বাংলাদেশে শিল্পায়নের সমস্যা রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।
Table of Contents
বাংলাদেশে শিল্পায়নের সমস্যা
বিশ্ব আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। কারণ শিল্পবিপ্লব মানব জীবনকে স্বপ্নের মতো রঙিন করে দিয়েছে। জীবন হয়েছে সুখের, ভোগের ও আরামের। আবার অন্যদিকে কতিপয় মানুষ, সমাজ তথা দেশ বিভিন্ন কারণে এর আশীর্বাদ থেকে পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ তেমনি একটি দেশ, যেটা এখনো শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ
বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শোষণ, নির্যাতন, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ও বিপ্লবের ফলে শিল্পায়নের তেমন বিকাশ ঘটাতে পারেনি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শোষণ ও বৈষম্য, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি প্রভৃতি কারণেও এ দেশে শিল্পায়ন বিকাশ লাভ করতে পারেনি। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:
১. ঐতিহাসিক পটভূমিগত কারণ
বর্তমান বাংলাদেশ যে ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত তা ঐতিহাসিক বিভিন্ন পর্বে বিদেশীদের দ্বারা শাসিত, শোষিত, বঞ্চিত, লুণ্ঠিত ও অবহেলিত হয়ে আসছে। ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক ভিত বরাবরই থেকেছে দুর্বল। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন পাশ্চাত্যে ব্যাপক শিল্পায়ন প্রক্রিয়া চলছিল, তারই একটা বিশেষ পর্বে (১৭৫৭-১৯৪৭) বাংলাদেশ ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ।
ব্রিটিশ যুগে শাসকগোষ্ঠী ভারতের কয়েকটি স্থানে যেমন— কলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ প্রভৃতি এলাকায় শিল্প-কারখানা গড়ে তুললেও এ অঞ্চলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার শিল্পায়নে কোনো প্রয়াস নেয়নি। অধিকন্তু বাংলাদেশ ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্য বিক্রির অন্যতম বাজারে পরিণত হয়। ফলে শিল্পায়ন তো দূরের কথা, ব্রিটিশ শিল্পজাত দ্রব্য এখানে আমদানির ফলে আমাদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পও ভেঙ্গে পড়ে।
২. উদ্যোক্তার অভাব
মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিতে সক্ষম এমন উৎসাহী ব্যক্তি তথা উদ্যোক্তার অভাব থাকায় বাংলাদেশ শিল্পায়নে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পাশ্চাত্যের শিল্পায়িত সমাজে অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিয়ে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলে। কিন্তু বাংলাদেশে বরাবরই শিল্পায়নে আগ্রহী ও উদ্যোগী ব্যক্তির বেশ অভাব লক্ষ্য করা গেছে। উদ্যোক্তার অভাবেই বাংলাদেশে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
৩. আধুনিক প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানের অভাব
শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হলে দরকার আধুনিক প্রযুক্তির পর্যাপ্ততা তথা প্রযুক্তি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান। কারণ প্রতিটি শিল্প-কারখানায়ই আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে। সেজন্য কেবল পুঁজি ও সদিচ্ছা থাকলেই শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা যায় না । শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হবে এমন যন্ত্রের কলকব্জা, চালন ক্ষমতা ও কৌশল সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের জনগণের সে জ্ঞানের অভাবে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেনি।
৪. দক্ষ শ্রমিকের অভাব
বাংলাদেশ শিল্পায়নের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। আমাদের দেশে শিক্ষার হার খুবই কম। তার ওপর শিক্ষাব্যবস্থা এমন যে, তা দক্ষ শ্রমিকের অভাব পূরণে ব্যর্থ। কারণ আমাদের দেশে আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষার অভাব সর্বত্র বিরাজমান। ফলে আমাদের বেকার জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশই প্রযুক্তি জ্ঞানহীন। সুতরাং দক্ষ শ্রমিকের অভাব আমাদের দেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক বাধা।
৫. রাজনৈতিক কারণ
শিল্পায়নের ক্ষেত্রে দুটি রাজনৈতিক কারণেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। যেমন
ক. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন কারণে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন এবং বারবার শিল্পনীতি পরিবর্তিত হওয়ায় বাংলাদেশে শিল্পোন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
খ. কোনো শিল্পপতিই চান না যে, তার কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হোক। কারণ উৎপাদন ব্যাহত হলে তার লোকসানের আশঙ্কা থাকে। বিভিন্ন কারণে হরতাল, ধর্মঘট, মিছিল, ভাঙচুর হলে শিল্পপতিরা শিল্প-কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে উৎসাহ বোধ করেন না।
৬. প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। যারা দরিদ্র নয় তাদের অনেকেরই আবার সঞ্চয় করার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই। আর সঞ্চয় না থাকলে শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগের জন্য মূলধন সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য চাই প্রচুর মূলধন। তাই প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবেও এখানে শিল্পায়ন ব্যাহত হচ্ছে।
জনসাধারণের যে ক্ষুদ্র অংশটি মূলধন গঠনে সক্ষম তাদের অনেকেই আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টরে অর্থ বিনিয়োগ করতে চায় না। তারা তাদের অর্থ জাঁকজমকপূর্ণ ঘরবাড়ি, জমিজমা, স্বর্ণালংকার, গাড়ি ও অন্যান্য বিলাসদ্রব্য সামগ্রীর পেছনে ব্যয় করে। সুতরাং মূলধনের অভাব বাংলাদেশে শিল্পায়নের অন্যতম অন্তরায়।
৭. মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব
ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি শিল্প-কারখানা গঠনের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। একটি বৃহৎ শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। ঐ কারখানা স্থাপনের শুরুতে যে আনুমানিক খরচ ধরা হয় বছরের ব্যবধানে মুদ্রাস্ফীতির কারণে সে খরচ অপর্যাপ্ত মনে হয়। কারণ বিভিন্ন উপকরণের দাম অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে চলে। এমন অবস্থায় গৃহীত প্রকল্প শেষ করতে আরো অর্থ খরচ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতির কারণে আমাদের দেশে কোনো শিল্প উদ্যোক্তার পক্ষে তাই স্থির করা সম্ভব নয় যে, তাকে প্রকল্পের জন্য মোট কত অর্থ ব্যয় করতে হবে। আর এসব কারণেই অনেক শিল্প উদ্যোগী ব্যক্তি শিল্প স্থাপনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
৮. শর্তহীন বৈদেশিক সাহায্যের অভাব
এ কথা ঠিক যে, শিল্পায়িত অনেক দেশ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের উন্নয়নকল্পে তাদের সাহায্যের হাত অধিকতর সম্প্রসারিত করেছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, ঐ সব সাহায্য শর্তহীন নয়। সাহায্যদাতা দেশগুলো তাদের দেশের যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল আমাদের অধিক দামে কিনতে এবং সে দেশের টেকনিশিয়ান বা এক্সপার্টদের অনেক বেতনে এ দেশের বিভিন্ন প্রযুক্তি পরিচালনায় চাকরি দিতে শর্ত আরোপ করে। ফলে বৈদেশিক সাহায্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সাহায্যদাতা দেশেই নানাভাবে ফিরে যায়।
৯. উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব
উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব বাংলাদেশের শিল্পায়নের পথে একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অন্তরায়। বিশেষ করে স্থল ও জলপথ ব্যবস্থা অন্যাবধি এতই অনুন্নত যে, শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী, স্বল্প সময়ে ও স্বল্প বায়ে আনা-নেয়া সম্ভব হয় না। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত বলেই আজও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও চাহিদা অনুসারে শিল্প-কারখানা স্থাপন করা যাচ্ছে না। কেবল কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায়ই শিল্প-কারখানা স্থাপনের কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। সাম্প্রতিক কালের যানজট ও প্রতিনিয়ত পরিবহন ধর্মঘট যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
১০. কাঁচামাল ও খনিজ সম্পদের অভাব
শিল্পের জন্য চাই পর্যাপ্ত পরিমাণে ও নিয়মিতভাবে কাঁচামালের সরবরাহ। দেশে বিভিন্ন ধরনের ভারী শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাঁচামাল আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। এগুলো আমদানি করতেও প্রচুর খরচ লাগে। আবার শিল্পের জন্য দরকার পর্যান্ত শক্তিসম্পন্ন বা খনিজসম্পদ। যেমন তেল, লৌহ, কলো, ইস্পাত ইত্যাদি। এগুলোর অভাবে বাংলাদেশের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
১১. দেশাত্মবোধের অভাব
আমাদের দেশের জনগণের স্বদেশে তৈরি শিল্পজাত দ্রব্য কেনার পরিবর্তে বিদেশী জিনিসপত্র কেনার প্রবণতা বেশি। ফলে দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রি হয় কম এবং এতে করে দেশীয় শিল্পগুলোকে চরম লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। দেশাত্মবোধের অভাবে জনগণ দেশীয় শিল্পের বিকাশে সহযোগিতা করেছে না ।
১২. জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে উচ্চাভিলাষী ও হিতৈষী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ বরাবরই আরে ভুষ্ট থেকেছে বা তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়েছে। মোটা ভাত মোটা কাপড় এবং মাথা গুঁজবার ঠাঁই হলেই তারা পরিতুষ্ট। এর চেয়ে বেশি কিছু পাবার তেমন প্রয়োজন বোধই জাগেনি। ইদানীং বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তরকালে যদিও অনেকেই জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে উচ্চাভিলাষী মনের পরিচয় দিচ্ছে, তথাপি তাদের অনেকেই কেবল ভোগবিলাসী জীবনের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছে।
আরো অধিক মুনাফার আশায় তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হিতৈষী মনে তারা শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে নারাজ। তারা নানা কারণে এটাকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ মনে করে। বিনা ঝুঁকিতে সহজে রাতারাতি অধিক সম্পদশালী হবার বাসনা ও মনমানসিকতার কারণে দেশে একটি স্থায়ী শিল্পপতি শ্রেণী গড়ে উঠতে পারছে না।
প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূরীকরণের উপায়
বাংলাদেশে শিল্পায়নের পথে যেসব অন্তরায় রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে ইতিমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত ঐ সব প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করতে পারলেই বাংলাদেশে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে এবং দেশ শিল্পায়িত হবে বলে আশা করা যায়। নিচে এসব প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের উপায়সমূহ উল্লেখ করা হলো:
১. অবকাঠামো উন্নয়ন
বাংলাদেশ সফর শেষে একজন বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের শিল্পায়ন বিকাশের পথে প্রধান বাধা হচ্ছে দুর্বল অবকাঠামো যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন বাংলাদেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই বাংলাদেশের শিল্পায়নের জন্য অবকাঠামো উন্ননে একান্ত অপরিহার্য।
২. ঋণখেলাপি সংস্কৃতি রোধ
ঋণখেলাপিরা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান শত্রু। খেলাপি ঋণগ্রহীতারা নানা প্রভাব প্রতিপত্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের নামে শত শত কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ না করে অন্য অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে । এই খেলাপি ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়মিত পরিশোধ করা হলে উক্ত টাকা পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতি লাভবান হতো। কিন্তু ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে দেশ সমৃদ্ধির সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই জাতীয় সার্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের স্বার্থে এই ঋণখেলাপি সংস্কৃতি বন্ধ করা অতীব জরুরি।
৩. প্রযুক্তির উন্নয়ন
বাংলাদেশের শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির লাগসই ব্যবহার অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রবার্ট শোলো প্রমাণ করেছেন যে, দেশের শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে পুঁজি ও শ্রমের অবদানের তুলনীয় প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং এর যথোপযুক্ত ব্যবহারের অবদান অনেক বেশি। পুঁজি ও শ্রমের বর্ধিত দক্ষতার সাথে প্রযুক্তির সার্বিক প্রয়োগ না থাকলে উন্নয়নের গতি মন্থর হতে বাধ্য। তাই বাংলাদেশকে শিল্পায়নের চালের মোকাবিলা করতে প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ নজর দিতে হবে।
৪. স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের মতে, বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ব্যবস্থার অভাবে প্রশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলছে দুর্নীতি। তাই শিল্পায়নের স্বার্থে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন।
৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
শিল্পায়নের জন্য দেশে একটি গণতান্ত্রিক তথা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন উন্নয়নের জন্য একটি যৌক্তিক রাজনৈতিক দর্শনের।
৬. নীতি নির্ধারণ ও নীতি প্রণয়ন
সরকারি নীতি নির্ধারণ ও নীতি প্রণয়নে এমন রাজনৈতিক দর্শনের প্রয়োজন, যাতে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে দেশের উদ্যোক্তারা আগ্রহী হন ।
৭. বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি
মূলধন গঠনে উদ্বুদ্ধ করা এবং যাদের প্রয়োজনীয় মূলধন রয়েছে তারা যাতে নির্বিঘ্নে নিরাপত্তার সাথে শিল্প-কারখানায় অর্থ বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হতে পারে, তেমন একটি অনুকূল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
৮. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা
আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক সময় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অতিরিক্ত অনেক সময় লেগে যায়। ফলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায় বহুগুণ। তাই শিল্প স্থাপনের উপাদান সহজলভ্য করার জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
৯. দেশাত্মবোধ সৃষ্টি
দেশাত্মবোধ সৃষ্টির জন্য দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি ও বিদেশী পণ্য বর্জন করার মন-মানসিকতা সৃষ্টি করতে জনমত গড়ে তুলতে হবে। বস্তুত স্বদেশী শিল্পের বিকাশের জন্য চাই ত্যাগ স্বীকার এবং প্রকৃত দেশপ্রেম। আমর যদি বাইরের জিনিস ব্যবহার একেবারে বাদ দিতে পারি, তাহলে দেশী শিল্পজাত দ্রব্যের মান ক্রমেই প্রতিযোগিতায় স্বাভাবিক নিয়মে উন্নত হবে এবং বিদেশী দ্রব্যের প্রতি মোহ পরিত্যাগ করাও সহজ হবে।
১০. উন্নত জীবনযাত্রা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি
সমাজের সকল শ্রেণীর মধ্যে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করার মতো একটা সদিচ্ছা তথা অভিলাষ সৃষ্টি করতে হবে এবং ঐ সদিচ্ছা পূরণের জন্য দেশকে যে শিল্পায়িত করতে হবে এটার গুরুত্ব অনুধাবন করার ব্যবস্থাও করতে হবে।
১১. কাঁচামাল সহজলভ্যকরণ
শিল্পায়নের স্বার্থে কাঁচামালের সহজলভ্যতা সৃষ্টিতে প্রয়োজনবোধে সরকারকে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে রয়েছে অজস্র সমস্যা। এদিকে নতুন বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনীতি মূল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা গ্রহণ করায় বাংলাদেশকেও শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের শিল্পায়নের জন্য উপরোক্ত সম্ভাব্য করণীয়সমূহ যথাযথভাবে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং আঞ্চলিক অর্থনীতির সংহতিকরণের মাধ্যমে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে প্রাণসঞ্চার করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
আরও দেখুনঃ