Site icon Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন : সমস্যা ও সমাধান | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন : সমস্যা ও সমাধান

বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন : বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত। দেশের জাতীয় আয়ের বিরাট একটি অংশ আসে কৃষি খাত থেকে। বর্তমান জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান শতকরা ২৩.৪৬ ভাগ; কিন্তু বাংলাদেশের কৃষি খাত তথা কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে রয়েছে হাজারো সমস্যা। তাই জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাসমূহের প্রতিকার অনতিবিলম্বে জরুরি।

 

 

Table of Contents

বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন : সমস্যা ও সমাধান

বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়নের সমস্যাসমূহ

বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাসমূহ নিম্নরূপ

১. সনাতন চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মান্ধাতার আমলের চাষ পদ্ধতি। অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলেই এখনো পর্যন্ত কাঠের লাঙল এবং এক জোড়া বলদই কৃষকের একমাত্র সম্বল। কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে এখনো পৌঁছায়নি। ফলে শুধু শারীরিক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল কৃষি প্রত্যাশিত ফসল উৎপাদন করতে পারেনি।

২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রতি বছর বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস লেগেই আছে। ১৯৯৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫২টিই প্লাবিত হয়। বিআইডিএস-এর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ‘১৮-এর বন্যায় বিভিন্ন খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ২০০০ সালের বন্যায়ও দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি খাতের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

 

 

৩. প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা

বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। সর্বত্র সেচব্যবস্থা না থাকার ফলে কৃষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হলে এখানে কৃষি কাজের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। আবার মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলেও পানি নিষ্কাশনের অভাবে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

৪. ভালো বীজের অভাব

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক অজ্ঞ ও অশিক্ষিত । অজ্ঞতার কারণে তারা ভালো বীজের সুফল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। সে কারণে তারা ভলো বীজ সংরক্ষণের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। আর ভালো বীজ ব্যবহার না করার ফলে তাদের উৎপাদিত ফসলও কম হয়।

৫. কৃষি জমির ক্ষুদ্রায়তন ও খণ্ড-বিখণ্ডতা

বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থার অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো এখানকার কৃষি জমিগুলোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আয়তন ও খণ্ড-বিখণ্ডতা। কৃষি জমিগুলো আয়তনে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ও খণ্ড-বিখণ্ড হবার ফলে কলের লাঙল বা ট্রাক্টর ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ এখানকার কৃষি জমিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও প্রয়োগ করা যায় না বলে এখানকার জমির ফলনও কম হয়।

৬. সারের অভাব

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। অর্থাভাবে কৃষিতে সারসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োগ করতে তারা ব্যর্থ হয়। সার প্রদান ছাড়াই একই জমি বারবার চাষাবাদের কারণে জমির উর্বরতা শক্তি ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক কারণে ফলনও কম হচ্ছে।

৭. ঋণের স্বল্পতা

বাংলাদেশের কৃষকগণ নিদারুণভাবে গরিব। ফলে তাদের কোনো উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে না। বর্তমানে প্রচলিত কৃষকদের কৃষি উপকরণ ক্রনা করার জন্য প্রদেয় ঋণের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অল্প, ফলে কৃষি উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উপনীত হতে পারছে না।

৮. কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়া

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন নতুন বাসস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন নতুন বাসস্থান তৈরি করতে গিয়ে আবাদযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। বাসস্থান সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে শুধু ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত চাষাবাদযোগ্য এক লক্ষ আশি হাজার একর জমি হ্রাস পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দরুন ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাবার অন্যতম কারণ।

 

 

৯. চাষাবাদে অনীহা

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় তারা কৃষি কাজের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ কৃষক পরিবারে লক্ষ্য করা যায়, যারা পূর্বে সম্পূর্ণভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল, বর্তমানে তারা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরশীল। বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির কারণে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চাষাবাদের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে কৃষি উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে ।

১০. মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য

বাংলাদেশের কৃষি বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। ফলে প্রকৃত ক্রেতা এবং প্রকৃত বিক্রেতার মাঝে থাকে অসংখ্য মধ্যস্বত্বভোগী। এ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।

১১. অন্যান্য সমস্যা

ক কীটপতঙ্গের আক্রমণ, খ. সেচের অভাব, গ. ত্রুটিপূর্ণ ভাগচাষ ব্যবস্থা, ঘ. সংরক্ষণের অভাব, ঙ. দক্ষ শ্রমিকের অভাব ইত্যাদি।

কৃষি সমস্যা সমাধান

বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপরোক্ত সমস্যাসমূহ সমাধানকল্পে নিম্নোক্ত
ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা যায়

১. পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে তারা ঠিকমতো কৃষিকাজ করতে পারে না বলে উৎপাদনও ঠিকমতো হয়। না। আর কৃষিক্ষেত্রে প্রদেয় ঋণের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয় বিধায় কৃষি উৎপাদন ব‍্যাহত হয়।

১৯৭৯-৮০ সালে বাংলাদেশের কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ৪.৫৮ ভাগ। এমতাবস্থায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়াই স্বাভাবিক। তাই কৃষিঋণের ব্যবস্থা এমনভাবে করতে হবে, যাতে কৃষকরা প্রয়োজনের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ কৃষিঋণ নিতে পারে। এক্ষেত্রে কৃষিঋণের পরিমাণ মোট উৎপাদনের ন্যূনতম ২৫% হওয়া উচিত।

 

 

২. সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ

কৃষকদের বহু কষ্টে উৎপাদিত শস্যের একটি বিরাট অংশ প্রতি বছর নানা প্রকার কীটপতঙ্গের আক্রমণে নষ্ট হয়। কৃষকরা সাধারণত এ কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিহত করতে অপারগ। তাই কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য সম্প্রতি উদ্ভাবিত সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আরো জোরদার করা উচিত।

৩. বাজার ব্যবস্থার ত্রুটি দূরীকরণ

বর্তমানে ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার দরুন কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। তাই এ সমস্যা সমাধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে সরকারি জন্মকেন্দ্র খোলা যেতে পারে। ফলে কৃষকরা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্মা থেকে মুক্তি পেয়ে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে এবং কৃষি উৎপাদনে উৎসাহী হবে, যা সামগ্রিকভাবে কৃষি উন্নয়নে প্রভাব ফেলবে।

৪. সংরক্ষণাগার স্থাপন

বাংলাদেশে সংরক্ষণের অভাবে প্রতি বছর ২৫% থেকে ৩০% কৃষিজাত পণ্য নষ্ট হয়ে যায় ৷ এই কৃষিজাত পণ্য যাতে নষ্ট না হয় সেজনা দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার স্থাপন করতে হবে। এতে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়ে অধিক পরিমাণ কৃষি উৎপাদনে উৎসাহী হবে।

৫. শ্রম দক্ষতা বৃদ্ধি

বাংলাদেশের কৃষি কাজে নিয়োজিত অধিকাংশ কৃষি শ্রমিকই অদক্ষ। কৃষি শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এতে করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

৬. উন্নত মানের বীজের ব্যবহার

বাংলাদেশের কৃষকগণ অজ্ঞতার কারণে ভালো বীজের প্রতি নজর দেয় না। ফলে তারা ফলনও কম পায়। অথচ উন্নতমানের কৃষি বীজ ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব । তাই এ ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন হতে হবে ।

৭. আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ

বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে উন্নত দেশসমূহের মতো আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হলে কৃষি উৎপাদন নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে পারে, যা কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সূচনা করতে পারে নতুন মাত্রা।

৮. সার সরবরাহ নিশ্চিত করা

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সার, কীটনাশক, ওষুধ, কৃষির উপকরণসহ কৃষিতে ভর্তুকির বিষয়গুলো জনগণ অতি সহজেই আশা করে। কৃষি জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সার প্রয়োগ করলে জমির উর্বরতা শক্তি ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তাই কৃষি উৎপাদন ও কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সারসহ কৃষি উপকরণের মূল্য স্থিতিশীলকরণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে ।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপসংহার

বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা একাধিক সমস্যায় জর্জরিত। ফলে কৃষি উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছতে পারছে না। তবে আশার কথা, বহুবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি বাংলাদেশ খাদ্যোৎপাদনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করছে এবং বিশ্বের অষ্টম খাদ্যোৎপাদনকারী দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। এ সফলতা অর্জন করায় বাংলাদেশের সরকারপ্রধান FAO-এর সেরেস পুরস্কার’ লাভ করেছে। তাই বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপরোক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করতে পারলে কৃষি ও খাদ্যোৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন জগতে প্রবেশ করতে পারবে বলে আশা করা যায়।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version