বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম [ Buddhism in Bangladesh ]

বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম [ Buddhism in Bangladesh ]: বৌদ্ধধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম (Buddhism) বাংলাদেশের বসবাসরত মানুষের একটি বড় অংশের ধর্ম। বাংলাদেশকে জানতে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মাচার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা জরুরী। গৌতমবুদ্ধের বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে তাকেই বৌদ্ধধর্ম বলা হয়। বৌদ্ধদের ধর্মশাস্ত্রের নাম ত্রিপিটক। ত্রিপিটক চারটি বৌদ্ধ সংগীতি বা মহাসমাবেশের সারসংক্ষেপ। ত্রিপিটকে তিনটি প্রধান ভাগ রয়েছে- বিনয়, সূত্ত বা সূত্র ও অভিধম্ম বা অভিধর্ম। বিনয় ভাগটিতে রয়েছে সংঘের ভেতর বসবাস করার জন্য পালনীয় অনুশাসনাবলী। সূত্ত ভাগটি মূলত গৌতম জীবনচরিত।

বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম [ Buddhism in Bangladesh ]

গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর (ধর্মের ভাষায় পরিনির্বাণ) প্রায় ২০০ বছর পর খ্রি. পৃ. ৮৮-৭৬ এর দিকে সম্রাট অশোকের আমলে পালি ভাষায় রচিত ত্রিপিটক সর্বপ্রথম সংকলনের সূচনা হয়। পালিভাষায় ‘তিপিটক’ আর সংস্কৃত ভাষায় ‘ত্রিপিটক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সংগ্রহ। বিজ্ঞজনের উপলব্ধির ধর্ম বলে পরবর্তীকালে এ ধর্মের নাম হয় ‘বৌদ্ধ ধর্ম’। গৌতম বুদ্ধের জীবন ও বাণীই বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতের নেপাল ও বিহারের সীমান্তবর্তী রাজ্যে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন ক্ষত্রিয় রাজ শুদ্ধোধন।

বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম [ Buddhism in Bangladesh ]

অন্য এক স্থানে আছে, Five hundred and sixty years before Christ a religious reformen appeared in Bengal-Buddha (Buddha and Early Buddhism)। কথিত আছে, বুদ্ধদেব মায়াদেবীর দক্ষিণাংশ ভেদ করে বের হয়ে আসেন। তাঁর জন্মের সাতদিন পরে মায়াদেবীর মৃত্যু হয়। বুদ্ধের পারিবারিক নাম ছিল গৌতম। শাক্যবংশের গৌরব বা সিংহসদৃশ মহাপুরুষ বলে আর এক নাম ছিল শাক্যসিংহ। এছাড়া শাক্যমুনি, সুগত, জিন (বিজয়ী), ভার্গব এরূপ আরও অনেক নাম ছিল।বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম (Buddhism), বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম [ Buddhism in Bangladesh ]

বুদ্ধদেবের জন্মের পূর্বে কুমারী মহামায়ার কাছে এক দেবদূত এসে বললেন : দেখো বাছা, তুমি এমন একটি সন্তান ধারণ করবে যে রাজকীয় বংশের কুমার হয়েও সংসারধর্ম ছেড়ে ‘বুদ্ধ’ হবেন এবং মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করবেন।

মহামায়া লজ্জিত হয়ে বললেন, হে দেবদূত, আমি তো কুমারী, বিবাহিত নই-সুতরাং…।’ দেবদূত বললেন, ‘চিন্তার কোন কারণ নেই ভদ্রে, সবই প্রজাপতির ইচ্ছা। তুমি সৌভাগ্যবতী।’ এই বলে দেবদূত অন্তর্হিত হলেন।

বুদ্ধের জন্মের সময় সেই নির্দিষ্ট তারকার আবির্ভাব হয়েছিল এবং স্বর্গ থেকে বহু দেবদেবী নেমে এসে তার জন্মোৎসবে মেতেছিল। বলা হয়েছিল: A hero, glorious and incompatible, has been born, a saviour unto all nations of the earth (Aryan Sun-Myths) |

বুদ্ধদেব জন্ম নিলেন ২৫ ডিসেম্বর, যখন নতুন সূর্য ওঠে। ডিসেম্বরে মকর রাশি (২১ ডিসেম্বর-১৯ জানুয়ারি)-কে হস্তীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। ঋকবেদেও মার্তণ্ডের শিশুকে সূর্য বলে ধরা হয়। যেমন, সেখানে বলা হয়েছে The elephant (Marttanda of Rig Veda) is the symbol of his son, the solar God-man; therefore Buddha comes to earth in the form of an elephant (প্রাগুক্ত)।

কথিত আছে, বিশাখা তারা থেকে বোধিসত্ত্ব শুভ্র হস্তী শাবকের আকারে নেমে এসে মহামায়ার শরীরের দক্ষিণদিকে প্রবেশ করে। এ ঘটনা মহামায়াও স্বপ্নে দেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, বোধিসত্ত্ব প্রবেশের সঙ্গে একটা পদ্মফুলের আবির্ভাব হয়, যা ব্রহ্মার প্রতীক।

বর্ণিত আছে যে, ভগবান বুদ্ধ এবং পূর্বজন্মে হস্তীদের রাজা ছিলেন। তাঁর দুই রাণী ছিল সুভদ্রা। মহাসুভদ্রা ছিল বুদ্ধের প্রিয় রাণী। সেই জন্য সুভদ্রা তাকে হিংসা করত। ইতোমধ্যে সুভদ্রা মারা গেল এবং পরজন্মে কাশীর মহারাণীরূপে জন্মলাভ করল। একদা সে এক শিকারীকে হাতির দাঁত আনার জন্য বনে পাঠাল। শিকারী খুঁজে খুঁজে হস্তীরূপী বুদ্ধকে বের করল। তার নিকট সব কথা শুনে বুদ্ধ নিজেই তাঁর দাঁত কেটে শিকারীকে দিলেন। কিন্তু যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি মারা যান। এই গল্পটির নাম ‘ছন্দক দাতক’। সাঁচী স্তূপের পশ্চিম তোরণে সহচরসমেত হস্তীরূপী বুদ্ধের চিত্র খোদাই করা আছে।

বুদ্ধ তাঁর মত প্রচারের পূর্বে রুদ্রক ব্রাহ্মণের সাক্ষাৎ পান এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তারপর তিনি উরুভেলায় তপস্যা শুরু করে উপবাস করেন। পরে নিরঞ্জন নদীতে স্নান করেন। তিনি যখন তপস্যা শুরু করেন, তখন ‘মার’ অর্থাৎ দুষ্ট প্রকৃতির শয়তান তাঁকে প্রলুব্ধ করে ফেরাতে চেয়েছিল। কিন্তু বেদের মন্ত্রের জোরে শয়তান তার চেষ্টায় সফল হয়নি। বুদ্ধত্ব লাভের পর দেবদূতেরা তাঁকে অভিবাদন জানায়।

পবিত্র ডুমুর বৃক্ষের তলে বুদ্ধ তাঁর শিষ্য সংগ্রহ শুরু করেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে জুডাস-এর মত (যে শিষ্য যিশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল) এক শিষ্য ছিল-দেবদত্ত। এই দেবদত্ত বুদ্ধকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি।

বুদ্ধ সঙ্গানদীর উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে গেছেন। তিনি রুগ্ন ব্যক্তিদের স্পর্শের দ্বারা আরোগ্য করেছেন। কিন্তু সন্দেহবাদীর ভ্রম নিরসনে বুদ্ধদেব গভীর নদীর উপর দিয়ে হেঁটে গেছেন। অথচ তাঁর পায়ে একফোঁটা জল স্পর্শ করেনি। এক দুষ্কৃতকারী রাজা তার এক শিষ্যের পা কেটে দিলে তিনি তা জোড়া দিয়ে সবল করেন। তাঁর দর্শনে রোগীদের রোগ সেরে যেত, অন্ধ তার দৃষ্টি ফিরে পেত এবং বধির ফিরে পেত তার শ্রবণশক্তি। তাঁর শিষ্যেরাও মোজেজা দেখাতে পারত। যেমন, এক জাহাজডুবির ফলে এক ভক্ত বিপদাপন্ন হলে তাঁর এক শিষ্য মন্ত্রের প্রভাবে তাকে উদ্ধার করে। এমনকি তাঁর শিষ্যেরা বিদেশী ভাষা বুঝতে ও বলতে পারার ক্ষমতাও অর্জন করেছিল।

সংস্কারক হিসেবে বুদ্ধদেব যা করেছিলেন, তা হল, তিনি পুরোহিতশ্রেণির ক্ষমতা খর্ব করেন, জাতিভেদ প্রথার উচ্ছেদ সাধনে প্রয়াসী হন, বহুবিবাহ ও দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, নারীদের তিনি পুরুষের সমান অধিকার দেন এবং আধ্যাত্মিক জীবনে যে তাদেরও অধিকার আছে, এর স্বীকৃতি দেন, রক্তক্ষয় বন্ধ করেন।

বুদ্ধদেবই প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রতিবাদ করে বলেছিলেন যে, অনুষ্ঠান ও পশুবলির মাধ্যমে পুণ্যলাভ করা যায় না। আত্মশুদ্ধির জন্য সংযম ও অনুশীলনের প্রয়োজন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রচারকদের মাধ্যমে ধর্মপ্রচার করে মানুষের চেতনা জাগাতে প্রয়াসী হন।

বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম (Buddhism), বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম [ Buddhism in Bangladesh ]

বুদ্ধদেব প্রায় ৪৫ বছরকাল ধর্মপ্রচার করেন এবং খ্রি. পূ. ৪৮৩ অব্দে দেহত্যাগ করেন। বুদ্ধের মৃত্যুর অনেক পরে (খ্রিষ্টের জন্মের একশ বছর পর) রাজা কণিষ্কের সময় কয়েকজন বৌদ্ধ পণ্ডিত মহাযান বলে বৌদ্ধধর্মের এক নতুন শাখা প্রবর্তন করেন। এরা বলেন, বুদ্ধত্ব বা নির্বাণ লাভ করলে মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়। যে প্রাণী বুদ্ধত্ব লাভের চেষ্টা করছেন, অথচ সম্পূর্ণরূপে বুদ্ধ হননি, তিনিই পৃথিবীর যথার্থ উপকার করতে পারেন। এ প্রাণীর নাম বোধিসত্ত্ব। সুতরাং ধর্ম উপার্জন করতে হলে বুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে বোধিসত্ত্বকে পূজা ও ভক্তি করা এবং বোধিসত্ত্বদের মত লোকসেবা করা উচিত। অতি সংক্ষেপে এটাই মহাযানদের মত। যারা মহাযান মত মানতেন না, তাদের হীনযান বলা হত। চীন-জাপানের বৌদ্ধরা মহাযানী, আর শ্যাম, সিংহল প্রভৃতি দেশের লোকেরা হীনযানী 1

বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর শিষ্যগণ তাঁর মৃতদেহ জ্বালিয়ে দিলে বৃষ্টি হয়। ফলে তাঁর হাড়গুলো রক্ষা পায়। ভক্তগণ এই হাড়গুলো আটভাগে ভাগ করে আটটি পাত্রে রেখে একেকটি স্তুপ নির্মাণ করেন। কথিত আছে, সম্রাট অশোক (খ্রি. পৃ. ২৬৯-২৩২) এই আটটি স্তুপ ভেঙে হাড়গুলো বের করে নেন এবং এগুলো ভাগ করে ৮৪,০০০ স্তুপ নির্মাণ করেন।

বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হবার পর প্রায় ৪০০-৫০০ বছর পর্যন্ত বৌদ্ধগণ মূর্তিপূজা করতেন না। এমনকি বুদ্ধের কোন ছবিও আঁকা হয়নি। বুদ্ধের জন্ম দেখবার দরকার হলে একটি পদ্ম এঁকে দেখানো হত। সম্ভবত খ্রিষ্টের প্রথম শতক হতে বৌদ্ধধর্মে মূর্তিপূজা শুরু হয়। গান্ধার ছাড়া মথুরা প্রভৃতি অঞ্চলে বহু মূর্তি পাওয়া গেছে। এসব অঞ্চলে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব ব্যতীত আরও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি দেখতে অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, তারা প্রভৃতি। পাওয়া যায়। যেমন,

ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিষ্টাব্দ ৩২০-৫৪৫ কুমার গুপ্ত পর্যন্ত) সময় থেকে বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে যায় এবং খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতক থেকে এর প্রাধান্য লোপ পায়। তবে সনাতন ধর্মে বুদ্ধকে বিষ্ণুর এক অবতার বলে মেনে নেয়া হয়েছে। জয়দেবের ‘দশাবতার স্তোত্র’-এ আছে :

‘নিন্দসি যজ্হবিধেরহহ শ্রুতি জাতং

সদয় হৃদয় দর্শিত পশুঘাতম্।

কেশব ধৃত বুদ্ধশরীর

জয় জগদর্শী হরে।

অর্থাৎ যজ্ঞের নিয়ম যে সকল বেদবাক্য দেয়া আছে, তুমি তার নিন্দা করো; কারণ যজ্ঞে পশুবধ দেখে তাদের হৃদয় করুণায় গলে যায়; হে বুদ্ধরূপী কৃষ্ণ, তোমার জয় হোক।

বুদ্ধদেব ভগবান মানতেন না। কিন্তু তাঁর অনুসারী ভক্তগণ তাঁকে ভগবান বানিয়ে ছেড়েছে। সূর্যপুরাণের মাহাত্ম্য এখানেই। আর্থার লিলি তাই বলেছেন: A new Sun Myth had to be made for Buddha, and not a Buddha for a Sun-Myth. (Buddha and Early Buddhism) | বুদ্ধদেবের দশটি প্রধান উপদেশবাণী হল :

  • কাউকে হত্যা করবে না।
  • কোন জিনিস কেউ না দিলে গ্রহণ করবে না।
  • অবৈধ যৌনকর্মে লিপ্ত হবে না।
  • মিথ্যা কথা বলবে না।
  • নেশাগ্রস্ত হবে না অর্থাৎ মাদকদ্রব্য সেবন করবে না।
  • দুপুরের পর খাদ্যগ্রহণ করবে না। জাগতিক আমোদ-প্রমোদে মত্ত হবে না।
  • অলংকার ও সুগন্ধিদ্রব্যে ভূষিত হবে না। উঁচু ও গদিযুক্ত আরামদায়ক বিছানায় শোবে না।
  • স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য গ্রহণ করবে না।

সিদ্ধার্থ বাল্যকাল থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে বিচলিত হন এবং দুঃখকে কীভাবে অতিক্রম করা যায় সে সম্বন্ধে ভাবেন। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু এই বিষয়গুলি যে সকল জীবের জন্য সত্য তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। শুধু মানুষ কেন অন্যান্য জীবের মধ্যে কি জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু নেই? এ সকল বিষয় চিন্তা করে চারটি সত্যের পথ (চতুরায্য সত্য) আবিষ্কার করে তিনি ‘বুদ্ধ’ হলেন? ‘বুদ্ধ’ কোন্ চারটি সত্যের পথ (চতুরায্য সত্য) আবিষ্কার করে তিনি ‘বুদ্ধ’ হলেন। ‘বুদ্ধ’ কোন ঐশ্বরিক কিছু নয়, অলৌকিক অথবা অতীন্দ্রিয়ও নয়। ‘বুদ্ধ’ ছিলেন একজন জ্ঞানী; যিনি জীবন ও জগতের সকল বাস্তব ধর্মকে সম্যকভাবে জেনেছেন স্বপ্রজ্ঞায় ও স্বপ্রচেষ্টায়।

বুদ্ধ ‘সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত করেন। এটি একটি অদ্বৈত আদর্শ। এ আদর্শ ব্যক্তি তথা সমাজের বহুজনকে একত্র করাই শিক্ষা। ‘সংঘ’ একটি শক্তি। ঐক্য ও সংহতি। বুদ্ধের এ আদর্শ দেখে যিশু প্রচার করেন ‘ঈশ্বরের রাজত্ব’। এটি একটি সামাজিক আদর্শ। বৌদ্ধ ধর্ম এবং খ্রিষ্ট ধর্ম-এর এ আদর্শকে দেখে দার্শনিক হফডিং (Hofding) তাঁর Philosophy of Religion গ্রন্থে মন্তব্য করে বলেন : ‘যিশু যেখানে ইয়োরোপকে বিশালতর করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, বুদ্ধ সেখানে সমগ্র এশিয়াকেই আলোকিত করেছেন।’ বৌদ্ধ ধর্মের জন্য এর চেয়ে শ্রেষ্ঠতম মন্তব্য আর কী হতে পারে? এদিক দিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম এক যুগান্তকারী ধর্ম।

বুদ্ধ যুগ এবং এবং প্রাক্ বৌদ্ধ যুগের ঐতিহাসিক বিচারে দেখা যায় পরস্পর-বিরোধী নানান মতবাদ, প্রথা, আত্মা, ঈশ্বর, জগৎ ইত্যাদি সম্বন্ধে অপ্রচ্ছন্ন ধারণা সে যুগের জনজীবনকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। ফলে সৃষ্টি হত সূক্ষ্ম তর্ক যুদ্ধের। একদিকে ছিল বেদ, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার, অন্যদিকে বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের প্রাণীহত্যা ইত্যাদি অনুষ্ঠান-সর্বস্বতা। ছিল নিগ্রহ, ছিল জড়বাদী ধ্যান ধারণা, ছিল অবিশ্বাসী নানা ধরনের প্রচলিত বিশ্বাস। চিন্তা জগতে এসেছিল এক সর্বনাশা এবং সর্বগ্রাসা অরাজকতা- তখনই বুদ্ধ প্রচার করলেন অহিংসা, মৈত্রী করুণার বাণী। প্রচার করলেন দুঃখ-সমুদয়, দুঃখ নিরোধমার্গের কথা। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (আটটি বিশুদ্ধ বা সম্যক পথ), কর্মবাদ, প্রতীত্যসম্যুৎপাদবাদ (কার্যকারণবাদ), পঞ্চস্কন্ধ ইত্যাদি বিজ্ঞানভিত্তিক মতবাদ।

বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম, Buddhism in Bangladesh
বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম, Buddhism in Bangladesh

 

বুদ্ধ প্রদর্শিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ হল :

১. সম্যক দৃষ্টি (right belief or knowledge or right perception) ২. সম্যক সংকল্প বা সম্যক চিন্তা (right thought)
৩. সম্যক বাক্ (right speech)
৪. সম্যক কর্ম (right action)
৫. সম্যক আজীব (right means of livelihood)
৬. সম্যক ব্যায়াম (right exertion or endeavour)
৭. সম্যক স্মৃতি (right concentration or meditation)

এই আটটি একত্রে অষ্টাঙ্গিক পথ। এই পথে সাধন করে সাধক সত্যে উপনীত হতে পারেন।

বুদ্ধ এমন একটি পথ আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, যা মানুষকে জাগতিক দুঃখের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে, তাকে প্রকৃত সুখ ও শান্তির সন্ধান দেবে। তাই তিনি ধর্মচক্র প্রবর্তন-এ (প্রথম ধর্ম প্রচার) চারটি ‘আর্যসত্য’ পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আর্যসত্যগুলি হল- ১. জীবন বা অস্তিত্ব দুঃখের, ২. কামনা-বাসনা (তহা-তৃষ্ণা), আসক্তি ইত্যাদি জাগতিক অস্তিত্ব সমুদয়ের মূল কারণ, ৩. কামনা-বাসনা (তৃষ্ণার) অবসানের উপায় বা পথ বর্তমান। এই পথ বা মার্গ হল ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ।’

ঈশ্বরের ধারণা বৌদ্ধ ধর্মে স্থান পায়নি। কর্মবাদকে ঈশ্বরের স্থানে বসানো হয়েছে। বৌদ্ধ কর্ম, ঈশ্বর কিংবা দেবতার ইচ্ছা নয় কর্ম নৈর্ব্যক্তিক। এটি একটি মৌল ধারণা। ঈশ্বর বা খোদার দোহাই দিয়ে বুদ্ধ মানুষের অর্জন এবং মনন শক্তিকে খাটো করতে চাননি। বুদ্ধ প্রমাণ করতে চেয়েছেন ঈশ্বর, খোদা, (God) অথবা দৈবশক্তির চেয়েও মানুষের আত্মশক্তি, সৃষ্টিশক্তি অথবা প্রজ্ঞাশক্তি অনেক অনেক বড়। সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার বৌদ্ধ ধর্মে স্বীকৃতি পেয়েছে। একমাত্র গৌতম বুদ্ধই শ্রেণি বৈষম্য এবং জাতিগত বাধা ভেঙে দিয়ে পরিত্রাণের পথ দেখিয়েছেন সকল শ্রেণির মানুষকে।

অন্যান্য ধর্মের মত বৌদ্ধ ধর্মেও বিভক্তিকরণ দেখা যায়। বৌদ্ধধর্ম প্রথমত হীনযান এবং মহাযান এ দুভাগে এবং পরে আঠার ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এ বিভক্তি সংঘের ঐক্য, সংহতি ও অদ্বৈত আদর্শকে বিনষ্ট করেছে। সংঘের বিভিন্ন মত, ধ্যান ধারণা এবং বিশ্বাস মেনেই এই বিভক্তিকরণের উদ্ভব ঘটেছে। শীল, সমাধি, প্রজা-এ তিনটি বৌদ্ধ ধর্মের সার সংক্ষেপ। একজন মানুষের পরিপূর্ণতা আসে এ তিনটির মধ্য দিয়েই। এর মধ্যদিয়েই বিমুক্তজীবন, এর মধ্য দিয়েই নির্বাণ। ‘নির্বাণ” বৌদ্ধ ধর্মের পরম এবং শ্রেষ্ঠতম স্থান।

বৌদ্ধধর্মের আধ্যাত্মবাদী দর্শনের মূলকথা বোধিসত্ত্বের মধ্যে নিহিত রয়েছে। গভীর অরণ্যের বোধিবৃক্ষ মূলে ক্রমাগত ছয় বছর কঠোর ধ্যান করে গৌতম বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব বা পরম জ্ঞান লাভ করেন। কথিত আছে যে, বুদ্ধ ৫৫০ বার জন্মগ্রহণ করে জগতের সকল প্রাণীর মুক্তি কামনা করেন। তিনি কখনও রাজা, কখনও প্রজা, দেবতা, বণিক, চণ্ডাল আবার কখনও হাতি, ঘোড়া, ময়ূর, রাজহাঁস কিংবা অন্যান্য পশু-পাখিরূপে ২,৫০০ বছর ধরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রতি জন্মেই তিনি কোন কোন পারমীর শর্ত পূরণ করে ক্রমশ পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। বোধিসত্ত্ব লাভের পর ধ্যানমগ্ন হয়ে তিনি অতীত জীবনের সকল কথা স্মরণ করেন, যা জাতকের গল্প হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। জাতকের কাহিনীগুলোতে জন্ম-জন্মান্তরের সাধনা দ্বারা জীবনের গতিকে একটি উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের একটি প্রচ্ছন্ন ধারণা রয়েছে।

 

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার [ 7th century buddhist monastery ]
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার [ 7th century buddhist monastery ]

 

বুদ্ধের ধর্মদর্শন পর্যালোচনা করলে দুটি সত্য প্রতিভাত হয়। একটি ব্যবহারিক সত্য আর অপরটি আধ্যাত্মিক বা পরমার্থ সত্য। আমি, তুমি, সে—এগুলো হচ্ছে ব্যবহারিক অনিত্য, দুঃখ, অনাত্ম—এগুলো হচ্ছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান। আধ্যাত্মিকতার উন্নতিকল্পে ধ্যানমগ্নতার বিষয়টিতেই বৌদ্ধধর্ম অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। অন্তর্দৃষ্টিতে জ্ঞানালোকের বিকিরণ ঘটিয়ে আত্মার মুক্তি অন্বেষণ করার মধ্যেই বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের সঞ্চালন। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গের সন্ধান দিয়েছেন। আট অঙ্গের সমন্বয়ে দুঃখ মুক্তির এই একমাত্র উপায়টির নাম অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই অষ্টাঙ্গিক মার্গের শেষ স্তর হল সম্যক। সমাধি যার মাধ্যমে সাধক

আত্মার মুক্তি তথা নির্বাণ লাভ করতে পারেন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে পাল শাসন ছিল বুদ্ধের শিক্ষায় আলোকিত। এ শিক্ষা বিস্তার লাভ করেছিল আরব, গ্রিস, এশিয়া মাইনর সমগ্র মধ্য এশিয়া হয়ে চীন-জাপান পর্যন্ত। আজ দুনিয়ার যেখানেই লুপ্ত বৌদ্ধ সভ্যতার সন্ধান মিলছে সেখানেই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বৌদ্ধ বিহারের। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের। যা অপরাপর সভ্যতার ক্ষেত্রে খুবই বিরল। যাই হোক, মহান বুদ্ধের শিক্ষায় কোথাও মূর্তিপূজার কোন স্বীকৃতি নেই, পূজা কেন থাকবে? কারণ তাঁর শিক্ষায় তো ঈশ্বরই ছিল অনুপস্থিত; তিনি ছিলেন, নিরীশ্বরবাদী। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা, প্রথা-সর্বস্বতা, যাগ-যজ্ঞের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন।’ বুদ্ধদেব ছিলেন মূর্তিপূজার ঘোরতর বিরোধী। তিনি চাইতেন না কেউ তার পূজা করুক।

আমাদের জানা কালের মধ্যে বুদ্ধদেবই প্রথম মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। (কিন্তু) তার এই বিদ্রোহ সহিংস ছিল না। ছিল একেবারে অহিংস। কখনো কোথাও তিনি বলেননি মূর্তি ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তিনি তার ধর্মমতে স্থান দেননি মূর্তিপূজাকে। তাই সম্রাট অশোকের আমলে (২৭৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) বৌদ্ধ ধর্ম যখন তার প্রাধান্যের চরম শিখরে পৌছালো তখনও বুদ্ধদেবের মূর্তি পূজার শুরু হয়নি। এমনকি তখনও বুদ্ধের কোন মূর্তি তৈরি করা হয়নি। ধর্মের নিষিধের কারণে। ফলে কাকে পূজা অর্চনা দেবে?

তবে হ্যাঁ, মহান বুদ্ধের তিরোধানের প্রায় ৩০০ বছর পরে মথুরা অঞ্চলে পাথরের বুদ্ধ মূর্তি বানানো শুরু হয়। এই সময় থেকেই বুদ্ধ মূর্তির পূজা চলতে থাকে। পরে ভক্তকুল তাদের আপনজনের বিচ্ছেদের ব্যথা ভুলে থাকার জন্য যেমন সংগ্রহ করেছিল বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শনসমূহ তেমনি অতিভক্ত অনুসারীদের কেউ কেউ স্বয়ং বুদ্ধকেই প্রভু জ্ঞান করে প্রভু বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণপূর্বক তাতে ভজতে আরম্ভ করে। এভাবেই পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মন বা বৌদ্ধ মত পরিণত হয় বৌদ্ধ ধর্মে আর নিরশ্বরবাদী বুদ্ধ স্বয়ং বনে যান ‘ঈশ্বর’।

আধুনিকযুগে আবার বৌদ্ধধর্ম গুরুত্ব পেতে থাকে এবং ভারতীয় জীবনবোধের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীলংকার বৌদ্ধ ভিক্ষু অনাগরিক ধর্মপাল (১৮৬৪-১৯৩৩) কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মহাবোধি সোসাইটির সকল সদস্যদের ব্যক্তিগত জীবন বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে আনা এবং তার আদর্শ সদস্যদের আত্মীয় ও পরিজনদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। এই সোসাইটি ভারত ও শ্রীলংকার সকল বৌদ্ধ সৌধগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং পুনর্নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়। এ সময়ের অপর একটি বৌদ্ধ সংগঠন ছিল ভারতীয় বুদ্ধ মহাসভা।

সমাজে খাপ খাওয়াতে না পেরে বঞ্চিত শ্রেণির মানুষেরা বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং হচ্ছেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রয়াত বি. আর. আম্বেদকার এবং তাঁর শিষ্যদের এই ধর্মগ্রহণ করার ঘটনা থেকে। মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায়ের সকল মানুষ এবং কিছু তফশিলী জাতিভুক্ত মানুষও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

গৌতম বুদ্ধ জন্মেছিলেন জম্বুদীপের (পরবর্তীকালে ইন্ডিয়া নামে পরিচিত, ভারতবর্ষ বা হিন্দুস্থান) এক শ্রেণিবিভক্ত সমাজে। তিনি সমকালীন ভারতীয় মানসলোক চিনতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন জীবনের অশান্তির রূপকে প্রত্যক্ষ করতে। তাই তিনি মানুষের দুঃখের কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন। সে ব্যাপারেই তিনি বোধি লাভ করেছিলেন। সাধারণ মানুষকে জীবনধারণের নতুন পথরূপে ‘মধ্যম’ পথের সন্ধান দিয়েছিলেন, যে পথ বর্তমান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও বহির্বিশ্বেও প্রাসঙ্গিক। রাজনীতি, ধর্মীয় ও সামাজিক অবনমন থেকে এর মাধ্যমেই মুক্তিলাভ করা যায়। তাই একদা প্রায় অবসিত বৌদ্ধধর্ম বাঙালি সমাজ তথা বর্তমান বিশ্বে আজও প্রাসঙ্গিক।

 

Ruins of Bhuddist Bihara, Somapura Mahavihara, নওগাঁর পাহাড়পুরের প্রাচীন বৌদ্ধপীঠের ধ্বংস স্তুপ
Ruins of Bhuddist Bihara, Somapura Mahavihara, নওগাঁর পাহাড়পুরের প্রাচীন বৌদ্ধপীঠের ধ্বংস স্তুপ

 

সহায়ক গ্রন্থাবলি  :

  • সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বৌদ্ধ ধর্ম; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৭৭
  • ড. মানকুন্তলা হালদার দে, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস; করুণা প্রকাশনী, কলকাতা ১৯৭৮
  • গিরিশচন্দ্র বড়ুয়া, বৌদ্ধধর্ম; বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৮
  • ড. সুকোমল বড়ুয়া ও সুমন কান্তি বড়ুয়া, ত্রিপিটক পরিচিতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ;
  • বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০০ জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া, বৌদ্ধধর্মের কর্মবাদ বনাম সৃষ্টিরহস্য; কৃষ্টি সাহিত্য সংসদ,
  • ঢাকা, ২০০০ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বৌদ্ধধর্মের উন্মেষ: ভারতে এবং বহির্বিশ্বে; প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০২
  • ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য, বৌদ্ধদের দেবদেবী; চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা ২০০৫

আরও পড়ুন:

Leave a Comment