বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা রচনা

বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।

Table of Contents

বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা

 

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিনিয়োগের সাথে উন্নয়নের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। বিনিয়োগের মাধ্যমে উদ্ভাবন হয় নতুন নতুন প্রযুক্তি, সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান এবং বিভিন্ন জাতি, ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সেবা ও পণ্যাদি আদান-প্রদান সম্ভব হয় ।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার ‘পরবর্তী উদীয়মান তারকা’। তবুও বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং বিদেশী বিনিয়োগের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রয়েছে শত-সহস্র প্রতিবন্ধকতা।

 

অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগ

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকে পরিমাপক হিসেবে ধরে নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে সংজ্ঞাটি প্রচলিত তা হলো economic development is the process whereby the real per capita income of a country increases over a long period of time. মূলধন গঠন ছাড়াও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন খাতে আর্থিক সুবিধা সৃষ্টি করেছে। এগুলো হলো

১. রপ্তানি বৃদ্ধি;

২. সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি

৩. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি;

৪. উৎপাদনের দক্ষতা বৃদ্ধি;

৫ উৎপাদন কারখানা এবং ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন;

৬. প্রযুক্তি হস্তান্তর ও কারিগরি জ্ঞান প্রসারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ।

বিনিয়োগের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হচ্ছে মূলধন। প্রধানত তিনটি মূল উৎস থেকে মূলধন সংস্থাপন

হয়। যেমন ১. অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়, ২. বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং ৩. বৈদেশিক সাহায্য।

 

বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা

 

বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের চিত্র

বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এশিয়ার অধিকাংশ দেশের চেয়ে বাংলাদেশ উদারভাবে দেশকে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশের হাতে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং এর প্রভাব সম্পর্কে অনেকে বাংলাদেশকে এশিয়ার Emerging Tiger’ বা ‘উদীয়মান ব্যাঘ্র’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ তেমন আশাব্যঞ্জক নয় ।

 

বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের সমস্যা

বিনিয়োগ সংক্রান্ত সরকারি টাস্কফোর্সের খসড়া প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১৪টি সমস্য চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে

১. বিদেশে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি;

২. অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব;

৩. বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি জায়গাতেই সেবা প্রদানের ব্যবস্থা অর্থাৎ ওয়ান স্টপ সার্ভিসের অভাব;

৪. ঘোষিত সরকারি নীতি বাস্তবায়নের ও সরকারি বিভাগগুলোর সমন্বয়ের অভাব;

৫. শ্রমিক বিশৃঙ্খলা ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর অঙ্গিনা

৬. হরতালসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড,

৭. প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ইনসেনটিভ বা উৎসাহদানের অভাব ও অবকাঠামোগতভাবে পিছিয়ে থাকা;

৮. কাস্টমস ছাড় করানোর জটিলতা।

৯. দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মশক্তির অভাব;

১০. নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সরকারি বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য ও উপাত্তের অভাব;

১১. দুর্নীতি

১২. আমদানি ও বাণিজ্যনীতির অতি দ্রুত উদারীকরণ করার ফলে স্থানীয় পণ্য উৎপাদন শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব;

১৩. দক্ষ ও কার্যকর বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ের অভাব:

১৪. ঋণের ওপর সুদের উচ্চহার ।

 

বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা

 

নিচে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের উপরোক্ত সমস্যাসমূহ এবং আরো কতিপয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. বিদেশে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি

সম্প্রতি বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্সের মহাসচিব বলেছেন, বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায় দুর্বল অবকাঠামো ও বিদেশে বাংলাদেশের মলিন ভাবমূর্তি।

বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশের একটা নেতিবাচক ইমেজ রয়েছে যে, বাংলাদেশ হলো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, বন্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি সমস্যায় আক্রান্ত দেশ। বাংলাদেশ ভাবলেই বিদেশীদের অনেকেই দেখে পানিতে ডোবা একটি দেশের ছবি। সেই দেশে শুধু খাদ্যাভাব আর দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের আর একটা ইমেজ হলো, সাহায্য চাওয়া। বাংলাদেশ মানে যেন ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট বল, সেখানে শুধু দান করা, শুধু দেয়া।

বিদেশে এমন একটা ধারণাও গড়ে উঠছে যে, বাংলাদেশকে কিছু দিলে সেটা আর ফেরত পাওয়া যায় না, বাংলাদেশকে শুধু দিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশ যেন শুধু খেলাপি ঋণের দেশ এবং সরকারি কর্পোরেশনসমূহের প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা লোকসান দেয়ার দেশ। বাংলাদেশ মানে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে শুধু গিঁটের পর গিট পড়া, সেসবের কোনো সমাধান না হওয়া। বস্তুত বাইরে বাংলাদেশের এ ধরনের নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে লগ্নিকারক দেশ ও সংস্থাসমূহ বাংলাদেশে বড় যে কোনো বিনিয়োগে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে।

 

২. অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব

বিদেশী বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। বাংলাদেশে তার পর্যাপ্ত অভাব ও ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, রেল ও সড়ক ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত নয়। সবচেয়ে করুণ বিদ্যুৎ সরবহরাহজনিত অবস্থা । কল-কারখানায় গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সময়মতো এবং চাহিদামতো পাওয়ার কোনো গ্যারান্টি নেই, নেই ঠিকমতো টেলিফোন ব্যবহারের নিশ্চয়তা। বাংলাদেশের কোনো সরকারই এ যাবৎ অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা উন্নয়নের সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি ও ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এ অবস্থায় দেশী বিনিয়োগকারীরাই বিনিয়োগে ভরসা পায় না ।

 

৩. হরতালসহ নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

হরতালসহ নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায়। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের উন্নয়নের জন্য হরতাল একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা, দেশটিতে একদিনের হরতালে ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ সম্পর্কে রাজনৈতিক দলসমূহের উদাসীনতার কারণে বার বার ডাকা হরতালে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

 

বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা

 

৪. দুর্নীতি

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ দুর্নীতির ওপর ভাসছে। দুর্নীতি হচ্ছে এমন একটা দুষ্ট ক্ষত যা জনগণের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের প্রধান প্রতিবন্ধক। বর্তমানে বৈদেশিক বিনিয়োগ, দারিদ্র্য বিমোচন, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গৃহীত সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকার বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়শীল দেশেও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলছে এ দুর্নীতি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ট্রাস্টি প্রফেসর মোজাফফর আহমেদের মতে, বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণে শুধু ২০০০ সালের প্রথম ছয় মাসে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এমতাবস্থায় বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে দ্বিধাগ্রস্ত থাকাটাই স্বাভাবিক।

 

৫. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আমাদের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। শিল্প ও বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় অহেতুক বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিনিয়োগ উৎসাহিত হতে পারছে না। শিল্প- বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় বিরাজমান এসব অহেতুক বিধি-নিষেধ, নিয়ন্ত্রণ এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য উচ্ছেদ না করলে যতই বাণিজ্য টিম পাঠানো হোক বা নতুন আইন-বিধি তৈরি করা হোক কিংবা বিনিয়োগের সুযোগ- সুবিধা বাড়ানো হোক, কোনোদিনই বিদেশী বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উৎসাহিত হবে না।

 

৬. বিনিয়োগ বোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা

বিনিয়োগ বোর্ড একটি স্পেশালাইজড প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এখানে থাকা উচিত পরিসংখ্যান, অর্থনীতি, এমবিএ ডিগ্রিধারী দক্ষ লোকজন, যারা এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো বোঝেন। বিনিয়োগ বোর্ডে সে ধরনের লোক নেই। এটা বিনিয়োগ বোর্ডের ব্যর্থতার একটি কারণ । তাছাড়া বিনিয়োগ বোর্ডের আরেকটি সমস্যা হলো ঘন ঘন নির্বাহী পদে রদবদল। অবাক হবার বিষয়, বিনিয়োগ বোর্ডের ১৩ বছরের জীবনে ১৭ জন নির্বাহী চেয়ারম্যান পরিবর্তিত হয়েছেন।

 

৭. দক্ষ ও কার্যকর বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ের অভাব

বিনিয়োগ ও সকল শিল্পায়নের অন্যতম মৌলিক শর্ত হচ্ছে যথাযথ ব্যাংকিং সহায়তা। বাংলাদেশে তা সম্পূর্ণরূপেই অনুপস্থিত। কোনো ব্যাংকেরই যথাযথ দায়িত্ব ও অধিকারের ভিত্তির ওপর প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই। বাংকগুলো খেলাপি। ঋণগ্রহীতা ও দলীয় দৌরাত্ম্যের কাছেই অনেক সময় জিম্মি থাকে। তাই ব্যাংক ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন না দিলে বাংলাদেশে কখনো বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষিত হবে না।

 

৮. প্রতিকূল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

বাংলাদেশে বাইরের পুঁজি না আসার এবং অভ্যন্তরীণ পুঁজির স্বাভাবিক নিয়মে বিকশিত না হওয়ার আর একটি গুরুতর কারণ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, অর্থনীতির সুষ্ঠু পরিচালনা বহুলাংশে নির্ভর করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। কিন্তু বাংলাদেশে দোকানে, মহল্লায়, কল-কারখানায়, দালান-কোঠা নির্মাণে চাঁদা দাবি করা একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। থানা পুলিশ বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ইঙ্গিতে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসকে আনুকূল্য দেয়।

 

৯. কর প্রশাসনের অব্যবস্থা

বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট না হওয়ার আরো একটি কারণ হলো বিরাজমান কর কাঠামো ও কর প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের নির্যাতন ও দুর্নীতি। বহু উন্নয়নশীল দেশে বিদেশী পুঁজি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে কর কাঠামো ঢেলে সাজানো হয়েছে, ক্যাপিট্যাল গেইন ট্যাক্স হ্রাস করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।

 

১০. নির্ভেজাল জমি সংকট

বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা নির্ভেজাল জমি । যে কোনো বড় শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হলে ২০ থেকে ২৫ একর জমির প্রয়োজন হয়। কিন্তু নির্ভেজাল জমি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত দাইও কোম্পানি ভুয়াপুরে বেসরকারিভাবে জমি নিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার মাটি ভরাট কাজ করে তাদের মিল উদ্বোধন করতে যাওয়ার দিন বন বিভাগ এ জমিকে তাদের জমি বলে দাবি করে।

অথচ ছয় মাস ধরে কাজ করার সময় বন বিভাগ কিছু বলেনি। তাছাড়া যে মালিকের কাছ থেকে দাইও কোম্পানি জমি ক্রয় করেছে, উল্লিখিত পরিমাণ জমিসহ আরো অনেক পরিমাণ জমি দীর্ঘদিন এবং রেকর্ডসহ সবকিছু সে মালিকের নামে রয়েছে।

এ অবস্থায় দাইও কোম্পানি ভীষণভাবে বিরক্ত হয়। পরে সরকারিভাবে তাদের সাভার ইপিজেডে জমি দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে যে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, তা অন্যান্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জানাজানি হওয়া। ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

 

বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা

 

১১. ব্যাংক ঋণ সমস্যা

দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য বর্তমানে সবচাইতে বড় সমস্যা ব্যাংক ঋণ। বড় কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে গেলে বিভিন্ন ব্যাংক কনসোর্টিয়াম গঠন করে অর্থের যোগান দেয়ার বিধান চালু আছে। বেশ কিছু দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তা এ ধরনের শিল্প স্থাপনের জন্য আবেদন করে ঘুরপাক খাচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানা অজুহাতে শুধু ঘুরপাকের নীতিই অবলম্বন করছে। আর যখন শিল্প স্থাপনের জন্য কেউ ব্যাংক ঋণ পায় তখন বৈদেশিক মুদ্রার উঠানামা, যন্ত্রপাতির মূল্য বৃদ্ধিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই সংকট শুরু হয়ে যায়।

 

বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা

2020 Bangladesh A Long Run Perspective Study শীর্ষক সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাংকের এক দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সাল নাগাদ কমপক্ষে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি বিনিময় হার অনুযায়ী স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

উক্ত রিপোর্টে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ পর্যায়ে এফডিআই আহরণের জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই সু অর্থনৈতিক রেগুলেটরি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। যদি তা করা হয়, তবে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। বিশ্বব্যাংকের এ রিপোর্টে বিদ্যমান সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ২০২০ সালে কেমন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব তার চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।

এতে দেখা যায়, এ সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। গড় বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। সর্বজনীন বয়স্ক শিক্ষা ও মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হবে। কার্যকরভাবে পরিবেশ সংরক্ষিত হবে। সাফল্যের সাথে নগরায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে। ২৫ বছরে ৫ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ এবং দ্রুততর প্রবৃদ্ধির জন্য সম্পদের যোগান বৃদ্ধি পাবে।

বিশ্ববাজারে চাহিদার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে অর্থনীতির বহুমুখীকরণ ঘটবে। এতে বলা হয়, এ উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অর্থায়নের সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠতে পারে বৈদেশিক বিনিয়োগ ।

বিশ্বব্যাংক রিপোর্টটিতে ২০২০ সালের উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়ার সম্ভাবনাকে তুলে ধরে বলেছে, তা অর্জনের জন্য বর্তমানে প্রচলিত অনেক রীতিনীতির পরিবর্তন আনতে হবে। প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল শাসনব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করতে না পারলে এ সমৃদ্ধির স্বপ্ন শুধু কল্পনাই রয়ে যাবে।

রিপোর্টটিতে প্রকাশিত প্রাকৃতিক গ্যাস খাতে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে প্রত্যাশিত বৈদেশিক বিনিয়োগ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি সম্পর্কে আশাবাদী হতে সমর্থন যোগায়। এছাড়া বিদ্যমান যেসব সম্ভাবনা রয়েছে তা নিম্নরূপ:

 

১. তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে বিনিয়োগের সম্ভাবনা

বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান আনিসুল হক চৌধুরী বলেছেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে তেল ও গ্যাস খাতে বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত। তাদের মতে, বাংলাদেশে এ খাত বিপুল সম্ভাবনাময় । এদিকে গত তিন বছরে বাংলাদেশের মার্কিন কোম্পানিগুলোর সরাসরি বিনিয়োগ প্রায় শূন্য থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে এবং অতিরিক্ত হিসেবে আরো কয়েকশো মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অপেক্ষায় আছে ।

এদিকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০১ পেট্রোবাংলায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ (ইউএসিএস) ও পেট্রোবাংলার যৌথ সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের পরিমাণ প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিএসএফ), যা গ্যাস সম্পদ উত্তোলনে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আগমন সম্পর্কে আশাবাদী হতে সমর্থন যোগায় ।

 

২. ইপিজেডে বিনিয়োগের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের অন্যতম সম্ভাবনা হলো ইপিজেড এলাকায় বিনিয়োগ। বাংলাদেশে নতুন কোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইপিজেডের অভ্যন্তরস্থ প্রতিষ্ঠানের জন্য ১০ বছর পর্যন্ত Tax Holiday বা শুল্ক রেয়াত অনুমোদিত । ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের ইপিজেড এলাকায় শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে।

কোরিয়ার একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে কেইপিজেড নির্মাণ করেছে। তাছাড়া উত্তর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বেসরকারি ইপিজেড নির্মাণাধীন রয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, বাংলাদেশ এখন শিল্পযুগে পর্দাপণ করেছে এবং দেশে দ্রুত শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ।

 

৩. বস্ত্রশিল্পে বিনিয়োগের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ অর্জনকারী শিল্পের মধ্যে বস্ত্রশিল্প বা তৈরি পোশাক শিল্প অন্যতম। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের বিপুল চাহিদা থাকায় দেশী-বিদেশী প্রচুর বিনিয়োগকারী বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পে পুঁজি বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

প্রথমেই দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। এবং অধিক মূল্যের বাজারে প্রবেশ করতে হবে। JETRO-এর সহযোগিতায় সম্প্রতি বাংলাদেশ জাপানের বাজারে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তা এবং শ্রমিক শ্রেণীর কাজের গুণগত মান ঠিক থাকলে ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশ কোটামুক্ত প্রতিযোগিতায় সহজেই টিকে থাকতে পারবে।

বাংলাদেশের ক্রমসম্প্রসারমাণ গার্মেন্টস শিল্পে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ অব্যাহত গতিতে বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ অচিরেই Garment Valley-তে পরিণত হবে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

৪. কৃষিভিত্তিক শিল্পে বিনিয়োগের সম্ভাবনা

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ সফরকালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফিদেল রামোস বলেছিলেন, ‘কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশে। উচ্চফলনশীল ধানবীজের ব্যবহার এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এছাড়া সাম্প্রতিককালে তেলবীজ, আখ, তুলা, আলু ও গম উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে নাটকীয়ভাবে। তাই বিশ্বায়নের নতুন শতকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

 

৫. সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম । গত ২৩ মার্চ ২০০০ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মহাসচিব ফ্রান্সিসকো ফ্রাগিউলি বাংলাদেশ সফরকালে বলেন, বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে বিপুল সম্ভাবনাময় এক অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পর্যটন শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।

পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য উন্নত প্রযুক্তি বা উচ্চ মূলধনের প্রয়োজন নেই। বরং দেশে বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবসৃষ্ট সুবিধাদি দ্বারাই এ শিল্পকে উন্নতর করে তোলা যায়, যা দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে ।

 

৬. মার্কিন বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা

গত সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশে আমেরিকার সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রায় ৭৫ কোটি ডলার। এগুলো মূলত তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ খাতে। আমেরিকান চেম্বারের এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, আগামী এক বছরে আরো ৬০ কোটি ডলার বৈদেশিক সাহায্য আসবে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে দুদেশের মধ্যকার অতীত দাতা গ্রহীতা সম্পর্কের পরিবর্তে বর্তমানে অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক জোরদার করবে বলে আশা করা যায় ।

 

উপসংহার

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে অসংখ্য সমস্যা, তেমনি রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। বর্তমান সরকারের শিল্পনীতিতে কৌশলগত কারণে শুধু ৫টি শিল্পখাত ছাড়া সকল খাত বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।

বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির বিশ্বায়নের ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণ করে রপ্তানিনির্ভর নতুন নতুন শিল্প প্রসারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি নতুন নতুন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ এবং বাংলাদেশের এসব জোটসমূহের সদস্যপদ প্রাপ্তির ফলে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment