বাংলাদেশের লোকশিল্প রচনা

বাংলাদেশের লোকশিল্প রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালিরা মৌসুমী কাজের অবসরের ফাঁকে ফাঁকে হরেক রকমের কারুশিল্প সৃষ্টি করতো। এগুলোর মধ্যে সুচি শিল্প, তাঁত শিল্প, নকশিকাঁথা ও মসলিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গৃহিণীরা কাজের বিশ্রামে নকশিকাঁথা কিংবা নানারূপ কারুময় শিল্পকলা অনায়াসে সৃষ্টি করে ফেলতো। এসবের সুনাম বহুকাল আগেই বিদেশেও ছড়িয়েছে। আমাদের লোকশিল্প আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের পরিচায়ক।

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

লোকশিল্পের পরিচয় :

লোকশিল্প সাধারণ লোকের জন্য সাধারণ লোকের সৃষ্টি। এর পরিধি এত ব্যাপক ও প্রকৃতি এত বিচিত্র যে, এককথায় এর সংজ্ঞা নিরূপণ করা যায় না। অগাস্ট প্যানিয়েলা (August Panyella) বলেন, লোকশিল্পের কেবল ‘শিল্প’ শব্দ বোঝা কঠিন নয়, ‘লোক’ শব্দও সমান সমস্যাপূর্ণ। তার ভাষায়, ‘In the expression Folk art it is not only the word ‘art’ that is
difficult to understand, the word ‘Folk’ is equally problematic.

Webster’s New Collegiate Dictionary ‘লোক’-এর ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছে The great proportion of the members of a people that determines the group character and the tends to preserve its characteristics form of civilization and its customs, arts and crafts, legends, traditions and superstitions from generation to generation.

অর্থাৎ ‘লোক’ হলো সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ যারা গোষ্ঠীচরিত্র নির্ধারণ করে এবং সভ্যতা, আচার, বিশ্বাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, চারু ও কারুশিল্পের বিশিষ্ট রূপকে বংশপরম্পরায় ধরে রাখে ।

নৃতাত্ত্বিক অভিধানে ‘লোক’-এর সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে Folk in ethnology is the common people who share a basic store of old tradition. অর্থাৎ পুরাতনঐতিহ্যের অংশীদার যেসব সাধারণ মানুষ, নৃতত্ত্বের পরিভাষায় তারাই Folk বা লোক নামে অভিহিত ।

আর ‘শিল্প’ হলো মানব মনের আনন্দিত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ। শিল্প মানুষের সত্তার গভীরতম প্রকাশ। এবার দেখা যাক একত্রে লোকশিল্পকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা লোকশিল্পের সংজ্ঞা এড়িয়ে যান এ বলে যে, দেখলেই তাকে চেনা যাবে। ‘Know when you see it. Material will define itself if one would allow it to so.’ সবচেয়ে সহজলভ্য উপাদান মাটি থেকে আরম্ভ করে কাঠ, বাঁশ, বেত, পাতা, সুতা, লোহা, তামা- সোনা-রূপা, ধাতব দ্রব্য, সোলা, পাট, পুঁতি, ঝিনুক, চামড়া পর্যন্ত নানা উপাদান লোকশিল্প নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।

কামার, কুমার, ছুতার, তাঁতি, কাঁসারু, সোনারু, শাঁখারি, পটুয়া প্রভৃতি পেশাদার এবং অন্য অনেক অপেশাদার নর-নারী লোকশিল্পের নির্মাতা। এরূপ বিভিন্ন ও শ্রেণী প্রকৃতির লোকশিল্পের সংজ্ঞায়ন সত্যিই দুঃসাধ্য ব্যাপার। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় এরই প্রতিফলন ঘটেছে ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘Although the definition of the folk art is not get firm, it may be considered as the art created among groups that exist within the framework of a developed society but for geographically or cultural reason, are largely separated from the sophisticated artistic developments of their time and that produced distinctive styles and objects for local needs and tastes.’

অর্থাৎ যদিও লোকশিল্পের সংজ্ঞা এখনো নির্ণয় করা হয়নি, তবু গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ যারা উন্নত সমাজের কাঠামোর মধ্যেই বিরাজ করে কিন্তু ভৌগোলিক অথবা সাংস্কৃতিক কারণে শিল্পের উন্নত ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাদের নির্মিত এই শিল্পকে লোকশিল্পরূপে বিবেচনা করা যায়, অবশ্য স্থানীয় চাহিদা ও রুচির কারণে এই শিল্প স্থানীয় বৈশিষ্ট্যসূচক রীতি ও বস্তুগুণ ধারণ করে।

এ সংজ্ঞায় লোকশিল্প অপেক্ষা লোকশিল্পীর ওপর জোর পড়েছে। ‘লোকশিল্প উন্নত সমাজের কাঠামোর মধ্যেই বিরাজ করে’ কথাটার গুরুত্ব আছে। Folk-এর সংজ্ঞায় এ শ্রেণীর গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষকে আমরা শনাক্ত করেছি। স্থানীয় চাহিদা ও রুচি অনুযায়ী লোকশিল্পের রীতি ও বস্তুধর্ম গড়ে ওঠে, আর এ কারণেই মার্জিত শিল্পের বিকশিত ও উন্নত ধারার সাথে এটি তাল মেলাতে পারে না।

লোকশিল্পের অপর একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন হ্যারল্ড অসবোর্ন (Harold Osborne)। তিনি লিখেছেন,
‘Objects and decorations made in a traditional fashion by craftsmen without
formal training, either for daily use and ornament or for special occasion such as wedding and funerals are called folk art.’

অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পায়নি এমন কারুশিল্পী প্রথাগত যেসব বস্তু ও সরঞ্জাম প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহার, অলংকরণ, বিবাহ বা মৃতের সৎকারের কাজে তৈরি করে, সেসব শিল্পবস্তুকে লোকশিল্প বলে।

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

এটি অত্যন্ত সাদামাটা সংজ্ঞা। লোকশিল্পের ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে সত্য, তবে এর নান্দনিক ও রসগত মূল্য উপেক্ষা করলে চলে না। সব কাঁথা লোকশিল্পের নমুনা নয়, নকশি কাঁথাই লোকশিল্পের নিদর্শনরূপে গণ্য হয়। কেননা এতে চিত্র আছে, রঙের ব্যবহার আছে, মটিফের বিন্যাস আছে, সর্বোপরি শিল্পীমনের স্পর্শ আছে। কুমার দেবমূর্তি গড়ে, তার হাতের স্পর্শে কোনোটি মনসা, কোনোটি সরস্বতী দেবীর রূপ লাভ করে, সৃজনশীলতার গুণেই এটি সম্ভব হয়।

ব্রতের আল্পনায় ধর্মীয় আবেগ, বিয়ের আল্পনায় নান্দনিক আবেগ এবং একুশের আল্পনায় জাতীয়তার আবেগ আছে। চিত্রবস্তুর নির্বাচনে ও বিন্যাসে এরূপ বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। এখানে শিল্পীর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না পেলেও পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এক ধরনের হাতে-কলমে শিক্ষা পায় তারা, বাকিটা স্বভাব-প্রতিভার গুণে সৃষ্টির কাজ চালিয়ে নেয়। সুতরাং লোকশিল্পী পূর্বপুরুষের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করে সমাজের মানুষের চাহিদা ও উপযোগিতার কথা বিবেচনায় রেখে মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রথাগতভাবে যে শিল্প গড়ে, তাকেই লোকশিল্প হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়।

 

লোকশিল্পের শ্রেণীবিভাগ :

ফোকলোরের তিনটি প্রধান ধারা রয়েছে। যথা : মৌখিক (oral), বস্তুগত (material) ও অগক্রিয়াগত (performing)। লোকজ চারু ও কারুশিল্প একত্রে ‘লোকশিল্প’ নামে অভিহিত। শিষ্ট শিল্পের মতো লোকশিল্পেরও তিনটি প্রধান শাখা রয়েছে। যথা : চিত্র, ভাস্কর্য স্থাপত্য। প্রতি শাখার আবার নানা উপবিভাগ রয়েছে। উপকরণ, ক্যানভাস ও রীতি অনুযায়ীউন্নত শিল্পের মতো লোকশিল্পেরও নিম্নরূপ শ্রেণীকরণ করা যায় :

১. অঙ্কন (painting) ও নকশা (sketch),

২. সূচিকর্ম (embroidery),

৩. বয়নশিল্প (weaving),

৪. আদর্শায়ন (modeling),

৫. ভাস্করণ (engraving),

৬. স্থাপত্যশিল্প (architecture):

নিচে উল্লিখিত শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী কয়েকটি লোকশিল্পজাত বস্তুর নাম, আধার, উপকরণ ও শিল্পীর নাম আলোচনা করা হলো।

 

অঙ্কন

আল্পনা অঙ্কন:

বর্তমানে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আল্পনা আঁকা সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। লোকশিল্পের এ ধারাটি শিক্ষিত সমাজেও উঠে এসেছে। লোকশিল্পের এটি একটি জনপ্রিয় শাখা, এতে রঙ-তুলির ব্যবহার আছে। চালের পিটালি দিয়ে সাদা, গোবর জল নিয়ে মেটে, কাঠ-কয়লা দিয়ে কালো, পোড়া ইটের গুঁড়া দিয়ে লাল বা খয়েরি ইত্যাদি দেশজ রঙ ও বাজারের কেমিক্যালজাত বিভিন্ন রঙ এ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় । সাধারণত মেঝে, দেওয়াল, কুলা, পিঁড়ি, ঘরের খুঁটি, দুয়ার, পূজার বেদী, সরা, কলস, ঝাঁপি ইত্যাদি আধার বা পাত্রে আল্পনা আঁকা হয় ।

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

পটচিত্র অঙ্কন:

পটচিত্র আর একটি মাধ্যম, যা এ দেশের লোক-ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। আল্পনার রূপকার নারীসমাজ, পটচিত্রের রূপকার মূলত পুরুষ, তবে এর জটিল প্রক্রিয়ায় নারীও অংশগ্রহণ করে থাকে। এদিক থেকে পটচিত্র একটি যৌথশিল্প। পটুয়া নামের এক শ্রেণীর পেশাজীবী মানুষ পটচিত্রের নির্মাতা পটুয়াদের আদি পুরুষ মঙ্করী’ বৌদ্ধ ছিল। তারা যুদ্ধকাহিনী পট বা কাপড়ে এঁকে তার সাহায্যে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করত।

মধ্যযুগে পটুয়ারা কৃষ্ণলীলা, রামলীলা, চৈতন্যলীলা কাপড়ে অথবা কাগজে চিত্রিত করে প্রচার করত। এটি তাদের জীবিকারও উপায় ছিল। এ যুগে গাজীর পট, মহরমের পট-এর সন্ধান পাওয়া যায়, যার পৃষ্ঠপোষক ছিল মুসলিম সমাজ। এভাবে পট হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

উচ্চি অঙ্কন:

উদ্ভি লোকশিল্পের একটি স্থায়ী ধারা। বিশ্বের নানা জাতির মধ্যে শরীরের নানা অংশে উল্কি আঁকার ও ধারণ করার রীতি প্রচলিত আছে। আফ্রিকার কোনো কোনো উপজাতি প্রায় সারা অঙ্গেই বিচিত্র রূপের ও রঙের উল্কি পরে। উল্কি অঙ্কনে ধর্ম, চিকিৎসা, সংবাদ আদান-প্রদান, সৌন্দর্যচর্চা ইত্যাদি মনোভাব কাজ করে।

আমাদের দেশে বৈরাগী-বোষ্টামীরা বাহুতে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির উল্কি ধারণ করে। উপজাতিদের মধ্যে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুরিয়ারা উল্কি পরে। তারা গোত্রধর্ম, পবিত্রতা ও সৌন্দর্যজ্ঞানে উল্কি ধারণ করে থাকে। উল্কি আঁকার জন্য পেশাদার নারী-পুরুষ আছে। উদ্ভি দেহে আজীবন থেকে যায়। বর্তমানে শহরের অনেক শৌখিন ছেলেমেয়ে ফ্যাশন হিসেবে অঙ্গে উদ্ভি ধারণ করে।

মুখোশচিত্র অঙ্কন:

গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুখোশ তৈরি হয়। হাল্কা কাঠ, শোলা, মাটি, রঙ ইত্যাদি মুখোশ তৈরির উপকরণ। গাজন-নৃত্যে শিবের, কালী-নৃত্যে কালীদেবীর মুখোশ পরার রীতি হিন্দু সমাজে প্রচলিত আছে। দেবতার মুখোশে দেবভাব, মানুষের মুখোশে মানবভাব, জীবজন্তুর মুখোশে পশুভাব, ভূত-প্রেতের মুখোশে বীভৎসভাব ফুটিয়ে তোলা হয়। এ ধরনের মুখোশে নৃত্যাভিনয়ের চেতনামিশ্রিত থাকায় লোকশিল্পী কিছুটা সৌন্দর্যসৃষ্টির প্রয়াস পান।

শখের হাঁড়ি অঙ্কন:

লোকশিল্পীদের কাজ বিশদ এবং বহুল । তারা হাঁড়ি গড়েন, সরা তৈরি করেন, সেই হাঁড়ি ক্ষেত্র বিশেষে শখের হাঁড়ি, সেই সরা ক্ষেত্র বিশেষে লক্ষ্মীর সরা। কোনো কোনো গ্রামাঞ্চলে মাটির সরাতে লক্ষ্মী- রাধাকৃষ্ণ-গাজীর মূর্তি ও মহরমের ঘটনা চিত্রিত করা হয়। এতে পটের অনুরূপ রঙ-তুলির ব্যবহার আছে। শখের হাঁড়িতে ফল, ফুল, ফসল, বসতি, জনপদ ইত্যাদির চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়।

পুতুলচিত্র অঙ্কন:

ছুতার, কুমার, মালাকার এবং গৃহস্থ বালিকারা রঙ এবং রঙিন সুতার সাহায্যে পুতুলচিত্র
তৈরি করে। পুতুলচিত্র তৈরির উপকরণ হলো কাঠ, কাপড়, মাটি, শোলা ইত্যাদি। খেলনাচিত্র : গ্রামবাংলার গৃহস্থ নরনারীরা কাঠ বা মাটিনির্মিত খেলনার ওপর রঙের সাহায্যে বিভিন্ন চিত্র এঁকে খেলনাচিত্র তৈরি করেন।

 

সূচিকর্ম:

নকশি কাঁথা নকশি কাঁথা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের লোকশিল্পের সবচেয়ে মনোরম নিদর্শন। নকশি কাঁথা সূচিকর্মের অন্তর্ভুক্ত। কয়েক ফালি কাপড় স্তর পরম্পরায় সাজিয়ে কাঁথার জমিন তৈরি করা হয়। সাধারণ ব্যবহার্য সূচে রঙ-বেরঙের সুতা পরিয়ে ‘ফোঁড়’ দ্বারা এই জমিনে ছবি আঁকা হয় ।

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

নকশি কাঁথার ছবি ও নকশা :

নকশি কাঁথাতে সাধারণত মাছ, পাতা, ছড়া বা ধানের শীষ, চাদ, তারা, বৃক্ষ, ঘোড়া, হাতি, দেব-দেবীর ছবি অথবা কোনো গ্রামীণ ঘটনার ছবি বুনন করা হয়। পাহাড়-পর্বত, পশু-পাখি, প্রসাধনী দ্রব্য, রান্নাঘরের জিনিসপত্র, পালকী, মটর, ঘোড়সওয়ার, মসজিদ-মন্দির, গ্রাম্যমেলা, রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, জ্যামিতিক নকশা, ফুল ও নানা ধরনের আল্পনা এবং শ্লোক, নানা ফিগার মোটিফ এতে দেখতে পাওয়া যায়।

নকশি কাঁথার প্রকার :

লোকশিল্প হিসেবে নকশি কাঁথা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে । প্রয়োজনের দিক থেকে নকশি কাঁথাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- লেপ, ঢাকনা, ওশার ও থলে । এসবের মধ্যে লেপ এবং ঢাকনাই উল্লেখযোগ্য। লেপকাঁথা আবার দুই প্রকার। যেমন- দোরখা এবং আঁচল বুননী ।

 

বয়নশিল্প:

নকশি পাটি :

নকশি পাটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকশিল্পীরা রঙিন বেত দিয়ে অত্যন্ত সুন্দর ও চমৎকার নকশি পাটি তৈরি করে থাকেন ।

নকশি শিকা :

বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলের নারীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় আরেকটি বয়নশিল্প হলো নকশি শিকা। গৃহস্থ রমণীরা পাট বা সুতার জো-এর ওপর পাট, সুতা, পুতি, কড়ি ইত্যাদির সাহায্যে নকশি শিকা তৈরি করেন । এই নকশি শিকায় গ্রামবাংলার নারীরা বিভিন্ন জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখেন ।

নকশি পাখা :

গ্রামবাংলার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প নকশি পাখা। গৃহস্থ নারীরা অত্যন্ত শখ করে পাতা বা সুতার টানার ওপর রঙে রঙিন সুতা এবং পাটের মাধ্যমে নকশি পাখা তৈরি করেন।

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

ঝুড়ি, কুলা-ডালা, ফুলচাঙ্গা :

এ দেশের ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্পের অন্যতম হলো বেত ও বাঁশের জো এর তৈরি ঝুড়ি, কুলা-ডালা ও ফুলচাঙ্গা। ঝুড়ি এবং কুলা-ডালা তৈরি করে যে সকল লোকশিল্পী তাদেরকে ডোম জাতি বলা হয় । আর সাধারণত গৃহস্থ রমণীরা ফুলচাঙ্গা তৈরি করে ।

 

আদর্শায়ন:

লোকশিল্পের অন্যতম প্রধান শাখা এই আদর্শায়ন। পুতুল, খেলনা, হাঁড়ি-পাতিল, দেবমূর্তি, মুখোশ, মুকুট, সন্দেশ-পিঠা-আমসত্ত্বের ছাঁচ, নকশি পিঠা, মিষ্টি, অলঙ্কার, নৌকা, ভাজিয়া, রথ, শৌখিন দ্রব্য খাট-পালঙ্ক-সিন্দুক বাক্স, পাখি, গাড়ি ইত্যাদি সবই আদর্শায়নের অন্তর্ভুক্ত লোকশিল্পজাত বস্তু।

পুতুল :

কুমার, ছুতার, গৃহস্থ রমণী ও বালিকারা মাটি, কাঠ, কাপড়, সুতা, পাট,, ধাতু ইত্যাদির সাহায্যে মাটির পুতুল কাঠের পুতুল, কাপড়ের পুতুল, ধাতুর পুতুল ইত্যাদি তৈরি করেন। খেলনা মাটি, কাঠ, শোলা ও ধাতুর সাহায্যে কুমার, ছুতার, গৃহস্থ ব্যক্তি ও মহিলারা শিশু-কিশোরদের জন্য নানা রকমের খেলনা তৈরি করেন। এই ধরনের খেলনার মাঝে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখি, মানুষ, হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদির প্রতিকৃতি।

দেবমূর্তি :

হিন্দুদের দেবমূর্তি একটি উল্লেখযোগ্য লোকশিল্প। পেশাদার কুমার মাটি, বাঁশ, কাঠ, সুতা, শোলা, ধাতু, কাপড়, রঙ ইত্যাদি উপকরণের সাহায্যে হিন্দুদের নানা দেবদবীর মূর্তি তৈরি করেন।

নকশি পিঠা :

বাংলার নারীমনের শিল্প সৌন্দর্যের প্রকাশ নকশি পিঠা। এতে আছে যুগ-যুগান্তরের বাংলার অন্তঃপুরিকাদের চিন্তা, চেতনা ও রসবোধ। পিঠা সুন্দর, স্বাদে ভরপুর ও বেশিদিন রাখার জন্য বিভিন্ন ডিজাইনে, মোটিফে, সাইজে বা নকশা দিয়ে যে পিঠা তৈরি করা হয় তাকে নকশি পিঠা বলে। অতিথি আপ্যায়ন, বিয়ে-শাদী, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, বিশেষ অনুষ্ঠান, ঈদ, খতনা, নবান্ন, শবে-বরাত, শবে-কদর ও জামাই আদরে নকশি পিঠা দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়।

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

ভাস্করণ :

কাঠখোদাই শিল্প ( প্রধানত মূর্তি ও নকশা খোদাই), ধাতুর নকশা, পোড়ামাটির ফলকচিত্র ইত্যাদি হলো লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত ভাস্করণের নিদর্শন। বাড়ি, দরজা, জানালা, বেড়া, খাট, পালঙ্ক, বাক্স, সিন্দুক, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি তৈরির ক্ষেত্রে ছুতার কাঠ খোদাই করে বিভিন্ন রকমের দৃষ্টিনন্দন নকশা ও ডিজাইন তৈরি করেন। বাসন-কোসন এবং শৌখিন দ্রব্যের যাবতীয় কাজে কাঁসারু ও স্বর্ণকার তামা, পিতল, লোহা, সোনা, রূপা ইত্যাদির সাহায্যে ধাতুর নকশা তৈরি করেন। এ ছাড়া ঘরবাড়ি, মসজিদ, মন্দির ইত্যাদি অলঙ্করণের সময় কুমার পোড়ামাটির ফলকচিত্র তৈরি করেন।

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

স্থাপত্যশিল্প :

বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্পে লোকশিল্পের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা, মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ঘরামি, ছুতার ও রাজমিস্ত্রিরা বিশেষ ধরনের নকশা ও ডিজাইনে এগুলো গড়ে তোলেন। এ সকল অবকাঠামো নির্মাণে মাটি, মাঠ, বাঁশ, খড়, দড়ি ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করা হয়।

লোকশিল্প সংগ্রহের গুরুত্ব লোকশিল্প যে কোনো জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। তাই একটি জাতির আত্মপরিচয় সম্পূর্ণভাবে আনার জন্য লোকশিল্প সংগ্রহের গুরুত্ব অপরিসীম। এ সম্পর্কে বিখ্যাত লোকবিজ্ঞানী আশুতোষ ভট্টচার্য বলেন, ‘লোক-সংস্কৃতির রূপ- রসগত বহুমুখী আলোচনাই এর সব নয়, এর জন্য তাত্ত্বিক আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু এ কথা সত্য, তাত্ত্বিক আলোচনার পূর্বে এর উপকরণের যথাসম্ভব সামগ্রিক সংগ্রহ আবশ্যক।

কেবল মাত্র আংশিক সংগ্রহের ওপর তাত্ত্বিক আলোচনা সম্ভব নয় । কেবলমাত্র সংগ্রহের আয়তন নয় তার গুণগত দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে কিংবা সপ্তাহ বিষয়ে কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত গবেষক বা সংগ্রহকারী দ্বারা সংগ্রহ করা দরকার।’

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

লোকশিল্প সংগ্রহের সমস্যা :

লোকশিল্পজাত বস্তু সংগ্রহের সমস্যা ও অসুবিধা অনেক। অনেক সময় লোকশিল্পী তার নিজস্ব সৃষ্টি হস্তান্তর করতে অনীহা প্রকাশ করেন। কারণ, শিল্পী সৃষ্টির আনন্দে তাঁর শিল্পকর্মে ব্রতী হন তাই নিজের সৃষ্টির প্রতি মমত্ববোধের জন্য তিনি হাতের তৈরি জিনিস সহজে হাতছাড়া করতে চান না। পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত অতি পুরাতন লোকশিল্পজাত বস্তু পরিবারের ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রাখতে চান শিল্পীর উত্তরাধিকারী।

সরল গ্রামবাসী অনেক সময় তাদের শিল্পকর্মের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না। যে সামান্য জিনিস তারা তৈরি করে ক্ষেত্রবিশেষে তা যে অমূল্য সম্পদরূপে বিবেচিত হতে পারে তা তারা বোঝে না। ফলে তার সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। সেজন্য অনেক সময় লোকশিল্পজাত সামগ্রী সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া ও সহযোগিতা পাওয়া যায় না।

শিল্পকর্মের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা আর একটি সমস্যার সৃষ্টি করে। সেটা হলো নকল সামগ্ৰী চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা। শিল্প সামগ্রীর পেশাদারী বিক্রেতা বা মিডলম্যানদের মধ্যে সাধারণত এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন— পিতল বা ব্রোঞ্জের প্রাচীন ভাস্কর্যের চাহিদা বৃদ্ধির দরুন আজকাল পুরাতন আদলে পিতল ব্রোঞ্জের মডেল তৈরি করে তার ওপর এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করা হয়। ফলে পুরাতন মূর্তি এবং এসব নকল ভাস্কর্যের মধ্যে তারতম্য করা মুস্কিল হয়ে পড়ে।

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

লোকশিল্প সংরক্ষণের সমস্যা :

সংগৃহীত সামগ্রীর সংরক্ষণেও সমস্যা আছে। সাধারণত ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী উপাদানে লোকশিল্প সৃষ্টি করা হয়। ফলে এগুলোর স্থায়িত্ব কম। বাঁশ, বেত, সুতা, পাতা প্রভৃতির ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা দেয়। লোকশিল্পীরা যে রঙ ব্যবহার করেন তারও স্থায়িত্ব নেই। তাছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়ায় সংগৃহীত, সামগ্রী ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।

 

বাংলাদেশের লোকশিল্প

 

লোকশিল্প সংরক্ষণের উদ্যোগ :

লোকশিল্পের সংগ্রহ দু রকমের হতে পারে : বাস্তব সংগ্রহ (Physical collection) অথবা তার দলিলায়ন (documentation)। বাস্তব সংগ্রহের জন্য প্রয়োজন সপ্তাহশালা বা জাদুঘর।

১৯৩৭ সালে স্থাপিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ সংস্থা ‘আশুতোষ মিউজিয়াম অফ ইন্ডিয়ান আর্ট নামক জাদুঘর সম্ভবত বিভাগ-পূর্ব বাংলায় লোকশিল্প সংগ্রহের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস। ১৯৬৯ সালে এ জাদুঘরের সংগ্রহ সংখ্যা ছিল ২৫,০০০। এর বিরাট অংশ হলো লোকশিল্প। এ জাদুঘরে বাংলাদেশের লোকশিল্পের বেশ কিছু নিদর্শন আছে। এর মধ্যে নকশি কাঁথা ও মাটির খেলনা পুতুল উল্লেখযোগ্য ।

১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা জাদুঘর ১৯৮৩ সালে জাতীয় জাদুঘরে উন্নীত হয়। ২,১৫,০০০ বর্গফুটের এ বিশাল জাদুঘরে লোকশিল্পের নিদর্শনের মধ্যে আছে অনেকগুলো নকশিকাঁথা, কাঠ খোদাই, টেরাকোটা বা পোড়া মাটির ফলক, পুতুল, পুঁথি, পটচিত্র, মৃৎপাত্র প্রভৃতি ।

বাংলা একাডেমীর লোক-ঐতিহ্য বিভাগের লোকশিল্প সংগ্রহশালার জন্য সংগ্রহ শুরু হয় ১৯৬৪ সাল থেকে। ১৯৬৯ সালে গৃহসংস্থানের পর সংগ্রহশালা বাস্তব রূপ গ্রহণ করে। সংগ্রহের মধ্যে আছে নকশিকাঁথা, মুখোশ, লোকবাদ্যযন্ত্র, শীতল পাটি, নকশি পাখা, লোক-অলঙ্কার, নকশি পিঠা, শিকা, মৃতফলক, পুতুল প্রভৃতি।

লোকশিল্পের পঠন-পাঠন ও সংগ্রহের জন্য ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। বাংলার এককালের রাজধানী সোনারগাঁয়ে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের সদর দপ্তর এবং লোকশিল্প জাদুঘরের স্থান নির্বাচন করা হয়। ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে সর্দার বাড়ি নামক এক পুরানো জমিদার বাড়ি মেরামত করে তাতে লোকশিল্প জাদুঘর স্থাপিত হয়। নানা লোকশিল্পের নিদর্শন এ সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে।

এ ছাড়া চট্টগ্রামের জাতিতত্ত্ব জাদুঘর, রাঙামাটির ট্রাইবাল কালচারাল একাডেমি ও বিরিশিরি ট্রাইবাল একাডেমিতে উপজাতীয় শিল্পের সংগ্রহ আছে। মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর ও ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের লোকশিল্পের নিদর্শনের মধ্যে মাটির ফলকচিত্র উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, ত্রিশাল প্রভৃতি আঞ্চলিক জাদুঘরে কিছু কিছু লোকশিল্পের নিদর্শন রক্ষিত আছে।

 

google news logo Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

 

উপসংহার:

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় লোকশিল্পের প্রয়োজন বা উপযোগিতা জাতিতাত্ত্বিক দিক দিয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু লোকশিল্পের অনেক উপাদানই আজ বিলুপ্তির পথে। পুঁথিচিত্র, পুঁথির পাটাচিত্র, পটচিত্র আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। বাঁশের অলংকৃত বেড়া, লক্ষ্মীর সরা, লোক-অলংকার বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ।

কিছু কিছু শিল্প নিদর্শন বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অনেক মূল্যবান লোক নিদর্শন পুড়ে গেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে, অথবা হারিয়ে গেছে। আগামীতে যদি এভাবে লোকশিল্পের উৎপাদন ও ব্যবহার আরো কমতে থাকে, তবে ইতিহাস খ্যাত ঢাকাই মসলিন শাড়ির মতো একদিন লোকশিল্পের অনেক উপাদানও হারিয়ে যাবে।

এ ছাড়া বর্তমানে শহরের সঙ্গে গ্রামের ব্যবধান দ্রুত অপসারিত হচ্ছে, শিক্ষার বিস্তার ঘটছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব জীবনের সর্বস্তরে পড়েছে। এমতাবস্থায় লোকশিল্পের নমুনা সংগ্রহ ও স সেগুলোর উৎস-ইতিহাস ও শিল্প-বিচার এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরবকে ধরে রাখার স্বার্থে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে লোকশিল্পের জন্য আর্থিক বিনিয়োগ ও রাজব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।

দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য লোকশিল্পীদের উৎসাহ বাড়াতে হবে। এতে লোকশিল্পসহ আমাদের হারানো দিনের অনেক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment