বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা রচনা

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে এ দেশের দামাল ছেলেরা এই তারিখটিকে মহীয়ান করে দিয়ে গেছেন।

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

২১ ফেব্রুয়ারির সেই রক্তধারা ধাপে ধাপে এগিয়ে দিয়েছে এ দেশের গণমানুষের চেতনাকে, বাঙালির রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক চাহিদাকে। পরিণতিতে এসেছে ‘৫৪-এর নির্বাচন, ‘৬২-এর সামরিক শাসকের শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন, ‘৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয় এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এভাবেই এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। বস্তুত ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ।

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

 

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট :

ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের অঙ্কুরোদগম ঘটেছিল বায়ান্নর সেই ফেব্রুয়ারি মাসেই। আর যে বীজ থেকে এই অঙ্কুর উদগত হয়েছিল, ভাষা আন্দোলনের সেই বীজ রোপণের কাজটি হয়েছিল আরো আগে— ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই, যখন নিখিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয় ।

এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর গঠিত ‘তমুদ্দুন মজলিস’-এর মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঢাকায় একটি সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই উত্থাপিত হয় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতিদানের প্রথম প্রকাশ্য দাবি।

এমতাবস্থায় নভেম্বর ১৯৪৭-এ করাচিতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে পূর্ব বাংলায় এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ঢাকায় সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং কতিপয় দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নীতি গৃহীত হয়।

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

 

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দাবি ছিল নিম্নরূপ :

ক. বাংলা ভাষা হবে পূর্ব বাংলার একমাত্র শিক্ষার বাহন এবং অফিস-আদালতের প্রধান মাধ্যম ।

খ. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি বাংলা ও উর্দু। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্যগণ, বিশেষত কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি জানান।

কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই দাবির বিরোধিতা করেন। ফলে ঢাকায় ক্ষত্র ও বুদ্ধিজীবী মহলে চরম অসন্তোষ দেখা দেয় এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এভাবে সংগ্রাম পরিষদ ১৫ মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট ও হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন অব্যাহত রাখে।

অবশেষে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষার দাবি সমর্থনের আশ্বাস নিজে আন্দোলন প্রশমিত হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এবং কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষ ঘোষণা দিলে আন্দোলন পুনরায় চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয় ।

১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় একই ঘোষণা দেন যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ ফলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবী মহলে দারুণ ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এ আন্দোলনের অংশ হিসেবেই ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় পালিত ছাত্র ধর্মঘটের জনসভায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা এবং দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ।

২১ ফেব্রুয়ারির উক্ত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তৎকালীন গভর্নর নুরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদ এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল বের করলে পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার এক মারাত্মক সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে প্রাণ হারান এবং আহত হন বহুসংখ্যক ব্যক্তি। এর ফলে সারা বাংলায় আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

ঢাকায় এ ঘটনার প্রতিবাদে তিনদিন একটানা হরতাল পালিত হয় এবং দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। অবশেষে তীব্র বিক্ষোভের মুখে সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং সাময়িকভাবে প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা করার সুপারিশ সম্বলিত একটি প্রস্তাব প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অতঃপর ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দিলে বাঙালি জাতির প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়।

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকার স্বরূপ :

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এক ধাপ এগিয়ে দেয়। জনগণের মধ্যে এ আন্দোলন এক নতুন জাতীয় চেতনার জন্য দেয় এবং এ চেতনাই ক্রমে ক্রমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। তাই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের গণচেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য :

ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদে হারিয়ে যাওয়া একটি সুপ্ত জাতিসত্তার পুনর্জাগরণ ছিল ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ প্রয়াসকে বর্জন করে ধর্মনিরপেক্ষ জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার সঠিক পদক্ষেপ ছিল ভাষা আন্দোলন। কেন মায়ের ভাষায় কথা বলতে দেয়া হবে না – এ প্রশ্নই বাঙালিকে তার আত্মোপলব্ধির সঠিক স্তরে পৌঁছে দেয়।

পাকিস্তানি হয়েও জাতিসতায় তারা বাঙালি, সে জাতিসত্তা সংরক্ষণ করতে না পারলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে –এ সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হওয়ায় বাঙালি যুবকরা সেদিন তাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাই ভাষা আন্দোলনের রূপ যতোটা না সাংস্কৃতিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এ কথাই প্রমাণ করে ।

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য :

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য অনুসন্ধানে একটু গভীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হলে বোঝা যাবে, এটা শুধু মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নয়। এ অন্দোলনকে যারা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ রাখতে চান, তারা এ আন্দোলনের সুগভীর তাৎপর্যের প্রতি উদাসীন বলেই মনে হয়। আসলে যে কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা আন্দোলনের বিচার করা প্রয়োজন ।

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলন নিম্নোক্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল :

১. ‘৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ : ‘৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী মেনিফেস্টো ২১ দফার প্রথম দফাই ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি। এ নির্বাচনে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এপ্রিল ১৯৫৪ আইন পরিষদের অধিবেশনে মুসলিম লীগ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত পোষণ করে। এটি ছিল বাঙালি জাতির ৫২-র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলন।

২. জাতীয়তাবাদের উন্মেষ : এই আন্দোলন পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনা তথা বাঙালি জাতীয়বাদের উন্মেষ ঘটায়। অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতির মনে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়।

৩. ‘৫৬ সালের সংবিধানে স্বীকৃতি : মার্চ ১৯৫৬ পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালের প্রথম আইন পরিষদে গৃহীত ভাষা ফর্মুলা এ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটা ছিল বাংলা ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়। সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হলে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়।

৪. সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায় : ভাষা আন্দোলনের শিক্ষাই বাঙালি জাতিকে প্রথম স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায় ।

৫. পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহে ভূমিকা : ‘৫২-এর একুশের চেতনায় ভাস্বর বাঙালি জাতি রাজনৈতিক অধিকার বা স্বাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বাধিকার অর্জনের দিকে এগুতে থাকে। ‘৬২-র ‘হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’-এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনে ছাত্র সমাজ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২ “শিক্ষা দিবস’ ঘোষণা করে।

১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালি জাতিকে এমন একটি ধারণা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে যে, পাকিস্তানিরা আমাদের শুধু নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করবে। তাই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ লাহোরে শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। ভাষা স্যামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি ছয় দফাকে জাতীয় মুক্তির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে।

‘৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান এবং ‘৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পেছনে প্রেরণা ও শক্তি যুগিয়েছিল ‘৫২-র ভাষা আন্দোলন। ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার ১৬৯টি (মহিলা আসনসহ) আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮২টি আসন লাভ করে এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী শেখ মুজিবের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল বিধিসম্মত । কিন্তু তা না করে শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র । প্রহসনমূলক আলোচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বাঙালি মুজিবের হাতে ক্ষমতা দেয়া হবে না, প্রয়োজনে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হবে। ইয়াহিয়া খান দম্ভভরে ঘোষণা করেন, ‘এ দেশের মানুষ চাই না, মাটি চাই’। ফলে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ মধ্যরাত থেকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালি নিধন অভিযান শুরু হয়ে যায়। এতে করে সব ধরনের অহিংস তৎপরতার সুযোগ নস্যাৎ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।

এটি ছিল মহান ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে প্রত্যাশার চূড়ান্ত প্রাপ্তি। জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ২১-এর চেতনা মুক্তিযুদ্ধে জাতিকে যুগিয়েছে অসীম সাহস। সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে বাংলার বীর জনতা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ হানাদার বর্বর পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে।

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন সফল পরিণতিতে পৌঁছায়। এই আন্দোলন যে বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ ছিল তা স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে।

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির অসাধারণ বিজয় ও ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এ কথাই প্রমাণ করে যে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে ভাষা আন্দোলন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের যে প্রাথমিক সোপান রচনা করেছিল, জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার পথে সে আন্দোলন দ্রুত রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

 

ধর্ম যে কোনো জাতিসত্তার মূল ভিত্তি হতে পারে না, ভাষা আন্দোলন তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে। বাঙালিকে পাকিস্তানি বানানোর প্রক্রিয়ার নীলনকশা নির্বোধ পাকিস্তানি শাসকরা তৈরি করেছিল। বাঙালি সহজেই তা বুঝতে সক্ষম হয় এবং ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তার জবাব দেয়। জাতিসত্তা ধ্বংস করার লক্ষ্য সামনে রেখে ভাষার ওপর আঘাত করা হয়।

একটি জনগোষ্ঠীকে শোষণ ও শাসন করতে হলে তার মূল অস্তিত্বে আঘাত হানা দরকার—এ কথা মনে রেখেই পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির বুকে গুলি চালিয়েছিল। কিন্তু তার প্রত্যুত্তর ছিল এতই কঠিন ও কঠোর যে, ষড়যন্ত্রকারীদের অপচেষ্টা সফল হতে পারেনি। তারপরও উনিশ বছর পাকিস্তান তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও প্রতিরোধ ও সংঘাতের সম্মুখীন হয়েই তা করতে হয়েছে। তবে শেষ পরিণতিতে তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।

বাঙালি শুধু তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, স্বাধীন জাতিসত্তাও প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই বিশ্বের মানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে যে, বাঙালির ভাষা আন্দোলন ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রাথমিক সোপান। এই আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি জাতি স্বাধীন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই আন্দোলনের পরিণতি হচ্ছে স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশ।

ভাষা আন্দোলনই প্রথম বাঙালিদেরকে ঐক্যের দুর্ভেদ্য প্রাচীর গঠন এবং অধিকার আদায়ে ইস্পাত কঠিন শপথে বলীয়ান করে তোলে। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তি আন্দোলনে প্রতি স্তরে প্রেরণা যুগিয়েছে ভাষা আন্দোলনের রক্তরাঙা ইতিহাস। সুতরাং ভাষা আন্দোলন নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মাত্রিকতা :

১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (UNESCO) সাধারণ পরিষদে আমাদের জাতীয় চেতনার ধারক ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে।

ইউনেস্কোর গৃহীত প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলা হয় ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯১টি দেশ বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারিকে পালন করছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। বাংলা ও ভাষা বাঙালির জন্য এ প্রাপ্তি সহস্র মর্যাদার প্রতীক ।

আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে অমর একুশ স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের সাথে সংযোগ ঘটেছে আন্তর্জাতিকতাবাদের। আমাদের ভাষা আন্দোলন আজ শুধু বাংলাদেশ বা বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলন নয়, বিশ্বের যে জনগোষ্ঠীই মায়ের ভাষায় কথা বলার আন্দোলন করুক না কেন, সে আন্দোলনে উৎসাহ যোগাবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

অমর একুশের আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি বয়ে এনেছে বাঙালির জন্য অসাধারণ গৌরব। ‘৫২ থেকে ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালি জাতি স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন করেছিল, সে আন্দোলনের যৌক্তিকতা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেল।

ভাষা আন্দোলনকে হিন্দুদের ইসলামবিরোধী চক্রান্ত ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে যারা আখ্যায়িত করেছিল তাদের মুখোশ আজ উন্মোচিত হয়েছে। তাই নতুন শতাব্দীতে একুশ উদযাপিত হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে, নতুন মাত্রিকতায়, আন্তর্জাতিকতাবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে। বাঙালি আজ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক।

 

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা

 

উপসংহার :

শুধু ভাষা নয়, এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙালি জাতি সারা বিশ্বের কাছে স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের এক প্রকৃত উদাহরণ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ভাষা শহীদদের মহান ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীন বাঙালি জাতি আজ এক মহান গৌরবের অধিকারী। আমাদের মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আজ শুধু শোক প্রকাশের দিন নয়, গৌরবেরও দিন। তাই মহান একুশের সুগভীর তাৎপর্য প্রতিটি বাঙালিকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলে সফল ও সার্থক হবে অমর একুশের মহান ত্যাগ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment