বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ রচনা

বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। হরতাল বর্তমান বাংলাদেশের একটি প্রধান আলোচ্য এবং বিবেচ্য বিষয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে হরতাল শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে এবং এর পরিমাণও অনেক। দেশব্যাপী হরতালের পাশাপাশি হয়েছে আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে হরতাল। তবে অশির দশক থেকে বাংলাদেশে হরতালের তীব্রতা বেড়েছে। অতীতের কালেভদ্রে হরতালের পরিবর্তে এখন আমরা দেখছি ঘন ঘন হরতাল।

বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

 

হরতাল জনগণের দৈনন্দিন জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। হরতাল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একট কৌশল হিসেবে বহু আগে থেকেই স্বীকৃত। প্রধানত রাজনৈতিক কর্মসূচি মর্যাদা রক্ষা, হিসেবেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ধারায় এর সূচনা।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও বাঙালিরা মাতৃভাষার গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় সর্বোপরি স্বাধিকারের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সভা, সমাবেশ, মিছিল, ধর্মঘট, ঘেরাও এবং অবরোধের পাশাপাশি হরতাল কর্মসূচি গ্রহণ করে। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতালের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হরতাল দেশের জন্য অকল্যাণকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

 

হরতালের উৎপত্তি :

হরতাল শব্দটি বাংলাভাষায় গৃহীত হয়েছে গুজরাটি ভাষা থেকে। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে ‘হরতাল [গুজরাটি শব্দ : হর (প্রত্যেক) + তাল (তোলা) অর্থাৎ প্রতি দরজায় তালা । শব্দের অর্থ— বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য যানবাহন, হাটবাজার, দোকান পাট, অফিস আদালত প্রভৃতি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করা।’

হরতাল বলতে কি বোঝায় তা শব্দের অর্থ থেকে খুবই স্পষ্ট। ইংরেজি ‘জেনারেল স্ট্রাইক’ বা ‘সাধারণ ধর্মঘট’ এবং হিষ্ট্রি ‘বন্ধ’ শব্দকে হরতালের সমার্থক বলে ধরে নেয়া যায়। আদিতে হরতাল ছিল ব্যবসায়ীদের কারবার সংক্রান্ত দাবি দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টি ও প্রতিবাদ প্রকাশের কৌশল হিসেবে দোকান পাট, গুদাম ঘর প্রভৃতি বন্ধ রাখা।

১৯২০-৩০-এর দশকে ভারতের রাজনীতিতে হরতাল নতুন মাত্রা যোগ করে। এ সময় মহাত্মা গান্ধী তাঁর নিজ এলাকা গুজরাটে পরপর অনেকগুলো ব্রিটিশ বিরোধী বনধ বা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে হরতালকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের রূপ দেন। বাংলাদেশে হরতাল জনগণের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের একটি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত রাজনৈতিক পন্থা।

 

 

বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

 

হরতালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :

যে কোনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজেই সংঘবদ্ধভাবে ক্ষোভ প্রকাশের কতিপয় পথ ও পদ্ধতি থাকে, যদিও সেগুলো একেক সমাজে একেক রকম হতে পারে। নির্দিষ্ট দেশে সরকার পরিচালনার ধরনের উপরেও প্রতিবাদের ভাষা ও কৌশলসহ এসব পদ্ধতির হেরফের ঘটে।

উদাহরণ হিসেবে নবাব মুর্শিদকুলী খানের চাকলা ব্যবস্থার কথা বলে যায়। এ ব্যবস্থায় সব ক্ষুদ্র জমিদারগুলোকে চাকলাদারদের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করতে বলা হলে ক্ষুদ্র জমিদারেরা তা মেনে নিতে পারেনি। তারা পূর্বের মতো সরাসরি সরকারকে রাজস্ব দেয়ার পক্ষে আরজি জানিয়ে মৃদু প্রতিবাদ গড়ে তোলে ।

নবাবী সরকার পদ্ধতিতে দাবিদাওয়া জানানোর জন্য আরজির উপরে অন্য কোনো পদ্ধতিতে দাবিদাওয়া সরকার সহ্য করতো না। আরজির মধ্য দিয়ে পরিচালিত আন্দোলনকে ক্ষুদ্র জমিদাররা নাম দিয়েছিল হুকুমত-ই-বায়াৎ, যার অর্থ খোদ সরকার ও তাদের মাঝামাঝি অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয় । রংপুরের প্রজা সমাজ ১৭৮৩ সালে ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ডিংরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

ডিং ছিল দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত খাজনা দেয়া বন্ধ রাখার আন্দোলন। এ আন্দোলনে প্রজারা সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিল সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত স্থানীয় কর্তাদের বিরুদ্ধে। রংপুরের প্রজাদের এ ডিং আন্দোলনের আদলে পরবর্তীতে যশোর নদীয়া পাবনার নীল চাষীদের ডংকা আন্দোলন গড়ে উঠে। ডংকা এক রকমের ঢোল।

১৮৫৯-৬০ সালের এ আন্দোলনে বাংলার নীল চাষীরা ডংকা বাজিয়ে ঘোষণা করে দেয় যে, তারা আর নীল চাষ করবে না। একটি ডংকার আওয়াজ শোনামাত্র দূরে আর একটি ডংকা বাজানো মানে ছিল সেখানেও ঐ আন্দোলনের শরিকরা সংহতি ঘোষণা করছে। এমনিভাবে ১৮৫০-৬০ এর দশকে ফরায়েজি আন্দোলনের কৌশল ছিল জোট।

জমিদার কর্তৃক বেআইনি এ অন্যায়ভাবে আরোপিত আবওয়াব (খাজনাতিরিক্ত চাঁদা) আদায়ের বিরুদ্ধে প্রজারা জোট গঠন করে প্রতিরোধ রচনা করে। প্রতি পরগনায় কৃষকদের নিয়ে জোট গঠন করা হয়। স্থানীয় জোটগুলো সংশ্লিষ্ট হয় আঞ্চলিক জোটের সঙ্গে।

আঞ্চলিক জোট সমন্বয়ে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় জোট। ১৮৭৩ সালের পাবনা কৃষক বিদ্রোহ সংগঠকরা যে আন্দোলন পরিচালনা করে তা ছিল আজকের ধর্মঘটের অনুরূপ। ধর্মঘট হচ্ছে হিন্দু কৃষক পরিবারের একটি দেবতার প্রতীকস্বরূপ পাত্র। এ পাত্র স্পর্শ করে প্রজারা প্রতিজ্ঞা করে যে, প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত খাজনা হারের উপরে তারা কোনো বাড়তি খাজনা দিবে না ।

 

বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

 

অতএব, দাবি আদায়ের জন্য সংগঠিত ভাবে প্রতিবাদ ব্যক্ত করা বাংলার ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। শুধু সময় ও স্থানভেদে এর ধরন ও পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে। ইউরোপীয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শিল্প শ্রমিকরা বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে মাঝে মাঝেই ধর্মঘটের আয়জন করে আসছে। শিল্প শ্রমিকদের ধর্মঘট পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঞ্চলেও বিস্তারিত হয়। রাজনৈতিক ধর্মঘট যা প্রায়শই হরতাল নামে অভিহিত হয়।

ঔপনিবেশিক শাসকদের উৎখাতের আন্দোলনে একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯২০-এর দশক থেকে ৫০-এর দশক পর্যন্ত হরতাল ও ধর্মঘটকে সমার্থক হিসেবেই গণ্য করা হতো। ষাটের দশক থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে হরতালকেই ধর্মঘটের চেয়ে অধিকতর জোরদার অস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে গণমানুষকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে হরতাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৮০-এর দশকে হরতাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিরোধী দলসমূহ এরশাদের শাসনকে (১৯৮২-৯১) অবৈধ ঘোষণা করে ঘনঘন হরতাল ডেকে প্রশাসনকে অকেজো করে দেয় এবং তার সরকারের পতন ঘটে।

পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের  নেতৃত্বে বিরোধী দলসমূহ বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে (১৯৯১-৯৬) উপর্যুপরি হরতালের মাধ্যমে তীব্রচাপে রাখে। শেখ হাসিনার প্রশাসনও (১৯৯৬-২০০১) হরতালের চাপ থেকে মুক্ত ছিল না। এরই ধারাবাহিকতায় চার দলীয় জোট সরকারও (২০০১-২০০৬) হরতালের অস্ত্র থেকে রক্ষা পায়নি।

১৯৯০-এর দশক থেকে ক্ষমতাসীন সরকারসমূহ এবং জনগণের ব্যাপক অংশ হরতালকে খুব ভালো চোখে দেখে না । রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে হরতাল ঔপনিবেশিক আমলে ফলপ্রসূ ছিল। কিন্তু অনেকের মতে, একটি আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্রে এ অস্ত্রের প্রয়োগ অসঙ্গতিপূর্ণ ।

এতদসত্ত্বেও বিরোধী দলীয় রাজনীতিকদের ব্যাপক অংশ এখনও সরকারকে চাপে রাখতে এ অস্ত্র প্রয়োগের পক্ষপাতী। তাদের মতে, বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমন যে, কোনো ইস্যুর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে এখনও হরতাল একটি শক্তিশালী কৌশল ।

 

স্বাধীন বাংলাদেশে হরতাল :

স্বাধীন বাংলাদেশে হরতাল হবে না কিংবা তার প্রয়োজন হবে না, দেশ চলবে গণতান্ত্রিক ধারায়, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন থাকবে না, মৌলিক মানবাধিকার থাকার নিশ্চিত এমন প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই নেমে আসে দুঃশাসন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরে জেলের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়।

দেশ চলে যায় সামরিক সরকারের হাতে। হরতাল পরিণত হয় প্রতিবাদর ভাষায়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসার পরও হরতাল চলছে। নিপীড়ক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের এ চূড়ান্ত হাতিয়ারটি অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে প্রাথমিক হাতিয়ার হিসেবে। পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যত গণতান্ত্রিক অধিকার প্রসারিত হচ্ছে হরতালও যেন তত বেশি হচ্ছে।

সভা, মিছিল, ধর্মঘট প্রভৃতি গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের ভাষা ছেড়ে বেশি বেশি আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে হরতালের। রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল ডাকছে কখনও এককভাবে, কখনও জোটবদ্ধভাবে। অন্যান্য সংগঠনও ডাকছে। জাতীয়ভিত্তিক হরতালের পাশাপাশি পালিত হচ্ছে আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে অসংখ্য হরতাল।

এক সময়ে গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল বা দলসমূহ পণবিরোধী শাসকদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত হরতাল পালনের আহ্বানের মাধ্যমে। কিন্তু কালক্রমে অনেক দলের কাছে হরতাল আহ্বান নিছকই যেন রাজনৈতিক সুবিধাবাদিদের প্রতিফলন। আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করার পরিবর্তে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কৌশল ।

দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রস্তুতি ও প্রচারাভিযান শেষে হরতাল পালনের রেওয়াজের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে এসেছে তাৎক্ষণিকতা। হরতাল কলবৎ করার জন্য পিকেটিংয়ের স্থান নিয়েছে বোমাবাজি ও আতঙ্ক সৃষ্টির নানা কৌশল। এর রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবে চালু হয়েছে ‘সাউন্ড এফেক্ট’।

 

বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

 

হরতালের ইস্যু:

ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে অনেক হরতাল পালিত হয়েছে সরকারকে কোনো গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার বা সংশোধনের জন্য অথবা সরকারকে কোনো নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিংবা দাবি মানতে বাধ্য করার জন্য। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুতেই জাতীয় পর্যায়ে হরতাল পালিত হয়েছে। অর্থনৈতিক ইস্যুতে হরতালের অনেকগুলোই জাতীয় বাজেটের প্রতিবাদে ডাকা হয়েছে। দমন পীড়নের প্রতিবাদেও অনেক হরতাল হয়েছে।

আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ের হরতালের ক্ষেত্রেও এসব ইস্যু দেখা যায়। তার পাশাপাশি আছে স্থানীয় ইস্যু। ৬০ বছরের হরতালের ইস্যু পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ইস্যুতে হরতাল ডাকা হয়েছে অন্তত ৫০০টি। গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ডাকা হরতালের সংখ্যা ৬০০-এর বেশিটি । তবে রাজনৈতিক ইস্যু এবং গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদের ইস্যুর মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন টানা মোটেই সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, গ্রেফতার ও নির্যাতনের ইস্যুটি রাজনৈতিক ধরনের। অরাজনৈতিক ইস্যুকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি গ্রেফতার হলেও তাকে রাজনৈতিক দমন পীড়ন হিসেবে আখ্যায়িত করে হরতাল ডাকার ঘটনা আছে দেশের নানা স্থানে।

 

হরতাল প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

 

কারা হরতাল ডেকেছে :

হরতাল আহ্বানের সাথে জড়িত আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন এবং অন্যান্য সংগঠন। কখনও জোটবদ্ধভাবে হরতাল ডাকা হয়েছে, কখনও বা এককভাবে। জাতীয় পর্যায়ে এককভাবে ডাকা হরতালগুলোর সাথে আওয়ামী লীগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জড়িত। জোটবদ্ধভাবে ডাকা হরতালের সাথে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বেশি জড়িত।

ষাটের দশকে আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে তারা ডেমোক্রেটিক একশন কমিটির (ডাক) হয়ে হরতাল ডেকেছে। ১৯৮২ সালের পর এরশাদের শাসনামলে ১৫ দলীয়, ৭ দলীয় ও ৫ দলীয় জোটের পাশাপাশি তারাও হরতাল ডেকেছে। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে (১৯৯১-৯৬) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে তারা আওয়ামী লীগের এবং জাতীয় পার্টির সাথে হরতাল ডেকেছে।

১৯৯৬ সালের ২৩ জুনের পর তারা শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে হরতাল ডেকেছে। এছাড়া তারা এককভাবেও বেশ কিছু হরতাল ডেকেছে। এর বেশিরভাগই দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলে পরিচিত চট্টগ্রাম এলাকায়।

শাসকদল ও তার অঙ্গ সংগঠনের হরতাল ডাকার ঘটনাও আছে। ১৯৭৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগ হরতাল ডেকেছিল। তবে শাসক দলের পক্ষে সবচেয়ে বেশি হরতাল ডাকা হয় বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসেই বিএনপির বিভিন্ন ইউনিট অন্তত ২৫টি স্থানীয় হরতাল আহ্বান করে নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ।

জোটের রাজনীতির সাথে পরিচিতি আমাদের দীর্ঘকালের। দেখা যায়, আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় তুলনামূলক শরিক দলগুলো মিছিল, সমাবেশ, ঘেরাও প্রভৃতির পরিবর্তে হরতাল আহ্বানে বেশি উৎসাহী। এক্ষেত্রে সুবিধাবাদী মনোভাব স্পষ্ট। হরতাল সফলে মূল ভূমিকা বড় দলকেই রাখতে হয়। ব্যর্থতা এলে মূল দায়ভার তাদের ওপরেই চাপানো হয়।

অনেক ছোট দলের কাছেই হরতাল আহ্বান হচ্ছে সবচেয়ে সফল কর্মসূচি। বড় দলের ক্ষেত্রেও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। এসব দলে ধনবান শ্রেণীর প্রভাব স্পষ্ট। হরতালে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয় তার সরাসরি প্রভাব পড়ে এ শ্রেণীর ওপর। তাই বিরোধী দল ঘনঘন হরতাল ডেকে তাদেরকে নিজ দলের সরকারের প্রতি বিরাগভাজন করে তোলে ।

 

হরতালে হতাহত :

৬০ বছরের হরতালে ৩০০ জনের বেশি নিহত হওয়ার তথ্য মিলেছে সংবাদপত্রে। এ হিসাব যে পূর্ণাঙ্গ নয়, সেটা স্পষ্ট। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতে সান্ধ্য আইন লঙ্ঘন করে রাজপথে নেমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে অগণিত লোকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। এদেরকে হরতালে নিহত বলে ধরা হয়নি। প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী হরতালে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছিল এরশাদের শাসনামলে ১০৯ জন।

বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে ৬৩ জন এবং শেখ হাসিনার শাসনামলে ৩৭ জনের মৃত্যুর কথা সংবাদপত্রে জানা যায়। ১৯৪৭ সাল থেকে ৭১ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩৬ জন, ১৯৭২ সাল থেকে ৭৫ সালে ১ জন এবং ১৯৭৫ থেকে ৮২ সালে সামরিক শাসন পর্যন্ত ৬ জন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মৃত্যু ঘটেছে পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আক্রমণে। হরতালে নিহত বেশির ভাগের পরিচয় সংবাদপত্রে নেই। যেমন, ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতালে ১০ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও কারো পরিচয় জানা যায়নি।

গণআন্দোলনে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যা সরকারের বিরুদ্ধে জনমত আরও প্রবল। করেছে। এমনকি হরতাল আহ্বানের কারণও হয়েছে। কিন্তু তাদের মৃত্যু হরতালের কারণে হয়েছে বলে চিহ্নিত করা যায়নি। উদাহরণ হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্র নেতা আসাদুজ্জামান, ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে ছাত্র মিছিলে পুলিশের ট্রাক উঠিয়ে দেয়ায় নিহত ছাত্রনেতা ইব্রাহিম সেলিম ও দেলোয়ার হোসেন এবং পরের দিন আদমজী জুট মিলে হরতালের সমর্থনে আয়োজিত মিছিলে সরকার সমর্থক গুন্ডাদের হামলায় নিহত শ্রমিক নেতা তাজুল ইসলামের কথা বলা যায়।

গত ৬০ বছরে হরতালের সময়ে ১৫ হাজারের বেশি আহত এবং প্রায় ১২ হাজার গ্রেফতারের কথা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায় । এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। তবে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা সংবাদপত্রে উল্লেখ কমই হয়েছে। গ্রেফতারকৃত সকলেই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী নয়। পুলিশ হরতালের আগে বা পরে যেসব টোকাইকে গ্রেফতার করে তাদেরও হিসাবে ধরা হয়েছে। পুলিশ অনেককে সন্দেহবশতও গ্রেফতার করেছে।

 

বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

 

হরতাল নয় কর্মসূচি :

জেনারেল এইচ এম এরশাদের শাসনামলে কড়া মার্শাল ল’ পরিস্থিতির বাইরেও কয়েকবার সংবাদপত্রের ওপর হুকুম জারি হয় বিরোধী দলগুলো হরতাল, ধর্মঘট ও অবরোধ ডাকলেও সংবাদপত্রে তা লেখা যাবে না। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী জনাব আনোয়ার জাহিদ ছিলেন এ নীতির উৎসাহী সমর্থক। তিনি সম্পাদকদের ডেকে সামরিক আইনের ধারাসমূহ মেনে না চললে কঠোর শান্তির হুমকি দেন।

সাংবাদিকরা অবশ্য এ অন্যায় আদেশের কাছে নতি স্বীকার করেনি। তার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল ও জোটের ডাকা হরতাল কর্মসূচির কথা জনগণকে ঠিকই জানিয়ে দেয়। তবে একটু কৌশল করে। হরতালের পরিবর্তে লেখা হয় কর্মসূচি। যেমন: ‘আজ দেশব্যাপী অর্ধদিবস কর্মসূচি’, ‘দেশব্যাপী পূর্ণ দিবস কর্মসূচি পালিত,’ ‘তিন জোট টানা ৪৮ ঘণ্টা কর্মসূচি’ ডেকেছে প্রভৃতি।

 

হরতাল ও সাংবাদিক নিপীড়ন :

গত ৬০ বছরে সাংবাদিকরা সবসময়ই পুলিশ এবং অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের টার্গেট হয়েছে। হরতালের সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা বাড়াবাড়ি করে ৷ আবার সময়ে সময়ে তারা বাধ্য হয়েও অ্যাকশনে যায় । আন্দোলনের প্রকৃতি এবং এর প্রতি সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণেও তাদেরকে নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। তবে তাদের এ কার্যক্রম সংবাদপত্রে প্রকাশ হোক, এটা তারা চায় না।

আলোকচিত্র শিল্পীদের তাদের আরও ভয়। কারণ তারা অপরাধকে ক্যামেরা বন্দী করে রাখে। সাংবাদিকরা কোনো না কোনোভাবে পুলিশের কাছে লাঞ্ছিত, নিগৃহীত বা মারধরের শিকার হননি, এমন হরতাল বাংলাদেশের ইতিহাসে কমই হয়েছে। সংবাদপত্র কর্মীদের কিংবা সংবাদপত্র বহন করা যানবাহন হরতালের আওতামুক্ত বলে ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু অনেক হরতালে সাংবাদিকদের বহনকারী যানবহন ভাঙচুর কিংবা পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে । এছাড়া অনেক সময় হরতাল আহ্বানকারীদের হাতেও সাংবাদিকরা লাঞ্ছিত হন।

 

হরতাল, মিছিল, জনসভা :

হরতালের সাথে পিকেটিং, হরতাল আহ্বানকারী শক্তির মিছিল, সমাবেশ ও জনসভা অনুষ্ঠান যেন রেওয়াজ। এমনকি সর্বাত্মক হরতাল হলেও পিকেটাররা ভোর হতে না হতেই রাজপথে নেমে আসে। পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকের শেষেও পিকেটার ছাড়া অনেক হরতাল পালিত হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এর কারণ হচ্ছে পিকেটাররা রাজপথেই নামেনি পিকেটিং করে বন্ধ করার মতো আছে অগণিত রিকশা, সরকারি বিআরটিসি বাস, ট্রেন, অফিস ও কারখানা।

পিকেটিং না করলেও বন্ধ থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট । কেউ তাদের বাধা না দিলেও রাজধানীসহ অনেক শহরে এগুলো খোলা হয়নি। কেন রাজপথ থেকে পিকেটাররা উধাও! এটা কি শুধু পুলিশি নির্যাতনের কারণে? নাকি হরতালের প্রতি তাদেরও অনীহা? হরতাল ডাকলেই কোনো না কোনোভাবে যখন হয়ে যায়, তখন পিকেটিংয়ের প্রয়োজন কি? এমন ধারণাও কাজ করতে পারে।

ক্রমাগত হরতালে তারা ক্লান্ত, এটাও সম্ভবত কারণ। পুলিশ চিরকালই হরতালকে নিরুৎসাহিত করেছে এবং দমননীতি চালিয়েছে। তবে কেন এই নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণের সময়ে এ প্রশ্নের উত্তর জানা অবশ্যই প্রয়োজন ।

 

বাংলাদেশে হরতাল : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

 

হরতাল ও বোমবাজি :

হরতাল পালনের জন্য মিছিল, মশাল মিছিল ও জনসভা অনুষ্ঠান, পোস্টার ও লিফলেট প্রকাশ, মাইকিং পদযাত্রা, পথসভা প্রভৃতি প্রস্তুতিমূলক কাজ করার প্রথা চালু ছিল দীর্ঘকাল থেকে। জনসাধারণ এভাবেই হরতালের কথা জানতে পারতো। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে হরতাল আহ্বানকারীর হরতালের আগের রাতে বোমাবাজির রীতি চালু করে। নব্বইয়ের দশকেও তা চলতে থাকে ।

কেউ কেউ একে অভিহিত করে ‘সাউন্ড অ্যাফেক্ট’ হিসেবে। বোমাও ক্রমে শক্তিশালী হয়। হরতালের দিনেও ব্যাপক বোমাবাজি হয়। হরতাল অমান্য করে কোনো যানবাহন বের হলে তা রুখতে পিকেটারদের অনুরোধের স্থান নেয় বোমা। চলন্ত বাসে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের পরিবর্তে ছুড়ে মারা হয় বোমা। এতে সাধারণ মানুষের মৃত্যু, আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শাসকদের পাশাপাশি জনসাধারণও কেন আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষে পরিণত হবে এটা এমনকি হরতালের সমর্থকদের কাছেও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

 

হরতাল নিয়ে জরিপ :

ঘনঘন হরতাল আহ্বানের যৌক্তিকতা নিয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র হরতাল বিষয়ে জনমত জরিপ পরিচালনা করে। এ জরিপ চালানোর প্রধান কারণ দেশের সুশীল সমাজে বর্তমানে হরতালের যৌক্তিকতা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন ওঠেছে। ১৯৯৫ সালের ৯ মার্চ ভোরের কাগজে’ হরতাল প্রশ্নে একটি জনমত জরিপের ফল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ১২ ও ১৩ মার্চ (১৯৯৫) বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে যে হরতাল ডাকা হয়েছে তার প্রতি জনমতের ৫৪ শতাংশের সমর্থন নেই। শতকরা ৩৬ শতাংশ সমর্থন জানিয়েছেন। ১০ শতাংশ কোনো মতামত দেননি। দেশের মোট ৩২টি অঞ্চলে জরিপ চালানো হয়।

১৯৯৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘প্রথম আলো’য় হরতাল নিয়ে আরেকটি জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় ৬৩.২৮% লোকের হরতালের প্রতি সমর্থন নেই। ২৫.৬৭% লোক হরতাল সমর্থন করেন। ১১.০৫% কোনো মতামত দেননি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, হরতালের বিরুদ্ধেই বেশিরভাগ জনমত এবং তাদের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে হরতাল আহ্বানকারীরা এসব জনমত জরিপ বিবেচনায় নেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

 

হরতালে ক্ষয়-ক্ষতি:

বেশিরভাগ হরতালের ইস্যু রাজনৈতিক, কিন্তু হরতালে অর্থনীতির ক্ষতিই হয় সবচেয়ে বেশি। আশি ও নব্বইয়ের দশকের ঘনঘন হরতাল তাই শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তারা প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করে হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে বলেছেন।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারের সাথে মিলিয়ে হরতাল দেয়ায় টানা তিন-চারদিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। লে. জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে হরতালে অর্থনীতির কি ক্ষতি হয় তার বিবরণ দিয়ে লাখ লাখ পোস্টার ছাপিয়ে বিতরণ করেছিলেন। তার মতে, হরতালে একদিনে দেশের ক্ষতি হয় দেড়শ কোটি টাকা। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক পূর্তমন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, বিরোধী দলের হরতালে দেশে একদিনেই ক্ষতি হয় ২৫০ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার শাসনামলে তার অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেছেন, একদিনের হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি হয় ৩৮৬ কোটি টাকা।

তিন হিসাবের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। সবচেয়ে বড় কথা, হরতালে ক্ষতি হয় মূলত অর্থনীতির, এটা দেশের নেতৃবৃন্দ
স্বীকার করেছেন। তারপরও কেন এত হরতাল এটা একটা সর্বজনীন প্রশ্ন।

গার্মেন্টস শিল্পে দেশব্যাপী একদিনের হরতালে ক্ষতি হয় একশ কোটি টাকার বেশি। এ হিসাব বিজেএমইএ সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমানের। গার্মেন্টস শিল্পকে অর্ধদিবস হরতালের আওতার বাহিরে রাখার ঘোষণা দেয়ার পরও এ ক্ষতির কথা তিনি বলেছেন।

বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়ার হিসাব ছিল প্রতি দিনের হরতালে ক্ষতি ২৫০ কোটি টাকা। তিনি যে সময়ে এ হিসাব দিয়েছিলেন, তার তুলনায় টাকার ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমেছে। অর্থাৎ টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। পাশাপাশি অর্থনীতির আকার কিছুটা বড় হয়েছে। তাই প্রতিদিনের ২৫০ থেকে বেড়ে ৩৮৬ কোটি টাকা হতেই পারে । ৬০ বছরের হরতালে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা দিয়ে নব্বই দশকের শেষ দিকের আকারের অন্তত ৭টি সরকারি উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন করা যায়।

এ হিসাবে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার কিংবা গবেষণায় কি ক্ষতি হয় তা নেই। রোগ-ব্যাধিতে জরুরি চিকিৎসা কিভাবে ব্যবহৃত হয় তা নেই। আকস্মিক স্থানীয় হরতালে বা সড়ক অবরোধে আটকা পড়ে মানুষের জীবনে কি চরম দুর্ভোগ নেমে আসে তাও নেই। এমনই আরও অনেক ক্ষতির কথাই বলা নেই । সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে হরতাল অসংখ্য মানুষের উপার্জনের অধিকার কেড়ে নেয় ।

তাদের খাদ্য ক্রয় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য আয়ের পথ এ সময়ে বন্ধ থাকে। সব হরতাল অপ্রয়োজনীয় এ কথা কেউ বলবে না। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতান্ত্রিক শাসনকালের তুলনায় প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন এবং জেনারেলদের সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরোক্ষ সেনা শাসনের স্থায়িত্ব বেশি। স্বভাবতই হরতালকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভাষা হিসেবে বেছে নেয়। কিন্তু সামরিক শাসকদের গড়ে তোলা দুটি দলও ক্ষমতা হারানোর পর হরতাল ভক্ত হয়ে ওঠে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

হরতালের ইতিবাচক দিক :

কিছু বৃহৎ স্বার্থের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম এবং লাখ লাখ মানুষের আত্মদান গৌরবের ভাস্বর। সে সময়ে অর্থনীতির অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে। মানুষ সেটা হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকার একটি প্রহসনমূলক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। দেশ-বিদেশে এর বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এই নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের দাবিতে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের হরতালকে অযৌক্তিক বলা যাবে না।

পাকিস্তান ও ঔপনেবিশক ধরনের শাসনামলে বাঙালি জাতি তার ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য হরতাল নামের এ চূড়ান্ত প্রতিবাদের ভাষা সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের হাতেগোণা কয়েকটি হরতাল গণবিরোধী শাসকের ভিন্ন নড়বড়ে করে দিয়েছিল। এমনকি ১৯৭১ সালের ২-৬ মার্চ পর্যন্ত হরতালগুলো ডাকা হয়েছিল আধাবেলা করে এবং ৮ মার্চ থেকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র যুদ্ধের আগে সর্বাত্মক হরতালের রূপ নেয়া অসহযোগ আন্দোলনের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১৮ দিন। এ সময়ে রিকশা ছাড়াও যান্ত্রিক যানবাহন চলাচলে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। বন্ধ রাখা হয় অফিস, আদালত কল-কারখানা। অথচ নব্বইয়ের দশক থেকে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র।

 

উপসংহার :

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে দেশে প্রায় আড়াই দশক সংসদীয় শাসন বিরাজ করছে এই ভূখণ্ডে, যা ৬০ বছরের ইতিহাসে নেই। সংবাদপত্রের স্বাধীন মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা আছে। সামরিক শাসন, জরুরি আইন কিংবা এ ধরনের কোনো কোনো আইনে রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নেয়া হয় না। সভা, সমাবেশ, মিছিল করা যায় অবাধে। প্রতিবাদের ভাষা আছে অনেক। কিন্তু তারপরও হরতাল কেন বাড়ছে? কারণে-অকারণে কেন হরতালকে বেছে নেয়া হচ্ছে? কালেভদ্রে সীমিত সময়ে হরতালের স্থান কেন নিচ্ছে ঘনঘন বা লাগাতার হরতাল?

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment