বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তার দুটো অংশ একটি পূর্ব পাকিস্তান, অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়।
Table of Contents
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম
পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কখনই পূর্ব পাকিস্তানকে সমমর্যাদাপূর্ণ একটি প্রদেশ মনে করেননি। এছাড়া কতিপয় মুসলিম লীগ নেতা সুকৌশলে সমৃদ্ধশালী পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ তথা করদ রাজ্যে পরিণত করার প্রয়াসে লিপ্ত হন। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে। বাঙালিরাও তার যথাযথ জবাব দিতে দেরি করেনি। ফলে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিক্রিয়ায় ধাপে ধাপে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হতে থাকে।
ভাষা সমস্যা ও ভাষা সংগ্রাম :
পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথমেই দেখা দেয় ভাষা সমস্যা। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই পশ্চিমা স্বার্থান্বেষী মহল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পায়তারা করতে থাকে। বাংলার জাতীয় ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনার বীজ রোপিত হয় যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই নিখিল পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘তমুদ্দুন মজলিস’ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে আন্দোলন শুরু হয়, তা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি সহ বিভিন্ন সংগঠনের অধীনে ধর্মঘট, হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো নাম না জানা শহীদের জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। এর প্রভাব বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের পরতে পরতে দেখতে পাওয়া যায় এবং এরই সার্থক পরিণতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ উদ্ভবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ‘৫২-র ভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এক ধাপ এগিয়ে দেয়। জনগণের মধ্যে এ আন্দোলন এক নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এ চেতনাই ক্রমে ক্রমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বহু গুণে বাড়িয়ে দেয় এ আন্দোলন । তাই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের গণচেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
১৯৮০ সালের ‘জিজ্ঞাসা’র একুশে সংকলনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক নতুন দিকদর্শন, এই আন্দোলন বাঙালিদের মনে যে বৈপ্লবিক চেতনা ও ঐক্যের উল্লেখ ঘটায় তা আমাদের পরবর্তী সকল আন্দোলনের প্রাণশক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগায়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করে তা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষভাবে প্রেরণা যুগিয়েছে এ ভাষা আন্দোলন। অতএব বলা যায়, ভাষা আন্দোলনই ধাপে ধাপে পরবর্তীতে সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভবকে ত্বরান্বিত করেছে।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন :
মুসলিম লীগের রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং পূর্ববাংলার প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে মোকাবিলা করার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, এ কে ফজলুল হক এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। পূর্ব বাংলার গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা ভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করে ।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দান, কৃষকদের অগ্রগতি সাধন, দেশে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠা, মুর্ভিক্ষের অভিশাপ দূর করা এবং পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থ ব্যতীত পূর্ব বাংলাকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দান ছিল ২১ দফার মূল বিষয়বস্তু। এ নির্বাচনে স্পিকারসহ ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৩৭টি আসন ছিল মুসলিম আসন। এর মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে মুসলিম লীগ পেয়েছিল মাত্র ১০টি আসন। যুক্তফ্রন্ট মোট ভোট পেয়েছিল ৯৭ ভাগেরও বেশি। এ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণ বাংলা ভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে সুস্পষ্ট রায় দেয়।
যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের তাৎপর্য :
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে অনেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম বলে মনে করেন। সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত ‘History of Bengal’ গ্রন্থে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়, ‘However the election result had on decissive important on the nature and direction of subsequent political changes including the emergence of Bangladesh.’ 3528 সালের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ববাংলার জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন এবং শুধু ধর্মের নামে তাদের প্রতারিত করা যায় না। এ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, পূর্ব বাংলার জনগণ স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ ।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন :
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জোটবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে। প্রভুত্বব্যঞ্জক সরকারের অবসানের জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার সূত্রপাত ঘটালে আইয়ুব খান ভীত হয়ে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচিতে তাকে গ্রেপ্তার করেন।
সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভের মুখে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন এবং দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদকে গ্রেপ্তার করে। এতে ছাত্র আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
আইয়ুববিরোধী ছাত্র বিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য অসংখ্য ছাত্র, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুক্তি দেয়ার পরপরই ছাত্র সমাজ হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন শুরু করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন ১৭ সেপ্টেম্বর এক মর্মান্তিক ঘটনার পরিণতি লাভ করে।
ছাত্র বিক্ষোভকালে পুলিশের গুলিতে কয়েকটি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে, যার প্রতিবাদে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আহ্বানে ৭ অক্টোবর সমগ্র পাকিস্তানে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন পরবর্তীকালের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন : ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালি জাতিকে এমন একটি ধারণা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে যে, পাকিস্তানিরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য শুধু আমাদের ব্যবহার করবে।
তাই পশ্চিমা শাসকচক্রের দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ আর হীন বঞ্চনার তিক্ত অভিজ্ঞতা বিচার করে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক মহাসম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষার দাবিসম্বলিত ছয় দফাভিত্তিক এক কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঐতিহাসিক এই ছয় দফা কর্মসূচি ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি জাতীয় মুক্তির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে।
ছয় দফার গুরুত্ব :
বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে ছয় দফা আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায় ছয় দফা দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় মুক্তির সনদ’। ড. মুহাম্মদ হান্নান “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ছয় দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্মারক, যেখানে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম নতুনভাবে গতি লাভ করেছিল।’ রওনক জাহান বলেন, “ছয় দফা আন্দোলন ক্ষণস্থায়ী হলেও তা বাঙালির রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটায় এবং তা পরবর্তীকালের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’ ভাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে ছয় দফার ভূমিকা ছিল অনন্য।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা :
ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলন যখন জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে, তখনই শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নেমে আসে নিপীড়ন। শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারলেন, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় বাঙালিদের তাদের ন্যায্য রাজনৈতিক অধিকার দেবে না, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। তাই শেখ মুজিব স্বাধীনতার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে যে সকল অন্তরায় ছিল তা দূর করার জন্য ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। তাই ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বাংলাদেশের আলী রেজা এবং ভারতীয় Inter Intelligence Department-এর ব্রিগেডিয়ার মেনন অংশ নেন। কিন্তু চূড়ান্ত সময় আসার পূর্বেই এ পরিকল্পনার খবর আইয়ুবের প্রশাসনে জানাজানি হয়ে যায়। ফলে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা’ রুজু করা হয় । বাঙালি জনতা এই মামলার বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলে।
এ মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ঢাকা সেনানিবাসে পুলিশের গুলিতে শহীদ হলে আন্দোলন আরো তীব্র রূপ ধারণ করে। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এগার দফার ভিত্তিতে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। অবশেষে ছাত্র আন্দোলন ও গণআন্দোলনের মুখে সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়।
‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান :
আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি উপেক্ষিত হলে ১৯৬৯ সালে সারা দেশে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। সরকার এ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় । এ উদ্দেশ্যে সরকার সমগ্র দেশে জরুরি অবস্থা ও ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র- জনতা জরুরি অবস্থা অমান্য করে রাস্তায় নেমে পড়লে শুরু হয় প্রচণ্ড আন্দোলন ও বিক্ষোভ।
এ সময় সরকারি নির্দেশে পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালালে নিহত হয় আসাদসহ বহু সাধারণ মানুষ। ফলে আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল এ মৌলিক অধিকার আদায়ের শপথ নিয়ে আট দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। পরবর্তী আন্দোলনমুখী ঘটনায় মতিউর, জোহা, জহুরুল হকের শাহাদাত বরণ পাক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মহাবিস্ফোরণ হিসেবে দেখা দেয়। ফলে পতন ঘটে স্বৈরাচার আইয়ুবের। প্রকৃতপক্ষে ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানই পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পথ সুদৃঢ় করার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিকাশের পথ প্রশস্ত করে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন :
আইয়ুবের পতনের পর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া। তিনি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দেয়া ঘোষণা করেন। ‘৭০-এর ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়। অবশ্য বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে কয়েকটি আসনে ‘৭১-এর ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে।
পূর্ববাংলার ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮২টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ । ফলে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । এ নির্বাচনে জনগণ ছয় দফার প্রতি সমর্থন দান করে এবং বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো স্বশাসন ও আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ লাভ করে । ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের চূড়ান্ত অধ্যায়ে এ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি :
নির্বাচনোত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ডাকার জন্য প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবর্গ পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথা অনুযায়ী ৩ মার্চ অধিবেশনে ডাকেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে তা ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। এমতাবস্থায় সর্বস্তরের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। অন্যদিকে শেখ মুজিব ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় ৪ দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো হলো :
১. সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে।
২. অবিলম্বে সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
৩. সামরিক বাহিনীর হাতে প্রাণহানির তদন্ত করতে হবে।
৪. অধিবেশনের পূর্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা নির্বাচনের ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে ইয়াহিয়া খান গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। এদিকে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে ১৬ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ প্রহসনমূলক আলোচনার ব্যবস্থা করেন। তবে গোটা আলোচনা পর্বটাই ছিল ইয়াহিয়া খানের ছলনা। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল আলোচনার অন্তরালে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা। সেজন্য সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ইয়াহিয়ার উক্ত প্রহসনের আলোচনাকে ‘বিশ শতকের সর্বাধিক জঘন্যতম প্রবঞ্চনা’ বলে আখ্যায়িত করেন।
২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিকল্পিতভাবে তার সশস্ত্র বাহিনীকে এ দেশের ঘুমন্ত নর-নারী ও শিশুদের পৈশাচিক কায়দায় হত্যাকাণ্ড চালাবার এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়ে মধ্যরাতে ঢাকা তাগ করেন। গ্রেপ্তার হবার পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ২৭ মার্চ শেখ মুজিবের পক্ষে মেজর জিয়া উক্ত স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। ফলে সম্মিলিতভাবে বাঙালিদের পাক বাহিনীর গণহত্যা প্রতিরোধের সূচনা ঘটে।
বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন বাহিনী গঠনের মাধ্যমে সংগঠিত রূপ লাভ করে। দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ বিকশিত হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত অধ্যায় তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
আরও দেখুনঃ