বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য নিয়ে জানবো আজ। শিশুসাহিত্য অর্থ শিশুদের উপযোগী সাহিত্য। সাধারণত ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে এ সাহিত্য রচনা করা হয়। এই বয়সসীমার ছেলেমেয়েদের শিক্ষামূলক অথচ মনোরঞ্জক গল্প, ছড়া, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদিকেই সাধারণভাবে শিশুসাহিত্য বলে। যারা শিশুসাহিত্য রচনা করেন তাদের শিশুসাহিত্যিক বলা হয়। বাংলাদেশের এই ধরনের সাহিত্য চর্চা নিয়ে আজকের প্রবন্ধ।
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য
প্রারম্ভিক কথা :
জন্মের পর থেকেই একটি শিশু বিস্ময়ভরে পৃথিবীর দিকে দৃষ্টিপাত করে। চারদিকের আলো-ছায়া, পাখির কলকাকলী, মানুষজন, পশুপাখি প্রতিটি বস্তুর দিকে শিশু কৌতূহলভরা দৃষ্টিতে চায়। সবকিছুর অর্থ ও রহস্য সে উদঘাটন করতে চায়। এরকম একটি সংবেদনশীল পর্যায়ে শিশুর সুষম বিকাশে শিশুসাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে শিশুদের নিয়ে সাহিত্য রচনার ব্রতী হয়েছেন সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, লেখক, মনোবিজ্ঞানী এবং আরো অনেকে। দেশের বুদ্ধিজীবী, কুশীলব, প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শিশুসাহিত্যের অগ্রগতি ও উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে।
শিশুসাহিত্যের সংজ্ঞার্থ নিরূপণ :
সাহিত্য মানব জীবনের উৎকর্ষ ঘটায়। সুন্দর, সাবলীল সাহিত্য তাই মানব জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে। শিশুসাহিত্যও শিশুদের ভাবনা-ধারণা নিয়ে জিজ্ঞাসু ব্যক্তির তথা বহু জনের বহু মতের জালে আবদ্ধ হয়েছে। শিশুসাহিত্য রচিত হয় পঠন-শ্রবণের মাধ্যমে শিশুদের আনন্দ বিধান আর শিক্ষাদানের জন্য। শিশুসাহিত্যের সংজ্ঞায় ভাই বলা হয়, ‘In its usually accepted sense, children’s literature includes only that literature intended for the entertainment or instruction of children.”
এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকার দ্বিতীয় বিবৃতিতে সত্যিকার শিশুসাহিত্যের কাছে প্রথমেই যে জিনিসটির দাবি করা হয়েছে তা হলো প্রকাশভঙ্গির সরলতা আর স্পষ্টতা। কেননা শিশুর মন জটিলতামুক্ত তাই তারা সরল পথের অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘শিশুরা আর যাই হোক, অর্থলোভী জাত নয়। অতএব শিশুপাঠ্য রচনায় যত খুশি ভাটপাড়া সুলভ শব্দ প্রয়োগ করুন। আশঙ্কার কিছু মাত্র কারণ নেই—শিশুরা সে রচনা দেখে গলা শুকিয়ে জলের গ্লাসের দিকে হাত বাড়াবে না।’
শিশুমন কল্পনাপ্রবণতার অধিকারী। তাদের চোখে মুখে রয়েছে স্বপ্নের ঝিলিক। তারা চারপাশের পৃথিবীকে সহজেই সজীব করে তুলতে পারে। তাদের মাঝে সুপ্ত রয়েছে অসীম সম্ভাবনা। শিশুসাহিত্য বিশেষজ্ঞ এমেলিয়া এইচ মানসন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘Children must have their secret lives and so do we, and each must be respected.’
শিশুদের সাহিত্যে সহজ-সরল শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকে। কেননা তারা কঠিন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ শব্দ। সহজে বুঝতে ও আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। তাদের সাহিত্য শুধু আনন্দের বাহন নয়, অনুভূতিরও বাহন। এ কারণে একজন সাহিত্যিক যখন শিশুদের জন্য কিছু রচনায় প্রবৃত্ত হন, তখন তিনি সহজ- সরল শব্দ ব্যবহার করেন, যা একজন শিশু পড়ামাত্রাই বুঝতে পারে। তাছাড়া তিনি শিশুদের শিক্ষামূলক বিষয়ের চেয়ে আনন্দরস ও অনুভূতি ব্যক্তকরণের দিকেই গুরুত্ব দেন বেশি।
শিশুসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য : সহজ-সরল ভাষায় হাস্যরস ও অনুভূতি প্রকাশের জন্য শিশুদের নিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয় সাধারণত তাকে বলা হয় শিশুসাহিত্য। ওপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে শিশুসাহিত্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা যেতে পারে;
ক. সহজ-সরল শব্দের সমাহার।
খ. গুরুদন্ডীর ও কঠিন শব্দ পরিহার।
গ. প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত শব্দাবলী প্রয়োগ।
ঘ. অভিধানের অনুগামী না হয়ে শিশুমনে দোলা লাগানো
ঙ. হাস্যরস ও কৌতূহল উদ্দীপক শব্দ ও বাক্য। চ তৎসম শব্দের পরিবর্তে দেশীয় শব্দের প্রয়োগ।
|ছ. সমাসবদ্ধ শব্দের প্রয়োগ কম।
জ. শব্দের অর্থ স্পষ্ট ও বোধগম্যতা ইত্যাদি।
শিশুসাহিত্যের উদ্দেশ্য :
শিশুসাহিত্যের উদ্দেশ্য শিশুর মনোবিকাশের পথ সুগম করা। ভয়-ভীতি, অন্ধ কুসংস্কার ইত্যাদি পরিহার করে যাতে সুষম জীবন গড়ে তুলতে পারে সেদিকটি গুরুত্ব দিয়েই শিশুসাহিত্য রচিত হয়ে থাকে। জোসেফ ফ্রাঙ্ক এ প্রসঙ্গে বলেন, …. আসলে শিশুসাহিত্য হচ্ছে তা-ই যা তার পাঠককে একটা প্রত্যক্ষবাদী আর কল্যাণজনক অভিজ্ঞতা দেয়। সে অভিজ্ঞতা যেমন অনুভূতির হতে পারে, তেমনি জ্ঞানেরও। … শিশুসাহিত্যের এই-ই চরিত্র লক্ষণ এবং এই-ই উদ্দেশ্য।
শিশুসাহিত্যের প্রকারভেদ :
শিশুসাহিত্যের প্রকারভেদ ও সংজ্ঞার্থ নিরূপণে শিশুসাহিত্যিক, জ্ঞানপিপাসু, মনোবিজ্ঞানী, দার্শনিকগণের মধ্যে মতানৈক্য বিদ্যমান। তবে সমালোচনা-আলোচনা যা-ই থাকুক, শিশুসাহিত্যের বিষয়াবলী প্রধানত দুটি বৈশিষ্ট্যশ্রেয়ী : ভাবগত এবং শিক্ষণীয়। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক মার্গারেট এল নরগার্ড শিশুভোগ্য রচনাবলীকে নিম্নোক্ত বারো ভাগে বিভক্ত করেছেন :
১. ছেলেভুলানো উপাখ্যান আর ছবির বই
২. লৌকিক উপাখ্যান
৩. পরীর উপাখ্যান বা রূপকথা
৪. আবোল-তাবোল উপাখ্যান আর সবাক পশুকাহিনী
৫. কিংবদন্তি
৬. আন্তর্জাতিক ভাব ছড়ানো গল্প- উপন্যাস
৭. আঞ্চলিক কাহিনী
৮. কল্পিত পশুকাহিনী
৯. ইতিহাস এবং জীবনী
১০. সমকালীন রোমাঞ্চ এবং কীর্তিকাহিনী
১১. প্রকৃতিবিজ্ঞান, জড়বিজ্ঞান ও বিশ্বকোষ
১২. ছড়া ও কবিতা।
শিশুসাহিত্যের বিষয় :
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, ভালোমন্দ যাচাই করার বুদ্ধি তাদের অনুপস্থিত। কাজেই শিশুসাহিত্যের বিষয় হবে জীবনধর্মী, কল্যাণধর্মী, যা তাকে সত্যে ব্রতী হতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। তাই জীবন ও বাস্তবতা এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে শিশুসাহিত্যের বিষয়াবলী নির্বাচিত হওয়া উচিত। আর্নেস্ট ফিলারের ভাষায়, It clearly refers to an attitude not a style.
কাজেই একজন সাহিত্যিক যখন বিষয় নির্বাচন করবেন তখন তাকে এসব বিষয় প্রাধান্য দিয়েই তা নির্বাচন করতে হবে। একজন শিশুসাহিত্যিক যখন তার বিষয় নির্ধারণ করবেন তখন তিনি শিশুর মনোপযোগী সাহিত্যই নির্ধারণ করবেন।
শিশুসাহিত্যের ক্রমবিকাশ :
বিশ্বে শিশুসাহিত্যের যাত্রা শুরু প্রাচীনকাল থেকেই। প্রথম শিশুপাঠ গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত ‘কেজেমনির হিতোপদেশ’। গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। অন্যান্য সাহিত্যের তুলনায় শিশুসাহিত্যের যুগবিভাগ সরল। মার্গারেট এল নরগার্ডের মতে, এ সাহিত্যের দীর্ঘতম পর্ব আদিযুগ—যার সূচনা প্রাচীন যুগে এবং অবদান মধ্যযুগে।
মধ্যযুগের সঠিক তারিখ নির্ণয়ে তিনি অবশ্য ব্যর্থ হয়েছেন। তবে প্রাচীনকালে। শিশুসাহিত্যের সন্ধান পাওয়া যায় মিশর, ভারতীয় উপমহাদেশ, আসিরিয়া-ব্যাবিলনিয়া, গ্রিস প্রভৃতি দেশে। পাথর, বালি ফলক, প্যাপিরাসের বুকে প্রাচীনকালে শিশুসাহিত্য লেখা হতো। আঙ্গিকের ক্ষেত্রে গদ্য আর কবিতা এবং বিমানের ক্ষেত্রে রূপকথা, রূপককথা, ইতিহাস, জীবনী ইত্যাদি বিষয় এ সময় লেখার মধ্যে স্থান পেত।
আদিযুগে শিশুদের নিয়ে রচিত আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘সুত্তপাঠক’। এ গ্রন্থটি প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে রচিত হয়। গ্রন্থটি ভারতীয় উপমহাদেশের বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ‘সুত্রপাঠক’-এর পর ভারতীয় উপমহাদেশে রচিত হয় আরো অনেক গ্রন্থ। শিশুদের কাছে সেগুলো খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এগুলোর মধ্যে কালিদাসের ‘দ্বাত্রিংশং পুলিশ” সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর’, ‘হিতোপদেশ ইত্যাদি গ্রন্থের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইংল্যান্ডে ১৪৭৬ সালে উইলিয়াম ক্যাকসটন প্রথম মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন। তিনি ইউরোপের সাহিত্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পরবর্তীকালে শিশুদের নিয়ে অনেক সাহিত্য রচিত হয়। এর মধ্যে জন বুলিয়ানের (১৬২৮-৮৮) নীতিবাগীশ রচনা পিলএমিস প্রগ্রেস (১৬৭৮-৮৪), আর দা লাইফ অ্যান্ড ডেখ অন মি. ব্যাডম্যান (১৬৮০), ড্যানিয়েল ডিফোর (১৬৫৯-১৭৩১) রবিনসন ক্রুসো (১৭১৯), জোনাথন সুইফটের (১৬৬৭-১৭৪৫) কাল্পনিক ভ্রমণ কাহিনী গালিভারস ট্রাভেলস (১৭১৬) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইউরোপের লৌকিক কাহিনী সংকলন শিশু’সাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এগুলোর সংগ্রাহক এবং প্রকাশক ফ্রান্সের শার্ল পেরো। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৬৯৮ সালে।
আধুনিক যুগে শিশুসাহিত্যের বিকাশে যারা অভাবনীয় সাফল্য রেখেছেন তাদের মধ্যে ইংল্যান্ডের লুই ক্যারলের নাম সর্বপ্রথম স্মরণীয়। তার ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ ও ‘এলিস থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস’ পৃথিবীর প্রতিটি শিশুর কাছে লোভনীয়। কল্পনার মনোহারিতা এবং এডভেঞ্চারের নাটকীয়তায় এই গ্রন্থ দুটি সমূহ শিশু’সাহিত্যে মাইলফলক। এছাড়া ব্যাপক সমাদর লাভ করেছেন আর এম ব্যালান্টাইন ও রবার্ট লুই স্টিভেনসন। ব্যালান্টাইনের ‘গোরিলা হানটার্স’ এবং ‘কোরাল আইল্যান্ড’ শিশুদের কাছে খুব জনপ্রিয়। তাছাড়া জে কে রলিংসের শিশুতোষ সিরিজ ‘হ্যারিপটার’ ও সাম্প্রতিক সময়ে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বাংলাদেশে শিশু’সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি :
বাংলাদেশে শিশু’সাহিত্যের চর্চা দীর্ঘদিনের নয় । প্রাচীনকালে শিশুদের নিয়ে রচিত তেমন উল্লেখযোগ্য বাংলা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। তবে মধ্যযুগের শেষের দিকে দেব-দেবীর কাহিনীনির্ভর শিশুসাহিত্য শিশুমহলে সমাদর লাভ করে। মঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন উপাখ্যান শিশুদের মাঝে সহজেই স্থান পায়।
রামায়ণ, মহাভারতের নানা কাহিনী এবং কিছু আধাসাহিত্যিক উপাখ্যান নিয়ে রচিত হয় শিশুসাহিত্য। এসব সাহিত্য শিশুদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এভাবে শিশু’সাহিত্য প্রাচীন ও মধ্যযুগ অতিক্রম করে আধুনিক যুগে পদার্পণ করে। উনিশ শতককে বাংলা শিশু’সাহিত্যের সূচনা পর্ব বলা যায়। অনেকে রাধামাধব মিত্রের কবিতাবলীকে বাংলার প্রথম শিশুতোষ গ্রন্থ বলে মনে করেন। এ গ্রন্থটি ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হয়। রাধামাধবের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বোধেছুদয়’ ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। এতে বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষাপ্রীতি সম্পর্কিত কিছু উক্তি ছিল ।
বাংলা শিশুতোষ কবিতায় ভাষাপ্রীতির প্রকাশ এর আগে আর দেখা যায়নি। পুরোপুরি শিশুভোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয় বসন্ত’, সর্বানন্দ রায়ের “শরৎকুমারী’, মুনশী নামদারের ‘বনগাঁয়ে শিয়াল রাজা’ ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
ক. শিশুসাহিত্যে বাংলা নাটক :
সূচনাপর্বে শিশুতোষ নাটকের অস্তিত্ব ছিল প্রায় অজ্ঞাত। পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে দু-একটি রচনা দেখা যেত। এগুলোর মধ্যে ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত ‘বালক বন্ধু’ পত্রিকার ‘জাতে জাতে লড়াই’ বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাছাড়া ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘ভক্তির ডোর”, “চিতোর গৌরব’ ইত্যাদিও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় নাটক।
খ. শিশুদের নিয়ে কবিতা :
বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য বহু কবিতা গ্রন্থ রচিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায় থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব উল্লেখযোগ্য কবিরা শিশুদের জন্য বহু কবিতা লিখেছেন । এছাড়া আমাদের শিশুতোষ ছড়াসাহিত্যও বেশ সমৃদ্ধ।
গ. শিশুসাহিত্যে রূপকথা :
শিশুদের রচনায় রূপকথা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আঙ্গিকে এসেছে। এর মধ্যে যোগীন্দ্রনাথের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘ছোটদের রামায়ণ’। দক্ষিণারঞ্জনের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ও “ঠাকুরদাদার ঝুলি” আজও শিশুমহলে জনপ্রিয়। রূপকথার বড় সংগ্রাহক বলে তাকে গণ্য করা হয়ে থাকে। বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম রূপকার হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার রচিত ‘রাজকাহিনী’, ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘ভূতপতরীর দেশ’ ইত্যাদি ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
ঘ. স্বাধীনতাত্তোর শিশুরচনা :
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিশু’সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ছয় বছর আমাদের শিশুসাহিত্যের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য রচনা পাওয়া যায় না। তবে ১৯৭৮ সালের পর বাংলা সাহিত্যের চর্চা নবরূপে সূচিত হয়। এর মধ্যে রচনাভঙ্গীতে তথা বিষয়গত বৈচিত্র্যে মনোরম কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ যেমন – সত্যেন সেনের ‘আমাদের এই পৃথিবী’ ও ‘এটমের কথা’ এ দুটি গ্রন্থই শিশুদের জনপ্রিয়।
সুব্রত বড় য়ার “চাঁদে প্রথম মানুষ’ আকাশচারণ বিষয়ক সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। সবচেয়ে উপভোগ্য সংকলন হাবিবুর রহমানের ‘পুতুলের মিউজিয়াম এবং আবদুল্লাহ আল-মুতীর রহস্যের শেষ নেই’ ও ‘আবিষ্কারের নেশায়। ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক শিশুতোষ গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আসাদ চৌধুরীর “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, সাহিদা বেগমের ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন’, রফিকুল ইসলামের ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে লিখিত হয়েছে দুটি ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের ‘সব কটা জানালা’ এবং আমীরুল ইসলামের ‘কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প’।
বাংলাদেশের শিশুপত্রিকা:
বেশ কটি শিশুপাঠ্য পত্রপত্রিকা আমাদের দেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ‘নবারুণ’, শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত “শিশুবার্ষিকী, এখলাস উদ্দীন সম্পাদিত ‘রঙিন ফানুস’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লেখযোগ্য পত্রিকার পরিচয় নিচে দেয়া হলো :
নবারুণ :
তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তর থেকে প্রকাশিত একটি সচিত্র কিশোর মাসিক পত্রিকা। পত্রিকাটিতে কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ ও নানাবিধ ফিচার থাকে। পত্রিকাটিতে শিশু- কিশোরদের জন্য একটি বিভাগ নির্ধারিত রয়েছে। এতে শিশুদের রচনা প্রকাশিত হয়।
সবুজ পাতা :
ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত একটি মাসিক পত্রিকা। ‘শিশু-কিশোরদের কাছে ইসলামের মৌলিক আদল ও শিক্ষা পৌঁছানো, নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সত্যিকার চেহারা তাদের কাছে তুলে ধরা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্যের সঙ্গে তাদের পরিচয় করানো, দেশ ও দশের প্রতি তাদের কর্তব্যবোধ জাগিয়ে তোলা, তাদের মনে মানুষ হওয়ার আগ্রহ বাড়ানো এবং জ্ঞান- স্পৃহার প্রতি আগ্রহী করে তোলা সবুজ পাতার উদ্দেশ্য।
শিশু :
বাংলাদেশ শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত সচিত্র মাসিক পত্রিকা। শিশু-কিশোর লেখকদের রচনা সমৃদ্ধ ‘কচি হাতের কলম থেকে এই পত্রিকার একটি আকর্ষণীয় বিভাগ। পত্রিকাটিতে অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সের শিশুদের উপযোগী লেখা প্রকাশিত হয়ে থাকে।
ধান শালিকের দেশ :
ধান শালিকের দেশ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত একটি সচিত্র শিশু- কিশোর মাসিক পত্রিকা। বর্তমানে ছয় মাস পরপর এটি প্রকাশিত হচ্ছে। ফুলকুড়ি : মাহবুবুল হক সম্পাদিত ‘ফুলকুঁড়ি’ বেসরকারি উদ্যোগে প্রকাশিত একটি সচিত্র শিশু-কিশোর মাসিক। ফুলকুঁড়ি একটি শিশু সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়।
কিশোর জগৎ :
বেসরকারি উদ্যোগে প্রকাশিত মোখতার আহমেদ সম্পাদিত একটি সচিত্র কিশোর পত্রিকা। বিজ্ঞান সাময়িকী : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক আমাদের শিশু-কিশোরদের আগ্রহ ও চর্চা যে দিন দিন। বাড়ছে তার প্রধান প্রমাণ মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী। পত্রিকাটি শিশু-কিশোর মাসিক পত্রিকা হিসেবে না হলেও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেই এর জনপ্রিয়তা বেশি।
শিশু’সাহিত্যের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর অবদান কম নয়। প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় শিশুদের জন্য সপ্তাহে একটি বিভাগ নির্ধারিত থাকে। এ বিভাগে শিশুতোষ বিষয়ক রচনা, গল্প, কবিতা, ছড়া প্রকাশিত হয়। ইত্তেফাকে কচিকাচার মেলা’, প্রথম আলোতে ‘গোল্লাছুট’, যুগান্তরে ‘আলোর নাচন’ সংবাদে ‘খেলাঘর’, দৈনিক খবরে ‘শাপলা দোয়েল’, দৈনিক ইনকিলাবে ‘সোনালী আসর’, দৈনিক জনতার ‘কচি কন্ঠের আসর’ ইত্যাদি নামে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে শিশুদের জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। আমাদের দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের রচনা এবং শিশু-কিশোর রচিত লেখাও এতে ছাপা হয়। এই বিভাগগুলো আমাদের শিশু পত্রিকার অভাব অনেকখানি মুচিয়েছে।
শিশুসাহিত্যে বর্তমান উদ্যোগ :
শিশুসাহিত্য শিশুর সুষম বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ বিষয় প্রাধান্য দিয়েই শিশু’সাহিত্যের প্রসারে দেশের লেখক, বুদ্ধিজীবী সবাই একই কাতারে শামিল হয়েছেন। বর্তমান বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আলী ইমাম, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, সাহিদা বেগম, সুকুমার বড় য়া, খালেক বিন জয়েন উদ্দীন প্রমুখ সাহিত্যিক শিশুদের নিয়ে সাহিত্য রচনা করছেন।
শিশু একাডেমী, বাংলা একাডেমী, পাবলিক লাইব্রেরী, নজরুল একাডেমী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান থেকে শিশুদের জন্য বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়ে থাকে। শিশুদের সাহিত্যচর্চায় উৎসাহদানেও এসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংগঠনও শিশুদের অধিকার ও শিশু’সাহিত্য নিয়ে কাজ করে আসছে। বর্তমান সরকারও শিশুদের সমস্যা সমাধান ও তাদের মানসিক বিকাশে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার শিশুদের নিয়ে গল্প, নাটক ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে।
উপসংহার :
শিশুসাহিত্যের ধারা অব্যাহত রাখা ও তা আরো সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। হ্রাসকৃত মূল্যে কাগজ ও অন্যান্য প্রকাশনা সামগ্রীর সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলে এ দেশে আরো উন্নতমানের শিশু পত্রিকা ও শিশু’সাহিত্য প্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। আজকের শিশুরাই আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে। এ কারণে শিশুদের সুস্থ বিকাশ ও সুষম মনের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগে তারা ব্যর্থ হবে।
আরও দেখুন: