মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ রচনা

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।

Table of Contents

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

 

স্নায়ুযুদ্ধোত্তর নতুন বিশ্বব্যবস্থার পরিমণ্ডলে প্রতিনিয়তই ঘটছে পরিবর্তন। এক নতুন পৃথিবীর জন্ম হচ্ছে আমাদের সামনে। শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, অর্থনৈতিক পরিবর্তনও এর একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর এক্ষেত্রে মুক্তবাজার অর্থনীতি এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিবর্তন প্রবাহে প্রধান অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় উৎপাদন এবং দারিদ্র্যের হার যখন সমান্তরালে বেড়ে চলেছে ঠিক তখনই বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি নতুন অর্থনীতির মাত্রা যোগ হয়েছে। নতুন এ অর্থনীতির নাম মুক্তবাজার অর্থনীতি ।

চলমান সময়ে অর্থনীতির জগতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের নাম মুক্তবাজার অর্থনীতি। মুক্তবাজার অর্থনীতি মূলত উদার গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। এটা এমন এক অর্থনীতি, যেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বহু উন্নয়নশীল দেশে মুক্তবাজার বিষয়টি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ।

বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের সিংহভাগ মুক্তবাজার প্রসঙ্গটি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তবে এসব দেশের সরকার মুক্তবাজার নীতি মেনে নিয়ে ইতিমধ্যে তা কার্যকর করা শুরু করেছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান প্রসঙ্গে পর্যালোচনা করা জরুরি ।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি

‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ বা ‘বাজার অর্থনীতি’ শব্দবন্ধটি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। “Macmillan Dictionary of Economics -এর প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী মুক্তবাজার অর্থনীতি হচ্ছে

“An economic system in which decisions about the allocation of resources and production are made on the basis of prices generated by voluntary exchanges between producers, consumers, workers and owners of factors of production. Decision making in such an economy is decentralized 1. e. decisions are made independently by groups and individuals in the economy rather than by caral planners.”

অর্থাৎ, এটা হচ্ছে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সম্পদের বণ্টন এবং উৎপাদন সম্পর্কিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় মূল্য বা দামের ভিত্তিতে, যা কিনা পক্ষান্তরে নির্ধারিত হয় ভোক্তা, শ্রমিক এবং উৎপাদনের উপকরণসমূহের স্বত্ত্বাধিকারীদের স্বতঃস্ফূর্ত মিথস্ক্রিয়ার ফলে। এ ধরনের ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে অর্থাৎ সিদ্ধান্তসমূহ প্রণীত হয় কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকারীদের পরিবর্তে অর্থনীতিতে স্বাধীনভাবে কর্মরত গোষ্ঠীসমূহ এবং ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

 

McGraw-Hill Dictionary of Modem Economics-এর মতে, মুক্তবাজার অর্থনীতি হলো A mode of economic organization in which the forces of supply and demand are relied upon to solve the problems of the selection of which goods to produce, the method of producing them, and the persons who will receive them once they have been produced.

অর্থাৎ, এটি হলো অর্থনৈতিক সংগঠনের এমন এক অবস্থা, যেখানে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিতে কি কি দ্রব্য বা সেবা কি কি পদ্ধতিতে কারবার ভোগের জন্য উৎপাদিত হবে, সেসব প্রশ্নের মীমাংসার তার বাজারের সরবরাহ ও চাহিদাশক্তির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়।

উপরিউক্ত সংজ্ঞা দুটো থেকে এ কথা সহজেই অনুধাবন করা যেতে পারে যে, মুক্তবাজার অর্থনীতি হলো কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতির বিপরীত একটি প্রত্যয়, যা কিনা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের নেতৃত্বকে প্রচার করে থাকে। উল্লেখ্য, মুক্তবাজার অর্থনীতিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নামেও প্রায়শ অভিহিত করা হয়।

মুক্তবাজার অর্থনীতি হলো ধ্রুপদী অর্থে পুঁজিবাদী অর্থনীতি। অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো ঘরানা থেকে শুরু করে এমনকি কেইনস ঘরানা পর্যন্ত সব অর্থনীতিবিদের আরাধ্য মুক্তবাজার অর্থনীতি। এ অর্থনৈতিক দর্শনের মূল কথা হলো ‘Laisser Fair’ বা ‘অবাধ স্বাধীনতা’। এর অপর অভিব্যক্তি হলো ‘Survival of the fittest’ বা ‘যোগ্যতমের শ্রেষ্ঠত্ব। মুক্তবাজার অর্থনীতি উৎপাদনের উপকরণসমূহের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যতীত টিকে থাকতে পারে না।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি বনাম বাজার অর্থনীতি

প্রকৃতপক্ষে মুক্তবাজার অর্থনীতি হচ্ছে বাজার অর্থনীতির একটা বিশেষণযুক্ত রূপের নাম বিশেষণটির নাম মুক্তা। শুধু ‘বাজার অর্থনীতি’ বললেও ‘মুক্ত’ কথাটি এসে যায় । কারণ, বাজার, শক্তিগুলোকে (চাহিদা ও সরবরাহ) মুক্তভাবেই ক্রীড়া করতে দিতে হয় । প্রসঙ্গক্রমে বাজার অর্থনীতি সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যেতে পারে।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

 

বাজার অর্থনীতি

বাজার অর্থনীতি হচ্ছে এমন এক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, যা দাম নির্ধারণের দায়িত্বটা বাজার শক্তিসমূহ (Market forces) তথা চাহিদা ও সরবরাহের হাতে ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতী। কোনো বাহ্যিক চাপ বা নিয়ন্ত্রণ দিয়ে কোনো দ্রব্য বা সেবার দাম কমানো বা বাড়ানো বাজার দর্শনের পরিপন্থী।

প্রতিযোগিতাই হলো বাজার অর্থনীতির চালিকাশক্তি, প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই পাওয়া যায় যোগ্যতা এবং দক্ষতার স্বীকৃতি। অযোগ্য ও অদক্ষ পণ্য প্রতিযোগিতায় মার খেয়ে বাজার থেকে বিলুপ্ত হয়। প্রতিযোগিতাই উৎপাদকদেরকে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাধ্য করে।

সুতরাং বাজারে সরকারি নিয়ন্ত্রণ অনাকাঙ্ক্ষিত বাজার অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথের মতে, সরকারের ভূমিকা হবে দেশরক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং যথাযথ নীতি নির্ধারণই হবে সরকারের কাজ। অন্যদিকে সরকার পণ্যের মূল্য নির্ধারণ, উৎপাদনে বিনিয়োগ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে অনেক পুঁজিবাদী দেশেই অর্থনীতিতে সরকারের জোরালো ভূমিকা চোখে পড়ে।

সরকার মনোপলি নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমাজের দুর্বল অংশকে (যারা প্রতিযোগিতায় টেকে না) সহায়তা করে। এমন কি আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশেও বিশাল মাপের সরকারি বিনিয়োগ চোখে পড়ে। এটি একদিকে বাজার শক্তিসমূহের প্রতি নিরপেক্ষ মান্যতা, অন্যদিকে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতির ওপর ছেড়ে দেয়ার একটি দৃষ্টিভঙ্গি।

কিন্তু ব্যবহারগত দিক থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি বিশেষত্ব চোখে পড়ে। এটি একটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, যাকে বলা যায় Globalization বা বিশ্বায়ন। বাজার অর্থনীতি একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেও কার্যকর হতে পারে অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতি বলতে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাকে বোঝায় না; বরং বাজার অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিকভাবে চালু করাই হলো মুক্তবাজার অর্থনীতি।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতির উপাদান

মুক্তবাজার অর্থনীতির কয়েকটি প্রধান উপাদান হলো ১. উদারীকরণ, ২. আন্তর্জাতিকীকরণ ও নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণ, ৪. ব্যক্তিমালিকানা প্রবর্তন।

উপরের চারটি বিষয়ই হলো মুক্তবাজার অর্থনীতির অনিবার্য উপাদান। এ কয়েকটি বিষয়ের বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো দেশেই মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করা সম্ভব নয়। বস্তুত বাণিজ্য উদারীকরণ, সরকারি বিধিনিষেধ শিথিলকরণ, ব্যক্তি উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদান প্রভৃতি পদক্ষেপের সম্মিলিত ব্যবস্থাই হলো মুক্তবাজার অর্থনীতি ।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

 

মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য

মুক্তবাজার নীতি এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রায় সমার্থক। মুক্তবাজার অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনই হচ্ছে মুক্তবাজার নীতি। অ্যাডাম স্মিথ অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে এ দর্শন প্রথম উপস্থাপন করেন, অ্যাডাম স্মিথের মতে, বাজারে একটা ‘অদৃশ্য হাত’ আছে, সেই ‘অদৃশ্য হাত’ চাহিদা সরবরাহের মাধ্যমে উৎপাদন ও বিতরণ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে চালিত করে ।

প্রত্যেকেই সেই প্রক্রিয়াসমূহে নিজের অবস্থান ও প্রয়োজনভিত্তিক অংশগ্রহণ করবে। বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা থাকবে এবং চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারিত হবে। ক্রেতারা তাদের চাহিদা, রুচি ও সামর্থ্যের ভিত্তিতে দ্রব্য ক্রয় করবে।

আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর স্থবির অর্থনীতিতে লক্ষ্য বেঁধে দেয়। এগুলো হলো জাতীয় অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অবসান, উদার আমদানিনীতি প্রবর্তন, অবাধ বাজার প্রতিষ্ঠা এবং বেসরকারিকরণ।

এ ব্যবস্থাগুলো গ্রহণের সাথে সাথে আরো যে বিষয়গুলো যুক্ত হয় তা হচ্ছে অনুন্নয়নমূলক কাজ থেকে উন্নয়নমূলক কাজে সম্পদ স্থানান্তর করা, রপ্তানি বৃদ্ধি করা, সরকারি অর্থ ব্যয় এবং প্রশাসনের যৌক্তিক পুনর্বিন্যাস ও দেশজ সম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধি করা ।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি হবে ব্যক্তি উদ্যোগ। শিল্প, ব্যবসায়- বাণিজ্য, ব্যাংকিং, পরিবহন, কৃষি, সেবা প্রভৃতি অর্থনীতির সব খাতেই বেসরকারি উদ্যোগের একচেটিয়া প্রাধান্য থাকবে। সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে বেসরকারি উদ্যোগ এবং উদ্যমই নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করবে অর্থনীতির প্রকৃতি ও অগ্রগতি। মুক্তবাজার অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে

১. আমদানি-রপ্তানিতে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। যে কোনো দ্রব্য যখন খুশি যতটা ইচ্ছা অবাধে আমদানি করা যাবে। অনুরূপভাবে রপ্তানিতেও কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না।

২. কোনো পণ্যের ওপর Tariff protection থাকবে না। এর উদ্দেশ্য হলো ভোক্তারা যেন প্রতিযোগিতামূলক দরে সুলভে ভালো পণ্য পেতে পারে তা নিশ্চিত করা। এর আরেকটি উদ্দেশ্য হলো উন্নত দেশের উন্নত মানের পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় দেশীয় পণ্যের মান বাড়ানো ।

৩. Market Mechanism-এ প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হবে। সরকার কোনো বিশেষ পণ্যের দর বেঁধে দেবে না বা মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে না।

৪. দেশীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে ভর্তুকি দিয়ে থাকে তা থাকবে না।

৫. রপ্তানি বাণিজ্য হবে অবাধ, মুক্ত ও হস্তক্ষেপবিহীন, কোনো রকম বিধিনিষেধ থাকবে না। তেমনি কোনো ধরনের বিশেষ ও আর্থিক আনুকূল্যও থাকবে না।

৬. উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সরকার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে না।

৭. বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশ উৎসাহিত করা হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সব রকম উৎসাহ প্রদান এবং অবাধ সুযোগ দেয়া হবে।

ঐতিহাসিক পটভূমিতে মুক্তবাজার অর্থনীতি : মানবসভ্যতার শুরু থেকে বাজারের ধারণাটি মানুষের মধ্যে থাকলেও লিখিতভাবে বাজারনীতির চর্চা শুরু হয়েছে অনেক পরে। খ্রিস্টের জন্মের আড়াই হাজার বছর আগেও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ মানুষ করেছে এবং ভিন্ন অবয়বে বাজার থাকলেও শাস্ত্রগতভাবে অর্থনীতির চর্চা শুরু হয়েছে মাত্র দুশ বছর আগে।

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথকে আধুনিক অর্থনীতির জনক বলা হয়, যার সাথে আমরা পরিচিত হই ১৭৭৬ সালে। অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো, টি আর ম্যালথাস, জেবি মো প্রমুখ ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক ।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি নতুন কিছু নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ্বে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দিকে তা বিভিন্ন দেশে চালু ছিল। নতুন করে এ প্রক্রিয়ার ওপর জোর দেয়া শুরু হয় ১৯৭০-এর দশক থেকে। বর্তমানে এর গতি অনেক দ্রুততর এবং আকারে অনেক বৃহৎ।

কেননা বিশ্ব অর্থনীতি এখন অনেক বেশি উন্নত ও অনেক বেশি ব্যাপক। এর আগে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে অর্থনীতির যে পদ্ধতি প্রচলিত ছিল সেটা মূলত পরিকল্পনাভিত্তিক এবং সেখানে বড় দায়িত্ব পালন করতো সরকার। যদিও ঐ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশে বেসরকারি খাতকে যথেষ্ট সহায়তা করতো সরকার। এসব দেশে সরকারি খাত ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রাধান্য ছিল।

১৯৭০-এর দশকের আগে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিকে দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হতো। তাই প্রত্যেক দেশই তখন জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর চেষ্টা করতো। তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিভিত্তিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্য নিরসন হওয়ার কথা ছিল ট্রিকল-ডাউন (ওপর থেকে চুইয়ে নিচে পড়া) এফেক্ট-এর মাধ্যমে। কিন্তু দেখা গেল, অনুন্নত দেশগুলোর আয় খুব একটা বাড়ছিল না।

পাশাপাশি দারিদ্র নিরসন তো হচ্ছেই না, বরং বাড়ছে। তখন বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য দাতা দেশ ধারণা করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে উন্নয়নশীল দেশসমূহে অর্থনীতির যে বিকাশ হওয়া উচিত ছিল তা হচ্ছে না। তাই তারা এ সকল দেশের জন্য অর্থনৈতিক সংস্কার বা স্থিতিশীলতা ও কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস, কর্মসূচি নির্ধারণ করে এবং একে সাহায্য দানের শর্ত হিসেবে চিহ্নিত করে।

প্রথম দিকে এই প্রক্রিয়াটি ছিল মূলত সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংস্কারভিত্তিক। ঐ সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে যা যা অন্তর্ভুক্ত ছিল সেগুলো হচ্ছে বেসরকারিকরণ, শুল্কহার কমানো এবং বিশ্বায়নে অগ্রগতি সাধন, আয়কর সংস্কার, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, শ্রমবাজার সংস্কার, সরকারি অর্থনৈতিক নিয়মনীতি শিথিলকরণ, সরকারের আকার ছোট করা ইত্যাদি। মোটকথা, বাজার অর্থনীতিই হবে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার চালিকাশক্তি, সরকার সে ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজেকে ন্যূনতম পর্যায়ে স্থাপন করবে এবং বিশ্বায়ন হবে প্রত্যেকটি দেশের জন্য কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক অগ্রগতির এক ব্যাপক উৎস

১৯৭০-এর দশক থেকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এ সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে। শর্ত দাঁড়ায়, বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য দাতার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিতে হলে এ সংস্কারের ভিত্তিতেই নিতে হবে।

এ সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করলেই সাহায্য পাওয়া যাবে, অন্যথায় নয় । অনেক দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলো এসব শর্তে সাহায্য নিতে শুরু করলো। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু শ্রীলংকাই ১৯৭৭ সালে এ সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছিল।

পাকিস্তান আশির দশকের গোড়ার দিকে শুরু করলেও ঐ দশকের শেষের দিক পর্যন্ত তেমন এগোয়নি। বাংলাদেশ সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করে ১৯৮৭ সালে, তবে তা জোরেসোরে বাস্তবায়ন করে আসছে ১৯৯১ সাল থেকে। ভারত ১৯৯১ সালে সংস্কার প্রক্রিয়া চালু করে। এ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ কর্তৃক উদ্ভাবিত সংস্কার প্রক্রিয়া তথা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলনের ইতিবৃত্ত।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টে যায়। অনেকগুলো উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আবার বিশ্ব রাজনীতিতে প্রবল শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা বিশ্ববাজারে নিজেদের অংশ দাবি করে। নতুনভাবে স্বাধীনতা লাভকারী অনেক দেশই সংরক্ষণবাদ নীতি গ্রহণ করে।

এ পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ সালে হাভানায় মিত্রশক্তিগুলো মিলিত হয় পারস্পরিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে। মোট ২৩টি রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জন্য এক সাধারণ সমঝোতায় উপনীত হয়, যাকে ‘জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ (GATT)’ বলা হয়। বর্তমানে বিশ্বের সোয়াশরও বেশি দেশ এ GATT-এর আওতায় চুক্তিবদ্ধ।

দেশগুলো ১৯৯৪ সালে চুক্তিতে স্বাক্ষর করায় ১৯৯৫ সাল থেকে GATT রূপান্তরিত হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যার লক্ষ্য হচ্ছে সারা বিশ্বের বাণিজ্যকে ক্রমান্বয়ে অবাধ করা, শুল্কহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনা এবং ক্রমান্বয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা ।

বর্তমানে WTO-এর পাশাপাশি অঞ্চলিকভাবেও কিছু মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চলে গেছে একক মুদ্রায়, আসিয়ান চলে যাচ্ছে শূন্য শুল্কে । মুক্তবাজারের প্রায় অভিন্ন শর্ত নিয়ে আরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে NAFTA, SAPTA, LAFTA APEC ইত্যাদি অর্থনৈতিক গোষ্ঠী।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আঞ্চলিক বাধা বা অসমতাগুলো যত দ্রুত কমিয়ে এনে আঞ্চলিক মুক্তবাজারের জোটগুলোকে সাবলীল করা যায়, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তত দ্রুত মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

 

মুক্তবাজার অর্থনীতির সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ

প্রতিটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থারই কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। আর মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব থেকেই আমরা এর সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ চিহ্নিত করতে পারি। নিচে তা উপস্থাপন করা হলো,

মুক্তবাজার অর্থনীতির সুবিধাসমূহ

১. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি।

২. আন্তর্জাতিকভাবে ভোগ বৃদ্ধি।

৩. দরিদ্র দেশগুলোতে আমদানি বৃদ্ধি।

৪. প্রযুক্তির দ্রুততর হস্তান্তর।

৫. অবাধ তথ্যপ্রবাহ।

৬. পুঁজি ও শ্রমের সহজতর সঞ্চালন।

৭. ভোক্তার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি।

৮. সর্বত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি।

৯. বিকল্প বিবেচনায় ভোক্তার সুবিধা ও স্বাধীনতা।

১০. আন্তর্জাতিকতাবাদের অনিবার্য বিকাশ ।

১১. যোগাযোগ ও পরিবহন খাতের সম্প্রসারণ।

১২. সরকারের সর্বময় ক্ষমতা হ্রাস।

১৩. আন্তর্জাতিকভাবে মনোপলির প্রভাব খর্বকরণ।

১৪. পুঁজিবাজারের আন্তর্জতিকায়

১৫. আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাগের উদ্ভব ।

১৬. বিদেশী বিনিয়োগের যাতায়াত।

১৭. শিল্প-সংস্কৃতির বিনিময়, মিশ্রণ ও উপার্জন সুবিধা ।

১৮. জনগোষ্ঠীর বিশ্ব পরিভ্রমণ বৃদ্ধি।

১৯. ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক নির্ভরতা।

২০. রপ্তানি বাজারের সম্প্রসারণ ও ঝুঁকি হ্রাস।

২১. সম্পদের বিকল্প ব্যবহার বৃদ্ধি।

২২. দীর্ঘমেয়াদে সর্বনিম্ন উৎপাদন খরচের নিশ্চয়তা।

২৩. সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরক্ষায় ব্যয় হ্রাস।

২৪. চোরাচালানের প্রবণতা হ্রাস।

২৫. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংহতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি ।

২৬. অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্রমবর্ধমান সুযোগ।

২৭. সরকারি মেশিনারির সংকোচন

২৮. দেশগত মন্দার ঝুঁকি হ্রাস।

২৯. কল্যাণ অর্থনীতির (Welfare Economics) প্রচলন।

৩০. বাণিজ্য বাঁধা হ্রাস ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

 

মুক্তবাজার অর্থনীতির অসুবিধাসমূহ

প্রকৃতপক্ষে মুক্তবাজার হচ্ছে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দক্ষতা ও সমৃদ্ধির অভিমুখে এক অনিবার্য অভিযাত্রা। সুতরাং এর প্রয়োগে ত্রুটি বা বাধাবিপত্তি যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সেগুলোই সাময়িক দৃষ্টিতে মুক্তবাজার অর্থনীতির অসুবিধা যেমন—

১. দরিদ্র দেশে প্রাথমিকভাবে শিল্পরুক্ষ্মতা বৃদ্ধি ।

২. অদক্ষ খাতে বেকারত্ব বৃদ্ধি।

৩. উন্নত দেশগুলোর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ বৃদ্ধি।

৪ উন্নত দেশ কর্তৃক অনুন্নত দেশের বাজার দখল।

৫ শিল্প-সংস্কৃতিতে মিশ্রণ এবং অনেক ক্ষেত্রে দেশীয় ঐতিহ্যের বিলুপ্তি।

৬. সরকারি নিয়ন্ত্রণহীনতা।

৭. যোগ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে নৈরাজ্যের সম্ভাবনা।

৮. দুর্বলের নিশ্চিত বিলুপ্তি।

৯. অধিক ঝুঁকি ও সতর্কতা।

১০. অর্থনৈতিক নির্ভরতাকে জিম্মি করার সম্ভাবনা।

১১. জনসাধারণের মাঝে ভোগবাদ বৃদ্ধি ।

১২. উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনুকরণ প্রবণতা বৃদ্ধি ।

১৩. এক দেশের বিপর্যয় দ্রুতগতিতে অন্য দেশে সংক্রমিত হওয়া।

১৪. দরিদ্র দেশের শিল্প বহুমুখিতা (Industrial Diversity) হ্রাস।

১৫ অপেক্ষাকৃত কম মুনাফার উৎপাদনে অনাগ্রহ।

 

বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির অভিযাত্রা ও গৃহীত পদক্ষেপ

স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকার প্রেক্ষাপটগত কারণেই খানিকটা নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ব্যাপক জাতীয়করণের মাধ্যমে শিল্প-কলকারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেয়া হয় এবং এর মিশ্র ফল আসে। রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাপক লোকসান, ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নৈরাজ্য, শ্রম কাঠামোর অদক্ষতা ব্যাপক জাতীয়করণকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করে। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সরকার ব্যাপক ব্যক্তিগতায়ন কর্মসূচি হাতে নেয় । কিন্তু তখন পর্যন্ত মুক্তবাজার অর্থনীতি সম্বন্ধে আমরা সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করিনি।

আশির দশকের মাঝামাঝি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ প্রভাবিত সংস্কার কর্মসূচি বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় এক নব অধ্যায়ের সূচনা করে। আন্তর্জতিকায়ন, উদারীকরণ, নিয়ন্ত্রণমুক্তি এবং ব্যক্তিগতায়ন প্রভৃতি সংস্কার কর্মসূচি প্রধান অ হিসেবে মুক্তবাজারকে ত্বরান্বিত করে। নাইয়ের দশকের শুরু থেকে মুক্তবাজারের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ অবাধ বৈদেশিক বিনিয়োগ আহ্বান করে।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

 

শেয়ার বাজারও তখন থেকে বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ১৯৯৪ সালে গ্যাট (GATT)-এ স্বাক্ষর করেছে এবং ১৯৯৫ এর ডিসেম্বর থেকে এ দেশে সাপটা (SAPTA) কার্যকর হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ একই সাথে দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে ৷ মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালায় সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং তা সাম্প্রতিককালে জোরদার করা হয়েছে।

সরকারের সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতিমালা বিশেষত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রতি মনোযোগী ও ব্যক্তি উদ্যোগের প্রতি উদার হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা কিছুটা উজ্জ্বল হয়েছে। আমদানি লাইসেন্সের জটিল প্রক্রিয়া ও আমদানি পাসবুক ব্যবস্থা পুরোপুরি উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমদানি শুল্ক ১৯৯০-৯১ সালের গড়ে ৮৯% থেকে বর্তমানে গড়ে ৪০%-এ কমানো হয়েছে।

একইভাবে বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজতর করা হয়েছে ও সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন খাতে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়েছে। ফলে জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ এবং অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহনে ব্যক্তিগত পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিনিয়োগ প্রক্রিয়া এখন এতটাই সহজ করা হয়েছে, এর জন্য সরকারি অনুমোদন নেয়ার দরকার হয় না।

কর প্রশাসনকে নতুনভাবে সাজানো এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে অর্থ-ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান একটি সংস্কার কর্মসূচি হলো ভ্যাটের (VAT) প্রবর্তন করপোরেট ট্যাক্সও স্বল্প সময়ের মধ্যে ৪০%-এ নেমে এসেছে।

দ্বৈত বৈদেশিক বিনিময় হারকে বিলুপ্ত করে চলতি হিসেবে মুদ্রা রূপান্তরের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ডলারের তথা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়মূল্য বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড ও সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন করে প্রশাসনিক ও আইনগত সংস্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগের পরিবেশ আরো অনুকূল করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা থেকে সরকার এখন সহযোগী ও উৎসাহদাতার ভূমিকায় নিজেকে উপস্থাপন করতে আগ্রহী। সরকারের এ ভূমিকা বিনিয়োগ বোর্ডকে শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করেছে। অর্থ খাতে একটি নমনীয় সুদের হার সংক্রান্ত নীতি গ্রহণ করা হয়েছে এবং নির্দেশনার মাধ্যমে ভর্তুকি হারে ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।

এসব পদক্ষেপেরই অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিগত খাতের সঞ্চয়কে সচল করা এবং সম্পদ বণ্টনে উন্নয়ন ও বিনিয়োগের লক্ষ্যে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো। শ্রমিক স্বার্থে সরকার শিল্প সম্পর্ক নীতিমালা (সংশোধিত) ১৯৮৯ ঘোষণা করেছে, যার লক্ষ্য শ্রমিক সম্প্রদায়কে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করা ।

সরাসরি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সম্প্রতি কিছু উৎসাহব্যঞ্জক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পদক্ষেপসমূহের মধ্যে শিল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজতর করা, অনুমোদিত রয়্যালিটি, ট্রেড হলিডে, বেসরকারি পর্যায়ে ইপিজেড স্থাপনের অনুমতি, বেতন ও পারিতোষিক প্রেরণের ক্ষেত্রে নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধা এবং পুঁজি ও মুনাফা পুনর্ব্যয়নের ব্যাপারে সুবিধা প্রদান উল্লেখযোগ্য ।

বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বৈধতার নিশ্চয়তা দিচ্ছে ১৯৮০ সালে প্রণীত বিদেশী ব্যক্তিগত বিনিয়োগ (সহায়তা ও রক্ষা) অধ্যাদেশ আইন। তাছাড়া কয়েকটি সীমিত খাতের বাইরে অন্য যে কোনো শিল্পেই সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে এবং ইকুইটির ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এসব কারণে এবং সাম্প্রতিক উদারীকরণ পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বর্তমানে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নতি ঘটেছে, যদিও তা রয়েছে খুবই নগণ্য স্তরে-বার্ষিক কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার মাত্র।

বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির কোনো একমুখী প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। কারণ এ দেশে এখনো সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গরূপে মুক্তবাজার চালু হয়নি।

এর মূল কারণ সংস্কার কর্মসূচি মাঝপথে থেমে থাকা নিম্নলিখিত কারণে সংস্কার কর্মসূচি মাঝপথে থেমে আছে যথা

১. সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের দৃঢ়তার অভাব,
২. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা,
৩. রশিল্প ও অদক্ষতা লালনের রাজনৈতিক স্বার্থ,
৪. দুর্বল ব্যক্তিখাত,
৫ ট্রেড ইউনিয়নসমূহের চাপ,
৬. কর্মসূচি সম্পর্কিত বোধগমাতার সংকট ইত্যাদি।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

 

এ ছাড়া গ্যাটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে বা সাপটার মাধ্যমে আঞ্চলিকভাবে যে মুক্তবাজার চালু হওয়ার কথা ছিল তার গতিও সন্তোষজনক নয়। এটা মূলত জিডিপিতে বাণিজ্যের ক্ষুদ্র অনুপাতের অবদান এবং মুক্তঝণিজ্য ব্যবস্থায় বাংলাদেশের আঞ্চলিক পশ্চাদপদতার জন্যই হয়েছে। এতদসত্ত্বেও মুক্তবাজার অর্থনীতির কিছু প্রভাব ধীরগতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পরিলক্ষিত হয়, যা নিম্নরূপ

১. শুল্ক হ্রাস

প্রতিটি বাজেটেই ক্রমান্বয়ে আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনা হচ্ছে। ২০০৫ সাল নাगान সর্বোচ্চ শুল্কহার হতে পারে ১৫%। বাংলাদেশে পূর্বের সর্বোচ্চ ২০০% শুল্কহার কমতে কমতে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৫০%-এ নেমে এসেছে।

 

২. বাণিজ্য বৃদ্ধি

মুক্তবাজার ও মুক্তবাণিজ্যমুখী অভিযাত্রার ফলে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ তবে সরকারের লক্ষ্য রপ্তানি অধিক হারে বৃদ্ধি করা।

 

৩. ভোগ বৃদ্ধি

মুক্তবাজারের বদৌলতে আমদানিকৃত দ্রব্যসমূহের দাম পূর্বাপেক্ষা কমেছে, যা ভোক্তার চাহিদা ও ভোগকে বাড়িয়েছে।

 

৪. ব্যক্তিখাতের বিকাশ

মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করার ফলে এ দেশে সরকারি খাতের পাশাপাশি ব্যক্তিখাতে ব্যাংক, বীমা, শিল্প, পরিবহন, যোগাযোগ, টেলিফোন প্রভৃতি বেড়েছে।

 

৫. অবাধ তথ্যপ্রবাহ

এর ফলে বাংলাদেশে ডিশ স্যাটেলাইট টিভি, ইন্টারনেট, ই-মেইল প্রভৃতির প্রসার ঘটেছে এবং দেশবাসী বিশ্ববাজার, শিল্প ও বিনোদন সম্পর্কে অবহিত হচ্ছে।

 

৬. শিল্পরুগ্নতা ও বেকারত্ব

মুক্তবাজারের ধাক্কায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশজ শিল্পগুলো রুগ্ন হয়ে পড়ছে। অনেক শিল্প বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং এর ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

৭. শিল্প থেকে বাণিজ্য

বড় বড় পুঁজি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নতুন করে শিল্প স্থাপনের চেয়ে বাণিজ্যের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ে অধিক আগ্রহী হয়ে পড়েছে।

 

৮. পুঁজিবাজারের বিকাশ

মুক্তবাজারের ফলে দেশে পুঁজিবাজারের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। এর ফলে মাত্র কয়েক বছরে পুঁজি বাজার বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে কয়েক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

 

৯. সরকারি দায় হ্রাস

আগে সর্বক্ষেত্রেই সরকারি হস্তক্ষেপ চলত, কিন্তু বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে যে কোনো ক্ষেত্রে (প্রতিরক্ষা, বিচার ও প্রশাসন বাদে) প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সরকারি ও ব্যক্তি উত্তর খাত এগিয়ে আসতে সক্ষম। বাংলাদেশে এটা ধীরে হলেও ঘটা শুরু করেছে।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের করণীয়

মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে যত বিতর্কই হোক না কেন, এটা থেকে পিছিয়ে যাওয়া বা একে বন্ধ করে দেয়ার উপায় বাংলাদেশের নেই। অতএব বাংলাদেশের উচিত মুক্তবাজারের সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়া। তাই মুক্তবাজার অর্থনীতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এ মুহূর্তে সরকার তথা বাংলাদেশের করণীয় হলো

১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করা। সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। সমাজের দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করা।
২. সংস্কার কর্মসূচি পূর্ণভাবে অব্যাহত রাখা।
৩. যথাসম্ভব দ্রুত প্যাট বাস্তবায়নে প্রস্তুতি নেয়া।
৪. বিদেশী বিনিয়োগ প্রকৃত অর্থেই উন্মুক্ত করা।
৫ বাণিজ্যের সরকারি বাধা ও অনুৎপাদনশীল নিয়ন্ত্রণ দূর করা।
৬. ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
৭. লোকসানি সরকারি খাত বিলুপ্ত করা।
৮ অনুৎপাদনশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল দলীয় ট্রেড ইউনিয়ন বন্ধ করা।
৯. বন্দর, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন করা।
১০. গণমাধ্যমে মুক্তবাজার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা।
১১. পণ্যের বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও গতিশীল করা।

এছাড়া মুক্তবাজারের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য দরকার আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ, সর্বক্ষেত্রে ভর্তুকি পরিহার, শুল্কহার হ্রাস, সরকারি খাতের সংকোচন, প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পরিকল্পিত উন্নয়ন ব্যবস্থার প্রবর্তন আওতায় চলে এসেছে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপসংহার

প্রায় সারা বিশ্ব আজ মুক্তবাজার অর্থনীতির আওতায় চলে এসেছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও মুক্তবাজার অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তাদের নবতর অর্থনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে। বাংলাদেশে মুক্তবাজার এখনো হামাগুড়ি দিচ্ছে। এর সঠিক বাস্তবায়ন না ঘটলে একদিকে অদক্ষতার মূল্য দিতে হবে, অন্যদিকে মুক্তবাজার সম্বন্ধে জনমনে ভ্রান্ত ধারণা জন্মলাভ করবে।

জনগণের সচেতনতা ও সরকারের দায়বদ্ধতা সম্মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে পারে মুক্তবাজারের সাফল্য । বাংলাদেশের প্রধান দলগুলো তাদের অর্থনৈতিক ইশতেহারে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছে। তাই মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে কোনো দোদুল্যমানতার অবকাশ নেই। আমাদেরকে মুক্তবাজারের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সেজন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবর্তন প্রয়োজন।

আয় ও সুবিধার সুষম বণ্টন নিশ্চিত না করে মুক্তবাজারের প্রচলন আমাদের দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যকে দিন দিন বৃদ্ধি করবে। তাই আমাদের উচিত দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে যথাযথ পদক্ষপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুক্তবাজার অর্থনীতির সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়া ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment