Site icon Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু যৌতুক প্রথা রচনা

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু যৌতুক প্রথা রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও সকল ক্ষেত্রেই নারীরা বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার। নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, পাচার, বহুবিবাহ ইত্যাদি অন্যতম।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু যৌতুক প্রথা

নারীরা তাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অধিকার ও সুযোগ সুবিধা থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। ঘরে যেমন নারীর স্বাধীনতা নেই, তেমনি বাইরে তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে যৌতুক বর্তমানে সর্বাধিক পরিচিত। যৌতুক একটি সামাজিক প্রথা।

এ প্রথা বহুদিন ধরে সমাজজীবনে কুপ্রথা হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। কেননা, ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে যেসব রীতিনীতি সমাজে বহুদিন ধরে অস্তিত্ব বজায় রেখাও তার মধ্যে যৌতুক প্রথা বিশেষ অগ্রগণ্য। এ অমানবিক প্রথা মানুষকে অবমূল্যায়ন করছে, বৃদ্ধি করছে সামাজিক সমস্যা, নিয়ে আসছে মানবজীবনে চরম দুঃখ-দুর্দশা ও হতাশা।

যৌতুকের বলি হিসেবে প্রতিনিয়ত সংবাদপত্রে যে খবর প্রকাশিত হয়, তা নিষ্ঠুর মানুষের নির্মম কাজেরই পরিচায়ক আধুনিক সভ্যতার বুকে ক্ষতচিত্তের মতো বিরাজ করছে এ যৌতুক প্রবণতা, যার শিকড় আমাদের সামাজিক ইতিহাসের সুগভীর অন্ধকারে প্রোথিত। ফলে সামাজিক আইনের আশ্রয়ে এর নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণে সমাজকে বাধ্য হতে হয়েছে।

 

 

যৌতুকের ঐতিহাসিক সংজ্ঞার্থ নিরূপণ :

যৌতুকের সংজ্ঞার্থ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, বিয়ের সময় কনে যে সম্পদ বা সম্পত্তি নিয়ে আসে বা তাকে দিয়ে দেয়া হয় বা বিয়েতে প্রাপ্ত স্ত্রীধন হচ্ছে যৌতুক। অর্থাৎ মেয়ের বিয়ের সময় অভিভাবক বরপক্ষকে যে অর্থ সম্পদ, অলঙ্কার বা আসবাবপত্র দেয়ার অঙ্গীকার। করে, তাই যৌতুক। মেয়ের কোনো অযোগ্যতা তাকে পুষিয়ে দেয়া হয় যৌতুকের মাধ্যমে। আবার কখনও ছেলে তার অতিযোগ্যতা বা দুষ্প্রাপ্যতাকে যৌতুকের বাটখারায় বিক্রয় করে অথবা স্রেফ লালসার কারণে বরপক্ষ যৌতুকের দাবি করে বসে। যে কারণেই যৌতুকের আদান-প্রদান হোক পরিণাম এর একটিই ‘গৃহদাহ’।

১৯৮০ সালে প্রচলিত যৌতুক আইন অনুসারে যৌতুক বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষকে অথবা বিবাহের কোনো এক পক্ষের পিতামাতা বা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোনো পক্ষকে বিবাহ মজলিসে বা বিবাহের পূর্বে বা পরে যে কোনো সময় বিবাহের পণরূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদত্ত বা প্রদানের অঙ্গীকারবদ্ধ যে কোনো সম্পত্তি এবং মূল্যবান জামানতকে বোঝায়। এক্ষেত্রে প্রদেয়। দেনমোহর বা মোহরানা এর অন্তর্ভুক্ত হবে না ।

নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ অনুসারে যৌতুকের অর্থ হলো কোনো বিবাহের কনেপক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা বরপক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উক্ত বিবাহের সময় বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে বিবাহের পণ হিসেবে প্রদত্ত অথবা প্রদানে সমর্থ অর্থ, সামগ্রিক সম্পদ এবং উক্ত বর বা বরের পিতামাতা বা বরপক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কনে বা কনেপক্ষের কোনো ব্যক্তির নিকট দাবিকৃত অর্থ সামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ। বলা যায়, যৌতুক প্রথা এমন একটি রীতি যার মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হওয়া বা টিকে থাকার জন্য বর বা কনেপক্ষ স্বেচ্ছায় বা চাপে পড়ে অপরপক্ষকে অর্থ-সম্পদ দিয়ে থাকে বা দিতে সম্মত হয়।

 

 

যৌতুকের ঐতিহাসিক পটভূমি :

অতি প্রাচীনকাল থেকেই যৌতুকের প্রচলন ছিল। প্রাচীন সাহিত্যে যৌতুক প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায়। অথর্ববেদে রাজবধূদের শতগাড়ী নিয়ে আসার বিবরণ লিপিবন্ধ রয়েছে। কন্যাপণ হিসেবে শতগাভী ও একটি রথ দেয়ার রীতিও প্রচলিত ছিল। মহাভারতে অসুর বিয়েতে কন্যাপণের কথা রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, প্রাচীনকালে যৌতুক হিসেবে কন্যাপণ প্রথার প্রচলন ছিল। এ পণ প্রথা থেকেই ধীরে ধীরে বরপণ প্রথার প্রচলন ঘটে। নৃবিজ্ঞানে যৌতুক প্রথার উদ্ভব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। আদিম সমাজে কন্যা ক্রশ্নরীতির যে প্রচলন লক্ষ্য করা যায়, তা- ই পরিবার প্রতিষ্ঠা ও যৌতুক প্রথার উদ্ভবকে ত্বরান্বিত করেছে।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, প্রাচীনকালে যৌতুক বা উপহার দান প্রথা আদিম অর্থনীতির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। সে সময় কোনো বাড়িতে কোনো অতিথি এলে যৌতুক দেয়া হতো। বিনিময়ে অতিধি কিছু উপঢৌকন দিতেন। প্রাচীন রোম ও গ্রিসসহ মধ্যযুগে অনেক দেশেই যৌতুক দেয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। তখন বিভিন্ন সমাজে দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে সন্ধি কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য মেয়ের বিয়ে দেয়া হতো। বিয়েতে কন্যা এবং অর্ধেক রাজত্ব দানের রীতি প্রচলিত ছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতীয় সমাজে রত্নালংকার, দাস-দাসী, গরু, মহিষ, হাতি প্রভৃতি যৌতুক দেয়ার প্রথা ছিল ।

দীনেশচন্দ্র সেন কর্তৃত সংগৃহীত ময়মনসিংহ গীতিকায় দেওয়ানা-মদিনা এবং বিভিন্ন পুঁথি সাহিত্যে তার প্রমাণ মেলে। হিন্দু সমাজ থেকে অন্যান্য রীতিনীতির মতো যৌতুক প্রথার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। বিয়েকে মুসলিম সমাজে সব সময় দু’পক্ষের সম্মতিতে সম্পাদিত চুক্তির বলে ভাবা হয়েছে। খ্রিস্টান কিংবা হিন্দুদের বিয়ে যেমন পবিত্র ব্রতস্বরূপ, মুসলমানদের তা নয়। শুধু দু’পক্ষের সম্মতি নয়, মুসলিম বিয়ের অন্যতম শর্ত হলো ‘মোহর’ বা ‘কন্যাপণ’।

মোহর বলতে বোঝায় বিয়ের সময় বর কর্তৃক কনের ওপর ধার্যকৃত অর্থের পরিমাণ। প্রথাটি ইসলাম বা পূর্ব আরব দেশীয় । অতীতে বরকে যৌতুক দেয়ার প্রশ্নই ছিল না। যদিও ধনীগৃহের মেয়েরা বিপুল গয়নাগাটি এবং তাদের বররা দামি উপঢৌকন লাভ করতো। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু সমাজের মেয়েরা স্বামীর ঘরে যাওয়ার পর পিতার সম্পত্তিতে অধিকার হারায়।

ফলে সান্ত্বনাস্বরূপ বিয়ের সময় পিতা মেয়েকে অলঙ্কার, ধনসম্পদ, আসবাবপত্র প্রভৃতি দিয়ে থাকে, যাতে কন্যার গুরুত্ব কিছুটা বৃদ্ধি পায়। আর তখন থেকে বুদ্ধিমান বরপক্ষ নিজের মূল্য ও গুরুত্বকে চিরকাল কন্যার গুরুত্বের চেয়ে বেশি বলে প্রচার করেছে। ফলে যৌতুক প্রথা হয়েছে স্থায়ী ব্যবস্থা এবং পরবর্তীতে মুসলমান সমাজও এর সুফল ভোগের উদ্দেশ্যে এটিকে গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত প্রথা হিসেবে মোহর ধার্য হয় বটে, তবে তা ঐ প্রধার প্রতি পরিহাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। কনের পরিবারের কাছ থেকে অর্থ এবং যৌতুক সামগ্রী দাবি করা এখন সমাজের সর্বস্তরেই একটি সাধারণ ঘটনা।

 

 

যৌতুকের বৈশিষ্ট্য :

কন্যার বিয়ের সময় তার অভিভাবক কর্তৃক বরকে যে কোনো দ্রব্যসামগ্রী বা টাকা পয়সা দেয়াই হলো যৌতুক। এটি বরের হীনমন্যতা ও আমাদের সামাজিক কুসংস্কারের একটি ফসল।

সুযোগ্য পাত্রে কন্যাকে পাত্রস্থ করার জন্য পাত্রপক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে অথবা কন্যাপক্ষের আগ্রহের আতিশয্যে যা কিছু উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়, তা যে নামেই আখ্যায়িত হোক না কেন তা যৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয় । মেয়ের সুখের জন্য পিতামাতার কল্যাণ কামনা যৌতুকের রূপ ধারণ করে বরের বাড়িতে উপস্থিত হয় । যৌতুকের ভার যত বেশি কন্যার সমাদরও তত বেশি হবে এমন একটা প্রত্যাশা পিতামাতাকে উদ্দীপ্ত করে। কিন্তু সবক্ষেত্রেই এ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মিলন ঘটে না। তখন যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়ে তার রাহুগ্রাস সমাজ জীবনকে কলুষিত করে তোলে।

 

 

যৌতুকের কারণ :

বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের পিছনে ক্রিয়াশীল কারণগুলোর অন্যতম হচ্ছে যৌতুক। এ প্রথার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন কারণ জড়িত। এগুলোর মধ্যে সামাজিক কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস, সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা লাভের মোহ, দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, উচ্চাভিলাসী জীবনযাপনের বাসনা, পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের নিম্ন আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বা প্রতিশ্রুতিশীল জামাই পেতে মেয়ের বাবারা বিস্তর টাকা পয়সা ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকে।

শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রসর নারীর মূল্য নির্ধারণ করা হয় যৌতুকের মাধ্যমে। যোগ্যতা যেমন পাত্রকে উচ্চ আসনে বসায় তেমনি অর্থবিত্ত সমৃদ্ধ পিতার অযোগ্য কণ্যাকে সুযোগ্য পাত্রে পাত্রস্থ করার স্বপ্ন থাকে। সম্পদ সমৃদ্ধ শশুর যেমন জামাতা ক্রয় করতে চান, তেমনি অর্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনায় বরও উদ্দীপ্ত হয়। ফলে যৌতুক প্রথাতে পাত্র ও পাত্রীর পক্ষের মিলনবন্ধন ঘটে।

হিন্দু সমাজের উত্তরাধিকার আইনে মেয়েরা পিতৃসম্পদের দাবিদার নয় বলে যা দেয়ার তা বিয়ের সময়ই লাভ করার সুযোগ থাকে। যৌতুক সেখানে যথার্থই প্রতিষ্ঠিত। মুসলমান সমাজে মেয়েরা সম্পদের উত্তরাধিকারী হলেও অতিরিক্ত পাওনার মতো যৌতুক সেখানে স্থান করে নিয়েছে। সামাজিক রেওয়াজ, নির্লজ্জ ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি, হীনমন্যতা, নৈতিক অধঃপতন ইত্যাদি যৌতুকের মূল কারণ।

 

বর্তমান যৌতুক প্রবণতা :

বাংলাদেশে আজকাল যৌতুকের পরিবর্তে ডিমান্ড কথাটি বেশি প্রচলিত। একে আবদার, খুশি করা, সাজিয়ে দেয়াও বলা হয়। এ সামাজিক কু-প্রথা এখন আমাদের সমাজে একেবারে শিকড় গেড়ে বসেছে। আমাদের দেশে গত দেড় দশক আগেও যৌতুক বলতে সাধারণত বোঝাত মেয়ে-জামাইকে বিয়েতে কিছু টাকা, খাট-বিছানা, গহনা দিয়ে মেয়েকে সাজিয়ে দেয়া । এখন এগুলো তো আছেই, টিভি, ফ্রিজ, মোটর সাইকেল ইত্যাদি চাওয়াও স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

উচ্চবিত্তদের চাহিদা আরও ব্যাপক। নিম্নবিত্ত বেকার যুবকেরা চাকরি, বিদেশে যাওয়ার খরচ, ভবিষ্যৎ সংসার জীবনের অনেক কিছুই যৌতুক হিসেবে আদায় করে। পাত্রী অভিভাবকদের সামর্থ্য বিচার এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না। যৌতুক যারা দেয়, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য মেয়েকে খুশি করা। আর যারা নেয়, তাদের লক্ষ্য হলো বিনাশ্রমে কিছু পয়সাকড়ি হাতিয়ে নেয়া। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারেও এ প্রবণতা দিনের পর দিন প্রকট হয়ে উঠছে।

 

যৌতুকের প্রভাব বা পরিণাম :

বাংলাদেশের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জনজীবনে যৌতুক প্রথা ও নারী নির্যাতন এক অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এ সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করার ক্ষেত্রে মূল কারণ যৌতুক প্রথা। যৌতুকের বাড়াবাড়ি এতোই ব্যাপক যে, এর ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ, বধূহত্যা, আত্মহত্যার মতো তীব্র সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যৌতুকের টাকা না পেয়ে স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই মিলে গৃহবধূর ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। তাদের এ ক্যাঘাতে অনেক সময় গৃহবধূ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

আমাদের দেশে এ প্রবণতা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজে যৌতুক প্রথা থাকার ফলে তা ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করছে । পুরুষশাসিত সমাজে বরপক্ষ মনে করে যৌতুক তার ন্যায্য পাওনা এবং স্বীকৃত শর্তের তিল পরিমাণ পূরণ না হলে কন্যাকে বিষাদের জ্বালা ভোগ করতে হয়। নীরবে, নিভৃতে সবধরনের অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া আর কোনো গত্যান্তর থাকে না।

মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক সময় সে বাধ্য হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। অসহায় পিতামাতা মেয়ের সুখ শান্তির জন্য অনেক সময় সবকিছু বিলিয়ে দেয়। কিন্তু তাতেও বরপক্ষের মন জুটে না। কন্যাটিকে কিভাবে তাড়ানো যায়, এমনকি পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায়ের ঘনঘটাও কন্যার ললাট লিখন হয়। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধিষ্ণু যৌতুক প্রবণতা আমাদের সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

 

 

নারী বিষয়ক আইন ও এর প্রয়োগ :

বিশ্ব যখন অবাধ গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে, নারীরা যখন প্রশাসন, নীতিনির্ধারক, পরিকল্পনাবিদ, বৈমানিক, সৈনিক, প্রকৌশলী, আইনজীবী হচ্ছে তখন আমাদের দেশের নারী সমাজ বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। আজও তারা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। উন্নয়ন সফলতা নির্ভর করে মূলত নারী পুরুষের সমান অংশীদারিত্বের ওপর। নারী অধিকার রক্ষায় আমাদের সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় সংযোজন করা হয়েছে নিম্নোক্ত নীতি ও কৌশল ।

নারীর এ সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়
গ্রহণ করেছে জাতীয় উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণের পরিকল্পনা, যার অধীনে রয়েছে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, নারী উন্নয়নে জাতীয় পরিকল্পনা প্রভৃতি ।

পারিবারিক জীবন গঠন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা অবহেলার নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীদের সামাজিক অবস্থান ও তাদের পারিবারিক পরিস্থিতির বাস্তবে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি । ক্ষেত্রবিশেষ তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের ওপর সকল প্রকার নির্যাতন রোধের উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন আইন। যেমন- বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯, মুসলিম বিবাহভঙ্গ আইন-১৯৩৯, মুসলিম পারিবারিক আইন-১৯৬১, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজি.) আইন-১৯৭৪, যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০, নারী নির্যাতন আইন-১৯৮৩, পারিবারিক আদালত-১৯৮৫ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০।

আইনগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে মূলত নারী সমাজের নিরাপত্তা ও তাদের অধিকার রক্ষার জন্য। ১৯৮০ লালের যৌতুক বিরোধী আইনে যৌতুক প্রদান ও গ্রহণকে শাস্তিযোগ্য ঘোষণা করা হয় ।

পরবর্তীকালে এ আইনের আরও সংস্কার করে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, বিয়ের পূর্বে কিংবা পরে যে কোনো সময় বর বা কনেপক্ষের কাছ থেকে দেনমোহর ব্যতীত প্রত্যক্ষভাবে কোনো সুবিধা ভোগ করলে তা যৌতুক বলে গণ্য হবে এবং এ আইনের আওতায় যৌতুক দাবি বা গ্রহণের জন্য কোনো ব্যক্তি সর্বাধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়বিধ দণ্ড ভোগ করবে। যৌতুকের জন্য নির্যাতন বা হত্যা করলে তার সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌতুকের শান্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে

ধারা-১১.

যদি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতামাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য উক্ত নারীর মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন, উক্ত নারীকে, স্বামীর পিতামাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা ব্যক্তি (ক) মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদণ্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উভয় ক্ষেত্রে উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত দণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

(খ) আহত করার জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা আহত করার জন্য অনধিক চৌদ্দ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উভয় ক্ষেত্রে উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন ।

শুধু আইন দিয়ে এ সামাজিক যৌতুকের বিনাশ করা সম্ভব নয়। যৌতুক যারা দেয় এবং নেয় প্রয়োজন তাদের মানসিকতার পরিবর্তন করা। যৌতুক দেয়া ও নেয়া যে জঘন্য ও অপছন্দনীয় কাজ, সমাজ সংসারে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণার কোনো বিকল্প নেই।

 

 

ধর্মীয় দৃষ্টিতে যৌতুক :

যৌতুক সামাজিকভাবে ক্ষতিকর বলেই আইনের দৃষ্টিতে তা দণ্ডনীয় অপরাধ এবং একই সঙ্গে ইসলামে নিষিদ্ধ বা হারাম হিসেবে বিবেচিত। যৌতুক প্রসঙ্গে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে দুটি বিষয় বিবেচ্য। প্রথমত, এটি একটি অর্থনৈতিক লেনদেন এবং দ্বিতীয়ত, এটি বৈবাহিক চুক্তি। অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের নীতিমালা হলো তা অবৈধভাবে বা অনির্ধারিত পথে অর্জন করা চলবে না। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘তোমরা একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’ (সুরা বাকারা ১৮৮)

সুতরাং অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা একেবারে পরিষ্কার। আর তা হলো অন্যায়ভাবে বা যা প্রাপ্য নয় তা কোনোক্রমেই গ্রহণ করা বা দাবি করা যাবে না। যদি তা করা হয়। তাহলে তাকে সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে পবিত্র কুরআনে চিহ্নিত করা হয়েছে৷

দ্বিতীয়ত, বৈবাহিক বিষয়ে লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হলো স্বামীরাই স্ত্রীকে মোহর বাবদ কিছু সম্পদ প্রদান করবে। সুতরাং শরীয়তের দৃষ্টিতে মোহর প্রদান স্বামীর অন্যতম দায়িত্ব এবং তা স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ অধিকার । এমনকি স্ত্রীকে প্রদত্ত মোহর ফেরত নেয়ার কোনো সুযোগও স্বামীর জন্য নেই। বরং এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণের সংকল্প কর এবং তাহাদের একজনকে অগাধ অর্থ দিয়ে থাক তবুও তা হতে কিছুই প্রতিগ্রহণ করো না। (সূরা সিনা, ২০)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে আর্থিক লেনদেন সবসময় মেয়েরাই লাভবান হওয়ার কথা। বিয়েতে পুরুষদের শুধু দায়ভার গ্রহণ করতে হয়। এর বিনিময়ে কোনোভাবেই লাভবান হওয়ার সুযোগ তাদের নেই। সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, যৌতুকের অর্থ সম্পদ দাবি বা তা আদায় ইসলামের দৃষ্টিতে পরিষ্কার অবৈধ বা হারাম। আর এ দাবিতে জোর জবরদস্তি করা শুধু অর্থনৈতিক অপরাধ নয়, বরং তা দণ্ডবিধির আওতাভুক্ত অপরাধও বটে। সুতরাং কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমান কোনোক্রমেই যৌতুকের দাবি করতে পারেন না।

 

যৌতুক নিবারণের উপায় :

যৌতুক একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। এর বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত অবস্থান গ্রহণ প্রয়োজন । যৌতুক প্রথার সপক্ষে কোনো যুক্তিই গ্রাহ্য নয়। যৌতুকদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের প্রয়োগের মাধ্যমেই সমাজ থেকে এ ব্যাধিটি নির্মূল সম্ভব। শুধু আইন প্রয়োগ করে এ কুপ্রথার বিলোপসাধন সম্ভব নয়।

পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, আইনের কঠোর প্রয়োগ, নারীর শিক্ষা ও মর্যাদা দান, সামাজিক প্রতিরোধ এসব কিছুই কার্যকর করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ যাবৎকালে বাংলাদেশের নারী সমাজের জন্য যেসব আইন গৃহীত হয়েছে সেসব আইনের সাথে নারী সমাজকে সম্পৃক্ত করার জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর কোনোটিই পরিপূর্ণভাবে সফল হতে পারেনি। এর জন্য একক কোনো কারণ দায়ী নয়।

এক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কর্তৃত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন অনিয়ম ও নীতিহীনতা। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নারী সমাজের অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও ক্ষমতাহীনতা, রয়েছে আইনের ব্যাপক ভিত্তিক প্রচারের অভাব, আইন প্রয়োগকারীদের উদাসীনতা, উচ্চ মহলের অবৈধ হস্তক্ষেপ। ফলে দিন দিন বেড়ে চলেছে যৌতুক প্রবণতা।

যৌতুকের প্রকৃতি, কারণ, প্রভাব ও পাশাপাশি যৌতুক বিরোধী আইনের কার্যকারিতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানার উদ্দেশ্যে তাই প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাস্তব তথ্য সংগ্রহ করা। পরবর্তীতে নীতিনির্ধারকরা ও পরিকল্পনাবিদরা যাতে এর ওপর ভিত্তি করে যৌতুক সম্পর্কিত আইনের বিধির প্রয়োগিকতা কতখানি তা অনুধাবন করে তাদের কার্যপরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন ।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপসংহার

যৌতুকের জগদ্দল পাথরের নিচে বাংলাদেশের হতভাগ্য নারী ও দুর্ভাগা অভিভাবকগণ প্রতিনিয়তই নিষ্পেষিত হচ্ছেন। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, নির্ভরশীলতা, অসচেতনতা, দুর্বল আইনি কাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব প্রভৃতি কারণেই নারীরা যৌতুকের শিকার হচ্ছেন। যৌতুক প্রথা মানবাধিকার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। যৌতুক হবার প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য গবেষণানির্ভর ও বাস্তব তথ্যভিত্তিক আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

 

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version