বাংলাদেশের নারী | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

বাংলাদেশের নারী : পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। নারীরা এখন আর শুধু অন্তঃপুরবাসী নয়, বরং পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমাজের উন্নতি সাধনে কাজ করছে। অথচ বাংলাদেশের নারীসমাজ যুগ যুগ ধরে শোষিত ও অবহেলিত হয়ে আসছে। পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে নারীদের সর্বদা রাখা হয়েছে অবদমিত। তাদের মেধা ও শ্রমশক্তিকে সমাজ ও দেশ গঠনে সম্পৃক্ত করা হয়নি।

 

বাংলাদেশের নারী

 

Table of Contents

বাংলাদেশের নারী

 

নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে গ্রহণ করা হয়নি কোনো বাস্তব পদক্ষেপ। অথচ মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণ করতেও পুরুষের পাশাপাশি সহায়তা করে নারী। এটি কোনো একমুখী প্রক্রিয়া নয় বরং দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়া নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তির অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সর্বজনীনতা সংরক্ষণ করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নারীর স্বাধীন ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিশ্চিত করা। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের সংবিধানে নারী

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই এ উপমহাদেশে নারী জাগরণের উন্মেষ ঘটে। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং স্বাধিকার আন্দোলনেও নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল অসাধারণ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অসামান্য অবদান রাখে। মুক্তিযুদ্ধের এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই বাংলাদেশের নারীরা আত্মনির্ভরশীল ও সচেতন হয়ে ওঠে। শিক্ষা গ্রহণ ও কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা এবং নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীসমাজের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগে। এতে দেশে নারী উন্নয়নের এক বিরাট সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

ফলে দেশের জাতীয় উৎপাদনে নারীর অংশগ্রহণ আবশ্যক হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিধান সন্নিবেশিত হয়। সংবিধানের ২৭ ধারায় উল্লেখ করা হয়, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ২৮(১) ধারায় রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।

২৮(২) ধারায় বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন। ২৮(৩)-এ উল্লেখ আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা বিশ্রামের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না।

২৮(৪)-এ উল্লেখ আছে, নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্র হতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না। ২৯(১)-এ রয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের ক নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।

২৯(২)-এ হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোর্ট, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্র কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সেক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা য না।’ ৬৫(৩) ধারায় নারীর জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে এবং এ ধারার অধীনে স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে ।

 

বাংলাদেশের নারী

 

নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান

বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিকভাবে নারীর অবস্থান বহুলাংশে অবহেলিত। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও পুরুষের সমকক্ষ দাবি করা তাদের পক্ষে ন হচ্ছে না। নারীরা শিক্ষা-দীক্ষায় পুরুষের চেয়ে অনগ্রসর। ফলে তারা অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ। লেখাপড়া কম জানা বা না জানার কারণে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ নয় সামাজিক দিক থেকে নারীরা বিপর্যস্ত।

পুরুষের সাথে সম-অধিকার তারা ভোগ করতে পারে না। ন কুসংস্কারে নারীদের মন আচ্ছন্ন। চার দেয়ালের মধ্যেই যেন তারা সীমাবদ্ধ। নারী সমাজের অনগ্রসরতার জন্য তাদের সামাজিক মর্যাদা নেই। সমাজকে এগিয়ে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে ন বরং তারা সমাজকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।

নারী নির্যাতন

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় নারীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সামাজিকভাবে সম-মর্যাদাসম্পন্ন বলে স্বীকৃতি না পাওয়ায় সবদিক থেকে নারীদের বঞ্চিত হতে হচ্ছে। শ্রম দানে তারা পুরুষের চেয়ে নিম্নস্তরের বিবেচিত হয়। সমান শ্রম দিলেও নারীরা পুরুষের সম পারিশ্রমিক পায় না।

বাংলাদেশের নারীরা যৌতুকের শিকার হয়। আইনগত দিক থেকে যৌতুক গ্রহণ অন্যায় বিবেচিত হলেও পুরুষের এ অযৌক্তিক লোভে অনেক নারীকেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়, এমনকি অকালে মারাও যায়। যৌতুকের কারণে অনেক বিবাহিতা নারীকে স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হতে হয়। স্বামীগৃহে অত্যাচার, অর্থনৈতিক সঙ্কট, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, সামাজিক কুসংস্কার ইত্যাদি নান কারণে বাংলাদেশের নারী সমাজকে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

এসিড নিক্ষেপে নারী জীবন বিপর্যস্ত করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরনির্ভরশীল। ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং উপেক্ষিত জীবনের অধিকারী এদেশের নারী সমাজ

নারীশিক্ষা

আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। সমাজ গঠনে তারা পুরুষের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু নানা কারণে শিক্ষা-দীক্ষা, উৎকর্ষ ও অভিজ্ঞত বৃহৎ জনগোষ্ঠী অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অবশ্য নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের একেবারেই যে অগ্রগতি নেই, তা নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটেছে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।

বিশ্ব পরিসরে বিভিন্ন আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এবং দেশের সংগঠনগুলোর ইতিবাচক ভূমিকার ফলে জীবন ও জীবিকার নানান্তরে নারীরা এগিয়ে শিক্ষাঙ্গনেও তারা পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। তবে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি, তা মূলত উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যে সীমিত। দেশের মোট নারীর ২৬ শতাংশ মাত্র সাক্ষর। বাকি ৭৪ শতাংশ। নারী এখনো কুসংস্কার ও অম্লতার আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি ।

 

বাংলাদেশের নারী

 

নারীমুক্তি আন্দোলন

বাংলাদেশে নারীর অধিকারহীনতা ও নির্যাতন যথেষ্ট উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে উঠেছে। সেজন্য দেশে নারীমুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে এবং এর কিছুটা ইতিবাচক ফলও প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এদেশে বহুদিন আগেই মহীয়সী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তার দেখানো পথ অনুসরণ করেই এদেশে নারীমুক্তি আন্দোলন সম্প্রসারিত হয়েছে। শিক্ষার জন্য নারীদের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি হয়।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বের উন্নত দেশের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে এদেশে নারীসমাজের শিক্ষা ও মর্যাদা সম্প্রসারিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি প্রেরণ করে বিশ্বের নারীমুক্তি আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। দেশের নারী সমাজের সচেতনতার ফলে নারী নির্যাতন বিরোধী আইন প্রণীত হয়েছে এবং তা প্রয়োগের মাধ্যমে নারীর অধিকার সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সে সাথে নারী নির্যাতন বন্ধের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। দেশে পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠাও নারী আন্দোলনের ফসল।

নারীর অবমূল্যায়ন

বিশ্বব্যাপী আজ যেখানে নারী প্রগতির জয়ধ্বনি ঘোষিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের নারীসমাজকে নানাভাবে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। এখানকার সমাজে নারীকে সবসময় পুরুষের অধঃস্তন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। প্রচার-বিজ্ঞাপনে অহেতুক নারীর উপস্থিতি টেনে আনা হয়। নির্যাতিত নারীর পুরো নাম-ঠিকানা, এমনকি ছবি সংবলিত রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অথচ নির্যাতনকারী পুরুষের ছবি ছাপানো হয় না। বস্তুত এখানে খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষা- দীক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের বৈষম্যের শিকার হয়। তবে ইদানীং এ ভাবধারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে ।

 

বাংলাদেশের নারী

 

নারীর ক্ষমতায়ন

নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর অন্তর্ভুক্তি তথা উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করার প্রথম উদ্যোগ ১৯৭২ সালে। ১৯৭৩ সালে দু জন নারীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৭৪ সালে একজন নারীকে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক নিয়োগ করা হয়। বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় ৪ জন নারী রয়েছেন।

বর্তমানে সরকারপ্রধান ও বিরোধীদলীয় নেত্রী দুজনই স্বনামধন্য নারী। গত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৭ জন মহিলা প্রার্থী ৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তধ্যে বেগম খালেদা জিয়া ৫টি আসনের মধ্যে ৫টিতেই বিজয়ী হন। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪টি আসনে জয়ী হন। তাছাড়া খুরশিদ জাহান হক, ড. হামিদা বানু শোভা, বেগম রওশন এরশাদ ও ইলেন ভুট্টো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন খুরশিদ জাহান হক ও বেগম সেলিমা রহমান। ইউনিয়ন পরিষদের ১২টি সদস্যপদের মধ্যে ৯টিতে সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখাসহ সংরক্ষিত ৩টি আসনে নারীর প্রতিযোগিতার সুযোগ রাখা হয়েছে। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের মহিলাদের সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটে নির্বাচন।

২০০২ সালের নির্বাচনে বহু নারী সরাসরি ভোটে চেয়ারম্যান ও মেম্বার ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়াও মহিলাদের সংরক্ষিত আসনে ১২ হাজার ৮২৮ জন মহিলা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ পৌরসভা নির্বাচনেও মহিলারা এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত আসন লাভ করেন। গ্রাম পরিষদেও ৩০% নারীর অংশগ্রহণ সংরক্ষণ করা হয়েছে। এভাবে উপজেলা ও জেলা পরিষদে ৩০% মহিলা নির্বাচিত হলে সারা বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে নারীদের অংশগ্রহণ শক্তিশালী হবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশের প্রশাসনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব এবং উপসচিবগণ নীতি নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে থাকেন। বর্তমানে সচিব পদে কর্মরত ৫১ জনের মধ্যে একজন ও নার নেই। ৭৪ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে একজন নারী, যুগ্ম সচিব ২৩২ জনের মধ্যে চৌদ্দ জন এবং উপসচিব ১২৮৮ জনের মধ্যে মাত্র ১৩৪ জন নারী রয়েছেন। রাষ্ট্রদূত, বিচারপতি, কাষ্টমস কমিশনার, ডিসি পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন নারী রয়েছেন।

সম্প্রতি ডিসি পর্যায়ে মহিলা নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য গেজেটেড পদ শতকরা ১০ ভাগ এবং ননগেজেটেড পদে শতকরা ১৫ ভাগ কোটা নির্দিষ্ট করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৬০ ভাগ কোটা নারীদের জন্য সংক্ষরণ করেছেন। সম্প্রতি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে অফিসার পদে মহিলাদের নিয়োগ বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের ইতিহাসে জন্ম দিয়েছে নতুন অধ্যায়ের।

 

বাংলাদেশের নারী

 

নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে কতিপয় সুপারিশ

নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বাস্তব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব সরকারের। একটি সুসংগঠিত ও সুবিন্যস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমেই এ দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করা সম্ভব। তবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সকল পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন প্রেক্ষিত বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। এ প্রসঙ্গে সম্ভাব্য কতিপয় সুপারিশ তুলে ধরা হলো

১. নারী উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো

নারীর ক্ষমতা উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতীয় অবকাঠামো যেমন—মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, জাতীয় মহিল সংস্থা ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল বিভাগ, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাঠামো বিস্তৃত করতে হবে এবং নারী উন্নয়নের যাবতীয় কর্মসূচি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের জন্য এ প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

২. জাতীয় মহিলা উন্নয়ন পরিষদ

নারী উন্নয়ন নীতি নির্ধারণ, উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবা পর্যালোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে ৪৪ সদস্যবিশিষ্ট যে মহিলা উন্নয়ন পরিষদ গঠ করা হয়েছে তার কার্যপরিধি নিম্নরূপ হতে পারে

ক. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণা বিভাগ ও সংস্থার উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন ।

খ. মহিলাদের আইনগত অধিকার, মহিলা উন্নয়ন এবং মহিলাদের নির্যাতন প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয়াবলী সম্বন্ধে নীতি প্রণয়ন ।

গ. সকল কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের স্বার্থ সংরক্ষণ, অংশগ্রহণ ও তাদের ভাগ্যোন্নয়ন সম্পর্কে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

৩. সংসদীয় কমিটি

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক গঠিত নারী উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করতে হবে, যা নারী উন্নয়ন কর্মসূচির পর্যালোচনা করে নারী অগ্রগতির লক্ষ্যে সরকারকে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করার পরামর্শ প্রদান করবে।

৪ নারী উন্নয়ন ফোকাল পয়েন্ট

বিভিন্ন ফোকাল পয়েন্ট যথা— মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির আলোকে কর্মসূচি গ্রহণ, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে এবং এ সকল সংস্থার কার্যক্রমে যাতে জেন্ডার প্রেক্ষিত প্রতিফলিত হয় এবং তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও দলিলসমূহে জেন্ডার বিষয়ে সুস্পষ্ট ও পর্যাপ্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয় সে লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

এছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রীকে সভাপতি এবং নারী উন্নয়নে চিহ্নিত ফোকাল পয়েন্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি বেসরকারি নারী উন্নয়নমূলক সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি নারী উন্নয়ন বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি নারী উন্নয়ন সম্পর্কিত কর্মসূচি পর্যালোচনা, সমন্বয় ও মূল্যায়ন করবে। কমিটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমস্যা চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শ প্রদান করবে ।

৫. থানা ও জেলা পর্যায় :

নারীর অগ্রগতি এবং ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ের প্রশাসন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, স্থানীয় সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দপ্তর ও এনজিওদের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন ও নারী উন্নয়ন কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

৬. তৃণমূল পর্যায়ে

তৃণমূল পর্যায়ে গ্রাম ও ইউনিয়নে নারীকে স্বাবলম্বী দল হিসেবে সংগঠিত করতে হবে । এ দলসমূহকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার আওতায় নিবন্ধীকৃত সংগঠন হিসেবে রূপ দেয়া যেতে পারে। সরকারি, বেসরকারি উৎস, ব্যাংক, অন্যান্য আর্থিক সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সম্পদ আহরণ করে এ সংগঠনগুলোর সাথে ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনসমূহের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ও সমন্বয় সাধন করবে এবং তৃণমূল পর্যায়ের সকল সংগঠনের কার্যক্রমের স্থানীয় উন্নয়নের প্রেক্ষিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য উৎসাহিত এবং সহায়তা দান করবে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

৭. নারী উন্নয়নে এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনের সাথে সহযোগিতা

প্রকৃত নারী উন্নয়ন একটি ব্যাপক কাজ। সরকারের একার পক্ষে এ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা কার্যত অসম্ভব। তাই এ কাজে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস নেয়া যেতে পারে, যাতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

এক্ষেত্রে নিজস্ব কর্মসূচির অতিরিক্ত Catalyst বা সহায়কের ভূমিকা পালন করাই হবে সরকারের মূল দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে নারী উন্নয়নের সকল স্তরে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্তকরণ ও তাদের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নারী সংগঠনসমূহের সাথে সহায়তা ও সমন্বয় বিধান করতে হবে।

৮. নারী ও জেন্ডার সমতাবিষয়ক গবেষণা

নারী উন্নয়ন ও সমতা বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা পরিচালনার জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। সকল গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন এবং নারী ও শিশুদের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে গবেষণার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। এবং পৃথক জেন্ডার গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।

৯. নারী উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান

ঢাকায় বিদ্যমান নারী উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান 8 শক্তিশালীকরণসহ বিভাগ, জেলা ও থানায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। এসব কেন্দ্রে বিভিন্ন কারিগরি, বৃত্তিমূলক, নারী অধিকার এবং শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

১০. সামাজিক সচেতনতা

নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা কর্মসূচির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ কর্মসূচিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ১ আইনবিধি ও দলিলাদি থেকে নারীর মর্যাদাহানিকর বক্তব্য ও মন্তব্য অপসারণ, ২. মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কার্যনির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাযুদ্ধের সচেতনতা এবং ৩. নারী-পুরুষের সম্পর্ক, অধিকার ও নারী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাঠ্যসূচিতে রা বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

১১. নারী নির্যাতন প্রতিরোধ

নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কর্মসূচির ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং এসব কর্মসূচিতে সচেতনতা, আইনগত পরামর্শ ও শিক্ষা, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তথা মামলা পরিচালনা করা, মামলা পরিচালনার জন্যে নিরাপদ আশ্রয় ও পুনর্বাসন, আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এক্ষেত্রে একটি বিশেষ কৌশল হিসেবে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেলসহ অন্যান্য নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের কর্মপরিধিকে বিস্তৃত ও শক্তিশালী করা যেতে পারে।

১২. আর্থিক ব্যবস্থা

তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ ও জেলা পরিষনে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে | পরিবার কল্যাণ, অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে এবং নারী উন্নয়নে নিয়োজিত মন্ত্রণালয় এবং সংস্থা যেমন স্বাস্থ্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, শ্রম ও জনশক্তি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ে নারী উন্নয়নের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ও কর্মসূচি চিহ্নিত করে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।

১৩. সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা

নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বস্তরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতার যোগসূত্র গড়ে তুলতে হবে । সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহকে যথোপযুক্ত এবং সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান করতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে চিন্তাধারা, দক্ষতা ও তথ্যের আদান-প্রদান করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ, বৈঠক, কর্মশালা ইত্যাদির মাধ্যমে এই আদান-প্রদান চলবে। ক্ষেত্র বিশেষে সরকারি- বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে নারী উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

১৪. বহুপাক্ষিক সহযোগিতা

নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও উপ- আঞ্চলিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করতে হবে।

উপসংহার

দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। নারী সমাজকে উপেক্ষা করে, অবহেলিত রেখে জাতি এগিয়ে যেতে পারে না । তাই নারীশিক্ষার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা করতে হবে। নারী-পুরুষের ব্যবধান সম্পর্কে পুরানো ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের মর্যাদা স্বীকার করতে হবে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের যথাযথ অগ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে প্রতিটি স্তরে নারী-পুরুষকে সমানভাবে মর্যাদা দান করা উচিত।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment