা করে না, ফলে ঘেরের মালিকরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থানীয় চাষীদের হারি দেওয়া বন্ধ রাখে। সরকারি জমির (খাস জমি) ইজারাদান পদ্ধতিও খুব স্বচ্ছ নয় এবং কেবল বিত্তবান, ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই এ ধরনের জমির ইজারা পাওয়ার সামর্থ্য রাখে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বড় বড় ঘের তৈরির জন্য ছোট জমির মালিকদের সমবায়ে যোগদানের আহ্বান জানায়, কিন্তু এ ব্যাপারে স্থায়ী অভিযোগ রয়েছে যে ছোট জমির মালিকরা লাভের ন্যায্য হিস্যা বা ঘের- ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের সুযোগ কোনটাই পায় না।
কখনো একটি এলাকা চিংড়ি চাষের আওতায় এসে গেলে ঘেরের মালিকেরা ছোট ছোট ধানক্ষেতের লাগোয়া বিশাল এলাকা লোনাপানিতে ডুবিয়ে দেয়, তাতে (ঘেরের বাইরের ও ভিতরের) গোটা এলাকায় জমির উৎপাদন ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। পরিণামে এসব জমির মালিকেরা নিজের জমিকে চিংড়ির ঘেরে পরিণত করে বা বড় ঘেরের মালিকদের কাছে জমি ইজারা দিতে বাধ্য হয়।
এভাবে বিশাল এলাকায় চিংড়ি চাষ ক্রমে ক্রমে ধান চাষের জায়গা দখল করে নেয়। স্থানীয়ভাবে চাষের উপযোগী বেশ কয়টি ঐতিহ্যবাহী ধানের জাত (গাঁশি, কালশি ইত্যাদি) তথা মূল্যবান জার্ম প্লাজম ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় সাতক্ষীরা জেলা ছিল চালের উদ্বৃত্ত এলাকা, কিন্তু বর্তমানে সেখানে বাইরে থেকে চাল আসে।
চিংড়ি চাষের দরুন বহুমুখী শস্যচাষ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এসব এলাকায় ধান ছাড়া অন্য শস্য, গবাদি পশুর খাদ্য, শাকসবজি ইত্যাদি বর্তমানে আর জন্মানো যাচ্ছে না। কাজেই চিংড়ি চাষের এলাকায় এসব ফসলের দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসবের দাম যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ফলের গাছসহ সব ধরনের গাছের সংখ্যা ১০% থেকে ৩০% কমে গেছে। পরিণামে চিংড়ি চাষ বহু প্রান্তিক চাষীকে বসতবাড়ি ও ছোট জমি খণ্ড পরিত্যাগ করে নিকটবর্তী শহর বা নগরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে।

উপসংহার
বাংলাদেশে বহু সম্ভাবনাময় শিল্প বিকশিত হতে পারেনি শুধু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। চিংড়ি, যাকে ‘শ্বেতস্বর্ণ’ বলে অভিহিত করা হয়, এই সুবর্ণকে যথাযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা ও সমূহ আন্তরিকতা নিয়ে যত্ন করা উচিত। ২০০৮ সালের জন্য ঘোষিত ভিশন ২০০৮ বাস্তাবায়িত হলে তা আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে, সন্দেহ নেই ।
আরও দেখুনঃ