Tag Archives: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

বাংলাদেশ-পাকিস্তান রাজনৈতিক সম্পর্ক ১৯৭১-১৯৭৫ – আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন

বাংলাদেশ-পাকিস্তান রাজনৈতিক সম্পর্ক ১৯৭১-১৯৭৫ [ Bangladesh Pakistan Relations ] – আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন :  আধুনিক বিশ্বে দুটি পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থে সম্পর্ক স্থাপন নতুন কোনো ঘটনা নয়। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো তাদের ঔপনিবেশিক অতীত ভুলে গিয়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ব্রিটেনের এককালের বিভিন্ন উপনিবেশ বর্তমানে স্বাধীন দেশগুলো এখন ব্রিটেনের নেতৃত্বাধীন কমনওয়েলথের সদস্য।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান রাজনৈতিক সম্পর্ক ১৯৭১-১৯৭৫ - আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন - 1971 people who shaped the outcome
1971 people who shaped the outcome

 

স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান প্রাথমিক আবেগ ও ক্ষোভ কাটিয়ে উঠে উভয়ের স্বার্থে সম্পর্ক গড়ে তুলতে তৎপর হয়ে ওঠে। অবশ্য এর পেছনে উভয় দেশের পরিপূরক অর্থনীতি, অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয় অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই উভয় দেশ তাই প্রাথমিক তিক্ততা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালায় এবং কিছু বিষয়ে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয় । উভয় দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা পরস্পরের দেশ সফরও করেন।

যদিও উভয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদ্যমান দীর্ঘদিনের সন্দেহ ও টানাপোড়েনের কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে এই সম্পর্ক স্থাপনে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল প্রবল। উভয় পক্ষের এই দৃষ্টিভঙ্গিগত কঠোরতার কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তান ২৬ মাস সময় নেয়। পাকিস্তান মুজিব আমলে স্বীকৃতি দিলেও উভয় দেশের মধ্যে এ আমলে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। উভয় দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয় যেমন—সম্পদ বণ্টন, বাংলাদেশে অবস্থানরত অবাঙালি পাকিস্তানী (বিহারী নামে পরিচিত) ফেরত নেয়ার ব্যাপারে সৃষ্ট অচলাবস্থা এবং এ ক্ষেত্রে দুটি দেশের বিদ্যমান ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিগত অবস্থান দুটি দেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠতার দিকে নিয়ে যায়নি।

তাই মুজিব আমলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককে সম্পর্কের প্রাথমিক পদক্ষেপ ও সূচনাপর্ব হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বর্তমান প্রবন্ধে দুদেশের সম্পর্ক কিভাবে বৈরী থেকে ক্রমান্বয়ে সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে তা দেখানো হবে। চূড়ান্ত পর্বে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাপ্তিযোগ কি ঘটেছে সে বিষয় নির্দেশ করার চেষ্টা করা হবে।

১. বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক: প্রাক-স্বীকৃতি পর্ব (১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত)

শুরু থেকেই পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জেড. এ. ভুট্টো বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত নেতিবাচক মনোভাব দেখান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করার সময় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কট্টর বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি খসড়া প্রতিলিপি টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলেন এবং সাংবাদিকদের জানান, তিনি যুদ্ধবিরতি চুক্তি কিছুতেই মেনে নেবেন না। অবশ্য তার এই প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে পাকিস্তানী জেনারেলরা একই তারিখ রাতে আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং পরের দিনই অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে তারা আত্মসমর্পণ করেন।

Zulfikar Ali Bhutto 1971
Zulfikar Ali Bhutto 1971

 

যদিও এ সংবাদ পাওয়ার পরও ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া ছিল ‘বাংলাদেশ বলে কিছু নেই, আছে পূর্ব পাকিস্তান। ২ তবে ভুট্টোর মত একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, পাকিস্তানের এই ঘটনাপ্রবাহই তাকে রাষ্ট্রের কর্ণধার হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এই উপলব্ধি থেকেই ১৮ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি জানান, পাকিস্তানের দুটি অংশের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তিনি সদা সচেষ্ট থাকবেন।

২০ ডিসেম্বর ভুট্টো দেশে ফিরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত তার প্রথম ভাষণে বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ আখ্যা দিয়ে একে পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করেন। তিনি তার স্বভাবসুলভ আবেগময় বক্তৃতায় বাঙালি জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এবং ভুলের মাশুল যাতে দেশ বিভক্তির রূপ না নেয় সে দিকে লক্ষ্য রেখে পাকিস্তানের ঐক্যের জন্য বাংলাদেশের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। ভুট্টো বলেন,

আমি মুসলিম বাংলার নেতা ও জনগণের কাছে যেতে চাই এবং বিদেশী কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে চাই। আমরা বিগত ২৪ বছর যেমন ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করেছি, ভবিষ্যতেও সে রকমভাবে বসবাসের জন্য নতুন একটা মীমাংসায় উপনীত হবো। তবে এই মীমাংসা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে হতে হবে।” ৫

একই দিন প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেও তিনি পাকিস্তানের দুই অংশকে ঐক্যবদ্ধ করে নতুন সরকার গঠনের পক্ষে মত দেন। ৬ একাত্তরের মার্চ মাসে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে অনীহা, নয় মাস জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে যোগসাজশ, সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে ইরান, চীন সফর, সর্বোপরি উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দান সামরিক জান্তার প্রতি তার সমর্থনেরই প্রমাণ দেয়। যদিও পাকিস্তানের ভাঙনে ভুট্টো তার দায়-দায়িত্ব এড়ানোর জন্য নিজের ভূমিকাকে আড়াল করতেই প্রতিষেধক হিসেবে আগাম ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য তার প্রচেষ্টার প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেন। নিজের এই লক্ষ্যসাধনে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য, জেনারেলদের অযোগ্যতা ও নারী কেলেঙ্কারির কাহিনী ডিসেম্বর মাসেই পাকিস্তানের টেলিভিশনে তুলে ধরা হয়।৭

A grim Yahya Khan at a function during his dictatorship that lasted from March 25, 1969, to December 20, 1971.
A grim Yahya Khan at a function during his dictatorship that lasted from March 25, 1969, to December 20, 1971.

 

২০ ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়াসহ ৬ জন জেনারেলকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান এবং গণতন্ত্র ফিরে না আসা পর্যন্ত সামরিক শাসন বলবৎ রাখার ঘোষণার মাধ্যমে ভুট্টো যেমন একদিকে নিজের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন, অন্যদিকে তেমনি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য তার আন্তরিকতা প্রদর্শনের জন্য পাকিস্তানে বন্দি শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের অনুকূলে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এড়িয়ে এই উদ্যোগের পেছনে ভুট্টোর উদ্দেশ্য ছিল দুটি।

প্রথমত, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য পাকিস্তানীদের মধ্যে যে ক্ষোভ ছিল তাকে নিজের অনুকূলে আনা; দ্বিতীয়ত, ভারতকে এড়িয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকায়ন। এ ছাড়া শেখ মুজিবের সঙ্গে অনুষ্ঠিত একাত্তরের ২৭ ও ২৯ ডিসেম্বরের দুটি বৈঠকে ভুট্টো মুজিবকে যে কোনো মূল্যে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানান। ১০

শেখ মুজিব দেশে ফেরার আগে এ বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ভুট্টো পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে অন্তত কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেন।১১ ভুট্টো প্রদত্ত এই প্রস্তাবে বলা হয়, পাকিস্তানের দুটি অংশ নিয়ে কনফেডারেশন হবে, তবে ভিন্ন অর্থনীতি, প্রশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি থাকবে। ১২ একই সঙ্গে ভুট্টো মুজিবকে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যে কোনো পদ গ্রহণের প্রস্তাবও দেন।১৩ শেষ পর্যন্ত কনফেডারেশন গঠন সম্ভব না হলে শিথিল কনফেডারেশনের প্রস্তাবও দেন তিনি।

Bhutto welcomes Sheikh Mujibur Rehman in Lahore, 1974
Bhutto welcomes Sheikh Mujibur Rehman in Lahore, 1974

 

উলপার্ট অবশ্য শেষ মুজিবের দেশে ফিরে গিয়ে জনসভার আয়োজন করা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছেন। ১৪ মুজিব-ভুট্টোর এই বৈঠক ছিল অত্যন্ত গোপনীয়, যে কারণে তাদের আলোচ্যসূচি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। স্ট্যানলি উলপার্ট ছাড়া আর কোথাও উল্লিখিত বক্তব্যের সমর্থনে কোনোরকম প্রামাণ্য বিবরণ না পাওয়ায় বৈঠকের আলোচ্যসূচির সত্যতা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকতে পারে। তবে উলপার্ট নিজেও স্বীকার করেছেন, ভুট্টো পরবর্তীকালে মুজিবকে ব্ল্যাকমেইল করার কাজে এই বৈঠকের আলোচ্যসূচিকে ব্যবহার করেছেন।

বৈঠকের পর এবং মুজিবের পাকিস্তানে অবস্থানকালেই ১৯৭২-এর ১ জানুয়ারি ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো দুই অংশের ঐক্য এবং একটি রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে তার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।১৫ পরের দিনই করাচিতে ভুট্টোর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দেশটির নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে মুজিবকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঐ দিনই মার্কিন সাময়িকী ‘টাইমস’ ভুট্টোর বক্তব্যের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে পাকিস্তানের উভয় অংশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমঝোতা কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেন।১৬ যদিও রবার্ট পেইন মনে করেন যে, শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠকে কোনো চুক্তি বা ঐ জাতীয় কোনো সুবিধা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ভুট্টো মুজিবকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।১৭

মুজিবের মুক্তির পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় কারণ ছিল সক্রিয়। মুজিবকে মুক্তি না দিলে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিদের যে ফিরিয়ে আনা যাবে না ভুট্টো সেটা তার বিভিন্ন বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশে নয় মাস পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ এবং নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবকে বন্দি ও তার প্রহসনমূলক বিচারের উদ্যোগ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইয়াহিয়া বহির্বিশ্বে নিন্দিত হয়েছিলেন।

এই প্রেক্ষাপটে ভুট্টো মুজিবকে মুক্তি দিয়ে নিজেকে একজন প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালান। তবে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ভুট্টো এই স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একক দায় না নিয়ে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি করাচিতে প্রায় এক লাখ লোকের এক সমাবেশে মুজিবের মুক্তির জন্য জনতার রায় চান। উপস্থিত জনতা ইতিবাচক মত দিলে ভুট্টো মুজিবের মুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ঐ দিনই রেডিও পাকিস্তান এই মুক্তির কথা ঘোষণা করে।।

Bhutto with Qaddafi, Yasser Arafat, Sheikh Mujibur Rehman
Bhutto with Qaddafi, Yasser Arafat, Sheikh Mujibur Rehman

 

সরকারি দল পিপিপি ছাড়াও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং ন্যাপ একে স্বাগত জানায়। কারণ, তাদের বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত ছিল পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান’ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ সহায়ক। ভুট্টো নিজেও বিভিন্ন বক্তৃতায় অনুরূপ মত দেন। মুজিবের মুক্তির পেছনে ভুট্টোর আরো যে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য কাজ করে তা হলো: প্রথমত, ভুট্টো এর মাধ্যমে এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যে, নয় মাসের যুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল সামরিক শাসকদের মতের বিরুদ্ধে।

বন্দিদশা থেকে মুজিবকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে তিনি নিজেকে একজন মার্জিত, মধ্যপন্থী, মধ্যস্থতাকারী ও গ্রহণযোগ্য পাকিস্তানী নেতা হিসেবে উপস্থাপিত করার এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং বহির্বিশ্বে একাত্তরে পালিত নিজের ভূমিকা আড়াল করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সহানুভূতিও কামনা করেন। তৃতীয়ত, মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ড উদ্ধার করাসহ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পথ সুগম করা। সবশেষে বলা যায়, ৩ জানুয়ারির জনসভাতেই ভুট্টো বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে তার ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন।

এর থেকে অনুমান করা যায় যে, মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপও অব্যাহত ছিল। ১৮ তবে ভুট্টো মুজিবের মুক্তির ঘোষণা দিলেও সঙ্গে সঙ্গে তার মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেননি। এর মাধ্যমে ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে সমঝোতার সর্বশেষ চেষ্টা চালান। এ সময় মুজিবেকে প্রথমে তুরস্ক বা ইরানে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯ তাই ৮ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে মুজিবকে লন্ডনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

ভুট্টো মুজিবকে সরাসরি কয়েকটি কারণে ঢাকা পাঠাতে চাননি। প্রথমত, এর ফলে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হত। এ ছাড়া একটি স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের মত শত্রুপক্ষের বিমান অবতরণের জটিলতাও ছিল। শেখ মুজিব নিজেই পরে স্বীকার করেন পাকিস্তান সরকার তাকে লন্ডনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং একজন বন্দি হিসেবে এ ব্যাপারে তার করার কিছুই ছিল না। ২০ মুজিব তার উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেনসহ ঐ দিন লন্ডন এবং ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির পর ঢাকায় পৌঁছেন।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, London, on his return to Bangladesh 1972
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, London, on his return to Bangladesh 1972

 

ঢাকা ফিরে ঐ দিনই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল সমাবেশে মুজিব ভুট্টোর প্রস্তাবিত বিশেষ সম্পর্কের বিপক্ষে মত দিয়ে বলেন,

“পাকিস্তানী ভাইয়েরা আপনাদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। আমি চাই আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সেনাবাহিনী আমাদের অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে, আমাদের মা-বোনের মর্যাদাহানি করেছে। তবুও আপনাদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষ নেই। আপনারা স্বাধীন থাকুন, আমরাও স্বাধীন থাকি। বিশ্বের অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের সাথে আমাদের যে ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে, আপনাদের সাথেও আমাদের শুধু সেই ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে।” ২১

শেখ মুজিবের এই ভাষণে দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত, কনফেডারেশন ও শিথিল সম্পর্ক-সংক্রান্ত ভুট্টোর প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল তার এই ভাষণের উল্লিখিত অংশটুকু। অন্যদিকে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রদত্ত তার রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রথম ভাষণে পাকিস্তান ও পাকিস্তানী বাহিনী সম্পর্কে কঠোর বক্তব্য না দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সমতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব স্থাপনের আহ্বান জানান।

মুজিবের এই বক্তৃতা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচার পেলেও ১৩ জানুয়ারি লাহোরে ভুট্টো সাংবাদিকদের ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। পাশাপাশি তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদনও রাখবেন তারা যেন ‘তথাকথিত বাংলাদেশকে’ স্বীকৃতি না দেন। কারণ মুজিবের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে তার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। বাংলাদেশকে কয়েকটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি তার সমঝোতার পথে বাধার সৃষ্টি করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি মুজিবের ১০ জানুয়ারির ভাষণকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করার অনুরোধ জানান, কারণ তার ভাষায় মুজিবের এটাই শেষ কথা নয়। ২২

সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো বাংলাদেশকে চালসহ অন্যান্য পণ্য সাহায্য, দুটি দেশের মধ্যে বিমান সার্ভিস চালু এবং ২৮০০০ বাঙালি সৈন্যকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাবও দেন। ২৩ ভুট্টোর ঐ দিনের ভাষণের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পরের দিনই মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের সব দ্বার চিরদিনের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং টিকে থাকার জন্যই এর প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ২৪ পরের দিন মুজিব আরো বলেন, ভুট্টো যদি মনে করেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র, তবে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আমি পাকিস্তানেরও প্রেসিডেন্ট, পশ্চিম পাকিস্তানে নিজের প্রতিনিধি নিয়োগেরও ক্ষমতা রাখি। ২৫

ভুট্টো মুজিবের এই উক্তিকে কূটনৈতিকভাবে ব্যবহার করেন এবং পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে মুজিবের হাতে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ক্ষমতা অর্পণ করে। রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তিনি মুজিবকে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যে কোনো একটি পদ গ্রহণের পুরনো প্রস্তাবও নতুন করে দেন। ২৬ অবশ্য মুজিব ভুট্টোর কূটনৈতিক চাল বুঝতে পেরে ১৮ জানুয়ারি বলেন, ‘আমি পাকিস্তান চাই না, বাংলাদেশ হচ্ছে এখন বাস্তব সত্য। বাংলাদেশের একজন সরকারী মুখপাত্র এক বিবৃতি মারফত ঐ দিনই বলেন, অথচ এই ভুট্টোই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণে বাধা দানকারীদের অন্যতম ছিলেন।

১০ মাস পর তার এই প্রস্তাব সত্যিই বিলম্বিত সিদ্ধান্ত | ২৭ মুজিবের পরিষ্কার বক্তব্য সত্ত্বেও ভুট্টো স্বীকৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রচারণা এবং তার জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ৮টি মুসলিম দেশ সফরের আগেভাগে স্বীকৃতির প্রশ্নে বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করতে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। ভুট্টো তার সফরের প্রাক্কালে অর্থাৎ ১৯ জানুয়ারি বলেন,

“অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোতেই পাক ভারত উপমহাদেশের সমস্যার সমাধান করতে হবে। পাকিস্তানের এখন প্রথম কাজ হচ্ছে টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে একটি নতুন দেশ গড়ে তোলা।”২৮

কিন্তু বাংলাদেশের ঐক্যের বিপক্ষে বক্তব্য, জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিদের ভারতে স্থানান্তর, ২৪ জানুয়ারি দালালদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত ও আইন প্রণয়নের প্রচেষ্টায় ভারতে আটক পাকিস্তানী বন্দিদের ব্যাপারে পাকিস্তান চিন্তিত হয়ে পড়ে।

ভুট্টো জানুয়ারি মাসে ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ চালান এবং মুসলিম দেশ সফরের মাধ্যমে ভারতের দখল করে নেয়া পাকিস্তানী ভূখণ্ড প্রত্যার্পণ এবং পাক যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্য ভারত ও বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ সৃষ্টির প্রয়াস পান। একই সাথে তিনি সফরকারী ৮টি দেশের (ইরান, তুরস্ক, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া ও মিসর) রাষ্ট্রপ্রধানদের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐক্যের সর্বশেষ সুযোগ দেয়ার অনুরোধ জানান।

পাশাপাশি জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী ২১টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশের সঙ্গে পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ৩১ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং ব্রিটেনের আশু স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণায় পাকিস্তান কমনওয়েলথ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৯ জানুয়ারি মাসে এ সব উদ্যোগের পাশাপাশি পাকিস্তান সরকারি পর্যায়ে ঈদের উৎসব পালন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, ভুট্টোর ভাষায়,

দেশের জনসংখ্যার বড় অংশ পূর্বাঞ্চলের জনগণকে বিদেশী আগ্রাসনের আওতায় রেখে পশ্চিম পাকিস্তান ঈদ উৎসব পালন করতে পারে না।“৩০

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য ছিল রীতিমত হাস্যকর, কেননা ২১টি দেশ বাংলাদেশকে যেখানে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তার স্বাধীনতা লাভের পর দেড় মাস অতিবাহিত হয়েছে, তখনও এ ধরনের সিদ্ধান্ত রীতিমত কূটনৈতিক শিষ্টাচার-বহির্ভূতও ছিল। যদিও তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সেটা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

তবে ভুট্টোর এই অপপ্রচার ও হুমকি সত্ত্বেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি থেমে থাকেনি। বরং ফেব্রুয়ারি মাসে মুসলিম দেশ সেনেগাল, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ আরো ২৮টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্যে ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, সুইডেন, জাপান, ফ্রান্স ও কানাডার মত দাতা দেশও ছিল। বিপুল সংখ্যক দেশের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভুট্টোর চীন সফর, ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফর পাকিস্তানের জন্য ঈপ্সিত ফল বয়ে আনেনি।

ভারতের বিরুদ্ধে ভুট্টো চৈনিক নেতাদের কঠোর মনোভাব প্রত্যাশা করলেও তার সফর শেষে প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহারে ভারতকে ১৯৭১ সালের ৭ ও ২১ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তানের দখল করা ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়ার দাবি ছাড়া ভুট্টোর চীন সফরে প্রাপ্তিযোগ বিশেষ হয়নি। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ত ঘোষণায় পাকিস্তান ও ভারতকে উভয়ের সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি উত্থাপন করা ছাড়া ভারতের বিরুদ্ধে আর কোনোরকম মন্তব্য না থাকায় পাকিস্তান বিশেষ সন্তুষ্ট হয়নি।

তাই মার্চ মাসের মাঝামাঝি ভুট্টোর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে উপমহাদেশের শান্তি স্থাপনে তাদের মধ্যস্থতা করার আহ্বানকে পাকিস্তান গুরুত্বসহ বিবেচনা করে। এ পর্যায়ে পাকিস্তান যে সব দেশের সঙ্গে জানুয়ারি মাসে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল তাদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেয়।

অবশ্য ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বাংলাদেশের কিছু উদ্যোগ কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে আটকেপড়া অবাঙালিদের (বিহারী) জান-মাল রক্ষায় জাতিসংঘের মহাসচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করে পত্র দেয়ার৩২ পরপরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আটক অবাঙালিদের সাথে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের বিনিময়ের প্রস্তাব দেন। যদিও ভুট্টো এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

কারণ ভুট্টোর বিবেচনায় অবাঙালি নয় বরং পাক যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি ছিল জরুরি বস্তুত বিহারীদের ফেরত নিতে তিনি প্রথম থেকেই অনীহা প্রকাশ করে আসছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরকালে মস্কো বাঙালিদের প্রত্যাবাসনে প্রভাব বিস্তারের আশ্বাস দেয়। দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ২৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিবকে পাঠানো এক জরুরি বার্তায় আটক বাঙালিদের প্রত্যাবাসনে তার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

Bhutto and Mujib in Dhaka 1971 as the troops were being amassed
Bhutto and Mujib in Dhaka 1971 as the troops were being amassed

 

মার্চ মাস পর্যন্ত পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তির কাছ থেকে তেমন ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে ভুট্টো সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দেন। বৈঠকের প্রেক্ষাপট রচনার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশে প্রথমে ২৮,২০০ টন চাল এবং দ্বিতীয়-দফায় আরো এক লক্ষ টন চাল প্রেরণের ঘোষণা দেন। এ ক্ষেত্রে ভুট্টো সরাসরি বা মিত্র দেশের মাধ্যমে বৈঠকের উদ্যোগ নেন। ঐক্য প্রস্তাবকে আড়ালে রেখে বৈঠকের ওপর জোর দেয়ার মূল কারণ ছিল স্বীকৃতির আগে মুজিবের সঙ্গে বৈঠক হলে পাকিস্তানে তার জন্য সেটা কূটনৈতিক বিজয়স্বরূপ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হত।

এ ছাড়া বিরোধী দলের বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে জাতীয় পরিষদের অনুমোদনের আগে দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হলেও সেটা তার নিজের দেশে ভুট্টোর ইমেজ বাড়াতে সাহায্য করত। দেশবাসীর কাছে ভুট্টো তাহলে এটা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হতেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ সঙ্গে তার সরকার সব সময় যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে’ ৩৪ দ্বিতীয়, ভারতকে উপেক্ষা করে প্রস্তাবিত এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে ভারতের ওপরও পাকিস্তানের কূটনৈতিক বিজয় সূচিত হত।

Lieutenant General Amir Abdullah Khan Niazi, signing the Treaty of Surrender on December 16, 1971
Lieutenant General Amir Abdullah Khan Niazi, signing the Treaty of Surrender on December 16, 1971

 

ভুট্টো তার এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের প্রস্তাব দেন এবং বলেন, এই বৈঠকের পরপরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে।৩৫ যদিও ভুট্টোর এ প্রস্তাব এবং ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়া ও জাপানের মধ্যস্থতায় দেয়া এ জাতীয় বৈঠকের প্রস্তাব বাংলাদেশ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে।৩৬ বস্তুত ভুট্টো এ সময় উল্লিখিত বৈঠককে কেন্দ্র করে রীতিমত কূটনীতির আশ্রয় নেন।

২ মার্চ গার্ডিয়ান পত্রিকার পিটার প্রেটনকে (Peter Preton) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো মার্চ মাসের শেষ অথবা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে একতরফাভাবে মুজিব ও ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের ঘোষণা দেন। অথচ এই বৈঠক সম্পর্কে বাংলাদেশ ও ভারত কিছুই জানত না। ভুট্টোর বক্তব্য থেকে এটাই বোঝা যায় যে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পরের দিন জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আবারো বলেন, তিনি আশাবাদী, ভারতের সঙ্গে শীঘ্রই তার বৈঠক হবে এবং এরই ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবের সঙ্গেও বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।৩৭ তার এই বক্তব্য থেকে অবশ্য আগের দিনের বক্তব্যের ফাঁকটি বেরিয়ে আসে।

১৫ মার্চ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে বৈঠকের উদ্যোগ নেয়া হবে এবং প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে তার সম্মতি দিয়েছেন। অথচ মার্চ মাসে পাকিস্তান সফররত ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব স্যার ডগলাস হিউম পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ ভাষ্য অস্বীকার করেন এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে উপমহাদেশের তিনটি দেশ নিজেরাই তাদের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হবে।৩৮ এ সময় জাপান সরকারও অনুরূপ মন্তব্য করে। এই বৈঠকজনিত উদ্যোগের পাশাপাশি পাকিস্তান ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বাংলাদেশে মুসলিম বাংলা’ আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য দিতে থাকে। পাকিস্তান রেডিওতেও এর পক্ষে বক্তব্য দেয়া হয়।

Mujib and Bhutto
Mujib and Bhutto

বাংলাদেশকে মুসলিম বাংলা আখ্যা দেয়ার পেছনে ভুট্টোর বেশ কিছু উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ কিংবা ‘পূর্ব পাকিস্তান’, ‘ঢাকা কর্তৃপক্ষ’ আখ্যা দিলেও প্রায় অর্ধশতাধিক দেশের স্বীকৃতির পর ‘বাংলাদেশ’ নাম ব্যবহার করা হলে আন্তর্জাতিক চাপ আসতে পারে বলে ভুট্টো ‘মুসলিম বাংলা’ নাম ব্যবহার করা যুক্তিসঙ্গত মনে করেন। দ্বিতীয়ত, সরাসরি ‘বাংলাদেশ’ নাম ব্যবহার করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দেয়া, যা ভুট্টোর পাকিস্তানের ঐক্যের সম্ভাবনাকে নষ্ট করতে পারে।

সবশেষে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাফল্যে মুক্তিকামী সিন্ধি, বেলুচ ও পাঠানরা যাতে উৎসাহিত না হয় সে কারণে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। সিন্ধুতে ১৯৭২ সালের জুন-জুলাই মাসে ভাষা দাঙ্গা শুরু হলে ভুট্টো মন্তব্য করেন,

যারা বিছিন্নতাবাদের কথা চিন্তা করছে, তাদের বাংলাদেশের পরিণতি দেখে শিক্ষা লাভ করা উচিত। “৩৯

ভুট্টো বাংলাদেশ ও লন্ডনে মুসলিম বাংলা আন্দোলনকারীদের যে আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন তার জীবনীকার উলপার্ট ও পাকিস্তানের সাপ্তাহিক ‘স্পটলাইট’ সেটা উল্লেখ করে। ‘স্পটলাইট’-এর ১৯৭৪ সালের ২৬ আগস্ট সংখ্যায় বাংলাদেশবিরোধী ভুট্টোর ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এই নব্য স্বাধীন দেশটি যাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল না হতে পারে এবং পাশ্চাত্যের সাহায্যকারী দেশগুলোর সহানুভূতি ও সাহায্য যাতে না পায় সে জন্য ভুট্টো সরকার পাকিস্তানের বৈদেশিক দূতাবাসের মাধ্যমে প্রচারকাজে চার কোটি টাকা ব্যয় করে।৪০

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ হলেও এ সব দলের নেতাদের অনেকে মওলানা ভাসানীর ভারতবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন নামে ও ব্যাপারেও এদের অনেকে ‘মুসলিম বাংলা’ নামে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা শুরু করে। ভুট্টো এভাবে একদিকে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালান অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে আগ্রহ দেখান।

১৯৭২ সালের মধ্য মার্চ মাসে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হলে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারে বেশি আশাবাদী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার মধ্যস্থতায় তাই এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি বৈঠকের প্রস্তাব দেয়া হয়। ৪১ যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়ার প্রস্তাবকে ‘অসমর্থনযোগ্য উপদেশ’ অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন।৪২ জুন মাসে ইথিওপিয়ার মাধ্যমে বৈঠকের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

এপ্রিল মাস থেকে পাকিস্তানের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার মূল কারণ ছিল জুন মাসে আসন্ন সিমলা বৈঠক এবং এই বৈঠককে সামনে রেখে মুজিবের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো, যাতে পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির মাধ্যমে ভারতের ওপর কূটনৈতিক বিজয় অর্জন করা যায়। ইতোমধ্যে যুদ্ধবন্দি ইস্যুতে বাংলাদেশের বক্তব্য থেকে পাকিস্তানের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ভারত নয়, বাংলাদেশই যুদ্ধবন্দিদের আটক রেখে সুবিধা আদায়ে বেশি পক্ষপাতী।

এ কারণে পাকিস্তান জুন মাসের প্রথম থেকে সতর্কতা অবলম্বন করে এবং পাকিস্তানের একজন মুখপাত্র ১ জুন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, শেখ মুজিব সিমলা বৈঠকে যোগ না দিলে আমরা আলোচনা ভেঙে দেবো। সে ক্ষেত্রে আমরা ভারতকে জানিয়ে দেবো আমরা অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। মুজিব কখন বৈঠকে যোগ দিতে চান, শুধু সে কথাটিই আমাদের জানিয়ে দেবেন।৪৩

পাকিস্তানের সঙ্গে স্বীকৃতির আগে বৈঠকের জন্য চাপ সৃষ্টিই ছিল এ ধরনের হুমকির উদ্দেশ্য। কিন্তু ১৯ জুন রয়টার প্রতিনিধি গোরাল্ড র‍্যাপজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, স্বীকৃতির আগে তার পাক-ভারত শীর্ষ বৈঠকে যোগদানের কোনো সম্ভাবনা নেই।৪৪ যদিও ২৩ জুন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের মধ্যস্থতায় পাক-ভারত বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হতে থাকে।

মার্চ মাসে পাকিস্তান সফরকালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈঠকের কথা ব্রিটেন অস্বীকার করলেও কূটনৈতিক মহল তার বাংলাদেশ সফরকে বৈঠকের ব্যাপারে তার উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বলে অভিহিত করেন।

এই সফরের সময় ভুট্টো ব্রিটেন, ইরান, তুরস্ক ও মিসরের মধ্যস্থতার কথা উল্লেখ করেন। পাশাপাশি এও বলেন, ভারত ছাড়া যে কোনো দেশে মুজিব-ভুট্টো শীর্ষ বৈঠকে তিনি রাজি আছেন। ৪৫ অথচ ব্রিটেন ছাড়া এ সব দেশের কেউ তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতিই দেয়নি। ব্রিটিশ সচিবের সফরকালেই ভুট্টো জুলাই মাসের মধ্য বা শেষপাদে শীর্ষ বৈঠকের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এর থেকেই ধারণা করা যায়, ব্রিটিশ সচিবের সফরকে কেন্দ্র করে একটি কূটনৈতিক উদ্যোগের চিন্তাভাবনা হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টোর এই বৈঠকের ঘোষণাকে ভিত্তিহীন বা কল্পনাপ্রসূত বলে উড়িয়ে দেন। ৪৬

Sheikh Mujibur Rahman making his way through a sea of supporters in Lahore while he was still a Pakistani
Sheikh Mujibur Rahman making his way through a sea of supporters in Lahore while he was still a Pakistani

২৮ জুন থেকে সিমলায় পাক-ভারত বৈঠক শুরু হয় এবং ২ জুলাই সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ অবশেষে সিমলা বৈঠকে অংশ না নেয়ায় বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট বিষয় যেমন যুদ্ধবন্দি ইস্যুতে আলোচনা হয়নি। তবে ভুট্টো ইন্দিরা গান্ধিকে আশ্বাস দেন যে, পাকিস্তান খুব শীঘ্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। যদিও পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ভুট্টো স্রোতের বিপরীতে চলতে শুরু করেন। গোপন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া-সংক্রান্ত বিরোধী দলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৩ জুলাই ভুট্টো বলেন,

আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি, চুক্তি তো দূরের কথা, ভারতের মাটিতে আমি ‘বাংলাদেশ’ শব্দটিই উচ্চারণ করিনি।

এর মধ্য দিয়ে স্বীকৃতির পরিবর্তে তিনি পুনরায় পাকিস্তানের ঐক্যের প্রচারণায় নামেন। ১৫ জুলাই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ভুট্টো বলেন, মুজিব সব সময়ই ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী। তবে তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের কামনাও অসম্ভব নয়। ২১ জুলাই এক জনসভায় তিনি বাংলাদেশকে আবারো পাকিস্তানের অংশ বলে দাবি করেন। এ সময় ইন্দোনেশিয়ার মাধ্যমে পুনরায় মুজিব-ভুট্টো শীর্ষ বৈঠকের চেষ্টাও চালানো হয়।

১৯ থেকে ২১ জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়া সফরকালে প্রেসিডেন্ট সুহার্তো ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আদম মালিক পুনরায় বৈঠকের এ প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা প্রত্যাখ্যান করেন।৫০ এ ছাড়া এ সময় ভুট্টো যে কোনো পূর্বশর্ত ত্যাগ করে মুজিবকে বৈঠকের প্রস্তাব দেন। কারণ, তার মতে, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের স্বার্থেই এই বৈঠক অতি জরুরি।৫১

অবশ্য আগস্ট মাসে বাংলাদেশের জাতিসংঘভুক্তিকে সামনে রেখে পাকিস্তান আবারও বৈঠকের প্রস্তাব নিয়ে কূটনীতি শুরু করে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং যুক্তরাজ্যের মাধ্যমে পাকিস্তান বৈঠকের উদ্যোগ নেয়। এ সময় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সফরকালে ভুট্টোর বিশেষ দূত ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এম. কে. জাতোই এই দুটি দেশের মাধ্যমে মুজিব ভুট্টো বৈঠকের উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে পাক-চীন ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন।৫২

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেলে পুনরায় তৃতীয় দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়ে পাকিস্তানের কূটনৈতিক মহলে আশার সঞ্চার হয়। ২৮ জুলাই লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকা এক রিপোর্টে উল্লেখ করে, চিকিৎসার জন্য মুজিব যখন লন্ডনে যাবেন, তখন তার সঙ্গে ভুট্টোর বৈঠক হবে এবং এর আগে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। পত্রিকার করাচিস্থ প্রতিনিধি তথ্যমন্ত্রী কায়সার নিয়াজির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। পত্রিকাটি মুজিবের লন্ডন গমনকে একটি ‘কূটনৈতিক প্রয়াস’ হিসেবে মন্তব্য করে এবং ঐ মন্তব্যে বলা হয়, মুজিব ইচ্ছাকৃতভাবে মস্কোর আমন্ত্রণ প্রত্যান করে লন্ডনে তার অপারেশন করছেন।

বৈঠকের ব্যাপারে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ন উদ্যোক্তা হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।৫৩ এই রিপোর্ট ছাপার পরপরই মুক্তির এক বিবৃতিতে একে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেন এবং পুনরায় দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আগে স্বীকৃতি, তারপর ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক হতে পারে।৫৪

এ সময় বাংলাদেশের একজন সরকারি মুখপাত্র আরো পরিষ্কারভাবে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন গমনের পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। শুধু চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডন যাচ্ছেন। মস্কোতে তার চিকিৎসার জন্য রুশ নেতাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে পাশ্চাত্যের কিছু সংবাদপত্রের খবর সম্পর্কে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর মস্কো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, চিকিৎসকের পরামর্শে আগেই তার লন্ডন যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ৫৫

প্রকৃতপক্ষে লন্ডনে মুজিব-ভুট্টো বৈঠকের খবরটি ছিল পাকিস্তানের একটি কূটনৈতিক চাল। পাশ্চাত্যের পত্রপত্রিকা ছাড়াও বিবিসি এবং পাকিস্তানের পত্রিকায় এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। এর পেছনে পাকিস্তান সরকারের যে হাত ছিল, ভুট্টোর বক্তব্য থেকে সেটা বোঝা যায়। তিনি বলেন, পাকিস্তান উপমহাদেশে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চায়। মুজিব লন্ডনে অবস্থানকালে পাকিস্তানের সেই সদিচ্ছাকে ভ্রান্তভাবে উপস্থাপিত। করেছেন।৫৬

শেখ মুজিব লন্ডনে অবস্থানকালে ভুট্টোর এ সব উদ্যোগ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনীহার কারণেই সফল হতে পারেনি। কিন্তু ভুট্টো এ সময় মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং পাকিস্তান নৃত্যবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালান। ২৪ আগস্ট লন্ডনের টেলিগ্রাফ। পত্রিকার প্রতিনিধি পিটার গিল তার এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, লন্ডনস্থ পাকিস্ত দূতাবাসের মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে যে বাংলাদেশের আয়ু হবে ক্ষণস্থায়ী এবং অচিরেই বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রিত হবে।৫৭

মুজিবের লন্ডন সফরকালে ১৭ আগস্ট এক দল লোকের তার ক্লিনিকের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন, স্বাধীনতাবিরোধী স্লোগান উচ্চারণ এবং মুজিবকে উদ্দেশ করে একটি লিফলেট বিতরণসহ এ জাতীয় নানা তৎপরতা থেকে মনে হয় যে, এর পেছনে পাকিস্তানের যোগসাজশ ছিল। অবশ্য পাকিস্তান এখানেই ক্ষান্ত দেয়নি। লন্ডন থেকে শেখ মুজিব ২১ আগস্ট জেনেভা গেলে সেখানে ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য একজন দূত পাঠান। ৫৯ দৃতের নাম ও বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে কোনো সূত্র থেকে কোনো কিছু জানা না গেলেও আগস্ট মাসে ভুট্টোর এই অতি উৎসাহী মনোভাবের কারণ চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। ৮

আগস্ট জাতিসংঘ সদস্যভুক্তির জন্য বাংলাদেশ আবেদন করলে ভুট্টো এ সময়টিকে তার কূটনৈতিক তৎপরতার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেন। মুজিব যাতে বৈঠকে রাজি হন সেই লক্ষা থেকে ১০ আগস্ট জাতিসংঘে চীনের বিরোধিতার মাধ্যমে মৃদু হুমকি দেয়া হয়। এ সময় পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় এই মর্মে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় যে, যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দেয়া না হলে চীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করবে। মুজিবের লন্ডনে অবস্থানকালে ভুট্টোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ২৫ আগস্ট চীন ভেটো প্রদানের মাধ্যমে পাকিস্তানের হুমকির বাস্তব রূপ দেয়। এর তিনদিন পর অর্থাৎ ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ দালাল আইন সংশোধন করে দালালদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে।

Zulfikar Ali Bhutto at one of the several United Nations Security Council meetings ahead of the fall of Dhaka.
Zulfikar Ali Bhutto at one of the several United Nations Security Council meetings ahead of the fall of Dhaka.

১৯৭২ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অগ্রগতি হয়নি বরং সেটা ১৯৭১ সালের পর্যায়ে নেমে আসে। ২৯ আগস্ট ঢাকায় চীনের ভেটো প্রয়োগের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তান ও চীনের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। ফলে একদিকে যেমন পাকিস্তানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার এত দিনের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়, অন্যদিকে দুটি দেশের মধ্যে সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারটিও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়ে।

এভাবে দুটি দেশের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধির ফলে অমীমাংসিত ইস্যুতে মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যস্থতাকে গুরুত্ব দিলেও পাকিস্তান বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি। পাকিস্তান আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছিল ভারত ছাড়া যে কোনো জায়গায় মুজিবের সঙ্গে ভুট্টো বৈঠকে রাজি আছে। অবশ্য ভারতও তার জাতীয় স্বার্থেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয়ের চেয়ে পাক-ভারতের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনায় বেশি আগ্রহ দেখায়।

সোভিয়েত আগ্রহের কারণে বিজয়ী শক্তি হয়েও ভারত সিমলা চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের অধিকৃত এলাকা ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের নৈকট্য কামনা করেছে। অথচ, রাজনৈতিক কারণে এ বিষয়টি আরো দীর্ঘায়িত করলে দেনদরবারে ভারত ও বাংলাদেশ অধিক লাভবান হতে পারত। বস্তুত স্বীকৃতি দেয়ার আগে কোনো বৈঠকের ব্যাপারে বাংলাদেশের অনীহার কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো বৈঠকের সম্ভাবনা দেখা দেয়নি।

অবশ্য জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে পিকিংপন্থী ন্যাপের সভাপতি মওলানা ভাসানীকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার একটি সম্ভাবনা দেখতে থাকে। পিকিংপন্থীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানের ‘মুসলিম বাংলা’ আন্দোলনের প্রসার ঘটানোর কথা উলপার্ট বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এপ্রিল মাস থেকে বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নামে বাংলাদেশবিরোধী লিফলেট বিলি করা হয়।

পাকিস্তানের পত্রিকায় ভুট্টোর আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী সংবাদ গুরুত্বসহ ছাপা হয়। তবে মওলানা ভাসানীকে দেয়া ভুট্টোর ৮ জুলাইয়ের চিঠি এবং তাকে পাকিস্তান সফরে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি বাংলাদেশে বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়। বাংলাদেশ সরকারকে এড়িয়ে ভুট্টো কিসের ভিত্তিতে মওলানা ভাসানীকে আমন্ত্রণ জানান সেটা স্পষ্ট না হলেও ভুট্টো যে মওলানা ভাসানীকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, সে কথা বোঝা যায়। উল্লিখিত চিঠিতে ভুট্টো মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠায় ভাসানীর সাফল্য কামনা করেন। ৬০

অবশ্য ২৬ জুলাই টাঙ্গাইলের সন্তোষে ভাসানী সাংবাদিকদের জানান যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে দিলেই শুধু তার পাকিস্তান সফর সম্ভব হতে পারে।৬১ এই বক্তব্য থেকে ভাসানীর সঙ্গে ভুট্টোর পত্র বিনিময়ে ভারতীয় সূত্রের সমর্থন মেলে। পরবর্তী মাসে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে চীনের ভেটো প্রয়োগের পরের দিন ভাসানীর ‘বৃহত্তর বাংলা’ গঠনের আহ্বান তাকে নতুন করে বাংলাদেশবিরোধী প্রবণতায় জড়িয়ে ফেলে। এতে বলা হয়, প্রস্তাবিত বৃহত্তর বাংলা রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হবে বাংলাদেশের ১৪টি জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাসহ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল। ৬

২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও মওলানা ভাসানী বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার হুমকি দেন।৬০ অথচ, এই দাবি ছিল বাংলাদেশের সংবিধান ও স্বাধীনতার পরিপন্থী। ৬৪ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ বিক্ষিপ্তভাবে এর বিরুদ্ধে মন্তব্য করলেও জোরালো কোনো প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা তোফায়েল আহমদ ১৩ সেপ্টেম্বর মন্তব্য করেন যে, বৃহত্তর বাংলা স্লোগানের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বে চিড় ধরিয়ে নবীন বাংলাদেশকে বন্ধুহীন ও দুর্বল করে ফেলা ।৬৫

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কথিত বৃহত্তর বাংলা আন্দোলনকে ভুট্টোর মুসলিম বাংলা আন্দোলনের সংস্করণ বলে মন্তব্য করে। অবশ্য ভাসানীর একটি মন্তব্য এর পেছনে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। ‘হুকুমতে রব্বানী’-এর জনসভায় তিনি বলেন, যারা মুসলিম বাংলার জন্য কাজ করছে, তাদের জন্য আমি দোয়া করি। আল্লাহর রহমতে তারা জয়যুক্ত হবে। ৬৬ অবশ্য ভারত বিদ্বেষের পাশাপাশি ভারতের কিছু অঞ্চলকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্তি-সংক্রান্ত ভাসানীর এই বাস্তবতাবিবর্জিত প্রস্তাবটি বাংলাদেশে বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করলেও পাকিস্তানের গণমাধ্যম এবং স্বয়ং ভুট্টোর কাছে এই ঘোষণা ব্যাপক আশার সঞ্চার করে।

Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman with Soviet Premier Alexei Kosygin in Moscow, March 1, 1972
Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman with Soviet Premier Alexei Kosygin in Moscow, March 1, 1972

 

বিরোধী দলগুলোর মাধ্যমে মুজিববিরোধী আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা এবং মুসলিম বাংলা আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে সাহায্য করলেও একজন প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজ্ঞ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ভুট্টো বুঝতেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার একমাত্র ন্যায়ানুগ কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন শেখ মুজিব সরকার। তাই আগস্ট মাসের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতার রেশ কাটিয়ে ভুট্টো নতুনভাবে উদ্যোগ নেন। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফরকালে ইন্দোনেশিয়ার মধ্যস্থতায় ভুট্টো-মুজিব শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তাব আবার দেয়া হয়।

শীর্ষ বৈঠক সম্ভব না হলে সচিব বা দূত পর্যায়ে বৈঠকের প্রস্তাবও পাকিস্তান দেয়। সেপ্টেম্বর ৭ তারিখে বোম্বের সাপ্তাহিক Blitz-এর সম্পাদক পি. কে. কারাঞ্জিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আগে মুজিবের সঙ্গে বৈঠকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, আমরা বৈঠক শুরু করলে স্বীকৃতির বিষয়টি এমনিতেই এসে যাবে। আলোচনার ফলাফল যাই হোক না কেন, আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবই। স্বীকৃতি বৈঠকের সাফল্য বা ব্যর্থতার ওপর কিংবা বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করল কিনা, তার ওপর নির্ভরশীল নয়। এ জন্যই মুজিবকে বৈঠকের প্রস্তাব দিচ্ছি। ধরে নেয়া যায় এটি স্বীকৃতির আগের পর্যায়।

এরপরও বাংলাদেশ বৈঠকের ব্যাপারে তার আগ্রহ দেখায়নি। বরং জেনেভা থেকে দেশে ফেরার পথে নয়াদিল্লিতে যাত্রাবিরতিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকানুষ্ঠানে ১৪ সেপ্টেম্বর পরিষ্কার ভাষায় বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আগে ভুট্টোর সঙ্গে কোনো সাক্ষাৎ হতে পারে না। তবে ১৮ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কগত বিষয় আলোচনার জন্য তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতাকে স্বাগত জানান।

যদিও সেপ্টেম্বর মাসে এ ক্ষেত্রে কোনোরকম অগ্রগতি সাধিত হয়নি। বরং সেপ্টেম্বর ২২ তারিখে গার্ডিয়ান পত্রিকার (লন্ডন) এক রিপোর্টে ৩২ হাজার বাঙালি দালালের গ্রেপ্তার, ডেইলি টেলিগ্রাফের (লন্ডন) ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ৫ হাজার দালালের বিচার কার্যক্রম শুরু এবং অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশ সরকারের গ্রেপ্তার করা দালালের সংখ্যা ৪১ হাজারে উন্নীত হওয়ার ঘোষণায় পাকিস্তান রীতিমত বিচলিত হয়। ভুট্টো পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আটক বাঙালিদের বিচারের হুমকি দেন। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি জাতিসংঘের মহাসচিব ও আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সভাপতির কাছে জরুরি তারবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব আটক বাঙালিদের প্রশ্নে তার সাহায্য কামনা করেন এবং এই আবেদনের প্রেক্ষিতে ২২ অক্টোবর মহাসচিবের প্রতিনিধি স্যার রবার্ট জ্যাকসন পিন্ডিতে উপস্থিত হন।

British Prime Minister Edward Heath receives the First President of Bangladesh Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman at 10 downing street (January, 1972)
British Prime Minister Edward Heath receives the First President of Bangladesh Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman at 10 downing street (January, 1972)

 

অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা সত্ত্বেও তৃতীয় সপ্তাহে দুজন পাকিস্তানী সাংবাদিক মাজহার আলী খান ও সৈয়দ নাজিউল্লাহ বাংলাদেশ সফরে আসেন। বেসরকারি হলেও স্বাধীনতার পর এই প্রথম পাকিস্তানের কোনো প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসেন। তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যদিও বেসরকারি পর্যায়ে তাদেরকে যোগাযোগের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। মুজিব তাদের জানান, একমাত্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নেয়ার পরই সমতার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বৈঠক হতে পারে।৬৭

পাকিস্তান ফিরে গিয়ে ডন পত্রিকার সম্পাদক মাজহার আলী খান একাত্তরে বাঙালিদের ওপর পরিচালিত পাকবাহিনীর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতির পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে অতি উৎসাহের কারণে নভেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার ডন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে দেয়। অবশ্য নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তান সরকার আটক ২৪০ জন বাঙালি হাজিকে মুক্তি প্রদান করে এবং এর পরপরই বাংলাদেশ ভারতে আটক পাকিস্তানী সামরিক বন্দি পরিবারবর্গকে মুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়।

এ মাসের ১৮ তারিখে বাংলাদেশের জাতিসংঘে সদস্যভুক্তির ব্যাপারে ২২ জাতির পক্ষ থেকে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে নিউইয়র্কে বৈঠকের জল্পনাকল্পনা চলতে থাকে। ১৬ নভেম্বর নিউইয়র্ক পোস্ট-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো এ রকমই আভাস দেন। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর সত্যতা অস্বীকার করেন। ৬৮

অবশ্য বাংলাদেশের বেসামরিক পরিবারবর্গের মুক্তি ঘোষণার বিপরীতে এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানে আটক ১০ হাজার বাঙালি শিশু ও মহিলাকে মুক্তি দেয়ার বিষয়ে ভুট্টোর ঘোষণাকে দুটি দেশের বরফ গলার সূত্রপাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ মাসের ২৯ তারিখে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দানের প্রশ্নে সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিজয়ের সূচনা করে।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman takes oath as the Prime Minister of a free and independent Bangladesh, January 12, 1972
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman takes oath as the Prime Minister of a free and independent Bangladesh, January 12, 1972

 

বাহাত্তরের ডিসেম্বর মাসে ভুট্টো বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করেন। এই মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশ সরকার ২৫০ জন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দির বিচারের সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তান এর প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানের একজন সরকারি মুখপাত্র একে জেনেভা কনভেনশনের পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন।৬৯ পাকিস্তান এর বিপরীতে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের বিচারের হুমকি দেয়। এই হুমকিকে কেন্দ্র করে দুটি দেশের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলতে থাকে। পাশাপাশি ভুট্টো স্বীকৃতির আগে মুজিবের সাথে তার বৈঠকের উদ্যোগ অব্যাহত রাখেন।

১০ ডিসেম্বর মার্কিন সাময়িকী নিউজ উইককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মুজিবের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দেন। এর দুদিন পর সিবিএস টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশকে যথাসময়ে স্বীকৃতি প্রদানের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তবে স্বীকৃতির আগে তিনি মুজিবের সঙ্গে ‘তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার’ ওপর জোর দেন। ৭০ অবশ্য নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস থেকে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারটি যে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির পূর্বশর্ত, সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করে স্বীকৃতির পক্ষে সীমিত আকারে বক্তব্য দিতে থাকেন।

১৯৭২ সালের মধ্যে প্রায় ১০০টি দেশের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ, ৩০ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বাংলাদেশকে সদস্যপদ দানের সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়াই যে উপমহাদেশের সমস্যা সমাধানের পথ, পাকিস্তানের কাছে সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। যদিও ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসে কূটনৈতিক রীতি অনুযায়ী পাকিস্তান কোনো বাণী পাঠায়নি। বরং পাকিস্তানে সে দিন পূর্ব পাকিস্তান দিবস পালিত হয়।

জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগসহ বিভিন্ন দল ও তাদের ছাত্র সংগঠন দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালন করে। ৭১ সরকারি দল পিপিপি দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন না করলেও এ দলেরও মনোভাব ছিল অন্যান্য দলের মতই। এ সব দল কার্যত পূর্ব পাকিস্তান হারানোর দুঃখজনিত স্মৃতি রোমন্থন এবং পাকিস্তানের পুনঃএকত্রীকরণের জন্য তাদের মতামত ব্যক্ত করে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাকিস্তান ও পাকিস্তানী বাহিনীর ধ্বংসলীলা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা চলতে থাকে। পত্রিকার ক্রোড়পত্র, রেডিও এবং টিভির অনুষ্ঠানে পাকবাহিনীর নির্যাতন-গণহত্যা তুলে ধরা হতে থাকে। ভুট্টো ও পাকিস্তানীদের একত্রীকরণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে ২৫ ডিসেম্বর শেখ মুজিব ভুট্টোকে বাংলাদেশে এসে পাকবাহিনী সাধিত হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্নাদি সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার আহ্বান জানান। ৭২ এর প্রতিক্রিয়া ভুট্টো পরের দিন ব্যক্ত করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুজিবের সঙ্গে তার বৈঠকে মুজিবের ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী হিসেবে অভিহিত করেন। ৭৩

তবে ১৯৭২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে প্রদত্ত বিভিন্ন বক্তব্যে বাংলাদেশ যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগের চেয়ে আগ্রহী, সেটা বোঝা যায়।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman takes oath as the Prime Minister of a free and independent Bangladesh, January 12, 1972
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman takes oath as the Prime Minister of a free and independent Bangladesh, January 12, 1972

 

নভেম্বর মাসের শেষ দিকে শেখ মুজিব এক ভাষণে বলেন, পাকিস্তান যদি তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়, তাহলে বাংলাদেশ হয়ত ক্ষমা করে দিতেও পারে। ৭৪ এই মন্তব্য যুদ্ধবন্দিদের লক্ষ্য করে বলা হয়েছে কিনা সে কথা স্পষ্ট করে বলা না হলেও এর থেকে মনে হয় যে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য ছাড় দিতে রাজি। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ভারত সফরকালে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ৭৫ কিন্তু পাকিস্তানের স্বীকৃতির আগে বৈঠকের ব্যাপারে বাংলাদেশ তার আগের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।

১৭ ডিসেম্বর করাচি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আকবর-ই-জাহানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসের সাধারণ নির্বাচনের পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা ঘোষণা করেন। ভুট্টো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির ব্যাপারে আস্থাশীল থেকেই এই সিদ্ধান্তে আসেন। ফলে দুটি দেশের কাছাকাছি আসার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা নষ্ট হয়ে যায়।

এ ছাড়া ১ ডিসেম্বর পাকিস্তান সরকার গৃহীত অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করে একটি ধারা সংযোজন করলে দুটি দেশের মধ্যকার তিক্ততাকে সেটা আরো বাড়িয়ে তোলে। এতে বলা হয় যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশী আগ্রাসনের অবসান হলে প্রদেশটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ৭৬

পাকিস্তানের এই ধৃষ্টতা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি এক অপমানজনক অভিব্যক্তিস্বরূপ এবং দেশটির এই মানসিকতার জন্য সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ, ইতোমধ্যে স্বাধীনতার এক বছর তখন পূর্ণ এবং ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ তার সংবিধান গ্রহণ করে সাংবিধানিকভাবেও পাকিস্তানের সঙ্গে ছিন্ন করেছে যাবতীয় সম্পর্ক।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, London, on his return to Bangladesh 1972
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, London, on his return to Bangladesh 1972

১৯৭২ সাল পর্যন্ত দুটি দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ায় এবং পাশাপাশি বাংলাদেশ উল্লিখিত সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে তাকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়ায় দুটি দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি বা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়নি। পাকিস্তান বরং আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতার নীতি গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক দলগুলো বিভিন্ন নামে পিকিংপন্থী দলগুলোর ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগ, ভারত ও স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড শুরু করে। সেপ্টেম্বর মাসে মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি সংবলিত মুসলিম বাংলার গেরিলা ফৌজের স্বঘোষিত অধিনায়ক জেনারেল হাবিব খানের একটি ইশতেহার বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লোকের নামে ডাকযোগে পাঠানো হয়।

ভাসানী বৃহত্তর বাংলা আন্দোলনের নামে মুসলিম বাংলা আন্দোলনকে সমর্থনের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে দলে টানার চেষ্টা করেন। প্রকাশ্য জনসভায় তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি ছাড়াও ১৯৭২-এর ২৫ ডিসেম্বর সন্তোষে ইমাম ও মুসল্লিদের এক সম্মেলনে ইসলামী শিক্ষা ও সংবিধান প্রবর্তনের দাবি জানান। দৈনিক আজাদ এই সম্মেলনকে মূলত ইমাম ও মুসল্লি সম্মেলনের ব্যানারে বেআইনি ঘোষিত দলগুলোর সম্মেলন বলে মন্তব্য করে। এতে মূলত আল-বদর, রাজাকার, আল-শামস ও মুজাহিদরা যোগ দেয়।

এই সম্মেলনে পাকিস্তান আমলের মত ইমামদের সরকারি ভাতা দেয়ার দাবি জানানো হয়। নির্বাচন সামনে রেখে স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্মেলন ও সমর্থন লাভই তার এই উদ্যোগের মূলে কাজ করে। ভাসানীর এই উদ্যোগ ও আওয়ামী লীগবিরোধী তৎপরতা থেকে ভুট্টো এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আওয়ামী লীগবিরোধীদের ভোটের বড় অংশ ভাসানীসহ পিকিংপন্থীদের বাক্সে যাবে। ভাসানী তথা আওয়ামী লীগবিরোধীদের কথিত জয়লাভে আশান্বিত হয়েই ভুট্টো নির্বাচন পর্যন্ত স্বীকৃতি পিছিয়ে দেন।

নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ভুট্টোর এ সব উদ্যোগ ছাড়াও নভেম্বর মাসে রেডিও পাকিস্তানে প্রচারিত এক কথিকায় ভাসানীসহ যারা আওয়ামী লীগবিরোধী তৎপরতায় জড়িত, তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামী ভাবধারা প্রতিষ্ঠার উপদেশ দেয়া হয়। ৭৮ এ ছাড়া ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর একটি অঙ্গসংগঠন আজান-ই-হক বাংলাদেশের আশেপাশে কোথাও প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তান সরকার গঠনের সুপারিশ করে। এই সরকার গঠনের জন্য তারা চীন সীমান্ত অথবা আসামের কাছাকাছি কোনো জায়গাকে উপযুক্ত মনে করে।

শুধু তাই নয়, সংগঠনটি উল্লিখিত সরকারের নিজস্ব রেডিও স্টেশন ও পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারবিরোধী তৎপরতা চালানোর সুপারিশও করে। ৭৯ পাকিস্তানের পত্রিকায় এই দলগুলোর পক্ষে রিপোর্ট প্রকাশ অব্যাহত থাকে। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের আন্তরিকতা সত্ত্বেও পাকিস্তান তাই স্বীকৃতির প্রশ্নে পিছিয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ স্বীকৃতির আগে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে অনীহা প্রকাশ করলেও বন্ধুদেশ ভারত উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ হয়ত স্বাগত জানাত। কিন্তু ভারত নিজস্ব নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক ও জাতীয় স্বার্থের কারণে উদ্যোগ নেয়নি।

এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারলেও ১৯৭২ সালে তার কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে ১৯৭৩ সালের গোড়ার দিকে জাতিসংঘ উদ্যোগ নেয়।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman speaks at a crowded press conference at London’s Claridge’s Hotel hours after his arrival in London on January 8, 1972
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman speaks at a crowded press conference at London’s Claridge’s Hotel hours after his arrival in London on January 8, 1972

 

১৯৭৩ সালের প্রথম থেকেই ১৯৭১-৭২ সালের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক অতিবাহিত হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের সরকার ও ভারতবিরোধী তৎপরতার সঙ্গে পাকিস্তানের পত্রপত্রিকাও যোগ দেয়। বছরের শুরুতেই পাকিস্তান সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘পাকিস্তান টাইমস’ ভাসানীর মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সমর্থন ব্যক্ত করে। পত্রিকায় ভাসানীর প্রশংসা করা হয় এবং ৬ জানুয়ারি এই পত্রিকা ভাসানীর নেতৃত্বের গঠিত বিরোধীদলীয় জোটকে৮০ ‘পাকিস্তানপন্থী ও মুজিববিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। যদিও পাকিস্তান সরকার কৌশলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকে প্রাধান্য দেয়।

বাংলাদেশ বছরের প্রথম থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। জানুয়ারির ২ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি ভাষণে আবার উল্লেখ করে, কোনো চাপই পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত থেকে তার সরকারকে নড়াতে পারবে না।৮১ যদিও এ মাসের ১৭ তারিখে আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তান যদি তার সংবিধান থেকে ‘পূর্বাঞ্চল’ সম্পর্কে গৃহীত ধারা সংশোধন করে, তবে যুদ্ধাপরাধী ছাড়া সকল পাকিস্তানী বন্দিকে বাংলাদেশ ছেড়ে দিতে রাজি আছে। ৮২

১৯৭২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে যে ছাড় দিতে চেয়েছিলেন, আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে তার প্রতিফলন ঘটে। অবশ্য এর পেছনে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশের বন্দিশিবিরে ৪ জন পাকবন্দির নিহত হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এমনকি ভারতেও যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে প্রতিক্রিয়ার প্রভাব যে কার্যকর ছিল, এটা বলা যায়। এ ইস্যুতে পাকিস্তানের ব্যাপক প্রচারণার ফলে ভারতের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রী গোলাম মোস্তফা জাতোই ২৩ জানুয়ারি জাতীয় পরিষদে যুদ্ধবন্দি ইস্যুটি নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপনের হুমকি দেন। একই মাসের ৩০ তারিখে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী ত্রিদিব রায়ও একই হুমকি দেন।৮৩

অবশ্য তিহাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতিসংঘের মহাসচিবের উপমহাদেশের তিনটি দেশ অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সফরের পটভূমিতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের অগ্রগতি সম্পর্কে অনেক দেশই আশাবাদ ব্যক্ত করে। মহাসচিব নিজেও তার সফরের আগে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনটি দেশের অমীমাংসিত বিষয়ে সফর অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে মন্তব্য করেন।৮৪

বাংলাদেশ সফরকালেও তিনি একই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। অবশ্য ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তার উপমহাদেশ সফরকে সফল বলে অভিহিত করলেও কূটনৈতিক দৃষ্টিতে এবং প্রাপ্তিযোগের দিক থেকে এই সফর তেমন কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। মূল সমস্যা অর্থাৎ পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে তিনি কোনো ভূমিকা রাখেতে পারেননি। অথচ তার সফরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান স্বীকৃতি দিলে দেশে ভুট্টোর মুখ রক্ষা করা সম্ভব হত। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও মহাসচিবের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের সুযোগকে নষ্ট করে।

মহাসচিব এ ব্যাপারে মধ্যস্থতার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। তবে মহাসচিবের সফরের কয়েক দিনের মধ্যেই ভুট্টো তার পুরনো লাইনে আবারো বক্তব্য দিতে শুরু করেন। ৪ মার্চ তিনি এক বক্তৃতায় পুনরায় বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ৮৫ অথচ এই বক্তৃতার মাত্র ৩ দিন পরেই বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত ছিল এবং বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অর্জন করেছিল ১০০ দেশের স্বীকৃতি।

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman’s Homecoming

 

অবশ্য, ৭ মার্চ বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ভুট্টোকে হতাশ করে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনসহ ৩০৬টি (মোট আসন ৩৩০) আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ভাসানী ন্যাপ ও জাসদকে সরকারের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে সবাই ধারণা করলেও জাসদ ২টি আসন লাভ করে। এই নির্বাচনে ভাসানী ন্যাপ একটি আসনও পায়নি। একটি পুরনো দল ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ভাসানী ন্যাপের সংগঠন থাকা সত্ত্বেও দলটির বিপর্যয়ের জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মওলানা ভাসানী ও দলটির নেতৃবৃন্দের অসঙ্গতিপূর্ণ ভূমিকাকেই চিহ্নিত করেন।৮৬

নির্বাচনে বিজয়ী হলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাপক দুর্নীতি, খাদ্য ঘাটতি, অরাজকতার ফলে আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার সম্মুখীন হয় এবং বিরোধী দল, বিশেষ করে পিকিংপন্থী ন্যাপ ও জাসদ প্রকাশ্যে এবং স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলো গোপনে আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিরোধিতা করতে থাকে। এ সময় মুসলিম বাংলা আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘দৈনিক বাংলা’ ১৯৭৩ সালের ১৮ মার্চ যে সব আন্দোলনকারী মুসলিম বাংলা কায়েমের জন্য ব্ল্যাক ডিসেম্বর গ্রুপ গঠন করেছে, তাদের সম্পর্কে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের দুদিন পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মালেক উকিল পাকিস্তানী এজেন্টদের পরিচালিত মুসলিম বাংলা আন্দোলনকারীদের বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে প্রাণনাশের হুমকির তথ্য প্রকাশ করেন। তবে নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগবিরোধী তৎপরতা সত্ত্বেও পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করে। যদিও মার্চ মাসে ভুট্টোর বিশেষ দূত পাঞ্জাবের গভর্নর গোলাম মোস্তফা খান ও সেনাপ্রধান জেনারেল টিক্কা খানের ওয়াশিংটন সফর এবং পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের পুনঃপ্রতিশ্রুতি ভারত ও বাংলাদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়।

এপ্রিল মাসের শুরুতে যুদ্ধবন্দিদের বিচারের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ-সংক্রান্ত বিবিসির সংবাদ এবং ৩ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের এ বিষয়ক স্বীকারোক্তি থেকে বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত হয়। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশ যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করে। ঠিক সেই মুহূর্তে ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানের গৃহীত সংবিধানে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। সংবিধানের প্রথমভাগের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, “বিদেশী আগ্রাসনের অবসান হলে সংবিধান সংশোধন সাপেক্ষে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।”৮৭

বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান এবং এখানে বিদেশী আগ্রাসন বলতে ভারতের হস্তক্ষেপকেই বোঝানো হয়েছে, যা পাকিস্তানের অবন্ধুত্বসুলভ ও বাস্তবতাবিবর্জিত মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ছিল। এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিও হুমকিস্বরূপ ছিল। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এর নিন্দা করেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, যেখানে ১০০টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে পাকিস্তান সরকারের বৈরী মনোভাব রীতিমত হতাশাব্যঞ্জক। ৮৮

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman’s Homecoming

 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন একে ‘অশোভন পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেন।৮৯ পাকিস্তানের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে এ রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, জাতিসংঘ মহাসচিবের উপমহাদেশ সফর পাকিস্তানকে তার পূর্বের মনোভাব থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। অথচ পাকিস্তানের এই পদক্ষেপ সত্ত্বেও ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে পাকিস্তানকে উপমহাদেশে মানবিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী ছাড়া ভারতে আটক পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দি, পাকিস্তানে আটক বাঙালি এবং বাংলাদেশে আটক অবাঙালি প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশ এই যুক্ত ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও পাকিস্তান এ ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রতার পথ অবলম্বন করে।

যুক্ত ঘোষণার ভিত্তিতে পাকিস্তান সেই মুহূর্তে এগিয়ে এলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘদিনের বৈরিতার অবসান ঘটতে পারত। এর ফলে স্বীকৃতির প্রেক্ষাপট রচিত হত এবং দুটি দেশের মধ্যে বৈঠকের ভিত্তিতে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানের পথ সহজ হত। পাকিস্তান এ পথে না এসে বাঁকা পথ অনুসরণ করে এবং এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের শুরুতে বাংলাদেশ থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় পরিষদ সদস্যদের নামও সন্নিবেশ করে। মে মাসে পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত জাতীয় পরিষদের বিতর্কে বাংলাদেশের এ সব সদস্যের নাম প্রকাশিত হয়। ১০ অবশ্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বাধীনতার দেড় বছর অতিবাহিত করেছে এবং সংবিধান প্রণয়নসহ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনও সম্পন্ন করেছে।

৪ মে আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তান পাক যুদ্ধবন্দিদের বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরের বিপক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন এবং ৭ মে তথাকথিত ‘মুসলিম বাংলা’ আন্দোলনের কমান্ডার জেনারেল (?) হাবিব খান ও তার ২০ জন অনুসারীর গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্দেহ নতুন করে দেখা দেয়। গ্রেপ্তারকৃতরা তাদের স্বীকারোক্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সংযোগের কথা উল্লেখ করে।১১ যদিও ইসলামাবাদ থেকে এক সরকারি মুখপাত্র মুসলিম বাংলা আন্দোলনের প্রধানের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। ৯২

ভুট্টোর জীবনীকার উলপার্ট, পাকিস্তানের স্পটলাইন পত্রিকা ছাড়াও ভারতীয় সূত্রে মুসলিম বাংলা আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে ভুট্টোর বাঙালি মন্ত্রী মাহমুদ আলীকে লন্ডনে পাঠানোর সংবাদ প্রকাশিত হয়। ভারতীয় সূত্রে বলা হয়, মে মাসের শেষ দিকে মাহমুদ আলী লন্ডনে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাংলাদেশে জামায়াতের শক্তিশালী ভিত থাকায় তাদের মাধ্যমে মুসলিম বাংলা আন্দোলন জোরদার করা হবে।৯৩

১১ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় ভুট্টোর ৩৫ লক্ষ টাকা বিতরণের কথা উল্লেখ করেন।৯৪ যদিও মুসলিম বাংলা আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তারের পরও এ আন্দোলন থেমে থাকেনি। পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোতে বাংলাদেশে মুসলিম বাংলা আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে খবর প্রকাশ অব্যাহত থাকে। জুন মাসের শেষ দিকে পাকিস্তান টাইমস মন্তব্য করে যে, ঢাকার দেয়াল মুসলিম বাংলার স্লোগানে ছেয়ে গেছে।

যদিও সংবাদটি ছিল বিভ্রান্তিকর, তা সত্ত্বেও পরবর্তী দিনগুলোতে পত্রিকাগুলো এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ অব্যাহত রাখে। এ মাসেই নিউজ উইক-এ ভুট্টোর একটি সাক্ষাৎকার ও মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগ নতুন করে সন্দেহের জন্ম দেয়। জুন মাসের প্রথম দিকে এই পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে ভুট্টো বলেন, মুজিবের সঙ্গে তার খুব তাড়াতাড়ি বৈঠক হচ্ছে এবং বৈঠকে তারা দুটি দেশের অমীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করবেন। অথচ এই বৈঠক সম্পর্কে বাংলাদেশ কিছুই জানত না।

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman’s Homecoming

অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচনে ভরাডুবি সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী ভারত ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলনের ডাক দেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে তার সখ্য, হুকুমতে রাব্বানি (মওলানা ভাসানীর ঘোষিত বাংলাদেশের প্রথম ধর্মাশ্রয়ী দল) প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার, চীনের প্রতি অনুরাগের কারণে ভুট্টো এবং পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলো ভাসানীকে আওয়ামী লীগবিরোধী সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফরম হিসেবে চিহ্নিত করে।

ভাসানীর সঙ্গে ভুট্টোর গোপন সংযোগ নিয়ে জুন মাসের পুরো সময় জুড়ে ভারতের পত্রিকাগুলোতে খবর প্রকাশিত হলে ১০ জুন ভাসানী স্বীকার করেন যে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে তিনি ভুট্টোকে একটি চিঠি দিয়েছেন। তাতে তিনি পাকিস্তানে বাঙালি নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং তাদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন মাত্র। তার ভাষ্য, ভুট্টো তার পত্রের জবাবে মওলানা ভাসানীর অভিযোগ অস্বীকার করে বাঙালিদের অবস্থা সচক্ষে দেখার জন্য তাকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান।

ভাসানী অবশ্য দাবি করেন যে, তিনি ভুট্টোকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে তার পক্ষে পাকিস্তান যাওয়া সম্ভব নয়। ৯৫ ভাসানী এ সময় মুসলিম বাংলা আন্দোলনের সঙ্গে তাকে সংশ্লিষ্ট করে প্রচারিত ভারতীয় পত্রপত্রিকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। ৯৬ যদিও জুন মাসের শেষ দিকে একটি বক্তৃতায় মওলানা চিরাচরিত ভারত বিদ্বেষী মনোভাব ব্যক্ত করে ভুট্টোকে উদ্দেশ করে বলেন,

“কেন আপনি স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করছেন না? বাংলাদেশ এককালে পাকিস্তানী পণ্যের বড় বাজার ছিল, এটি আবার আপনার বাজারে পরিণত হতে পারে। যদি আপনি আপনার দেশের পণ্য এখানে আনেন, তবে ভারতের নিম্নমানের পণ্য এখানে আসা বন্ধ হবে।”৯৭

পরের মাসে ভাসানীর সঙ্গে ভুট্টোর গোপন যোগাযোগ বিষয়টি হিন্দুস্তান টাইমস প্রকাশ করলে বাংলাদেশে আবার বিতর্ক দেখা দেয়। এই পত্রিকার ঢাকাস্থ প্রতিনিধি ভুট্টোর একজন বাঙালি প্রতিনিধির সঙ্গে ভাসানীর বৈঠক এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য প্রয়োজনে কনফেডারেশন গঠন-সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়েও আলোচনার তথ্য প্রকাশ করে।

ভুট্টো এ সময় তার প্রতিনিধির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের প্রস্তাবও দেন। সোভিয়েত বার্তা সংস্থা তাসও ভুট্টোর সঙ্গে ভাসানীর এই গোপন যোগাযোগের বিষয়টিকে সমর্থন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ভুট্টো এভাবে একদিকে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধীদের সঙ্গে গোপন আঁতাত অব্যাহত রাখেন, অন্যদিকে তেমনি জুন-জুলাই মাসে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে পাক-ভারত বৈঠক অনুষ্ঠানে আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের প্রতি তার মনোভাবের ক্ষেত্রেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটান।

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয় মতামত চেয়ে সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করলে কোর্ট স্বীকৃতির ব্যাপারে জাতীয় পরিষদের চূড়ান্ত রায় দেয়ার অধিকার স্বীকার করে মত দেয়। ১৯ জাতীয় পরিষদে বিষয়টি উপস্থাপিত হলে পরিষদ যথাসময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে সরকারকে ক্ষমতা দিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করে । ১০০

এর পরপরই পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণার ভিত্তিতে জুলাই মাসের শেষ দিকে ইসলামাবাদে ভারতের সঙ্গে বৈঠকে বসে। যদিও ইসলামাদে বৈঠক চলাকালে প্যারিস সফররত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পাক-ভারত যুক্ত ঘোষণাবিরোধী এক মন্তব্য পাকিস্তানের আন্তরিকতা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি করে। ফরেন প্রেস এসোসিয়েশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একমাত্র পাকিস্তানের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারে। যদিও একই সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান যে, পাকিস্তান শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজি আছে। ১০

তবে তিনি কোনো শর্তের উল্লেখ করেননি। ইসলামাবাদ বৈঠকে বিশেষ অগ্রগতি না হওয়ায় আগস্ট মাসে দিল্লিতে পাক-ভারত বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। এই সম্মেলনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আলোচনা হয় এবং পাক-ভারত বৈঠক ১৮ আগস্ট শুরু হয়। ১০ দিন আলোচনার পর দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ত্রিমুখী প্রত্যাবাসন শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ঐ চুক্তির কোনো পক্ষ না হলেও বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় যুক্ত থাকায় বাংলাদেশ স্বভাবতই চুক্তির ফলে স্বস্তিবোধ করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের দিনই এক বিবৃতিতে এই চুক্তিকে স্বাগত জানান। ১০২

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে দিল্লি চুক্তির ভিত্তিতে পাকিস্তান থেকে বাঙালি, ভারত থেকে পাক যুদ্ধবন্দি এবং বাংলাদেশ থেকে অবাঙালি প্রত্যাবাসন শুরু হয়। এর ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে এত দিনের বৈরিতার বরফ গলতে থাকে। যদিও এ মাসের ২৮ তারিখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী জাতীয় সংসদে আবদুল কুদ্দুস মাখনের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ভুট্টো হলিডে পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক পাকিস্তানী নাগরিক এম. আসলামের মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন।

এই সংবাদটি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্থাপনের আন্তরিকতা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি করে। এ ছাড়া ২৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ব্যাংক একাউন্ট বাজেয়াপ্ত১০৪ এবং প্রত্যাবাসন শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে চৈনিক ভেটো বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের বৈরী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ৯ অক্টোবর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ঘোষণা

যদি বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেয়, তবে পাকিস্তান জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকারে বাধা দেবে না।“১০৫

এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনিই স্বীকার করেন যে, জাতিসংঘে চৈনিক ভেটোর পেছনে পাকিস্তানের হাত ছিল। এ ছাড়া অক্টোবর মাসেই বিহারীদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে পাকিস্তান শ্লথগতিতে এগুতে থাকে। দিল্লি চুক্তিতে Substantial Number বিহারীর মুক্তির শর্ত এবং বিহারী ফেরত নেয়ার ব্যাপারে আলোচনায় গুরুত্ব দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈঠক জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি না দেয়ায় আলোচনার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ।

জাপান সফর করার সময় ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাপানি সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আবারো স্বীকৃতিকে বৈঠকের পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করেন।১০৯ অথচ প্রত্যাবাসনের এক মাসের মধ্যেও স্বীকৃতির ব্যাপারে পাকিস্তান কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় পক্ষের তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে ছাড় দেয়ার সুযোগ ছিল। পাকিস্তানের স্বীকৃতি দেয়ার আগে বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমে সেই স্বীকৃতিকে ত্বরান্বিত করতে পারত। পাকিস্তানও তার স্বীকৃতির ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখাতে পারত। কিন্তু কোনো পক্ষই সে দিকে না গিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে থাকে।

জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, মুসলিম বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক এবং অক্টোবর মাসে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বাংলাদেশের আরব বিশ্বকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়ার ফলে মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশের প্রতি তাদের নীতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের তাগিদ থেকে অনেক মুসলিম দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনকে প্রাধান্য দেয়।

তবে এ পর্যায়ে এসে এটা বোঝা যায় যে, দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের পথে প্রধান বাধা ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার। উভয় দেশের আত্মসম্মানের সঙ্গে বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। তবে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের কিছু সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায় যে, যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে সরকারের আগের কঠোর মনোভাব আর নেই।

২৬ অক্টোবর ঈদ উপলক্ষে ৪০০ দালালকে মুক্তি দান ছাড়াও ৩০ নভেম্বর আকস্মিকভাবে সরকারি ঘোষণা বলে দালাল আইন বাতিলের মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত, বিচারাধীন সকল আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। প্রধানমন্ত্রী এক সপ্তাহের মধ্যেই দালালদের ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন, যাতে তারা তৃতীয় বিজয় দিবস পালনের উৎসবে অংশ নিতে পারে।১০৭

দালাল আইন বাতিল করায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের মত পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানে পুনর্বাসিত বাঙালি দালালদের মধ্যেও স্বস্তি ফিরে আসে। এই আইন বাতিলের পরের দিনই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ভুট্টোর মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রী দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত দালালদের পাকিস্তানে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিলে পরিষদে তা গৃহীত হয়। ১০৮ যেখানে পাকিস্তান তার নাগরিক অর্থাৎ আটকেপড়া বিহারীদের ফেরত নিতে গড়িমসি করছিল সেখানে দালালদের পুনর্বাসনের বিষয়টি ছিল রীতিমত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

Mandatory Credit: Photo by Laurent/AP/Shutterstock (7376486a)Rahman Sheik Mujibur Rahman, President of the Awami League, is shown during a news conference at his residence in Dacca, East Pakistan, . In 1972, Sheik Mujib, as he was popularly known, became Bangladesh's first prime minister. In 1975, he was overthrown in a coup d'etat and assassinatedSHEIK MUJIBUR RAHMAN
Mandatory Credit: Photo by Laurent/AP/Shutterstock (7376486a)Rahman Sheik Mujibur Rahman, President of the Awami League, is shown during a news conference at his residence in Dacca, East Pakistan, . In 1972, Sheik Mujib, as he was popularly known, became Bangladesh’s first prime minister. In 1975, he was overthrown in a coup d’etat and assassinatedSHEIK MUJIBUR RAHMAN

 

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার দালালদের বিচারের জন্য এর আগে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে কেন এই সিদ্ধান্তটি নেয়। প্রথমত, ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের আগে ও পরে বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহল পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব পোষণের পক্ষে মত দেন। মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান ও অলি আহাদসহ বেশ কয়েকজন প্রবীণ নেতা দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দাবি করেন।১০৯

এমনকি মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার জাসদ সভাপতি মেজর (অব.) এম. এ. জলিলও দালাল আইন বাতিলের দাবি জানান। ১১০ সরকার নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি প্রসঙ্গে পক্ষে-বিপক্ষে মত প্রকাশ শুরু করে। এভাবে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সৃষ্ট প্রবল চাপ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে এবং বাঙালিদের মুক্তির স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির ব্যাপারেও সরকার ভাবতে থাকে।

দ্বিতীয়ত, সেপ্টেম্বর মাসে প্রত্যাবাসন কাজ শুরু হলে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে দালালদের ক্ষমা করা হয়। তাই দালালদের মুক্তি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির পূর্ব পর্যায় হিসেবেও উল্লেখ করা যায়। এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিতে সরকার জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা চালায়।

তৃতীয়ত, পিকিংপন্থীদের ও জাসদসহ বিরোধী দলগুলো নিজেদের দলে টানার জন্য দালালদের ক্ষমতার আগ্রহ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। বাংলা জাতীয় লীগের প্রধান অলি আহাদ ‘আজাদ বাংলা’ আন্দোলনের ডাক দেন এবং মুক্তিপ্রাপ্ত দালালদের এই আন্দোলনে সাড়া দেয়ার আহ্বান জানান। ১১১

তার দলীয় কর্মসূচি ছিল মূলত মুসলিম বাংলার আন্দোলনের অনুরূপ। তাই উগ্রপন্থীদের প্রতিরোধের মাধ্যমে বিরোধী আন্দোলনকে দমনে সরকারের এটা ছিল একটা কৌশল। চতুর্থত, সরকার ১৯৭৩ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণে এ সব দালালকে ক্ষমা করার মাধ্যমে তাদের কয়েক লক্ষ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে সরকারের পক্ষে জনসমর্থন বৃদ্ধির কৌশল হিসেবেও বিবেচনা করেছে। পঞ্চমত, দালালদের মুক্তির অভ্যন্তরীণ কারণ হিসেবে আমলাদের চাপের কথাও উল্লেখ করা হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেকেই প্রধানমন্ত্রীকে এই মর্মে প্রভাবিত করেন যে, যুদ্ধবন্দি হিসেবে ১৮ মাস জেলে কাটানোর ফলে দালালদের যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে। তাই তাদের মুক্তির বিনিময়ে পাকিস্তান থেকে আটক বাঙালিদের নিয়ে আসা উচিত এবং এতে করে পাকিস্তানের স্বীকৃতিসহ দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নতির সম্ভাবনাও থাকবে। এ ছাড়া অনেক পুলিশ অফিসার চার্জশিট দিতে দেরি করেন, আমলাদের অনেকে বিচার কাজে বিলম্ব করেন।

এক হিসেবে দেখা যায়, অভিযুক্ত ৩৭ হাজার দালালের মধ্যে ১৯৭৩ সালের জুন পর্যন্ত মাত্র ৫৬৯ জনের বিচার হয়। ১১২ এর মধ্যে একটা হতাশাব্যঞ্জক ছবি ফুটে ওঠে। মন্ত্রীদের মধ্যে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন একটি ক্ষুদ্র অংশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে দৃঢ় প্রত্যয়ী হলেও ক্ষমার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের কারণে তার সহকর্মীদের অধিকাংশই দালালদের মুক্তির পক্ষে ছিলেন।

Zulfikar Ali Bhutto at one of the several United Nations Security Council meetings ahead of the fall of Dhaka.
Zulfikar Ali Bhutto at one of the several United Nations Security Council meetings ahead of the fall of Dhaka.

সবশেষে দালালদের ক্ষমার পেছনে আন্তর্জাতিক চাপের কথা উল্লেখ করা যায়। পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের পাশাপাশি দালালদের মুক্তির ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উদ্যোগ অব্যাহত রাখে এবং পাকিস্তানে দালালদের পুনর্বাসিত করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নামের মানবতাবাদী সংস্থা একাত্তরে বাঙালিদের গণহত্যার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া না দেখালেও স্বাধীনতার পরপর বিহারী, যুদ্ধবন্দি ও দালালদের ব্যাপারে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট হয়।

১৯৭৩ সালের মে মাসের পর পাকিস্তান, ভারত ও নেপাল হয়ে জুন-জুলাই মাসে সংস্থার একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে ব্যাপক যোগাযোগের পর সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে তারা দালালদের মুক্তির জন্য সুপারিশ সংবলিত একটি চিঠি দেন। এরই মধ্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হলেও ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে ঐ সংস্থা অভিযোগ করে যে, সাধারণ ক্ষমা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি জানান যে, ১৯৭৩ সালে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১১৭১০ জন দালাল ছাড়া পেয়েছে। ১১৩ এরপরও সংস্থা তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে। উপর্যুক্ত কারণে সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও নতুনভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করে।

ত্রিপক্ষীয় প্রত্যাবাসনের ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি যোগাযাগ প্রতিষ্ঠিত না হলেও পাকিস্তান সরকার ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখে দালাল আইন বাতিলকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করে এবং এই আশাবাদ ব্যক্ত করে যে, ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির বিচার বিষয়ে বাংলাদেশ অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেবে। ১৯৭৪ সালের ২১ জানুয়ারি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পুনরায় একই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ১১৪

দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি সব সময় গুরুত্ব পেয়েছে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে ইসলামী সম্মেলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে স্বীকৃতি ও বাংলাদেশের সম্মেলনে যোগদান নিয়ে ব্যাপক তৎপরতা চলতে থাকে। এই সম্মেলনের দিন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে, দুটি দেশের সমস্যা নিরসনে কূটনৈতিক তৎপরতা ততই জোরদার হতে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে দুটি দেশের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যথেষ্ট ফারাক ছিল।

ভুট্টো স্বীকৃতি না দিয়ে বাংলাদেশকে সম্মেলনে যোগদান ও সম্মেলনের মাধ্যমে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করার পক্ষপাতী ছিলেন। তার পরিকল্পনা মোতাবেক তিনি জানুয়ারি মাস থেকে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেন। খয়েরপুর স্টেডিয়ামে এ মাসের শেষ দিকে প্রদত্ত এক ভাষণে ভুট্টো বাংলাদেশকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, ইসলামী সম্মেলনের মত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য গুরুত্বহীন একটি পূর্বশর্ত আরোপ করা উচিত নয়। স্বীকৃতির বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় এবং সম্মেলনের সঙ্গে একে যুক্ত করা চলে না। কারণ যথাসময়ে স্বীকৃতি দেয়া হবে। ১১৫

তবে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, স্বীকৃতি না দিলে সম্মেলনে যোগ দেবে না। ১১৬ বাংলাদেশকে সম্মেলনে যোগদানে রাজি করাতে ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল, কুয়েত, লেবানন, সোমালিয়া, সেনেগাল ও আলজেরিয়ার প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে তাদের মতপার্থক্য নিরসনে মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দেন। কিন্তু বাংলাদেশের দৃঢ় মনোভাবের কারণে ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে নিঃশর্ত স্বীকৃতি দেয়।

শেখ মুজিব একই দিন ইসলামী সম্মেলনে যোগদানের ঘোষণা দেন। ১১৭ তবে তিনি স্পষ্ট ঘোষণা দেন যে, স্বীকৃতির অর্থ এই নয় যে, যুদ্ধবন্দিদের বিচার না করার শর্ত মেনে নেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের প্রচারমাধ্যমে এ ধরনের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সংশয়ের অবসান ঘটায়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২২ সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিব আলজেরিয়ার একটি বিমানে লাহোর যান। ঐ দিন লাহোর বিমানবন্দর তোপধ্বনির মাধ্যমে মুজিব ও তার সফর সঙ্গীদের বরণ করা হয়।

স্বাধীনতার পর এটি ছিল বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি দলের প্রথম পাকিস্তান সফর। এই সফর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন। ১১৮ এ ছাড়া ২৪ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো-মুজিব বৈঠক শেষে মুজিব পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে মীমাংসায় উপনীত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন ১১৯ ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির মুক্তি সম্পর্কে কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে তিনি এ বিষয়ে সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন। ১২০

মুজিবের এই বক্তব্যের আক্ষরিক অর্থ ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করে পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় শীঘ্রই যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ হয়। তবে মুজিব যে এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের চাপের সম্মুখীন হন, তা তার সফরসঙ্গী পররাষ্ট্র সচিবও স্বীকার করেন। নেতৃবৃন্দ যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে বিহারী ও সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এ সময় আরব আমিরাত দুটি দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মীমাংসার জন্য মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দেয়। ১২১

অবশ্য লাহোর থেকে ফিরে এসে শেখ মুজিবের যুদ্ধবন্দি ইস্যুতে মৌন ভূমিকাও অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এ ছাড়া সম্মেলনের পরপর মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের ঢাকা সফরও যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে ইঙ্গিতবাহী ছিল।

Sheikh Mujibur Rahman making his way through a sea of supporters in Lahore while he was still a Pakistani
Sheikh Mujibur Rahman making his way through a sea of supporters in Lahore while he was still a Pakistani

প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান সফর ও ইসলামী সম্মেলনে যোগদান দেশে মৃদু প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যদিও বাংলাদেশের সম্মেলনে যোগদানের পেছনে ১৯৭৩-৭৪ সালে ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি, দুর্ভিক্ষ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে ধর্মভিত্তিক দল ও পিকিংপন্থীদের ভারত ও মুজিব সরকারবিরোধীদের তৎপরতাও একটা বড় ভূমিকা পালন করে। ইসলামী সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে মুজিব তার সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ভারতপ্রীতির অভিযোগকে খণ্ডন করতে চেয়েছেন। ১২২

দ্বিতীয়ত, প্রবল আর্থিক সঙ্কটে পতিত হয়ে বাংলাদেশ এ সময় মুসলিম বিশ্বের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাংলাদেশ সম্মেলনে যোগদান না করলে পাকিস্তান সেই সুযোগে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার সুযোগ পেতো। ইতোমধ্যে অনেক আরব দেশ তেল সরবরাহ ও আর্থিক সহযোগিতা দিতে শুরু করায় অব্যাহত সাহায্য লাভের আশায় বাংলাদেশ সম্মেলনে যোগ দেয়।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও জনগণের একটি অংশ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে চীন ও পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে এ দুটি দেশের স্বল্পমূল্যের পণ্য আমদানিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এ প্রত্যাশার সঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব ক্রিয়াশীল ছিল।

চতুর্থত, আওয়ামী লীগ ও সরকারি মহল যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে কোনো ছাড় না দিয়ে পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের অচলাবস্থার নিরসনে মুজিবের প্রচেষ্টাকে একটা কূটনৈতিক বিজয় বলে প্রচার করেন। মুজিব নিজেও স্বীকৃতিকে সত্যের বিজয় বলে ঘোষণা করেন। ১২৩ দুই বছর অতিবাহিত হলেও জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ, চীন ও সৌদি আরবসহ কয়েকটি মুসলিম দেশের স্বীকৃতি না দেয়ার পেছনে পাকিস্তান যে জড়িত সেটা দেরিতে হলেও শেখ মুজিব উপলব্ধি করেন।

স্বাধীনতার পর মুজিবসহ অনেক মন্ত্রী পাকিস্তানের স্বীকৃতির ব্যাপারে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বক্তব্য দিলেও বাস্তব অবস্থার কারণে পাকিস্তানের স্বীকৃতি জরুরি বলে মনে করেন। ইসলামী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে স্বীকৃতি উভয় দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের যোগাযোগের অচলাবস্থার অবসান ঘটায়। মুজিবের লাহোর গমন, ভুট্টো-মুজিবের পাশাপাশি ছবি, মুজিবকে টিক্কা খানের স্যালুট করার ছবি বাংলাদেশের সরকার নিয়ন্ত্রিত ও বেসরকারি পত্রিকাগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়।

এর ফলে তাজউদ্দিনের দ্বিমত পোষণ সত্ত্বেও বাংলাদেশে সম্মেলনে যোগদানের বিপক্ষে তেমন জনমত গড়ে ওঠেনি। তবে সম্মেলনে মুজিবের এই যোগদানে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো। তারা মুজিবের এই সিদ্ধান্তকে ধর্মনিরপেক্ষতা হতে পশ্চাৎপসরণ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়।

পাকিস্তানের স্বীকৃতি ও ইসলামী সম্মেলনে যোগদানের ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে রুশ-ভারত নির্ভরশীলতা হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশ নতুন আন্তর্জাতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক নিবিড় হবার সুযোগ লাভ করে এবং ভবিষ্যতে মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা দেয়। ১২৪

তবে লাহোর সম্মেলনের ফলে পাকিস্তানই বেশি লাভবান হয়। পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টের রায় এবং দেশটির জাতীয় পরিষদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে প্রস্তাব নেয়া সত্ত্বেও জনমতের বিরোধিতার কারণে ভুট্টো তার ঘোষণার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। স্বীকৃতির পক্ষে সরকার এই ধারণাই দেন যে, মূলত মুসলিম উম্মাহর সংহতির জন্যই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এতে জামায়াত ও মুসলিম লীগসহ ডানপন্থী দলগুলোর স্বীকৃতি বিরোধিতার নামে সরকারবিরোধী আন্দোলন আপাতত বন্ধ হয়।

দ্বিতীয়ত, এর ফলে ভারতকে এড়িয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন ও ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। তৃতীয়ত, মুসলিম দেশগুলোর কাছে ভুট্টো এই ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন যে, মূলত মুসলিম উম্মাহর সংহতির স্বার্থেই দেশে প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এর ফলে মুসলিম বিশ্বে ভুট্টোর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় এবং পাকিস্তানের বর্ধিত অর্থনৈতিক সাহায্য লাভের পথ প্রশস্ত হয়।

মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য লাহোরে যে কমিটি গঠিত হয়, পাকিস্তান তার অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হয়। বিশ্বের তেল সঙ্কটকালে অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে পাকিস্তান হ্রাসকৃত মূল্যে তেল পায় এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার পথ সম্প্রসারিত ও জনসম্পদ রপ্তানি বহুলাংশে বেড়ে যায়। ১২৫

৩. বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক: যুদ্ধবন্দি মুক্তি ইস্যু

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দিলেও সে সময় দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। এ পর্যায়ে দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা ছিল প্রথমত, ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির মুক্তি, দ্বিতীয়ত, সকল বিহারীর পাকিস্তান প্রত্যাবাসন, তৃতীয়ত, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের দাবি করা সম্পদ আদায়ের বিষয়টি স্বীকৃতি দুটি দেশের মধ্যে বৈঠকের পরিবেশ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশ এত দিন বৈঠকের পূর্বশর্ত হিসেবে স্বীকৃতিকে উপস্থাপিত করে আসছিল। এ তিনটি অমীমাংসিত বিষয়ের প্রথমটি ছিল ত্রিপক্ষীয় অর্থাৎ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সংশ্লিষ্ট, অপর দুটি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিষয় ছিল। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম ইস্যুকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। ভারতের জন্য যুদ্ধবন্দি ইস্যুটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করায় ভারত এ ব্যাপারে ছাড় দিতে রাজি ছিল।

এ ছাড়া ভারত মে মাসে পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রস্তুতি হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্রুত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে পাকিস্তানের আত্মসম্মান ও জাতীয় স্বার্থে যুদ্ধবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি ছিল অত্যন্ত জরুরি। অবশ্য বাংলাদেশও জাতীয় স্বার্থে বিহারীদের পাকিস্তানে প্রেরণ ও তার পাওনা আদায়ের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয় এবং এ দুটি লক্ষ্য অর্জনের প্রেক্ষাপট রচনায় যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে আলোচনায় রাজি হয়। তাই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে তিনটি দেশই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।

মার্চ মাসের শুরুতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত যোগাযোগ করলে পাকিস্তানও ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সম্মত হয় এবং দিল্লিতে ৫ এপ্রিল বৈঠকের তারিখ নির্ধারিত হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারেও পাকিস্তান অত্যধিক আগ্রহ দেখায়।

পিপিপি’র মুখপত্র মুসাওয়াত (Mussawat) ২০ মার্চ এক রিপোর্টে উল্লেখ করে যে, খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে এবং পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গোলাম মোস্তফা খার বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন। এ পত্রিকায় আরো বলা হয়, মুজিব লাহোর সফরকালে তার সঙ্গে খারের বৈঠকের পর পাকিস্তান সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়। খারের নিযুক্তির প্রস্তুতি হিসেবে তাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করানো হয় বলেও পত্রিকাটি মন্তব্য করে। ২৪

মার্চ পাকিস্তান রেডিওতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টোও এই মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের আগে অমীমাংসিত বিষয় আলোচনার ওপর প্রাধান্য দেয় বেশি। অবশ্য পাকিস্তান বাংলাদেশের আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেনি।

মস্কো সফরকালে ১৯ মার্চ পাকিস্তানের আকাশসীমা অতিক্রমকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভুট্টোকে অভিনন্দনবাণী এবং ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির অভিনন্দনবাণী পাঠানো সত্ত্বেও কূটনৈতিক রীতি অনুযায়ী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তান কোনো বাণী পাঠায়নি। এর থেকে প্রমাণিত হয়, পাকিস্তান স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি।

অবশ্য ৫-৯ এপ্রিল দিল্লিতে পূর্বনির্ধারিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠক এবং ৯ তারিখে সম্পাদিত দিল্লি চুক্তির মাধ্যমে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে বাংলাদেশের ক্ষমা প্রদর্শন১২৬ এবং তিনটি দেশই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির ব্যাপারে ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। এর ফলে এত দিন ধরে দুটি দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে বাধার প্রাচীর ছিল, সেটা দূর হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেন। যদিও বিহারীদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে বৈঠকে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে এই চুক্তির পর দুটি দেশের সম্পর্কের অগ্রগতির ব্যাপারে পাকিস্তান বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১১

এপ্রিল এক সাংবাদিক সম্মেলনে পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে জাতিসংঘে সদস্যভুক্তির ব্যাপারে চীন যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি না করে, সে জন্য তিনি চীনকে অনুরোধ করবেন।১২৭ এর থেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন বৈঠকে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তি নিশ্চিত হয়। তবে মন্ত্রীর অন্য একটি মন্তব্য ছিল রীতিমত চমকপ্রদ । তিনি ঐ দিনই বলেন ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে বাংলাদেশ ক্ষমা প্রদর্শন করলেও পাকিস্তানের একাত্তরের ভূমিকার তদন্ত করে পাকিস্তান সরকার দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ১২৮

মূলত বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করাই ছিল তার এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য। অথচ হামুদুর রহমান কমিশন ও আফতাব কমিশনের রিপোর্ট কখনো প্রকাশই করা হয়নি। অবশ্য পাকিস্তান অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মীমাংসার আগেই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকে প্রাধান্য দেয় এবং এ কারণে বাংলাদেশকে প্রভাবিত করতেই যে মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ১১

এপ্রিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে তার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। পরের দিন ‘ভয়েজ অব আমেরিকার’ সঙ্গে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি পুনরায় এই ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১২৯ ‘পাকিস্তান টাইমস’-এ ব্যক্ত এক রিপোর্টে বলা হয়, ভুট্টোর সঙ্গে বিভিন্ন অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য মুজিব মে মাসে পাকিস্তান সফরে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ১৩০

অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুজিবের সফরের কথা উল্লেখ না করে মে মাসে দুটি দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। ১৩১ দুটি দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এপ্রিল মাসে অন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয় মীমাংসার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে সৃষ্ট সংশয়ের কিছুটা হলেও উপশম করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান নামে ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে যে ধারা ছিল ১৬ এপ্রিল সংবিধানের ওই ধারা সংশোধন-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৩২

৪. ভুট্টোর বাংলাদেশ সফর

এপ্রিল মাসের মধ্যে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রায় আড়াই বছরের সম্পর্কের বাধার প্রধান প্রাচীরটি অপসারিত হয়। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সকল বাঙালি পাকিস্তান থেকে এবং পাকিস্তানী বন্দি ভারত থেকে পাকিস্তানে ফিরে গেলেও বিহারীদের বড় অংশ তখনো পাকিস্তানে ফেরার অপেক্ষায় ছিল।

এপ্রিল মাসে দিল্লি চুক্তির পর পাকিস্তান তাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়ার নীতি গ্রহণ করে। এরপর উপমহাদেশের ঘটনাবলি দ্রুত ঘটতে থাকে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ভুট্টো তার বাংলাদেশ সফরের কথা ঘোষণা করেন। জুন মাসে এই সফরের ঘোষণা ছিল অতর্কিত ও নাটকীয়। অথচ মে মাসের ৯ তারিখে ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণের ২ দুদিন পর চীন সফরকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা বললেও বাংলাদেশ সফরের কোনো ইঙ্গিত দেননি।

মূলত ভুট্টোর চীন সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ১২ মে ৫ দিনের সফরে দিল্লি যাত্রা এবং পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ফারাক্কাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে বৈঠকের ব্যর্থতার কারণে ভুট্টো অতর্কিত বাংলাদেশ সফরের ঘোষণা দেন। যদিও এর আগে ভুট্টো জুন মাসে নির্ধারিত বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন। অবশ্য ভুট্টোর এই সিদ্ধান্তের পেছনে মে মাসের ভারতের রাজস্থানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক বিস্ফোরণকেও কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

এই প্রেক্ষাপটে ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের ঘোষণা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের চেয়ে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানাই ছিল মুখ্য বিবেচনা। বাংলাদেশকেও ভারতবিরোধী করে তোলাই ছিল অপর উদ্দেশ্য। ভারতকে পাশ কাটিয়ে ইসলামী সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদান এবং সম্মেলন পরবর্তীকালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন ভুট্টোকে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন লাভে আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে।

যদিও তিনি সন্দিহান ছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতে বাহ্যিক সুসম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে একযোগে এ ব্যাপারে কাজ নাও করতে পারে। কিন্তু তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ভারত মহাসাগরকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশের সহযোগিতা দরকার। ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দক্ষিণ এশিয়াকে পারমাণবিকমুক্ত এলাকা ঘোষণার যে প্রস্তাব উপস্থাপন করে, ২০ নভেম্বর তা ৮২ ও ২ ভোটে গৃহীত হয়।

জাতিসংঘে এই প্রস্তাব উত্থাপনের প্রাক্কালে ভুট্টো ঢাকা সফরকে তার মিশনের অংশ বলে অভিহিত করেন।১৩৩ ভুট্টোর সফরের সর্বশেষ উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা যায়, সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা ছিল ভুট্টোর কৃতিত্ব অর্জন চেষ্টারই নামান্তর। এ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করা, পাকিস্তানের ব্যাপারে বাঙালিদের মনোভাব পরিমাপ করাও ছিল তার এহেন মিশনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

Sheikh Mujib receiving Bhutto
Sheikh Mujib receiving Bhutto

বিবিসিতে ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের কথা প্রথম ঘোষিত হয়। ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণের ৯ দিনের মধ্যেই পাকিস্তান বেতারের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৮ মে বিবিসি জানায়, ২৬ মে ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে যাবেন এবং এর আগে দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঐ দিনই জানায়, এ ধরনের সংবাদ তারা পায়নি। ১৩৪

এর থেকে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশ সফরে অতর্কিত ঘোষণার পেছনে ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কাজ করেছে। অবশ্য ৮ জুন ভুট্টো তার এক ভাষণে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৭-২৯ জুন তার বাংলাদেশ সফরের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৩ জুন জাতীয় সংসদে শীঘ্রই দুটি দেশের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের কথা উল্লেখ করলেও সফরের তারিখ জানাননি । তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আগাশাহী ১৮ জুন ঘোষণা করেন, ২০ জুন ঢাকা ও ইসলামাবাদ থেকে একযোগে সফরের ঘোষণা দেয়া হবে। অবশেষে ২০ জুন এক বিবৃতিতে ২৭-২৯ জুন ভুট্টোর সফরের চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়া হয়।

ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণ, ১৫ জুন ভারতের প্রেসিডেন্টের ৫ দিনের ঢাকা সফরের মাত্র এক সপ্তাহ পর ভুট্টোর এই সংক্ষিপ্ত নোটিশে সফর এবং সফর উপলক্ষে ব্যাপক তৎপরতা বাংলাদেশে নানান প্রশ্নের জন্ম দেয়। সফরের প্রাক্কালে ২৩ জুন ১৩ সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তানী গোয়েন্দা দলের ঢাকা আগমন, রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে অবস্থান, ঢাকায় অবস্থানকালে চকবাজার, কুর্মিটোলা, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে পাকিস্তানী ও পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে ব্যাপক সাক্ষাৎ এবং অর্থ বিতরণের মত ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় কয়েকটি সূত্র থেকে।

ভুট্টোর নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই তাদের আগমন বলে প্রচার করা হলেও তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সফরকালে জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনার পাশাপাশি এই অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরের গোপন বৈঠক অনুষ্ঠান। সেনাবাহিনীর কয়েকজন পাকিস্তান ফেরত অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগের কথাও কোনো কোনো সূত্রে বিবরণে উল্লেখ করা হয়। ১৩৫

যদিও তাদের ঢাকা অবস্থানকালে ২৪ জুন বাংলাদেশ বেতারে এক অনুষ্ঠানে ভুট্টোবিরোধী বেশ কিছু মন্তব্য করা হয়। ঐ দিন বেতারের এক কথিকায় মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যার সূচনায় ভুট্টোর ঢাকা অবস্থান এবং করাচিতে ফিরে গিয়ে পাকবাহিনীর সামরিক হস্তক্ষেপের সমর্থনে তার বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়। অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান বাংলাদেশ বেতারের এই অনুষ্ঠানের প্রতিবাদ জানিয়ে মন্তব্য করে, এই তৎপরতা ভুট্টোর আসন্ন বাংলাদেশ সফর ও উপমহাদেশে শান্তি প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে।

একই সাথে বলা হয়, বাংলাদেশ বেতার এই অপপ্রচার অব্যাহত রাখলে এবং ভুট্টোর সফর স্থগিত হলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। ১৩৬ যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ জুন প্রকাশ করা হয়, ভুট্টোর সফর বাতিল বা স্থগিত করা বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো চিঠি তারা পাননি। আরো বলা হয়, বাংলাদেশ তাকে অভ্যর্থনা জানানোর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এবং পাকিস্তানও একটি আগাম দল ঢাকায় পাঠিয়েছে।

পাশাপাশি আসন্ন বৈঠকের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, এই সফর দুটি দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের পথ নির্দেশ করবে। ১৩৭ প্রকৃতপক্ষে ভুট্টো তার সফর বাতিল করার হুমকি দেয়ার মাধ্যম তার বিরুদ্ধে আনীত গণহত্যার অভিযোগকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কারণ, এ প্রচার অব্যাহত থাকলে পাকিস্তানে ‘৭২ সালে ভুট্টোকে পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী করে যে প্রচারাভিযান চলেছিল, সেটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারত। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ভুট্টোর সফরকালে তার বিরুদ্ধে যাতে কোনো সভা বা বিক্ষোভ না হয়, সে ব্যাপারে বাংলাদেশকে পরোক্ষভাবে সচেতন করে দেয়া হয়।

Mujib and Bhutto
Mujib and Bhutto

অবশ্য সব ধরনের জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে ভুট্টো ২৭ জুন ১০৭ সদস্য বিশিষ্ট বিশাল দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসেন। ভুট্টোর সফরকালে সরকারি অভ্যর্থনা খুবই সাদামাটা হলেও বেসরকারি উদ্যোগ ছিল ব্যাপক। বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত প্রায় ৩ মাইল রাস্তার দুপাশে লক্ষাধিক লোক দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। বিমানবন্দর রাস্তার উভয় পাশে জনতার ভিড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ভুট্টোর আগাম দলের জনসংযোগের কারণে এই স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যর্থনা সম্ভব হয়।

অভ্যর্থনা সমাবেশ থেকে কেউ কেউ ‘ভুট্টো জিন্দাবাদ, ‘পিন্ডি না দিল্লি, পিন্ডি পিন্ডি’, ইন্দিরার দালালি চলবে না চলবে না, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানও দেয়। ১৩৮ এই স্লোগান এবং বিপুল লোকের সমাবেশ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানপন্থী ও অবাঙালিদের বিপুল সমাগম ঘটানো হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা এই প্রথম প্রকাশ্যে রাস্তায় উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পায়।

পাকিস্তানপন্থীদের ভাষায়, ভুট্টোর অভ্যর্থনা শুধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীই অভ্যর্থনা নয় বরং তা ছিল ভারত ও তাদের তাবেদার আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নিঃসংকোচ ক্ষুব্ধতা আর বিদ্রোহেরই অভিব্যক্তি। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার জে. এন. দীক্ষিতও মনে করেন, ভুট্টোর সফরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানপন্থীরা একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায় এবং আওয়ামী লীগ ও ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নানান স্লোগান দেয়। দীক্ষিত স্বয়ং এই শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন এবং মন্তব্য করেন,

“People threw garlands of shoes at Sheikh Mujibur Rahman’s car on his journey back to the Presidents House. My Flag tampered with by the crowds as it slowed down near the road crossing at the then Inter Continental Hotel. Abusive slogans were shouted against the Indian High Commission and the Government of India. “১৩৯

২৭ জুন থেকেই সরকারি পর্যায়ে কর্মসূচি শুরু হয় এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ভুট্টোকে দেয়া সংবর্ধনায় এ সফরকে অপরিসীম তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করেন। তিনি আশা পোষণ করেন যে, এ সফরের ফলে অতীতের তিক্ততা, শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে উভয় দেশের জনগণের জন্য সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা সম্ভব হবে।১৪০

ভুট্টো নিজেও সংবর্ধনার জবাবে ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সফরের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ১৪১ তবে ভুট্টোর বক্তৃতার বড় অংশ জুড়ে মুক্তিযুদ্ধকালে তার দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে আত্মপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকারের চেষ্টা করেন। ভুট্টো ঢাকা অবস্থানকালে ২৮ জুন নাগরিক সংবর্ধনাসহ সকল পর্যায়ে প্রদত্ত তার ভাষণে একই বক্তব্য প্রচার করেন।

ভুট্টোর সফর পাকিস্তানের দৃষ্টিকে একটি সৌজন্য সফর হওয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিগত ক্ষেত্রে ব্যবধান ছিল প্রবল। ভুট্টো এই সফরের মাধ্যমে শীঘ্রই বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে এ দুটি বিষয়ের আগে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়, প্রধানত সম্পদ বণ্টন ও বিহারী প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়। ভুট্টো বাংলাদেশে এসেই ২৭ জুন প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নৈশভোজে উভয় দেশের মধ্যে ন্যায়বিচার ও বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করতে সম্পদ বণ্টন বিষয়ে একটি সম্মানজনক মীমাংসার ব্যাপারে তার আশাবাদ ব্যক্ত করলেও১৪২ শীর্ষ বৈঠকে পাকিস্তান এই দুটি বিষয়কে তেমন আমল দেয়নি।

Mujib and Bhutto burst out laughing in the Shalimar Garden
Mujib and Bhutto burst out laughing in the Shalimar Garden

 

বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদের মধ্যে স্বর্ণ মজুদ, বৈদেশিক মুদ্রা, বেসামরিক বিমান ও জাহাজ ইত্যাদি খাতে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ দুমাসের মধ্যে কিছু পরিমাণ অর্থ (token payment) প্রদানের প্রস্তাব করে। বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারীদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতেও বাংলাদেশ প্রস্তাব দেয়। বিহারীদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারটি পাকিস্তান সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। যদিও সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে মৌনতার আশ্রয় নেয়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ স্পষ্টতই জানিয়ে দেয়, এই দুটি সমস্যা জিইয়ে রেখে দুটি দেশের স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে না।

বাংলাদেশের এই মনোভাবের কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা বা জবাব পাকিস্তান না দিলেও সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো বলেন, দীর্ঘদিনের জটিল সমস্যার মীমাংসা এত তাড়াহুড়ো করে সম্ভব নয়। এই বক্তব্য ছিল পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মনোভাবের বিপরীতে এবং সমস্যার সমাধানে দীর্ঘসূত্রতার ইঙ্গিতবাহী। অবাঙালি ইস্যুতে পাকিস্তানের মনোভাব ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির চেতনাবিরোধী ছিল। কারণ এতে অবশিষ্ট অবাঙালিদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।১৪৩

এর ফলে ভুট্টোর সফরের সূচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে যে মন্তব্য এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচিত হতে যাচ্ছে বলে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তা নিরাশায় পরিণত হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২৯ জুন ভুট্টোর সফরকে নৈরাশ্যজনক ও ব্যর্থ বলে সরাসরি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ১৪৪ পরের দিন প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহার থেকেও সফরের ব্যর্থতা ফুটে ওঠে। এক পৃষ্ঠার এ ইশতেহারে বলা হয়: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে সাদর ও আন্তরিক অভ্যর্থনা জানানো হয়। সফরকালে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনে যান।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তা গ্রহণ করেন। ১৪৫ এই ইশতেহারের কোথাও সফরের সময়কার আলোচ্যসূচির কোনো প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি। তবে ইশতেহার থেকে বোঝা যায়, ঢাকা আলোচনা ব্যর্থ হলেও ভবিষ্যতে আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যায়নি। পশ্চিমা পত্রিকাগুলোতে সফরের ব্যর্থতার জন্য মূলত পাকিস্তানকেই দায়ী করা হয়।

যদিও পাকিস্তান মনে করে ভুট্টোর সফর সফল হয়েছে। পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো ২৭ জুন থেকে বাংলাদেশে সফরকেন্দ্রিক রিপোর্ট ও খবর ফলাও করে প্রচার করতে শুরু করে। ২৭ জুন ভুট্টোর অভ্যর্থনায় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান পাকিস্তানীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। ভুট্টো নিজেও বৈঠককে ‘সৌহাদ্যপূর্ণ ও সুখবর’ বলে মন্তব্য করেন।

ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বিদায়ী ভাষণে ভুট্টো দুদিনের সফরে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে দুদেশের সম্পর্ক উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন ।১৪৬ ভুট্টোর জীবনী লেখক স্ট্যানলি উলপার্ট মনে করেন, ভুট্টোর ঢাকা সফর পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে সফল ছিল। কারণ, ইয়াহিয়ার চেয়েও খারাপ লোক বলে ভুট্টোর সম্পর্কে বাঙালিদের মধ্যে যে ধারণা ছিল, এই সফরের মাধ্যমে ভুট্টো তা পরিবর্তনে সক্ষম হন। ১৪৭

পাকিস্তানের দৃষ্টিতে এ সফর যেহেতু নিরীক্ষাধর্মী ছিল, তাই এটা ছিল ইতিবাচক। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে, এটি ছিল শান্তি ও বন্ধুত্বের মিশন। ১৪৮ দেশে ফিরে ভুট্টো তার সফরকে সফল প্রমাণের জন্য ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে ২৯ জুন বলেন, ঢাকায় রাজনৈতিক, দ্বিপাক্ষিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাকিস্তান রেডিওতে দেয়া সাক্ষাৎকারে ভুট্টো আর এক ধাপ মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বলেন, উভয় দেশ অনতিবিলম্বে বাণিজ্য শুরু করার প্রাথমিক পদক্ষেপও নিয়েছে। ১৪৯

অথচ যুক্ত ইশতেহারসহ কোথাও এ বিষয়ের উল্লেখ নেই। এমনকি তার সফরকালে পাকিস্তানের পত্রিকার প্রতিবেদনের কোথাও এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। পাকিস্তানের গণমাধ্যমে ভুট্টোর সফরকে সফল বলে প্রমাণের উদ্যোগ অব্যাহত রাখে। পাশাপাশি সফরকালে বাংলাদেশের উপস্থাপিত দু-দফা প্রস্তাবের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘পাকিস্তান টাইমস’-এর কূটনৈতিক প্রতিনিধি এইচ. কে. বার্কি ২ জুলাই এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দাবিকে অযৌক্তিক ও অবান্তর বলে মন্তব্য করেন। পিপিপি’র মুখপত্র মাসরিক বাংলাদেশের অযৌক্তিক দাবি মেনে না নেয়ায় ভুট্টোর কূটনৈতিক বিচক্ষণতার ভূয়সী প্রশংসা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৫০

অবশ্য এ সময় পাকিস্তানের কিছু পত্রিকা যেমন ডন, সফরের ব্যর্থতা তুলে ধরলে সরকার সচেতন হয়ে ওঠে। ঐ দিন পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনৈক মুখপাত্র বলেন, সংবাদপত্রগুলো উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে যে, ভুট্টোর সফর মূলত বন্ধুত্বমূলক সফর এবং এই সফরের মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধান হবে এমনটি আশা করাও উচিত নয়। বরং দুনেতা তাদের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যে আলোচনা করেছেন, এটিই এই সফরের বড় সাফল্য।

এ আলোচনার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত পাকিস্তান সফরের পর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরো সাফল্য অর্জিত হবে। বাংলাদেশের দুটি দাবি সম্পর্কে মুখপাত্র মন্তব্য করেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত দাবি মেনে না নিলেও একটি যুক্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। বিহারীদের সম্পর্কে বলা হয়, মানবিক কারণে পাকিস্তান ১,৩৩,০০০ অবাঙালি ফেরত নিয়েছে, যাদের সবাইকে পাকিস্তানে পুনর্বাসন সম্ভব হয়নি এবং এখনো ৩৫,০০০ শিবিরে বসবাস করছে।

সরকারি এই বিবরণীতে নতুন কোনো প্রস্তাব বা বক্তব্য অনুপস্থিত। অবশ্য রেডিও পাকিস্তান ৬ জুলাই প্রচারিত এক কথিকায় ভুট্টোর সফরকে প্রথমবারের মত ব্যর্থ বলে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়। এই ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশের দু-দফা অযৌক্তিক দাবিকে দায়ী করা হয়। ১৫১

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে ড. কামাল হোসেনের ২৯ জুনের মন্তব্যের প্রতিবাদ করে ৪ জুলাই বলেন,

(১) বাংলাদেশ সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দুমাসের মধ্যে সম্পদ দাবি করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবটি সরাসরি নাকচ না করে সম্পদ বণ্টন প্রশ্নে দুটি দেশের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। এতে এটাও উল্লেখ করা হয় যে, কমিটি ৬ মাসের মধ্যে প্রতিবেদন পেশ করবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাবে রাজিও হন;

(২) সমস্ত অবাঙালিকে ফেরত নেয়া-সংক্রান্ত বাংলাদেশের দাবিতে পাকিস্তান বিস্মিত না হয়ে পারে না। কারণ এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে ইসলামাবাদে এবং আগস্ট মাসে দিল্লি চুক্তিতে আলোচিত হয়েছে। এ সব বিষয়ে মুজিব ভুট্টো বৈঠকে কোনোরকম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বরং এ ব্যাপারে আলোচনা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করা হয়।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ভুট্টোর সফর ছিল মূলত দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের প্রাথমিক পদক্ষেপ। দুটি দেশের দুটি চুক্তিতে স্বাক্ষর এই সফরের সাফল্য প্রমাণ করে। এর একটিতে যথাসম্ভব শীঘ্রই বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন এবং দ্বিতীয়টিতে অনতিবিলম্বে দুটি দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানী মন্ত্রীর ভাষ্যের বেশ কিছু অসত্য বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়।

এতে বলা হয়, প্রথমত, পাকিস্তান কমিশন গঠন নয় বরং সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত ইস্যু সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দেয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ তার দাবি করা ৪০০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ কিছু অর্থ দুমাসের মধ্যে পরিশোধের প্রস্তাব করে। অথচ পাকিস্তানী মন্ত্রী এ কথাটি গোপন করে বলেন, বাংলাদেশ তার সমুদয় পাওনা অর্থ ২ মাসের মধ্যে দাবি করেছে। ১৫২

পাকিস্তানী মন্ত্রীর দুটি চুক্তির কথাও সত্য ছিল না। প্রকৃতপক্ষে ভুট্টো এই সফরের সাফল্য সম্পর্কে প্রচার করলেও ক্রমান্বয়ে প্রকৃত ঘটনা যতই প্রকাশ হতে শুরু করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ততই মিথ্যার আশ্রয় নিতে থাকেন। তারা আশাবাদী ছিলেন সফরকালে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সফল হবেন।

এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ভুট্টোর সফরকালে মাহমুদ হারুনকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসেন। কিন্তু ভুট্টোর সে আশা পূরণ হয়নি। কোনো চুক্তি সম্পাদিত হলে কূটনৈতিক রীতি অনুযায়ী যুক্ত ইশতেহারে উল্লেখ হওয়ার কথা, অথচ যুক্ত ইশতেহারে এ ব্যাপারে কোনোরকম ইঙ্গিতও ছিল না।

তবে ভুট্টোর সফর বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যর্থ হলেও এই সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থীরা সংগঠিত হবার সুযোগ পায়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতি হলেও পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশে প্রাক-স্বাধীনতাকালীন অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায় সম্ভব নয়। তাই পাকিস্তানের বিবেচনায় এই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতার প্রধান কারণ ধর্মীয়, ঐতিহ্যগত যোগাযোগ এবং বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যের অবসান ঘটানো।

এই সফরকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে এ ধারণা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়। যদিও ভুট্টোর ঢাকায় পৌঁছানোর সময় যে গণঅভ্যর্থনা দেয়া হয়েছিল অবাঙালিদের ব্যাপারে তার অনীহার কারণে পাকিস্তান ফেরার সময় তারা আর উপস্থিত না হওয়ায় ভুট্টো নীরবে প্রস্থান করেন। তবে ভুট্টোর সফরের সময় একাত্তরের ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, আত্মপক্ষ সমর্থন সত্ত্বেও তার কিছু আচরণ ছিল পররাষ্ট্রনীতির রীতি-বহির্ভূত।

বিদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের ঢাকা সফরকালে রেওয়াজ অনুযায়ী সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণে তিনি প্রথমে অস্বীকৃতি; শেষত, বাংলাদেশের কঠোর মনোভাবের কারণে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণে রাজি হলেও পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্মৃতিসৌধে না গিয়ে বাইরে অবস্থান ছিল রীতিমত ঔদ্ধত্যের পরিচায়ক। ১৫৩

বাংলাদেশ কেনো মাত্র ১০ দিনের নোটিশে ভুট্টোর সফরকে উৎসাহিত করে, সেটা একটি প্রশ্নবোধক ব্যাপার হয়ে আছে। এর এ রকম একটা ব্যাখ্যা হতে পারে যে, ১৯৭৩-৭৪ সালে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের আর্থিক ও তেল সাহায্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এ সব দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সৌদি আরব ও চীনের স্বীকৃতি আদায়, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের আগ্রহ থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল। পাকিস্তান আকারে-ইঙ্গিতে এই ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছে যে, পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে তাদের ঋণ ও সাহায্যের পরিমাণ কমিয়ে দিলে মুসলিম বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো হতে পারে এর বিকল্প এবং পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে।

এ ছাড়া বিহারীদের স্বদেশে ফেরত দেয়া ও পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওনা সম্পদ ফেরত লাভের জন্য বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে দ্রুত বৈঠক করতে চেয়েছে।

৫. ভুট্টোর বাংলাদেশ সফর-পরবর্তী বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক (১৯৭৪ সালের জুন থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট)

ভুট্টোর সফর ব্যর্থ হলে ১৯৭৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি, মুজিবের লাহোর সম্মেলনে যোগদান এবং দিল্লি চুক্তির ফলে যে অগ্রগতির ধারা সূচিত হয় তা উল্টো দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এরপর থেকে উভয় সরকার পরস্পরবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রাখে, যা দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্কের আবারো অবনতি ঘটায়। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভুট্টো অপেক্ষা এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের নীতি গ্রহণ করেন।

১৯৭৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ব্যাপক বন্যা, বন্যার কারণে দুর্ভিক্ষ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আওয়ামী লীগ সরকার পররাষ্ট্রনীতির প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করার চাইতে অভ্যন্তরীণ সমস্যাদি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

এ সময় পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার কোনো সুযোগ তার হয়নি। তবে ২০ আগস্ট রেডিও ও টিভিতে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বন্যার কারণ হিসেবে পাকিস্তান সরকারের ২৪ বছরের শোষণ, বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণে চরম অবহেলাকেই দায়ী করেন। ১৫৪ অবশ্য পাকিস্তানও পিছিয়ে থাকেনি। বন্যার সুযোগে পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা ও দেশটির সরকার বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরু করে। জুলাই মাস থেকে বন্যার ছবি ও খবর গুরুত্বসহকারে ছাপানো হতে থাকে।

১ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া পত্রে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বন্যার্তদের জন্য দেড় লক্ষ মণ চাল ও ২০ লক্ষ পাউন্ড কাপড় সাহায্য ঘোষণা করলেও বন্যা পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা শুরু করে।

২ ডিসেম্বর এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো বলেন, বিপুল সংখ্যক মানুষের অনাহারে মৃত্যু সম্পর্কে জেনে আমরা মর্মাহত হয়েছি। এই বাঙালি জনগোষ্ঠী আশা করেছিল, স্বাধীন হলে তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান হবে। অথচ ফলাফল হয়েছে তার উল্টো।

বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ আনতো এবং তাদের সকল পশ্চাৎপদতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করত (১৫৫ এই বক্তব্যের মাধ্যমে একদিকে যেমন আওয়ামী লীগবিরোধী অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এই সঙ্কটকালেও ভুট্টো তার আগেকার প্রস্তাবের অনুসরণে নিঃশর্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেন। ১৫৬

ভুট্টোর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মাহমুদ আলী এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ৩ বছরের মধ্যেই ‘পূর্ব পাকিস্তানীরা’ অনাহার, দারিদ্র্য ও দুর্বিপাকে পতিত হয়েছে। এ বছরেরই জুন মাসে ভুট্টোর সফরের সময় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান ছিল মূলত মুজিবের প্রতি বাঙালির অনাস্থা ও পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি আস্থার পরিচায়ক। ১৫৭

পাকিস্তানের দৈনিক ডন ১৫ ডিসেম্বর মন্তব্য করে, বন্যাদুর্গত বাঙালিরা মন্তব্য করছে, তাদের জীবনযাত্রা পাকিস্তান আমলেই ভাল ছিল। একই সাথে ভুট্টো এ সময় পরিকল্পিতভাবে বন্যা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানে ভুট্টোর শাসনের সাফল্য ও বাংলাদেশের বিপর্যয় তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এর মাধ্যমে একদিকে তিনি বাঙালিদের চেয়ে পাকিস্তানীরা যে অনেক সুখে আছে তা প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে তেমনি পাকিস্তানপন্থীদের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়ারও চেষ্টা করেন।

পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো ছাড়াও লন্ডনে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় পাকিস্তান অংশ নেয়। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে লন্ডনে ‘প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তান অস্থায়ী সরকার গঠন’ করা হয় এবং একই মাসের ৭ তারিখে এই সংগঠনের দেয়া এক বিবৃতিতে ভারতীয় আগ্রাসন থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তানকে’ রক্ষায় এই সরকারের প্রত্যয় ঘোষিত হয়।

পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশকে দেয়া স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান থেকে অনুমান করা যায় লন্ডনে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার পেছনে ভুট্টোর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ২৬ আগস্ট করাচির স্পটলাইট পত্রিকা পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার অর্থ ব্যয়ের খবর প্রকাশ করে।

Sheikh Mujib receiving Bhutto
Sheikh Mujib receiving Bhutto

 

এ দিকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার অব্যবহিত পরেই ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ পুনরায় পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয় আলোচনার ব্যাপারে তার আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রগতি না হওয়ার জন্য উভয় দেশ পরস্পরকে দায়ী করে প্রচারণা অব্যাহত রাখে। ১৪

নভেম্বর কুয়েত সফরকালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন যে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হলেও পাকিস্তানের অনীহার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।১৫৮

বাংলাদেশ এ পর্যায়ে তার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তে অটল থেকে বিহারী প্রত্যাবাসন ও সম্পদ বণ্টন বিষয় দুটিকে সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচেনা করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান এ দুটি বিষয়কে গুরুত্বই দেয়নি। বরং সে মনে করে, বাংলাদেশ এই মনোভাব অব্যাহত রাখলে কোনো আলোচনাই ফলপ্রসূ হবে না।

সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মনোভাবকে দায়ী করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ২০ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ এখন সম্পদ বণ্টন ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে নতুন ইস্যু উপস্থাপন করছে। আমি খুশি হতাম যদি সম্পদ বণ্টন ও ঋণের দায় নিয়েও দুটি দেশের মধ্যে আলোচনা ও বৈঠক হত কিন্তু তারা শুধু সম্পদ বণ্টন নিয়ে কথা বলতে চায়, কোনো দায় গ্রহণে রাজি হয়নি।

আর এর অর্থ দাঁড়ায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ৫৬% সম্পদ পাবে। বাংলাদেশের এ দাবি আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতই অসম্ভব এবং এই দাবি অব্যাহত থাকলে সম্পর্কের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে। ১৫৯ ভুট্টোর এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিগত ব্যবধান প্রবল এবং এ কারণে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক ফলাফল সৃষ্টি হয়নি।

বরং ১৯৭৫ সালের প্রথম থেকে এই অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে। বছরের শুরুতেই থাট্টায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো সম্পর্কের প্রতিবন্ধকতার জন্য বাংলাদেশকেই দায়ী করেন। তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানবিরোধী অপপ্রচারের অভিযোগও আনেন। ১৬০ অন্যদিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ ২০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে তার প্রদত্ত বক্তৃতায় সম্পর্ক উন্নয়নে পাকিস্তানকেই দায়ী করে বলেন:

আমরা মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধে অভিযুক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করতে সম্মত হই। উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনে এটা আমাদের এক বিরাট অবদান। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল যে, পাকিস্তান এই মহানুভবতায় সাড়া দিয়ে দিল্লি চুক্তির প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ন্যায়নীতির ভিত্তিতে ভূতপূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ বণ্টন ও ৬৩ হাজার পাকিস্তানী পরিবারকে পাকিস্তান ফেরত নেয়া সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু জুন মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে আমাদের এ আশা পূরণ হয়নি। ১৬১

বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরে। ভুট্টোর সফরের ছ’মাসের মধ্যে অর্থাৎ জুন ১৯৭৪ থেকে জানুয়ারি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দুটি দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে কোনোরকম যোগাযোগ পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি। যদিও বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্যাদুর্গতদের জন্য ১০ হাজার ডলার সাহায্য পাঠায়।

তবে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কিছু পরিবর্তন পাকিস্তানকে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় উপকরণ সরবরাহ করে। বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থায় ভুট্টো বাংলাদেশে মুজিব সরকারকে উৎখাতের তৎপরতায় সহযোগিতা দিয়ে যান। স্ট্যানলি উলপার্ট ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে ভুট্টোর দুটি উদ্যোগের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন। প্রথম উদ্যোগটির সঙ্গে ভুট্টোর উপদেষ্টা মাহমুদ আলী জড়িত ছিলেন।

Bhutto - Mujib talks in Intercontinental Hotel Dhaka
Bhutto – Mujib talks in Intercontinental Hotel Dhaka

তার মাধ্যমে বাংলাদেশের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (স্বাধীনতাবিরোধী ও নিষিদ্ধ ঘোষিত) সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক ভুট্টোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আবদুল হকের প্রেরিত একটি চিঠি ১৬ জানুয়ারি ভুট্টোর হাতে পৌঁছায় এবং তাতে তিনি ভুট্টোকে ‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’ বলে সম্বোধন করে জনবিচ্ছিন্ন পুতুল মুজিবচক্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও ওয়্যারলেস ইত্যাদি উপকরণ প্রদানের আবেদন জানান।

পাকিস্তান সরকার চিঠিটি গুরুত্বসহ বিবেচনা করে এবং ভুট্টো এই ‘সৎ লোককে’ (আবদুল হক) কার্যকর সাহায্য করার সুপারিশ করেন। পরবর্তীকালে আবদুল হককে কী সহযোগিতা দেয়া হয়েছে, উলপার্ট সেটা উল্লেখ না করলেও বোঝা যায়, দলটি ভুট্টো সরকারের সহযোগিতা পেয়েছে। উলপার্ট জনৈক বাঙালি আব্দুল মালেকের মাধ্যমে ভুট্টোর সৌদি আরবে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার কথাও বিশদভাবে উল্লেখ করেন। ২২

জানুয়ারি আব্দুল মালেক সৌদি আরব থেকে ভুট্টোকে তার সফরের অগ্রগতি জানিয়ে পত্র দেন। চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান নিজেদের মুক্তির জন্য ভুট্টোর দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব লাভের জন্য গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করছে বলে মন্তব্য করেন। এ চিঠি প্রাপ্তির পর ভুট্টো তার ধর্মমন্ত্রী মওলানা কায়সার নিয়াজিকে সৌদি আরব পাঠান।

এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল মুজিবকে উৎখাতে সৌদি আরবের কূটনৈতিক ও আর্থিক সাহায্য এবং অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করা। ভুট্টো একই সাথে সৌদি আরবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন, ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ অথবা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতাদের সমন্বয়ে উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠনেরও চেষ্টা করে। ১৬২ এ ব্যাপারে সৌদি প্রতিক্রিয়া জানা না গেলেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং সৌদি আরবের আশ্বাস সত্ত্বেও স্বীকৃতি প্রদানের বিলম্ব ও বাংলাদেশের প্রতি বৈরী মনোভাব এই তৎপরতার আংশিক সাফল্য তুলে ধরে।

ভুট্টোর উপযুক্ত দুটি উদ্যোগের সত্যতা প্রমাণের কোনো উপায় না থাকলেও এ দুটি চিঠি ভুট্টোর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত থাকায়, উলপার্টের বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা, আব্দুল মালেকের পরিচয় না জানা গেলেও রাজনৈতিক আপোসকামিতা, ভুট্টোর বাংলাদেশে পিকিংপন্থী ও আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধীদের অর্থ সাহায্য সম্পর্কে উলপার্টসহ অন্যান্য সূত্রের সমর্থনের বিষয়টি ভুট্টোর উদ্যোগ-প্রয়াসের সত্যতাকেই প্রমাণ করে। ১৯৭৩-৭৫ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের ব্যাপক তৎপরতাও এই বক্তব্যের সাক্ষ্য দেয়।

Bhutto and Mujib in Dhaka 1971 as the troops were being amassed
Bhutto and Mujib in Dhaka 1971 as the troops were being amassed

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে ভুট্টোর বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা পাকিস্তানেও লক্ষ্য করা যায়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ভুট্টোর উপদেষ্টা মাহমুদ আলী এক বিবৃতিতে বলেন, পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একত্রিত হতে বাধা দিতে পারে। ১৬৩

এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠনের দাবি পুনরায় উপস্থাপন করে লাহোর হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এবং এই লক্ষ্যে তারা গঠন করে ‘পাকিস্তান একত্রীকরণ সমিতি’ নামের একটি সংগঠন। এই সমিতির উদ্যোক্তা ছিলেন দালালির অভিযোগে অভিযুক্ত নাগরিকত্বহীন লাহোর বারের বাঙালি অ্যাডভোকেট এ. কিউ. এম. শফিকুল ইসলাম ও হামিদুল হক চৌধুরী। ১১

এপ্রিল অনুষ্ঠিত সমিতির সভার এক প্রস্তাবে বলা হয়, মুসলিম বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান বৈদেশিক আক্রমণের শিকার হয়ে পৃথক হলেও বর্তমানে একত্রীকরণের ইচ্ছা প্রকাশ করছে। ১৬৪ ১৫ এপ্রিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক গফুর আহমদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের দুই অংশের একত্রীকরণ এবং এ জন্য প্রয়োজনে তার দলের যে কোনো আত্মত্যাগের ঘোষণা দেন। ১৬৫

পাকিস্তানের এ সব তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া জানা যায় ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের ভাষণ থেকে। তিনি বলেন,

ভুট্টো সাহেবকে জিজ্ঞাসা করি, বেলুচিস্তানের মানুষের অবস্থা কী? এরোপ্লেন দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করছেন। সিন্ধুর মানুষের অবস্থা কী? ঘর সামলান বন্ধু, ঘর সামলান। নিজের কথা চিন্তা করেন, পরের কথা চিন্তা করবেন না। পরের সম্পদ লুট করে খেয়ে বড় বড় কথা বলা যায়। আমার সম্পদ ফেরত না দেয়া পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে পারে না“।১৬৬

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য ও পাকিস্তানের তৎপরতা থেকে মনে হয় ১৯৭৫ সালে দুটি দেশের তিক্ততা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। অমীমাংসিত বিষয়ে পাকিস্তানের অনীহার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির কূটনীতি গ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে অবাঙালি প্রত্যাবাসন বিষয়ের উত্থাপন ছাড়াও ১৯৭৫ সালের মে মাসে জ্যামাইকার কিংসটনে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের বৈঠকে শেখ মুজিব সম্পদ বণ্টন ও বিহারী প্রত্যাবাসনের বিষয়টি তুলে ধরেন। ৫ মে সম্মেলনে প্রদত্ত তার বক্তব্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন:

The process of normalisation of relations could be further advanced if Pakistan would have come forward with a positive response on the question of repatriation of the remaining 63.000 families who had declared their option to the International Red Cross to be repatriated to Pakistan and also on the question of a just apportionment of assets. More particularly since we had constituted a majority in the former Pakistan and have since Independence assumed the very substantial burden of pre Independence liabilities:

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির এই ভাষণ সমর্থন করে বক্তব্য দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াকুব গাওয়ান, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও.আই.বি. চ্যাবন ও অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার ভাষণে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে দুই জাতিতে পরিণত একটি রাষ্ট্রকে তার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ১৬৮

পাকিস্তান ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথ থেকে বেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ সম্পর্কে আঁচ করতে পেরে তার প্রস্তাব যাতে সম্মেলনে পাস হতে না পারে সে জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। কিংসটনে কানাডায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইফতেখার আলী সম্মেলনের বাইরে তৎপরতা চালান। অবশ্য পাকিস্তানের এ জাতীয় অপচেষ্টা সত্ত্বেও সম্মেলনের শেষে যুক্ত ইশতেহারে বাংলাদেশের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ১৪ অনুচ্ছেদে সদস্যরা আশা পোষণ করেন যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিকভাবে সম্পত্তি বণ্টন ও বিহারীদের স্বদেশে প্রেরণের বিষয়ে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করবে। ১৬৯

পাকিস্তান সদস্য না হলেও সম্মেলনের গৃহীত এই প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একটি কূটনৈতিক বিজয়স্বরূপ ঘটনা ছিল। এই প্রথম এ দুটি সমস্যাকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলায় পাকিস্তান কূটনৈতিক ক্ষেত্রে চাপের সম্মুখীন হয়। এ ছাড়া কমনওয়েলথ সদস্যদের অনেকে পাকিস্তান যে সব ফোরামে সদস্য তারাও তার সদস্য থাকায় পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে চাপ দেয়। জুলাই মাসে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পদ বণ্টন বিষয়টি নিয়ে মুসলিম বিশ্বের মধ্যস্থতা কামনা করে।

সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে, আগস্ট মাসে আসন্ন জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে পুনরায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। যদিও ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের মৃত্যুর ফলে বাংলাদেশের নতুন সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নামে বিষয়টি উপস্থাপন করেনি। ফলে কূটনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া একটি ইতিবাচক সমাধান থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়। অবশ্য মুজিবের মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো বাংলাদেশের দুটি দাবিকে অযৌক্তিক বলে আবারো আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে বাংলাদেশের নেতিবাচক মনোভাবকে দায়ী করেন। ১৭০

উপসংহারে বলা যায় মুজিব আমলে দুপর্বে বিভক্ত বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সম্পর্ক কোনোভাবেই ঘনিষ্ঠতার দিকে যায়নি। দুদেশের মধ্যে কিছু অমীমাংসিত বিষয় যেমন পারস্পরিক লোক বিনিময়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি, অন্যদিকে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিদের বাংলাদেশের মুক্তি প্রদান, শেখ মুজিব ও ভুট্টোর একে অপরের দেশ সফর সত্ত্বেও সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেনি। সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে উভয় দেশের দৃষ্টিভঙ্গিগত অমিল ছিল প্রবল।

বাংলাদেশ স্বীকৃতির আগে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে অনীহা প্রকাশ এবং ভুট্টো ঠিক উল্টোটা অর্থাৎ বৈঠককে স্বীকৃতির পূর্বশর্ত হিসেবে উপস্থাপিত করেন। পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি, বিহারী বিষয় এবং বৈদেশিক ঋণের দায়ের ক্ষেত্রে সুবিধা লাভের জন্যই ভুট্টো এ বৈঠককে প্রাধান্য দেন। অথচ বাইরের চাপ সত্ত্বেও শেখ মুজিব এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি।

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বীকৃতির বিষয়ে সমাধান হলে বাংলাদেশ অমীমাংসিত বিষয় সমাধান সাপেক্ষে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং পাকিস্তান কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের পর এ বিষয়ে আলোচনার ওপর জোর দেন।

উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে না আসায় মুজিব আমলে দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। বরং উভয় দেশ বিভিন্ন সময় পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন ও অপপ্রচার অব্যাহত রাখে। ফলে বেসরকারি পর্যায়ে সীমিত বাণিজ্য ছাড়া এ পর্বে সম্পর্ক ছিল শীতল। অমীমাংসিত মানবিক বিষয়ে বাংলাদেশ উদারনীতি গ্রহণ করায় দুটি দেশের সম্পর্ক বাহাত ছিল চমৎকার।

যদিও সব অমীমাংসিত বিষয় যেমন—বিহারী প্রত্যাবাসন, সম্পদ বণ্টন বিষয় মীমাংসা না হওয়ায় মুজিব আমলে বিষয় দুটি জাতিসংঘে, জোটনিরপেক্ষ, কমনওয়েলথ সম্মেলনে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান এ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা স্থিতাবস্থা বজায় রাখায় বিষয় দুটিতে কোনো অগ্রগতি হয়নি যা উভয় দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মুজিব আমলে উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত না হওয়ায় উভয় দেশের মধ্যে কার্যত তেমন সম্পর্কই হয়নি। তাই শেখ মুজিব আমলে দুদেশের সম্পর্ককে সম্পর্কের প্রাথমিক পদক্ষেপ ও সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

In their words bhutto and mujib december 1971
In their words bhutto and mujib december 1971

 

তথ্যনির্দেশ

১. দ্রষ্টব্য সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ২০ জুলাই, ১৯৭২, পৃ. ৩২।

২. দ্রষ্টব্য, ঐ।

৩.  মার্কিন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠককালে ভুট্টো তার এত দিনের চীনপন্থী নীতি ব্যাখ্যা করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন চৈনিক নীতি এবং পাকিস্তানের ভূমিকার প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন। ভুট্টো ও মার্কিন নেতৃবৃন্দের বৈঠকের প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য Rafi Raza, Zulfikar Ali Bhutto and Pakistan 1967-1977, Dhaka, UPL, 1997, pp. 135-136.

8. ভুট্টোর বক্তৃতার জন্য দ্রষ্টব্য, Pakistan Horizon, Documents, Vol. XXV, No. 1, 1972, p. 145.

৫.. IDSA News Reviews in Pakistan and Bangladesh, December, 1971, pp. 18-19, আরো দ্রষ্টব্য Pakistan Times 21 Decembers, 1972.

৬. New York Times, 21 December, 1971.

৭. এ ছাড়া ২৪ ডিসেম্বর লাহোর হাই কোর্টে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মামলা হয়। রাওয়ালপিণ্ডিতে সুপ্রিমকোর্টের এক মামলায় ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণকে এক অন্যায় দখল, বেআইনি ও অসাংবিধানিক পদক্ষেপ বলে অভিহিত করে।

৮. New York Times op.cit., ইয়াহিয়া ছাড়া অন্যরা হচ্ছেন এস. জি. এম পীরজাদা, জেনারেল ওমর, জেনারেল খোদা দাদখান, জেনারেল কায়ানি ও জেনারেল মিঠা খান।

৯. Mohammad Ayub, India Pakistan Bangladesh Search for New Relationship, New Delhi, Indian Council of World Affairs, 1975, p. 76.

১০. Stanley Wolpert, Zulfi Bhutto of Pakistan His Life and Times, Delhi, Oxford University Press, 1993, pp. 174-175 লেখক ভুট্টোর নিজস্ব লাইব্রেরি থেকে ভুট্টো-মুজিব বৈঠকের রেকর্ড করা অংশের ভিত্তিতে এই অংশ রচনা করেন। ভুট্টোর ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের আকাঙ্ক্ষাকে স্ট্যানলি উলপার্ট বর্ণনা করেন এভাবে, Humpts Dumpts Pakistan Back Together Again.”

১১. Ibid, p. 175.

১২. Pakistan Times, 31 December, 1971.

১৩. Kessing’s Contemporary Archieve, Vol. XVII, 1971-72, p. 25110.

১৪. Ibid, আরো দ্রষ্টব্য Woopert, p. 175, op.cit, উলপার্ট ছাড়া তাহমিনা দুররানি তার My Feudal Lord, New Delhi, Sterling Publishers Ltd. 1991, p. 262; গ্রন্থে মুজিবের ভুট্টোকে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেন। সাংবাদিক অ্যানথনি ম্যাসকারেনহাসও লন্ডনে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় ভুট্টোকে দেয়া মুজিবের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেন, দ্রষ্টব্য, Anthony Mascacnhas, Bangladesh A Legacy of Blood, London: Hoder and Stoughon, 1986, p. 95.

১৫. আনন্দবাজার পত্রিকা? অবশ্য ২ জানুয়ারি ১৯৭২ ক্রিশ্চিয়ান মনিটর (লন্ডন) এক সম্পাদকীয়তে ভুট্টোর এই আশাবাদকে বোকার স্বর্গ বাস বলে মন্তব্য করে। দ্রষ্টব্য The Christian Monitor, 5 January, 1972.

১৬. দ্রষ্টব্য দৈনিক বাংলা, ৩ জানুয়রি, ১৯৭২।

১৭. রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার (গোলাম হিলালি অনূদিত), ঢাকা, ইউপিএল, ১৯৮৯, পৃ. ১৮।

১৮. The Dawn, 4 January, 1972. ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে বৈঠকের প্রাক্কালে পিন্ডিতে মার্কিন, রুশ ও চৈনিক রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের বিবরণ প্রকাশিত না হলেও অনুমান করা যায়, তারা মুজিবের মুক্তির বিষয়ে জোর দেন। এই বৈঠকের ১০ দিনের মধ্যেই মুজিবের মুক্তি তাই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ভুট্টোর রাজনৈতিক উপদেষ্টা রাফি রাজাও এ ব্যাপারে বৈদেশিক চাপের কথা উল্লেখ করেন। দ্রষ্টব্য Rafi Raza, op.cit., p. 225,

১৯. এ দুটি দেশ ছিল RCD, সিয়েটোর সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধকালে সরাসরি পাকিস্তানকে অস্ত্র যোগানদার এবং স্বাধীনতার পর ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা পালনকারী। এ দুটি দেশের মাধ্যমে ভুট্টো ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ব্যাপারে মুজিবের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন।

২০. L. L. Khatib, Who Killed Mujib, New Delhi, Vikas, 1982, p. 106-107.

২১. দৈনিক বাংলা, ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২।

২২. Times of India, 14 January, 1972 এবং দৈনিক পূর্বদেশ, ১৪ জানুয়ারি, ১৯৭২।

২৩. Pakistan Times (Karachi), 14 January, 1972.

২৪. দৈনিক বাংলা, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭২।

২৫. Kessing’s Contemporary Archieve, op.cit. p. 25111.

২৬. The Dawn, 18 January; আরো দ্রষ্টব্য দৈনিক বাংলা, ১৮ জানুয়ারি, ১৯৭২।

২৭. Kessing’s Contemporary Archieve, op.cit.

২৮. ইত্তেফাক, ২০ জানুয়ারি, ১৯৭২।

২৯. Pakistan Horizon, Chronology, Vol. XXV, No. 1, 1972, p. 124.

৩০. Pakistan Times, 28 January, 1972.

৩১. Pakistan Horizon, op.cit, p. 125.

৩২. Times (London), 8 February, 1972.

৩৩. Pakistan Horizon, op.cit., p. 129, 133.

৩৪. Sanal Edam Aruku, “India-Pakistan Relations the Bhutto Era”, M.Phil Thesis, New Delhi, January, 1979, p. 25.

৩৫. Assam Tribute, 11 February, 1972.

৩৬. Pakistan Horizon, op.cit., p. 131.

৩৭. Pakistan Horizon, Chronology, Vol. XXV, No. 2, 1972, p.84.

৩৮. Tbid, p. 86.

৩৯. দ্রষ্টব্য বরুণ সেনগুপ্ত, বিপাক-ইস্তান, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৭২, পৃ. ৫৯।

৪০. উদ্ধৃত মঞ্চে নেপথ্যে’, দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪।

৪১. Pakistan Horizon, op.cit., p. 90.

৪২. The Bangladesh Observer, 9 June, 1972.

৪৩. দৈনিক বাংলা, ৪ জুন, ১৯৭২।

৪৪. ঐ ২১ জুন, ১৯৭২।

৪৫. Pakistan Times, 26 June, 1972.

৪৬. The Bangladesh Observer, 8 July, 1972.

৪৭. Pakistan Horizon, Documents, Vol. XXV. No 3, 1972,

৪৮. Hindustan Times, 16 July, 1972.

৪৯. Statesman, 22 July, 1972.

৫০. The Bangladesh Observer, 21 July, 1972.

৫১. Pakistan Times, 11 August, 1972.

৫২. Asian Recorder, Vol. XVIII, No. 36, 1972, p. 10957.

৫৩. উদ্ধৃত, দৈনিক বাংলা, ২৯ জুলাই, ১৯৭২।

৫৪. ঐ, ৩১ জুলাই, ১৯৭২।

৫৫. ঐ ৬ আগস্ট, ১৯৭২।

৫৬. Verinder Grover and Ranjana Arora (eds.), Political System in Pakistan, Vol. 10, New Delhi, Deep and Deep Publishers, 1995, p. 297.

৫৭. উদ্ধৃত Hindustan Times, 25 August, 1972.

৫৮. ৩৮টি প্রশ্ন সংবলিত এই লিফলেটটি ‘পাকিস্তান টাইমস’-এ ১৮ আগস্ট প্রকাশিত হয়।

৫৯. Hindustan Times, 25 August, 1972.

৬০. দ্রষ্টব্য আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ জুলাই, ১৯৭২।

৬১. দৈনিক বাংলা, ২৭ জুলাই, ১৯৭২।

৬২. Pakistan Horizon, Chronology, op.cit., p. 98. বিস্তারিত বিবরণের জন্য আরো দ্রষ্টব্য সংবাদ, ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২।

৬৩. Pakistan Horizon, Chronology, Vol. XXV, No. 4, 1972, p. 81.

৬৪. সংবিধানের প্রথমভাগের ২য় অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের সীমা সম্পর্কে বলা হয়েছে। (ক) ১৯৭১ খৃস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল এবং (খ) যে সকল এলাকা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সীমানাভুক্ত হইতে পারে। দ্রষ্টব্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, (ঢাকা: আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তারিখ উল্লেখ নেই), পৃ. ৩।

৬৫. দৈনিক বাংলা, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২। ঢাকা, মুক্তি প্রকাশনী,

৬৬. দ্রষ্টব্য, আবু সাইয়িদ, মেঘের আড়ালে সূর্য, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বিতর্ক, ১৯৮৭, পৃ. ২৪।

৬৭. Pakistan Horizon, op.cit., p. 99.

৬৮. Ibid, p. 104.

৬৯. Pakistan Horizon, Chronology, Vol. XXVI No. 1, 1973, p. 18.

৭০. দৈনিক বাংলা, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭২।

৭১. Dawn, 17 December, 1972.

৭২. IDSA News Review in South Asia, January, 1973, p. 18.

৭৩. দৈনিক বাংলা, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭২।

৭৪. Pakistan Horizon, Chronology, Vol. XXV. No. 4, 1972, p. 104.

৭৫. Ibid, Chronology, Vol. XXVI, No. 1, 1973, p. 61.

৭৬. Hindu, 1 January, 1973.

৭৭. দৈনিক জনপদ, ১ মার্চ, ১৯৭৩।

৭৮. Link, 26 November, 1972, p. 21.

৭৯. Times of India, 26 December, 1972.

৮০. ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ৬ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো ছিল ভাসানী ন্যাপ, বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদ), বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, কমিউনিস্ট পার্টি। এই জোটের অধিকাংশ দল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন করে। জোটভুক্ত সবগুলো দল মিলে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হয়। ভাসানী ন্যাপ ১৬৯টি, বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ৩টি, শ্রমিক কৃষক সাম্যবাদী দল ৩টি আসনে প্রার্থী দেয়।

৮১, Pakistan Horizon, op.cit., p. 70.

৮২. Ibid, p. 74.

৮৩. Ibid., pp. 75-76.

৮৪. Ibid., p. 71.

৮৫. Pakistan Times, 5 March, 1973.

৮৬. দ্রষ্টব্য মওদুদ আহমদ (জগলুল আলম অনূদিত), বাংলাদেশ: শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ঢাকা, ইউপিএল, ১৯৮৩, পৃ. ১৮৪৷

৮৭. “Constitution of Islamic Republic of Pakistan”, Foreign Affairs Report (Islamabad), Vol. XXII, July, 1973, p. 131. অথচ রেডিও পাকিস্তান ঐ দিনই ঘোষণা করে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৬,৪৮,৯২০০ জন। এ হিসাব করা হয় ১৯৭২ সালে সেপ্টেম্বর প্রণীত আদমশুমারির ভিত্তিতে। জনসংখ্যার এই হিসাব থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে বাদ দেয়া হয়েছে। জনসংখ্যার এই পরিসংখ্যানই বাংলাদেশকে আলাদা দেশ হিসেবে পাকিস্তানের স্বীকৃতির প্রমাণ দেয়। দ্রষ্টব্য Satish Kumar, The New Pakistan, New Delhi, Vikas, 1978, p. 266.

৮৮. The Bangladesh Observer, 16 April, 1973.

৮৯. দৈনিক বাংলা, ১৮ এপ্রিল ১৯৭৩। ১৯ এপ্রিল জাতীয় সংসদে তিনি পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টার নিন্দা করেন।

৯০, The National Assembly of Pakistan (Legislature) Debates, Official Reports, Vol. III, No. 24 May, No. 1, 1973. pp. I-V. এতে বেলুচিস্তানের ৫ জন, পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৮ জন, উত্তর-পশ্চিম সীমন্ত প্রদেশের ১৮ জন, পাঞ্জাবের ৮৪ জন এবং সিন্ধুর ২৭ জনসহ মোট ৩০২ জন সদস্যের নাম ছাপা হয়। অথচ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত ত্রিবিদ রায় ও নুরুল আমিন ছাড়া সকলেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। কেউ পাকিস্তানে উপস্থিতও ছিলেন না। মূলত সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখানোর জন্যই এই হঠকারিতার আশ্রয় নেয়া হয়।

৯১. Statesmen, 10 May, 1973, ধৃত সকলে ছিল রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্য। তাদের কাছে থেকে অস্ত্র ছাড়াও মুসলিম বাংলার অনুকূলে প্রচার সহায়ক পুস্তিকা ও প্রচারপত্র পাওয়া যায়। জেনারেল হাবিব স্বীকার করে যে, সে নিজে ভারতীয় হাইকমিশনারকে মার্চ মাসে প্রদত্ত পত্রে তার প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে।

হাবিব আরো স্বীকার করে, তাদের আন্দোলন ভুট্টোর প্রস্তাবিত কনফেডারেশন পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত ছিল। তাদের সঙ্গে ভুট্টোর প্রতিনিধিদের সংযোগের কথাও স্বীকার করে। তাদের ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল ও দিনাজপুরে শাখা রয়েছে। উল্লেখ্য এ সব জেলায় ইতোমধ্যে মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে মুসলিম বাংলার চাঁদতারা খচিত পতাকা ওড়ানো হয়।

৯২. Dawn, 11 May, 1973.

৯৩, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ জুলাই, ১৯৭৩।

৯৪, ঐ।

৯৫. Party Life, New Delhi, 11 June, 1973,

৯৬. Tbid., 18 June, 1973.

৯৭. Pakistan Times, 28 June, 1973.

৯৮. Hindustan Times, 21 July, 1973.

৯৯. Pakistan Horizon, Chronology, Vol. XXVI. No. 3, 1973, pp. 76-77.

১০০. Tbid, p. 78.

১০১. Sos. Ibid, p. 81.

১০২. Ibid, p. 86.

১০৩, জাতীয় সংসদের বিতর্ক সরকারি বিবরণী, খণ্ড ৩, ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩, পৃ. ৩১২। মন্ত্রী জানান, স্বাধীনতার পর থেকে আসলাম ঢাকায় অবস্থান করে পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। গোয়েন্দা বিভাগ ও সরকারি পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতার ফলে তিনি এ সময় দেশ ত্যাগ করেন। হলিডে প্রথম দিকে তার সঙ্গে পত্রিকার সংশ্লিষ্টতা গোপন রাখলেও হলিডে ১৯৭৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সংখ্যা তার দায়িত্ব পালনের কথা স্বীকার করে। ১৯৯৮, পৃ. ৮২।

১০৪. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের তারিখ, ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৮, পৃষ্টা. ৮২।

১০৫. Pakistan Horizon, op.cit., No. 4, 1973, p. 71.

১০৬. Job. Ibid, p. 73.

১০৭, একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, ঢাকা, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, ১৯৮৭, পৃষ্ট.২২।

১০৮. Holiday, 13 January, 1976,

১০৯. আতাউর রহমান খান ও ভাসানী মনে করতেন দালাল আইন জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। দ্রষ্টব্য: মওদুদ আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭১।

১১০, গণকণ্ঠ, ১১ ডিসেম্বর ১৯৭৩। জাসদ-এর মুখপত্র দৈনিক গণকন্ঠ তার বিভিন্ন প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র কলামে দালালদের মুক্তির পক্ষে মতামত প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক আবুল ফজল ২৩ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক-এ ‘স্বাধীনতা দুইটি প্রতিবেদন’ শীর্ষক নিবন্ধে অনুরূপ মত দেন।

১১১, সংবাদ, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩, ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩।

১১২. বাংলার বাণী, ২০ জুন, ১৯৭৩।

১১৩. Amnesty International Annual Report 1973-74, London, Amnesty International Publications, 1974, p. 50.

১১৪. Pakistan Horizon, Chronology, Vol. XXVII. No. 1, 1974, p. 84, 100.

১১৫. Dawn 24 January, 1973.

১১৬, দৈনিক বাংলা, ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪।

১১৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ওআইসি সম্মেলনে যোগদানের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে দ্বিমত দেখা দেয়। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে একজন মন্ত্রীকে লাহোরে পাঠানোর অভিমত দেন। তিনি যুক্তি দেখান যে, প্রধানমন্ত্রী লাহোরে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়ের মীমাংসার জরুরি তাগিদ হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থীরা অধিকতর সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবে।

অবশ্য খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রধানমন্ত্রীকে জোর সমর্থন দেন। দ্রষ্টব্য এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ঢাকা, ইউপিএল, ১৯৯৬, পৃ. ১৭২।

১১৮. Dawn 24 February, 1974.

১১৯, Ibid, 25 February, 1974.

১২০. Pakistan Horizon, op.cit, p. 106.

১২১ Fakhruddin Ahmed, Critical Times: Memoirs of a South Asian Diplomat Dhaka, UPL, 1994, p. 204.

১২২. Md. Nazrul Islam, Foreign Policy of Bangladesh the Mujib Era”, M.Phil Thesis, New Delhi, January, 1982, p. 187.

বাংলাদেশ চর্চা: ষষ্ঠ

১২৩, দ্রষ্টব্য মওদুদ আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬৪।

28. Tufa Zaman, ‘Bangladesh and the Organization of Islamic Conference 1971-1988, M.Phil Thesis, New Delhi, January, 1984, p. 145.

(১২৫, Pakistan Relations with the Islamic States, A Review by Ministry of Foreign Affairs, Government of Pakistan, in Pakistan Horizon, Vol. XXX, No. 1, 1977, p. 229.

১২৬. ১৯৫ জনের বিচার এবং তাদের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল প্রচুর। বাংলাদেশ সরকার কখনোই তাদের নাম প্রকাশ করেনি। ভারত ও পাকিস্তান সরকার তাদের তালিকা চেয়েও পায়নি। এমনকি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তালিকা চাওয়া হলে বিশেষ কারণে তা প্রকাশ সম্ভব নয় বলে তারা মন্তব্য করেন।

329. Pakistan Horizon, op.cit., p. 81. ১২৮. Kessing’s Contemporary Archieve, Vol. XX, 1974, p. 26509.

১২৯. দৈনিক জনপদ, ১৩ এপ্রিল, ১৯৭৪,

300. Pakistan Times, 14 April, 1974.

(১৩১, Pakistan Horizon, op.cit, p. 81. (১৩২. দৈনিক সমাজ (ঢাকা), ১৮ এপ্রিল, ১৯৭৮।

১৩৩. দ্রষ্টব্য G. W. Chowdhury, India Pakistan Bangladesh and the Major Powers, London, The Free Press, 1975, p. 240-241.

১৩৪. ইত্তেফাক, ১৯ মে, ১৯৭৪।

১৩৫. J.N. Dixit, Liberation and Beyond Indo-Bangladesh Relations, Dhaka, UPL, 1999, p. 192 এই দলের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পর্কে পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন আহমদও তার গ্রন্থে অনুরূপ মন্তব্য করেন।

১৩৬. Dawn, 26 June, 1974.

১৩৭, Pakistan Horizon, op.cit. p. 91.

১৩৮ পূর্বদেশ, ২৮ জুন ১৯৭৪; আরো দ্রষ্টব্য Hindustan Standard 20 July 1974. বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব একই মত পোষণ করেন। অবশ্য বাংলাদেশের ২/১টি পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ২০০০ লোক ভুট্টোবিরোধী একটি বিক্ষোভ প্রদর্শনও করে। তারা ‘Bhutto go back’, ‘Bhutto go back’, ‘We Condemn Genocide’ লেখা শ্লোগানের পোষ্টার ও প্লাকার্ড বহন করে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের ভুট্টোর সফরকে কেন্দ্র করে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানের আন্তরিকতার কারণে ভুট্টো বিরোধিতা প্রবল হতে পারেনি। ভুট্টোবিরোধী স্লোগান সম্পর্কে তার সফরসঙ্গী রাফি রাজাও তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। দ্রষ্টব্য Rafi Raza, op. cit, p. 225.

139. J.N. Dixit op.cit., p. 190.

380. Pakistan Horizon, op.cit. pp. 190-191.

141. Ibid, pp. 191-192.

বাংলাদেশ-পাকিস্তান রাজনৈতিক সম্পর্ক ১৯৭১-১৯৭৫

182. Dawn, 28 June, 1974,

১৪৩. পূর্বদেশ, ৩০ জুন, ১৯৭৪।

388, Morning News (Dacca), 30 June, 1974.

384. Rabindranath Trivedi (Compiled), International Relations of Bangladesh and Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 1974-75, Vol. II, Dhaka, Parama, 1999, pp. 1196-1197.

386. Pakistan Horizon, op.cit., p. 195.

389. Stanley Wolpert, op.cit., p. 238.

188. Facts on File, Vol. 34, No. 1756, 6 July, 1974, p. 542.

১৪৯. Morning News (Karachi) 30 June, 1974 আরো দ্রষ্টব্য, Hindustan, Standard, 1 July, 1974.

১৫০. দ্রষ্টব্য, Public Opinion Trends and Analysis (POT), Pakistan Series, New Delhi, Vol. II, Part 71, pp. 387. এরপর শুধু (POT) উল্লেখ করা হবে। আরো দ্রষ্টব্য পাকিস্তানের মর্নিং নিউজ, জং, নওয়া-ই ওয়াক্তসহ অন্যান্য পত্রিকা সফর-সংক্রান্ত মতামতের জন্য দ্রষ্টব্য POT-এর এ সংখ্যার ৩৮৭-৮৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

১৫১. Dawn, 5 July, 1974 আরো দ্রষ্টব্য আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ জুলাই, ১৯৭৪। ১৫২. Kessing’s Contemporary Archieve, Vol. XX, 1974, p. 26680.

১৫৩. দ্রষ্টব্য ফারুক চৌধুরী, “বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য”, মাসিক বেতার বাংলা, ১৬-৩১ শ্রাবণ ১৪০৩, পৃ. ৮৫। ২৮ জুন সকাল ১০:৪৫ মিনিটে স্মৃতিসৌধে পৌঁছার আগে ভোর থেকে ভুট্টোবিরোধীরা স্লোগান দেয়। তাদের অনেকের হাতে প্ল্যাকার্ড ছিল ‘killer Bhutto go back’, অবশ্য নিরাপত্তা রক্ষীরা তাদের সরিয়ে দেয়। যদিও এখানে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানও শোনা যায়। তবে পাল্টা ধাওয়ার মুখে কিছুক্ষণের মধ্যে এই স্লোগান বিলীন হয়ে যায়। স্মৃতিসৌধ-সংক্রান্ত ঘটনাবলির জন্য দ্রষ্টব্য Morning News and Hindustan Times, 29 June, 1974.

১৫৪. Statesman, 21 August, 1974.

১৫৫. Morning News (Karachi) 3 December, 1974.

১৫৬, Pakistan Horizon, Chronology, Vol. XXVLI, No. 1, 1975, p. 64,

১৫৭, Pakistan Times 6 December, 1974.

১৫৮, ইত্তেফাক, ১৫ নভেম্বর, ১৯৭৪।

১৫৯, Pakistan Times, 30 December, 1974.

১৬০. Morning News (Karachi), 3 January, 1975.

১৬১. জাতীয় সংসদের বিতর্ক, বাংলাদেশ প্রথম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের সরকারি বিবরণী, খণ্ড ১, সংখ্যা ১, ১৯৭৫, পৃ. ১২।

১৬২. Stanley Wolpert, op.cit, p. 248.

১৬৩. Morning News (Karachi) March, 1975.

১৬৪. POT Pakistan Series, Vol. III, Part 39, 16 April, 1975, p. 234.

১৬৫. Ibid.

১৬৬. উদ্ধৃত, সরকার সিরাজুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম: সরদার তৌফিক জুনায়েদ, ১৯৮৯, পৃ. ১৩৩-৩৪।

১৬৭. Rabindranath Trivedi, op.cit., p. 133.

১৬৮. ইত্তেফাক, ৮ মে, ১৯৭৫।

১৬৯. উদ্ধৃত ফারুক চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৭।

১৭০. Dawn, 7 August, 1975.

আরও পড়ুন:

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক একটি তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণের প্রয়াস – মোহাম্মদ সেলিম

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক একটি তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণের প্রয়াস – মোহাম্মদ সেলিম : বিশ্বায়নের এই যুগে কোন রাষ্ট্র “একা চল” নীতি গ্রহণ করতে পারে না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশ, নিরাপত্তা, বিজ্ঞানপ্রযুক্তি, ভৌগোলিক অবস্থান এমনি বহুমুখী প্রয়োজন আর নানা ধরনের বাধ্যবাধকতা প্রতিটি রাষ্ট্রকেই অন্য রাষ্ট্রের কাছে নির্ভরশীল করে তুলেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বৈদেশিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি রাষ্ট্রকেই বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণের প্রয়াস - মোহাম্মদ সেলিম - বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Srimoti Indira Gandhi Interacting with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rehman on 07 Feb 1972 at Raj Bhawan ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Srimoti Indira Gandhi Interacting with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rehman on 07 Feb 1972 at Raj Bhawan ]

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক

বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ উঠলে ভারতের নামই প্রথম মনে আসে, যদিও মায়ানমারের সঙ্গেও বাংলাদেশের সীমান্ত বিদ্যমান। উল্লেখ্য বাংলাদেশের মোট সীমান্তের ৭৮.৮৬ শতাংশ ভারতের সঙ্গে আর মাত্র ৬.০৫ শতাংশ মায়ানমারের সঙ্গে। কেবল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলে ভারতীয় প্রভাব অনস্বীকার্য। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সাতটি দেশের মোট ভূখণ্ডের পরিমাণ এবং জনসংখ্যার চাইতে ভারতের ভূখণ্ড এবং জনসংখ্যা বেশি। স্মর্তব্য, আয়তনের দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় তেইশ গুণ এবং পাকিস্তানের তুলনায় চার গুণেরও বেশি বড়।

তথাপি ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অবস্থানগত গুরুত্ব রয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তসহ আকার এবং প্রকৃতিগত দিকও বিবেচনা করতে হবে। একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে সে দেশের ভৌগোলিক অবস্থা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থানের রণকৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। একদিকে এটি যেমন দক্ষিণ এশিয়ার অংশ, অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে রয়েছে ভৌগোলিক সংশ্লিষ্টতা। বিশ্বের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ ভৌগোলিক-সংযোগকারী হিসেবে কাজ করছে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পর্বে দুই পরাশক্তির মধ্যে নৌশক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে আটলান্টিকের পরিবর্তে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে ওঠে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্র। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে বিশ্বের বড় শক্তিগুলো পরস্পরবিরোধী ভূমিকা নেয়। তাই ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।

অন্যদিকে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের কাছেও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্ব অস্বীকারের উপায় নেই। কারণ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি ভূবেষ্টিত রাজ্য আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, অরুণাচল, মেঘালয় এবং ত্রিপুরা ভারত থেকে প্রায় ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা পরিস্থিতির মত অবস্থায় আছে। একই কারণে এ সব রাজ্য কলকাতা বা মাদ্রাজ সমুদ্রবন্দরের কোন সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। শুধু নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যকার ১৬/১৭ মাইল প্রস্থের “শিলিগুড়ি করিডোর”-এর মাধ্যমে ভারত তার বৃহদঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করছে। ১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশের অভ্যুদয় এর ফলে উপমহাদেশের শক্তিসাম্যও পরিবর্তিত হয়ে যায়। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মায়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ব্যতীত বাংলাদেশ সামগ্রিক অর্থে ভারত-পরিবেষ্টিত (India locked) একটি রাষ্ট্র। এর পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার, উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় ও আসাম, পূর্বে আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মায়ানমার এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এমনি ভৌগোলিক অবস্থানের বাধ্যবাধকতার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে “India Factor” বা “ভারত উপাদান” গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।২

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৭১-১৯৮১ সময়কাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আলোচ্য সময়ের বিশেষ গুরুত্ব হলো এ সময়ে দুটি রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যথাক্রমে সরকার পরিচালনা করে। বর্তমানেও ঘুরে ফিরে এ দুটি দলই ক্ষমতায় আসছে। প্রকৃতপক্ষে প্রথম একদশকে দুদেশের সম্পর্কের দ্বিমাত্রিক চরিত্র লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে, ১৯৭১-১৯৭৫ পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ, আন্তরিক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে পঁচাত্তর-উত্তরকালে পারস্পরিক আস্থার অভাব সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে। কিন্তু এই বক্তব্যের অতিসরলীকরণ পুরোপুরি প্রশ্নাতীত নয়।

যে বিষয়টি বিবেচ্য তা হলো ১৯৭১-১৯৭৫ সময়কালে দুদেশের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা ছিল গভীর। বিশেষভাবে ভারত সরকারের মনোভাব ছিল ইতিবাচক। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন মহল রাজনৈতিক কারণে “ভারত বিরোধিতা” নিয়ে আসে সহজে জনমত প্রভাবিত করার কৌশল এবং নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির উপায় হিসেবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও এর প্রভাব দেখা যায়। একই সমান্তরালে ভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রতিকূল ধারা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদিতে ভারত সরকারও অনমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

আলোচ্য দশকে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক উত্থান-পতন লক্ষ্য করা যায়। নানা কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এবং এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার সুযোগও বিদ্যমান।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কোন না কোন পর্যায়ে ভারতীয় মনোভাব এবং প্রতিক্রিয়ার বিষয় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রায় চার দশক সময়কালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বহু চড়াই-উৎরাই লক্ষ্য করা যায়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশ জন্মলগ্নেই কিছু দ্বিপাক্ষিক সমস্যা লাভ করে। আবার কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীনতার পর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে সম্পর্কের সূচনা হয়। কিন্তু দুদেশের সৌহার্দ্য-বন্ধুত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ইতিবাচক সম্পর্ক উভয়ের জন্যই কল্যাণকর। বিশেষভাবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কোন বিকল্প নেই।

জাতীয় স্বার্থেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের জনৈক কূটনীতিক। তিনি লিখেছেন,

Bangladesh has a vital stake that neighbouring countries remain peaceful, stable and friendly or at least not unfriendly towards Bangladesh. Bangladesh has a more direct interest in making sure that hostilities between countries and within countries in South Asia do not occur.

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রাচীনকাল থেকে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যগত সাদৃশ্য এবং ভারতের ছয়টি রাজ্যের সঙ্গে ভূখণ্ডগত সম্পর্ক। ভাষা, জাতিগত মিলের ফলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষভাবে বাংলা ভাষাভাষি ভারতীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশের অধিবাসীদের জাতিগত সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার বন্ধন রয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী প্রাণের দায়ে, সম্ভ্রম রক্ষার জন্য সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। স্মর্তব্য, এই বিরাট সংখ্যক শরণার্থীর অনেকেই ছিল ভারত সরকারের ত্রাণ কার্যক্রমের বাইরে। সাধারণ ভারতীয় জনগণের সাহায্য-সহানুভূতিই ছিল শরণার্থীদের প্রধান সম্বল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলেও এই অঞ্চলের জনগণের মনোজগতে বড় ধরনের বৈরিতার জন্ম দেয়নি। এক ধরনের সহমর্মিতার বন্ধন অটুট ছিল।।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

এমনি ধরনের পারস্পরিক আস্থা, সহানুভূতির বন্ধনের কথা বললেও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ২/৩ বছরের মধ্যেই দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে কেবল নয়, এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও “India Factor” অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে স্বাধীনতা-উত্তর মুজিব সরকারের আমলে দেশের অভ্যন্তরে “ভারতবিরোধী” জনমতকে তোষণ করার জন্য। বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান, ওআইসি এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতি ও সহানুভূতি লাভের চেষ্টা চালায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধারা এখনও অব্যাহত। যে কারণে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচার-প্রচারণায় ভারত বিরোধিতা প্রাধান্য পায়। প্রধান দলগুলো একে অপরকে “ভারতের দালাল” বলে আক্রমণ করতেও দ্বিধা করে না। বাংলাদেশের জনগণের একটি অংশের মধ্যে “ভারতবিরোধী মনোভাব বিদ্যমান—এটা অস্বীকারের জো নেই। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের প্রতিও ভারতীয় জনগণের একটি অংশ বিশেষভাবে নয়াদিল্লির মনোভাব খুব একটা ইতিবাচক নয়। ভারতের রাজনৈতিক এলিটরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে এর পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছে।

কিন্তু কথা হলো ভারতীয় জনগণ এবং সরকারের অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে এবং বিশ্বের সরকারসমূহের উদাসীনতা ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন যে মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ত, সে অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন ছিল। সম্ভবত এমনিতর সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়টি দুদেশের সরকার এবং জনগণের মধ্যে পারস্পরিক প্রত্যাশাকে অবাস্তব পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুদেশের রাজনৈতিক এলিটদের শ্রেণীস্বার্থগত প্ররোচনা।

বর্তমান পারস্পরিক নির্ভরশীল বিশ্বে বাংলাদেশের মত ছোট এবং দুর্বল রাষ্ট্রের পক্ষে ভারতের ন্যায় শক্তিশালী নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে এক ধরনের বৈরী সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের সামর্থ্যের মধ্যে পড়ে কি না তা নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করার সময় এসেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণার সুযোগ বিদ্যমান। এই বিষয়ে ভারতসহ অন্যান্য দেশে দুএকটি গবেষণা যে হয়নি তা নয়। কিন্তু গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি, তাত্ত্বিক কাঠামো, ব্যবহৃত তথ্য উপাত্ত, সবশেষে একপেশে বিশ্লেষণ গবেষণাকর্মগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। এ বিষয়ে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

১.

নিম্নে আলোচিত গবেষণা গ্রন্থগুলোর বাইরে দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জার্নালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলোতে দুদেশের সম্পর্কের নানা ইস্যু প্রাধান্য পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফারাক্কা সমস্যা, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, সীমান্ত সংঘর্ষ, ভারসাম্যহীন বাণিজ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা, আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রভৃতি। প্রবন্ধগুলো সুনির্দিষ্ট ইস্যু/সমস্যা জানতে সাহায্য করলেও স্বাভাবিক কারণেই সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধের পর্যালোচনা করতে গেলে তা বিরাট আকার ধারণ করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশনার পর্যালোচনা কেবল গ্রন্থ/গবেষণাকর্মের (এম.ফিল ও পিএইচডি) মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছে।

ড. এস. এস. বিন্দ্রা তার Indo-Bangladesh Relations, New Delhi, 1982 গ্রন্থে ১৯৭২-১৯৮১ পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্ক আলোচনা করেছেন। ভূমিকা উপসংহারসহ মোট ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন বিষয়বস্তুকে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম “Indo Bangladesh Relations: Mujib Era” এই অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়কালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি আলোচনা করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ভারত সরকার বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে আর দুদিন পরেই বাংলাদেশ নয়াদিল্লিতে ৯ ডিসেম্বর তার প্রথম দূতাবাসের উদ্বোধন করে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সূচনা এখান থেকে নয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধের গোড়াতেই ভারত সক্রিয় ইতিবাচক ভূমিকা নেয়। লেখক মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার বিস্তারিত আলোচনা করেননি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখ করেছেন। তবে এ সময়ে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিসমূহ, সরকারপ্রধানসহ দুদেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের সফরের আলোচনা আছে।

গুরুত্বপূর্ণ যে সব চুক্তি আলোচিত হয়েছে তা হলো, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব সহযোগিতা এবং শান্তি চুক্তি (১৯ মার্চ, ১৯৭২), পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে দিল্লি চুক্তি (২৮ আগস্ট, ১৯৭৩)। তবে এ সময়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুদেশের মধ্যে অনেকগুলো চুক্তি/প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। দুদেশের মধ্যে তিন স্তরভিত্তিক বাণিজ্য চুক্তি (২৮ মার্চ ১৯৭২), ভারত-বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ জুলাই তিন বছর মেয়াদী নতুন বাণিজ্য চুক্তি, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭৪ দুদেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য ১০ জুন ১৯৭২ আণবিক শক্তি ও মহাশূন্য গবেষণার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ ক্রীড়া, তথ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান বিনিময়ের জন্য দুবছর মেয়াদী প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এ সময়ে স্বাক্ষরিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হলো সীমান্ত চুক্তি (মে, ১৯৭৪)। উনিশশ পঁচাত্তরের সামরিক অভ্যুত্থান ও ইন্দো-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর প্রভাব আলোচনার মধ্য দিয়ে এই অধ্যায় শেষ করা হয়েছে।

আলোচিত অধ্যায়ের বিষয়বস্তুকে লেখক ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে পুনর্গঠন কার্যক্রমে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। সেই জাতীয় সঙ্কটকালীন মুহূর্তে ভারত ব্যতীত বাংলাদেশের বিকল্প কোন বন্ধু ছিল না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানী লেখকরা যেমন মনে করেন পাক-ভারত যুদ্ধ, তেমনি লেখকও প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। তিনি লিখেছেন,

“The dismemberment of Pakistan after the Indo-Pak war of 1971 alter the state structure of South Asia, “

৫ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার, জনগণ, সেনাবাহিনীর ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি মুজিবনগর সরকার, বাংলাদেশের জনগণের ত্যাগ, মুক্তিবাহিনীর অবদানকে অবহেলার চোখে দেখাটা ইতিহাসসম্মত হবে না। লেখক ভারতবিরোধী প্রচারণার কয়েকটি কারণ নির্দেশ করেছেন। এর মধ্যে বৃহৎ আকারের চোরাচালানী, ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণ, বাংলাদেশ সরকারের দৈনন্দিন প্রশাসনে ভারতীয় হস্তক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। ভারতবিরোধী প্রচারণার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক বাঙালিদের জাতিগতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি লিখেছেন,

“The Bengalis are emotional, sentimental and negative in their behaviour. They always wanted a scapegoat for their own follies. During the Pakistan rule they blamed West Pakistan for all the misfortunes and miseries. And after that they started using India as a tool in order to fulfil their desires. “

একজন ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি জাতি সম্পর্কে এমনি অসম্মানজনক মন্তব্য করা দুঃখজনক, তার অর্থ কি এই যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রাম কেবল অক্ষমতার প্রতিফলন ছিল? এই দৃষ্টিভঙ্গি মোটেই ইতিহাসসম্মত নয়। ভারতবিরোধী জনমতের জন্য পরোক্ষভাবে লেখক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছেন এভাবে,

“The Government of Bangladesh tried little to wipe out the misconceptions regarding India from the minds of the people of Bangladesh.”

এই অভিযোগও বস্তুনিষ্ঠ নয়। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার তার নিজের স্বার্থেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই ভারতবিরোধী প্রচারণায় ইন্ধন যোগাতে পারে না। বরং উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বক্তৃতা/বিবৃতিতে ভারতের ইতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। লেখক ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নানা দিক আলোচনা করতে গিয়ে এমন ধারণা দেবার চেষ্টা করেছেন যে, ভারত নানাভাবে বাংলাদেশের কল্যাণে উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণ অকৃতজ্ঞের মত ভারত বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি লেখক বিবেচনায় নেননি, তা হলো বাংলাদেশের জনগণের কতভাগ ভারত বিরোধিতায় অংশগ্রহণ করেছে এবং ভারতবিরোধী হবার জন্য প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতের কোন দায়-দায়িত্ব ছিল কি না? এই অধ্যায়ের শেষে লেখক ইন্দো-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুজিব আমলকে “স্বর্ণযুগ” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারপরও আমরা জানি মুজিব আমলের প্রায় চার বছর সময়কালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বহু ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম “Indo-Bangladesh Relations: Post-Mujib Era” বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। এই অধ্যায়ে জিয়াউর রহমানের মৃত্যু পর্যন্ত দুদেশের ঘটনাবলি আলোচনা করা হয়েছে। এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ভারতে মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে জনতা দলের সরকার গঠন। দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে অনেক টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়।

এই অধ্যায়ে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো—ভারতবিরোধী প্রচারণা, দুদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সীমান্ত সমস্যা, ফারাক্কা সমস্যা, জনতা দলের সময়ে ইন্দো-বাংলাদেশ সম্পর্ক, সীমান্তপথে অবৈধ অভিবাসন সমস্যা, নিউ মুর দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বিরোধ। এই সময়কালে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় আলোচনার মাধ্যমে ফারাক্কা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে রূপদানের চেষ্টা করে। অন্যদিকে ভারত সরকার বরাবরের মত দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে দুদেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে।

উল্লেখ্য জনতা দলের সরকার ক্ষমতাসীন হবার পূর্বে ফারাক্কা ইস্যুতে কোন অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে ফারাক্কা ইস্যুতে দুদেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে ফারাক্কা সমস্যার অতীত ইতিহাস, আইনগত দিক থেকে শুরু করে জনতা সরকারের আমলের স্বাক্ষরিত চুক্তির নানা দিক বিশেষভাবে ভারতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বড় অভিযোগ হলো,

“… the agreement was signed without keeping in mind the experts’ opinion and the national interest of India. “

৮ ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিক আলোচনায় একজন গবেষক হিসেবে লেখক বিষয়ের প্রতি বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির জন্য বাংলাদেশকেই দায়ী করেছেন একতরফা। চোরাচালান, ফারাক্কা সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা প্রভৃতি বাংলাদেশের একার পক্ষে সমাধান সম্ভব কি? অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার দায়ও লেখক এককভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। তার মতে,

“The economic relations between the two countries can be further developed provided Bangladesh Government takes maximum benefit by importing items from India. India is the only country from where Bangladesh can import items of its choice more easily and comparatively at cheaper rates.”

ভারতের বিশাল অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির পাল্লা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তবে দুদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক দাবি।

এই গ্রন্থের আরেকটি সীমাবদ্ধতার দিক উল্লেখ করা যেতে পারে। লেখক প্রাইমারি সোর্স (মুখ্য উৎস) ও সেকেন্ডারি সোর্স (গৌণ উৎস) হিসেবে একচেটিয়াভাবে ভারতীয় উপাদ । ব্যবহার করেছেন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি দলিলপত্র, সংসদ বিবরণী, বই, পুস্তক, পত্রপত্রিকা ব্যবহার করলে, উভয় দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ইস্যুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। যে কারণে লেখক ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে পেরেছেন হয়ত, কিন্তু বাংলাদেশের নয়।

শওকত হাসানের

“India Bangladesh Political Relations during the Awami League Government, 1972-75″

১০ অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ১৯৮৭ অপ্রকাশিত পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। হাসান তার অভিসন্দর্ভকে ভূমিকা, উপসংহার ছাড়া আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। এই অভিসন্দর্ভের মূল বক্তব্য হলো ‘৭২-৭৫ সময়কালে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ণয় করা। বিশেষভাবে উক্ত সময়কালে দুদেশের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কতটা সফল হয়েছে বা জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দুদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ বিশ্লেষণ করা।

উপরোক্ত গবেষণাকর্মে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য “influence relationship”-কে গ্রহণ করা হয়েছে। এই তত্ত্বের আলোকে লেখক দেখাতে চেয়েছেন দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পর পরস্পরকে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে বা হয়নি। অর্থাৎ ১৯৭২-৭৫ সময়কালে দুদেশের সম্পর্ক কেবল পারস্পরিক প্রভাবের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। যদিও একজন গবেষকের পক্ষে দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাবের বিষয় প্রমাণ করা খুব সহজ কাজ নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

প্রথম অধ্যায়ে “ইনফ্লুয়েন্স তত্ত্বের” যৌক্তিকতা আলোচিত হয়েছে, দ্বিতীয় অধ্যায়ে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় দুইশ বছরের ১৭৫৭-১৯৪৭ ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম “দি ফরমেটিভ ইয়ার্স, ১৯৭১ ৭২”। এই অধ্যায়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্থায়ী সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে যুদ্ধকালীন নীতিনির্ধারণের বিভিন্ন বিষয়/ঘটনা আলোচনা করেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির ওপর বিস্তারিত আলোচনা স্থান পেয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়ে প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের সমস্যাগুলো আলোচিত হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে নিরাপত্তার ধারণাগত ভিন্নতা নিয়ে তিনটি বিষয়ের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তা হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, ইসলামী সম্মেলন। সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ। সপ্তম অধ্যায়ে সীমান্ত সম্পর্কিত আলোচনা স্থান পেয়েছে। এই অধ্যায়ে স্থল সীমান্ত, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ ও বঙ্গোপসাগরে তেল অনুসন্ধানের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। অষ্টম অধ্যায়ে গঙ্গার পানির হিস্যার ওপর আলোচনা করা হয়েছে। আর নবম অধ্যায়ে উপসংহার।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমান আধিপত্যের প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। মুসলিম শাসনকালে হিন্দুরা কিভাবে ক্ষমতা ও মর্যাদা হারায় এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে হিন্দুরা অনেকাংশে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনকে অনিবার্য করে তোলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হিসেবে পাকিস্তানের দুঅংশের নানা বৈষম্য আলোচনা করেছেন। এবং পাকিস্তানের দুঅংশের ভারতের প্রতি বিপরীতধর্মী মনোভাব গ্রহণের কারণও ব্যাখ্যা করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ভারতের প্রতি বিদ্বেষ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। লেখক এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসত্তা অর্জনের ফলে বাঙালি হিন্দু তথা ভারত সম্পর্কে তিক্ততা হ্রাস পায়। এর সঙ্গে যুক্ত করা যায়। যে, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে চর্চা শুরু হয়, ক্রমে এই ধারা বেগবান হয়েছে। যে কারণে কাশ্মীর ইস্যু বা দ্বিজাতিতত্ত্ব পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে সেই মাত্রায় গৃহীত হয়নি। লেখক উল্লেখ করেছেন,

“The leaders of West Pakistan, who now constituted the Muslim League leadership, were still preoccupied with the two-nation theory, the fundamental premise of which was the Hindu Muslim dichotomy “

১১ পশ্চিম পাকিস্তানে ধর্মীয় রাজনীতি বা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য বজায় রাখলেও, পূর্ব পাকিস্তানে সেক্যুলার রাজনীতি শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। লেখক যথার্থই দেখিয়েছেন যে, পূর্বাঞ্চলে “secular territorial nationalism” একটা স্পষ্ট আকার ধারণ করছে। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও পূর্ব পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে পাক-ভারতের ঐতিহ্যগত শত্রুতার সম্পর্কের আলোকে দেখেনি। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের সুপ্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠছে।

সত্তরের সাধারণ নির্বাচন-উত্তর ঘটনাবলি আলোচনা করতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করেছেন,

“The East Pakistanies launched a movement of civil disobedience protest the postponement of the opening of the National Assembly.”

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পরিপ্রেক্ষিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তা “আইন অমান্য আন্দোলন” নয় বরং অসহযোগ আন্দোলন নামে পরিচিত। লেখক আন্দোলনের যেমন ভুল নাম দিয়েছেন, তেমনি আন্দোলন পরিচালনাকারী দল বা নেতারও উল্লেখ করেননি।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের অন্যান্য বিরোধী দলের অংশগ্রহণে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট বা জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। শওকত হাসান উল্লেখ করেছেন যে, এক প্রকার ভারত সরকারের চাপের মুখেই অস্থায়ী সরকার বাধ্য হয়ে ৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। এমনি সুনির্দিষ্ট মন্তব্যের জন্য যে সুস্পষ্ট প্রমাণের প্রয়োজন তা হাজির করতে পারেননি। এমনকি মওলানা ভাসানীও মুক্তিযুদ্ধকালে জাতীয় সরকার গঠনের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ব্যতীত অন্য যে কোন দলের বা মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী বিরোধী দলসমূহের সরকার গঠিত হলে তা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।

লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী অস্থায়ী সরকার সম্পর্কে তিনটি নেতিবাচক মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তার নিজের নেওয়া সাক্ষাৎকারও এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন। বলা হয়েছে যে অস্থায়ী সরকার ছিল “phoney government”। এ ছাড়া এই সরকারকে “দুর্বল”, “অযোগ্য” সরকার বলে অভিহিত করা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে যে, অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বের প্রতি মুক্তিবাহিনীর কোন আস্থা ছিল না। বলা হয়েছে, অবরুদ্ধ ঢাকায় যাঁরা ছিলেন তারাও বিশ্বাস করতেন যে, অস্থায়ী সরকারের সদস্যরা কলকাতায় “gourmandized and womanized”-এ ব্যস্ত ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কেবিনেট কে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সাথে [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কেবিনেট কে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সাথে [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

অস্থায়ী সরকার সম্পর্কে যে মন্তব্যগুলো করা হয়েছে তা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে মাত্র নয় মাসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো তা কিভাবে, কার নেতৃত্বে? পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানী লেখকদের অভিযোগই সঠিক বলে প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, ভারতের ষড়যন্ত্রের ফসল।

বস্তুত মুজিবনগর বা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি সম্ভব হয়। মুজিবনগর সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি, মুক্তাঞ্চলে জোনাল কাউন্সিল গঠন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুজিবনগর সরকারের সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতার দিক ছিল না বলা যায় না, তবে মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির কৃতিত্বও অবশ্যই অস্থায়ী সরকারকে দিতে হবে।

ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজমের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আদর্শ হিসেবে লেখক ধর্মনিরপেক্ষতা ও এর প্রয়োগ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরেছেন। প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে, আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের কারণে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সমর্থন লাভ সম্ভব হয়। এটা স্বাভাবিক যে, আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যকার আদর্শগত সাদৃশ্য ভারতের নীতিনির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আদর্শগত উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার অর্থ এই নয় যে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করা হয়। তা নয় বরং দুটির সমন্বয়ে সম্পর্ক তৈরি হয়।

পাকিস্তানের রাষ্টীয় আদর্শ মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিপরীতে আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণ করে। তারপরও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা কৈ অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণকে ভারতের প্রভাবের ফল হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

“Secularism was a manifestation of Indian influence.”

কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার ১৫ বছর পূর্বেই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি গ্রহণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড় ভিত্তি হিসেবে সংবিধানে গৃহীত হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]

লেখক ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি এবং এর প্রায়োগিক বিষয়ে আওয়ামী নেতৃত্বে ধারণাগত অস্পষ্টতার উল্লেখ করেছেন। ভারতে ও বাংলাদেশে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রায়োগিক পার্থক্যের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

“Secularism as practised by the Awami League was similar to that of the Congress. But after independence the concept of secularism underwent a qualitative change, it was given a more literal interpretation: separation of religion from all worldly matters.”

সঙ্গত কারণেই দুটি দেশে একই আদর্শ বাস্তবায়নে ভিন্নতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন উভয়ে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী দুটি রাষ্ট্র। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তবায়নে দুটি দেশ ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশে পার্থক্য থাকতেই পারে। বিচার্য বিষয় হলো উক্ত আদর্শের প্রতি তারা আন্তরিক ও সৎ ছিল কি না।

ভারত উপমাদেশে বাংলাদেশ একমাত্র রাষ্ট্র যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশ প্রথম রাষ্ট্র যেখানে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতে ১৯৭৭ সালে ধর্মনিরপেক্ষতা সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে। ভারতে মৌলবাদী দলের কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা আর বাংলাদেশে মৌলবাদী দলের কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা এক নয়। জনাব হাসান বলেছেন আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে নানা মত ও পথের স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়। এবং যেহেতু ভারতে জনসংঘ, জামায়াতে ইসলামী এবং আকালী দলের মত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]

এখানে একটি তথ্যগত ত্রুটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তা হলো ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার পরপর ভারতে উগ্রসাম্প্রদায়িক দল হিন্দু মহাসভাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল! সুতরাং ভারতে মৌলবাদী দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়নি এটা ইতিহাসসম্মত নয়। ১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি তথাকথিত ইসলামী দলগুলো আদর্শগতভাবে বাংলাদেশকে পরিহার করেছে তাই নয় বরং পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে নানা রকমের অত্যাচার, নির্যাতনের মাধ্যমে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রতিহত করতে।

ভারতের মৌলবাদী দলগুলো ভারতের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেনি। বাংলাদেশের মৌলবাদী দল সম্পর্কে একই মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং স্বাধীনতার পর জনমতের যৌক্তিক প্রতিফলন হিসেবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের সময়কালে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিদায়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমতি প্রদান করা হয়।

লেখক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আবুল ফাতেহের সাক্ষাৎকার থেকে সেক্যুলারিজম সম্পর্কে উদ্ধৃত করেছেন যে,

“Secularism came by compulsion because Mujibnagar government was in India and heavily dependent on India for moral, material and diplomatic support. Its secular policy existed only to the extent that the party opened its doors to the Hindus”.

১৪ মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পূর্বে আওয়ামী লীগ সেক্যুলার রাজনীতি গ্রহণ করে। সুতরাং এটাকে “ভারতীয় বাধ্যবাধকতা” হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না। একটি আদর্শ, কোন বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে তা গ্রহণ করা যায় না। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন তার সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা একটি আদর্শ, পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদের বিপরীতে এই আদর্শের জন্ম। এটি কোন বিশেষ সংখ্যালঘু বা হিন্দুদের খুশি করা বা ভারতীয় প্রভাবের ফল নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman ]
সেক্যুলারিজমের প্রতি হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেখক আওয়ামী মন্ত্রিসভার জনৈক হিন্দু মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া উদ্ধৃত করেছেন যে,

“পাকিস্তান আমলে হিন্দুরা স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ভাল ছিল। কারণ পাকিস্তান আমলে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হিসেবে আইনগতভাবে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হত। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে বিশেষ অধিকার রহিত করা হয়।”

১৫ লেখক যে হিন্দু মন্ত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, তার নাম উল্লেখ করেননি, এমনকি তার সাক্ষাৎকারও লেখক নিজে সে সময় নেননি। ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার ১৯৭২ সনে উক্ত হিন্দু মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আর লেখক ১৯৮৫ সনে নায়ারের কাছ থেকে উক্ত তথ্য পেয়েছেন। এই তথ্যটি oral history বা oral evidence-এর অন্তর্গত। সাম্প্রতিক বিষয়ে কাজ করতে গেলে oral history/oral evidence-এর ব্যবহার প্রায়ই অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু oral evidence ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতার প্রয়োজন। বিশেষভাবে এমনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জরুরি, যা এখানে করা হয়নি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে অন্তহীন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তার দুটি এখানে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রথমত, মিত্রবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে লে. জে. অরোরার নিয়োগ,

দ্বিতীয়ত, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কর্নেল ওসমানীর অনুপস্থিতি।

উল্লিখিত বিষয় দুটিতে বিতর্কের অবসান ঘটানোর মত দালিলিক প্রমাণ যেমন নেই, তেমনি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি। ওসমানীকে যৌথ বাহিনীর প্রধান না করার বিষয়ে লেখক অস্থায়ী সরকারের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করেছেন যা তার ভাষায় “ভারতের দয়ার” ওপর নির্ভরশীল ছিল। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কর্নেল ওসমানীর অনুপস্থিতি বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দেয়। লেখক মন্তব্য করেছেন,

“The Indian Army had came at the eleventh hour and seized the victory that belonged to it [Muktibahini].”১৬

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সে সম্পর্কে লেখকের ধারণা খুব একটা স্পষ্ট নয় বলে মনে হয়। একাত্তরে জুন-জুলাই মাস থেকেই সীমান্ত রক্ষীবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকমের সহায়তা দিতে শুরু করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণসহ অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা করে।

কেবল যৌথ কমান্ডের অধীনে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এমন ভাববার কোন কারণ নেই। অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এমনকি কোথাও কোথাও ভারতীয় সেনা সদস্য মৃত্যুবরণ করে ও পাকবাহিনীর হাতে বন্দিও হয়। সুতরাং ভারতীয় বাহিনী “at the eleventh hour”-এ এসে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে বলা ইতিহাসসম্মত নয়।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কেন কর্নেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না, এ বিষয়ে লেখক কর্নেল ওসমানীর বক্তব্য উপস্থাপন করলে যথাযথ হতে পারত। কারণ লেখক কর্নেল ওসমানীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, সুতরাং তার সুযোগ ছিল কর্নেল ওসমানীর কাছ থেকে এ বিষয়ে অবহিত হওয়ার। তা না করে লেখক তার মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

১৯৪৭ সনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র বিখ্যাত “দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম। দ্বিজাতিতত্ত্বের মৌল বক্তব্য হলো ভারতে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলমান দুটি জাতি এবং জাতি গঠনে ধর্মই প্রধান ভূমিকা রাখে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাত মাসের মধ্যে ভাষার প্রশ্নে বাঙালিদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়।

ক্রমে এই বিরোধ বিস্তৃত হয়েছে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্যে। যার অনিবার্য পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বা ধর্মীয় জাতীয়তার প্রত্যাখ্যান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড় স্তম্ভ। কেবল ধর্মের ভিত্তিতে যে জাতি গড়ে ওঠে না তার প্রমাণ বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তারপরও দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি লেখকের গভীর আস্থা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। যখন তিনি মন্তব্য করেন যে,

“The validity of the theory remains unchallenged”

পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে যাবার পরও কিভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বৈধতা অব্যাহত থাকে তা বোধগম্য নয়। লেখক এ প্রসঙ্গে আরো মন্তব্য করেছেন যে,

“East Bengal’s independence neither invalidated the justification for theocratic states, nor validated secular statehood.”

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের আমলে পরিত্যক্ত হয়। তথাপি বাংলাদেশ একটি ‘theocratic state’-এ পরিণত হয়নি।

পূর্ববঙ্গের “personality” ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক বাঙালির মুসলমান পরিচয় ও বাঙালিত্বকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন। এমনি বক্তব্য ইতিহাসসম্মত নয়। এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন যে,

“হিন্দু-মুসলমানের ক্ষেত্রে বাঙালি পরিচয়টাই প্রাধান্য পেয়েছে বা এই পরিচয়ের ধারাবাহিকতা বিভিন্ন সময় এলিট বা রাষ্ট্র নষ্ট করতে চাইলেও পারেনি। এই বোধের কারণেই হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বদলে বাঙালিত্বের বিভিন্ন উপাদান রক্ষার ব্যাপারে যৌথ লড়াই হয়েছে।”১৭

উপরন্তু শওকত হাসান মনে করেন, যুক্তবাংলায় এবং পাকিস্তানে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা “exploited equally” (p. 98) ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশের অংশ হিসেবে দুই বঙ্গের মধ্যে যে শোষণ প্রক্রিয়া আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দুটি অংশের মধ্যে শোষণ কিভাবে সমান হতে পারে। এমনি বক্তব্যের পক্ষে তথ্য বা পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেননি।

Surrender of Pakistani Army at Dhaka
Surrender of Pakistani Army at Dhaka

 

চতুর্থ অধ্যায়ে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির ওপর বিস্তারিত আলোচনা স্থান পেয়েছে। নানা দিক আলোচনা করেছেন। চুক্তির বিভিন্ন ধারা ও দশটি অনুচ্ছেদ কি কি আছে তা বর্ণনা করা হয়েছে। চুক্তির প্রতি দুদেশের প্রতিক্রিয়ার আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, নেতৃবৃন্দের বক্তব্য বিবৃতি প্রাধান্য পেয়েছে। ভারতীয় পক্ষ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করায় তা উল্লেখ করা হয়নি। কেন ভারতীয়রা ইতিবাচক মনে করল তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে,

“As far as Indian self-interest was concerned India would not be disadvantaged in any way from a friendship treaty with Bangladesh,”১৮

অন্যদিকে বাংলাদেশ পক্ষের সরকারি দল ও চুক্তির বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য আলোচনা করা হয়েছে। বিরোধীদের মধ্যে মওলানা ভাসানীর সাত দলীয় অ্যাকশন কমিটি, মোহাম্মদ তোহার কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (এমএল), মাওপন্থী অন্য ক্ষুদ্র গ্রুপগুলোও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। এ ছাড়া ডানপন্থী দলগুলোও এই চুক্তির বিরোধিতা করে তীব্র ভাষায়, উল্লেখযোগ্য হলো মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক লীগ এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জাসদ) চুক্তির বিরোধিতা করে।

তবে মণি সিংহের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর আহমদের মস্কোপন্থী ন্যাপ সক্রিয় সমর্থন না করে “maintain a neutral posture”। এই নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার কারণ হিসেবে লেখক উল্লেখ করেছেন দল দুটির ক্ষমতার অংশীদার হবার বাসনা যা ১৯৭৫-এ বাকশালে যোগদানের মাধ্যমে সফল হয় বলে লেখক মনে করেন।

তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আতাউর রহমান খানও বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। সুতরাং চুক্তি সম্পাদনের তিন বছর পরে বাকশালে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে মণি সিংহ বা মোজাফফর আহমদ চুক্তির সমালোচনা থেকে বিরত থেকেছেন এমন বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং রাজনৈতিক আদর্শগত কারণ ও ভারত-সোভিয়েত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি দলের অবস্থান বিবেচনা করা উচিত।

চুক্তি সম্পর্কে লেখক, মওদুদ আহমদের গ্রন্থ “Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman”১৯ এবং চীনপন্থী সাংবাদিক এনায়েত উল্লাহ খানের ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে থেকে চুক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। এই দুজনই ভারতবিরোধী ও আওয়ামী লীগবিরোধী, দুজনই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে কোন বিষয়ে তাদের মন্তব্য যে নেতিবাচক হবে এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? যেখানে এনায়েত উল্লাহ খান নিজেই নিজেকে “pathologically anti Indian” হিসেবে অভিহিত করতে পছন্দ করেন।

চুক্তির প্রতিটি ধারা লেখক বর্ণনা, বিশ্লেষণ করেছেন, দুটি সার্বভৌম, স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। চুক্তির কোন ধারা এমন ছিল না যে, এক পক্ষের ওপর প্রযোজ্য অন্য পক্ষের ওপর নয়। চুক্তিটি ভারতের জন্য ইতিবাচক হলে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কেন? তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও যথেষ্ট প্রমাণসহ উপস্থাপিত হয়নি। জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন চুক্তি প্রসঙ্গে বলেন,

“I fail to understand which aspect of this treaty is contrary to our interests…… Every clause of the treaty is equally applicable to either country.”

অন্যদিকে ভাসানীর মূল। দাবি ছিল

“ to rid the country of this treaty”২০

মৈত্রী চুক্তির পটভূমির আলোচনা শুরু হয়েছে ইয়াহিয়া-মুজিব সংলাপের ব্যর্থতা থেকে। মৈত্রী চুক্তির উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে অস্থায়ী সরকার ভারতের সঙ্গে কোন “বিশেষ চুক্তির” উদ্যোগ নিয়ে ছিল কি না? চুক্তির শর্ত কি ছিল? বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুদেশের মধ্যে কোন গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল কি না? ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া চুক্তি বিষয়ে মুজিব সরকারের কৌশলগত ব্যর্থতা, কেন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়? চুক্তির ধারার পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা, চুক্তির আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিত আলোচনা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর হয়েছিল তার নৈর্বক্তিক গবেষণা আজও হয়নি। তবে ভারতবিরোধী মনোভাবে ইন্ধন যোগাতে বেশ কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডানপন্থী ও চীনপন্থী বামরা একই কণ্ঠে “গোলামির চুক্তি” বলতে দ্বিধা করেননি। পরিহাসের বিষয়ে হলো পঁচাত্তর-পরবর্তী কোন সরকারই এই চুক্তি বাতিল করেননি। কালক্রমে এমনিতেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এবং তা পুনরায় নবায়নের ক্ষেত্রে কোন পক্ষই আগ্রহ দেখায়নি।

পঞ্চম অধ্যায়ে দুদেশের সম্পর্কের প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শওকত হাসান মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতীয়দের জন্য “economic windfall” বয়ে আনবে বলে ভারতীয়দের মধ্যে প্রত্যাশা কাজ করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ সরকারের কাছেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত ব্যতীত উল্লেখযোগ্য বিকল্প ছিল না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সময়কালে অনেকগুলো বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়। প্রথম বাণিজ্য চুক্তিটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ। এই চুক্তিতে সীমান্ত বাণিজ্যের কারণে অচিরেই দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর মূল কারণ ছিল চোরাচালান। চোরাচালানের প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র ভাষায় ভারতবিরোধী ও আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালায়। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৭৩ সালে জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ভারত তিন বছর মেয়াদী বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরের বছর সামিট মিটিং-এ ইকোনমিক প্যাক্ট স্বাক্ষরিত হয়। আরো দুটি বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তা হলো ভারতে পাট বিক্রয় ও বাংলাদেশের মুদ্রা ছাপানো। মওলানা ভাসানী ভারতীয় পণ্যের বিরুদ্ধে অবরোধের ঘোষণা দেন। এনায়েত উল্লাহ খানের পত্রিকা “হলিডে”তে দুদেশের বাণিজ্যকে “colonial trade” হিসেবে অভিহিত করা হয়।

দুদেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক ঘাটতি, চোরাচালান নিয়ে সরকারের ভূমিকা সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল তা বলা যাবে না। সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি দেশে পর্বতসম সমস্যার মুখে সরকারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। এ ছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি ও চোরাচালানের বিষয়টি পরবর্তী সরকারগুলোর আমলেও যে সন্তোষজনক মাত্রায় সমাধান হয়েছে তা নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

ষষ্ঠ অধ্যায়ে দুদেশের মধ্যে নিরাপত্তার ধারণাগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের নিরাপত্তা ধারণা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে উপমহাদেশের “ব্যালেন্স অব পাওয়ার” পরিবর্তিত হয়ে যায়। এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিশেষভাবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানজনিত কৌশলগত গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।

ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মোকাবেলায় বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান আমলে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সহায়তা পেলেও বাংলাদেশ আমলে তা বন্ধ হয়ে যায়।

নিরাপত্তা ধারণার ক্ষেত্রে বড় বিতর্ক দেখা দেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আকার, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও সামর্থ্য নিয়ে। সর্বোপরি এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এর সঙ্গে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারী সেনা সদস্যদের সেনাবাহিনীতে নেয়া হবে কি না? লেখক দুক্ষেত্রেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক মনোভাব তুলে ধরেছেন। ভারতের সামরিক, বেসামরিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, বাংলাদেশের স্থায়ী বড় আকারের সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই কারণ “”Bangladesh had no external security concern.”।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন জাতীয় ইস্যু যেমন, সংবিধান প্রণয়ন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা এবং বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে পুরো মনোযোগ প্রদান করে। যে কোন কারণেই হোক বাংলাদেশ সরকারের কাছে দেশের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনায় আসেনি।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল বা এখনো আছে। সেনাবাহিনী বিষয়ে তাদের একটা আশঙ্কা ছিল যে, পাকিস্তানের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরে যাঁরা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা প্রত্যেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষিত এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রক ভূমিকা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। অবশ্য পাক সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবীদেরই শুধু একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। বাঙালি সেনা সদস্যদের ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারগণই স্বাধীনদেশে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ন্যায় তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও শক্তিশালী দেখতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণে বাংলাদেশ তাদের যুদ্ধের ফসল। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্ব তারা বড় করে দেখেননি।

স্বাধীনতার পরপর সেনাবাহিনী নিয়ে যে বিতর্কের জন্ম হয়, তার অবসান এখনো হয়নি। বরং জাতীয় স্বার্থে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী একটি প্রতিরক্ষা নীতি ও সেনাবাহিনীর কাঠামো অদ্যাবধি দাঁড় করানো গেল না। দুঃখজনক হলো ক্রমে এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ. এন. এম নূরুজ্জামান, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ. এন. এম নূরুজ্জামান, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান

 

অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর গঠন, এর প্রেক্ষাপট, প্রশিক্ষণ, রাজনীতিতে প্রভাব এবং দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে নানামুখী চিন্তাভাবনার অবতারণা হয়।

তাজউদ্দিন আহমদ চেয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর সবাইকে “ন্যাশনাল মিলিশিয়া”তে অন্তর্ভুক্ত করবেন। কিন্তু পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহৎ অংশ আবার পড়াশুনায় ফিরে যায়। ১০-১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে নেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শনকারীদের সেনাবাহিনীতে গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু জেনারেল ওসমানী মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বল প্রশিক্ষণের কারণে প্রত্যেককে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেন।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি স্বতন্ত্র প্যারামিলিটারি বাহিনীর প্রস্তাব করেন যা জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। এই বাহিনীর পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র প্রশিক্ষণ সর্বোপরি এই বাহিনীর কর্মতৎপরতা দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কোন সমস্যার জন্য ভারতকে দায়ী করা একটা রাজনৈতিক ফ্যাশনে পরিণত হয়।

এর একটা কারণ হতে পারে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা, রক্ষীবাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করা হয়েছে একই সঙ্গে ভারতকেও দোষারোপ করা হয়। মওলানা ভাসানী ও এনায়েত উল্লাহ খান প্রায় একই ভাষায় সমালোচনা করেছেন রক্ষীবাহিনীর। হলিডেতে বলা হয় যে

“It is an extension of the CRP (Central Reserve Police of India) to safeguard an obliging government of the Indian ruling class and the expansionist interests of Indian sub imperialism.”

দুঃখজনক হলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ সব মন্তব্যের কোন বাস্তব ভিত্তি ছিল না। যা পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে লেখকও যুক্তিযুক্ত মন্তব্য করেছেন যে,

“Although the people had become wise to the fact that the Jatio Rakkhi Bahini was not an Indian Paramilitary force” 25

ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় সদস্যপদ গ্রহণ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন যে, ভারত চায়নি বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য হোক, কারণ এতে করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। কিন্তু মুজিব এ সব আপত্তিকে আমলে নেননি। তিনি মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ গ্রহণ করে। এটাকে ভারতবিরোধীরা বলার চেষ্টা করেছে যে, “Mujib was frustrated with India (p. 203)”। প্রকৃতপক্ষে এটা ব্যক্তি মুজিবের হতাশা হিসেবে দেখা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ তখন বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি ও সাহায্য লাভ জরুরি ছিল ।

সপ্তম অধ্যায়ে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তা হলো, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং বঙ্গোপসাগরে তেল অনুসন্ধান। ১৯৭৩ সনের মাঝামাঝি থেকে দুদেশের মধ্যে সীমান্ত বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দুদেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ছিটমহলসমূহের পারস্পরিক হস্তান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ৬১ বর্গকিলোমিটারের অধিক ভূমি লাভ করে।

Satellite image of Bangladesh 2001 কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা বাংলাদেশের আলোকচিত্র Bangladesh Gurukul | বাংলাদেশ গুরুকুল, GOLN

তথাপি বেরুবাড়িকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলো মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ভূখণ্ডগত সার্বভৌমত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন এবং মওলানা ভাসানী সবাই ভারতের নিকট দক্ষিণ বেরুবাড়ি হস্তান্তরের তীব্র নিন্দা জানায়। একদিকে বাংলাদেশ বেরুবাড়ি হস্তান্তর করে ভারতের কাছে অন্যদিকে চুক্তি মোতাবেক ভারত বাংলাদেশের নিকট তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তরের কথা। কিন্তু ভারত সরকার তাদের পার্লামেন্টে সীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থন করতে না পারার কারণে বাংলাদেশ তিন বিঘা করিডোরের মালিকানা লাভ করেনি। এটাও দুদেশের সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

সামুদ্রিক সীমা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে দুদেশের আলোচনায় এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় । “base point” নির্ধারণের ক্ষেত্রে জটিলতার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে দুদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে তালপট্টি দ্বীপ বা নিউ মুর দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দুদেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগর এলাকায় তেল অনুসন্ধান নিয়ে দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধের একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে ভূ ও সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ সমস্যা। পরিতাপের বিষয় এখনো পর্যন্ত দুটি দেশ পরস্পরের নিকট সন্তোষজনক কোন সীমান্ত নীতি গ্রহণে সক্ষম হয়নি। অথচ প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে সুসম্পর্কের এটি অন্যতম পূর্বশর্ত।

অষ্টম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তা হলো ফারাক্কা ইস্যু। বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে এই সমস্যা লাভ করে। ১৯৬০-এর দশকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিশেষজ্ঞ ও সচিব পর্যায়ে বহু মিটিং হলেও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগ পর্যন্ত কোন সমাধান অর্জন সম্ভব হয়নি। গঙ্গা অববাহিকা, ফারাক্কা বাঁধ এবং গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে দুদেশের আলাপ-আলোচনার দীর্ঘ ইতিহাস বিবৃত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে, সচিব/মন্ত্রী পর্যায়ে এবং যৌথ নদী কমিশনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সভা হলেও দুপক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার কারণে কোন অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি।

গঙ্গার পানির হিস্যার বিষয়টি দুদেশেই অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবেশ, অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং নিজ নিজ দেশের জনমত। বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, ভারতেও বাংলাদেশের প্রতি আবেগ উচ্ছ্বাস হ্রাস পেতে শুরু করে। তা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্বদানকারী খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং বি. এম. আব্বাস উভয়ে ভারতবিরোধী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। অবস্থার যথেষ্ট অবনতির পর মোশতাকের জায়গায় সেরনিয়াবাতকে নিয়োগ করা হয়। অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধীও ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে রাও-এর পরিবর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে নিয়োগ করেন। অর্থাৎ দুদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল সম্পর্কোন্নয়নের। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানা সমস্যার কারণে গ্রহণযোগ্য সমাধানে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব পরিবার সহ ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Begum Mujib with Family & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব পরিবার সহ ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Begum Mujib with Family & Srimathi Indira Gandhi ]

লেখক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য “influence theory” গ্রহণ করেছেন। এই তাত্ত্বিক কাঠামো গ্রহণ করবার কারণে প্রতিটি বিষয়ে লেখক কে, কাকে প্রভাবিত করছে সে আলোকে বিবেচনা করেছেন কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময় influence-এর ঘটনা ঘটে না। influence-এর বিষয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অন্তর্নিহিত একটি বিষয়। লেখক সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার তেমন একটা নিতে পারেননি, উপরন্ত এতদসংক্রান্ত সরকারি দলিল-দস্তাবেজও ব্যবহার করতে পারেননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংগত কারণেই লেখক প্রশ্নাতীতভাবে এক রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অন্য রাষ্ট্র কতটা প্রভাবিত করেছে তা প্রমাণ করতে পারেননি। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ, মুজিবনগর সরকার, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার বিশ্লেষণে লেখক “গবেষকের নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকা” ক্ষুণ্ন করেছেন।

ইফতেখার এ. চৌধুরী Bangladesh’s External Relations অপ্রকাশিত পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মে ১৯৮০ (২২ আলোচ্য অভিসন্দর্ভের বিষয়বস্তুকে লেখক মোট ১১টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। বিভিন্ন দেশ/অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আলোচনার পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত দিক বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পরাশক্তি চীন, মধ্যপ্রাচ্য, বার্মা ও নেপাল, জাতিসংঘসহ তৃতীয় অধ্যায়ে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে।

এখানে তৃতীয় অধ্যায়ের অংশ বিশেষ, যেখানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে, তার ওপর আলোচনা সীমিত রাখা হবে। লেখক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আলোচনা করতে গিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্ব থেকে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত ভারতের ভূমিকা একই রকম ছিল না। শুরুতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমাগত শরণার্থীর চাপ বৃদ্ধি ও জাতীয় রাজনীতিতে ভারত সরকারের ওপর চাপ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল সমীকরণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে সুনির্দিষ্ট ও প্রত্যক্ষ করে দেয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান, বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে কেন্দ্র করে নানামুখী সমস্যা, পরাশক্তিসহ বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যাশিত সমর্থন না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক প্রস্তুতির বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখক তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

এপ্রিল মাসের শেষ দিকেই অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের রাষ্ট্রপতি কাছে “তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি”র অনুরোধ জানিয়ে পত্র দেন। আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠার বহুপূর্বে মার্চ মাসের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ পালিত হয় স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, লোকসভাসহ বিভিন্ন বিধানসভা এবং ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো “তাৎক্ষণিক” স্বীকৃতির দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে।

অস্থায়ী সরকার কেবল ভারতের কাছে স্বীকৃতি দাবি করেছে এমন নয়, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃতির আহ্বান জানান। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতের অর্থনীতির জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করে তাই নয়। এই সমস্যা থেকে আরো অনেক সমস্যার জন্ম হয়।

“They (refugees) upset the demographic balance of some of the Muslim majority west Bengali border districts, increasing the likelihood of communal tensions there.”20

শরণার্থী সমস্যার কারণে কেবল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি নয়, কোথাও কোথাও দাঙ্গার উপক্রমও হয়। শরণার্থী সমস্যার আরেকটি জরুরি দিক লেখক উল্লেখ করেননি তা হলো দুর্বিষহ বেকার সমস্যায় আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গের শ্রম বাজারে শরণার্থী বনাম স্থানীয়দের প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া শরণার্থীদের ভারত সরকারের ত্রাণ প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছিল। শরণার্থীর পেছনে অপ্রত্যাশিত ব্যয়ের ফলে ভারতের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বেশ বিঘ্নিত হয়। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে শরণার্থীর ভরণপোষণে ৭০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হিসাব করা হয়। যা অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে।

চীনা-আমেরিকান কূটনৈতিক প্রয়াসের পরিপ্রেক্ষিতে “some sort of Bangladesh”-এর অভ্যুদয় সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো খন্দকার মোশতাককে কেন্দ্র করে মার্কিন উদ্যোগ সফল হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না বললে অত্যুক্তি হবে না হয়ত। কারণ মোশতাকের প্রস্তাব মূল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তথা মুজিবনগর সরকার বা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা কারো কাছেই গৃহীত হবার কোন কারণ ছিল না। লেখক “এক ধরনের বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে সম্ভাবনার কথা বলেছেন তা কেন বাস্তবায়িত হয়নি তার কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে “হিন্দু শরণার্থী এবং ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী” বলে মন্তব্য করেছেন।

লেখকের বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি হিন্দু শরণার্থী এবং ভারতের স্বার্থের বিষয়। এখানে বাংলাদেশ, মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযোদ্ধা, জনগণ তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। বাস্তবতা হলো মার্চ এপ্রিল মাসের দিকে হয়ত এক ধরনের রাজনৈতিক সমাধান অর্জন সম্ভব ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বর, অক্টোবরের দিকে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ ব্যতীত, তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধান কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।

আর একটি দুঃখজনক বিষয় হলো লেখক কিভাবে পাকিস্তানী দৃষ্টিকোণ দেখে বিষয়টি বিবেচনা করলেন। কারণ পাকিস্তান পুরো একাত্তর জুড়ে প্রচারণা চালিয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ বলতে কিছু নেই, পুরো বিষয়টি ভারতের ষড়যন্ত্রের ফল। এটি পাক-ভারতের বিষয় আর জড়িত পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা। লেখকও এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন।

ভারত সরকারও প্রথম দিকে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেয়। যে কারণে ভারত সরকার স্বীকৃতি প্রদান থেকেও বিরত থাকে। ক্রমে সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়ে। চূড়ান্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে ভারত অভ্যন্তরে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শক্তি বৃদ্ধির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরিণতিতে যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় ঘটে।

স্বাধীনতার পরপর ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, বাণিজ্য, পাকিস্তানী যুদ্ধ বন্দিদের বিচার, যৌথ নদী কমিশন, দুদেশের মধ্যকার মৈত্রী চুক্তি, ইত্যাদি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের অসন্তোষের কারণ নিয়েও আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে লেখক মন্তব্য করেছেন যে,

“It was on the Trade front that cracks in bilateral relations began to appear. “২৪

এর জন্য তিনি প্রথমে দায়ী করেছেন চোরাচালান, এ ছাড়া ভারতীয় পণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য এবং ভারতের মারওয়ারি ব্যবসায়ীদের শোষণমূলক মনোভাবকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চারটি বিষয় লেখক আলোচনা করেছেন। যথা ফারাক্কা বাঁধ, territorial water, ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণ, সিকিমের সংযুক্তি বিশেষভাবে ফারাক্কা ইস্যু এবং সামুদ্রিক জলসীমা চিহ্নিত করা নিয়ে দুদেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হলেও দুপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন সমাধানে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়। যা দুদেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।

১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৭৫-এ বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থানের পর ভারতের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের মোশতাক বা জিয়া সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যায় না। কেবল ১৯৭৭ সালে ৫ নভেম্বর জিয়া সরকারের সঙ্গে দেশাই সরকারের ফারাক্কা চুক্তি বড় ইতিবাচক ঘটনা।

ভিরেন্দ্র নারায়ণ তার গ্রন্থ Foreign Policy of Bangladesh (1971-1981) (জয়পুর, ভারত, ১৯৮৭)২৫-এ বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা উত্তরকালের প্রথম এক দশকের পররাষ্ট্রনীতি আলোচনা করেছেন। ভূমিকা, উপসংহারসহ মোট দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে গ্রন্থটিকে।

প্রথম অধ্যায়ে উদ্দেশ্য, পরিধি ও সীমাবদ্ধতা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাত্ত্বিক কাঠামো, তৃতীয় অধ্যায়ে নির্ধারকসমূহ, চতুর্থ অধ্যায়ে মুজিব যুগের আশা ও হতাশার প্রেক্ষাপট পঞ্চম অধ্যায়ে ভারত-বাংলাদেশে সম্পর্ক (১৯৭১ ১৯৭৫), ষষ্ঠ অধ্যায়ে ভারত-বাংলাদেশে সম্পর্ক (১৯৭৫-১৯৮১), সপ্তম অধ্যায়ে বাংলাদেশ এবং বৃহৎ শক্তিবর্গ, অষ্টম অধ্যায়ে বাংলাদেশ ও ইসলামী বিশ্ব, নবম অধ্যায়ে অভ্যুত্থান উত্তর সময়কাল, দশম অধ্যায়ে উপসংহার

লেখক যে তাত্ত্বিক কাঠামো গ্রহণ করেছেন, তার মাধ্যমে একটি দেশের বৈদেশিক সম্পর্কের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। লেখক তার গবেষণাকর্মের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন,

“It is a study of the foreign policy as a sub-component of the national liberation movement of Bangladesh. Foreign policy per se, therefore, is not the main focus of It is rather the national liberation movement of Bangladesh, which has been discussed and in this context the role of major powers vis-à-vis the national liberation movement has been examined.”*

জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন পর্ব এবং স্বাধীনতা উত্তর প্রথম দশক এই দুই পর্বে ভারতসহ বৃহৎ শক্তিবর্গ যথা মার্কিন, চীন ও সোভিয়েত ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev
Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev

 

এই গ্রন্থে ১৯৭১-১৯৮১ সময়কালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিস্তারিত বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখক ১৯৭১-১৯৮১ সময়কালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক (১৯৭১-১৯৭৫) অধ্যায়ে লেখক দেশের সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। দুদেশের সম্পর্কের অসাম্প্রদায়িক ভিত্তি, সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ, প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ, ভারতবিরোধী প্রচার-প্রচারণা, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্ব, ভারতের নিজস্ব ভ্রান্তি ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করেছেন।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক (১৯৭৫-১৯৮১) অধ্যায়ে বাংলাদেশে পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর ক্রমবর্ধমান ভারত বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে। এই সময়ে “ফারাক্কা ইস্যু” ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ফারাক্কা ইস্যু এবং ১৯৭৭ সালে দুদেশের মধ্যে পানি বণ্টনের অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির ওপর আলোচনা স্থান পেয়েছে।

উল্লিখিত দু’অধ্যায়ে মাত্র চল্লিশ পাতায় (৭১-১১১) দীর্ঘ একদশকের ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আলোচনা করেছেন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চাইতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। মূল সুরটি ছিল বাংলাদেশের ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রসার। লেখকের মতে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মাওবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সরকারের বিরোধিতার নামে ভারত বিরোধিতা শুরু করে। এ সব কিছুর পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইন্ধন ছিল জোরালো মাত্রায়।

“The Maoists and communal elements were playing exactly the same role giving grist to the mill of anti Indian tirade which fitted well in the strategy of the imperialists to destabilise the entire South Asian region, as they knew that the unity between India and Bangladesh was a bulwark against their plans to derail the process of national liberation in the entire region. “২৭

লক্ষ্য করা যায় যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দায়টাই লেখকের দৃষ্টিতে বেশি। তারপরও লেখক ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কিছু ভ্রান্তির কথা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় অসাধু ব্যবসায়ীদের নিম্নমানের পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশের প্রেরণ, চোরাচালান ব্যাপক বৃদ্ধি, বিশেষ করে ফারাক্কা ইস্যুতে ভারতের অনমনীয় মনোভাবের উল্লেখ করেছেন।

বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা প্রসঙ্গে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, “The Humanitarian Role Played by India.” এই গ্রন্থের সামগ্রিক মূল্যায়নে বলা যায় লেখক জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত হয়েছে কিনা, প্রতিবন্ধকতা কি ছিল, অভ্যন্তরীণ বৈরী রাজনীতি লেখকের আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে।

লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে কেবল ‘humanitarian role’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোকে খুব সঠিক ব্যাখ্যা বলা যায় না। কোন দেশের সরকার কেবল সামাজিক কারণে, মানবিক কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মুক্তিসংগ্রামে এমনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয় না। সেখানে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে জনগণের ভূমিকাকে সরকারের ভূমিকা থেকে পৃথক করে দেখা যেতে পারে। সাধারণ ভারতীয় জনগণ বাংলাদেশের অসহায় শরণার্থীদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে মানবতাবোধ থেকেই।

তার তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে বলা যায় যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আলোচনা সম্পূর্ণতা পায়নি। দুদেশের সম্পর্কের চাইতে অধিক আলোচিত হয়েছে দুদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। সর্বোপরি লেখক ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দুদেশের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন।

ডেনিশ রাইটের লেখা, Bangladesh Origins and Indian Ocean Relations (1971-1975), Dhaka, 1988২৮ গ্রন্থে তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত (১৯৭১-১৯৭৫) সময়কালের দুদেশের সম্পর্কের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করেছেন। লেখক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পটভূমির বিশ্লেষণসহ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী খুটিনাটি অনেক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন।

Indira Gandhi & Tajuddin Ahmad
Indira Gandhi & Tajuddin Ahmad

 

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন কলকারখানা লুট, ঢাকায় প্রাপ্ত সকল বিদেশী পণ্য ক্রয় এবং বিহারী সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির অসন্তোষ, এমনকি আক্রমণের শিকার হয়। লুটপাটের কারণ হিসেবে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, ভারতীয় সেনাদের দৃষ্টিতে যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী বাংলাদেশের নয় বরং পাকিস্তানের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে একরকম ছিল না।

এই ঘটনার জন্য তারা ভারত সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানায়। যে কারণে ৩১ জন ভারতীয় সেনা সদস্যের কোর্ট মার্শাল হয়। তবে দ্রুত ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারের ফলে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখে।

Bangladesh’s Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman observes the exit parade of the Indian Army stationed in Bangladesh, March 12, 1972
Bangladesh’s Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman observes the exit parade of the Indian Army stationed in Bangladesh, March 12, 1972

 

যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের অবকাঠামো ও অর্থনীতির পুনর্গঠনে একমাত্র ভারত, খাদ্যসহ জরুরি পণ্যসামগ্রীসহ বিপুল পরিমাণ ঋণ ও সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ায়।

এতদসত্ত্বেও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ন্যাপ নেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘ভারতবিরোধী’ প্রচার-প্রচারণা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের দ্রুত ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা’ অর্জনকে ভারত সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করে। যে কারণে নিজের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য পঞ্চাশ লক্ষ পাউন্ড ঋণ প্রদান করে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ছিল অবধারিত। তবে বাণিজ্য সম্পর্ক দুদেশের পরিপ্রেক্ষিতেই সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যর্থ হয়। বিশেষভাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। এর প্রধান কারণ চোরাচালান। দুপক্ষই চোরাচালানরোধে নানা পদক্ষেপ নিলেও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভে ব্যর্থ হয়। এমনকি দুদেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ারও কথা ওঠে। লেখক যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে,

“During the entire 1971-1975 period the pattern of trade between India and Bangladesh failed to produce the close economic ties desired by both government.”

চোরাচালান, মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী মনোভাবকে চাঙ্গা করে। চোরাচালানকে কেন্দ্র করেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম মতবিরোধ দেখা দেয়। মূলত এটাকে ভিত্তি করেই ভারতবিরোধী প্রচার বেশ বেগবান হয়ে ওঠে। ভাসানী ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি ভারতীয় শোষকদের বিরুদ্ধে “জেহাদ” ঘোষণা করেন। ভারতীয় পণ্য বয়কটের আহ্বান জানান।

দুদেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী আরো দুটি বিষয় লেখক আলোচনা করেছেন তা হলো বাংলাদেশের মুদ্রা ও ফারাক্কা সমস্যা। তবে ফারাক্কা সমস্যার ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধের সব চাইতে বড় জায়গাটি হলো ফারাক্কা ইস্যু। অবশ্য বাংলাদেশের আবির্ভাবের বহু পূর্বে ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে ভারত, কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা এমনি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাঁধ নির্মাণ শুরু হলেও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কারণে পুরো পরিস্থিতি বদলে যায়।

পাকিস্তান আমল থেকেই দুদেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭২ সালের গোড়াতেই ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে দুদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। কিছু দিনের মধ্যেই স্থায়ী যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। যৌথ নদী কমিশনের অনেকগুলো সভা অনুষ্ঠিত হলেও গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে কোন ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ-ভারত উভয়ে স্ব স্ব অবস্থানে অনড় থাকার কারণে এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান অর্জনও সম্ভব হয়নি। এই সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি লেখক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তা হলো,

“The Political aspect of the Ganges waters dispute, it was probably only at the level of head of state meetings that it could really be resolved. “৩০

তথাপি ফারাক্কা বাঁধের আনুষ্ঠানিক পরীক্ষামূলক উদ্বোধনের পূর্বে দুদেশের মধ্যে স্বল্পমেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গঙ্গার পানি বণ্টনের ইস্যু দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেবে থেকে যায়।

US 7th fleet Aircraft Carrier which headed to the Bay of Bengal in (1971)
US 7th fleet Aircraft Carrier which headed to the Bay of Bengal in (1971)

 

লেখক সমস্যাগুলোর বিবরণ দিয়েছেন বেশি, বিশ্লেষণ দিয়েছেন কম। দুটি দেশের জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্বের জায়গাটি লেখক উদ্ঘাটন করতে পারেননি। ১৯৭১-১৯৭৫ সময়কালে লেখক যে সমস্যাগুলো আলোচনা করেছেন, তার বাইরে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বয়ে গেছে। যেমন সীমান্ত সমস্যা ও ওআইসিতে বাংলাদেশের যোগদান। এই দুটি বিষয় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে।

রেখা সাহা তার India Bangladesh Relations গ্রন্থে মুজিব, জিয়া ও এরশাদ আমলে বাংলাদেশ-ভারতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের নানা দিক আলোচনা করেছেন। ভূমিকা ব্যতীত চারটি অধ্যায়ে দুই দশকের বেশি সময়ের দুদেশের সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন। স্বল্প পরিসরে দীর্ঘ সময়ের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আলোচনা করায় অনেক বিষয়েই গভীর বিশ্লেষণ অনুস্থিত।

এই গ্রন্থটি লেখকের পিএইচডি অভিসন্দর্ভের ফসল। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রত্যাশা ছিল এতে গবেষণা পদ্ধতি, তাত্ত্বিক কাঠামো এবং লিটারেচার রিভিউ অন্তত থাকবে। এই ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা আশাহত হয়েছি। তবে পূর্ববর্তী ভারতীয় গবেষকদের সঙ্গে তার একটা পার্থক্য হলো তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা, একাডেমিশিয়ানদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশী উপাদান বেশি ব্যবহার করেছেন। কিছু অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান না হওয়ার জন্য বাংলাদেশের দায় বেশি মনে করলেও সামগ্রিকভাবে দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকাই বড় হওয়া উচিত মনে করেন। তার মতে,

“Much more important than the solutions of the disputes… is the need for the restoration of the climate of understanding in Indo-Bangladesh relations that prevailed during the Mujib era. This is a difficult task but the major initiative has to come from India. “

জগলুল হায়দার তার The Changing Pattern of Bangladesh Foreign Policy: A Comparative Study of the Mujib and Zia Regimes (1971-1981)৩৩ গ্রন্থে নয়টি অধ্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আলোচনা করেছেন। যে সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আলোচনা স্থান পেয়েছে সেগুলো ভারত, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং মুসলিম বিশ্ব। এই রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুজিব ও জিয়া আমলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে। স্বল্প পরিসরে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশসহ তিনটি পরাশক্তি ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক আলোচনার কারণে বিভিন্ন ইস্যু একদিকে যেমন গভীরতা পায়নি, তেমনি সম্পূর্ণও হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Srimathi Indira Gandhi & Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Srimathi Indira Gandhi & Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman ]

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে লেখক ‘জাতীয় স্বার্থে’র ধারণাকে গ্রহণ করেছেন তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে ‘জাতীয় স্বার্থে’র ধারণাকে প্রয়োগ করেছেন রক্ষণশীল দৃষ্টিকোণ থেকে। উক্ত গ্রন্থে তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক বাংলাদেশ-ভারতের এক দশকের সম্পর্ক মাত্র ৮ পৃষ্ঠায় (পৃ. ২৭-৩৪) বর্ণনা করেছেন। এই সময়কালের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো আলোচনার চেষ্টা করেছেন। স্বাভাবিক কারণেই এমনি সংক্ষিপ্ত একটি অধ্যায়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা জটিল দিকের পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না। লেখক দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, জিয়ার সময়কালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। তার মতে,

“Nationally, Zia changed his policy from Mujib’s old route of secularism and socialism. Internationally Zia shifted from the Indo-Soviet orbit very hurriedly and tied the fate of Bangladesh with the United States, the west, China and the Islamic World. “৩৪

লেখকের মতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে কারণ এর ফলে জিয়ার সময়কালে বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। কৌশলে লেখক যা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন তা হলো কেবল বৈদেশিক সাহায্যের আকাঙ্ক্ষা থেকে জিয়া, মুজিব আমলে অনুসৃত নীতির পরিবর্তন করেননি। বরং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যে সব দল বা গোষ্ঠীর সক্রিয় সমর্থনে জিয়া তার ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন, তাদের নীতি ছিল ভারতবিরোধী।

আর বহু গবেষণা থেকেই এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, জিয়ার সময়কালে প্রাপ্ত অবাধ বৈদেশিক সাহায্যের এক বিরাট অংশ দেশের উন্নয়নে কোন অবদান রাখেনি। বরং তা বড় বড় ঋণখেলাপীর জন্ম দিয়েছে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। সুতরাং এই পরিপ্রেক্ষিতে জিয়ার নীতি সত্যিই কতটা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেছে, আর কতটা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে পরিচালিত হয়েছে সে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়।

উপরিউক্ত গবেষণাকর্মগুলোতে একপেশে বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে। ভারতীয় গবেষকগণ কেবল ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলো বিবেচনা করেছেন। যে কারণে দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান নানা সমস্যা সমাধান না হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেছেন একতরফা। ভারতের বাইরে যাঁরা এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন তাদের অধিকাংশের মধ্যে ভারতবিরোধী/পাকিস্তানী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। যে কারণে বিষয় বিশ্লেষণে দৃষ্টিভঙ্গিগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

অধিকন্তু দুদেশের সম্পর্কের গবেষণায় ভারতীয় লেখক/গবেষকগণ প্রাধান্য দিয়েছেন ভারতীয় তথ্য-উপাত্তের ওপর। আর ভারতের বাইরের লেখক/গবেষকদের কাছে পশ্চিমা পত্রপত্রিকার গুরুত্ব ছিল বেশি। মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা তথ্য-উপাত্তের ব্যবহার নিতান্তই নগণ্য। সম্ভবত তথ্য-উপাত্ত নির্বাচনে বাস্তবধর্মী ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব দুদেশের সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় হিসেবে থেকে গেছে।

২.

পদ্ধতিগতভাবে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা বেশ দুরূহ কাজ। কারণ নানা পরিপ্রেক্ষিত থেকে রাষ্ট্রসমূহ তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে থাকে। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।

ঐতিহাসিক পদ্ধতি

সমকালীন ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষণায় এই পদ্ধতি বেশ প্রাচীন। কূটনৈতিক ইতিহাস আমাদের সহায়তা করে জানতে যে কোন বিশেষ ইস্যু বা পরিস্থিতি মোকাবেলায় একজন কূটনীতিক বা রাজনীতিক কি উপায় অবলম্বন করে সাফল্য বা ব্যর্থতা পেয়েছেন। তাই বলা যায়

“ইতিহাস আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের সনাতন বা চিরাচরিত অথচ প্রয়োজনীয় পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে অতীতের নীতিগত ধারা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, অতীতের চিন্তাধারা, উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত, ঐতিহাসিক মৈত্রী ও দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, লেনদেন বা আচার ও আচরণের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের নীতিমালা, কূটনৈতিক ব্যবহারের ঐতিহ্য প্রভৃতির দিকদর্শন মেলে।”৩৫

ঐতিহাসিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে উপলব্ধি করা সম্ভব। এ ছাড়া পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির মধ্যকার সম্পর্ক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণের আলোকে ঐতিহাসিক পদ্ধতি একটি গ্রহণযোগ্য কর্মপরিকল্পনার সুপারিশ কর পারে।

বাংলাদেশ-ভারত নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্রদ্বয়, সব সময় একই ভৌগোলিক আকার ও রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত ছিল না। ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি দুটি দেশের মধ্যে যে বন্ধন তৈরি করেছে তা কোনভাবেই অস্বীকারের জো নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের সম্পর্কের গবেষণায় ঐতিহাসিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। পাশাপাশি ঐতিহাসিক পদ্ধতির সহজাত সীমাবদ্ধতা অস্বীকারের উপায় নেই, এর সঙ্গে আরো যুক্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের জটিল ও অপ্রত্যাশিত ইনপুট। যে কারণে শুধু ঐতিহাসিক পদ্ধতি যথেষ্ট নয় এই গবেষণায়।

আদর্শ মূল্যবোধভিত্তিক পদ্ধতি

একটি রাষ্ট্র তার ইতিহাস-ঐতিহ্য, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে বিশেষ কোন নীতিকে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। যা সংবিধানে সন্নিবেশিত থাকতে পারে আবার নাও পারে। কিন্তু আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই আদর্শবাদিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আদর্শবাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মৌল ভিত্তি হিসেবে ন্যায়বোধ বা উচিত-অনুচিত ধারণাকে গ্রহণ করেছে, যে কারণে আদর্শভিত্তিক পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতাকে আমলে নেয়া হয় না, বরং ন্যায়বোধ অনুযায়ী কি ধরনের সম্পর্ক হওয়া কাম্য তার ওপর জোর দেওয়া হয়। ম্যাকিয়াভেলি যেখানে রাষ্ট্রের স্বার্থ হাসিলে যে কোন পন্থা অবলম্বনের অনুমোদন দিয়েছেন, এর বিপরীতে জ্যা জ্যাক রুশো ও ইম্যানুয়েল কান্ট আদর্শবাদকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের মূল মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনও এই মতবাদ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ৩৬

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে আদর্শবাদিতার প্রত্যক্ষ প্রভাব। আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সাদৃশ্য, ১৯৭১-১৯৭৫ সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারণে, ভারত সরকারের দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে, আস্থা-নির্ভরতার ভিত্তি তৈরি করে আদর্শিক মিল। এ ছাড়া অন্য বিষয় ছিল যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আবেগজাত। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় দোদুল্যমানতা থাকা সত্ত্বেও অন্তিমে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।

বর্ণনামূলক পদ্ধতি

আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কোন বিশেষ ঘটনা বা সমস্যার বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয় বিশেষ ঘটনা বা সমস্যাকে এর পটভূমি, উদ্ভব, বিস্তার, সমাধানের অন্তরায় অর্থাৎ সমস্যা বা সঙ্কটের আনুপাক্ষিক বিশ্লেষণ উপস্থাপিত করা হয়। ৩৭

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অনেকগুলো সমস্যা অমীমাংসিত অবস্থায় আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই সমস্যাগুলো এড়িয়ে গিয়ে, কাঙ্ক্ষিত সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিটি সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতসহ গভীর বিশ্লেষণ করা হবে এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য পথ নির্দেশের চেষ্টা করা হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে উল্লিখিত তিনটি পদ্ধতিই কোন না কোনভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্লেষণে উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতিরই বিষয় সংশ্লিষ্ট উপাদান নিয়ে একটি সমন্বিত পদ্ধতির আলোকে গবেষণা করা যেতে পারে।৩৮

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

তাত্ত্বিক কাঠামো

বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সঙ্গে নানা বিষয়যুক্ত হয়ে এটাকে জটিল করে তুলেছে। ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নানা বিষয় দুদেশের সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতিমালা অনুযায়ী “জাতীয় স্বার্থই প্রতিটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বলা বাহুল্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও জাতীয় স্বার্থের ধারণা ক্রিয়াশীল।

তবে কেবল জাতীয় স্বার্থের আলোকে দুদেশের সম্পর্কের জটিল ইস্যুগুলোর সঠিক ও সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ত সম্ভব হবে না। কারণ বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের বিষয়টি গতানুগাতিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মত নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের বা ভারতের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক হয়ত এভাবে বিশ্লেষণ সম্ভব। তবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে বিবেচনা করতে হবে স্বতন্ত্র তত্ত্বকাঠামোর অধীনে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আবেগগত ও আদর্শগত বিষয়কে অস্বীকার করে দুদেশের সম্পর্কের যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়ত সম্ভব নয়। আবেগগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠীর কারণে, আবেগকে আরো তীব্র করেছে উনিশশ সাতচল্লিশ সনে ভারত বিভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে অভিবাসী জনগোষ্ঠী। যারা উপর্যুক্ত রাজ্যগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কিন্তু জন্মভূমি পূর্ববঙ্গ কখনো তাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।

পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিরোধ একেবারে ছিল না তা নয়। তবে বিরোধের একটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল অর্থনৈতিক বিষয়াদি, ধর্ম মুখ্য হয়ে ওঠেনি। এক পর্যায়ে ধর্মই বিরোধের কেন্দ্রে চলে আসে।

“হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে ১৯৪৭ সালে বাঙলা আবার ভাগ হয়। কিন্তু এ সময় প্রায় কারও কণ্ঠেই প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হলো না, বরং দ্বিতীয় বার বাঙলা ভাগ নিশ্চিত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে একটা সংঘবদ্ধ আন্দোলন পরিচালিত হলো—যার লক্ষ্য ছিল ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশকে ভাগ করা।”৩৯

আমরা জানি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসমানদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়াতেই ১৯৪৮ সালেই ভাষার প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বিরোধের জন্ম হয় তা ক্রমে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতার পথে ধাবিত হয়। ১৯৪৭-১৯৭১ সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অসাম্প্রদায়িক চরিত্র।

যেখানে ১৯৪৭ পূর্বকালে জাতীয়তাবাদ ছিল ধর্মীয় এবং/অথবা সাম্প্রদায়িক৪০ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বহু ছাত্র সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে অভিনব ব্যাপার। যেখানে ধর্মীয় আবেগ আর ভারতবিরোধিতাই হলো পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির প্রধান উপাদান। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের ন্যায্য আন্দোলন দাবি-দাওয়াকে বিবেচনা করেছে ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে।

১৯৪৮-এ শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব আন্দোলন সংগ্রাম একই মানদণ্ডে মূল্যায়ন করেছে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী। যে কারণে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী তথাকথিত ভারতীয় চক্রান্তের নামে একদিকে যেমন বাঙালিদের ন্যায্য আন্দোলন সংগ্রাম দমন করেছে দুই যুগ ধরে, তেমনি বাঙালিদের নিকট ভারত-পাকিস্তান বিরোধের বিষয়টি একান্তই পশ্চিম পাকিস্তানের বিষয় হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।

এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর সন্দেহ, অবিশ্বাস যেমন বাড়তে থাকে তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যগুলোর সঙ্গে এক ধরনের সহানুভূতির সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। দীর্ঘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক বিরোধ অনেকটা ফিকে হয়ে আসে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদী নীতির কারণে।

এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালে কলকাতা সফরকালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক নেতাজী ভবনে দেওয়া ভাষণে বলেন,

“বাঙালি এক অখণ্ড জাতি। আর তারা একই ভাষায় কথা বলে এবং একই সুসংহত দেশে বাস করে। তাদের আদর্শ ও এক, জীবন ধারণের প্রণালীও এক। …. আজ আমাকে ভবিষ্যৎ ইতিহাস গঠনে অংশগ্রহণ করতে হবে। আমি ভারত বলতে পাকিস্তান ও ভারত দুটিই বুঝি। কারণ ঐ বিভাগ আমি কৃত্রিম বিভাগ বলে মনে করি।”৪১

আমরা জানি এমনি বক্তব্যের জন্য ফজলুল হককে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তারপরও স্বীকার করতে হবে যে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সাধারণ জনগণের মানস জগতের সঙ্গে ফজলুল হকের ভাবনার সাযুজ্য ছিল।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আদর্শ বা নীতি-মূল্যবোধের কোন স্থান নেই সম্ভবত এ কথা নিশ্চয়তাসহকারে বলা চলে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ উড্রো উইলসনের ‘চৌদ্দ-দফা কর্মসূচির বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। জাতিপুঞ্জ পরবর্তীতে জাতিসংঘের সনদে ‘চৌদ্দ-দফা’র প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ভার্সাই সম্মেলনেও উইলসন আদর্শবাদী ভূমিকা পালন করেন ৪২ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘আদর্শ’ (ideology)-কে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে,

“A system of beliefs or theories that usually serves as a guide to action and that may form the basis of a socio political programme. “8*

অন্যত্র আদর্শের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি, ক্ষমতার প্রয়োগ, ব্যক্তির ভূমিকা, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ধরন এবং সমাজের উদ্দেশ্যসমূহ।৪৪

বিশিষ্ট গবেষক Mari Holmboc Rüge দেখছেন কিছুটা ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে। একটি জাতির ভাবমূর্তি (অর্থাৎ আদর্শ) সে জাতির সংসদ সদস্যদের বিতর্কে, রাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিফলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস/সিনেটে যে বিতর্ক হয় (পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে) তার প্রেক্ষাপট ক্ষমতার রাজনীতি ব্রিটেনে অর্থনীতি ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নরওয়েতে বিশ্বশান্তি ও সমঝোতা ।৪৫

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ‘আদর্শ’কে সংজ্ঞায়িত করা বেশ জটিল ও দুরূহ কাজ। তবে ‘আদর্শ’-এর ধারণা কিছুটা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন Northedge. তার মতে,

“We may distinguish between various functions of ideology in foreign policy: to bind the country together psychologically,… a prism through which states perceive the international realities on which their foreign policy must work. Without ideology a nation does not exactly perish, but it can hardly know what to approve and disapprove. “৪৬

বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শবাদিতার কার্যকারিতা নিয়ে ভিন্নমত অবশ্যই রয়েছে। তবে কোন কোন দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘আদর্শ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় জায়গা জুড়ে আছে আদর্শ। কারণ। আদর্শগত সাদৃশ্য দুদেশের সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল উনিশশ একাত্তরে। এই ধারা অব্যাহত থাকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত। পঁচাত্তর-উত্তরকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যায়। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক হলো পঁচাত্তরের সামরিক অভ্যুত্থান।

এমনি বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র (RAW)-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বি. রমনের লেখায়। তিনি লিখেছেন,

১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর একদল সেনা কর্মকর্তা ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু সে সব সেনা কর্মকর্তার রাজনৈতিক সমর্থকরা ভারতের প্রতি খুব একটা বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন না। ১৯৭১ সালের আগের পূর্ব পাকিস্তানের মত বাংলাদেশ ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র হয়ে পড়ে।”৪৭

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের জনগণ ও সরকারের কাছ থেকে যে সর্বাত্মক সাহায্য সহানুভূতি লাভ করে তার একটা বড় কারণ হলো, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শ।৪৮ গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শগত সাদৃশ্য ছিল। তার অর্থ এই নয় যে, কেবল আদর্শগত মিলের কারণে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছে। একই সঙ্গে ভারতের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে ছিল এই সিদ্ধান্ত।

পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলে, ভারতের দিক থেকে কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে বিশেষ সহায়ক হয়। তাই বলা যায় মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল একই সঙ্গে আদর্শবাদিতা ও জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পারিচালিত। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে অবশ্যই আদর্শবাদিতা ছিল। মুখ্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও আশদবাদিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উনিশশ বাহাত্তর সালে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসমূহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বলা হয়। “জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা—এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র:

ক. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন;

খ. প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং

গ. সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।”৪৯

বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না উপরিউক্ত আদর্শসমূহ ভারতের রাষ্ট্রীয় আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

মুজিব আমলে জাতীয় স্বার্থের টানাপোড়েন যে হয়নি, তা বলা যাবে না। কোন কোন দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে দুপক্ষই অনড় অবস্থান নিতে অনাগ্রহী ছিল না। তারপরও সামগ্রিক বিচারে দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বজায় ছিল। বলা যায় দুদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শের মিল এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শগত সাযুজ্য উনিশশ পঁচাত্তরের পনের আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে আদর্শিক পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেমন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পৃষ্ঠপোষকতা পায় তেমনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ অগ্রাধিকার পায়।

মুজিবের শাসনের অবসানের পর সৌদি আরব ও চীনের স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। জিয়া পরিকল্পিতভাবে ইসলামী পরিচয়কে বড় করে তুলতে চেয়েছেন দেশের ভেতরে ও বাইরে। জিয়া ক্ষমতাসীন হবার পরপর ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়কে আরবি ও বাংলায় কোরান ও হাদিসের বাণী উৎকীর্ণ করে বিশাল বিশাল বোর্ড শোভা পেতে থাকে। রাস্তার পার্শ্বে ইসলামী অনুকরণে তোরণ নির্মাণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। জিয়ার এমনি উদ্যোগকে একাত্তরপূর্ব চিন্তা-চেতনার পুনঃপ্রকাশের প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে তিনি মিত্রশূন্য ছিলেন না। দক্ষিণপন্থী ও বাম দলের একাংশ পাকিস্তান আমল থেকেই “ভারত বিরোধিতা”কে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রধান উপাদানে পরিণত করে। স্বাভাবিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধিতা করে। এই দলগুলোই জিয়ার সমর্থক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। আদর্শগত দিক থেকে জিয়া যে সব দল/গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন তা বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের পথে অন্তরায় হওয়াটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পর্কের ইসলামীকরণকে জিয়া সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নম্বর ৪ অনুযায়ী সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদের ১(২) ধারায় সন্নিবেশিত হয়—

“রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।”৫০

এতক্ষণ আদর্শবাদিতার ওপর আলোচনা করলেও বাংলাদেশ-ভারত দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে “জাতীয় স্বার্থ”কেও একটি উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। যে কোন দেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। জাতীয় স্বার্থ অর্জন করাই প্রতিটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্র তাদের বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনা করে থাকে জাতীয় স্বার্থের আলোকে। ১৯৭১-১৯৮১ সময়কালে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তার জাতীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। দুদেশের সম্পর্ককে জাতীয় স্বার্থ কিভাবে প্রভাবিত করছে এর বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে “জাতীয় স্বার্থ” সম্পর্কে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না হয়ত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

“জাতীয় স্বার্থ” অভিধাটি অপেক্ষাকৃত নবীন বলা যেতে পারে। স্বার্থ বা “interest” শব্দটি ল্যাটিন থেকে উদ্ভূত যার অর্থ

“It concerns it makes a difference to, it is important with reference to some person or thing. “৫১

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড উভয় ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একটি জাতির পররাষ্ট্রনীতির পর্যাপ্ততা বা উৎসের মূল্যায়ন বা বর্ণনা, ব্যাখ্যায় জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে বিশ্লেষণের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে আধুনিক অর্থে “জাতীয় স্বার্থ” ধারণার ব্যবহার শুরু হয়। এমন ধরনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাবেশ ঘটে “জাতীয় স্বার্থে” যা একটি জাতির নীতিসমূহের লক্ষ্যে পরিণত হয়।

নানা ধরনের জাতীয় স্বার্থ হতে পারে, যেমন, আদর্শিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং সাংস্কৃতিক। কেবল বৈদেশিক ক্ষেত্রে নয়, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও জাতীয় স্বার্থের প্রতিফলন ঘটে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এলে “জাতীয় স্বার্থ”কেও জাতিরাষ্ট্র সময়ের উপযোগী করে নেয়।

আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক যে কোন উপায় গ্রহণ করা যেতে পারে জাতীয় স্বার্থ আদায়ের জন্য। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে “জাতীয় স্বার্থ” অভিধাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তথাপি এর সঙ্গে জাতীয় সম্মান (national honour), জাতীয় অহংবোধ (national prestige) এবং অপরিহার্য স্বার্থের (vital interest) সঙ্গে একটি প্রভেদ থাকা বাঞ্ছনীয়। যদি “জাতীয় স্বার্থ”কে রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা ও বস্তুগত অর্জন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় তাহলে “জাতীয় সম্মান” এবং “জাতীয় অহংবোধ” হলো একটি মানসিক অবস্থা এবং যা একটি জাতির জন্য অবিচ্ছেদ্য।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় জাতীয় স্বার্থ নিয়ে দরকষাকষি করা যায় বা ছাড় দেওয়া যায় জাতীয় মর্যাদা’ এবং ‘অহংবোধ’-এর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। অন্যদিকে যখন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকগণ কোন জাতীয় ইস্যুতে কোন প্রকার ছাড় না দিয়ে কঠোর অবস্থান নেয় এমনকি যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি গ্রহণে পিছপা হয় না। সে ইস্যুকে জাতির জন্য অপরিহার্য স্বার্থ” বলা যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

“জাতীয় স্বার্থ”-এর অর্থ বা সংজ্ঞা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক বা মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, আমলা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ সবাই ব্যাপকভাবে অভিধাটি ব্যবহার করলেও এর ধারণাগত দিকটি যথাযথভাবে আলোচিত হয়নি। জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে দি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স ডিকশনারিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে,

“… a highly generalised conception of those elements that constitute the state’s most vital needs. These include self-preservation, independence, territorial integrity, military security and economic well being.”

কিছুটা ভিন্নভাবে জাতীয় স্বার্থকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে, জাতীয় স্বার্থ হলো সামগ্রিকভাবে একটি দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ যার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হবে ঐ দেশের পররাষ্ট্রনীতি।৫২ জাতীয় স্বার্থ নিরূপণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন স্টেফান ক্রাসনারের কাছে বস্তুগত উদ্দেশ্য এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী আদর্শিক লক্ষ্যসমূহ হলো জাতীয় স্বার্থ।

ডোনাল্ড ন্যুকটারলিন চারটি মৌলিক স্বার্থের সমষ্টিকে জাতীয় স্বার্থ বলেছেন। যথা প্রতিরক্ষা স্বার্থ, অর্থনৈতিক স্বার্থ, বিশ্ব ব্যবস্থার স্বার্থ এবং আদর্শিক স্বার্থ। এই সংজ্ঞা থেকে জাতীয় স্বার্থের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেলেও এর ভাব বা মনোগত দিকটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, জাতীয় স্বার্থ হলো যে নীতি বা নীতিসমূহের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়কালে, একটি নির্দিষ্ট জাতিরাষ্ট্রে বসবাসকারী ব্যক্তি, দল বা উপদলের স্বার্থ সংরক্ষিত করা।

বলা যায়, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে, তাই জাতীয় স্বার্থের গড়নে ইতিহাসের ভূমিকা অপরিহার্য। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির অগ্রাধিকার ও দাবি-দাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থেরও প্রয়োজনীয় সংস্কার, পরিবর্তন করতে হয়। যেমন, স্নায়ুযুদ্ধকালীন পর্বে জাতীয় স্বার্থ জাতীয় নিরাপত্তার সমার্থক শব্দে পরিণত হয়। কিন্তু বর্তমানে নিরাপত্তার ধারণারও পরিবর্তন ঘটছে, অনেক জাতি তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত স্বার্থ নিয়ে অধিক উদ্বিগ্ন।

জাতীয় স্বার্থের যেমন সার্বজনীন সংজ্ঞা নেই, তেমনি এর পরিধি বা সীমা নিয়েও মতানৈক্য আছে। একটি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থের মধ্যেই কি এর পরিসর সীমিত থাকবে নাকি পরিবেশগত, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আত্মিক প্রয়োজনগত স্বার্থগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত হবে? বাস্তববাদীরা জাতীয় স্বার্থকে কেবল বস্তুগত অর্জন যথা সামরিক, রাজনৈতিক এবং

অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করে থাকেন। যদিও অন্যরা জাতীয় স্বার্থকে আরো বিস্তৃত পরিসরে ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী। যেমন জেমস বিলিংটন মনে করেন,

“National interest should be understood both in terms of material and non-material aspects. .”৫৩

যে সকল রাজনৈতিক দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের লেখনী বাস্তববাদীদের জাতীয় স্বার্থ ও বৈদেশিক নীতির ধারণাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন তারা হলেন থুসিডাইডিস, ম্যাকিয়াভেলি, কৌটিল্য, থমাস হবস, হুগো এসিয়াস, রুশো প্রমুখ। কিন্তু সাম্প্রতিককালের বাস্তববাদীদের ভাবনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে ই. এইচ. কার এবং হান্স মর্গেনথু রচনাবলি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

বাস্তববাদীরা মনে করেন রাষ্ট্রের স্বার্থ (state interest)-এর ধারণা থেকে জাতীয় স্বার্থের উদ্ভব হয়েছে। তাদের মতে এই ধারণা সার্বজনীনভাবে বৈধ এবং এটা হলো

“Unaffected by the circumstances of time and places” ৫৪ মর্গেনথু বিশ্বাস করেন এটি কেবল রাজনৈতিক প্রয়োজনের বিষয় নয় বরং একটি জাতির নৈতিক দায়িত্ব অন্য জাতির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। তার মতে,

“And above all, remember always that it is not only a political necessity but also a moral duty for a nation to follow in its dealings with other nations but one guiding star, one standard for thought, one rule for action: the National Interest.”

৫৫ বাস্তববাদীরা ক্ষমতা এবং নিরাপত্তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনা করে থাকেন, তাদের বিবেচনায় অন্য সব স্বার্থই রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা স্বার্থের অধস্তন।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগগত, আদর্শগত ও জাতীয় স্বার্থের বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। আবেগগত, আদর্শগত ও জাতীয় স্বার্থের ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতীয় অবস্থান। দুদেশের সম্পর্কের সবচাইতে স্পর্শকাতর বিষয় সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে ভারতের সরকার ও জনগণ এত গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল যে, পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সম্পৃক্ততা বড় ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবকে দুটি পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক দুভাবে দেখা যেতে পারে। ভারতে ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারকদের (political actor) মধ্যে দুটি গোষ্ঠীই রয়েছে। ভারতের ডানপন্থী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধকে দেখে এই অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের মহাসুযোগ হিসেবে। জনসংঘ, স্বতন্ত্র ও হিন্দু মহাসভার তৎপরতা সে রকমই সাক্ষ্য দেয়।৫৬

১৯৪৭ সালে ভারত-বিভাগ চূড়ান্ত কোন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেনি। পাকিস্তানের ভাঙনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা হিসেবে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। এর দ্বারা ভারত কোন কোন ক্ষেত্রে সুবিধা পেতে পারে সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই দক্ষিণপন্থী দলগুলোর কাছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক কোন আবেদন ছিল না।

জনসংঘ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চের আক্রমণের পর স্বাধীনতা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জনসংঘ তার অবস্থান পরিবর্তন করে। জনসংঘের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে জুলাই মাসের শুরুতে। উদয়পুরে প্রতিনিধি সভায় সভাপতির ভাষণে অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেন,

“The Government of India should not do anything to hinder this historical process of the disintegration of Pakistan. In fact it is the duty of the government to promote this process. “৫৭

আগস্ট মাসে সম্পাদিত ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির সমালোচনা করে বাজপেয়ী বলেন,

দুদেশের যুক্ত ইশতেহারে রাজনৈতিক সমাধানের নামে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে যা বাংলাদেশের পিঠে ছুরিকাঘাতে শামিল। ৫৮

এক সময়ে জনসংঘের প্রভাবশালী নেতা এম. এল. সোন্ধি বলেন,

“বাংলাদেশ সঙ্কট ভারতের জন্য এক বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে— এই সুযোগে পাকিস্তানকে তার পূর্বাঞ্চল থেকে বঞ্চিত করে দক্ষিণ এশিয়ায় “major factor” হিসেবে আবির্ভূত হবার।”৫৯

As Jana Sangh president, Vajpayee addresses a mammoth rally in Delhi in August 1971, demanding the immediate recognition of Bangladesh by the Indian government
As Jana Sangh president, Vajpayee addresses a mammoth rally in Delhi in August 1971, demanding the immediate recognition of Bangladesh by the Indian government

 

জনসংঘ বরাবরই বাংলাদেশ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান অথবা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বিরোধী অবস্থান নেয়। তারা মনে করে ভারতকে এককভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। তা হবে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। কোন রাখঢাক ছাড়া বাজপেয়ী বলেন,

“We want recognition to Bangladesh so that the way is cleared for giving massive military aid to that country. “৬০

জনসংঘের মূল লক্ষ্য ছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা। এবং চিরশত্রু পাকিস্তানের ভাঙন নিশ্চিত করে পূর্বাঞ্চলের ওপর থেকে তার অধিকার হরণ করা।

ভিন্নপরিপ্রেক্ষিত থেকে হলেও জনসংঘ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু রাজা গোপালচারির স্বতন্ত্র পার্টি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করে। এই অবস্থানের প্রধান কারণ হলো সম্ভাব্য চৈনিক হস্তক্ষেপের ভীতি। বাংলাদেশ সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান সম্ভব তার জন্য প্রয়োজন আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখা, পাকিস্তানের ভাঙন বা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে এই সঙ্কটের অবসান হবে না। এই প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র পার্টিপ্রধান রাজা গোপালচারি লিখেছেন যে,

“If a frustrated Mujibur Rahman yields to the temptation of inviting China, it would be a fatal step which terminate in its (Bangladesh’s) becoming a satellite of communist China. “৬১

তা ছাড়া শরণার্থীর ভরণপোষণ যুদ্ধের চাইতে বেশি ব্যয়বহুল এই যুক্তিতে ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াকে স্বতন্ত্র পার্টি সমর্থন করে না। বরং যুদ্ধের কারণে ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাবার আশঙ্কা যেমন আছে তেমনি পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছ থেকে পাকিস্তানের সাহায্য পাবার সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে পারে। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা ভারতের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সঞ্চার করতে পারে।

“The Hindu Muslim relations within the country might also become strained if India became deeply involved in the Bangladesh problem. “৬২

স্বতন্ত্র পার্টি মুক্তিযুদ্ধকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে যেমন দেখেছে তেমনি চীনের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের বিষয়ও বিবেচনা করেছে। শেষ পর্যন্ত দলীয় অবস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে নিজের স্বার্থে ভারতের নিরপেক্ষ থাকা উচিত।

কিন্তু ভারতের বাম, অসাম্প্রদায়িক, উদার রাজনৈতিক দলের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সংগ্রাম, জনগণের ত্যাগ আর আদর্শিক প্রেরণা তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের আলোকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিবেচনা করেনি বরং জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে দেখে।৬৩

Bangladesh’s Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman observes the exit parade of the Indian Army stationed in Bangladesh, March 12, 1972
Bangladesh’s Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman observes the exit parade of the Indian Army stationed in Bangladesh, March 12, 1972

 

প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘জনতা’য় দলীয় অবস্থান সম্পর্কে লেখা হয় যে, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাসহ মৌলিক আদর্শগত বিষয়ে আওয়ামী লীগ এবং ভারত অংশীদার হওয়ায় ভারতের জনগণ এই সংগ্রামে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। ৬৪ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সীয়) দৃষ্টিতে বাংলাদেশ আন্দোলন পাকিস্তানের দুঅংশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ছিল না, বরং এটা ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জনতার ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রাম যা পাকিস্তানের উভয় অংশ এবং ভারতের জনসাধারণের সমর্থন করা উচিত।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের মধ্যে দলগত অবস্থানের দিক থেকে আদর্শগত সাদৃশ্য, বিশেষত গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা উল্লেখ করা যায়। নীতিগত প্রশ্নে শাসক দল কংগ্রেস এবং ভারত সরকারের মধ্যে মতানৈক্য না থাকার কথা। যদিও লোকসভায় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিতর্কে শাসক দলের অনেক সদস্য সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে সামগ্রিক বিচারে কংগ্রেস এবং ভারত সরকারের নীতি ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়,

“The working committee expresses its solidarity with the people of East Bengal and solemnly pledges itself to do whatever lies within its power to mitigate their sufferings,”

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে সামগ্রিক বিচারে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। অর্থাৎ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তবে রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে তাদের করণীয় স্থির করেছে। যে কারণে দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে বামপন্থী দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার, দক্ষিণপন্থী দলসমূহ এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্তর্নিহিত মিল লক্ষ্য করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের ন্যায্য আন্দোলন দাবি-দাওয়াকে বিবেচনা করেছে ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে মুসলমানদের আবাসভূমি পাকিস্তানকে ভাঙার হিন্দু ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে। বাঙালিদের স্বাধীন হবার রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামকে বিবেচনা করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা গৃহযুদ্ধ হিসেবে।

১৯৭১ সালের জুন মাসে করাচি থেকে প্রকাশিত পাকিস্তান সরকারের প্রচার পুস্তিকায় পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করা হয় যে,

“Sheikh Mujibur Rahman was fighting India’s war… How deep and long-term have been India’s plans for subversion in Pakistan is by now well-known… They ( Indians) started from the very day in 1947 when Pakistan was created. Since that day Indians have, never reconciled themselves to the fact of Pakistan and have employed every device to cripple this state. “৬৭

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন,

“ভারতকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে।… আওয়ামী লীগের ছ-দফা কর্মসূচি ছিল মূলত দেশকে দুঅংশে বিভক্ত করার ফর্মুলা। ….. পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এই বিশ্বাসে ৬-দফার পক্ষে ভোট দিয়েছে যে, এর মাধ্যমে বর্তমান অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটবে।”৬৮

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছেন পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রেসিডেন্ট পীর মোহসিন উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন,

“ভারতের এ সব কার্যকলাপ আমাদেরকে আজাদীপূর্ব দিনগুলোতে মুসলমানদের ওপর হিন্দুদের নির্যাতনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, যে সময় ব্রিটিশ রাজ্যের ছত্রছায়ায় ভারতীয় হিন্দুরা প্রতারণা করে মুসলমানদের সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে এবং তাদের ধর্মীয় কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ ও মুসলিম ছাত্রদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সীমিত ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা সৃষ্টি করে মুসলমানদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করেছে।” ৬৯

Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev
Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev

 

পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ইত্তেহাদুল উলেমার সাধারণ সম্পাদক মওলানা মিয়া মফিজুল হক বলেন,

“ভারত পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি মানুষকে চিরদিনের জন্য দাসে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত রয়েছে। … যারা ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী হয়ে ভারতীয়দের সাহায্যের আশায় আছেন, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন”। ৭০

ভারতকে দায়ী করে পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ বলেন,

“ভারত বিভাগ বাতিল করার জন্য ভারত প্রতিটি সুযোগেরই সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। … লক্ষ লক্ষ মুসলমানের জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে ভারতীয় মুসলমানদের এই বাসভূমি অর্জিত হয়েছে। ….. পাকিস্তানের বর্তমান শাসনতান্ত্রিক সমস্যা পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তা জনসাধারণকে দেশের সংহতি ও আদর্শ রক্ষা থেকে কখনোই বিরত করবে না।”৭১

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য ছিল। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাদের অবস্থান গ্রহণের কারণ হলো:

(ক) মুক্তিসংগ্রাম সফল হলে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও গণতান্ত্রিক ধারা শক্তিশালী হবে;

(খ) পরোক্ষভাবে এটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দুর্বল করবে;

(গ) এর ফলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা তিরোহিত হবে এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হবে।

৭২ তবে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছে। দলীয় তত্ত্ব অনুযায়ী এটা ছিল

“মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদলেহনকারী দুই কুকুরের লড়াই।”

এই দ্বন্দ্বের এক পক্ষে ছিল ইয়াহিয়া ও ভুট্টো অন্যদিকে শেখ মুজিব ও তার সমর্থক। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ উভয় পক্ষ শোষিত জনগণের শত্রু। তাই তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য গেরিলা বাহিনী গঠন করে। মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে ১০ হাজার সদস্যের ‘লাল গেরিলা’ দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি তৈরি করে শ্রেণীশত্রু নিধনযজ্ঞে লিপ্ত হয়। ৭৩

চীনপন্থী পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টি, ইস্ট বেঙ্গল ওয়ার্কার্স মুভমেন্ট। এই দল দুটি মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে প্রাথমিক পর্যায়ে গৃহীত দলের তাত্ত্বিক অবস্থান ধরে রাখতে সমর্থ হয়নি। এক পর্যায়ে বিভিন্ন উপদলে ভাগ হয়ে যায় নেতৃবৃন্দ। তবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী চীনপন্থী কমিউনিস্টরা মুক্তিসংগ্রাম কমিটি গঠন করে। এই কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ঘোষণা করা হয়। যদিও ভাসানী তা অস্বীকার করেন।

ভারতের সিপিএম এই কমিটিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে।৭৪ তবে পিকিংপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মওলানা ভাসানী, মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি প্রফেসর মোজাফফর আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর, কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ মুজিবনগর সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানান।

Maulana Abdul Hamid Khan Bhashani, Maulana Abdur Rashid Tarkabagish, Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman
Maulana Abdul Hamid Khan Bhashani, Maulana Abdur Rashid Tarkabagish, Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শবাদিতাকে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক বিবেচনা করতে চান না। তাদের বিবেচনায় একটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যা কিছু করে এর পেছনে প্রণোদনা যোগায় জাতীয় স্বার্থ। সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এমনি বক্তব্যের সমর্থনে লিখেছেন যে,

“১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন যে ভূমিকা পালন করেছিল, তার মূলেও ছিল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তাদের জাতীয় স্বার্থ।” ৭৫

এই পটভূমিতে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে,

“পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে আদর্শ সাধারণভাবে ভূমিকা পালন করলেও বিশেষ পরিস্থিতি এবং নির্দিষ্ট কোন সমস্যার প্রতি যে নীতি অনুসৃত হয়, তার মূলে কাজ করে জাতীয় স্বার্থ।”৭৬

অনুরূপভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও জাতীয় স্বার্থ তবে একমাত্র উপাদান হিসেবে মেনে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত হয় না। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন মনে করেন,

“Every country of course, is and will be motivated by self-interest. In 1971, every party involved saw to its own interest, the Bangalees saw to their interest, and so did Pakistan, and still then it is not true to say that the matter of ideology was not there. The Soviet Union always supported the freedom struggles of the third world countries as Saudi Arabia supports the Islamic countries. “৭৭

কেউ কেউ বলবার চেষ্টা করেন যে, ভারত কেবল তার জাতীয় স্বার্থে চিরশত্রু পাকিস্তানের ভাঙন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে। এই বক্তব্য অস্বীকার করছি না। পাকিস্তানের ভাঙন ভারতের জন্য সামরিক, অর্থনৈতিক এবং দক্ষিণ এশিয়া ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই বিরাট অর্জন।

আমরা মনে করি ভারতের ভূমিকার আড়ালে কেবল জাতীয় স্বার্থ ক্রিয়াশীল ছিল তা নয় এর সঙ্গে অপরিহার্যভাবে যুক্ত ছিল। আদর্শবাদিতা এবং ভাষা ও জাতিগত আবেগ। এমনকি কখনো কখনো আদর্শবাদিতা জাতীয় স্বার্থকেও ছাপিয়ে গেছে। কারণ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অবসান হবে এটা নিশ্চয় পূর্বনির্ধারিত ছিল না।

তাই একাত্তরে জুন-জুলাই মাসেও ভারত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এমন অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে যা তার জাতীয় নিরাপত্তা এবং অখণ্ডতার জন্য ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ ভারত সরকার কেবল পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাঙালির জাতিগত ভাবাবেগের চাপে ছিল তা নয় প্রায় সমগ্র ভারতব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক সহানুভূতি, আবেগের সঞ্চার হয়।

এমনি জনমতের চাপে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন যা তার দেশের জাতীয় স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারত। সুতরাং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিশ্লেষণে আদর্শ ও আবেগের জায়গায় যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শের সঙ্গে কংগ্রেসের মিল না থাকলে ভারতীয় সহায়তা পাওয়া সহজ হত না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে ভারতের ভূমিকা কী হত? খুবই হাইপোথিটিক্যাল প্রশ্ন।

Tajuddin Ahmad Indira Gandhi
Tajuddin Ahmad Indira Gandhi

 

যথার্থ উত্তর দেওয়া মুশকিল। অন্তত এটুকু বলা যায় সাম্প্রদায়িকতাই যদি আওয়ামী নেতৃত্বের লক্ষ্য হত তাহলে এক পাকিস্তান ভেঙে দুই পাকিস্তান সৃষ্টিতে ভারতের উৎসাহিত হবার বাস্তব কোন কারণ ছিল না। সুতরাং আদর্শবাদিতাকে এ ক্ষেত্রে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। একই কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। আদর্শিক কারণে পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্য, মার্কিন সহায়তা পেয়েছে পুরোপুরি।

8.

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়টি নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের উদ্ভবকে কিভাবে দেখছে এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়নই বা কী তার ওপর। স্বাধীনতার পরপর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু চীনপন্থী বামদল ও ডানপন্থী দলগুলো সদ্য স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে ‘ভারত বিরোধিতা’কে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত করে।

এটা ছিল পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাবাহিকতা, কারণ এই দলগুলো বাংলাদেশের উদ্ভবকে দেখেছে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। যে কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের যে কোন সমস্যার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলো ভারতকে দায়ী করে জনমতকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। যা দুদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক ছায়া ফেলে। তবে আওয়ামী লীগ আমলে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার কারণে জাসদ ও মওলানা ভাসানীর ছত্রছায়ায় সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো তাদের তৎপরতা চালিয়ে যায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখলের পর স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক দল ও চীনপন্থীদের সমন্বয়ে নতুন রাজনীতিক দল গঠন করে ‘ভারত বিরোধিতা’কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে বাংলাদেশের উদ্ভবের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে।

এই তাত্ত্বিক কাঠামোর যথার্থতা প্রমাণিত হবে স্বাধীনতা-পরবর্তী এক দশক ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের পর্যালোচনা থেকে। ১৯৭১-১৯৮১ সময়কালে দুদেশের সম্পর্কের সামগ্রিক বিশ্লেষণে লক্ষ্য করা যায় দুদেশের মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আদর্শগত, আবেগগত ও জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে। কেবল জাতীয় স্বার্থের ধারণা কিংবা প্রচলিত বৃহৎ রাষ্ট্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ধারণার আলোকে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করলে সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া যাবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

কারণ দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগ ও আদর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগ ও আদর্শগত দিক থেকে একটা সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক অমোচনীয় বিভাজন রেখা। এই ঘটনাকে ভারতের সরকারি প্রতিক্রিয়ায় ‘great shock’ (ভয়াবহ আঘাত) হিসেবে অভিহিত করা হয়।

আদর্শিক পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল জিয়াকে ভারতের দুটি বিপরীতধর্মী সরকারের মুখোমুখি হতে হয়। কৌশলগত কারণে জিয়া দেশাইয়ের সঙ্গে এক রকম সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সফল হলেও, ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তার ক্ষমতা গ্রহণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। যে কারণে মিসেস গান্ধীর সময়কালে জিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল শীতল, কখনও কখনও অত্যন্ত বৈরী। সুতরাং বলা যায় উপর্যুক্ত তাত্ত্বিক কাঠামোর অধীনে দুদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের সামগ্রিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন সম্ভব হবে। ৭৮

 

তথ্যনির্দেশ

১. Shaukat Hassan, The India Factor in the Foreign Policy of Bangladesh’ in M. G. Kabir and Shaukat Hassan, edited, Issues and Challenges Facing Bangladesh Foreign Policy, Dhaka, 1989, p. 52.

২. Ishtiaq Hossain, “Bangladesh-India Relations: issues and problems”, in Emajuddin Ahmed, edited, Foreign Policy of Bangladesh, Dhaka 1984, p. 34.

৩. Harunur Rashid, International Relations and Bangladesh, Dhaka, 2004, p.219.

8. Dr. S.S. Bindra, Indo-Bangladesh Relations, New Delhi, 1982..

৫. ঐ, পৃ. ১৪।

৬. ঐ, পৃ. ২৩।

৭. । ঐ।

৮. ঐ, পৃ. ৪৫।

৯. ঐ, পৃ. ৪৭।

১০. Shaukat Hassan, “India-Bangladesh Political Relations During the Awami League Government 1972-75”, Ph.D. Thesis, Australian National University. April, 1987.

১১. ঐ, পৃ. ৫৯।

১২. ঐ, পৃ. ৬৪।

১৩. ঐ, পৃ. ৭১।

১৪. ঐ, পৃ. ৭৫।

১৫. ঐ, পৃ. ৭৭।

১৬. ঐ, পৃ. ৯৭।

১৭. মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশ বাঙালি মানস রাষ্ট্রগঠন ও আধুনিকতা, ঢাকা, ২০০৭ পৃ. ৪৮।

১৮. Shaukat Hassan, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৫।

১৯. Moudud Ahmad, Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman, Dhaka,1983.

২০. Shaukat Hassan, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭।

২১. ঐ, পৃ. ১৯৯।

২২. Iftekhar A. Chowdhury, “Bangladesh’s External Relations, Ph.D. Thesis. Department of International Relations”, Australian National University, May, 1980.

২৩. ঐ, পৃ. ৬১।

২৪. ঐ, পৃ. ৭৯।

২৫. Virendra Narain, Foreign Policy of Bangladesh (1971-1981), Jaipur, India, 1987.

২৬. ঐ, পৃ. ৩।

২৭. ঐ, পৃ. ৭৮।

২৮. Denis Wright, Bangladesh Origins and Indian Ocean Relations, 1971-1975, Dhaka, 1988.

২৯. ঐ, পৃ. ১৩৮।

৩০. ঐ, পৃ. ১৫৩।

৩১. Rekha Saha, India Bangladesh Relations, Calcutta, 2000.

৩২. এ. পৃ. ২০৫।

৩৩. Zaglul Haider, The Changing Pattern of Bangladesh Foreign Policy: A Comparative Study of the Mujib and Zia Regimes, Dhaka, 2006.

৩৪. ঐ, পৃ. ২৩০।

৩৫. আবুল কালাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ তত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ, ঢাকা ১৯৯৯, পৃ. ২৫।

৩৬. Norman J. Padelford, George A. Liencoln and Lee D. Olvey, The Dynamics of International Politics, New York, 1976, p. 35.

৩৭. H. K. Chhabra, Relations of Nations Foreign Policy of Major Countries, Delhi, 1983, p. 3.

৩৮. গবেষণা পদ্ধতির আলোচনায় বিভিন্ন গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। তবে বিশেষ করে মোঃ আব্দুল হালিম, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলনীতি, ঢাকা ১৯৮৪ এবং আবুল কালাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ তত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ, ঢাকা, ১৯৯৯ থেকে বিশেষ সহায়তা গ্রহণ করেছি।

৩৯. জয়া চ্যাটার্জী, বাঙলা ভাগ হল: হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ-বিভাগ ১৯৩২-১৯৪৭, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ১।

৪০. আজিজুর রহমান মাল্লিক ও সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাঙালী জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ভিত্তি’ দ্র. সিরাজুল ইসলাম, সম্পাদিত, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, ১ম খণ্ড, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ৫৪০

৪১. উদ্ধৃত, কামরুদ্দীন আহমদ, বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ. ২৫। এ ছাড়া আরো দেখা যেতে পারে মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্তকুমার রায়, প্রশাসনের অন্দর মহল। বাংলাদেশ, কলকাতা, ১৯৮৭। আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫, Jayanta Kumar Ray, Democracy and Nationalism on Trial: A Study of East Pakistan, Simla, 1968, মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্ত কুমার রায়, বাংলাদেশে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ঢাকা, ১৯৯৫।

৪২. আবুল কালাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০।

৪৩. The New Encyclopaedia Britanica, Vol. V, Chicago, 1981, p. 287.

৪৪. Jack C. Plans and Roy Olton, The International Relations Dictionary, New York, 1969, pp. 105-107.

৪৫. উদ্ধৃত, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ইসলামী বিশ্ব ও বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ১৩।

৪৬. F. S. Northedge, “The Nature of Foreign Policy” in FS. Northedge (ed.) The Foreign Policies of Powers, London, 1968, p. 13.

৪৭. বি রমন, র-এর কাওবয়েরা, স্মৃতির সিঁড়িতে অবরোহণ, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৩৭-৩৮।

৪৮. “In fact, ideologically, the Al leadership had never subscribed to the doctrine of social change through violence…. Always upholding the principle of liberal democracy and which (AL) would establish a new exploitationless society based on nationalist feelings,” Shyamali Ghosh.

The Awami League 1949-1971, Dhaka, 1990, pp. 166-171. Md. Abdul Wadud Bhuiyan, The Emergence of Bangladesh and Role of the Awami League, New Delhi, 1982.

৪৯. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৯৪,

৫০. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭।

৫১. Fred A. Sandermann, David S. McLellan, Willam C. Olson, edited, The Theory and Practice of International Relations, Fifth edition, USA, 1979, p. 85.

৫২. The New Encyclopaedia Britanica, Vol. V, Chicago, 1981, p. 287,

৫৩. James H. Billington, “Reflections on the nonmaterial aspects of National Interests.” in Professor Gifford, edited, The National Interests of the United States, University Press of America, 1981, pp. 180-183.

৫৪. Hans J. Morgenthau, Politics Among Nations: The Struggle for Power and Peace, Sixth edition, New York, 1985, p. 70.

৫৫. Hans J. Morgenthau, In Defence of the National Interests: A critical Examination of America Foreign Policy, (1st ed.), New York, 1951, p. 242.

৫৬. মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯২, পৃ. ২০।

৫৭. The Times of India, 5 July, 1971.

৫৮. Organiser, Vol. XXV, No. 2, 21 August, 1971.

৫৯. N. M. Chatale (ed.), Bangla Desh Crisis and Consequences, New Delhi, 1971, pp. 146-148.

৬০. ঐ, পৃ. ৪৪

৬১. Swarajya, Vol. XV, No. 40, April 3, 1971, p. 21.

৬২. Swarajya, Vol. XV, No. 42, April 17, 1971, p. 21.

৬৩. New Age, Vol. XIV, No. 18, May 2, 1971, p. 1.

৬৪. Janata, Vol. XXVI, No. 11 April 4, 1971, p. 2.

৬৫. Peoples Democracy, Vol. 7, No. 14 April 18, 1971, p. 3.

৬৬. A. M. Zaidi and S. G. Zaidi, The Encyclopaedia of the Indian National Congress, Vol. 21, 1970-1971, New Delhi, 1984, p. 363.

৬৭. হাসান হাফিজুর রহমান, সম্পাদিত, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র, সপ্তম খণ্ড, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ. ৩৪১।

৬৮. দৈনিক পাকিস্তান, ৮.৪.১৯৭১।

৬৯. ঐ।

৭০. ঐ।

৭১. ঐ।

৭২. কেন্দ্রীয় কমিটি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যায়ন, কলকাতা, ২১.৫.৭১।

৭৩. গণশক্তি, এপ্রিল, ১৯৭১।

৭৪. Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh Revolution Dhaka 2nd impression, 2003. pp. 142-143.

৭৫. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, প্রাগুক্ত, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ১৪।

৭৬. ঐ।

৭৭. Muntassir Mamoon (ed.), Media and the Liberation War of Bangladesh, haka, 2002, p. 19.

৭৮. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, মোঃ সেলিম, “বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: ১৯৭১-১৯৮১”, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৮ (অপ্রকাশিত অভিসন্দর্ভ)।

আরও পড়ুন: