বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক, কৃষি উন্নয়ন, কৃষিপ্রযুক্তি নিয়ে আজ একটি প্রবন্ধ রচনা করবো। রচনা-সংকেত: ভূমিকা— বাংলার কৃষক ও কৃষকের জীবন— কৃষকের অতীত অবস্থা কৃষকদের কিছু দিন জাগের (উনিশ-বিশ শতক) অবস্থা বর্তমানে (একুশ শতকের প্রথম দশকে। কৃষি ও কৃষকদের দৃশ্যপট কৃষকদের দুরবস্থা ও কৃষি সঙ্কট কৃষক ও কৃষির উন্নতির উপায় — কৃষি উন্নয়নে একবিংশ শতাব্দীর চিন্তা— কৃষির গুরুত্ব— কৃষক ও কৃষির উন্নতির উপায়—সরকারি উদ্যোগ ও গৃহীত পদক্ষেপ— কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ – উপসংহার।
Table of Contents
বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক, কৃষি উন্নয়ন ও কৃষিপ্রযুক্তি রচনা
ভূমিকা :
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিই জাতির মেরুদণ্ড। জনসংখ্যার বিরাট ভারে মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা ও সতেজ করে তুলতে পারে একমাত্র কৃষিকাজ। বিশাল জনগণের নিরন্নমুখে অন্ন জোগাতে হলে চাই কৃষির ব্যাপক সম্প্রসারণ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশের মাঠে-প্রান্তরে যে কৃষিদ্রব্য উৎপন্ন হয়, তার সঙ্গে সমগ্র দেশবাসীর ভাগ্য জড়িত। কারণ বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৮০ জন কৃষিজীবী। এদেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সম্পূর্ণ কৃষির ওপর নির্ভরশীল বলে কৃষকের অবস্থার উন্নতি ঘটলে তা উৎপাদনে প্রতিফলিত হবে। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তিটি স্মরণযোগ্য- ‘দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয় জন? আর এই কৃষিজীবী কয় জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশের কয় জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী। সুতরাং জাতীয়জীবনে কৃষক সমাজের গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলার কৃষক ও কৃষকের জীবন:
‘গাহি তাহাদের গান-/ ধরণীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান।
শ্রম- কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
এতা ধরণী নজরানা দেয় ডানি ভরে ফুলে ফলে।’
– কাজী নজরুল ইসলাম।
যেসব শ্রমনিষ্ঠ মেহনতি মানুষের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে এ দেশ অনুপম সুন্দর, পুষ্পময় ও মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শক্ত হাতে লাঙল ধরে, কৃপণাধরণীর কঠিন মাটি চিরে নতুন ফসলের অযুত সম্ভাবনায় এ দেশকে সমৃদ্ধ করেছে তারা হল এ দেশের কৃষকসম্প্রদায় তথা বাংলার কৃষক। তারা আপন সুখ-শান্তি ও স্বাচ্ছন্দো নির্মোহভাবে বিসর্জন দিয়ে দেশ ও জাতির অগ্রগতির স্বার্থে প্রতিদানহীন, নীরব নিঃস্বার্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ। অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজের দেহের রক্তকে পানি করে জাতীয় অর্থনীতিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে, এবং সেই অতীতের মতো আজও বাংলাদেশ মানে কৃষকের দেশ। কৃষকের উৎপাদিত কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। বৈদেশিক মুদ্রায়, সম্ভব হয় শিল্পায়ন। কর্মসংস্থানের শতকরা ৬০ ভাগ আসে কৃষিখাত থেকে। তাই দেশের অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, অপরিহার্য।
কৃষকদের অতীত (প্রাচীন যুগে) অবস্থা :
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে পূর্ব-বাংলার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা থেকে আমরা জানতে পারি, অতীতে কৃষকদের অবস্থা কত সচ্ছল ছিল। তখন গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ- প্রবাদের মতো যে ঐশ্বর্যের ইঙ্গিত দেয় তা ছিল যথার্থ বাস্তব। তখন জনসংখ্যা ছিল কম, জমি ছিল পরিমাণে অনেক বেশি, ফলে কৃষকদের জীবনে সম্পদের প্রাচুর্যও ছিল অনেক বেশি। তারা তখন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করতো। উনিশ থেকে বিশ শতকে কৃষকদের অবস্থা : কৃষক জীবনে সে গৌরবের দিন আর নেই।
ইংরেজদের আগমনেদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে যে ঘুণ ধরেছিল তা থেকে পরবর্তীকালে কৃষকসমাজ মুক্তি লাভ করতে পারে নি। দেশের অন্ন সংস্থানের মহান ব্রতে নিয়োজিত এই কৃষক নানা রোগশোকে জর্জরিত, দুঃখে-কষ্টে ও পরিশ্রমে অনেক কৃষকই কঙ্কালসার। যান্ত্রিক সভ্যতার এ চরম উৎকর্ষের যুগেও কৃষক পড়ে রয়েছে পুরাতন চাষাবাদ পদ্ধতির বার্থ প্রচেষ্টার মাঝে।
জমির উৎপাদিকা শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। লোকসংখ্যার অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে জমি খন্ড খন্ড হয়ে অসংখ্য সংখ্যায় ভেঙে গেছে সেচ ব্যবস্থা, কীটনাশক, উন্নত বীজ, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি এবং কৃষকের সচেতনতা-এ সবের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অজ্ঞতার অন্ধকার। যুগ যুগ ধরে নির্মমভাবে শোষিত, বঞ্চিত কৃষক সম্প্রদায় আজ অধঃপতনের অতলে তলিয়ে গেছে। তাই কালবিলম্ব না করে একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে দেশ ও জনগণের প্রত্যাশার আলোকে কৃষি-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে—
‘বহুদিন উপবাসী নিঃস্ব জনপদে / মাঠে মাঠে আমাদের ছড়ানো সম্প
কাস্তে দাও আমার এ হাতে।”
– সুকান্ত ভট্টাচার্য।
বর্তমানে (একুশ শতকের প্রথম দশকে) কৃষি ও কৃষকদের দৃশ্যপট:
সময়ের পরিবর্তন এসেছে। সেই সে কৃষিতেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। আমাদের কৃষি এখন জীবননির্বাহী স্তরের চাষাবাদের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যান্ত্রিক উপায়ে ধান মাড়াই হচ্ছে। কোথাও কোথাও ড্রামসিডার দিয়ে বীজ বপন করা হচ্ছে। অনেক কৃষকই এখন মাখাতার আমলের লাঙল-জোয়াল, গরু ছেড়ে ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদ করছে। আবাদি জমির সিংহ ভাগই সেচের আওতায় চলে এসেছে।
এখন কিছু কিছু জায়গায় হাইব্রিড বীজ চাষ করা হচ্ছে এমনকী উচ্চ ফলনশীল বীজও উদ্ভাবন করছে কৃষকই। হরিপদ কাপালি আবিষ্কার করেছে উচ্চফলনশীল হরি ধান! তবে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি জমির পরিমাণ কমার কারণে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না। তাছাড়া সময়মতো সার না পাওয়া, বিদ্যুৎ বিপর্যয় ও লোডশেডিংয়ের কারণে অসুবিধা, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয় ইত্যাদি কারণে সংকট যেন দিন দিন ঘনিভূত হচ্ছে। তাই কৃষকদের দুঃখ-দারিদ্র্য থেকেই যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কথা স্মরণযোগ্য … চাষির অভাব অনেক বাড়িয়া গেছে। … জমিও পড়িয়া রহিল না, ফসলের দরও বাড়িয়া চলিল, অথচ সবৎসর দুই বেলা পেট ভরিবার মতো খাবার জোটে না, আর চাষি ঋণে ডুবিয়া থাকে, ইহার কারণ কি ভাবিয়া দেখিতে হইবে।

কৃষির গুরুত্ব :
মাটি; পানি এবং মানবসম্পদ- এ তিনটিই হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ তিন সম্পদের সর্বোত্তম সমন্বিত ব্যবহারের ওপরেই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি। আমাদের জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একমাত্র সোপান হচ্ছে কৃষি। কৃষির গুরুত্বের সঙ্গে জড়িত এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় –
১। খাদ্য উৎপাদনে কৃষি ও কৃষক :
বাংলাদেশের মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪.৪ মিলিয়ন হেক্টর যার প্রায় ১৩.৩ শতাংশ জুড়ে রয়েছে বনভূমি, ২০.১ শতাংশে রয়েছে স্থায়ী জলাধার, ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি এবং অবশিষ্ট ৬৬.৬ শতাংশ জমি কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। এর ৯০ শতাংশ জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ খাদ্যশস্য কৃষি ও কৃষক জোগান দিয়ে থাকে।
২। পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কৃষকের ভূমিকা :
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ অপুষ্টির শিকার। আমাদের কৃষকরা মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, শাকসবজি জোগান দিয়ে দেশের মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর করতে অবিরাম কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
৩। শিল্পায়নে কৃষি ও কৃষকের অবদান:
বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প, চিনিশিল্প, কাগজ শিল্পের প্রধান উপকরণ আসে কৃষি থেকে। এরকম আরও ছোট-বড় অনেক শিল্প রয়েছে যার কাঁচামাল আমরা কৃষি থেকে পেয়ে থাকি।
৪। রপ্তানি আয়ে কৃষি ও কৃষির ভূমিকা :
চা, পাট, বস সহ যেসব উপকরণ আমরা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি তা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষি থেকে আসে।
৫। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষির ভূমিকা :
এমন অনেক কর্মসংস্থান রয়েছে যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষি ও কৃষকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন- কৃষক যখন কৃষি কাজ করে তখন বিভিন্ন পর্যায়ে তাকে শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। পাশাপাশি কৃষি থেকে উৎপন্ন কাঁচামাল দিয়ে প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানায় নতুন নতুন কর্মের সংস্থান হচ্ছে।
কৃষকদের দুরবস্থা ও কৃষি সঙ্কট :
বর্তমানে নানা কারণে কৃষকের দুরবস্থা দিনকে দিন আরও তীব্র হচ্ছে। অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। জিডিপির ২২ শতাংশই কৃষিখাত থেকে অর্জিত হলেও শতকরা পঁচাশি ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু খাদ্যের জোগানদাতা কৃষক নিজেই অভুক্ত থাকছে। অবহেলা আর অব্যবস্থাপনায় কৃষি ও কৃষক আজ দারিদ্র্যে নিপতিত।
এখন অনেক, খুদে কৃষকই সংসারে দুবেলা খাবার জোটাতে পারছে না। বাধ্য হয়ে অনেকে দিন মজুরে পরিণত হচ্ছে। অনেক কৃষকই ক্রমাগত হয়ে পড়ছে প্রান্তজন। চলমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের করছে নিঃস্ব ও অসহায়। কিন্তু অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহের চাবিকাঠিকে অবহেলা করে উন্নয়নের চাকা বেশি দূর চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
বারে বারে সার, ডিজেল, বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে কৃষকের হাতে লাভের টাকা কখনো জমছে না। জাতীয় বাজেটে কৃষিখাতে সাধারণত যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা একদিকে যেমন অপর্যাপ্ত অন্যদিকে সুষ্ঠু ব্যাবস্থাপনার অভাবে কৃষি আজ সঙ্কটের মুখোমুখি। ভর্তুকির সুফল কৃষকের গোলা অব্দি শেষমেশ পৌঁছায় না। আবার যে খরচ দিয়ে কৃষক কৃষি পণ্য উৎপাদন করছে তা পণ্য বিক্রি করে উঠিয়ে আনতে পারছে না।
অন্যদিকে কৃষক তাদের পণ্য উৎপাদন করেই কম দামে মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। কৃষিঋণ পাওয়ার যোগ্যতা নেই ভূমিহীন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের। মহাজনের কাছ থেকে নেয়া ঋণের টাকা শোধ করতে তাকে নিঃস্ব হতে হয়। গ্রামেগঞ্জে তার পণ্য মজুদ রাখার মতো গোডাউন নেই। মধ্যস্বত্বভোগীদের কয়েক হাত ঘুরে যখন পণ্যটি শহরে আসে তখন তার নাম হয় আকাশ ছোঁয়া।
প্রকৃত উৎপাদক ও ভোক্তা কেউই কৃষি উৎপাদনের ফায়দা পায় না। মাঝখানের ফড়িয়া, দালালদের হাতেই পুরো সাতটা চলে যায়। গত আধা–দশক ধরেই আমাদের নীতি নির্ধারকরা কৃষি খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু গোটা দেশ যখন খাদ্য সঙ্কটে নিমজ্জিত তখন কৃষির দিকে নজর দেবার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
কৃষক, কৃষি ও কৃষির উন্নতির উপায় :
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আজ পুনরুজ্জীবিত করতে হলে, সর্বাগ্রেই চাই কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব। আর এ জন্যে প্রথমেই কৃষিকাদের মহানায়ক কৃষকের জীবন এবং তার দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে হবে। কৃষক বাঁচলে কৃষি বাঁচবে এবং কৃষি বাঁচলে আমাদের দেশ বাঁচবে। সমস্ত উন্নত দেশেই আজ কৃষি কাজের পদ্ধতি, উপকরণ ও তার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। যান্ত্রিক প্রযুক্তির প্রয়োগ কৃষিকে অকল্পনীয়ভাবে উৎপাদনমুখী করে তুলেছে। কাজেই দেশের উন্নয়নে এবং কৃষকের ভাগ্যের উন্নয়নে আমাদের অপরিহার্যভাবেই কৃষিক্ষেত্রে যন্ত্রপ্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে হবে। কাঠের লাঙলকে বিদায় জানাতে হবে। তার হাতে বিজ্ঞানের হাতিয়ার তুলে দিতে হবে। সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতকগুলো পদক্ষেপ হল——
(১) কৃষকসম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার মাধ্যমেই কৃষক তার শতাব্দীদীর্ঘ অস্থবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মীয় পশ্চাৎপদতা ঘুচিয়ে একজন বিজ্ঞানমনস্ক সুস্থ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
(২) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের কৃষকগণ অশিক্ষিত হওয়ায় আধুনিক কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত নয়। তাই কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষি কর্মকর্তাদের সক্রিয় সহযোগিতায় কৃষক সম্প্রদায়কে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।
(৩) কৃষকের উন্নতির জন্যে সুষ্ঠু সরকারি নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। বন্যার পানি যেন ফসলের ক্ষেতি করতে না পারে সে জন্যে নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ কিংবা নদী খননের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৪) কৃষিকাজের আধুনিকায়নের জন্যে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য।
(৫) গ্রামীণ জীবনে চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা দিয়ে গ্রামের প্রতি শিক্ষিত লোকের আকর্ষণ বৃদ্ধি করার মাধ্যমেও কৃষিজীবনের উন্নতি করা সম্ভব।
(৬) কৃষিখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ভর্তুকি বাড়িয়ে দিগুণ করতে হবে। এর সঙ্গে এ সুযোগগুলো কৃষক যাতে সরাসরি প্রায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
(৭) কম দামে উচ্চ ফলনশীল বীজ, নির্ভেজাল সার, কীটনাশক, আবাদি জমিগুলোকে বিদ্যুতের আওতায় এনে লোডশেডিং বিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে।
(৮) কৃষি গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গত পাঁচ-ছয় বছরে উচ্চ ফলনশীল ধানের নতুন জাত খুব একটা আসে নি। এজন্য গবেষণার মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল বীজ আবিষ্কার করতে হবে।
(৯) ভালো বীজ সরবরাহের ব্যবস্থা এবং বীজ বিতরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।
(১০) প্রতিটি গ্রামে যাতে কৃষকরা সহজে ও কম দামে বীজ পেতে পারে সেজন্য বাজেটে ভর্তুকি দিতে হবে।
(১১) কম মূল্যে জ্বালানি তেল ও কৃষির অন্যান্য সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে।
টেকসই কৃষিউন্নয়নের জন্য কৃষিপ্রযুক্তি ও অন্যান্য করণীয় বিষয় :
আমাদের কৃষিতে রয়েছে নানামুখী জলবায়ুর পরিবর্তন, বিশ্বায়ন, সীরাবদ্ধতা। ফলে জনসংখ্যার সমানুপাতে খাদ্যনিরাপত্তা গড়ে ওঠেনি। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের আগামীর কৃষি ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত করার জন্য কৃষিপ্রযুক্তির প্রয়োগ যেমন, অপরিহার্য, তেমনি টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য নিচের পদক্ষেপ গুলো নেয়া যেতে পারে:
(১) যত প্রদীপ ততো আলো। তাই প্রয়োজন কৃষিতে শিক্ষিতদের বেশি বেশি অংশগ্রহণ ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামার যেন গড়ে উঠতে পারে তার জন্য সহজ প্রশিক্ষণব্যবস্থার আয়োজন করা।
(২) কৃষি অফিস উপজেলা থেকে সম্প্রসারণ করতে হবে। কৃষি মাঠপ্রযুক্তির বিষয় বিধায় মৃত্তিকার ধরন, সুযোগ-সুবিধা ও জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রতি উপজেলাকে বেশ কয়েকটি অঞ্চল (region) ও উপঅঞ্চলে (sub-region) ভাগ করতে হবে। দুর্বল উৎপাদনশীল এলাকাগুলো উপঅঞ্চলে হবে। কয়েকটি ইউনিয়ন নিয়ে এক একটি অঞ্চল গঠন করতে হবে এবং প্রতিটি অঞ্চলই হবে পূর্ণ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও জনবলের একটি উৎপাদন ক্ষেত্র। উপঅঞ্চলগুলোর ধাপে ধাপে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। প্রতিটি অঞ্চলে গরু-ছাগল ও পোল্ট্রির সরকারি খামার গড়ে তুলতে হবে। যা খাদ্যের মৎস্যনিরাপত্তার অংশ বাড়াবে এবং জৈব কৃষিকে এগিয়ে নেবে। উৎপাদনকে পরিবেশনির্ভর ও টেকসই করবে।
(৩) Arial survey ভিত্তিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় কৃষি ফসল উৎপাদনে শস্যক্রম ও শসা আবর্তন এবং ফলদ বৃক্ষ রোপণ এলাকা নির্ধারণ করে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
(৪) কয়েকবছর মেয়াদি বিশেষ ‘কৃষি সারচার্য’ চালু করতে হবে। যা কৃষিতে বিভিন্ন সস্থায়ী উন্নয়নমুখি কার্যক্রমে ব্যয় করতে হবে।
(৫) আবাদী জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অউৎপাদনশীল জমিকে বেশ কয়েক ফসল সরকারি সাহায্যে চাষ ও সেচ সহায়তা দিয়ে উৎপাদনশীল জমিতে পরিণত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
(৬) কৃষি ও কৃষকের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলক কাজ করতে হবে।
(৭) কৃষিতে সর্বোচ্চ কৃষি প্রযুক্তি যেমন জলবায়ুর পরিবর্তন সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন জাত উদ্ভাবন করা। এছাড়া আন্তঃফসল চাষাবাদ, মিশ্র ফসল চাষাবাদ, ‘রিলে’ ও ‘রেটুন’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ, ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি, বাড়ির আঙিনায় পাহাড়ি এলাকায় লবণাক্ত এলাকায় চর এলাকায় চাষাবাদ, উফশীজাতের চাষ, শস্য বহুমুখীকরণ এবং ভাসমান পদ্ধতি চাষাবাদ ইত্যাদি প্রধান।
কৃষি উন্নয়নে একবিংশ শতাব্দীর চিন্তা :
কৃষির উন্নতি আটকে গেছে মূলত কৃষি জমির উর্বরতা ক্ষয়ে যাবার কারণে। পরিবেশ সম্মত উপায়ে জমির গুণাগুণ হিসেব না করেই আমরা কৃষি উৎপাদনে ব্যস্ত। জমির স্বাস্থ্য সমস্যা আছে।বছরের পর বছর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে তার বারোটা বাজিয়ে ফেলা হচ্ছে। তাই জমির গুণাগুণ পরীক্ষা করা, উপযুক্ত ডোজে সার দেয়া, জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করার মতো বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া খুবই জুরুরি। এজন্য কৃষি উন্নয়নে চলছে আধুনিক চিন্তা-ভাবনা:
(১) কৃষি ক্ষেত্রে নিবিড় চাষ এবং একর প্রতি ফলন বাড়ানোর তাগিদে অধিকহারে কৃত্রিম উপকরণ ব্যবহার করে মাটিতে সমতা আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
(২) এ দেশ কৃষি প্রধান ও কৃষি দেশের বৃহৎ শিল্প। মাটি। এ শিল্পের প্রধান উপ তাই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, তার উপাদানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ ইত্যাদি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। এ ব্যাপারে অধিক মনোযোগী হতে হবে।
(৩) সারা দেশে অঞ্চল ভিত্তিক মাটির অবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা বিবেচনায় রেখে ধানসহ সকল ফসলের জাত নির্বাচন করতে হবে।
(৪) অঞ্চলভিত্তিক সারাদেশে মাটির গুণগতমান পরীক্ষা করে জৈব ও অজৈব সারের ব্যবহার করতে হবে।
(৫) বিভিন্ন ধরনের কালচারেল প্র্যাকটিস যেমন বাস্থ্যবান বীজ সরবরাহ, উপযুক্ত পদ্ধতি, সময়মত পানি সরবরাহ, আগাছা দমনের কৌশল ইত্যাদি সার্বিক প্রক্রিয়ার দিকে নজর রাখতে হবে। সুষম শসা উৎপাদন এবং জনগণের পুষ্টি মানের উন্নয়নের জন্য অপ্রধান শস্যসমূহের লাভজনক উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
(৬) কৃষি ও অকৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেসরকারি সংস্থা ও নারীর অংশগ্রহণসহ কৃষি পণ্যের ব্যবসায়, প্রযুক্তি গ্রহণ ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে হবে।
কৃষিতে সরকারি উদ্যোগ ও গৃহীত পদক্ষেপ :
গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ব্যতীত দেশের উন্নতি সম্ভব নয়, তাই সরকারি পর্যায়ে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ ও পরিকল্পনা। সরকারি পর্যায়ে কৃষিক্ষণ দান, বয়স্ক শিক্ষা, অধিক খাদ্য ক কর্মসূচি’, ‘নিরক্ষরতা দূরীকরণ’ প্রভৃতি উদ্যোগ যথেষ্ট প্রশংসার দাবিদার। সরকার নতুনভাবে ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। চাষিদের হাতে জমির মালিকানা ফিরিয়ে দিয়ে চাষের জমিতে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার কাজ চলছে। চলছে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষের উপযোগিতার গুরুত্ব কৃষকদের সামনে তুলে ধরার কাজ।
সরকার কৃষকদের পাঁচ হাজার টাকার কৃষিঋণ এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিয়েছে। সরকারি উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় সার কীটনাশক ঔষধ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির সরবরাহ কৃষকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। উত্তম সেচ-ব্যবস্থা ও বন্যা-নিরোধ প্রকল্পের কর্মসূচি গ্রহণ কৃষকদের জীবনকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্যে এখনো অনেক কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে। চীন, জাপান, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের দৃষ্টান্তকে সামনে রাখলে আমরা এ ব্যাপারে উপকৃত হতে পারি। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য
“যাদের আমরা বলি চাষাভূষা, পুঁথির পাতার পর্দা ভেদ করে তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি পৌঁছায় না, তাদের উপস্থিতি আমাদের কাছে অস্পষ্ট। এই জন্যই ওরা আমাদের সকল প্রচেষ্টা থেকে স্বভাবতই বাদ পড়ে যায়।“
উপসংহার :
কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির মেরুদণ্ড বাংলাদেশের প্রাণস্বরূপ। সেই প্রাণ ছিল এতকাল অনাদৃত। ছিল উপেক্ষিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এদের ওপর চলেছে নির্বিচার অত্যাচার। মনুষ্যত্ব হয়েছে। নিগৃহীতা। সেই লাঞ্ছনার দিন আজ আর নেই। ওই শোনা যায়, নব প্রভাতের মঙ্গল শঙ্খধ্বনি। দিকে দিকে শুরু হয়েছে জাগরণের জোয়ার— ‘এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, । আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান পৌষপার্বণে প্রাণ-কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শশ্মশান। ” – সুকান্ত ভট্টাচার্য।
আরও দেখুন: