সাংবাদিকতায় নৈতিকতা ও বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে। সাংবাদিকতা বর্তমান সময়ে একটি মহৎ পেশা। আধুনিক সভ্যতার একটি চরম অবদান সংবাদপত্র। আর সংবাদপত্র সম্পাদনা নিঃসন্দেহে একটি মহৎ কাজ।
Table of Contents
সাংবাদিকতায় নৈতিকতা ও বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম
প্রাচীনকালে মানুষ যোগাযোগ প্রক্রিয়াকে শ্রদ্ধা ও ভয়ের চোখে দেখত। আদিতে ছিল কথা- In the beginning was the word. কিন্তু কালের বিবর্তন এবং যান্ত্রিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার ফলে বর্তমানে ‘কথা’র চেয়ে লিখিত রেকর্ড বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমনই একটি লিখিত রেকর্ড হলো সংবাদপত্র। আর যিনি সংবাদ সংশ্লিষ্ট কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি সাংবাদিক সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জপূর্ণ কাজ। এখানে থাকতে হবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ।
বিভিন্ন প্রলোভনে না ভুলে সকল সময় সঠিক তথ্য নির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। ভালো প্রচার মানেই দ্রুত গতিশীল, চিত্তাকর্ষক ও শ্রুতিমধুর সংবাদ পরিবেশনা। তা তথ্যবহুল ও পক্ষপাতহীন। পরিবেশনা হবে সুষ্ঠু, কারিগরী বাধামুক্ত। তাকে কখনোই কল্পনাবিলাসী, একঘেঁয়ে মনে হবে না।
কিন্তু বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতা পেশা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে তুমুল আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। এর মূলে রয়েছে পেশাগত নৈতিকতার অভাব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবে সভ্যতার অগ্রগতির জন্য শীঘ্রই এ বাধা দূর করতে হবে।
সাংবাদিকতায় নৈতিকতা
নীতি এবং নৈতিকতা মানব চরিত্রের একটি জটিল দিক। সাংবাদিকতায় নৈতিকতা কথাটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা যেখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে প্রবল চাপ আসে। এ সময় নৈতিকতা দৃঢ় না থাকলে সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিক দু-ই কলুষিত হয়। আর জাতি বঞ্চিত হয় বাস্তব বা প্রকৃত ঘটনা অনুধাবন থেকে। ফলে ক্রমেই সৃষ্টি হয় একটি ধূম্রজাল আর সরকার এবং জনগণের মধ্যে তৈরি হয় বিশাল দূরত্ব। প্রতিটি সংবাদপত্রেরই আছে কিছু মৌলিক নীতিমালা, যার ওপর ভিত্তি করে পরিবেশিত হয় সংবাদপত্রটি। সংবাদপত্রে যে নীতি বা সাংবাদিকতায় যে নৈতিকতা অবলম্বন করা উচিত তা নিম্নরূপ-
১. স্বার্থ পরিহার
একজন সাংবাদিককে তার পেশাগত দায়িত্বের ক্ষেত্রে সব সময় নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। এজন্য তাকে সংবাদ উৎসের সাথে সংশ্লিষ্টতা পরিহার করতে হবে। কেননা সংবাদের উৎস জানলে সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা আদায় করতে পারে । এছাড়াও বিভিন্ন ধারাবাহিক সংবাদ পরিবেশনের সময় সংশ্লিষ্ট মহল থেকে স্বার্থের হাতছানি দিতে পারে। এগুলো থেকে কৌশলে দূরে থাকতে হবে। কোনো ধরনের স্বার্থের নিকট আত্মসমর্পণ করলে সংবাদ মাধ্যম কলুষিত হবে।
২. নির্ভুলতা
সংবাদ পরিবেশনের সময় তথ্যের নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সাংবাদিক অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। সংবাদ পরিবেশনের আগে তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করতে হবে। ভুল তথ্য পরিবেশনের ফলে সৃষ্টি হয় আরও অনেকগুলো ভুল এবং পাঠকের মাঝে তৈরি হয় ভুল বোঝাবুঝি। এছাড়া অনেক সময় কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভুল তথ্য পরিবেশন করলে সমাজে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয়। ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই ভুল সংবাদ পরিবেশন থেকে দূরে থাকতে হবে ।
৩. সংবাদ নতুন সংবাদ তৈরির জন্য নয়
সাংবাদিকের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সংবাদ পরিবেশন করা। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে তা যেন নতুন সংবাদ জন্ম না দেয়। বিভিন্ন ধরনের Rumor stories’ যেগুলো সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে তা কোনোভাবেই পরিবেশন করা যাবে। না। সামান্য অসতর্কতার ফলে সৃষ্টি করতে পারে নতুন বিতর্ক। তাই যে কোনো সংবাদ পরিবেশনের পূর্বে ঘটনার সত্যতা এবং পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
৪. বস্তুনিষ্ঠতা
সংবাদপত্রে বস্তুনিষ্ঠতা খুবই কঠোরভাবে পালন করা উচিত। পরিবেশিত সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা না থাকলে তা সমাজের কাছে কখনোই গৃহীত হবে না। হেয়ালী, কল্পনাপ্রসূত সংবাদ কখনোই পরিবেশন করা উচিত নয়। এমন সংবাদ পরিবেশন করতে হবে যা তথ্য ও তত্ত্বনির্ভর হবে। দেশ, জাতি ও সমাজ তবেই সংবাদপত্র থেকে উপকৃত হবে ।
৫. ন্যায়নিষ্ঠতা
নীতিগতভাবে সাংবাদিকরা তাদের পরিবেশিত সংবাদে ন্যায়নিষ্ঠতা পালনে বাধ্য থাকেন। সংবাদপত্রের সত্য ঘটনা প্রকাশ করা উচিত। যেমন- কোনো ব্যক্তির গ্রেফতার সংক্রান্ত খবর তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ আছে কি-না তা না জেনে পরিবেশন করা ঠিক নয় । এর ফলে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা এবং এটা কোনো কোনো দেশে আইনগতভাবেও অবৈধ । কারণ এর ফলে নির্দোষ ব্যক্তির যশ, সুনাম ইত্যাদি সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হয় ।
৬. সেনসেলানালিজম
সাংবাদিকতা উত্তেজনা, অনুভূতি ভাবাবেগ ইত্যাদিকে সমর্থন করে। তবে এজন্য যেন সংবাদের জন্ম না দেয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। কোনো সংবাদই আবেগ এবং অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ করা ঠিক নয়। এছাড়া সংবাদ এমনভাবেও প্রকাশ করা ঠিক নয় যা সমাজে উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। সংবাদ পরিবেশনে যেটুকু ভাষাগত আর্ট দেয়া দরকার কেবল সেটুকুই দিতে হবে। মনে রাখতে হবে সাংবাদিকের মৌলিক দায়িত্ব হলো জনসাধারণকে গণতন্ত্র মনস্ক জাতি হিসেবে গড়ে তোলা এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।
৭. বৈচিত্র্য ও বোধগম্যতা
সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে বোধগম্যতা আনতে হবে। তা না হলে সমাজের জনগণ একঘেঁয়েমিতে বিরক্ত হবে। তবে এমন বৈচিত্র্য আনা ঠিক হবে না যার ফলে বোধগম্যতা নষ্ট হয় এবং বস্তুনিষ্ঠতা দূরীভূত হয়। এ দুটি বিষয়ের দিক নজরে রেখেই বৈচিত্র্য আনতে হবে। এক্ষেত্রে একজন সাংবাদিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
৮. শিষ্টাচার
সংবাদপত্রের মাধ্যমে শিষ্টাচার ব্যাপক প্রসার লাভ করে। Civility respect for persons make civic life possible এক্ষেত্রে গণমাধ্যম তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ভদ্রতা বা শিষ্টাচার প্রচলন একমাত্র গণমাধ্যমের ফলেই সম্ভব। সংবাদ পরিবেশনে কুরুচিপূর্ণ সংবাদ যেন পরিবেশিত না হয় তার দিকে নজর রাখতে হবে। কেননা এর ফলে যুব সমাজের অবক্ষয় এবং সমাজের আপামর জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনে ব্যাপক ক্ষতি হয় ।
৯. ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা
মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সংবাদ মাধ্যমের নেই এবং এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অনেক কিছুই ঘটে থাকে যেগুলো সংবাদপত্রে প্রকাশ করা ঠিক নয়। এগুলো সমাজে প্রকাশ হলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হেয় প্রতিপন্ন হয় এবং সমাজের সংহতি নষ্ট হয়। তাই একজন সাংবাদিককে এদিকে কঠোরভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে।
১০. আইন-আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন
দেশে প্রচলিত Law. Custom ইত্যাদি বিষয়ের দিকে নজর রেখে সংবাদ প্রকাশ করতে হবে। এমন ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা ঠিক নয় যার ফলে সামাজিক অনুশাসন ভেঙে পড়ে। তাছাড়া এ ধরনের সংবাদ জনগণের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা কমিয়ে দেয়। কাজেই এমন ধরনের সংবাদ প্রকাশ করতে হবে, যাতে আইনের শাসন সমুন্নত হয়, সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি পায় ।
হলুদ সাংবাদিকতা
যে সামাজিক পটভূমিতে গণসংবাদপত্রের বিস্তার ও পূর্ণত্ব লাভ ঘটে তার বৈশিষ্ট্য ছিল সাংস্কৃতিক সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা। নতুন এ মাধ্যমকে কতগুলো মৌলিক বিধি-বিধান গড়ে তুলে সেগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক আকার দিতে হয়, যেগুলো তার গ্রাহকবর্গের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যের নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে এবং ঐ মাধ্যমে কি কি ধরনের বিষয় পরিবেশিত হবে তা নিয়ন্ত্রণ করবে।
খোদ সমাজ কাঠামোটিই অস্থির থাকায় স্বাভাবিকভাবেই গণসংবাদপত্রগুলোকে সাংবাদিকতার বিধিবিধান গড়ে তোলার ব্যাপারে বয়ঃসন্ধির ঝড় তুফানের মতো সঙ্কটজনক অবস্থা অতিক্রম করতে হয়। সংবাদপত্র বিকাশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা নাটকীয় বিষয় ছিল হলুদ সাংবাদিকতার কালপর্ব। ১৮৮০- র দশক নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ ঘরে খবরের কাগজ জায়গা করে নেয়।
ঐ সময় খবরের কাগজের বিক্রয় সর্বাধিক পর্যায়ে থাকায় একে আর্থিক দিক থেকেও সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা সম্ভব হয়। এ প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে বিশাল বিশাল প্রতিযোগী খবরের কাগজগুলোর মধ্যে বাড়তি পঠ সংগ্রহের জন্য প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে নিউইয়র্কে উইলিাম র্যানডল্ফ হার্ট ও যোসেফ পুলিৎজার তাঁদের নিজ নিজ খবরের কাগজের প্রচার বৃদ্ধির জন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করতে থাকেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞাপন খাতে আয় ও মুনাফা বৃদ্ধি ।
প্রতিযোগী প্রতিটি পক্ষই নানারকম মানব আবেদনমূলক কাহিনী পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক বিষয় উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ পত্রিকাকে পাঠকের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করে। আজকের খবরের কাগজের অনেক কিছুই বস্তুত ১৮৯০-এর ঐ প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ের ফল। এর মধ্যে অন্যতম রঙিন কমিক। গোড়ার দিকে এ ধরনের কমিক চরিত্রের নাম ছিল ইংরেজিতে ইয়োলো কিড। আর সেটা থেকেই ইয়োলো। আর্নালিজম এসেছে বলে জানা যায়।
প্রতিযোগিতা প্রকাশ্য সংঘাতে এসে দাঁড়ানোর প্রেক্ষিতে খবরের কাগজগুলো বাড়তি পাঠককে আকর্ষণ করার জন্য ক্রমেই বেশি করে রোমাঞ্চ বিলাসী হয়ে ওঠে। খেলো বা ভয়ঙ্কর যা-ই হোক নির্বিচারে যে কোনো চিত্ত-চাঞ্চল্যকর কৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে। ১৮৯০-এর দশকের প্রথম দিকে সংবাদপত্রে ‘হলুদ’ সাংবাদিকতা চূড়ান্তভাবে ছেয়ে যায় ।
হলুদ সাংবাদিকরা সাংবাদিকতার নীতিমালা ও দায়িত্বকে আদৌ তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষের খবরা-খবর পাওয়ার জন্য যেসব সূত্রের ওপর নির্ভর করতো সেগুলোর গলা চেপে ধরে। তাদের সাংবাদিকতা হৈচৈ ফেলা স্কুল রোমাঞ্চ-চাঞ্চলা বিলাসী, থোড়াই কেয়ার সাংবাদিকতায় পর্যবসিত হয়। এর উদ্দেশ্য যে করেই হোক পাঠককে ফুসলিয়ে স্বপক্ষে ভাগিয়ে নেয়া।
এজন্য লেখায়, ছাপায় ও ইলাস্ট্রেশনে নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। এগুলো এই নতুন সাংবাদিকতারই গর্ব, যেগুলোর বিকৃত ব্যবহার চলতে থাকে। হলুদ সাংবাদিকতা জীবনের উঙ্গে নাটককে সস্তা সঙের যাত্রায় পর্যবসিত করে প্রতিদিনের বাস্তব সত্যকে পাকিয়ে পেঁচিয়ে এমন এক লোভনীয় পণ্য করে তোলে, যার বদৌলতে ঐ খবরের কাগজটি শোরগোল তুলে গলা ফাটিয়ে কাগজ বিক্রির হকারটির বিক্রি দারুণভাবে বাড়িয়ে দেয়।
ব্যাপারটার শেষ সেখানেই নয়, এক্ষেত্রে পত্রিকাটি পাঠকদের কার্যকর নেতৃত্বে না দিয়ে বরং তাদেরকে পাপাচার, যৌনতা ও সহিংসতার আলখেল্লায় বিভ্রান্ত করে।
হলুদ সাংবাদিকতা অনেক গোষ্ঠী ও ব্যক্তিকে মর্মাহত করে। ক্রমেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ফলে গণখবরের কাগজের কর্তারা একদিন বুঝতে পারেন যে, তারা সমাজ, বিশেষ করে নিয়মাচারের ধারক-বাহক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহিষ্ণুতার সীমা লংঘন করে গেছেন।
সুধী, মনীষী এ শিক্ষিত ব্যক্তিরা খুবই ক্ষুব্ধ হন। যোগাযোগের এ মহান নতুন মাধ্যমটিকে মনে করা হতো গণ সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উৎকর্ষের উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় সম্ভাবনা; অথচ সেটিই হলুদ সাংবাদিকতার কল্যাণে হয়ে ওঠে সামাজিক অবক্ষয়ের এক দানবীয় অশুভ প্রভাব । দেশ, জাতি, সমাজ হয়ে যায় কলুষিত। জাতির গর্ব হয় ভূলুণ্ঠিত।
বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম
প্রায় দেড়শ বছর হতে চলল, আমাদের দেশে সংবাদপত্রের প্রচলন হয়েছে । এর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে । মানুষ যতই বাইরের জগৎ ও অবেষ্টনী সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে তার নিকট সংবাদপত্রের গুরুত্ব ততই সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার সংবাদ ও সমালোচনা তার চিন্তা ও কর্মশক্তিকে প্রেরণা দিচ্ছে।
সংবাদপত্র ছাড়া শিক্ষিত মানুষের আজ এক মুহূর্ত চলে না। আমাদের দেশে আধুনিকতার সৃষ্টির পশ্চাতে সংবাদপত্রের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিদ্যমান। বস্তুতপক্ষে ইংরজি শিক্ষা ও ইংরেজদের সান্নিধ্যে আসার ফলে এদেশের যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে তা সংবাদপত্রের মাধ্যমেই দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। সংবাদপত্রই জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার প্রধান বাহন এবং এখনও এর ভূমিকা গুরুত্ব সহকারে প্রতিপালিত হচ্ছে।
সংবাদপত্রের এ গঠনমূলক ভূমিকাই জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব নির্দেশ করে। এখানেই আবার এর সর্বাপেক্ষা বড় দুর্বলতা । আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যম সরকার, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের মালিকানায় প্রকাশিত হয়। অতএব তার মধ্যে এ মালিকের (সরকার, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল যাই হোক) অভিপ্রায় প্রতিধ্বনিত না হয়ে পারে না। এরূপ অবস্থায় অনেক সময়ে ব্যক্তিতেও দলগত স্বার্থ বৃদ্ধি, স্বদেশপ্রেম ও মানব কল্যাণের আদর্শকে পর্যদুস্ত করে এবং তখনই সমগ্র দেশবাসীর পক্ষে ভুল পথে পদক্ষেপ নেয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
গণতন্ত্রের জন্য সাংবাদিকতা তথা সাংবাদিকরা একান্ত অপরিহার্য। তারা প্রচারণার ভিতর দিয়েই গণতন্ত্র চালু রাখার কাজটি করে যান। খোলাখুলিভাবে কাজ করতে সক্ষম সরকারই স্বাধীন সরকার। সরকার সাংবাদিকদের ভাষ্য আত হওয়া সম্পর্কিত ক্ষমতা খর্ব করতে শুরু করলেই বুঝতে হবে তাঁরা কোনো কিছু লুকোতে চান ।
প্রকৃতপক্ষে সংবাদপত্রের একটি সংজ্ঞা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে বরং যা অপ্রকাশিত রাখা হয় তাই খবরে ফলাও বা প্রচার করা হয়। রাজনীতিবিদরা দেশের স্বাধীনতা কেড়ে নিলে সেই সাথে তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও কেড়ে নেয় – এটা যুগপৎ ঘটে যাওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়।
সাংবাদিকতা পেশায় সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে কাজ করতে হয়। আর এর অর্থ হচ্ছে একজন সাংবাদিক তার স্রোতৃমাদীর কাছে সর্বাংশে দায়ী থাকবেন । তথা মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্য রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের মধ্যে বিড়াল-ইঁদুরের খেলা চলছে। তারা অশ্রদ্ধা, বিরুদ্ধাবাদিতা, সন্দেহজনক ও অবিশ্বাসী আচরণের মধ্য দিয়েই সবকিছু মেনে নিতে শিখেছেন। আর এসবই করছেন সত্যের নামে ।
রাজনীতিবিদরা গোপন করতে চান আর সাংবাদিকরা চান উদঘাটন করতে। এ দুখের ভূমিকার মাঝে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। কাজেই সংঘাত যে দেখা দিবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই । গণমাধ্যম ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকেই প্রচার সাংবাদিকরা রাজনীতিবিদদের জন্য আর একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন তা তারা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদেরই হোন আর চলতি ঘটনাবলী সংক্রান্ত সাংবাদিকই হোন ।
‘রিথিয়ান’ (Reithian) দৃষ্টান্তের অনুসারী সবদেশেই যেখানে সংবাদপত্র ও বেতার প্রচারের স্বাধীন রয়েছে সেখানকার রাজনীতিবিদরা যেভাবে সংবাদপত্রকে নিজেদের উপযোগী করে কৌশলে কাজে লাগাতে চান, সেভাবে তথ্য মাধ্যমের এ অংশকে সামনে আনতে পারবেন না বলে বুঝতে পেরেছেন। বাণিজ্যিক উপায়ে পারিচালিত কেন্দ্রগুলোকে প্রায়ই দেখা যায় তাদের মালিকদের পক্ষে কাজ করায় একটা ঝোঁক বা প্রবণতা থাকে।
আর তা স্বভাবতই ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। প্রচারের মানের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকার জন্য ব্রিটেনে এটা লক্ষ্য করা যায় না। অস্ট্রেলিয়াতে দ্বৈত পদ্ধতি রয়েছে। সেখানকার বেতার ও টেলিভিশন উভয় ধরনের প্রচার কেন্দ্রগুলোই প্রায় সর্বজনীনভাবে রক্ষণশীল এবং শ্রমিক দল বিরোধী।
বর্তমানকালে রাজনীতিবিদদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি গণমাধ্যমকে ঐতিহ্যবাহী ধারার বিবেচন করবেন না জনসংযোগের মাধ্যম হিসেবে। সাংবাদিকরা অবশ্যই নির্বোধ নয়। যে কেউ তাদের ব্যবহার করতে পারেন, এ বিপদের কথা তারা বোঝেন। বস্তুত কোনো কোনো সময় তাদের এভাবে ব্যবহার করা হয়ও। আর সে কারণেই তারা তাদের স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য যতটা পারেন করেন।
এটা এক অব্যাহত সংগ্রাম। রাজনীতিবিদরা গোপনীয়তা চান, আর চান তাদের বক্তৃতা বিবৃত্তিগুলোকে তাদের সুবিধামতো সময়ে প্রচার করার অধিকার পক্ষান্তরে সংবাদ মাধ্যম তাদের রজ্জু শক্ত করে ধরে রেখে রাজনীতিবিদের তাদের সুরে সুরে মেলানোর কাজে লাগাতে চান। প্রচার ব্যবস্থাটা হলো বিশেষ এক ধরনের ক্ষমতার উৎস রাজনীতিবিদরা তা বোঝেন। আর সে কারণেই তারা একে নিয়ন্ত্রণ করতে অভিলাষী।
উপসংহার
শিক্ষার বিস্তার এবং নাগরিক কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতার সাথে সাথে সংবাদ মাধ্যমের এ নিয়ন্ত্রণারোপ হ্রাস পাবে এবং সংবাদ মাধ্যমের মূল উদ্দেশ্য সার্থক হবে। মনে রাখা দরকার পরকে আপন এবং বাহিরকে ঘর করাই সংবাদ মাধ্যমের লক্ষ্য। তাই ভেদবুদ্ধি ও মিথ্যা প্রচারণা সংবাদপত্রের মৌলিক আদর্শের বিরোধী। অতএব সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সত্যনিষ্ঠ ও জনসেবার মনোভাব অত্যাবশ্যক। আশা করা যায় যে, সাংবাদিকতায় অধিকতর শিক্ষিত ব্যক্তি আত্মনিয়োগের ফলে এবং সামগ্রিক সমাজ চেতনার পরে সংবাদ মাধ্যম তার মুখ্য আদর্শকে সার্থকতার পথে অগ্রসর করে নিয়ে যাবে।
আরও দেখুনঃ