মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে একটি নমুনা প্রতিবেদন রচনা করবো আজ। বাংলাদেশের রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আমরা যতই সামনে আগাবো, আমাদের আগাতে হবে মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি ধরে, তাহলে আমরা বিপথগামী হবো না। এই নমুনা রচনাটি দেয়া হচ্ছে আপনাদের অননুশীলনের জন্য। আশা করি আপনারা এটা অনুশীলন করে নিজের মতো করে লিখবেন।
Table of Contents
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের উপন্যাস
ভূমিকা :
মুক্তিযুদ্ধ অনুযগটি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে বিভিন্নভাবে। এর মাধ্যমে সাহিত্যের ভাব, ভাষা, প্রকাশভঙ্গি আমূল পরিবর্তিত হয়েছে; বাংলা সাহিত্যে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা উপন্যাসের ভূখণ্ডে মুক্তিযুদ্ধ বিশাল এলাকা জুড়ে পরিব্যাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, যুদ্ধ প্রস্তুতি, যোদ্ধার ভূমিকা, বর্বর বাহিনীর নৃশংসতা, অবরুদ্ধ বাংলাদেশের নারী-পুরুষের মানসিকতা পাক বাহিনীর প্রতিরোধ সংগ্রাম এবং বিজয় এই ঐতিহাসিক দলিল চিত্র অক্ষন করতে শক্তিমত্ত হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন কয়েকজন প্রবীণ ও তরুণ ঔপন্যাসিক। দেশ, জাতি ও মানুষের বিপর্যয় মুহুর্তের চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে ঐতিহাসিক, সামাজিক দায়িত্ব যেমন তারা পালন করেছেন, তেমনি ভবিষ্যৎ রবিকরোজ্জ্বল ভূ-খণ্ডের বর্ণাঢ্য চিত্র রচনা করেছেন এবং সর্ব বাস্তব জীবনবোধের স্বাক্ষর রেখেছেন।
চেতনায় স্বাধীনতা:
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুটি গৌরবজনক অধ্যায়ই শুধু নয়, যে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়ারও অনুপ্রেরক তীর্থতিথি। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি অথবা ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বরে আমরা প্রতি বছর অভিষিক্ত হই।
বাংলা উপন্যাসের সূচনাকালে স্বাধীনতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়কে বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয় । এর একটি কারণ তিনি বিষয় হিসেবে বিভিন্ন কিছুকে উপন্যাসে আনয়ন করেছেন। স্বাধীনতা স্পৃহা পরাধীন ভারতবর্যের উপন্যাসে তিনিই প্রথম প্রকাশ করেছিলেন। তার ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে প্রথম ব্যক্ত হয় ভারতীয়দের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। এর পর বাংলা ভাষার প্রধান ঔপন্যাসিকগণ এই বিষয়কে উপন্যাস কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ ও ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে ভিন্ন মাত্রায় হলেও রাজনীতি ও স্বাধীনতা স্থাপন স্পৃহার কথা আছে। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী তে তিনি তো স্বাধীনতার দাবিই তুললেন মূলত। আর নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’য় আছে শোষিত ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। অর্থাৎ উপন্যাসে স্বাধীনতার ব্যাপারটি এসেছে প্রথম থেকেই এবং নানা মাত্রায়।
স্বাধীনতা স্পৃহা ও ১৯৭১-এর পূর্বকাল : ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হবার অব্যবহিত পূর্বে নানা সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দেশের মানুষের সহানুভূতি জাগ্রত হয়। উপন্যাস শিল্পীগণ সেই উত্তাল দিনগুলোতে অগ্রবর্তী চিন্তার পথিকৃতের মতো উপন্যাসে স্বাধীনতার কথা ব্যক্ত করেন। যদিও ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করেন।
এবং এতে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় তবু সাহিত্য শিল্পীগণ বিভিন্ন কৌশলে স্বাধীনতার কথা সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের মতো উপন্যাসেও প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে আবুল ফজলের ‘রাঙ্গা প্রভাত’ (১৯৫৭), শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ (১৯৬২), সত্যেন সেনের ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৬৯), আনোয়ার পাশার নীড় সন্ধানী’ (১৯৬৮), ইন্দু সাহার ‘কিষাণ’ (১৯৬৯) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব উপন্যাসে কখনো পরোক্ষভাবে কখনো প্রতীক বা রূপকের আড়ালে স্বাধীনতার কথা ব্যক্ত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন উপন্যাসের তালিকা :
বিভিন্ন বাংলা উপন্যাসে স্বাধীনতার আকৃতি বা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ফলে অর্জিত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বিশেষ করে যুদ্ধের ভয়াবহতা, লোক হত্যা, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন, যুদ্ধের পক্ষে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, কারো কারো যুদ্ধের বিরোধীতা ইত্যাদি নানা বিষয় উঠে এল উপন্যাসে। এসব উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর এবং যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বিনাশীল। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের একটি তালিকা নিচে প্রদান করা হলো :
১. শওকত ওসমান : জাহান্নাম হতে বিদায়, নেকড়ে অরণ্য, দুই সৈনিক, জলাঙ্গী ।
২. আনোয়ার পাশা : রাইফেল রোটি আওরাত।
৩. রশীদ করীম : আমার যত গ্লানি।
৪. সৈয়দ শামসুল হক : নিষিদ্ধ লোবান, নীল দংশন, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, ত্রাহী ।
৫. সেলিনা হোসেন : হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, কাঁটাতারে প্রজাপতি, নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি।
৬. হুমায়ূন আহমেদ : সৌরভ, আগুনের পরশমণি, অনিল বাগচীর একদিন, জোছনা ও জননীর গল্প, শ্যামল ছায়া, নির্বাসন।
৭. ইমদাদুল হক মিলন : কালো ঘোড়া, ফেরাও, মহাযুদ্ধ, অভিমান।
৮. মঞ্জু সরকার : তমস, প্রতিমা উপাখ্যান।
৯. আবু জাফর শামসুদ্দিন : দেয়াল।
১০. সরদার জয়েন উদ্দিন : বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ।
১১. আমজাদ হোসেন : অবেলায় অসময়।
১২. নুর মোহাম্মদ মোল্লা :এক প্রজন্যে সংলাপ ।
১৩. আল মাহমুদ : এ উপমহাদেশ।
১৪. জহির রায়হান : আরেক ফাল্গুন।
১৫. শাহরিয়ার কবির : পূর্বের সূর্য।
১৬. দিলারা হাশেম : একদা, অনন্ত।
বিভিন্ন উপন্যাসের বিষয় সংক্ষেপ:
রাইফেল রোটি আওরাত :
শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এ দেশের ইতিহাসের এক দুঃসহ ও নৃশংশতম অধ্যায়ের বিশ্বস্ত দলিল এই উপন্যাসটি। এ শুধু একাত্তরের বাংলাদেশের হাহাকারের চিত্র নয়, তার দীপ্ত যৌবনেরও এক প্রতিচ্ছবি। এ গ্রন্থের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন বাংলাদেশ আর বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষা, সংকল্প প্রত্যয় আর স্বপ্ন কল্পনারই যেন প্রতীক।
একাত্তরের মার্চের সে ভয়াবহ কটা দিন আর এপ্রিলের প্রথমার্ধের কালো দিনগুলোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার সংকীর্ণ পরিধি টুকুতেই এ বইয়ের ঘটনাপ্রবাহ সীমিত, কিন্তু এর আবেদন আর দিগন্ত দুঃখ এ সময়সীমার আগেও বহুদূর বিস্তৃত। বাঙালির বেদনা আর আশা-নিরাশার এ এমন এক শিল্পরূপ যা সব সময় সীমাকে ডিঙ্গিয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী অপরূপ সাহিত্য কর্ম হয়ে উঠেছে।
এটি তার শেষ বই। জীবনের শেষ বই প্রত্যক্ষ আর সাক্ষাৎ ঘটনাবলীকে তিনি উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন এ গ্রন্থে। ঢাকায় বিশেষে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে, যে বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের সব প্রগতি আন্দোলনের উৎস তার উপর পাক হানাদারের বর্বর আক্রমণ আর তাদের অমানুষিক তাবলীগার এমন নিখুত ছবি, এমন শিল্পোত্তীর্ণ রচনা আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ইতিহাসের দিক দিয়েও এ বইয়ের মূল্য অপরসীম ।
“ফ্ল্যাশব্যাক রীতিনির্ভর রাইফেল রোটি আওরাত-এর ভাষা শ্লেষাত্মক, প্রশ্ননির্ভর বিশ্লেষণধর্মী। নির্লিপ্ত, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিচেতনা দিয়ে লেখক প্রতিটি চরিত্র, পরিবেশ চিত্রিত করেছেন। সর্বত্র অনুসন্ধিৎসা আছে। ভাবাবেগের প্রাবল্য নেই, চরিত্র-পরিবেশ ভাষা সর্বত্র এক সংহত, সংযত নির্লিপ্ত শিল্পীমনেরই যেন উৎসারণ।” চোখের সামনে ঘটা টাটকা ঘটনাবলীর উত্তাপ তার শিল্প সত্তাকে কেন্দ্রচ্যুত করেনি কোথাও। লেখকের জন্য এর চেয়ে প্রশংসার কথা আর হতে পারে না।
দুই সৈনিক :
আমাদের জাতীয় চরিত্রের কলঙ্কময় দিক শওকত ওসমান তার দুই সৈনিক উপন্যাসে অঙ্কিত করেছেন। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিভাবে আমাদেরই আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ কেউ কত অযাচিতভাবে পাক মিলিটারির সহায়তা করতে এগিয়ে গিয়েছিল এবং অবশেষে নিজেদের এবং প্রিয়জনদের জীবনে দুর্ভোগ ও করুণ পরিণতি নেমে এসেছিল তার একটি চিত্র তিনি অঙ্কন করেছেন দুই সৈনিক উপন্যাসে।
নেকড়ে অরণ্য :
শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি উপন্যাস ‘নেকড়ে অরণ্য’ নির্বাসিত রমণীদের বোবা কান্নায় মুখর। একটা গুদাম ঘর শৃঙ্খলিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। গুদাম ঘরের মধ্যে যেসব নারী আছে তারা অপমানিতা, নির্যাতিতা, ধর্ষিতা এবং সেই সূত্রে হিন্দু-মুসলমান শিক্ষিত-অশিক্ষিত গ্রামীণ ও নাগরিক রমণীদের মধ্যে একটা ঐক্য ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রুচি, সংস্কৃতি ও ভাষার ব্যবধান দূর হয়ে একটি গভীর মমত্ববোধ পরা সবাই পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিল। সকলের কাছে একটা দুঃখই পাহাড়। তারই ভার সকলে বহনরতা। তাই একে অপরের কাছাকাছি হওয়ার ব্যগ্রতা অপরিসীম।
অবেলায় অসময় :
আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায় অসময়’ উপন্যাসের স্থান আকর্ষণীয়, একটি চলমান নৌকা বাংলাদেশের মিলন তীর্থ। মিলিটারির আক্রমণের ভয় নৌকাটির ভেতরে। বড়ুয়া, ব্যানার্জী, জনসন, জসিমদ্দি, কিশিত, টুপী, নামাবলী সবই আছে। কিন্তু এরা সব জাত ধর্ম এ নদীর জলে ঘুরে ফেলেছে। সব এখন মানুষ ।
আলী মাঝির দার্শনিক উপলব্ধি: ‘সুখের সময় যত জাত ধর্মের বাহাদুরী, মারামারি, খুনোখুনি! আজকে আমার এ নৌকার ভিতরে যেমন এক জাতের মানুষ, সারাজীবন এইভাবে বসবাস করলেই তো আর গাল গালাজ হয় স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে খণ্ড খণ্ড কাহিনী ফ্ল্যাশব্যাক রীতিতে এগিয়ে চলছে।
আলী মাঝি ও ফাতেমা, আদম ও হাওয়া, কাসেম ও সকিনা সমান মর্যাদা অর্জন করেছে। জুটির নাম নির্বাচনে আমজান হোসেনের ইতিহাস চেতনা কাজ করছে। বর্ণনার ভাষায় ঋজুতা, স্বাচ্ছন্দ্য ফুটে উঠেছে।
হাঙ্গর নদী গ্রেনেড :
সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসের নামকরণ এবং বিষয় বস্তুতে প্রতীকী ব্যঞ্জনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। হাঙ্গর আক্রমণকারী মিলিটারি, নদী-বুড়ী-তথা বাংলাদেশের নিস্তরাপ জীবন এবং গ্রেনেড মুক্তিযোদ্ধা ।
সর্বমোট বিরানব্বই পৃষ্ঠার উপন্যাসটির চুয়াল্লিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত প্রধান চরিত্র বুড়ীর জীবন, তার কৈশোর, যৌবন, বিবাহ, সন্তানহীনতা, সন্তানপ্রাপ্তি, স্বামীর মৃত্যু, সতীনের বড় ছেলের বিয়ে, দানী হওয়া ইত্যাদি যেন হাজার বছরের বাংলাদেশের নিস্তরাদ এক সেয়ে বৈচিত্রহীন শান্তনদীর মত প্রবাহিত জীবনের বর্ণনা রয়েছে। হাজার বছরের বাংলাদেশের নয় মাস সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যতিক্রমী।
নয় মাসের প্রথম পর্যায় পাকবাহিনী আক্রমণকারী হাঙ্গর এবং দ্বিতীয় পর্যায় প্রতি আক্রমণকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রেনেড। তাই হাঙ্গর ও গ্রেনেড উপন্যাসটির অর্ধেক জায়গা মাত্র জুড়েছে। হাজার বছরের নদীমাতৃক বাংলাদেশের হাঙ্গর ও গ্রেনেডের অবস্থান সংক্ষিপ্ত এবং ব্যতিক্রমী। তাই ইচ্ছে করেই হয়ত সেলিনা হোসেন তিন শব্দের নামকরণের যে সমন্বয় সাধন করেছেন তাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সমান জায়গা করে দেননি। সেলিনা হোসেনের বর্ণনা আন্তরিক, জীবন্ত এবং ভীষ্ম। ভাষা সরল বাক্য তীর্যক । সর্বত্র ঔচিত্যবোধের ছাপ বর্তমান।
পুবের সূর্য :
শাহরিয়ার কবির কিশোরদের জন্য লিখিত ‘পুবের সূর্য’ উপন্যাসে ২৫ মার্চের ভয়ঙ্কর রাতের ভয়াবহ পরিবেশ, মিলিটারির নির্বিচার হত্যাকাণ্ড আর ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের রাত্রিযাপন ও সংগ্রামী মানুষের প্রতিরোধের কাহিনী বেশ দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।
স্মৃতিচারণ ভঙ্গিতে লেখা এই কাহিনীতে অনেক ক্ষেত্রেই ফ্ল্যাশব্যাক রীতি অনুসৃত। শাহরিয়ার একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র অঙ্কন করে অগ্রসর চিন্তা এবং মহৎ শিল্পী চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। অত্যাচারী পাঞ্জাবী সেনাদের জঘন্যতম অত্যাচারের পাশাপাশি চিত্রিত হয়েছে পশ্চিমা মেজর বেগের মত চরিত্র, যে বন্দুককে ভীষণভাবে ঘৃণা করে এবং অস্থির হয়ে বলে আমাদের জেনারেল যা করেছেন যা ভাবছেন সভ্যতার ইতিহাসে এর নজীর নেই। আমি জানি এসব বলা ঘোরতর অন্যায়, তবু তোমার কি মনে হয় শাস্তি থেকে বাচতে পারবেন? এ চরিত্র যেন শওকত ওসমানের ‘নেকড়ে অরণ্য’-এর শের খানের পূর্ণ ও বলিষ্ঠ সংস্করণ।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বাবু ক্যাম্পে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলো, নতুন মুখের স্বপ্ন। সব শেষে সূর্য উঠল, জ্বলন্ত ইস্পাতের গোলকের মতো টকটকে লাল সূর্য, অসম্ভব লাল সূর্য।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্যের উদয় সম্ভাবনার এই প্রতীকী ব্যঞ্জনা দিয়েই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী শেষ। ‘স্বল্প ভাষণে, সুমিত বিন্যাসে ঘটনাগুলো স্বাভাবিকতায় সংস্থাপিত এবং চরিত্রগুলোও আপনরূপে সুবিকশিত।
জীবন আমার বোন:
মাহমুদল হকের ‘জীবন আমার বোন’ উপন্যাসে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের চাইতে এখানকার তরুণদের রাজনীতি সম্পর্কে তাদের বিবেচনাহীন আবেগ এবং কয়েকটি তরুণ- তরুণীর অবদমিত যৌন ইচ্ছার কথা চিত্রিত হয়েছে। মাহমুদল হকের ভাষা এ গ্রন্থে চরিত্রানুগ, পরিবেশনা, প্রান্ত। বোকা ও তার বন্ধুদের চরিত্রের মতো মাহমুদুল হকের ভাষাও অস্থির, চঞ্চল ও দ্রুতলয়ের।
ভাষা সর্বত্র টগবগে, ঘোড়ার মত লাফিয়ে এক প্রকার দৌড়িয়ে চলেছে এ ভাষা সারা শহর ফেটে পড়েছে বারুদের মত। স্টেডিয়ামে চেয়ার তাড়াতাড়ি, দোকানপাট সব বন্ধ, রাস্তায়- রাজায় কেবল মানুষ আর মানুষ। লাঠি সোটা, লোহার রড পাইপ যে যা হাতের কাছে পেয়েছে তাই নিয়ে ছেলে বুড়ো জোয়ানে সব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে উন্মুক্তের মতো। শ্লোগান আর শ্লোগান, চতুর্দিকে ফেটে পড়েছে শ্লোগান।
এই কোলাহল এই জাগরণ- এসব কিছু অর্থহীন ভেবে বেবী টেক্সিতে চড়ে ‘বেবী সেগুনবাগিচা বলা এবং সামান একটু আস্কারা পেয়ে নীপা ভাবীর সারা বয়স দুহাতে ঘটাঘাটি করে সম্পূর্ণ তছনছ করে দেয়া খোকার কাছে বেশ সহজ।
হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে ২৭ মার্চের পরে বোন রজ্জুকে নিয়ে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠেছিল সে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে থৈ থৈ মানুষ যে যার নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। শিলাবৃষ্টির পর জ্বরে বস্তুর গা পুরে যাচ্ছিল। তারপর সেখানেই মেশিনগান আর মর্টার নিয়ে পলায়নরত ভীত সন্ত্রস্ত নরনারীর ওপর পাশবিক উল্লাসে ঝাপিয়ে পড়েছিল হিংস সেনাদল অতর্কিতে। সেদিন বাকশক্তিহীন, অসুস্থ শায়িত রঞ্জু তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার পায়ের তলায় পড়ে চ্যাপটা হয়েছিল। একা বেঁচে থাকার অধিকার তার দেশ কিছুতেই দিতে পারে না রঙ্কুকে, পরে বুঝেছিল খোকা। খোকাদের এই চৈতন্যোদয়ই পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকে তীব্র গতিদান করেছিল।
যাত্রা:
শওকত আলীর ‘যাত্রা’ ২৭ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিলের জিঞ্জিরা সৈয়দপুরের ঘটনা ধারণ করেছে। ‘যাত্রা’র প্রথমেই বুড়িগঙ্গায় ছড়োছড়ি পাড়া পড়ি করে নৌকায় ওঠা পলায়নপর জনস্রোতের ঢাকা থেকে জিঞ্জিরা হয়ে উদ্দেশ্যবিহীন ছুটে চলার মর্মান্তিক দৃশ্য বিবৃত হয়েছে। হাজার হাজার ভয়তাড়িত রাতজাগা, ক্লান্ত মানুষগুলোর একই চিন্তা এখন দূরে চলে যাওয়া। শহর থেকে শুধু চলে যাওয়া যেখানে হোক, ঠিকানাবিহীন হোক শুধু হেটে চলা। এক নদী পার হয়ে আরেক নদী। যেন বা বাংলাদেশের বুকের ভিতরে চলে যাচ্ছে মানুষ শত্রুর হাত যেন পৌঁছতে না পারে, মৃত্যুর হিংস্র খাবার বাইরে যেন চলে যাওয়া যায় ।
সেদিন পলায়নপর মানুষের কোনো সতন্ত্র পরিচিতি ছিল না, সেদিন সবাই একসঙ্গে হাটে, তারপর লীলা-মঞ্জু-সাকিনা, হাসান, বাচ্চারা বিনু, রায়হান যেন একটি পরিবার। এখানে পঙ্গু, অসুস্থ হাসানের অন্য সেবা করতো বিনু প্রফেসর পত্নী, এখানে লীলা অপেক্ষা করে হাসানের জন্য যোশেফ ফার্নান্দেজ ধরে রাখে হাসানকে, রায়হানের টাকার জন্য ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয় রাতের আধারে। পলায়নটা সেদিন সত্য ছিল, অপরিহার্য ছিল। তবু তারও মধ্যে আনিসের মতো লোকেরা দেখেছে প্রতিরোধের লক্ষণ। ‘এই অবস্থাতেই প্রতিরোধ গড়ে উঠবে কেউ চাক বা না চাক তবু প্রতিরোধ হবে।
খাঁচায় :
রশীদ হায়দারের ‘খাঁচায়’ উপন্যাসে একাত্তরের অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের যন্ত্রণার কথা উচ্চারিত হয়েছে । ডিসেম্বরেই এ বাচায় আটকে পড়া মানুষের যন্ত্রণা-উৎকণ্ঠা তীব্র হয়েছিল। আমেরিকার সেভেনথ ফ্লীট বঙ্গোপসাগরের দিকে এগিয়ে আসছে শুনে জাফরের সমস্ত অনুভূতি গুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে রাস্তার মতো হয়ে গেছে। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে আমেরিকা, বাঁচাটা আরো সংকুচিত হয়ে আসছে, খাঁচার চারপাশে উদ্ভুত মারণাস্ত্র ।
যুদ্ধ লোভকে তীব্র করেছে, ধ্বংসকে অনিবার্য করেছে, মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেছে প্রিয়জন থেকে, মানসিক সমস্ত বোধকে উৎপাটিত করতে চেষ্টা করেছে যুদ্ধ। তবু যুদ্ধ কোনো যুদ্ধই মানবতাকে ধ্বংস করছে পারে না, পারেনি। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ইশতিয়াকের কাছেও সে মানবতা মুনিরীক্ষ নয়।
রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলীওয়ালা’ তার পিতৃহৃদয়ের বৈভব নিয়ে আরেকবার রশীদ হায়দারের সামনে এসেছিল। এই দৃষ্টির সচেতনতা, এই মানবিকতা অনুসন্ধানেই শিল্পীর মহৎ গুণ। অন্যদিকে রশীদ হায়দার স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের একটি সম্ভাব্য চিত্র রচনা করেছেন কয়েকটি আচড়ে। সেই সঙ্গে শাঁচার প্রতীকী ব্যঞ্জনা যথার্থ শিল্পরূপ লাভ করে। বাঁচা বাংলাদেশ, খাঁচায় বন্ধ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ।
অন্ধ কথামালা :
রশীদ হায়দারের ‘অন্ধ কথামালা’ উপন্যাসে মৃত্যু মুহূর্তে প্রতীক্ষারত একজন মুক্তিযোদ্ধার দুর্বিসহ স্মৃতি বর্ণনায় ভয়ানুল ও কল্পনাঞ্জলে বয়নের রুদ্ধশাস আবেগতপ্ত চিত্র অঙ্কিত।
সৌরভ ও আগুনের পরশমণি : উপন্যাস দুটোতে কাহিনীগত ঐক্য আছে। সৌরভে কাদের, রফিক মুক্তযুদ্ধে ট্রেনিংয়ে যায় আগরতলায় আর আগুনের পরশমণিতে আলম, সাদেক, গৌরাঙ্গ ট্রেনিং শেষে ঢাকায় যুদ্ধ করতে আসে। যুদ্ধের সময়ে বাঙালিদের স্বাধীনতাকামী মনোভার প্রেম ও দ্রোহের নিরিখে এখানে দেখানো হয়েছে।
নির্বাসন :
হুমায়ূন আহমেদের নির্বাসন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে লিখিত। কথা ছিল জরীর সাথে আনিসের বিয়ে হবে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক বাহিনীর হাতে আনিস গুলিবিদ্ধ হলে তার নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে যায়। চিকিৎসা চলে দীর্ঘদিন। কিন্তু রোগ মুক্তির কোনো লক্ষণ নেই। একটি ধূসর বিবর্ণ রিক্ত অন্ধকার সময় আনিসকে ঘিরে ফেলে। জরীর বিয়ে হয়ে যায় অন্য ছেলের সাথে। বরযাত্রীরা তৈরি হয়েছে বিদায় নিতে। সবাই ভারীকে ধরাধরী করে উঠানে নিয়ে এলো। আনিস জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। গভীর বিষাদে আনিসের চোখে জল এল। যে জীবন কোয়েলের, দোয়েলের, ফড়িংয়ের মানুষের সাথে তার কোনো কালেই দেখা হয় না। একটি বেদনাময় অনুসরণের মধ্যে কাহিনী শেষ হয়েছে।
জোছনা ও জননীর গল্প :
‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ তিনটি কাজ করেছেন। প্রথমত, তার নিজের ভাষায় দেশমাতার ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয়ত, একটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাস লিখেছেন এবং তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করেছেন।
এ উপন্যাসের কাঠামোটি খুবই আকর্ষণীয়। গল্পটি শুরুতে নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরির। এটি নানাভাবে এগোবে। পরাধীন দেশে জুমার নামাজ হয় না, জুমার নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এই কারণে ক্যাপ্টেন রাসের তাকে নীলগঞ্জ স্কুল এবং বাজারে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থার প্রদক্ষিণ করার। বাজারে ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটল। দরজির দোকানের এক দর্জি একটা চাদর নিয়ে ছুটে এসে ইরতাজউদ্দিনকে ঢেকে দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকল। ঘটনা এতই দ্রুত ঘটল যে সঙ্গের মিলিটারিরা বাধা দেবার সময় পেল না।
ইরতাজউদ্দিন ও দরজিকে মাগরেবের নামাজের পরে সোহাগী নদীর পারে নিয়ে গুলি করা হলো। মৃত্যুর আগে ইরতাজউদ্দিন পরম নির্ভরতার সঙ্গে আল্লাহপাকের কাছে উঁচু গলায় শেষ প্রার্থনা করল।
পরদিন নীলগঞ্জ স্কুলের হেড মাস্টার মনসুর সাহেব ও তার পাগল স্ত্রী আনিয়া ইরতাজউদ্দিনের লাশ টেনে আনার সময় বেলুচ রেজিমেন্টের সেপাই আসলাম খা তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। আসলাম চরিত্রটির মাধ্যমে লেখক বুঝিয়েছেন পাকিস্তান আর্মিতেও দুএকজন হৃদয়বান লোক ছিল।
এ উপন্যাসে চরিত্র হয়ে এসেছেন মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, টিক্কা খান অর্থাৎ সেই সময়কার সব শ্রদ্ধেয় ও নিন্দিত মানুষজন। ভারতীয় বাহিনীর চরিত্ররা এসেছে যে যার ভূমিকায়। মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে, রাজাকাররা এসেছে। শসীনার পীর সাহেব এসেছেন আর এসেছে সমগ্র দেশের নানান্তরের নানারকম মানুষ ।
বিভিন্ন স্মরণীয় উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে। বিভিন্ন চরিত্র, বিভিন্ন ঘটনার কথা বলা হয়েছে। শাহেদ, আসমানী, জোহর, মোবারক, গৌরাঙ্গ, নাইমুল, মরিয়ম, শাহ কলিম, রুনি, বি হ্যাগি স্যার, ধীরেন্দ্র রায় চৌধুরী, কংকন। আর অতি ছোট হারুন মাঝি। সে ছিল একজন ডাকাত। একটি উত্তাল সময় কিভাবে দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল স্বাধীনতার দিকে, কিভাবে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিল মানুষ এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়নো আছে সেই কথা।
তমস ও প্রতিমা উপাখ্যান :
মার্কসবাদী লেখক বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তিযুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।
উপসংহার :
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমলিন অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে সংঘটিত হলেও স্বাধীনতার আকুতি বাঙালির মনে দীর্ঘদিন ধরে লালিত। বাংলাদেশের অনেক ঔপন্যাসিক তাদের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে দেন। প্রায় প্রত্যেক লেখকের দৃষ্টিতে অসম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ জাত সত্তার উপরে এক বাংলাদেশী জাতিসত্তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে এখনও মনে রাখার মতো কোনো অমরগ্রন্থ রচিত হয়নি। আমরা অনাগত সেই উপন্যাসের অপেক্ষায় আছি।
আরও দেখুন: