বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]

বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ] : কোন একটি ভৌগোলিক এলাকায় দীর্ঘকাল বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সুদীর্ঘকাল ধরে আচরিত জীবনাচার, অভ্যাস, বিশ্বাস, সংস্কার ও জীবনবোধের ঘনীভূত বা জমাটবদ্ধ রূপই কালে ধর্ম নামে চিহ্নিত হয়। ধর্মের অস্তিত্ব নেই বা ছিল না, এমন কোন মানবসমাজের কথা জানা যায় না। ধর্ম মানুষের সমাজজীবনে, রাজনৈতিক জীবনে, অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বস্তুত সকল সমাজের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বস্তুত সকল সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ধর্ম এবং এটা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সর্বোতভাবে ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]

বাংলাদেশে ধর্মবিশ্বাস

উইকিপিডিয়া প্রদত্ত তথ্য ও ইউনেস্কো জরিপসূত্রে বলা যায় বর্তমান বিশ্বে ৪২০০টি ধর্মমত প্রচলিত আছে। এগুলি আবার ২৭০টি শাখা-প্রশাখা ও বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভক্ত। অনুসারিদের সংখ্যার ভিত্তিতে এসব ধর্ম থেকে কয়েকটি ধর্ম প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম হিসেবে বিবেচ্য। তারপরও বলা যায় পৃথিবীর কোন ধর্মই সর্বজনীন নয়। একে অন্যের পরিপুরক। তাই মানবিক প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে একেকটি নতুন ধর্ম। আর নব সৃষ্ট ধর্মই মানব সমাজে নানা জনপদে নানাভাবে মানুষের জীবনাচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

এই নিয়ন্ত্রণের বিধিবদ্ধ বিধান তৈরিতে যেসকল মহাপুরুষ অবদান রেখেছেন— তাঁরাই একেক জনপদে স্ব-সম্প্রদায়ের কাছে নমস্য হিসেবে পুজিত হয়ে আসছেন। এই মান্যতা থেকেই বিভিন্ন ধর্ম চিন্তকদের উপলব্ধি বোধই একেকটি নতুন ধর্মরূপে আবির্ভূত হয়। মানুষের মনেই ধর্মের জন্ম। খ্রি. পূ. পাঁচ শতকে গ্রিক দার্শনিক প্রোটোগোরাস সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেন Man is the measure for everything’।

বাংলায় মানুষ বা মানববোধের গুরুত্ব সূচিত হয় পালযুগ বা চর্যাযুগ থেকে। পরবর্তীকালে তা বিকশিত হতে থাকে নাথসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণবসাহিত্য, সুফিসাহিত্য, শাক্তপদ, বাউলগান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। বৌদ্ধ সহজিয়া ভিক্ষুবৃন্দের রচিত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে রয়েছে এই নিদর্শন। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় মানুষ। মানবকুলের বৈষম্যহীন সমাজে এক অনুপম রূপকল্প এই চর্যাপদ। চর্যাগীতির মানব বন্ধনার ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের (১৩৩৯-১৩৯৯) আবির্ভাব। মানববৈরী ধর্মবৃত্তির চেয়ে হৃদয়বৃত্তিকে উঁচুতে আসন দিয়ে চণ্ডীদাস দৃপ্ত ঘোষণা দিলেন- ‘শুন হে মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।

বাংলার এই জনপদে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব বাঙালি জনজীবন ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাধান্য পেলেও এখানে রয়েছে আরও অনেক ধর্ম সম্প্রদায়।

বাংলাদেশে বাঙালি সমাজে অনুসৃত হচ্ছে বহু লোকধর্ম। এ যেন সত্যের সাধনায় বহুমুখী স্রোতধারা। এই স্রোতধারায় মিশে আছে গোরক্ষনাথ প্রতিষ্ঠিত নাথধর্ম, শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম, আউলচাঁদ প্রবর্তিত কর্তাভজা ধর্ম, রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্মসহ এরকম আরো অনেক উপধর্ম।

এই উপধর্মের স্রোতবাহী ধারায় আরো রয়েছে দুঃখীরাম প্রবর্তিত সাহেবধনী সম্প্রদায়, কালাচাঁদ বিদ্যালঙ্কার প্রবর্তিত কিশোরীভজা সম্প্রদায়, বলরাম হাড়ি প্রবর্তিত বলাহাড়ি সম্প্রদায়, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রবর্তিত সৎসঙ্গ সম্প্রদায়, শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়া সম্প্রদায়, শ্রী ঠাকুরবাণী প্রবর্তিত ঠাকুরবাণী সম্প্রদায়, শ্রী বসন্ত সাধু প্রবর্তিত মা-দাদা সম্প্রদায়, মনোমোহন দত্ত প্রবর্তিত দয়াময় সম্প্রদায়, করমশাহ প্রবর্তিত পাগলা-পন্থা সম্প্রদায়, রামবল্লভ প্রবর্তিত মহানাম সম্প্রদায়, শ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত প্রবর্তিত মাধৱ গৌড়ীয় সম্প্রদায়, স্বামী স্বরূপানন্দ প্রবর্তিত অখণ্ডমণ্ডলী, শ্রীল ভক্তিবেদান্ত প্রভুপাদ প্রবর্তিত ইসকন ইত্যাদি। নিম্নে বাংলার লোকধর্ম ও বিশেষ উল্লেযোগ্য সম্প্রদায়ের ধর্মমত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপস্থাপিত হল :

বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]

ব্রাহ্মসমাজ:

হিন্দুধর্মের ভিন্ন মতাবলম্বী ব্রাহ্মসমাজ উপনিষদ থেকে ঈশ্বরের অদ্বৈতবাদ ও ইসলাম ধর্মের একেশ্বরবাদের সমন্বয়ে হিন্দুধর্মের একটি নতুন মতবাদ। পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে যারা হিন্দুধর্ম সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যমণি ছিলেন বাঙালি হিন্দু রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থার নাম ছিল ব্রাহ্মসমাজ। বৈদেকি ধর্মে মূর্তিপূজা ছিল না। বহু দেবতার পরিবর্তে এক ঈশ্বরবাদে রামমোহন রায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ব্রাহ্মরা একেশ্বরবাদী ও নিরাকার ব্রহ্মার উপাসক।

বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ] - ব্রাহ্মসমাজের মূলমন্ত্র 'ওঁ ব্রহ্ম কৃপাহি কেবলম্‌'
ব্রাহ্মসমাজের মূলমন্ত্র ‘ওঁ ব্রহ্ম কৃপাহি কেবলম্‌’

রাজা রামমোহন রায় এক ঈশ্বরবাদের সমর্থনে তুহুফাউল মুয়াহিউদ্দীন (একেশ্বরবাদীদের জন্য উপহার) শীর্ষক পুস্তক রচনা করে। তার আন্দোলন জোরদার হওয়ার পূর্বেই ৫৯ বছর বয়সে তিনি লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে পরিবর্তন আসে। কারণ বেদে মূর্তি ছিল না বটে কিন্তু একাধিক দেবতা যেমন— ব্রহ্ম, বিষ্ণু, শিব এর স্বীকৃতি ছিল। তাই রামমোহন রায়ের অনুসারীগণ বহু ঈশ্বরবাদের পূজায় ফিরে যান।

রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে আসীন হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১ ১৯৪১) পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯০৫)। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের বিশ্বাসে বহু পরিবর্তন আনয়ন করেন। ব্রহ্মবিদ্যা প্রচারের জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন ‘তত্ত্বাবোধিনী সভা’ (১৮৩৯)। এই সভার মুখপত্রস্বরূপ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাও প্রকাশিত হয়।

ব্রাহ্মগণ অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসে অবহিত হওয়ায় আগ্রহী ছিলেন। তারা অবতারবাদ প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তারা আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। অনুশোচনা ও সৎকর্মের মাধ্যমে অমরাত্মার মুক্তিই ছিল তাদের লক্ষ্য। ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়। ব্রাহ্মসমাজে কেবলমাত্র নিরাকার এক ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়। নিষিদ্ধ হয় সকল প্রকার মূর্তিপূজা। পরবর্তীকালে আদি ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুধর্মের উদার অংশে পরিণত হয়। প্রার্থনা সমাজ, আর্য সমাজ ও সর্বধর্ম সম্প্রদায়ও ব্রাহ্ম সমাজের অমৃত উৎস থেকে প্রবাহিত ধারা।

নববিধান ব্রাহ্মসমাজ :

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান বিশ্বজনীন চরিত্রের ফলে কেশব চন্দ্রের সমকালে দুনিয়া জোড়া দর্শন ও সংস্কৃতি বিশ্বজনীন রূপ লাভ করতে থাকে, আবিষ্কার ও ভাবনা জাতীয় চরিত্রের খোলস পরিত্যাগ করে সার্বজনীন ও বিশ্বমানবের সাধারণ সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হয়। ফলে যে উৎস থেকে রামমোহনের ব্রহ্মবাদের স্রোতধারার উৎপত্তি তা নদীর মত ক্রমশ সাগর অভিমুখী হতে থাকলে বহু ক্ষুদ্র ধারা মিলে বেগবান স্রোত ধারায় পরিণত হয়, ভৌগোলিক অবস্থার পরিবর্তন হতে হতে একই নদীর যেমন অবয়বতগত পরিবর্তন ঘটে, কোথাও বা নামের পরিবর্তন ঘটে, সেইরূপ নববিধান ব্রাহ্মসমাজ মূল ব্রাহ্মসমাজেরই স্রোতধারা।

Raja Rammohan Ray, রাজা রামমোহন রায় - বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
Raja Rammohan Ray, রাজা রামমোহন রায়

 

শত সহস্র তত্ত্বপুষ্পের মধু আহরণে যে কেশব চন্দ্রের নিরন্তর প্রয়াস, ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্রোণপুষ্পের মধু তাঁর সর্বগ্রাসী আত্মিক ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারে নি। শ্রীবিমলা প্রসাদ সিদ্ধান্ত সরস্বতী তাঁর বঙ্গে সামাজিকতা নামক গ্রন্থে নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘গরিফাস্থ সেন বংশীয় মৃত কেশব চন্দ্র দেবেন্দ্ৰব্রহ্মবাদের অনুকরণে স্বীয়বাদ পুষ্ট করেন।

শ্রীযুত দেবেন্দ্রনাথের কৃপায় তাহার ব্রহ্মানন্দ উপাধি ঘটে। জাতিভেদ রাহিত্য ধর্মাঙ্গ জ্ঞানে ও পাশ্চাত্যনীতি বহুল প্রচার বাসনায় ব্রহ্মানন্দের স্বতন্ত্রবাদ স্থাপন প্রয়োজন হইয়াছিল। মানবযুক্তিই ধর্মের ভিত্তি। যুক্তির সহিত শাস্ত্রীয় বচন ও সাধুবাক্যে অবিরুদ্ধ হইলে তাহা গ্রহণীয়। জ্ঞান করণগুলির সাহায্যে যে যুক্তি ব্যক্তিগত চেষ্টায় উৎপন্ন হইবে তাহার সহিত বিরোধ হইলেই তাহা অগ্রাহ্য। এই বাদে সমন্বয়াকাঙ্খা অঙ্কুরিত হয়। এই মত শাঙ্করবাদের চমৎকারিতার মধ্যে বিলীন হয় নাই।

কেশব ব্রহ্মবাদ, মায়িক ভক্তিবাদ ও রামকৃষ্ণবাদের আন্দোলিত হইয়া কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হইয়াছিল। পরে নববিধানরূপ মতে পর্যবসিত হয়। প্রাচীন ব্যবহারিক নানা ক্রিয়া পাশ্চাত্য যুক্তিদ্বারা নবীন ব্রহ্মবাদের অন্তর্গত করিবার আবশ্যক হইয়াছিল। চক্ষু মুদ্রিত করিয়া নিরাকার ব্রহ্মধ্যানাদি উপাসনা। স্ত্রী স্বাধীনতা প্রভৃতি সামাজিক সংস্কার ধার্মিক জীবনের কৃত্য বিশেষ।’

সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ :

প্রমত্তা নদী অনেক সময় তার দুকূল ভাসিয়ে যায়, কেশব চন্দ্রের প্রাণের মুক্তধারা সমাজ, সংস্কার ও সকল বাঁধাকে অতিক্রম করে যায়। কেশব চন্দ্রের মানবীয় ত্রুটি বিচ্যুতি এবং কোচবিহার বিবাহকে কেন্দ্র করে কেশব চন্দ্রের ব্রাহ্মসমাজ ভেঙ্গে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সৃষ্টি হয়। শিবনাথ শাস্ত্রী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ঋষি ও তাত্ত্বিক পুরুষ ছিলেন। চল্লিশের দশক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় উন্মাদনার ভাবোচ্ছ্বাস এক শ্রেণির মানুষের যৌক্তিক গ্রন্থিকে ছিন্ন করে ফেলে। বিশ্বাস অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হয়। বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তকগণ প্রত্যাদেশ, যুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক মূল্য বোধের উপরই নিজ নিজ মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

কিন্তু ধর্ম প্রবর্তকদের মৃত্যুর পর তাঁদের অনুসারিরা অযৌক্তিক ভাবালুতা দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। আণবিক বোমা বিস্ফোরণের দ্বারা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মত সাম্প্রদায়িকতা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে আচ্ছন্ন করে, কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, উপমহাদেশে ধর্মীয় শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল বিশ্বমানবের কল্যাণ প্রতিষ্ঠান ব্রাহ্মসমাজ।

ব্রাহ্মধর্মবীজ :

১. পূর্বে কেবল এক পরব্রহ্ম মাত্র ছিলেন; অন্য আর কিছুই ছিল না; তিনি এই সমুদয় সৃষ্টি করিলেন।

২. তিনি জ্ঞানরূপ, অনন্তস্বরূপ, মঙ্গলস্বরূপ, নিত্য, নিয়ন্তা, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, সর্বাশ্রয়, নিরবয়ব, নির্বিকার, একমাত্র, অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান, স্বতন্ত্র ও পরিপূর্ণ ; কাহারও সহিত তাঁহার উপমা হয় না।

একমাত্র তাঁহার উপাসনা দ্বারা ঐহিক ও পারত্রিক মঙ্গল হয়। তাঁহাকে প্রীতি করা এবং তাঁহার প্রিয়কার্য সাধন করাই তাঁহার উপাসনা। 8.

ব্রাহ্মসমাজ, কলকাতায় নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনালয় - বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
ব্রাহ্মসমাজ, কলকাতায় নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনালয়

ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ :

১. পূর্বে কেবল এক পরব্রহ্ম মাত্র ছিলেন, অন্য আর কিছুই ছিল না; তিনিই এই সমুদয় সৃষ্টি করিলেন।

২. তিনি জ্ঞানস্বরূপ, অনন্তস্বরূপ, মঙ্গলস্বরূপ, নিত্য, নিয়ন্তা, সৰ্ব্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, সর্বাশ্রয়, নিরবয়ব, নির্বিকার, একমাত্র, অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান, স্বতন্ত্র ও পরিপূর্ণ; কাহারও সহিত তাঁহার উপমা হয় না।

৩. একমাত্র তাঁহার উপাসনা দ্বারা ঐহিক ও পারত্রিক মঙ্গল হয়। ৪. তাঁহাতে প্রীতি করা এবং তাঁহার প্রিয়কার্য সাধন করাই তাঁহার উপাসনা। – আমি এই ব্রাহ্মধর্মবীজে বিশ্বাসপূর্বক ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করিতেছি।

৫. ওঁ সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-কর্তা, ঐহিক পারত্রিক মঙ্গলদাতা, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, মঙ্গল-স্বরূপ, নিরবয়ব, একমাত্র, অদ্বিতীয় পরব্রহ্মের প্রতি প্রীতি দ্বারা এবং তাঁহার প্রিয়কার্য সাধন দ্বারা তাঁহার উপাসনাতে নিযুক্ত থাকিব।

৬. পরব্রহ্ম জ্ঞান করিয়া সৃষ্ট কোন বস্তুর আরাধনা করিব না। ৭. রোগ বা কোন বিপদের দ্বারা অক্ষম না হইলে প্রতিদিবস শ্রদ্ধা ও প্রীতিপূর্বক পরব্রহ্মে আত্মা সমাধান করিব।

৪. সৎকর্মের অনুষ্ঠানে যত্নশীল থাকিব।

৫. পাপ কর্ম হইতে নিরস্ত থাকিতে সচেষ্ট হইব।

৬. যদি মোহবশত কখন কোন পাপাচরণ করি, তবে তন্নিমিত্তে অকৃত্রিম অনুশোচনাপূর্বক তাহা হইতে বিরত হইব।

৭. ব্রাহ্মধর্মের উন্নতি সাধনার্থে বর্ষে বর্ষে ব্রাহ্মসমাজের দান করিব। হে পরমাত্মন! সম্যকরূপে এই পরম ধর্ম প্রতিপালন করিবার ক্ষমতা আমার প্রতি অর্পণ কর।

ওঁ একমেবাদ্বিতীয়ম্।

 

সৎসঙ্গ সম্প্রদায়:

ভারতীয় সন্ত মতেরই একটি সম্প্রসারিত রূপ সৎসঙ্গ সম্প্রদায়। বাংলাদেশে এই মতের বিকাশ ও সম্প্রসারণ করেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্ৰ (১৮৮৮ ১৯৬৯)। সৎসঙ্গ বলতে Holy Communion বুঝায় কিন্তু কবীরপন্থা অনুসারে এখানে সাধুসঙ্গ ও ভজন গানের অনুষ্ঠান বুঝায়। কল্পতরুবৃক্ষ ও সৎসঙ্গ সমগুণ বিশিষ্ট, কল্পতরু বৃক্ষের নিকট যেমন বাঞ্ছিত বস্তু মিলে তেমনি সৎসঙ্গ দ্বারা বাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কাঠের সাথে বিদ্ধ হয়ে লোহা যেমন জলে ভাসতে পারে তেমনি সৎসঙ্গ দ্বারা মানুষের অসম্ভব বিষয় সম্ভবপর হয়। কয়লা যেমন আগুনের সঙ্গে মিলিত হয়ে রক্তিম বর্ণ প্রাপ্ত হয়, সৎসঙ্গও তেমনি মানুষকে ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়।

Sree Sree Thakur Anukulchandra, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র - বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
Sree Sree Thakur Anukulchandra, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

 

বাঁশের কাঠি লজেন্সের মধ্যে প্রবেশ করালে চিনির দামেই তা বিক্রয় হয়। পিপীলিকাও ফুলের মধ্যে লুকিয়ে রাজার মালায় প্রবেশ করে। জাগ্রত অবস্থায় পঞ্চাশ হাজার বছরের তপস্যার পুণ্য ফলের চেয়ে স্বপ্নযোগে একঘণ্টা সৎসঙ্গের মূল্য অধিকতর। স্বামী শিব দয়াল সিংহ আধুনিক সৎসঙ্গের প্রতিষ্ঠাতা। স্বামী শিবদয়াল সিংহ রাধাস্বামী মতের প্রবক্তা, তিনি শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতির পরিচালনার মধ্যে যে ইচ্ছাময়ের বহিঃপ্রকাশ তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

বর্তমান সভ্যতা Globalization এর সভ্যতা, এর জন্য যে Universalism-এর প্রয়োজন তা’ তিনি গ্রহণ করেছিলেন এবং সকল ধর্মের প্রাণসত্তা সৎসঙ্গ তা দিয়ে তিনি জগতের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এই আদর্শের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পাবনার হিমাইতপুর নিবাসী ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রকে কেন্দ্র করে জাতি, ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠি ও সম্প্রদায়ের বিকাশ ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রত্যয়ে এক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়, পরবর্তীকালে তাঁরা সৎসঙ্গ নামে পরিচিতি লাভ করে।

সৎসঙ্গের মর্মানুযায়ী বুদ্ধ, ঈশা (আ.), মুহম্মদ (স.) শ্রীচৈতন্য এবং শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কোন প্রভেদ নাই জীবোদ্ধারে তাঁরা যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন। সৎসঙ্গে ধর্ম বলতে বাঁচা বাড়ার মর্মকেই ধর্ম বলে অভিহিত করা হয়। জাগতিক ও পারমার্থিক বিকাশসহ জীব ও প্রাণির সুসামঞ্জস্য বিধানে তাঁরা নিষ্ঠাবান। সৎসঙ্গের প্রচারকদের ঋত্বিক বলা হয়। যে কেউ ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের প্রতি নিষ্ঠাযুক্ত ভক্তি রেখে ঋত্বিক হতে পারে। সৎসঙ্গের দীক্ষা হিন্দু, মুসলমান বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, নাস্তিকসহ সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত। সৎ সংযুক্তির সঙ্গে তদ্‌গতি সম্পন্ন যারা তারাই সৎসঙ্গী আর তাদের মিলন ক্ষেত্র হল সৎসঙ্গ। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন: মানুষ আপন টাকা পর,যত পারিস মানুষ ধর।

ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের রচনাবলি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সাবলীল এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন। প্রায় দেড়শটি গ্রন্থের গ্রন্থকার তিনি। একমাত্র সত্যানুসরণ ছাড়া বাকি গ্রন্থগুলো সবই শ্রুতি লিখনে প্রকাশিত। এসব গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে পুণ্যপুঁথি, চলারসাথী, নানা প্রসঙ্গ, কথা প্রসঙ্গ, বিবাহ বিধায়না, শিক্ষা বিধায়না, নিষ্ঠা বিধায়না, বিজ্ঞান বিধায়না, বিজ্ঞান বিভূতি, সমাজ সন্দীপনা সহ বিভিন্ন অমূল্য গ্রন্থ। আর্য কৃষ্টি সংরক্ষণ যজন, যাজন, ইষ্টভৃতির অঙ্গীকারে সৎসঙ্গের উদ্ভব।

 

রামবল্লভী সম্প্রদায়:

রামবল্লভী সম্প্রদায় কর্তাভজা সম্প্রদায়েরই একটি স্রোতধারা, আউলচাঁদ প্রবর্তিত কর্তাভজা সম্প্রদায় অনেকাংশে গোস্বামীতন্ত্রে রূপান্তরিত হলে আউল চাঁদের সত্যস্রোতে আরেকটি ধারার সৃষ্টি হয়; তার নাম রামবল্লভী সম্প্রদায়। রামবল্লভী সম্প্রদায়ের উদ্যোগী পুরুষ হলেন কৃষ্ণ কিংকর গুণসাগর ও শ্রীনাথ মুখোপাধ্যায়। রামবল্লভ নামক এক ব্যক্তিকে এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলে মান্য করা হয়। প্রতি বৎসর শিবচতুর্দশীতে এই সম্প্রদায়ের মেলা বসে। রামবল্লভী সম্প্রদায় সকল ধর্মের প্রবর্তক ও সকল ধর্ম গ্রন্থকে শ্রদ্ধা করে। রামবল্লভী সম্প্রদায়ের প্রার্থনা সভায় যিশু খ্রিষ্ট, হজরত মুহম্মদ (সা.) ও গুরু নানকের ভোগ প্রদান করা হয়। এই সম্প্রদায়ের বিশ্বাসসূত্র নিম্নরূপ:

রামবল্লভী সম্প্রদায় - বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
রামবল্লভী সম্প্রদায়

 

১. রামবল্লভী সম্প্রদায় জাতি ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষকে সমান জ্ঞান করে।
২. সকলের প্রতি বিনয় সম্মত আচরণে বিশ্বাসী।
৩. সকলের প্রতি ভালবাসা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী।
৪. পরদ্রব্য, পরস্ত্রীর প্রতি নির্মোহ।
৫. বিভিন্ন ধর্মের উপাস্য পরমসত্তা বহু নয়, ভিন্ন নয়, জাতি ভাষা কৃষ্টিভেদে একেরই ভিন্ন ভিন্ন নাম।

বাংলাদেশের লোকায়ত মানুষের মধ্যে অদ্য বিধি বিভিন্ন নামে এই ধারার সাধনা বিদ্যমান। বাংলাদেশ বিভিন্ন আউলিয়া দরবেশ সুফি সাধক ও গুরু নানকের পবিত্র পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে, পরবর্তীকালে সূফিদের মত কুকাসন্যাসীরাও সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে অশেষ অবদান রাখেন এবং পাশাপাশি খ্রিষ্টানমগুলির অনেক সাধক সম্প্রদায় (যারা আউল বাউলের সমপর্যায়ের) বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত থেকেছেন এবং অদ্যাবধি রয়েছেন। সেক্ষেত্রে বৌদ্ধ বাউল বৈষ্ণব ধর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর যিশু খ্রিষ্ট, মুহম্মদ (স.), নানক প্রমুখ পুরুষোত্তমের ভাবাদর্শে একটি নতুন সম্প্রদায়ের জন্ম বাঙালির অন্তর্নিহিত, সমন্বয়ী ও প্রেমিক সত্তার বহিঃপ্রকাশ ব্যতীত আর কিছুই নয়।

অখণ্ডমণ্ডলী সম্প্রদায়:

স্বামী স্বরূপানন্দকে কেন্দ্র করে অখণ্ডমণ্ডলীর উদ্ভব ও বিকাশ, এ সম্প্রদায়ের বেদ হল অখণ্ড সংহিতা। মানবজীবনে উৎকর্ষ লাভ করতে হলে ত্যাগ, আত্মনির্ভরশীলতা, ও ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজনীনতা রয়েছে। অখণ্ডমণ্ডলী শুধু মাত্র কৌমার্যের মাধ্যমে ব্রহ্মচয্য নয়, দাম্পত্য জীবনেও ব্রহ্মচর্যের ধারা প্রবর্তন করেছেন। অখণ্ডমণ্ডলী মনে করে যে, নারী পুরুষ আধ্যাত্মিক সাধনার চড়াই এবং উত্রাইয়ে যুগল এবং পরিপূরক শক্তি। অখণ্ডমণ্ডলী মূলত একেশ্বরবাদী বাংলাদেশে এর উদ্ভব হলেও পরিবর্তিকালে অনিবার্য কারণবশত বিহারের মানভূম জেলায় এর বিকাশ ঘটে।

ফতেপুর বসন্তপুর অখন্ড মন্ডলী- বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
ফতেপুর বসন্তপুর অখন্ড মন্ডলী

 

বাংলাদেশে ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী সহ বিভিন্ন স্থানে অখণ্ডমণ্ডলী বিদ্যমান। অযাচক ও বীর্যবানের ধর্মই হল অখণ্ডমণ্ডলী। ঢাকা অঞ্চলের শুভ্যাঢ্যা নিবাসী বীরেন্দ্র মালো নামক মল্লবর্মণ সম্প্রদায়ের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি (যিনি কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন) এই প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। টাঙ্গাইল অঞ্চলে গোপালপুর উপজেলার ডুবাইল গ্রামের শহীদ ভূপতি মোহন সরকার এক সময় অখণ্ড মণ্ডলীর বাণী প্রচার করেছেন।

কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের অন্তর্গত রহিম-পুরে একটি অখণ্ডমণ্ডল আশ্রম রয়েছে। যেখানে ‘ভবান ভিক্ষাংদেহি’ তথাকথিত সন্ন্যাসীদের মূলমন্ত্র। সেখান থেকে স্বামী স্বরূপানন্দ আযাচক ও অভিক্ষার ব্রতে অখণ্ডমণ্ডলীকে প্রতিষ্ঠা করেন। স্বামী স্বরূপানন্দ বলেন, ‘নিজ নিজ ক্ষুদ্র সংসার এবং হীনস্বার্থ নিয়া যাহারা ব্যস্ত, তাহাদের সংসারও দেখিতে না দেখিতে ছিন্নমূল তরুর ন্যায় ভূতলশায়ী হইবে, স্বার্থও দুর্বৃত্ত-পীড়নে নিষ্পেষিত হইয়া মরিবে। আজ তোমরা সকলকে স্বার্থ এবং সংসার এই দুই জঞ্জালের চিন্তা হইতে মুক্ত হইবার জন্য গভীর আবেগে আবেদন জানাও।

কক্সবাজার অখণ্ডমণ্ডলী - বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
কক্সবাজার অখণ্ডমণ্ডলী

 

পৃথিবীর সকলের স্বার্থের মধ্য দিয়া নিজের স্বার্থকে আদায় করিতে, জগতের সকলের সংসারের সর্বাঙ্গীণ পুষ্টির ভিতর দিয়া নিজের ক্ষুদ্রা সংসারের পুষ্টি আহরণ করিতে আজ তোমরা প্রত্যেককে উদ্বুদ্ধ কর। ব্যষ্টির তৃপ্তি এবং ব্যক্তির কুশলই আজ যেন কাহারও লক্ষ্য না হয়। সমষ্টির তৃপ্তি সমগ্রের কুশলের মধ্য দিয়া ব্যষ্টি আজ পরিপূর্ণরূপে তৃপ্তিমান এবং অফুরন্ত কুশলের অধিকারী হইতে পারে।’ স্বামী স্বরূপানন্দ আরো বলেন, ‘ক্ষুদ্রকে যে অবহেলা করে, তার দুঃখ পদে পদে। পৃথিবীতে তোমার অবজ্ঞার পাত্র যে কেউ নেই, এই কথাটি সত্য ক’রে জানো। ছোটর ভিতরে বড়’র বীজ খুঁজে বের কর। নিম্নতম অবস্থার এবং নীচতম চরিত্রের লোকের ভিতরেও উচ্চতম অবস্থা ও চরিত্র যে বিকশিত হতে পারে, এই বিশ্বাসকে জাগ্রত কর, জ্বলন্ত কর। ক্ষুদ্রের ভিতরেও বৃহৎকে দেখ।’

কিশোরীভজা সম্প্রদায়:

সৃষ্টির আদিম শক্তি হল চির কিশোরী, চিরচঞ্চলা কন্যাকুমারী। তাকে উপলব্ধি করেই ‘আমার উঠিতে কিশোরী বসিতে কিশোরী’ সংগীতের উদ্ভব। এই মহাজগৎ ও তার প্রাণিন সম্পদ যেন কিশোরীর ক্রীড়ার বস্তু, অর্ন্তনিহিত তাঁর মাতৃত্ব ও দয়ার গুণে পৃথিবীতে আমাদের আবির্ভাব। সৃষ্ট জীবের জন্য তিনি মাতা ও কন্যাস্বরূপ। ব্যক্তি বা গুটি কয়েক মানুষের কলংকের জন্য সূর্য যেমন কলংকিত হয়না তেমনি কতিপয় দূরাচারী ব্যক্তির জন্য কোন মতবাদকে অহিতকর বলা বিধেয় নয়।

মাধ্ব গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের বিমলাপ্রসাদ সিদ্ধান্ত সরস্বতী তার বঙ্গে সামাজিকতা নামক গ্রন্থে কিশোরীভজা সম্প্রদায়কে বক্র দৃষ্টিতে দেখেছেন, এখানে তিনি অক্ষয়পন্থীদের মত কিশোরী ভজা মতের বাহ্যিক দিকটা দেখেছেন। তার মত প্রাজ্ঞ জন বিষয়টি তাদের জীবনবেদ তথা চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে লক্ষ্য করলে এই মতের প্রাসঙ্গিকতা ও দার্শনিক গভীরতা উপলব্ধি করতে পারতেন। মোটকথা, অধিকার বঞ্চিত, ব্রাহ্মণ্যবাদ কর্তৃক সমাজ বহিঃস্কৃত এবং তথাকথিত মাধব গৌড়ীয় নিষ্ফলংক দেবদূতগণ (?) কর্তৃক স্বীকৃত মানুষেরা ধর্মান্তরিত না হয়ে আর্যকৃষ্টির সুউচ্চ পর্বতের শেষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁদের প্রতি বিচারবিহীন মন্তব্য ‘অমানীকে মান’ দেওয়া তত্ত্বের বৈরিতা ও ‘তৃণাদপি সুনীচেন’ আদেশের বরখেলাপ ব্যতীত আর কিছুই নয়।

কালাচাঁদ বিদ্যালংকার এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা কালাচাঁদ শুরুগৃহে অবস্থানকালে ধানভানার সময় গুরুপত্নীর গায়ে আঘাত লাগে। এর ফলে গুরুগৃহ থেকে পালিয়ে তিনি নবদ্বীপ চলে যান, সেখানে তিনি বংশরাম স্পষ্টদায়ক সহ বিভিন্ন আধ্যাত্মিক নেতার সংস্পর্শে আসেন, কর্তাভজা ও রাধাবল্লভীদের সাথে তাঁর মতাদর্শে মিল থাকায় পণ্ডিতেরা তাঁর কর্তাভজা ও রাধাবল্লভী সংশ্লিষ্টতা অনুমান করেন। মতে সহজিয়া, আচারে বৈষ্ণবরাই হয়ত কিশোরীভজা মতে প্রচারক। আদ্বিজ ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল সবার জন্যই কিশোরীভজাদের দ্বার উন্মুক্ত। তবে চক্র সাধনা অন্তরঙ্গ ভক্তদের মধ্যে সীমিত।

ঢাকা শহর ও তৎসংলগ্ন নমঃশূদ্র ও জেলে গ্রামগুলিতে অদ্যাবধি চক্র সাধনার অবশেষ বিদ্যমান রয়েছে। সাধনার ক্ষেত্রে এরা নারীকে/কুমারীকে অতিউচ্চ স্থান দেন। জেমস ওয়াইজ ও অন্যান্যদের বর্ণিত নগ্ন প্রেমলীলা কোথাও আমাদের প্রত্যক্ষ হয় নি, তবে তাঁরা প্রকৃতি ও পুরুষের আত্মিক উন্নতির জন্য পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে একত্রে সাধন ভজন করে থাকে। কেরানীগঞ্জ উপজেলার শুভাঢ্যা চৌকিদার হাটির সুরেন্দ্র সরকার, তোতারাম সাধু, দুখাই সাধু ও চন্দ্রবাউলের আখড়ার সেবায়েত তারাকুমার মহাশয়ের সংস্পর্শে থেকে কালাচাঁদের মত তথা কিশোরী ভজন সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। রামকৃষ্ণ মঠে প্রকাশ্য কুমারী পূজা শাস্ত্রীয় বিচারে বৈধ হলে কিশোরী ভজনের অবৈধতা সর্ব সাধারণের বোধগম্য নয়।

কর্তাভজা সম্প্রদায়:

কর্তাভজা সম্প্রদায়কে অনেকে বাউল মতবাদ হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন। বাউল এবং কর্তাভজা উভয় মতবাদের মধ্যে সাদৃশ্য থাকলেও একটি আরেকটি থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে তা বলা যায় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উদ্ভব। এরা নিজেদের আরাধা দেবতার নামকে কর্তা বলে অভিহিত করে। আউল চাঁদ এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। ঘোষপাড়াকে কেন্দ্র করে এর প্রচার ও উদ্ভব, প্রতি বৎসর দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে এই সম্প্রদায়ীদের মেলা বসে।

কর্তাভজা সম্প্রদায় বাংলাদেশ - বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
কর্তাভজা সম্প্রদায় বাংলাদেশ

 

ফকির আউল চাঁদ এর প্রতিষ্ঠাতা হলেও রামশ্রবণ পাল এর প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মানুষ যখন রসবিবর্জিত আচারের মরুবালিরাশি কিংবা মূল্যহীন শব্দের ধুম্র ধূলিতে দিকভ্রান্ত হচ্ছিল তখন জীবন সত্যের অঙ্গীকারের প্রেম ও বোধিবৃক্ষের লালনের সফল প্রয়াস ও অভিযানের মধ্য দিয়ে লোকায়ত মানব সম্প্রদায়ে এর উদ্ভব।

ব্রাহ্মসমাজের অভ্যুদয় যেমন উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের চিৎ প্রকর্ষের কারণ হয়েছিল, তেমনি নিরক্ষর তৃণমূল সহজ মানুষের সমাজে বুদ্ধির মুক্তি ও সংস্কারমুক্ত আত্মিক অনুশীলনের প্রয়োজনে লোকায়ত সমাজে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও প্রসার। মানুষ যে মানুষের পরিপূরক সত্তা এবং প্রেমের মধ্য দিয়েই মানুষ প্রজ্ঞার ধ্রুবলোকে অধিষ্ঠিত হতে পারে এবং সৃষ্টির মূল যে পরম কল্যাণ ও সুন্দর সেই ধারণা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের দান।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বিশ্বাসসূত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল

১. বাণীবদ্ধ শাস্ত্র আচারের মধ্যে সত্যস্রোত আটকে থাকে না, সত্য নিত্য নতুন রূপে চির বহমান।

২. জৈবিক প্রবৃত্তিকে নির্মূল করে সাধনা নয়, প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বমুখী ও সুসঙ্গত বিকাশের মধ্য দিয়াই অগ্রসর হতে হবে।

৩. জ্ঞানতত্ত্বের দিক থেকে তারা বাস্তববাদী, অনুমান নির্ভর নয়।

৪. বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ভেদবুদ্ধি এবং অন্ধ বিশ্বাস ও বিচারহীন আনুগত্য নাই তারা প্রতিবাদী এবং বিবেকের নিকট দায়বদ্ধ।

৫. কায়াসাধনার মাধ্যমে পরমসত্যের উপলব্ধি ঘটে, অধ্যাত্মসিদ্ধির জন্য গুরুশিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

৬. ধর্ম বর্তমানের বিষয়; ধর্ম ইতিহাস কিংবা অনুমান নয়। জীবনের জন্যই ধর্ম।

সাম্যবাদী বৌদ্ধধর্মের সকল উচ্ছেদের পর তৃণমূল মানুষের মধ্যে বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে অথবা বৌদ্ধধর্মের সাধনা প্রজাকুলের মধ্যে দীর্ঘকাল সংগোপনে সাধিত হবার পর অনুকুল পরিবেশে সূফীবাদের স্পর্শে বৈষ্ণব, আউল, কর্তাভজা নামে এরা পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে কর্তাভজাদের একটি বিরাট অংশ খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ভগবৎ সেবার নিয়মাবলি :

১. ভক্তি প্রাণ চিত্তে সবার উদ্দেশ্য প্রণতি কর্তব্য;

২. মিথ্যা ভাষণ, উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ, অহঙ্কার হিংসা প্রভৃতি পরিতাজ্য;

৩. সত্য বাক্য, সত্য আচার ও সত্যানুষ্ঠান পরিপালনীয়;

৪. আত্ম প্রশংসা মহৎজনের নিন্দা ও বেদ শাস্ত্রের নিন্দা পরিহর্তব্য; ৫. সভা অভ্যন্তরে কাহারও প্রতি কর্কশ বা অপ্রিয় বাক্য প্রয়োগ করবে না;

৬. সভা মধ্যে পাদ প্রসারণ অবিধেয়;

৭. সেবাপরাধ না ঘটে, তদ্বিষয়ে দৃষ্টি রাখিবে; ৮. শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে তদ্‌গত চিত্তে ভগবদ্ নিবৃত থাকিবে;

৯. সর্বদা ভগবত জনের সম্মাননা করবে;

১০. নিয়ত সৎগ্রসঙ্গে চিত্ত নিবিষ্ট রাখবে;

১১. সর্বদা সর্ব বিষয়ে সতর্ক থাকা বিধেয়;

১২. আত্ম শ্লাঘা বিবাদ কলহ প্রভৃতি পরিত্যাজ্য;

১৩. কুতর্ক পরিত্যাজ্য;

১৪. শ্রদ্ধাহীন ব্যাক্তিকে নাম উপদেশ প্রদান নিষিদ্ধ;

১৫. সকলকেই তুল্য মানুষ জ্ঞান করবে; ১৬. গুরু ভজনে অবজ্ঞা পরিত্যাজ্য;

১৭. সাধু সমাজের প্রতি ভয় ও ভক্তি প্রদর্শন কর্তব্য;

১৮. বিরলে নাম স্মরণ বিধেয়;

১৯. শুক্রবারে নিরামিষ ভোজী।

পিরালী সম্প্রদায়:

পীর নারায়ণ সম্প্রদায় অবৈদিক ধারণার মধ্য দিয়ে মানব মিলনের প্রয়াসী। সত্য নারায়ণ/সত্যপীর সম্প্রদায় বৌদ্ধ সাধনার ধারাবাহিক প্রকাশ ঘটে। পরম শ্রদ্ধেয় মছলন্ধী পীর মৎসেন্দ্রনাথকে অভিন্ন বলে মনে করা হয় অথবা দিনাজপুর জেলার সতিমন ডাঙ্গির সত্যমন ঠাকুররূপী ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ প্রতিমার মত অন্যান্য প্রতিমাগুলি পরবর্তীকালে সত্যপীরের/সত্যনারায়াণের রূপ লাভ করেছে কিনা তা গবেষণার বিষয়।

বৌদ্ধদেব পঞ্চতথাগত তান্ত্রিক বৌদ্ধযুগের অস্তিমপূর্বে লোকায়ত সামজে পঞ্চপণ্ডিতে রূপান্তরিত হয়, এই লোকায়ত সমাজ সুফি মরমিদের সংস্পর্শে ইসলামে আত্তীকরণের সময় পঞ্চতথাগতকে পঞ্চপীর/পাঁচপীর পূজা আজো বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশের রংপুর দিনাজপুরে ও ভারতের কোচবিহারে অঞ্চলে আজো পঞ্চপীর, সত্যপীর পূজা প্রচলিত রয়েছে। এক সময় মধুপুর গড় অঞ্চলে পঞ্চপীরের অনুসারীদের আখড়া বিদ্যমান ছিল।

বৌদ্ধ করব্যুহসূত্র মতে অবলোকিতেশ্বর (পদ্মপানি) এর হৃদয় হতে নারায়ণের জন্ম সে হিসাবে সত্যনারায়ণ সত্যপীর বৌদ্ধধর্মের প্রভাবজাত ও বৌদ্ধদের সত্যপূজার অবশেষ বটে, জৈন বৌদ্ধ যুগে তীর্থংকর ও অর্হৎ পূজার আরম্ভ অথবা সে যুগে মানুষ সাধনা বলে নরনারায়ণে পরিণত হয়। সত্যসেবা সাধনার গুণে তীর্থংকর এবং অর্হৎগণ সাধারণ মানুষের পূজা পেতে থাকেন এবং পরে তা সঙ্গত কারণে যোগী দরবেশ পীর ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অনেকে পৌরাণিক অর্হৎ, নাথ যোগীকে পীরদের সাথে অভিন্ন মনে করেন। রামেশ্বরী সত্যনারায়ণ পাঁচালীতে সত্যপীরের মাহাত্ম নিম্নরূপ:

‘কৃষ্ণকেশী কেশব মোর নাম, মক্কায় রহিম আমি অযোধ্যার রাম।

ফকির হইয়া আসি তোমার কারণ, কলিতে সম্প্রতি সত্যপীর নারায়ণ।

মতুয়া সম্প্রদায়:

ইতিহাসের জটিল বিন্যাসে না ঢুকে সহজ কথায় বললে বলতে হয়। গৌতমবুদ্ধ (৫৬৬-৪৮৬ খ্রিষ্টপূর্ব) থেকে শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) দেবের ঐতিহ্য-ঋদ্ধ এক বিপ্লবী ধর্ম আন্দোলন তথা সমাজ আন্দোলনের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মেছিলেন পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলার সাফলিডাঙা গ্রামে ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ। বেঁচে ছিলেন ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই মার্চ পর্যন্ত । তাঁর সুপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। তার প্রয়াণ তারিখ ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ তাঁদের ধর্ম সাধনার গোটা সময়টাই (১৮১২ থেকে ১৯২৭) পরাধীন দেশে, অবিভক্ত বাংলায়।

মতুয়া সম্প্রদায় - বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
মতুয়া সম্প্রদায়

 

তাঁদের প্রবর্তিত ধর্মমতের নাম ‘মতুয়া ধর্ম’। তাঁদের ধর্ম অবিভক্ত বাংলায়। তাঁদের ধর্ম আন্দোলন, সমাজ বিপ্লব, জীবনসাধনা বিষয়ে তাঁদের লেখা কোনও গ্রন্থ নেই। যেমন ছিল না চৈতন্যদেবের। হরিচাঁদ সামান্য শিক্ষিত ছিলেন, দলিল ইত্যাদি পাঠ করতে পারতেন। তাঁর পুত্রকে বর্ণ হিন্দুদের স্কুলে পড়ার সুযোগ ছিল না বলে মক্তবে ভর্তি করেন। এখানে পড়াশুনা করার পরে অন্যত্রও পড়াশুনা করেন। তবে তাঁদের জীবনলীলা বা কর্মসাধনা দর্শন মনন ও নির্দেশ বিধৃত আছে দুটি মহাগ্রন্থে। মতুয়া ধর্মের মানুষের শ্রেষ্ঠ শাস্ত্র সে দুটি।

হরিচাদের জীবন কেন্দ্রে রচিত মহাকবি তারক সরকারের শ্রীশ্রী হরি লীলামৃত এবং গুরুচাদের জীবন ও সংগ্রামের কথা লেখা আছে আচার্য মহানন্দ হালদারের শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত্র গ্রন্থে। দুটি গ্রন্থই ছন্দে বিধৃত। ভক্তদের অভিমতে যেন এ যুগের চৈতন্য চরিতামৃত।

আরমা জানি পৃথিবীর ইতিহাসে বহু যুগে বহু দেশে ধর্ম আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক মহামনীষী করেছেন সমাজ সংস্কার এমনি সমাজ বিপ্লব। হরিচাদ তাঁর মতুয়া ধর্মকে বলেছিলেন, ‘সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম’। যেন সেই আদিম সাম্যবাদী যুগের মত কথা। মনু-পূর্ব ভারতে বর্ণবিভাজন ছিল। কর্মভিত্তিক। জন্মভিত্তিক-গোষ্ঠীতন্ত্রবাদী ব্রাহ্মণ্য শোষণের বর্ণাশ্রম নয়। জানি না হরিচাদ তেমনি কোনও বিভেদ মুক্ত সনাতন ধর্মের কথা বলেছিলেন কিনা। সে যাইহোক পূর্ব বাংলার গ্রামে বসে শহরের সংযোগহীন একজন মানুষ বর্ণবাদকে অস্বীকার করলেন। তাঁর ধর্ম আন্দোলনে এল চার্বার বৃহস্পতি-বুদুর-উত্তরাধিকার, বস্তুবাদী চিন্তার আলোকে।

মতুয়া সম্প্রদায় - বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
মতুয়া সম্প্রদায়

 

তার আগের মহাপুরুষেরা বলেছেন স্বর্গলাভ, পরকাল, পরজন্ম, মোস্ত নির্বাণের কথা। তিনি বললেন, ‘এসব স্বৰ্গলোভ, পাপভয় দেখিয়ে মানুষের মানসিক শক্তিকে আচ্ছাদন করা হয়। এ প্রসঙ্গে গুরুচাঁদ বলেন, ‘অনন্ত শক্তির কেন্দ্র মানবের মন। পাপভয়ে স্বর্গলোভে করে আচ্ছাদন।’ ভারতের অন্য কোনও সাধু সন্তরা স্বর্গকে লোভের বস্তু হিসেবে ঘোষণা করেছেন কিনা—আমরা জানিনা। এই ধর্মমত তাই আমাদের ভাষায় একটি বস্তুবাদী বিপ্লবী ধর্মমত। যা অনেক ক্ষেত্রে ‘ধর্ম’ বলতে আমাদের যেসব পুরনো ধর্মীয় ধারণা আছে তাকে অতিক্রম করে যায়।

মতুয়া ধর্ম নাম কেন? কেউ বলেন হরি নামে মাতোয়ারা। কেউ বলেন ওদের তন্ত্র-মন্ত্র বাছ-বিচার নেই, হিন্দুরীতি মানে না। জাত-পাতহীন এ ধর্মমত; যেমন বিধর্মীর মতো। তাই মতুয়া ধর্ম। কুসংস্কার মুক্ত এর সূক্ষ্ম-সনাতন ধর্ম। যাদের মূল আশ্রয় এ জীবন, পিতা-মাতা-পুত্র-কন্যা-স্ত্রী আত্মীয়সহ এ গৃহ, গার্হস্থ্য-ধর্ম তাদের।

রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে যেমন উচ্চ শ্রেণির হিন্দু ধর্মে জাগরণের সৃষ্টি হয়, তেমনি ফরিদপুরের ওড়াকান্দি গ্রামে হরিচাদ ঠাকুর ও গুরুচাদ ঠাকুরে শুভ আবির্ভাবে তফসিলী জাতি তথা নমশূদ্রসম্প্রদায়ে জাগরণের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় সংস্কার প্রগতির পথকে যে উন্মোচিত করে তার প্রমাণ ইউরোপের প্রটেষ্ট্যান্ট আন্দোলন, চৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলন, ব্রাহ্ম সমাজ অতঃপর পূর্ববঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায় ও অন্যান্য আন্দোলন।

মতুয়া সম্প্রদায় - বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
মতুয়া সম্প্রদায়

 

মতুয়া সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার আগে বাংলার কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, নমশুদ্র, জেলে, কৈবর্ত সহ তফশীলি সম্প্রদায়ের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ এবং মানবেতর। বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যসমাজ এই সব ব্রাত্য ও লোকায়ত সমাজের মানুষকে নিজেদের গৃহপালিত জন্তুর চেয়ে নিম্নতর ভাবতেন। আবার ব্রাহ্ম সমাজ তখনও জমিদার বাড়ির আঙ্গিনা ছেড়ে তৃণমূল মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করেনি। এমতাস্থায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে তৃণমূল মানুষের বাঁচাবাড়া অর্থাৎ আত্মবিকাশে কোন পথ খোলা ছিল না। আবার সন্ধম পরিত্যাগ করে ইসলাম অথবা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবে তেমন মানসিক প্রস্তুতিও এদের ছিল না।

উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান প্রমুখ ইংরেজ সিভিলিয়ান খ্রিষ্টধর্ম প্রচার আরম্ভ করলে নিম্নবর্গের মধ্যে যারা অধিকতর নিম্ন এবং দরিদ্রের মধ্যে যারা অধিকতর দরিদ্র এবং যাদের ধর্ম বিক্রয় করা ছাড়া আর কোন বিষয় সম্পদ ছিল না। তারা আত্মরক্ষার তাগিদে দলে দলে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। তদুপরি, জনতার উপর চলছিল হাজারও ধরনের অত্যাচার। প্রচলিত ছিল গুরু প্রসাদীপ্রথা ও সতীদাহ প্রথা।

এই অবস্থায় হরিচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে একটি আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন সুচিত হয়। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষ হত দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষ হরিচাদের ডাকে প্রবলভাবে সাড়া দেয় এবং ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ি এক সময় এই অবহেলিত মানুষের মুক্তির কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে বঙ্গে যিশুর বিজয় যাত্রা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এককালে বর্ণ হিন্দুরা নমশূদ্রদেরকে চণ্ডাল নামে অভিহিত করত, মতুয়া উত্থানের ফলে তদানীন্তন বিট্রিশ সরকার ব্রাহ্মণ্যবাদের আরোপিত এই উপাধি নিষিদ্ধ করে।

হরিচাঁদ ঠাকুর পৃথিবীতে মহাসম্ভৃতির দায়িত্ব পালন করেন। মতুয়া সম্প্রদায়ের উন্নয়নীসভা নামশূদ্রদের মধ্যে বৈষয়িক জাগরণের সূচনা করে, এ সময় সারা বাংলাদেশে ৫,০০০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়, এই সমস্ত বিদ্যালয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের অনুসারিরা শিক্ষকতা করতেন। ধর্মদর্শনের ক্ষেত্রে মতুয়ারা বৈষ্ণব ঐতিহ্যের দাবিদার; যার উৎপত্তি সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম থেকে। বিশ্বের যতগুলি লোক ধর্ম রয়েছে মতুয়া তার মধ্যে অন্যতম। ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য থেকে উদ্ধার, সামাজিক ন্যায় বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা তাদের মহান ব্রত।

মতুয়া শাস্ত্রে রয়েছে/নীচ হয়ে করিব নীচের উদ্ধার অতি নিয়ে না নামিলে কীসে অবতার, নীচু জনে উচ্চ হবে বুদ্ধ তপস্যায়, বুদ্ধদেব অবতার যে সময় হয়। মতুয়াদের দ্বাদশ আজ্ঞা- ১. সদা সত্য কথা বলবে; ২. পিতা মাতাকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করবে; ৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে; ৪. জগৎকে প্রেম করবে; ৫. সকল ধর্মে উদার থাকবে; ৬. জাতিভেদ করবে না; ৭. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে; ৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে; ৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে; ১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না; ১১. ষড়রিপু বশে রাখবে ১২. হাতে কাম, মুখে নাম করবে।

অধ্যাত্ম অনুশীলনের মূল কথা হল আত্মোপলব্ধির সহিত মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ এবং বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সকল সত্তার সামগ্রিক কল্যান। উপরিউক্ত ধারণার সঙ্গে সত্য, প্রেম ও পবিত্রতার সমন্বয়ে মতুয়াবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মতুয়াবাদের দ্বাদশ আড্ডায় শীল, সমাধি, প্রজার প্রতিফলন ঘটেছে এবং পুরাতন নিয়মের দশ আজ্ঞা এবং নতুন নিয়মের অষ্টকল্যাণ বাণীর সাথে এর মিল রয়েছে। মতুয়ারা বর্তমান ও জীবন্ত ধর্মে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, দণ্ডকারণ্যসহ আন্দামান দ্বীপে মতুয়া ধর্মমত প্রচলিত আছে।

মহানাম সম্প্রদায়:

শ্রী জগদ্বন্ধু সুন্দর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদাবাদের ভাগবর্তী তীরের ডাহাপাড়া গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তার জীবনাবসান ঘটে। জগবন্ধু সুন্দরের উপাসকরা সুন্দরকে কেন্দ্র করে এক আধ্যাত্ম অভিযাত্রা শুরু হয়। তিনি দীর্ঘদিন ধ্যানমার্গে অতিবাহিত করেন, তাঁর শিষ্য মহেন্দ্রজী এই সম্প্রদায় গঠনে অসামান্য অবদান করেন। এই সম্প্রদায় বৈষ্ণব বেদান্তের অনুসারী, প্রকৃতি বিবর্জিত সাধনায় বিশ্বাসী।

বাংলাদেশ মহানাম সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ মহানাম সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় কমিটি

 

শ্রীশ্রী জগদ্বন্ধু মোট ৮ খানি গ্রন্থ রচনা করেছেন যথা- ১. শ্রমতী সংকীর্তন ২. শ্রী নাম কীর্তন ৩. শ্রীবিবিধ সংগীত; ৪. শ্রীসাকীৰ্ত্তন; ৫. শ্রীশ্রী হরিকথা; ৬. চন্দ্রপাত; ৭. ত্রিকাল; ৮. উদ্বাবন। ড. মহানামব্রহ্মচারী এই সাধক সম্প্রদায়ের একজন তাত্ত্বিক ও দার্শনিক প্রবক্তা। ফরিদপুরে গোয়াল চামটে ‘শ্রী অঙ্গণ’ অবস্থিত, ঢাকা টিকাটুলী সহ সারাবিশ্বে এই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শাখা রয়েছে। চন্দ্ৰপাত গ্রন্থে এই সম্প্রদায়ের বীজমন্ত্র মহানাম রয়েছে। হরিপুরুষ জগদ্বন্ধু মহাউদ্ধারণ।

চারি হস্ত চন্দ্র পুত্র হাকীট পতন। (প্রভু প্রভু হে) (অনন্তান স্ত ময়)

বৈষ্ণব সম্প্রদায়:

পরমসত্তা আনন্দময়, আনন্দ ও রস আস্বাদনের জন্য তিনি বিশ্বভুবন সৃষ্টি করেছেন, আনন্দ দিয়ে তিন জগৎসংসার লালন করেছেন এবং মহাজগতের গতি ও সদা পরিবর্তনের মূলে যে রস ও আনন্দ বিদ্যমান তাই তিনি। ব্যক্তি তার রস বৃক্ষের রসকলি। জগতের সকল কিছুই তার রসের প্রকাশ। বিশ্বসংসার রসবৃক্ষ ব্যক্তি তার ফল। মহাজাগতিক বৈচিত্র তার আনন্দের পরিপূরক সত্তা, সকল সত্তাই রসময় ও তার নাম।

মধুময় জগৎ ও আনন্দময় জীবনের লক্ষ্যে বৈষ্ণব মতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, ভাগবতের প্রতীক ও উপাখ্যানগুলি দ্বারা বৈষ্ণববমতের সারার্থ বর্ণনা করা হয়েছে। বৃন্দাবন আনন্দ ভূমির প্রতীক এখানে তৃণ, লতা, পুষ্প, গুল্ম, পশু, পাখি, পর্বত, নদী এবং মানুষ সকলই ঈশ্বরের গৌরব এবং প্রশংসার জন্য এখানে সকল কর্মই রস ও আনন্দের জন্য। বিষ্ণু পালনকর্তা, বৈষ্ণব পৃথিবীতে বিষ্ণুর প্রতিনিধি, শুদ্ধ বৈষ্ণবের উপস্থিতি সমতা উন্নয়ন ও ন্যায় বিচারের চেতনা জাগ্রত করে।

বিষ্ণু জগতে অবতীর্ণ হন শিষ্টের লালনও দুষ্টের বিনাশের জন্য। কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গীতা-র লোকসংগ্রহ ও ভাগবত নির্দেশিত দারিদ্র্য বিমোচনের তত্ত্ব অস্বীকার করে তারা জীবন ও জগত সম্পর্কে মায়াবাদী পন্থা গ্রহণ করে, ফলে অনিরূদ্ধ দেবের মত তারা বৈষ্ণব ধর্মের পুণাঙ্গ মত উপস্থাপন করেন নি অথবা শিখ গুরুদেব মত তারা অবিচারের বিরুদ্ধে জনতার কাতারে দাঁড়ান নি। মূলত বৈষ্ণব সম্প্রদায় ইউটোপীয় (বৈদিক) সাম্যবাদী। শ্রীমন্ত শঙ্করদেব, চৈতন্যদেব ও সমকালে সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্যবাদী ছিলেন। বৈদিক সাম্যবাদের মূলকথা হচ্ছে

এই বিশ্বচরাচরে যা কিছু আছে তা সবই পরমেশ্বর ভগবানের সম্পদ এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই জীবন ধারণের জন্য তিনি যেটুকু বরাদ্দ করে দিয়েছেন সেটুকুই গ্রহণ করা উচিত এবং সব কিছুই যে তার সম্পত্তি তা ভালভাবে জেনে কখনও তার অতিরিক্ত কোন কিছুর আকাঙ্খা করা উচিত নয়।

সর্বধর্ম সম্প্রদায়:

আনন্দচন্দ্ৰ নন্দী বা আনন্দ স্বামী এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। আনন্দ স্বামী ১২৩৯ বঙ্গাব্দের ১১ই বৈশাখ কুমিল্লা জেলার কালীকচ্ছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামদুলাল নন্দী, তিনি শৈশব থেকেই কঠোর অধ্যয়নের মাধ্যমে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও ফারসী ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করেন। অল্প বয়সেই তৎকালীন কুমিল্লা জেলায় ভাষাবিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে।

এক সময় আনন্দ স্বামী ব্রাহ্মসমাজের ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পাঠ করে। ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। অতঃপর আনন্দ স্বামী স্বীয় ভ্রাতা কৈলাশ চন্দ্ৰ নন্দীর সঙ্গে ১২৭৩ বঙ্গাব্দে (পূর্ব বাংলা ব্রাহ্মসমাজ মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন) ঢাকায় ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হবার পর থেকে তিনি নিজ গ্রামে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা করে প্রচার ও আধাত্ম সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি তার সাধনালব্ধ সত্যকে জনতার মধ্যে বিতরণে সচেষ্ট থেকেছেন; ১২৮৮ বঙ্গাব্দ হতে তাঁর ভিতর দয়াময় ভাবনা ক্রমবিকশিত হচ্ছিল এবং ১২৮৯ সনে তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হন।

বাংলার নব জাগরণের মধ্যে দিয়ে বাঙালির ভাবনার গুণাত্মক পরিবর্তন সাধিত হয়। পূর্ববর্তী ভাবনা এবং তৎকালীন ভাবনাগুলির মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও আদান প্রদানের ফলে নতুন ধর্ম মতের সৃষ্টি হয়। আনন্দ স্বামীর সর্বধর্ম সমন্বয় সেই প্রচেষ্টারই এক মহৎ অভিব্যক্তি। সাধক কবি মনোমোহন, লব চন্দ্র পাল, আফতাব উদ্দিন, মনছুর উদ্দিন সহজ অসংখ্য সাধক পুরুষ এই ধারার অনুসারী। সাতমোড়া, ভোলাচং, নরসিংদী, ত্রিপুরা, গাজীপুর অঞ্চলে এই ধারার সাধকমণ্ডলী বিদ্যমান রয়েছে। আনন্দ স্বামী ১৩০৭ বঙ্গাব্দে ১১ই জ্যৈষ্ঠ মৃত্যুবরণ করেন। কালীকচ্ছ গ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়। প্রকৃত তত্ত্ব, সর্বধর্ম্মগীতিকা তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। মনোমোহন দত্তের ভাষ্য অনুযায়ী স্বামীজীর মত নিম্নরূপ :

‘সর্বসামঞ্জস্য যোগে জগতের মঙ্গলের জন্য সাধনার ভাবে স্বামীজী দয়াময় নাম প্রাণের সহিত উপলব্ধি করিয়া সিদ্ধ যোগ লাভে অবতারীভাবে এই নাম সকল নামের যোগে মানুষের হৃদয়ের ভাব সামঞ্জস্য রাখিয়া প্রচার করিতে থাকেন। ধর্মের মূল বিষয় মানুষের আত্মপরিচয় ও স্বরূপ পুনরুদ্ধার। মনুষ্যত্বের বিপরীত কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বৌদ্ধিক মুক্তির নিরলস ও নিরন্তর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মসমাজের অভ্যুদয় ঘটে। ব্রাহ্ম সমাজের চিত্রকর্মের বিদ্যুৎদ্ধৃতি উচ্চকোটির মননশীল মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করলেও তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে প্রতীক প্রতিমা ও তথাকথিত গুরুতত্ত্বের বলয় থেকে বের করা সুকঠিন ও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

কায়াতরু বাঙালি মনীষীদের নিকট বোধিধিবৃক্ষ রূপে বিবেচিত; এখানেই বাংলার বোধিসত্তগণ প্রত্যেক বুদ্ধরূপে বোধিলাভ করেছেন। বাঙালি মননের বৈশিষ্ট্য শুধু বুদ্ধি নয়; প্রেম ও সহজ সাধনা এর কর্ষণক্ষেত্র; ফলে লোকায়ত মনন ভূমিতে যৌক্তিক আলো আবহাওয়ার আবহে যে ব্রাহ্মবীজ পত্রপল্লবায়িত হয়ে উঠে তারই পরিণাম সর্বধর্ম সমাজ। সর্বধর্ম মিশন বর্ধিষ্ণু সংগঠন, জনতার মধ্যে প্রতিনিয়ত সর্বধর্মকে জানার ইচ্ছা বাড়ছে। বাংলাদেশে সেমিটিক ধর্ম বলয়ের বাইরে সর্বধর্ম ব্যতীত অন্যকোন সংগঠনের এত প্রচার ও প্রসার নাই। সর্বধর্মের আরতির মধ্যে বিশ্বজনীনতার আভাস মিলে

সবে বল জয় জয় দয়াময়ের জয়। সৰ্ব্ব সিদ্ধি মহাশক্তি জগৎ লক্ষ্মীর জয়। স্থাবর জঙ্গম আদি পশু-পক্ষীর জয়। চেতন অচেতনাদি কীট পতঙ্গের জয়। শিব রামকৃষ্ণ দূর্গা আল্লা করিমের জয়।

নাথ বা যোগী সম্প্রদায়:

বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে যোগী সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করে। বাংলাদেশে তিন ধরনের যোগী বাস করে যথা ১. যোগী; ২. জাত যোগী; ৩. সন্ন্যাসী যোগী।

ব্রাহ্মণদের পরে যোগীরা স্বতন্ত্র স্বাধীন সম্প্রদায়, তাদের ধর্মীয় ও মাঙ্গলিক কাজের জন্য ব্রাহ্মণের উপর তারা নির্ভরশীল নয়। শিক্ষাদীক্ষায় যোগী সম্প্রদায় তুলনামূলকভাবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে অগ্রসর। যোগী সম্প্রায়ের লোকেরা নিজেদেরকে গোরক্ষনাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথ সহ নয়নাথের অনুসারী বলে দাবি করেন। পণ্ডিতেরা মনে করেন গোরক্ষনাথ একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন; গোরক্ষনাথই নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। আবার নাথধর্ম বিশ্বের প্রাচীন ধর্মগুলির মধ্যেও একটি সে বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। নাথসম্প্রদায়ের বিভিন্ন গ্রন্থাবলী পাঠ করে নয়জন নাথ ও চুরাশী জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়।

নয়নাথ এবং চুরাশী সিদ্ধার রচনাবলি ও সাধন প্রণালী সারা জীবনের অনুশীলনের বিষয়, শুধু সম্প্রদায় হিসাবে এর অমূল্য রত্নরাজি আর কারো নেই। অনেকে নাথধর্মকে সহজিয়া শূন্যবাদের অফসুট (Off shoot) বলে মনে করেন, এর পিছনে যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান রয়েছে। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণের তালিকা এবং নাথ সিদ্ধাচার্যগণের তালিকার তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায় যে ২৯ জন সিদ্ধাচার্যের নাম উভয় তালিকায় এসেছে। তবে বৌদ্ধ সহজতন্ত্র প্রভাবিত নাথধর্ম পরবর্তীকালে হিন্দু প্রাধান্যের যুগে হিন্দুধর্মে মিশে যায় এবং হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবীর মাহাত্ম্য ও নাথধর্মে স্বীকৃত হয়। তবু ও কায়াসাধন এবং দেহতত্ত্বের সাধনার উপর ভিত্তি করে যে নাথধর্মের উদ্ভব তার অন্তর্নিহিত সারসত্তার কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নাই।

উপমা উপাখ্যান এবং নাথশিক্ষায় শিক্ষাউপকরণের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটলেও মূলশিক্ষা থেকে নাথধর্মের তেমন কোন বিচ্যুতি ঘটে নাই। নিম্নে নয়নাথের তালিকা প্রদান করা হল:

১. একনাথ; ২. আদিনাথ; ৩. মৎস্যেন্দ্রনাথ; ৪. উদয়নাথ; ৫. দন্দনাথ; ৬. সত্যনাথ; ৭. সন্তোষনাথ; ৮. কুর্মনাথ; ৯. জালন্ধর নাথ।

সুধাকর চন্দ্রিকা, বর্ণনরত্নাকরের তালিকায় ৮৪ জন সিদ্ধার নাম থাকলেও উভয় তালিকাতে ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে কিংবা একই ব্যক্তির দুই নাম থাকতে পারে। বাংলা নাথ সাহিত্য রচয়িতাদের অধিকাংশই মুসলমান। বাংলায় বৈষ্ণব সাহিত্যের পরেই নাথ সাহিত্যের স্থান। মননের ধর্ম, জীবনের ধর্ম নাথ ধর্ম। মানুষই মানুষের নাথ, এই লক্ষ্যে উপনীত হবার সাধনা নাথসাধনা।

নাথধর্মের সম্প্রদায়গুলির নাম শ্রী অমৃতনাথ আশ্রমের পরস্পরা অনুযায়ী ১২ টি নাথ উপ-সম্প্রদায় রয়েছে। যথা:
১. সত্যনাথ পন্থা; ২. ধর্মনাথ পন্থা; ৩. দরিয়ানাথ পন্থা; ৪. অইয়ীনাথ পন্থা; ৫. বৈরাগাকীরা পন্থা; ৬. পন্থা; ৭. কপিলানী পন্থা; ৮. গঙ্গানাথী পন্থা; ৯. মন্নাথী পন্থা; ১০. রাওয়ালকী পন্থা; ১১. পাভা পন্থা; ১২. পাগলা পন্থা।

রাজমোহন নাথের দেওয়া তথ্য মোতাবেক নাথ ধর্মের তেরটি উপ-সম্প্রদায় রয়েছে, তা নিম্নরূপ। যথা-
১. মৎস্যেন্দ্রনাথ সম্প্রদায়; ২. আদিনাথ সম্প্রদায়; ৩. মীননাথ সম্প্রদায়; ৪. গোরক্ষনাথ সম্প্রদায়; ৫. বর্পরনাথ সম্প্রদায়; ৬. সত্নাথ সম্প্রদায়; ৭. বালকনাথ সম্প্রদায়; ৮. গোলকনাথ সম্প্রদায়; ৯. বিরূপাক্ষনাথ সম্প্রদায়; ১০. ভতূহরিনাথ সম্প্রদায়; ১১. অরিনাথ সম্প্রদায়; ১২. খেচরনাথ সম্প্রদায়; ১৩. রামচন্দ্রনাথ সম্প্রদায়।

লোকনাথপন্থী:

অতি সাম্প্রতিক বাংলাদেশে লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে কেন্দ্র করে তৃণমূল মানুষের মধ্যে তক্তিবাদের জাগরণ সৃষ্টি হয়, লোকনাথপন্থায় কোন মন্ত্রতন্ত্রের প্রয়োজন নেই, সাধক লোকনাথ তাঁর নামকেই মহামন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। অসামান্য সাধক পুরুষ লোকনাথ, তাঁর আদর্শই তার জীবন, বাক্য নয় আচরণ দিয়ে যদি কেউ মত প্রতিষ্ঠা করে থাকেন তিনিই লোকনাথ। লোকনাথ আপন সাধনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে যুক্তির চাইতে আবেগ বেশী কার্যকর বিধায় লোকনাথকে পরম ব্রহ্মের আসনে বসিয়ে একদল ভক্তের আতিশয্য দেখা যায় এবং এর দ্বারা ব্রাত্য ও লৌকিক বিশ্বাসে আরেকটি কার্যকর দেবতা সংযুক্ত করা হল।

দেবদেবীর উপাসনা দ্বারা মোক্ষ লাভের বিষয়টি কতটুকু যুক্তি গ্রাহ্য তা বিতর্কের বিষয় তবে নানাবিধ পূজা অর্চনাকে করে যে মূর্তিগড়া হয় এবং পূজার উপকরণ কেনা হয়, উৎসবে মেলা বসে, ফলে সমাজের প্রত্যেক স্তরে অর্থনৈতিক সঞ্চালন ঘটে, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বর্ণের মানুষের নিকট অর্থ পৌঁছে যায়। হিন্দুধর্মে পূজার অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। অতএব, শুধুমাত্র যুক্তি, থিওলজি দিয়ে মূর্তি পূজা বন্ধ করা যায় না। লোকনাথ কোন গুরুপম্পরা সৃষ্টি করে না গেলেও লোকনাথকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই একদল পাল পুরোহিত সৃষ্টি হয়েছে তাঁরা লোকনাথ মণ্ডলীর সগোত্রীয় সুহৃদ সন্ধান করে বেড়াচ্ছেন আপন বৈভবের জন্য, এমনকি আধুনিক যুগে তাবিজ করচ মাদুলি ঝাঁড়ফুঁক দৈববাণী বলা শুরু হয়েছে, যেটি মানুষের পশ্চাৎ

ভাবনাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে। লোকনাথের বাণী : যদি আমার প্রতি কোন কৃতজ্ঞতার ভাব অনুভব করিস তো আমাকে ভিক্ষা দিস। দরিদ্র আতুর সম্বলহীন অনাথের জন্য দয়া করে।

যা হাতে তুলে দিবি জানবি তা একমাত্র আমিই পাব। আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই রে। দুঃখ-দুর্দশাক্লিষ্ট এই জগৎসংসারে সকল পতিতজনের পরিত্রাণের নির্ভরতা দিয়ে বলেছেন ‘রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিবে আমিই রক্ষা করিব।

অসংখ্য ধর্মমতের মধ্যে নিমজ্জিত এই বিশ্ব মানবসমাজ। বাঙালি সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। সাধারণত ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বধর্মে নিষ্ঠাবান। কেউ কেউ হয়ত মনে করে তাঁর অনুসৃত ধর্মটিই ঠিক। এমতাবস্থায় কোন গবেষক যদি তাঁর ধর্মের দুর্বলতা চিহ্নিত করেন সেটা স্বধর্মে নিষ্ঠাবানের জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যাপার নয়। এই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে কোন নতুন সন্ধিৎসার অনুগামি হওয়া কিংবা ধর্মচিন্তায় পরিবর্তন ঘটানো এবং সেই সাথে সমাজে ভিন্ন ধর্মানুসারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সুরক্ষা করা একটি কঠিন বাস্তবতা।

যদিও একেশ্বরবাদী শাস্ত্রীয় মতে বহু ধর্মের অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়। ধর্ম একটাই। স্রষ্টা একজনই। এখানে সৃষ্টি বৈচিত্র্যের মধ্যে স্রষ্টার বহুত্বের উপলব্ধি অজ্ঞতাপ্রসূত বিষয়। তারপরও পরিত্রাণ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় যেসব ধর্মমত মানবসমাজে প্রচলিত আছে তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য উন্মোচন ধর্মগবেষকদের কাছে সহজ হলেও জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মপালনকারীর জন্য সহজ নয়। ইসলাম অনুসৃত সাধারণ ধর্মানুসারিও অসংখ্য পয়গম্বর নবী, রসূলের সন্ধান পান।

ইসলাম ধর্ম মতে, বিভিন্ন সময়ে মানব জাতিকে সতর্ক করার প্রয়োজনে পৃথিবীতে সত্তর হাজার মতান্তরে এক লাখ চব্বিশ হাজার পয়গম্বরের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩১৩ জন মতান্তরে ৩১৫ জন রাসূল এবং অবশিষ্ট সবাই নবী ছিলেন। নবী ও রসূলের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যের অন্যতম হল- যেসব নবীদের কাছে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাঁরা নবী ও রাসূল- এই সমন্বিত মহিমায় অভিষিক্ত এবং অপরাপর সবাই নবী মর্যাদায় অভিষিক্ত। সনাতন ধর্মের গীতায় ঘোষিত হয়েছে দুষ্কৃতিদের শাস্তিপ্রদান এবং সাধুদের পরিত্রাণ প্রাপ্তির জন্য যুগে যুগে স্বয়ং স্রষ্টা অবতাররূপে আবির্ভূত হন।

তবে তা স্বমূর্তিতে নয় (দ্র. পৃ. ৩৬৮-৬৯)। নিরাকার অবয়বে তাঁরই প্রতিনিধি হয়ে সাধারণ মানুষ থেকেই নির্বাচিত হয় এই পরিত্রাণসহায়ক প্রতিনিধি। তাই বলে এঁরা নিজেরাই স্রষ্টা নন- স্রষ্টার প্রতিনিধি। আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এঁরা লোকধর্মের প্রবক্তা পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত।

লোকধর্মে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি উপেক্ষিত

বাংলাদেশে আচরিত লোকধর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত নেই। এখানে শাস্ত্রীয় ধর্মানুসারিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত থেকে তাদের আপন ধর্মীয় পরিচয় উন্মোচন অনায়াসসাধ্য নয়। ফলে তারা স্বগোষ্ঠির মধ্যে সৎসঙ্গী, মতুয়া, বৈষ্ণব, নাথপন্থী প্রভৃতি স্বতন্ত্র নামে পরিচিত থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এঁরা সনাতন ধর্মানুসারি হিন্দু হিসেবেই বিবেচ্য। এ প্রসঙ্গে লোকধর্ম গবেষক অনুপম হীরা মণ্ডল এর অভিমত হল :

সকল প্রক রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তারা এক একটি বড় ধর্মের ধারক হিসেবে নিজেদেরকে পরিচয় দিতে বাধ্য হয়। আবার খুব কম ধর্মানুসারীই আছে যারা নিজেদেরকে তথাকথিত বড় ধর্মের পরিচয়ে পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যেমন, মতুয়া, সৎসঙ্গী, বৈষ্ণব প্রভৃতি ধর্মানুসারীগণ নিজেদেরকে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের বাইরে পরিচিত করে তুলতে চায় না। এরা কখনো এই সকল লোকধর্মগুলোকে সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করে আবার কখনো বা ধর্ম হিসেবে পরিচয় দেয়। ফলে একজন মতুয়া বা সৎসঙ্গী হিন্দু হয়ে মতুয়া বা সৎসঙ্গী।

আবার একজন মাইজভাণ্ডারী অনুসারী নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পর মাইজভাণ্ডারী হিসেবে খ্যাত। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, লালনের ফকিরী ধর্মের অনুসারী। এঁরা নিজেদেরকে হিন্দু বা মুসলমান কোন পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে চায় না। যদিও সমাজের পরিচয়ে কেউ মুসলমান কেউ হিন্দু হিসেবে পরিচিত। (বাংলাদেশের লোকধর্ম : দর্শন ও সমাজতত্ত্ব, পৃ. ২৬)।

এই লোকধর্ম থেকেই পৃথিবীর সকল শাস্ত্রীয় ধর্মের উদ্ভব। লোকধর্মকে ফোকলোরের ভাষায় বলা হয় Folk Religion। এর একাধিক প্রতিশব্দ রয়েছে। যেমন উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে একে ‘উপাসক সম্প্রদায়’ এবং সুধীর চক্রবর্তী তাঁর বাংলার গৌণ ধর্ম সাহেবধনী ও বলাহাড়ি নামক গ্রন্থে একে ‘গৌণ ধর্ম’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রশ্ন উত্তাপন করা যায়, লোকধর্মগুলি কীভাবে শাস্ত্রীয় ধর্মে রূপান্তরিত হল? এর উত্তর অনুসন্ধানে দেখা গেছে।

আদিম দৰ্শকে শাস্ত্রকাররা নিয়ম-রীতির পরাকাষ্ঠায় রূপ দিয়ে গ্রন্থবদ্ধ করে ধর্মানুসারীদের নিকট হাজির করে, এবং এই শাস্ত্রীয় রীতিকেই জীবন বিধান কিংবা অবশ্য পালনীয় রীতি বলে ঘোষণা দেয়। ধর্মকে যখন এরূপ শাস্ত্রবদ্ধ করে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া-করণকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বা সেগুলো ধর্মাচারের ক্ষেত্রে আবশ্যক হয়ে ওঠে তখন একটি ধর্ম শাস্ত্রীয় ধর্মের রূপলাভ করে।

আরও পড়ুন:

 

বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]
বাংলাদেশের লোকধর্ম [ The Folk Religion of Bangladesh ]

 

সহায়ক গ্রন্থাবলি:

  • ওয়াকিল আহমদ, বাংলা লোক-সংস্কৃতি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৪ আবদুল হাফিজ, লৌকিক সংস্কার ও মানবসমাজ; মুক্তধারা ঢাকা, ১৯৭৫ অক্ষয় কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (প্রথম খণ্ড): করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৮৯
  • অক্ষয় কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় (দ্বিতীয় খণ্ড); করুণা প্রকাশনী,
  • কলকাতা, ১৯৯৯ রমাকান্ত চক্রবর্তী, বাংলার গৌণ ধর্ম সাহবেধনী ও বলাহাড়ি; পুস্তক বিপণি,
  • কলকাতা, ২০০৩
  • মুহম্মদ আবদুল মান্নান চৌধুরী, মাইজভাণ্ডারী দর্শন, উৎপত্তি, বিকাশ ও বিশেষত্ব মাইজভাণ্ডার শরীফ, চট্টগ্রাম ২০০৫ সৈয়দ দেলওয়ার হোসেন মাইজভাণ্ডারী, গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারীর জীবন ও
  • কেরামত; মাইজভাণ্ডার শরীফ, চট্টগ্রাম ২০০৭ অনুপম হীরা মণ্ডল, বাংলাদেশের লোকদর্শ দর্শন ও সমাজতত্ত্ব; বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০১০
  • ড. সুমন সাজ্জাদ, ধর্ম নিম্নবর্ণ ঠাট্টা; অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৩ রায় রমানন্দ, ভগবানের তত্ত্বকথা; র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১৩ রঞ্জনা বিশ্বাস, বাংলার লোকধর্ম (প্রথম খণ্ড); বেহুলা বাংলা, ঢাকা, প্র. প্র. ২০২০

Leave a Comment