বিজয় দিবস রচনার একটি নমুনা প্রস্তত করে দেব আজ। এই রচনাটি আমাদের আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।
Table of Contents
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস রচনা
ভূমিকা :
১৬ ডিসেম্বর দিনটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিন বিকাল ৪টা ১৯ মিনিটের সময়ে তৎকালীন ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী তার ১৩ হাজার পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণ ছিল মূলত যৌথ বাহিনীর নিকট ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী একত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, মুক্তিবাহিনী তথা সমস্ত বাঙালি যোদ্ধার অধিনায়ক ছিলেন জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় জেনারেল ওসমানী ঢাকায় আসতে পারেননি। তার বদলে এসেছিলেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। তৎকালীন ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বিকাল ৪টায় পাকিস্তানের আত্মসমর্পণপর্ব অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের নিয়মে এই দিনে পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয় হয়ে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় ঘটে, তাই ১৬ ডিসেম্বর ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি :
বাংলাদেশের বিজয় দিবসের পটভূমিতে রয়েছে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের এক সংগ্রামী অধ্যায়, রয়েছে পাকিস্তানের জঙ্গিশাহীর দুই দশকের শাসন-শোষণ- নির্যাতনের বিরুদ্ধে অগ্নিশপথময় আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। সে ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন। পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এ আন্দোলনের মাধ্যমে উন্মেষ ঘটেছিল বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার। এ চেতনার ধারাই ক্রমবিকশিত হয়েছে ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। এসব আন্দোলনের উত্তঙ্গ প্রচণ্ডতার মুখে ঘটে যায় ‘৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান।
স্বাধিকার চেতনা ক্রমেই রূপ নেয় জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে। পাকিস্তানি সামরিক জঙ্গিশাহির শক্তিমত্ত দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অদম্য প্রতিরোধে ফুঁসে উঠেছিল ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি। স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল পাকিস্তানি চক্রের ধর্মান্ধতার বেড়াজাল, অগ্নিশপথ নিয়েছিল স্বাধিকার অর্জনের, ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল দুই দশকের দুঃশাসনের কেল্লাকে। সামরিক জান্তা বাধ্য হয়ে নির্বাচন দিলে বাঙালি জাতি পূর্ব বাংলায় স্বাধিকারের পক্ষে রায় দেয় এবং আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে স্বাধিকার আন্দোলন চরম শক্তি অর্জন করে।
কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতা চেতনাকে নস্যাৎ করার হীন প্রয়াসে ‘৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক অগ্রদ ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া বাহিনী হিংস্র শ্বাপদের মতো তীক্ষ্ণ নখনও বিস্তার করে অতর্কিতে হানা দিয়েছিল সুপ্তিমগ্ন জনপদে। তারপর দীর্ঘ নয় মাস ধরে প্রতিটি দিন ও প্রতিটি রাতকে কলঙ্কিত করেছে পাকিস্তানি দখলদার জল্লাদ বাহিনী নিরস্ত্র নারী-পুরুষের, শিশু-কিশোর- তরুণের, যুবা-বৃদ্ধের রক্তধারায় রঞ্জিত করেছে বাংলার শ্যামল মাটি আর নদীর স্বচ্ছ ধারাকে। শত- সহস্র মা-বোনের ওপর চালিয়েছে পাশবিক নির্যাতন। অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজে তছনছ করেছে জনপদ। জল্লাদ বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব থেকে প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়েছে কোটি কোটি নিঃসম্বল মানুষ। কিন্তু একাত্তরের সেই দিনগুলোতে কেবল বিপর্যয়কেই নিয়তি বলে মেনে নেয়নি নির্যাতিত বাংলাদেশ ।
জল্লাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল হাজার হাজার দেশপ্রেমিক । সমগ্র জাতি ঝাপিয়ে পড়েছিল প্রতিরোধ সংগ্রামে। ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক, ডাক্তার-প্রকৌশলী, কৃষক- শ্রমিক, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাইকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনী। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিল বাঙালি সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল অস্ত্র হাতে উদ্ধৃত মুক্তিসেনা। দেশপ্রেমের পবিত্র চেতনায় উজ্জীবিত কৃষক-শ্রমিকের হীরক প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের বিজয় দিবস সুসম্ভাবনায় উজ্জ্বল ও দুঃখস্মৃতিভারে আনত।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের তাৎপর্য :
মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কেবল একটি জাতীয় পতাকা এবং স্বাধীন ভূখণ্ডের মধ্যে সীমিত নয়, এর তাৎপর্য বিরাট ও সুদূরপ্রসারী। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে অবহেলিত পশ্চাদপদ শোষিত জাতি রচনা করেছিল অসামান্য গৌরবগাঁথা। বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভিয়েতনামের পর আরেক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশ। সেই সাথে জাতীয় জীবনে ঘটে গিয়েছিল নব জাগরণ, সৃষ্টি হয়েছিল অযুত সম্ভাবনার মুহূর্ত। স্বাধীনতার চেতনারূপ পরিগ্রহ করেছিল জাতীয় চার মূলনীতিতে — গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন:
২৬ মার্চ, ১৯৭১ বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে যেমন ‘স্বাধীনতা দিবস’-এর মর্যাদা পেয়েছে তেমনি ১৬ ডিসেম্বর ‘বিজয় দিবস’-এর গৌরব লাভ করেছে। অর্থাৎ হানাদার পাকবাহিনীকে বাংলার মুক্তি-পাগল দুর্বার গণবাহিনী নয় মাসের যুদ্ধে পরাজিত করে বিজয় লাভ করেছে, কাজেই এই মহান দিবসটি বাঙালির ‘বিজয় দিবস’-এর সম্মানে সমাদৃত। এই মহান দিবসের স্মরণে বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মহাসমারোহে উৎসবে আনন্দে মগ্ন হয়। নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয় দিবস পালন করা হয়। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যগণ পতাকা উত্তোলন করেন এবং কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে বিজয় দিবস পালন করেন।
স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে বিজয় দিবস পালন করে, বিশেষত ঢাকা স্টেডিয়ামে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাদের স্কুল-কলেজের নিজস্ব ইউনিফর্ম পরিধান করে নানা কুচকাওয়াজ ও কসরতের মাধ্যমে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সালাম জানায়। প্রধানমন্ত্রী তাদের সালাম গ্রহণ করেন। এ উপলক্ষে কাঙ্গালি ভোজের আয়োজন করা হয়। নানা সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংসদ বিজয় দিবসের স্মরণে আনুষ্ঠানাদি পালন করে। রেডিও- টিভি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। দেশের পত্র-পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। বিজয় দিবস উপলক্ষে সরকারও ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে।
সরকারি ও বেসরকারি ভবন শীর্ষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক ও আইল্যান্ডসমূহে জাতীয় পতাকায় সুশোভিত হয় । গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে রাতে আলোকসজ্জা করা হয়। দেশব্যাপী জেলা ও থানা সদরে পুলিশ, আনসার, ভিডিপি, স্কাউট, গার্লস গাইড ও বিএনসিসি শরীরচর্চা প্রদর্শন করে। রাজধানী ছাড়াও জেলা ও থানা সদরে ক্রীড়ানুষ্ঠান ও নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে জাতির সমৃদ্ধি কামনায় মুনাজাত ও প্রার্থনা করা হয়। দেশের বাইরে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে বিজয় দিবস উদযাপিত হয়। এছাড়াও দেশের শ্রমিক-যুব দল, নারী ও পেশাজীবী সংস্থা-সংগঠন জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, রক্তদান ও প্রদর্শনীর কর্মসূচি গ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, পরবর্তী বাস্তবতা ও আমাদের প্রত্যাশা :
শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলেও আমাদের স্বপ্ন সম্ভাবনা বাস্তবের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে। ১৯৭৫ সালে ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে জাতির জনকের মর্মান্তিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ হয় পরিত্যক্ত। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র হয় নির্বাসিত। প্রায় দেড় দশক জুড়ে নতুন করে সংগ্রাম করতে হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য। আদর্শিকভাবে স্বাধীনতার মূল চেতনার অনেক কিছুই এখন অধরা। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে এখনো পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন এখনো স্বপ্নমাত্র। জাতীয় জীবনে ঐক্যের বদলে সংঘাত, সুস্থিতির বদলে অস্থিরতা, শান্তির বদলে নৈরাজ্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একুশ শতকে পদার্পণের মুহূর্তে বাংলাদেশের কিছু অগ্রগতিও আছে। দেশের অর্ধেকেরও বেশি লোক দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠতে পেরেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। কৃষিক্ষেত্রে প্রাণের সাড়া জেগেছে। গ্রামীণ নারীসমাজ জাগতে শুরু করেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। বিদেশী বিনিয়োগও বাড়ছে।
উপসংহার :
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মুক্ত স্বাধীন স্বদেশ ভূমি—আমাদের অতি গর্বের এই বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ ঘটে এ দেশের মানুষের পরিপূর্ণ বিজয়। তাই এই দিবসটি “বিজয় দিবস’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে আসন করে নিয়েছে। তবে আমাদের এই সোনার বাংলাকে বিশ্বের দরবারে আরো সম্মানজনক স্থান দেয়ার লক্ষ্যে আমাদের সততার সাথে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই আমাদের বিজয় দিবস হবে সার্থক ।
আরও দেখুন: