Site icon Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

জলবায়ুর পরিবর্তন ও বাংলাদেশ রচনা

জলবায়ুর পরিবর্তন ও বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আর বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্র বৃদ্ধির কারণ হলো গ্রিন হাউস গ্যাস অভিঘাত (Green houss effect)। সাধারণত সূর্য থেকে ে তাপশক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠে আসে তার কিছু অংশ পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে এবং অধিকাংশ বিকিরিত পুনরার বায়ুনালে চলে যায়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস জমা হওয়ার ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপ বিকিরণ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এসব গ্যাস তাপ শোষণ করে। ফলে দেখা যায়, ক্রমাগত তৃপৃষ্ঠের উপরিভাগ উত্তপ্ত হচ্ছে।

জলবায়ুর পরিবর্তন ও বাংলাদেশ

 

গ্রিন হাউস অভিঘাতের জন্য দার গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন এবং নাইট্রোজেন ও সালফারের অক্সাইডসমূহ। এ সকল গ্যাসের উপস্থিতি বায়ুমণ্ডলে আগে লক্ষ্য করা গেলেও আধুনিককালে ব্যাপক জীবাশ্ম জ্বালানির দহন, বনাঞ্চল ধ্বংস এবং বিশেষ ধরনের কৃষিব্যবস্থা দিন হাউস অভিঘাতের মাত্রাকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

ফলে দেখা যাচ্ছে, ১৮৫০-১৯৬০-এ সময়কালের তুলনায় বর্তমান পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় পাঁচগুণ। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রতিনিয়ত দেখা দিচ্ছে নানা পরিবেশগত বিপর্যয়। ভারত, পাকিস্তানসহ নানা দেশে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেদারল্যা ব্রিটেনসহ অনেক সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশেরই তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাইক্লোন ও ঝড়ের কবলে পড়ে ইতিমধ্যে পৃথিবীর বহু উপকূলবর্তী দেশের লোকজন সর্বস্বান্ত হয়েছে।

 

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া:

জলবায়ু পরিবর্তন তথা বিশ্ব উষ্ণায়নের একটি সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি । সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায়—

প্রথমত, স্তূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের পানির উত্তাপ বৃদ্ধি পাবে এবং পানি সম্প্রসারিত হয়ে সমুদ্রের আয়তন ও পরিধিকে বাড়িয়ে তুলবে ।

দ্বিতীয়ত, উষ্ণায়নের ফলে পর্বতচূড়ায় জমে থাকা বরফ গলে সমুদ্রের পানির পরিমাণ বাড়াবে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে প্লাবিত এলাকার পরিমাণও বাড়বে।

তৃতীয়ত, উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গ্রিনল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকাসহ অন্যান্য ভূভাগের উপরিতলে জমা হয়ে বরফ গলে সমুদ্রে এসে মিশে যাবে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে।

সর্বোপরি, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিহের ভূপৃষ্ঠের অনেক পরিবর্তন দেখা দেবে।

Intergovernmental Panel of Climate Change (IPCC)-এর সমীক্ষায় বলা হয়, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে পরবর্তী প্রতি দশকে ৩.৫ থেকে ১৫ মিলিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি ২১০০ সাল নাগাদ তা ৩০ সেন্টিমিটার থেকে ১০০ সেন্টিমিটারে পৌঁছতে পারে।

 

 

জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য ভৌত অভিঘাতসমূহ

জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য অভিঘাতসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো প্লাবন, নদীপ্রবাহের ক্ষীণতা, পানিতে লবণাক্ততা, খরা, আকস্মিক বন্যা, সাইক্লোন, ঝড়, নদীভাঙন প্রভৃতি ।

 

ক. প্লাবন

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্লাবনজনিত ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের মোট ভূমির ১৭ শতাংশ তলিয়ে যাবে এবং এতে জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ ক্ষতিক্রান্ত হবে।

জলবায়ু পরিবর্তিত হলে দেশে বৃষ্টিপাত বাড়বে। এতে বর্ষাকালে নদ-নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেখা দেবে বন্যা। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে, ব্যাক ওয়াটার ইফের যুক্ত হলে, নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা ব্যাপক আকার ধারণ করবে। সাধারণত উঁচু ভূমি বলে পরিচিত ভূমি তলিয়ে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকার পরিসরও বাড়বে।

 

খ. নদ-নদীর ক্ষীণপ্রবাহ

আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশে জমিতে সেচ ও নৌ চলাচলের জন্য নন- নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। এতে প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ হ্রাস পাবে এবং নদীর ক্ষীণ প্রবাহ হেতু সামুদ্রিক লোনা পানি সহজে দেশের অভ্যন্তরীণ নদীপ্রবাহে প্রবেশ করে নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে। তখন সামুদ্রিক লোনা পানি উজান অঞ্চলে প্রবেশ করায় কৃষিতে সেচের প্রয়োজনীয় মৃদু পানির অভাব দেখা দেবে এবং দেশের মৎস্যসম্পদেরও বিপুল ক্ষতি হবে।

 

গ. পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি

পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি দেশের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও দূরবর্তী দ্বীপসমূহের প্রায় ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় লোনা পানি প্রবেশ করায় উন্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে।

বিশেষত নদ-নদীর মোহনায় অবস্থিত দ্বীপ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অধিক পরিমাণ লোনা পানি প্রবেশ করবে। ভূগর্ভস্থ পানি ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি উপকূলীয় পরিবেশকে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। লোনা পানির অনুপ্রবেশ দু ভাবে ঘটতে পারে—

প্রথমত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নদনদীতে অধিক হারে লোনা পানি ঢুকতে পারে:

দ্বিতীয়ত, নদ-নদীর ক্ষীণ প্রবাহের ফলেও সামুদ্রিক লোনা পানি উজান অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে।

এ দুটি প্রক্রিয়ার সম্মিলিত অভিঘাতে উপকূলীয় জীবনযাত্রা ব্যাপক ক্ষতির কবলে পড়বে।

 

ঘ. আকস্মিক বন্যা

পাহাড়ি বৃষ্টিপাতের কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, বিশেষত মেঘনা অববাহিকায় প্রতি বছরই আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা এ ধরনের আকস্মিক বন্যার শিকার। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। ফলে আকস্মিক বন্যার পৌনঃপুনিকতা, ক্ষতির পরিমাণ ও তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পাবে।

 

 

ঙ. খরা

কোনো এলাকার মাটিতে আর্দ্রতার অভাব তথা বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবনের মাত্রা বেশি। হলে খরা দেখা দেয়। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষাকালে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত ও পানির অভাবে রোপা আমন আবাদে অসুবিধা হয় এবং ধানের ফলনও কমে যায়। আবার শীতকালে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের তুলনায় অধিক হারে বাষ্পীভবনের ফলে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায় এবং কৃষিকাজের ব্যাপক ক্ষতি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরার প্রকোপ আরো বৃদ্ধি পায়। বর্তমানের মাঝারি ধরনের খরা উপদ্রুত এলাকা মারাত্মক খরা উপদ্রুত এলাকায় পরিণত হবে ।

 

চ. সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস

সাধারণত সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হয় উত্তপ্ত বায়ু ও ঘূর্ণিবায়ু থেকে । ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির একটি জটিল প্রক্রিয়া থাকলেও পানির উত্তাপ বৃদ্ধিই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে ঐতি বছর মে-জুন মাসে যে সামুদ্রিক ঝড় হয় তাতে উপকূলীয় জেলাসমূহ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বাড়লে পানির উত্তাপও বৃদ্ধি পাবে। তাতে স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে ঘূর্ণিঝড়ের পৌনঃপুনিকতা ও প্রচণ্ডতা।

 

ছ. নদীতীরে ও মোহনায় ভাঙন ও ভূমি গঠন

বাংলাদেশে মোট ৬৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র তটরেখা রয়েছে ৷ এর মধ্যে সুন্দরবন উপকূল ঘিরে রয়েছে ১২৫ কিলোমিটার, আর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ৮৫ কিলোমিটার। এছাড়াও সমুদ্র উপকূল বরাবর রয়েছে গঙ্গা ও মেঘনা অবাহিকায় অবস্থিত অসংখ্য প্রশস্ত জোয়ার-ভাটা সমভূমি (Tidal plain) এবং অসংখ্য নদী মোহনার বদ্বীপ। নদীসঙ্গমে অবস্থিত এ সকল বদ্বীপ ও সমুদ্র তটরেখা বরাবর ভূখণ্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। নিয়ত পরিবর্তনের এ খেলার মাঝেও এক ধরনের ভারসাম্য অবস্থা বিরাজমান। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিরাজমান এ ভারসাম্য অবস্থা আর টিকে থাকবে না।

IPCC-র সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে, প্রতি দুই সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে উপকূলীয় তটরেখ গড়ে ২-৩ মিটার স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হলে ২০৩০ সাল নাগাদ মূল ভূখণ্ডের ৮০-১২০ মিটার পর্যন্ত অতিক্রম করবে এবং কালক্রমে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

 

জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা

জলবায়ুর পরিবর্তন এবং এর অভিঘাতে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বিশেষত সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলোর আতঙ্কের শেষ নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিপন্নতার মাত্রা খুবই বেশি । বিশাল জনগোষ্ঠী, তিলে তিলে গড়ে তোলা ভৌত অবকাঠামো আর অর্থনীতির প্রাণশক্তি কৃষি – এ তিনটি ক্ষেত্রের বিপন্নতা দেশের সার্বিক ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।

 

 

 

ক. জনগোষ্ঠী ও প্লাবন

বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনো মাঝারি প্লাবনে দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ ভাগ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে বাড়বে প্লাবনের পৌনঃপুনিকতা ও তীব্রতা এবং প্লাবন এলাকার পরিধি বৃদ্ধি পাবে। সাথে সাথে বাড়বে বিপন্ন মানুষের সংখ্যা। ভারতের সাথে যে ৫৪টি নদীর পানিপ্রবাহের বিষয়ে সহযোগিতা আবশ্যক তাতে ব্যত্যয় ঘটলে এ বিপন্নতার মাত্রা আরো ব্যাপক হবে সন্দেহ নেই।

 

খ. প্লাবন ও ভৌত অবকাঠামো

১৯৯০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট বস্তুগত সম্পদের পরিমাণ হবে ১৮০০০ মিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ভৌত অবকাঠামো (Physical infrastructure) রয়েছে ২৮৪ বিলিয়ন টাকা মূল্যের। বিদ্যমান অবকাঠামোর ৭০ শতাংশই অস্থানান্তরযোগ্য বাড়িঘর। জলবায়ুর পরিবর্তন ও ভূপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিজনিত কারণে প্লাবনের তীব্রতা বাড়লে এ সকল অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। IPCC-র সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১০ সালে নাগাদ বাংলাদেশে প্লাবনজনিত কারণে বস্তুগত সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ হবে ২৪২ বিলিয়ন টাকা।

 

গ. প্লাবন ও কৃষি

জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। কৃষিখাতের এ বিপর্যয় দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে । IPCC-র সমীক্ষানুযায়ী, গতানুগতিক উন্নয়নধারা অব্যাহত থাকলে আগামী শতাব্দীতে প্লাবনের কারণে দেশে আমন ধানের উৎপাদন ১৩.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন হ্রাস পাবে। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দেশের কৃষি উৎপাদন বর্তমানের তুলনায় ৭০ শতাংশ কমে যাবে। ফলে দেশে ব্যাপক দারিদ্র্য, শহরে ব্যাপক অভিগমনসহ নানা প্রকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হবে।

 

ঘ. খরায় জনগোষ্ঠী ও কৃষির ক্ষয়ক্ষতি

বাংলাদেশে বর্তমানে শীত মৌসুমে প্রায় ৩৬০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা খরার কবলে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরার ব্যাপ্তি আরো বাড়বে এবং খরাকবলিত এলাকা ভবিষ্যতে ২২০০০ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। তাছাড়া আমন মৌসুমে খরার প্রকোপ বাড়লে মাঝারি ধরনের খরাকবলিত এলাকা চরম খরাকবলিত এলাকায় পরিণত হবে।

তখন খরাকবলিত এলাকা বর্তমানের তুলনায় চার গুণ বেড়ে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট ৭ কোটি ৩০ লাখ লোক খরাকবলিত এলাকায় বসবাস করে, যারা মোট জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে খরার প্রকোপ ও ক্ষয়ক্ষতি থেকেও আমাদের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য পরিণতি অনুমের গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমের ফসলের ওপর খরার প্রতিকূল প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জলবায়ুর পরিবর্তন হলে দেশের মধ্য-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গমের আবাদ অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং আলুর চাষও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে উত্তর-পশ্চিম ও মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের চাষাবাদ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে ।

 

ঙ. আকস্মিক বন্যা ও জনগোষ্ঠী

PCC-র সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে দেশে অতিবৃষ্টি দেখা দেবে এবং এতে নদীপ্রবাহের পরিবর্তন হয়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মধ্য অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলের কারণে ঘন ঘন আকস্মিক বন্যা দেখা দেবে। এ অঞ্চলে বর্তমানে ১ কোটি ২০ লাখ লোকের বসবাস। আকস্মিক বন্যায় এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি নদীভাঙন ও বাস্তুচ্যুতির প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে।

১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে দেশের প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে এবং ১২ লক্ষ লোক ভিটেমাটি হারিয়ে গৃহহীন হয়েছে ৷ জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নদীভাঙনের প্রকৃতি ও পরিধি বাড়বে, যা মানব দারিদ্র্য ও বাস্তুচ্যুতির হারও বাড়িয়ে দেবে।

 

চ. জলবায়ুর পরিবর্তন ও পরিবেশীয় রীতি

জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দেশের পরিবেশীয় রীতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। এমনিতেই দেশে জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ অপ্রতুল। জলবায়ুর পরিবর্তন হলে সম্পদের অপ্রাপ্যতা আরো বেড়ে যাবে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য দ্রুত বিনষ্ট হবে। ইতিমধ্যেই দেশের বৃহৎ বনভূমি সুন্দরবন ও হাওর অঞ্চলের পরিবেশীয় রীতি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

 

ছ. লোনা পানির অনুপ্রবেশ এবং জনগোষ্ঠী ও কৃষির বিপন্নতা

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ বসবাস করে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে IPCC-র সমীক্ষানুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ সেমি বৃদ্ধি পেলে ২৫০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটবে। ফলে দেশের প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ লোকের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপসংহার

সুতরাং জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি একটি আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র দেশের জন্য এর প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা ও সামর্থ্য খুবই সীমিত । এ সীমাবদ্ধ সামর্থ্যের কথা মাথায় রেখেই কৌশলগতভাবে অগ্রসর হতে হবে, যাতে দীর্ঘকালীন প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করা যায়।

সেজন্য বাংলাদেশের জন্য যেটি অত্যাবশ্যক সেটি হলো দেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ গবেষক দল গঠন, যারা সার্বক্ষণিকভাবে বিষয়টির প্রতি নজর রাখবে। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়ও সরকারকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে।

আপৎকালীন সময়ে জনগণকে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া উপকূলীয় এলাকায়। বাঁধ নির্মাণ ও সবুজ বেষ্টনী নির্মাণসহ অন্যান্য কর্মসূচিকে আরো ব্যাপক ও গতিশীল করতে হবে।

 

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version