মুক্তিসংগ্রাম ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের এক অনিবার্য বাস্তবতা। পাক হানাদার শাসকগোষ্ঠী ইসলামের নাম ভাঙিয়ে দীর্ঘদিন ধরে (১৯৪৭-৭১) বাংলার শান্তিপ্রিয় ধর্মভীরু মানুষের ওপর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে সীমাহীন অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন ও দমননীতি চালিয়ে আসছিল, তারই যবনিকাপাত ঘটে ইতিহাসের এই দিনটিতে।
Table of Contents
মুক্তিসংগ্রাম ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহের সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে ৯৭% এবং পূর্ব অংশে ৮০% ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিল। তাই আশা করা হয়েছিল, ইসলাম শুধু উভয় অংশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কই জোরদার করবে না, বরং একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই এই আশা ভুল প্রমাণিত হতে থাকে।
সাংস্কৃতিক বিরোধ ও পাক শাসন বিরোধী আন্দোলনঃ
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ ভাগের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। তাই সঙ্গত কারণেই আশা করা হয়েছিল, বাংলা হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানে সাধারণভাবে ব্যবহৃত ৬ ভাগ জনগণের মাতৃভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়।
বাঙালি জাতির উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি ছিল না। তবে তারা চেয়েছিল উর্দুর পাশাপাশি সিংহভাগ জনগণের ভাষা বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেতে। কিন্তু তা না করে বাঙালি জাতিকে আন্দোলনের মুখে ঠেলে দেয়া হয়। সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। যে কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে একটা রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকে তা-ই প্রমাণিত হয় পরবর্তী কালের ঘটনা প্রবাহে।
১৯৪৭-এ শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন ‘৫২-তে শহীদ হওয়া বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের রক্তে স্নাত হয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল। কিন্তু বাঙালি জাতিকে পাক হানাদারদের গোলামির জিঞ্জির ভাঙ্গতে প্রয়োজন হয়েছিল ‘৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ‘৬২-এর উত্তুঙ্গ শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬-এর ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলার বিরুদ্ধে সমুদ্র গর্জন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ এবং সর্বোপরি ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এই দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় বাংলার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের বিভেদ ঘুচে গিয়েছিল এবং ধর্মনিরপেক্ষতা পরিণত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনায় ।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের জয়লাভ :
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বীজ মূলত ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যেই নিহিত ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর থেকে পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলন থেকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির অসাধারণ বিজয় এ কথাই প্রমাণ করে যে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে ভাষা আন্দোলন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক সোপান রচনা করে এবং বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার পথে ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ লাভ করে ।
‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতনের পর সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে ১৯৭০ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। এই নির্বাচনই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রাথমিক পদক্ষেপ।
‘৭০-এর ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়। তবে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে কয়েকটি আসনে ‘৭১-এর ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে।
পূর্ব বাংলায় ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮২টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। ফলে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ নির্বাচনে জনগণ ছয় দফার প্রতি ম্যান্ডেট দান করে এবং বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো স্বশাসন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করে। দেশের বাইরে বিশ্ব জনমত সংহত করার ক্ষেত্রেও ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়ে ওঠে এক সুস্পষ্ট মাইলফলক।
নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি :
নির্বাচনের ফলাফলে অসন্তুষ্ট ইয়াহিয়া খান গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার জন্য পরামর্শ দেন। ইয়াহিয়া খান সংখ্যালধিষ্ঠ পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথানুযায়ী ৩ মার্চ অধিবেশন ডাকেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে তা ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়।
এ অবস্থায় সর্বস্তরের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপায়ন্তর না দেখে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় ৪ দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো হলো :
১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
২. অবিলম্বে সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
৩. সামরিক বাহিনীর হাতে প্রাণহানির তদন্ত করতে হবে।
৪. অধিবেশনের পূর্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা :
নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল বিধিসম্মত। অথচ সেই বৈধ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করে পুরনো পদ্ধতিতে সামরিক ও স্বৈরশাসন অব্যাহত রাখা হয়। ফলে পাকিস্তানে বৈধতার সঙ্কট (Legitimacy Crisis) দেখা দেয়।
পাকিস্তানের সংবিধান রচনা, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতকরণ এবং অন্যান্য যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে জেনারেল ইয়াহিয়া মুজিবের সাথে আলোচনায় বাধ্য ছিলেন। কিন্তু তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে অবজ্ঞা করে পিপলস পার্টির নেতার সাথে আলোচনা করে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেন। এই অবস্থায় জেনারেল ইয়াহিয়া গণবিচ্ছিন্ন হতে থাকেন এবং আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতির মুক্তির প্রতীকে পরিণত হয়। ফলে নির্বাচনোত্তর আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা।
কারণ নির্বাচন পূর্বে আন্দোলন হয়েছিল রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে, কিন্তু নির্বাচনোত্তর আন্দোলন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃত্বে। ফলে ‘৭০-এর নির্বাচন আওয়ামী লীগকে দেয় নেতৃত্বের আসন, যা মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের বৈধতা দান করে, বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ব্যাপক সমর্থনের মূলেও নির্বাচনের ফলাফল যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে ।
স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ :
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো’— এ দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার পর ইয়াহিয়া খান আন্দোলনকে দমন করার জন্য পূর্ব বাংলার গভর্নর হিসেবে জেনারেল টিক্কা খানকে পাঠান এবং ১৫ মার্চ আরো এক দফা শাসনতান্ত্রিক আলোচনার জন্য ঢাকা আসেন, ক্ষমতা ভাগাভাগি প্রশ্নে ১৬ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ আলোচনার ব্যবস্থা করেন। আসলে গোটা আলোচনাপর্বটাই ছিল ইয়াহিয়া খানের ছলনা।
মূল উদ্দেশ্য ছিল আলোচনার অন্তরালে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা। সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ইয়াহিয়ার উক্ত প্রহসনের আলোচনাকে ‘বিশ শতকের সর্বাধিক জঘন্যতম প্রবঞ্চনা’ বলে আখ্যায়িত করেন। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিকল্পিতভাবে তার সশস্ত্র বাহিনীকে এ দেশের ঘুমন্ত নর-নারী ও শিশুদের ওপর পৈশাচিক কায়দায় হত্যাকাণ্ড চালাবার এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়ে মধ্যরাতে ঢাকা ত্যাগ করেন।
গ্রেফতার হওয়ার আগে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর সম্মিলিতভাবে বাঙালির পক্ষে পাক বাহিনীর গণহত্যা প্রতিরোধের সূচনা ঘটে। বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বাহিনী গঠনের মাধ্যমে সংগঠিত রূপ লাভ করে। এরপর পাক বাহিনীর গণহত্যা যতো বাড়তে থাকে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ স্পৃহাও ততো গুণ বেড়ে যায় ।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকার:
যুদ্ধরত স্বাধীন বাংলাদেশকে পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্য ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে সংগঠিত ও সুপরিকল্পিতভাবে শুরু হয় মুক্তিসংগ্রাম ।
পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা :
২৫ মার্চ ‘৭১ মধ্যরাত থেকে পাক হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমগ্র বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতার ওপর পৈশাচিক কায়দায় গণহত্যার সূচনা ঘটায়। এই হত্যাকাণ্ড পরবর্তী দিনগুলোতে আরো ভয়াবহ রূপ লাভ করে।
এই পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের নির্দেশিত রূপরেখা অনুযায়ী স্থানীয় পর্যায়ে ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধের সূচনা হয়। পাশাপাশি সেনা, রাইফেলস, পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মেজর জিয়াউর রহমানের বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা। ফলে সম্মিলিতভাবে বাঙালির প্রতিরোধের সূচনা ঘটে।
পাক বাহিনীর গণহত্যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ফলেই বাঙালি জাতির একাংশ এর আগ পর্যন্ত স্বাধীনতার ব্যাপারে বিধামিত থাকলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বাহিনী গঠনের মাধ্যমে সংগঠিত রূপ লাভ করে। এর পরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা যতো বাড়তে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ স্পৃহাও ততো গুণ বেড়ে যায় ।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারত বিপুলসংখ্যক বাঙালি শরণার্থীদের আশ্রয় দান, তাদের ভরণপোষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ, বহির্বিশ্বে এবং জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ সারাবিশ্বকে প্রভাবিত করে।
তৎকালীন বৃহৎ পরাশক্তি সোভিয়েত রাশিয়া যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাঙালিদের পক্ষ অবলম্বন করে। যুদ্ধের শেষ দিকে জাতিসংঘ ভারতের পক্ষে ভূমিকা রেখে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বী দেশগুলোও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে থাকে। স্বয়ং পাকিস্তানের প্রধান সমর্থনকারী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও প্রকাশ্যে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ নিষিদ্ধ করে দেয় ।
অভ্যন্তরীণ দিক থেকে গেরিলা যোদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতা এবং সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানিদের বিচ্ছিন্ন করে তোলে। এদিকে মে ১৯৭১ বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে একটি টিম প্রেরণ করে । এই টিমের রিপোর্টের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক গণহত্যা বন্ধ এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত অনুদান পাঠানো স্থগিত করে। ফলে পাকিস্তানের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীলদের চাপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রও পাকিস্তানের জন্য পূর্ব বরাদ্দকৃত আর্থিক সাহায্য স্থগিত করে। ফলে পাকিস্তানে আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়। এদিকে আগস্ট থেকে নৌপথে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক জাহাজ ডুবির ফলে নৌবন্দর দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও গেরিলা বাহিনীর দ্বারা যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপর্যয়ের ফলে জরুরি অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
কৌশলগত এ সমস্যার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানিদের জন্য একমাত্র খোলা থাকে আকাশ পথ। কিন্তু ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচলের নিষেধাজ্ঞার ফলে সে পথও বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয়ভাবে বাঙালিরাও খাদ্য ও রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় অনেক জায়গায় পাকিস্তানিরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে ডিসেম্বরে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই অনেক পাকিস্তানি সৈন্য গ্রাম-গঞ্জ থেকে পালিয়ে শহরে আশ্রয় নেয়।
এদিকে পাকিস্তান ও ভারত পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে উভয় রণাঙ্গনে ভারতের ব্যাপক বিমান হামলা পাকিস্তানি বাহিনীকে চরমভাবে পর্যদুস্ত করে তোলে। ফলে ভারতের সাথে মাত্র ১৩ দিনের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
উপসংহার :
বস্তুত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় ছিল অবধারিত। কেননা এ যুদ্ধ ছিল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের, শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের এবং অস্ত্রের বিরুদ্ধে আবেগের। এ যুদ্ধ থেকে পিছু ফেরা মানেই ছিল দাসত্বের শৃঙ্খল পরা, বাঙালি জাতিসত্তা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হওয়া । তাই যে কোনো মূল্যে বাঙালি জাতিকে বিজয় অর্জন করতেই হতো । বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না। যে কারণে দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাঙালি জাতি অর্জন করে বহুল আকাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশার চূড়ান্ত বিজয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
আরও দেখুনঃ