বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক একটি তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণের প্রয়াস – মোহাম্মদ সেলিম

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক একটি তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণের প্রয়াস – মোহাম্মদ সেলিম : বিশ্বায়নের এই যুগে কোন রাষ্ট্র “একা চল” নীতি গ্রহণ করতে পারে না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশ, নিরাপত্তা, বিজ্ঞানপ্রযুক্তি, ভৌগোলিক অবস্থান এমনি বহুমুখী প্রয়োজন আর নানা ধরনের বাধ্যবাধকতা প্রতিটি রাষ্ট্রকেই অন্য রাষ্ট্রের কাছে নির্ভরশীল করে তুলেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বৈদেশিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি রাষ্ট্রকেই বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণের প্রয়াস - মোহাম্মদ সেলিম - বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Srimoti Indira Gandhi Interacting with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rehman on 07 Feb 1972 at Raj Bhawan ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Srimoti Indira Gandhi Interacting with Bangabandhu Sheikh Mujibur Rehman on 07 Feb 1972 at Raj Bhawan ]

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক

বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ উঠলে ভারতের নামই প্রথম মনে আসে, যদিও মায়ানমারের সঙ্গেও বাংলাদেশের সীমান্ত বিদ্যমান। উল্লেখ্য বাংলাদেশের মোট সীমান্তের ৭৮.৮৬ শতাংশ ভারতের সঙ্গে আর মাত্র ৬.০৫ শতাংশ মায়ানমারের সঙ্গে। কেবল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলে ভারতীয় প্রভাব অনস্বীকার্য। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সাতটি দেশের মোট ভূখণ্ডের পরিমাণ এবং জনসংখ্যার চাইতে ভারতের ভূখণ্ড এবং জনসংখ্যা বেশি। স্মর্তব্য, আয়তনের দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় তেইশ গুণ এবং পাকিস্তানের তুলনায় চার গুণেরও বেশি বড়।

তথাপি ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অবস্থানগত গুরুত্ব রয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তসহ আকার এবং প্রকৃতিগত দিকও বিবেচনা করতে হবে। একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে সে দেশের ভৌগোলিক অবস্থা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থানের রণকৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। একদিকে এটি যেমন দক্ষিণ এশিয়ার অংশ, অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে রয়েছে ভৌগোলিক সংশ্লিষ্টতা। বিশ্বের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ ভৌগোলিক-সংযোগকারী হিসেবে কাজ করছে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পর্বে দুই পরাশক্তির মধ্যে নৌশক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে আটলান্টিকের পরিবর্তে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে ওঠে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্র। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে বিশ্বের বড় শক্তিগুলো পরস্পরবিরোধী ভূমিকা নেয়। তাই ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।

অন্যদিকে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের কাছেও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্ব অস্বীকারের উপায় নেই। কারণ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি ভূবেষ্টিত রাজ্য আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, অরুণাচল, মেঘালয় এবং ত্রিপুরা ভারত থেকে প্রায় ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা পরিস্থিতির মত অবস্থায় আছে। একই কারণে এ সব রাজ্য কলকাতা বা মাদ্রাজ সমুদ্রবন্দরের কোন সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। শুধু নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যকার ১৬/১৭ মাইল প্রস্থের “শিলিগুড়ি করিডোর”-এর মাধ্যমে ভারত তার বৃহদঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করছে। ১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশের অভ্যুদয় এর ফলে উপমহাদেশের শক্তিসাম্যও পরিবর্তিত হয়ে যায়। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মায়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ব্যতীত বাংলাদেশ সামগ্রিক অর্থে ভারত-পরিবেষ্টিত (India locked) একটি রাষ্ট্র। এর পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার, উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় ও আসাম, পূর্বে আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মায়ানমার এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এমনি ভৌগোলিক অবস্থানের বাধ্যবাধকতার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে “India Factor” বা “ভারত উপাদান” গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।২

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৭১-১৯৮১ সময়কাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আলোচ্য সময়ের বিশেষ গুরুত্ব হলো এ সময়ে দুটি রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যথাক্রমে সরকার পরিচালনা করে। বর্তমানেও ঘুরে ফিরে এ দুটি দলই ক্ষমতায় আসছে। প্রকৃতপক্ষে প্রথম একদশকে দুদেশের সম্পর্কের দ্বিমাত্রিক চরিত্র লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে, ১৯৭১-১৯৭৫ পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ, আন্তরিক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে পঁচাত্তর-উত্তরকালে পারস্পরিক আস্থার অভাব সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে। কিন্তু এই বক্তব্যের অতিসরলীকরণ পুরোপুরি প্রশ্নাতীত নয়।

যে বিষয়টি বিবেচ্য তা হলো ১৯৭১-১৯৭৫ সময়কালে দুদেশের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা ছিল গভীর। বিশেষভাবে ভারত সরকারের মনোভাব ছিল ইতিবাচক। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন মহল রাজনৈতিক কারণে “ভারত বিরোধিতা” নিয়ে আসে সহজে জনমত প্রভাবিত করার কৌশল এবং নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির উপায় হিসেবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও এর প্রভাব দেখা যায়। একই সমান্তরালে ভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রতিকূল ধারা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদিতে ভারত সরকারও অনমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

আলোচ্য দশকে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক উত্থান-পতন লক্ষ্য করা যায়। নানা কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এবং এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার সুযোগও বিদ্যমান।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কোন না কোন পর্যায়ে ভারতীয় মনোভাব এবং প্রতিক্রিয়ার বিষয় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রায় চার দশক সময়কালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বহু চড়াই-উৎরাই লক্ষ্য করা যায়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশ জন্মলগ্নেই কিছু দ্বিপাক্ষিক সমস্যা লাভ করে। আবার কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীনতার পর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে সম্পর্কের সূচনা হয়। কিন্তু দুদেশের সৌহার্দ্য-বন্ধুত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ইতিবাচক সম্পর্ক উভয়ের জন্যই কল্যাণকর। বিশেষভাবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কোন বিকল্প নেই।

জাতীয় স্বার্থেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের জনৈক কূটনীতিক। তিনি লিখেছেন,

Bangladesh has a vital stake that neighbouring countries remain peaceful, stable and friendly or at least not unfriendly towards Bangladesh. Bangladesh has a more direct interest in making sure that hostilities between countries and within countries in South Asia do not occur.

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রাচীনকাল থেকে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যগত সাদৃশ্য এবং ভারতের ছয়টি রাজ্যের সঙ্গে ভূখণ্ডগত সম্পর্ক। ভাষা, জাতিগত মিলের ফলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষভাবে বাংলা ভাষাভাষি ভারতীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশের অধিবাসীদের জাতিগত সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার বন্ধন রয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী প্রাণের দায়ে, সম্ভ্রম রক্ষার জন্য সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। স্মর্তব্য, এই বিরাট সংখ্যক শরণার্থীর অনেকেই ছিল ভারত সরকারের ত্রাণ কার্যক্রমের বাইরে। সাধারণ ভারতীয় জনগণের সাহায্য-সহানুভূতিই ছিল শরণার্থীদের প্রধান সম্বল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলেও এই অঞ্চলের জনগণের মনোজগতে বড় ধরনের বৈরিতার জন্ম দেয়নি। এক ধরনের সহমর্মিতার বন্ধন অটুট ছিল।।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

এমনি ধরনের পারস্পরিক আস্থা, সহানুভূতির বন্ধনের কথা বললেও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ২/৩ বছরের মধ্যেই দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে কেবল নয়, এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও “India Factor” অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে স্বাধীনতা-উত্তর মুজিব সরকারের আমলে দেশের অভ্যন্তরে “ভারতবিরোধী” জনমতকে তোষণ করার জন্য। বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান, ওআইসি এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতি ও সহানুভূতি লাভের চেষ্টা চালায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধারা এখনও অব্যাহত। যে কারণে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচার-প্রচারণায় ভারত বিরোধিতা প্রাধান্য পায়। প্রধান দলগুলো একে অপরকে “ভারতের দালাল” বলে আক্রমণ করতেও দ্বিধা করে না। বাংলাদেশের জনগণের একটি অংশের মধ্যে “ভারতবিরোধী মনোভাব বিদ্যমান—এটা অস্বীকারের জো নেই। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের প্রতিও ভারতীয় জনগণের একটি অংশ বিশেষভাবে নয়াদিল্লির মনোভাব খুব একটা ইতিবাচক নয়। ভারতের রাজনৈতিক এলিটরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে এর পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছে।

কিন্তু কথা হলো ভারতীয় জনগণ এবং সরকারের অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে এবং বিশ্বের সরকারসমূহের উদাসীনতা ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন যে মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ত, সে অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন ছিল। সম্ভবত এমনিতর সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়টি দুদেশের সরকার এবং জনগণের মধ্যে পারস্পরিক প্রত্যাশাকে অবাস্তব পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুদেশের রাজনৈতিক এলিটদের শ্রেণীস্বার্থগত প্ররোচনা।

বর্তমান পারস্পরিক নির্ভরশীল বিশ্বে বাংলাদেশের মত ছোট এবং দুর্বল রাষ্ট্রের পক্ষে ভারতের ন্যায় শক্তিশালী নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে এক ধরনের বৈরী সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের সামর্থ্যের মধ্যে পড়ে কি না তা নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করার সময় এসেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণার সুযোগ বিদ্যমান। এই বিষয়ে ভারতসহ অন্যান্য দেশে দুএকটি গবেষণা যে হয়নি তা নয়। কিন্তু গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি, তাত্ত্বিক কাঠামো, ব্যবহৃত তথ্য উপাত্ত, সবশেষে একপেশে বিশ্লেষণ গবেষণাকর্মগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। এ বিষয়ে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

১.

নিম্নে আলোচিত গবেষণা গ্রন্থগুলোর বাইরে দেশ-বিদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জার্নালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলোতে দুদেশের সম্পর্কের নানা ইস্যু প্রাধান্য পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফারাক্কা সমস্যা, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, সীমান্ত সংঘর্ষ, ভারসাম্যহীন বাণিজ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা, আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রভৃতি। প্রবন্ধগুলো সুনির্দিষ্ট ইস্যু/সমস্যা জানতে সাহায্য করলেও স্বাভাবিক কারণেই সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধের পর্যালোচনা করতে গেলে তা বিরাট আকার ধারণ করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশনার পর্যালোচনা কেবল গ্রন্থ/গবেষণাকর্মের (এম.ফিল ও পিএইচডি) মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছে।

ড. এস. এস. বিন্দ্রা তার Indo-Bangladesh Relations, New Delhi, 1982 গ্রন্থে ১৯৭২-১৯৮১ পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্ক আলোচনা করেছেন। ভূমিকা উপসংহারসহ মোট ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন বিষয়বস্তুকে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম “Indo Bangladesh Relations: Mujib Era” এই অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়কালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি আলোচনা করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ভারত সরকার বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে আর দুদিন পরেই বাংলাদেশ নয়াদিল্লিতে ৯ ডিসেম্বর তার প্রথম দূতাবাসের উদ্বোধন করে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সূচনা এখান থেকে নয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধের গোড়াতেই ভারত সক্রিয় ইতিবাচক ভূমিকা নেয়। লেখক মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার বিস্তারিত আলোচনা করেননি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখ করেছেন। তবে এ সময়ে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিসমূহ, সরকারপ্রধানসহ দুদেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের সফরের আলোচনা আছে।

গুরুত্বপূর্ণ যে সব চুক্তি আলোচিত হয়েছে তা হলো, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব সহযোগিতা এবং শান্তি চুক্তি (১৯ মার্চ, ১৯৭২), পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে দিল্লি চুক্তি (২৮ আগস্ট, ১৯৭৩)। তবে এ সময়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুদেশের মধ্যে অনেকগুলো চুক্তি/প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। দুদেশের মধ্যে তিন স্তরভিত্তিক বাণিজ্য চুক্তি (২৮ মার্চ ১৯৭২), ভারত-বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ জুলাই তিন বছর মেয়াদী নতুন বাণিজ্য চুক্তি, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭৪ দুদেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য ১০ জুন ১৯৭২ আণবিক শক্তি ও মহাশূন্য গবেষণার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ ক্রীড়া, তথ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান বিনিময়ের জন্য দুবছর মেয়াদী প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এ সময়ে স্বাক্ষরিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হলো সীমান্ত চুক্তি (মে, ১৯৭৪)। উনিশশ পঁচাত্তরের সামরিক অভ্যুত্থান ও ইন্দো-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর প্রভাব আলোচনার মধ্য দিয়ে এই অধ্যায় শেষ করা হয়েছে।

আলোচিত অধ্যায়ের বিষয়বস্তুকে লেখক ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে পুনর্গঠন কার্যক্রমে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। সেই জাতীয় সঙ্কটকালীন মুহূর্তে ভারত ব্যতীত বাংলাদেশের বিকল্প কোন বন্ধু ছিল না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানী লেখকরা যেমন মনে করেন পাক-ভারত যুদ্ধ, তেমনি লেখকও প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। তিনি লিখেছেন,

“The dismemberment of Pakistan after the Indo-Pak war of 1971 alter the state structure of South Asia, “

৫ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার, জনগণ, সেনাবাহিনীর ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি মুজিবনগর সরকার, বাংলাদেশের জনগণের ত্যাগ, মুক্তিবাহিনীর অবদানকে অবহেলার চোখে দেখাটা ইতিহাসসম্মত হবে না। লেখক ভারতবিরোধী প্রচারণার কয়েকটি কারণ নির্দেশ করেছেন। এর মধ্যে বৃহৎ আকারের চোরাচালানী, ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণ, বাংলাদেশ সরকারের দৈনন্দিন প্রশাসনে ভারতীয় হস্তক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। ভারতবিরোধী প্রচারণার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক বাঙালিদের জাতিগতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি লিখেছেন,

“The Bengalis are emotional, sentimental and negative in their behaviour. They always wanted a scapegoat for their own follies. During the Pakistan rule they blamed West Pakistan for all the misfortunes and miseries. And after that they started using India as a tool in order to fulfil their desires. “

একজন ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি জাতি সম্পর্কে এমনি অসম্মানজনক মন্তব্য করা দুঃখজনক, তার অর্থ কি এই যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রাম কেবল অক্ষমতার প্রতিফলন ছিল? এই দৃষ্টিভঙ্গি মোটেই ইতিহাসসম্মত নয়। ভারতবিরোধী জনমতের জন্য পরোক্ষভাবে লেখক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছেন এভাবে,

“The Government of Bangladesh tried little to wipe out the misconceptions regarding India from the minds of the people of Bangladesh.”

এই অভিযোগও বস্তুনিষ্ঠ নয়। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার তার নিজের স্বার্থেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই ভারতবিরোধী প্রচারণায় ইন্ধন যোগাতে পারে না। বরং উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বক্তৃতা/বিবৃতিতে ভারতের ইতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। লেখক ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নানা দিক আলোচনা করতে গিয়ে এমন ধারণা দেবার চেষ্টা করেছেন যে, ভারত নানাভাবে বাংলাদেশের কল্যাণে উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণ অকৃতজ্ঞের মত ভারত বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি লেখক বিবেচনায় নেননি, তা হলো বাংলাদেশের জনগণের কতভাগ ভারত বিরোধিতায় অংশগ্রহণ করেছে এবং ভারতবিরোধী হবার জন্য প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতের কোন দায়-দায়িত্ব ছিল কি না? এই অধ্যায়ের শেষে লেখক ইন্দো-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুজিব আমলকে “স্বর্ণযুগ” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারপরও আমরা জানি মুজিব আমলের প্রায় চার বছর সময়কালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বহু ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম “Indo-Bangladesh Relations: Post-Mujib Era” বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। এই অধ্যায়ে জিয়াউর রহমানের মৃত্যু পর্যন্ত দুদেশের ঘটনাবলি আলোচনা করা হয়েছে। এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ভারতে মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে জনতা দলের সরকার গঠন। দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে অনেক টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়।

এই অধ্যায়ে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো—ভারতবিরোধী প্রচারণা, দুদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সীমান্ত সমস্যা, ফারাক্কা সমস্যা, জনতা দলের সময়ে ইন্দো-বাংলাদেশ সম্পর্ক, সীমান্তপথে অবৈধ অভিবাসন সমস্যা, নিউ মুর দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বিরোধ। এই সময়কালে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় আলোচনার মাধ্যমে ফারাক্কা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে রূপদানের চেষ্টা করে। অন্যদিকে ভারত সরকার বরাবরের মত দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে দুদেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে।

উল্লেখ্য জনতা দলের সরকার ক্ষমতাসীন হবার পূর্বে ফারাক্কা ইস্যুতে কোন অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে ফারাক্কা ইস্যুতে দুদেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে ফারাক্কা সমস্যার অতীত ইতিহাস, আইনগত দিক থেকে শুরু করে জনতা সরকারের আমলের স্বাক্ষরিত চুক্তির নানা দিক বিশেষভাবে ভারতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বড় অভিযোগ হলো,

“… the agreement was signed without keeping in mind the experts’ opinion and the national interest of India. “

৮ ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিক আলোচনায় একজন গবেষক হিসেবে লেখক বিষয়ের প্রতি বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির জন্য বাংলাদেশকেই দায়ী করেছেন একতরফা। চোরাচালান, ফারাক্কা সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা প্রভৃতি বাংলাদেশের একার পক্ষে সমাধান সম্ভব কি? অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার দায়ও লেখক এককভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। তার মতে,

“The economic relations between the two countries can be further developed provided Bangladesh Government takes maximum benefit by importing items from India. India is the only country from where Bangladesh can import items of its choice more easily and comparatively at cheaper rates.”

ভারতের বিশাল অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির পাল্লা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তবে দুদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক দাবি।

এই গ্রন্থের আরেকটি সীমাবদ্ধতার দিক উল্লেখ করা যেতে পারে। লেখক প্রাইমারি সোর্স (মুখ্য উৎস) ও সেকেন্ডারি সোর্স (গৌণ উৎস) হিসেবে একচেটিয়াভাবে ভারতীয় উপাদ । ব্যবহার করেছেন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি দলিলপত্র, সংসদ বিবরণী, বই, পুস্তক, পত্রপত্রিকা ব্যবহার করলে, উভয় দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ইস্যুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। যে কারণে লেখক ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে পেরেছেন হয়ত, কিন্তু বাংলাদেশের নয়।

শওকত হাসানের

“India Bangladesh Political Relations during the Awami League Government, 1972-75″

১০ অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ১৯৮৭ অপ্রকাশিত পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। হাসান তার অভিসন্দর্ভকে ভূমিকা, উপসংহার ছাড়া আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। এই অভিসন্দর্ভের মূল বক্তব্য হলো ‘৭২-৭৫ সময়কালে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ণয় করা। বিশেষভাবে উক্ত সময়কালে দুদেশের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কতটা সফল হয়েছে বা জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দুদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ বিশ্লেষণ করা।

উপরোক্ত গবেষণাকর্মে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য “influence relationship”-কে গ্রহণ করা হয়েছে। এই তত্ত্বের আলোকে লেখক দেখাতে চেয়েছেন দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পর পরস্পরকে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে বা হয়নি। অর্থাৎ ১৯৭২-৭৫ সময়কালে দুদেশের সম্পর্ক কেবল পারস্পরিক প্রভাবের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। যদিও একজন গবেষকের পক্ষে দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাবের বিষয় প্রমাণ করা খুব সহজ কাজ নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

প্রথম অধ্যায়ে “ইনফ্লুয়েন্স তত্ত্বের” যৌক্তিকতা আলোচিত হয়েছে, দ্বিতীয় অধ্যায়ে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় দুইশ বছরের ১৭৫৭-১৯৪৭ ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম “দি ফরমেটিভ ইয়ার্স, ১৯৭১ ৭২”। এই অধ্যায়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্থায়ী সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে যুদ্ধকালীন নীতিনির্ধারণের বিভিন্ন বিষয়/ঘটনা আলোচনা করেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির ওপর বিস্তারিত আলোচনা স্থান পেয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়ে প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের সমস্যাগুলো আলোচিত হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে নিরাপত্তার ধারণাগত ভিন্নতা নিয়ে তিনটি বিষয়ের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তা হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, ইসলামী সম্মেলন। সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ। সপ্তম অধ্যায়ে সীমান্ত সম্পর্কিত আলোচনা স্থান পেয়েছে। এই অধ্যায়ে স্থল সীমান্ত, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ ও বঙ্গোপসাগরে তেল অনুসন্ধানের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। অষ্টম অধ্যায়ে গঙ্গার পানির হিস্যার ওপর আলোচনা করা হয়েছে। আর নবম অধ্যায়ে উপসংহার।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমান আধিপত্যের প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। মুসলিম শাসনকালে হিন্দুরা কিভাবে ক্ষমতা ও মর্যাদা হারায় এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে হিন্দুরা অনেকাংশে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনকে অনিবার্য করে তোলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হিসেবে পাকিস্তানের দুঅংশের নানা বৈষম্য আলোচনা করেছেন। এবং পাকিস্তানের দুঅংশের ভারতের প্রতি বিপরীতধর্মী মনোভাব গ্রহণের কারণও ব্যাখ্যা করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ভারতের প্রতি বিদ্বেষ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। লেখক এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসত্তা অর্জনের ফলে বাঙালি হিন্দু তথা ভারত সম্পর্কে তিক্ততা হ্রাস পায়। এর সঙ্গে যুক্ত করা যায়। যে, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে চর্চা শুরু হয়, ক্রমে এই ধারা বেগবান হয়েছে। যে কারণে কাশ্মীর ইস্যু বা দ্বিজাতিতত্ত্ব পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে সেই মাত্রায় গৃহীত হয়নি। লেখক উল্লেখ করেছেন,

“The leaders of West Pakistan, who now constituted the Muslim League leadership, were still preoccupied with the two-nation theory, the fundamental premise of which was the Hindu Muslim dichotomy “

১১ পশ্চিম পাকিস্তানে ধর্মীয় রাজনীতি বা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য বজায় রাখলেও, পূর্ব পাকিস্তানে সেক্যুলার রাজনীতি শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। লেখক যথার্থই দেখিয়েছেন যে, পূর্বাঞ্চলে “secular territorial nationalism” একটা স্পষ্ট আকার ধারণ করছে। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও পূর্ব পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে পাক-ভারতের ঐতিহ্যগত শত্রুতার সম্পর্কের আলোকে দেখেনি। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের সুপ্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠছে।

সত্তরের সাধারণ নির্বাচন-উত্তর ঘটনাবলি আলোচনা করতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করেছেন,

“The East Pakistanies launched a movement of civil disobedience protest the postponement of the opening of the National Assembly.”

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পরিপ্রেক্ষিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তা “আইন অমান্য আন্দোলন” নয় বরং অসহযোগ আন্দোলন নামে পরিচিত। লেখক আন্দোলনের যেমন ভুল নাম দিয়েছেন, তেমনি আন্দোলন পরিচালনাকারী দল বা নেতারও উল্লেখ করেননি।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের অন্যান্য বিরোধী দলের অংশগ্রহণে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট বা জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। শওকত হাসান উল্লেখ করেছেন যে, এক প্রকার ভারত সরকারের চাপের মুখেই অস্থায়ী সরকার বাধ্য হয়ে ৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। এমনি সুনির্দিষ্ট মন্তব্যের জন্য যে সুস্পষ্ট প্রমাণের প্রয়োজন তা হাজির করতে পারেননি। এমনকি মওলানা ভাসানীও মুক্তিযুদ্ধকালে জাতীয় সরকার গঠনের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ব্যতীত অন্য যে কোন দলের বা মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী বিরোধী দলসমূহের সরকার গঠিত হলে তা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।

লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী অস্থায়ী সরকার সম্পর্কে তিনটি নেতিবাচক মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তার নিজের নেওয়া সাক্ষাৎকারও এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন। বলা হয়েছে যে অস্থায়ী সরকার ছিল “phoney government”। এ ছাড়া এই সরকারকে “দুর্বল”, “অযোগ্য” সরকার বলে অভিহিত করা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে যে, অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বের প্রতি মুক্তিবাহিনীর কোন আস্থা ছিল না। বলা হয়েছে, অবরুদ্ধ ঢাকায় যাঁরা ছিলেন তারাও বিশ্বাস করতেন যে, অস্থায়ী সরকারের সদস্যরা কলকাতায় “gourmandized and womanized”-এ ব্যস্ত ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কেবিনেট কে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সাথে [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কেবিনেট কে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সাথে [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

অস্থায়ী সরকার সম্পর্কে যে মন্তব্যগুলো করা হয়েছে তা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে মাত্র নয় মাসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো তা কিভাবে, কার নেতৃত্বে? পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানী লেখকদের অভিযোগই সঠিক বলে প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, ভারতের ষড়যন্ত্রের ফসল।

বস্তুত মুজিবনগর বা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি সম্ভব হয়। মুজিবনগর সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি, মুক্তাঞ্চলে জোনাল কাউন্সিল গঠন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুজিবনগর সরকারের সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতার দিক ছিল না বলা যায় না, তবে মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির কৃতিত্বও অবশ্যই অস্থায়ী সরকারকে দিতে হবে।

ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজমের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আদর্শ হিসেবে লেখক ধর্মনিরপেক্ষতা ও এর প্রয়োগ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরেছেন। প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে, আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের কারণে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সমর্থন লাভ সম্ভব হয়। এটা স্বাভাবিক যে, আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যকার আদর্শগত সাদৃশ্য ভারতের নীতিনির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আদর্শগত উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার অর্থ এই নয় যে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করা হয়। তা নয় বরং দুটির সমন্বয়ে সম্পর্ক তৈরি হয়।

পাকিস্তানের রাষ্টীয় আদর্শ মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিপরীতে আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণ করে। তারপরও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা কৈ অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণকে ভারতের প্রভাবের ফল হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

“Secularism was a manifestation of Indian influence.”

কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার ১৫ বছর পূর্বেই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি গ্রহণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড় ভিত্তি হিসেবে সংবিধানে গৃহীত হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]

লেখক ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি এবং এর প্রায়োগিক বিষয়ে আওয়ামী নেতৃত্বে ধারণাগত অস্পষ্টতার উল্লেখ করেছেন। ভারতে ও বাংলাদেশে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রায়োগিক পার্থক্যের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

“Secularism as practised by the Awami League was similar to that of the Congress. But after independence the concept of secularism underwent a qualitative change, it was given a more literal interpretation: separation of religion from all worldly matters.”

সঙ্গত কারণেই দুটি দেশে একই আদর্শ বাস্তবায়নে ভিন্নতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন উভয়ে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী দুটি রাষ্ট্র। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তবায়নে দুটি দেশ ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশে পার্থক্য থাকতেই পারে। বিচার্য বিষয় হলো উক্ত আদর্শের প্রতি তারা আন্তরিক ও সৎ ছিল কি না।

ভারত উপমাদেশে বাংলাদেশ একমাত্র রাষ্ট্র যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশ প্রথম রাষ্ট্র যেখানে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতে ১৯৭৭ সালে ধর্মনিরপেক্ষতা সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে। ভারতে মৌলবাদী দলের কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা আর বাংলাদেশে মৌলবাদী দলের কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা এক নয়। জনাব হাসান বলেছেন আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে নানা মত ও পথের স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়। এবং যেহেতু ভারতে জনসংঘ, জামায়াতে ইসলামী এবং আকালী দলের মত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]

এখানে একটি তথ্যগত ত্রুটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তা হলো ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার পরপর ভারতে উগ্রসাম্প্রদায়িক দল হিন্দু মহাসভাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল! সুতরাং ভারতে মৌলবাদী দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়নি এটা ইতিহাসসম্মত নয়। ১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি তথাকথিত ইসলামী দলগুলো আদর্শগতভাবে বাংলাদেশকে পরিহার করেছে তাই নয় বরং পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে নানা রকমের অত্যাচার, নির্যাতনের মাধ্যমে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রতিহত করতে।

ভারতের মৌলবাদী দলগুলো ভারতের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেনি। বাংলাদেশের মৌলবাদী দল সম্পর্কে একই মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং স্বাধীনতার পর জনমতের যৌক্তিক প্রতিফলন হিসেবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের সময়কালে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিদায়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমতি প্রদান করা হয়।

লেখক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আবুল ফাতেহের সাক্ষাৎকার থেকে সেক্যুলারিজম সম্পর্কে উদ্ধৃত করেছেন যে,

“Secularism came by compulsion because Mujibnagar government was in India and heavily dependent on India for moral, material and diplomatic support. Its secular policy existed only to the extent that the party opened its doors to the Hindus”.

১৪ মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পূর্বে আওয়ামী লীগ সেক্যুলার রাজনীতি গ্রহণ করে। সুতরাং এটাকে “ভারতীয় বাধ্যবাধকতা” হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না। একটি আদর্শ, কোন বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে তা গ্রহণ করা যায় না। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন তার সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা একটি আদর্শ, পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদের বিপরীতে এই আদর্শের জন্ম। এটি কোন বিশেষ সংখ্যালঘু বা হিন্দুদের খুশি করা বা ভারতীয় প্রভাবের ফল নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman when she called on April 10, 1974. ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ PD/NRS/Apr.74 M32GI/A63(36)Prime Minister Indira Gandhi in conversation with the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Mujib-ur-Rehman ]
সেক্যুলারিজমের প্রতি হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেখক আওয়ামী মন্ত্রিসভার জনৈক হিন্দু মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া উদ্ধৃত করেছেন যে,

“পাকিস্তান আমলে হিন্দুরা স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ভাল ছিল। কারণ পাকিস্তান আমলে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হিসেবে আইনগতভাবে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হত। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে বিশেষ অধিকার রহিত করা হয়।”

১৫ লেখক যে হিন্দু মন্ত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, তার নাম উল্লেখ করেননি, এমনকি তার সাক্ষাৎকারও লেখক নিজে সে সময় নেননি। ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার ১৯৭২ সনে উক্ত হিন্দু মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আর লেখক ১৯৮৫ সনে নায়ারের কাছ থেকে উক্ত তথ্য পেয়েছেন। এই তথ্যটি oral history বা oral evidence-এর অন্তর্গত। সাম্প্রতিক বিষয়ে কাজ করতে গেলে oral history/oral evidence-এর ব্যবহার প্রায়ই অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু oral evidence ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতার প্রয়োজন। বিশেষভাবে এমনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জরুরি, যা এখানে করা হয়নি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে অন্তহীন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তার দুটি এখানে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রথমত, মিত্রবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে লে. জে. অরোরার নিয়োগ,

দ্বিতীয়ত, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কর্নেল ওসমানীর অনুপস্থিতি।

উল্লিখিত বিষয় দুটিতে বিতর্কের অবসান ঘটানোর মত দালিলিক প্রমাণ যেমন নেই, তেমনি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি। ওসমানীকে যৌথ বাহিনীর প্রধান না করার বিষয়ে লেখক অস্থায়ী সরকারের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করেছেন যা তার ভাষায় “ভারতের দয়ার” ওপর নির্ভরশীল ছিল। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কর্নেল ওসমানীর অনুপস্থিতি বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দেয়। লেখক মন্তব্য করেছেন,

“The Indian Army had came at the eleventh hour and seized the victory that belonged to it [Muktibahini].”১৬

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সে সম্পর্কে লেখকের ধারণা খুব একটা স্পষ্ট নয় বলে মনে হয়। একাত্তরে জুন-জুলাই মাস থেকেই সীমান্ত রক্ষীবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকমের সহায়তা দিতে শুরু করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণসহ অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা করে।

কেবল যৌথ কমান্ডের অধীনে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এমন ভাববার কোন কারণ নেই। অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এমনকি কোথাও কোথাও ভারতীয় সেনা সদস্য মৃত্যুবরণ করে ও পাকবাহিনীর হাতে বন্দিও হয়। সুতরাং ভারতীয় বাহিনী “at the eleventh hour”-এ এসে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে বলা ইতিহাসসম্মত নয়।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কেন কর্নেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না, এ বিষয়ে লেখক কর্নেল ওসমানীর বক্তব্য উপস্থাপন করলে যথাযথ হতে পারত। কারণ লেখক কর্নেল ওসমানীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, সুতরাং তার সুযোগ ছিল কর্নেল ওসমানীর কাছ থেকে এ বিষয়ে অবহিত হওয়ার। তা না করে লেখক তার মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

১৯৪৭ সনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র বিখ্যাত “দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম। দ্বিজাতিতত্ত্বের মৌল বক্তব্য হলো ভারতে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলমান দুটি জাতি এবং জাতি গঠনে ধর্মই প্রধান ভূমিকা রাখে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাত মাসের মধ্যে ভাষার প্রশ্নে বাঙালিদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়।

ক্রমে এই বিরোধ বিস্তৃত হয়েছে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্যে। যার অনিবার্য পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বা ধর্মীয় জাতীয়তার প্রত্যাখ্যান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড় স্তম্ভ। কেবল ধর্মের ভিত্তিতে যে জাতি গড়ে ওঠে না তার প্রমাণ বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তারপরও দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি লেখকের গভীর আস্থা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। যখন তিনি মন্তব্য করেন যে,

“The validity of the theory remains unchallenged”

পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে যাবার পরও কিভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বৈধতা অব্যাহত থাকে তা বোধগম্য নয়। লেখক এ প্রসঙ্গে আরো মন্তব্য করেছেন যে,

“East Bengal’s independence neither invalidated the justification for theocratic states, nor validated secular statehood.”

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের আমলে পরিত্যক্ত হয়। তথাপি বাংলাদেশ একটি ‘theocratic state’-এ পরিণত হয়নি।

পূর্ববঙ্গের “personality” ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক বাঙালির মুসলমান পরিচয় ও বাঙালিত্বকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন। এমনি বক্তব্য ইতিহাসসম্মত নয়। এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন যে,

“হিন্দু-মুসলমানের ক্ষেত্রে বাঙালি পরিচয়টাই প্রাধান্য পেয়েছে বা এই পরিচয়ের ধারাবাহিকতা বিভিন্ন সময় এলিট বা রাষ্ট্র নষ্ট করতে চাইলেও পারেনি। এই বোধের কারণেই হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বদলে বাঙালিত্বের বিভিন্ন উপাদান রক্ষার ব্যাপারে যৌথ লড়াই হয়েছে।”১৭

উপরন্তু শওকত হাসান মনে করেন, যুক্তবাংলায় এবং পাকিস্তানে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা “exploited equally” (p. 98) ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশের অংশ হিসেবে দুই বঙ্গের মধ্যে যে শোষণ প্রক্রিয়া আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দুটি অংশের মধ্যে শোষণ কিভাবে সমান হতে পারে। এমনি বক্তব্যের পক্ষে তথ্য বা পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেননি।

Surrender of Pakistani Army at Dhaka
Surrender of Pakistani Army at Dhaka

 

চতুর্থ অধ্যায়ে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির ওপর বিস্তারিত আলোচনা স্থান পেয়েছে। নানা দিক আলোচনা করেছেন। চুক্তির বিভিন্ন ধারা ও দশটি অনুচ্ছেদ কি কি আছে তা বর্ণনা করা হয়েছে। চুক্তির প্রতি দুদেশের প্রতিক্রিয়ার আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, নেতৃবৃন্দের বক্তব্য বিবৃতি প্রাধান্য পেয়েছে। ভারতীয় পক্ষ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করায় তা উল্লেখ করা হয়নি। কেন ভারতীয়রা ইতিবাচক মনে করল তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে,

“As far as Indian self-interest was concerned India would not be disadvantaged in any way from a friendship treaty with Bangladesh,”১৮

অন্যদিকে বাংলাদেশ পক্ষের সরকারি দল ও চুক্তির বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য আলোচনা করা হয়েছে। বিরোধীদের মধ্যে মওলানা ভাসানীর সাত দলীয় অ্যাকশন কমিটি, মোহাম্মদ তোহার কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (এমএল), মাওপন্থী অন্য ক্ষুদ্র গ্রুপগুলোও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। এ ছাড়া ডানপন্থী দলগুলোও এই চুক্তির বিরোধিতা করে তীব্র ভাষায়, উল্লেখযোগ্য হলো মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক লীগ এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জাসদ) চুক্তির বিরোধিতা করে।

তবে মণি সিংহের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর আহমদের মস্কোপন্থী ন্যাপ সক্রিয় সমর্থন না করে “maintain a neutral posture”। এই নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার কারণ হিসেবে লেখক উল্লেখ করেছেন দল দুটির ক্ষমতার অংশীদার হবার বাসনা যা ১৯৭৫-এ বাকশালে যোগদানের মাধ্যমে সফল হয় বলে লেখক মনে করেন।

তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আতাউর রহমান খানও বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। সুতরাং চুক্তি সম্পাদনের তিন বছর পরে বাকশালে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে মণি সিংহ বা মোজাফফর আহমদ চুক্তির সমালোচনা থেকে বিরত থেকেছেন এমন বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং রাজনৈতিক আদর্শগত কারণ ও ভারত-সোভিয়েত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি দলের অবস্থান বিবেচনা করা উচিত।

চুক্তি সম্পর্কে লেখক, মওদুদ আহমদের গ্রন্থ “Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman”১৯ এবং চীনপন্থী সাংবাদিক এনায়েত উল্লাহ খানের ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে থেকে চুক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। এই দুজনই ভারতবিরোধী ও আওয়ামী লীগবিরোধী, দুজনই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে কোন বিষয়ে তাদের মন্তব্য যে নেতিবাচক হবে এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? যেখানে এনায়েত উল্লাহ খান নিজেই নিজেকে “pathologically anti Indian” হিসেবে অভিহিত করতে পছন্দ করেন।

চুক্তির প্রতিটি ধারা লেখক বর্ণনা, বিশ্লেষণ করেছেন, দুটি সার্বভৌম, স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। চুক্তির কোন ধারা এমন ছিল না যে, এক পক্ষের ওপর প্রযোজ্য অন্য পক্ষের ওপর নয়। চুক্তিটি ভারতের জন্য ইতিবাচক হলে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কেন? তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও যথেষ্ট প্রমাণসহ উপস্থাপিত হয়নি। জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন চুক্তি প্রসঙ্গে বলেন,

“I fail to understand which aspect of this treaty is contrary to our interests…… Every clause of the treaty is equally applicable to either country.”

অন্যদিকে ভাসানীর মূল। দাবি ছিল

“ to rid the country of this treaty”২০

মৈত্রী চুক্তির পটভূমির আলোচনা শুরু হয়েছে ইয়াহিয়া-মুজিব সংলাপের ব্যর্থতা থেকে। মৈত্রী চুক্তির উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে অস্থায়ী সরকার ভারতের সঙ্গে কোন “বিশেষ চুক্তির” উদ্যোগ নিয়ে ছিল কি না? চুক্তির শর্ত কি ছিল? বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুদেশের মধ্যে কোন গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল কি না? ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া চুক্তি বিষয়ে মুজিব সরকারের কৌশলগত ব্যর্থতা, কেন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়? চুক্তির ধারার পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা, চুক্তির আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিত আলোচনা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর হয়েছিল তার নৈর্বক্তিক গবেষণা আজও হয়নি। তবে ভারতবিরোধী মনোভাবে ইন্ধন যোগাতে বেশ কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডানপন্থী ও চীনপন্থী বামরা একই কণ্ঠে “গোলামির চুক্তি” বলতে দ্বিধা করেননি। পরিহাসের বিষয়ে হলো পঁচাত্তর-পরবর্তী কোন সরকারই এই চুক্তি বাতিল করেননি। কালক্রমে এমনিতেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এবং তা পুনরায় নবায়নের ক্ষেত্রে কোন পক্ষই আগ্রহ দেখায়নি।

পঞ্চম অধ্যায়ে দুদেশের সম্পর্কের প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শওকত হাসান মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতীয়দের জন্য “economic windfall” বয়ে আনবে বলে ভারতীয়দের মধ্যে প্রত্যাশা কাজ করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ সরকারের কাছেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত ব্যতীত উল্লেখযোগ্য বিকল্প ছিল না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সময়কালে অনেকগুলো বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়। প্রথম বাণিজ্য চুক্তিটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ। এই চুক্তিতে সীমান্ত বাণিজ্যের কারণে অচিরেই দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর মূল কারণ ছিল চোরাচালান। চোরাচালানের প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র ভাষায় ভারতবিরোধী ও আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালায়। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৭৩ সালে জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ভারত তিন বছর মেয়াদী বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরের বছর সামিট মিটিং-এ ইকোনমিক প্যাক্ট স্বাক্ষরিত হয়। আরো দুটি বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তা হলো ভারতে পাট বিক্রয় ও বাংলাদেশের মুদ্রা ছাপানো। মওলানা ভাসানী ভারতীয় পণ্যের বিরুদ্ধে অবরোধের ঘোষণা দেন। এনায়েত উল্লাহ খানের পত্রিকা “হলিডে”তে দুদেশের বাণিজ্যকে “colonial trade” হিসেবে অভিহিত করা হয়।

দুদেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক ঘাটতি, চোরাচালান নিয়ে সরকারের ভূমিকা সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল তা বলা যাবে না। সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি দেশে পর্বতসম সমস্যার মুখে সরকারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। এ ছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি ও চোরাচালানের বিষয়টি পরবর্তী সরকারগুলোর আমলেও যে সন্তোষজনক মাত্রায় সমাধান হয়েছে তা নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

ষষ্ঠ অধ্যায়ে দুদেশের মধ্যে নিরাপত্তার ধারণাগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের নিরাপত্তা ধারণা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে উপমহাদেশের “ব্যালেন্স অব পাওয়ার” পরিবর্তিত হয়ে যায়। এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিশেষভাবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানজনিত কৌশলগত গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।

ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মোকাবেলায় বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান আমলে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সহায়তা পেলেও বাংলাদেশ আমলে তা বন্ধ হয়ে যায়।

নিরাপত্তা ধারণার ক্ষেত্রে বড় বিতর্ক দেখা দেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আকার, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও সামর্থ্য নিয়ে। সর্বোপরি এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এর সঙ্গে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারী সেনা সদস্যদের সেনাবাহিনীতে নেয়া হবে কি না? লেখক দুক্ষেত্রেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক মনোভাব তুলে ধরেছেন। ভারতের সামরিক, বেসামরিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, বাংলাদেশের স্থায়ী বড় আকারের সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই কারণ “”Bangladesh had no external security concern.”।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন জাতীয় ইস্যু যেমন, সংবিধান প্রণয়ন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা এবং বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে পুরো মনোযোগ প্রদান করে। যে কোন কারণেই হোক বাংলাদেশ সরকারের কাছে দেশের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনায় আসেনি।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল বা এখনো আছে। সেনাবাহিনী বিষয়ে তাদের একটা আশঙ্কা ছিল যে, পাকিস্তানের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরে যাঁরা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা প্রত্যেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষিত এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রক ভূমিকা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। অবশ্য পাক সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবীদেরই শুধু একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। বাঙালি সেনা সদস্যদের ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারগণই স্বাধীনদেশে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ন্যায় তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও শক্তিশালী দেখতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণে বাংলাদেশ তাদের যুদ্ধের ফসল। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্ব তারা বড় করে দেখেননি।

স্বাধীনতার পরপর সেনাবাহিনী নিয়ে যে বিতর্কের জন্ম হয়, তার অবসান এখনো হয়নি। বরং জাতীয় স্বার্থে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী একটি প্রতিরক্ষা নীতি ও সেনাবাহিনীর কাঠামো অদ্যাবধি দাঁড় করানো গেল না। দুঃখজনক হলো ক্রমে এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ. এন. এম নূরুজ্জামান, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ. এন. এম নূরুজ্জামান, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান

 

অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর গঠন, এর প্রেক্ষাপট, প্রশিক্ষণ, রাজনীতিতে প্রভাব এবং দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে নানামুখী চিন্তাভাবনার অবতারণা হয়।

তাজউদ্দিন আহমদ চেয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর সবাইকে “ন্যাশনাল মিলিশিয়া”তে অন্তর্ভুক্ত করবেন। কিন্তু পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহৎ অংশ আবার পড়াশুনায় ফিরে যায়। ১০-১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে নেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শনকারীদের সেনাবাহিনীতে গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু জেনারেল ওসমানী মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বল প্রশিক্ষণের কারণে প্রত্যেককে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেন।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি স্বতন্ত্র প্যারামিলিটারি বাহিনীর প্রস্তাব করেন যা জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। এই বাহিনীর পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র প্রশিক্ষণ সর্বোপরি এই বাহিনীর কর্মতৎপরতা দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কোন সমস্যার জন্য ভারতকে দায়ী করা একটা রাজনৈতিক ফ্যাশনে পরিণত হয়।

এর একটা কারণ হতে পারে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা, রক্ষীবাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করা হয়েছে একই সঙ্গে ভারতকেও দোষারোপ করা হয়। মওলানা ভাসানী ও এনায়েত উল্লাহ খান প্রায় একই ভাষায় সমালোচনা করেছেন রক্ষীবাহিনীর। হলিডেতে বলা হয় যে

“It is an extension of the CRP (Central Reserve Police of India) to safeguard an obliging government of the Indian ruling class and the expansionist interests of Indian sub imperialism.”

দুঃখজনক হলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ সব মন্তব্যের কোন বাস্তব ভিত্তি ছিল না। যা পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে লেখকও যুক্তিযুক্ত মন্তব্য করেছেন যে,

“Although the people had become wise to the fact that the Jatio Rakkhi Bahini was not an Indian Paramilitary force” 25

ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় সদস্যপদ গ্রহণ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন যে, ভারত চায়নি বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য হোক, কারণ এতে করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। কিন্তু মুজিব এ সব আপত্তিকে আমলে নেননি। তিনি মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ গ্রহণ করে। এটাকে ভারতবিরোধীরা বলার চেষ্টা করেছে যে, “Mujib was frustrated with India (p. 203)”। প্রকৃতপক্ষে এটা ব্যক্তি মুজিবের হতাশা হিসেবে দেখা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ তখন বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি ও সাহায্য লাভ জরুরি ছিল ।

সপ্তম অধ্যায়ে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তা হলো, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং বঙ্গোপসাগরে তেল অনুসন্ধান। ১৯৭৩ সনের মাঝামাঝি থেকে দুদেশের মধ্যে সীমান্ত বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দুদেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ছিটমহলসমূহের পারস্পরিক হস্তান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ৬১ বর্গকিলোমিটারের অধিক ভূমি লাভ করে।

Satellite image of Bangladesh 2001 কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা বাংলাদেশের আলোকচিত্র Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

তথাপি বেরুবাড়িকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলো মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ভূখণ্ডগত সার্বভৌমত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন এবং মওলানা ভাসানী সবাই ভারতের নিকট দক্ষিণ বেরুবাড়ি হস্তান্তরের তীব্র নিন্দা জানায়। একদিকে বাংলাদেশ বেরুবাড়ি হস্তান্তর করে ভারতের কাছে অন্যদিকে চুক্তি মোতাবেক ভারত বাংলাদেশের নিকট তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তরের কথা। কিন্তু ভারত সরকার তাদের পার্লামেন্টে সীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থন করতে না পারার কারণে বাংলাদেশ তিন বিঘা করিডোরের মালিকানা লাভ করেনি। এটাও দুদেশের সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

সামুদ্রিক সীমা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে দুদেশের আলোচনায় এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় । “base point” নির্ধারণের ক্ষেত্রে জটিলতার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে দুদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে তালপট্টি দ্বীপ বা নিউ মুর দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দুদেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগর এলাকায় তেল অনুসন্ধান নিয়ে দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধের একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে ভূ ও সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ সমস্যা। পরিতাপের বিষয় এখনো পর্যন্ত দুটি দেশ পরস্পরের নিকট সন্তোষজনক কোন সীমান্ত নীতি গ্রহণে সক্ষম হয়নি। অথচ প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে সুসম্পর্কের এটি অন্যতম পূর্বশর্ত।

অষ্টম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তা হলো ফারাক্কা ইস্যু। বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে এই সমস্যা লাভ করে। ১৯৬০-এর দশকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিশেষজ্ঞ ও সচিব পর্যায়ে বহু মিটিং হলেও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগ পর্যন্ত কোন সমাধান অর্জন সম্ভব হয়নি। গঙ্গা অববাহিকা, ফারাক্কা বাঁধ এবং গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে দুদেশের আলাপ-আলোচনার দীর্ঘ ইতিহাস বিবৃত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে, সচিব/মন্ত্রী পর্যায়ে এবং যৌথ নদী কমিশনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সভা হলেও দুপক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার কারণে কোন অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি।

গঙ্গার পানির হিস্যার বিষয়টি দুদেশেই অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবেশ, অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং নিজ নিজ দেশের জনমত। বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, ভারতেও বাংলাদেশের প্রতি আবেগ উচ্ছ্বাস হ্রাস পেতে শুরু করে। তা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্বদানকারী খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং বি. এম. আব্বাস উভয়ে ভারতবিরোধী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। অবস্থার যথেষ্ট অবনতির পর মোশতাকের জায়গায় সেরনিয়াবাতকে নিয়োগ করা হয়। অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধীও ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে রাও-এর পরিবর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে নিয়োগ করেন। অর্থাৎ দুদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল সম্পর্কোন্নয়নের। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানা সমস্যার কারণে গ্রহণযোগ্য সমাধানে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব পরিবার সহ ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Begum Mujib with Family & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব পরিবার সহ ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Begum Mujib with Family & Srimathi Indira Gandhi ]

লেখক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য “influence theory” গ্রহণ করেছেন। এই তাত্ত্বিক কাঠামো গ্রহণ করবার কারণে প্রতিটি বিষয়ে লেখক কে, কাকে প্রভাবিত করছে সে আলোকে বিবেচনা করেছেন কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময় influence-এর ঘটনা ঘটে না। influence-এর বিষয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অন্তর্নিহিত একটি বিষয়। লেখক সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার তেমন একটা নিতে পারেননি, উপরন্ত এতদসংক্রান্ত সরকারি দলিল-দস্তাবেজও ব্যবহার করতে পারেননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংগত কারণেই লেখক প্রশ্নাতীতভাবে এক রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অন্য রাষ্ট্র কতটা প্রভাবিত করেছে তা প্রমাণ করতে পারেননি। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ, মুজিবনগর সরকার, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার বিশ্লেষণে লেখক “গবেষকের নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকা” ক্ষুণ্ন করেছেন।

ইফতেখার এ. চৌধুরী Bangladesh’s External Relations অপ্রকাশিত পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মে ১৯৮০ (২২ আলোচ্য অভিসন্দর্ভের বিষয়বস্তুকে লেখক মোট ১১টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। বিভিন্ন দেশ/অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আলোচনার পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত দিক বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পরাশক্তি চীন, মধ্যপ্রাচ্য, বার্মা ও নেপাল, জাতিসংঘসহ তৃতীয় অধ্যায়ে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে।

এখানে তৃতীয় অধ্যায়ের অংশ বিশেষ, যেখানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে, তার ওপর আলোচনা সীমিত রাখা হবে। লেখক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আলোচনা করতে গিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্ব থেকে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত ভারতের ভূমিকা একই রকম ছিল না। শুরুতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমাগত শরণার্থীর চাপ বৃদ্ধি ও জাতীয় রাজনীতিতে ভারত সরকারের ওপর চাপ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল সমীকরণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে সুনির্দিষ্ট ও প্রত্যক্ষ করে দেয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান, বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে কেন্দ্র করে নানামুখী সমস্যা, পরাশক্তিসহ বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যাশিত সমর্থন না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক প্রস্তুতির বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখক তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

এপ্রিল মাসের শেষ দিকেই অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের রাষ্ট্রপতি কাছে “তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি”র অনুরোধ জানিয়ে পত্র দেন। আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠার বহুপূর্বে মার্চ মাসের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ পালিত হয় স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, লোকসভাসহ বিভিন্ন বিধানসভা এবং ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো “তাৎক্ষণিক” স্বীকৃতির দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে।

অস্থায়ী সরকার কেবল ভারতের কাছে স্বীকৃতি দাবি করেছে এমন নয়, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃতির আহ্বান জানান। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতের অর্থনীতির জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করে তাই নয়। এই সমস্যা থেকে আরো অনেক সমস্যার জন্ম হয়।

“They (refugees) upset the demographic balance of some of the Muslim majority west Bengali border districts, increasing the likelihood of communal tensions there.”20

শরণার্থী সমস্যার কারণে কেবল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি নয়, কোথাও কোথাও দাঙ্গার উপক্রমও হয়। শরণার্থী সমস্যার আরেকটি জরুরি দিক লেখক উল্লেখ করেননি তা হলো দুর্বিষহ বেকার সমস্যায় আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গের শ্রম বাজারে শরণার্থী বনাম স্থানীয়দের প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া শরণার্থীদের ভারত সরকারের ত্রাণ প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছিল। শরণার্থীর পেছনে অপ্রত্যাশিত ব্যয়ের ফলে ভারতের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বেশ বিঘ্নিত হয়। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে শরণার্থীর ভরণপোষণে ৭০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হিসাব করা হয়। যা অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে।

চীনা-আমেরিকান কূটনৈতিক প্রয়াসের পরিপ্রেক্ষিতে “some sort of Bangladesh”-এর অভ্যুদয় সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো খন্দকার মোশতাককে কেন্দ্র করে মার্কিন উদ্যোগ সফল হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না বললে অত্যুক্তি হবে না হয়ত। কারণ মোশতাকের প্রস্তাব মূল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তথা মুজিবনগর সরকার বা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা কারো কাছেই গৃহীত হবার কোন কারণ ছিল না। লেখক “এক ধরনের বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে সম্ভাবনার কথা বলেছেন তা কেন বাস্তবায়িত হয়নি তার কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে “হিন্দু শরণার্থী এবং ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী” বলে মন্তব্য করেছেন।

লেখকের বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি হিন্দু শরণার্থী এবং ভারতের স্বার্থের বিষয়। এখানে বাংলাদেশ, মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযোদ্ধা, জনগণ তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। বাস্তবতা হলো মার্চ এপ্রিল মাসের দিকে হয়ত এক ধরনের রাজনৈতিক সমাধান অর্জন সম্ভব ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বর, অক্টোবরের দিকে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ ব্যতীত, তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধান কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।

আর একটি দুঃখজনক বিষয় হলো লেখক কিভাবে পাকিস্তানী দৃষ্টিকোণ দেখে বিষয়টি বিবেচনা করলেন। কারণ পাকিস্তান পুরো একাত্তর জুড়ে প্রচারণা চালিয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ বলতে কিছু নেই, পুরো বিষয়টি ভারতের ষড়যন্ত্রের ফল। এটি পাক-ভারতের বিষয় আর জড়িত পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা। লেখকও এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন।

ভারত সরকারও প্রথম দিকে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেয়। যে কারণে ভারত সরকার স্বীকৃতি প্রদান থেকেও বিরত থাকে। ক্রমে সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়ে। চূড়ান্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে ভারত অভ্যন্তরে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শক্তি বৃদ্ধির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরিণতিতে যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় ঘটে।

স্বাধীনতার পরপর ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, বাণিজ্য, পাকিস্তানী যুদ্ধ বন্দিদের বিচার, যৌথ নদী কমিশন, দুদেশের মধ্যকার মৈত্রী চুক্তি, ইত্যাদি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের অসন্তোষের কারণ নিয়েও আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে লেখক মন্তব্য করেছেন যে,

“It was on the Trade front that cracks in bilateral relations began to appear. “২৪

এর জন্য তিনি প্রথমে দায়ী করেছেন চোরাচালান, এ ছাড়া ভারতীয় পণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য এবং ভারতের মারওয়ারি ব্যবসায়ীদের শোষণমূলক মনোভাবকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চারটি বিষয় লেখক আলোচনা করেছেন। যথা ফারাক্কা বাঁধ, territorial water, ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণ, সিকিমের সংযুক্তি বিশেষভাবে ফারাক্কা ইস্যু এবং সামুদ্রিক জলসীমা চিহ্নিত করা নিয়ে দুদেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হলেও দুপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন সমাধানে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়। যা দুদেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।

১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৭৫-এ বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থানের পর ভারতের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের মোশতাক বা জিয়া সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যায় না। কেবল ১৯৭৭ সালে ৫ নভেম্বর জিয়া সরকারের সঙ্গে দেশাই সরকারের ফারাক্কা চুক্তি বড় ইতিবাচক ঘটনা।

ভিরেন্দ্র নারায়ণ তার গ্রন্থ Foreign Policy of Bangladesh (1971-1981) (জয়পুর, ভারত, ১৯৮৭)২৫-এ বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা উত্তরকালের প্রথম এক দশকের পররাষ্ট্রনীতি আলোচনা করেছেন। ভূমিকা, উপসংহারসহ মোট দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে গ্রন্থটিকে।

প্রথম অধ্যায়ে উদ্দেশ্য, পরিধি ও সীমাবদ্ধতা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাত্ত্বিক কাঠামো, তৃতীয় অধ্যায়ে নির্ধারকসমূহ, চতুর্থ অধ্যায়ে মুজিব যুগের আশা ও হতাশার প্রেক্ষাপট পঞ্চম অধ্যায়ে ভারত-বাংলাদেশে সম্পর্ক (১৯৭১ ১৯৭৫), ষষ্ঠ অধ্যায়ে ভারত-বাংলাদেশে সম্পর্ক (১৯৭৫-১৯৮১), সপ্তম অধ্যায়ে বাংলাদেশ এবং বৃহৎ শক্তিবর্গ, অষ্টম অধ্যায়ে বাংলাদেশ ও ইসলামী বিশ্ব, নবম অধ্যায়ে অভ্যুত্থান উত্তর সময়কাল, দশম অধ্যায়ে উপসংহার

লেখক যে তাত্ত্বিক কাঠামো গ্রহণ করেছেন, তার মাধ্যমে একটি দেশের বৈদেশিক সম্পর্কের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। লেখক তার গবেষণাকর্মের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন,

“It is a study of the foreign policy as a sub-component of the national liberation movement of Bangladesh. Foreign policy per se, therefore, is not the main focus of It is rather the national liberation movement of Bangladesh, which has been discussed and in this context the role of major powers vis-à-vis the national liberation movement has been examined.”*

জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন পর্ব এবং স্বাধীনতা উত্তর প্রথম দশক এই দুই পর্বে ভারতসহ বৃহৎ শক্তিবর্গ যথা মার্কিন, চীন ও সোভিয়েত ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev
Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev

 

এই গ্রন্থে ১৯৭১-১৯৮১ সময়কালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিস্তারিত বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখক ১৯৭১-১৯৮১ সময়কালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক (১৯৭১-১৯৭৫) অধ্যায়ে লেখক দেশের সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। দুদেশের সম্পর্কের অসাম্প্রদায়িক ভিত্তি, সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ, প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ, ভারতবিরোধী প্রচার-প্রচারণা, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্ব, ভারতের নিজস্ব ভ্রান্তি ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করেছেন।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক (১৯৭৫-১৯৮১) অধ্যায়ে বাংলাদেশে পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর ক্রমবর্ধমান ভারত বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে। এই সময়ে “ফারাক্কা ইস্যু” ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ফারাক্কা ইস্যু এবং ১৯৭৭ সালে দুদেশের মধ্যে পানি বণ্টনের অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির ওপর আলোচনা স্থান পেয়েছে।

উল্লিখিত দু’অধ্যায়ে মাত্র চল্লিশ পাতায় (৭১-১১১) দীর্ঘ একদশকের ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আলোচনা করেছেন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চাইতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। মূল সুরটি ছিল বাংলাদেশের ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রসার। লেখকের মতে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মাওবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সরকারের বিরোধিতার নামে ভারত বিরোধিতা শুরু করে। এ সব কিছুর পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইন্ধন ছিল জোরালো মাত্রায়।

“The Maoists and communal elements were playing exactly the same role giving grist to the mill of anti Indian tirade which fitted well in the strategy of the imperialists to destabilise the entire South Asian region, as they knew that the unity between India and Bangladesh was a bulwark against their plans to derail the process of national liberation in the entire region. “২৭

লক্ষ্য করা যায় যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দায়টাই লেখকের দৃষ্টিতে বেশি। তারপরও লেখক ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কিছু ভ্রান্তির কথা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় অসাধু ব্যবসায়ীদের নিম্নমানের পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশের প্রেরণ, চোরাচালান ব্যাপক বৃদ্ধি, বিশেষ করে ফারাক্কা ইস্যুতে ভারতের অনমনীয় মনোভাবের উল্লেখ করেছেন।

বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা প্রসঙ্গে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, “The Humanitarian Role Played by India.” এই গ্রন্থের সামগ্রিক মূল্যায়নে বলা যায় লেখক জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত হয়েছে কিনা, প্রতিবন্ধকতা কি ছিল, অভ্যন্তরীণ বৈরী রাজনীতি লেখকের আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে।

লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে কেবল ‘humanitarian role’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোকে খুব সঠিক ব্যাখ্যা বলা যায় না। কোন দেশের সরকার কেবল সামাজিক কারণে, মানবিক কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মুক্তিসংগ্রামে এমনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয় না। সেখানে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে জনগণের ভূমিকাকে সরকারের ভূমিকা থেকে পৃথক করে দেখা যেতে পারে। সাধারণ ভারতীয় জনগণ বাংলাদেশের অসহায় শরণার্থীদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে মানবতাবোধ থেকেই।

তার তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে বলা যায় যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আলোচনা সম্পূর্ণতা পায়নি। দুদেশের সম্পর্কের চাইতে অধিক আলোচিত হয়েছে দুদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। সর্বোপরি লেখক ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দুদেশের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন।

ডেনিশ রাইটের লেখা, Bangladesh Origins and Indian Ocean Relations (1971-1975), Dhaka, 1988২৮ গ্রন্থে তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত (১৯৭১-১৯৭৫) সময়কালের দুদেশের সম্পর্কের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করেছেন। লেখক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পটভূমির বিশ্লেষণসহ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী খুটিনাটি অনেক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন।

Indira Gandhi & Tajuddin Ahmad
Indira Gandhi & Tajuddin Ahmad

 

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন কলকারখানা লুট, ঢাকায় প্রাপ্ত সকল বিদেশী পণ্য ক্রয় এবং বিহারী সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির অসন্তোষ, এমনকি আক্রমণের শিকার হয়। লুটপাটের কারণ হিসেবে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, ভারতীয় সেনাদের দৃষ্টিতে যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী বাংলাদেশের নয় বরং পাকিস্তানের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে একরকম ছিল না।

এই ঘটনার জন্য তারা ভারত সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানায়। যে কারণে ৩১ জন ভারতীয় সেনা সদস্যের কোর্ট মার্শাল হয়। তবে দ্রুত ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারের ফলে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখে।

Bangladesh’s Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman observes the exit parade of the Indian Army stationed in Bangladesh, March 12, 1972
Bangladesh’s Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman observes the exit parade of the Indian Army stationed in Bangladesh, March 12, 1972

 

যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের অবকাঠামো ও অর্থনীতির পুনর্গঠনে একমাত্র ভারত, খাদ্যসহ জরুরি পণ্যসামগ্রীসহ বিপুল পরিমাণ ঋণ ও সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ায়।

এতদসত্ত্বেও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ন্যাপ নেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘ভারতবিরোধী’ প্রচার-প্রচারণা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের দ্রুত ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা’ অর্জনকে ভারত সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করে। যে কারণে নিজের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য পঞ্চাশ লক্ষ পাউন্ড ঋণ প্রদান করে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ছিল অবধারিত। তবে বাণিজ্য সম্পর্ক দুদেশের পরিপ্রেক্ষিতেই সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যর্থ হয়। বিশেষভাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। এর প্রধান কারণ চোরাচালান। দুপক্ষই চোরাচালানরোধে নানা পদক্ষেপ নিলেও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভে ব্যর্থ হয়। এমনকি দুদেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ারও কথা ওঠে। লেখক যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে,

“During the entire 1971-1975 period the pattern of trade between India and Bangladesh failed to produce the close economic ties desired by both government.”

চোরাচালান, মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী মনোভাবকে চাঙ্গা করে। চোরাচালানকে কেন্দ্র করেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম মতবিরোধ দেখা দেয়। মূলত এটাকে ভিত্তি করেই ভারতবিরোধী প্রচার বেশ বেগবান হয়ে ওঠে। ভাসানী ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি ভারতীয় শোষকদের বিরুদ্ধে “জেহাদ” ঘোষণা করেন। ভারতীয় পণ্য বয়কটের আহ্বান জানান।

দুদেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী আরো দুটি বিষয় লেখক আলোচনা করেছেন তা হলো বাংলাদেশের মুদ্রা ও ফারাক্কা সমস্যা। তবে ফারাক্কা সমস্যার ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধের সব চাইতে বড় জায়গাটি হলো ফারাক্কা ইস্যু। অবশ্য বাংলাদেশের আবির্ভাবের বহু পূর্বে ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে ভারত, কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা এমনি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাঁধ নির্মাণ শুরু হলেও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কারণে পুরো পরিস্থিতি বদলে যায়।

পাকিস্তান আমল থেকেই দুদেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭২ সালের গোড়াতেই ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে দুদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। কিছু দিনের মধ্যেই স্থায়ী যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। যৌথ নদী কমিশনের অনেকগুলো সভা অনুষ্ঠিত হলেও গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে কোন ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ-ভারত উভয়ে স্ব স্ব অবস্থানে অনড় থাকার কারণে এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান অর্জনও সম্ভব হয়নি। এই সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি লেখক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তা হলো,

“The Political aspect of the Ganges waters dispute, it was probably only at the level of head of state meetings that it could really be resolved. “৩০

তথাপি ফারাক্কা বাঁধের আনুষ্ঠানিক পরীক্ষামূলক উদ্বোধনের পূর্বে দুদেশের মধ্যে স্বল্পমেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গঙ্গার পানি বণ্টনের ইস্যু দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেবে থেকে যায়।

US 7th fleet Aircraft Carrier which headed to the Bay of Bengal in (1971)
US 7th fleet Aircraft Carrier which headed to the Bay of Bengal in (1971)

 

লেখক সমস্যাগুলোর বিবরণ দিয়েছেন বেশি, বিশ্লেষণ দিয়েছেন কম। দুটি দেশের জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্বের জায়গাটি লেখক উদ্ঘাটন করতে পারেননি। ১৯৭১-১৯৭৫ সময়কালে লেখক যে সমস্যাগুলো আলোচনা করেছেন, তার বাইরে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বয়ে গেছে। যেমন সীমান্ত সমস্যা ও ওআইসিতে বাংলাদেশের যোগদান। এই দুটি বিষয় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে।

রেখা সাহা তার India Bangladesh Relations গ্রন্থে মুজিব, জিয়া ও এরশাদ আমলে বাংলাদেশ-ভারতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের নানা দিক আলোচনা করেছেন। ভূমিকা ব্যতীত চারটি অধ্যায়ে দুই দশকের বেশি সময়ের দুদেশের সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন। স্বল্প পরিসরে দীর্ঘ সময়ের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আলোচনা করায় অনেক বিষয়েই গভীর বিশ্লেষণ অনুস্থিত।

এই গ্রন্থটি লেখকের পিএইচডি অভিসন্দর্ভের ফসল। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রত্যাশা ছিল এতে গবেষণা পদ্ধতি, তাত্ত্বিক কাঠামো এবং লিটারেচার রিভিউ অন্তত থাকবে। এই ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা আশাহত হয়েছি। তবে পূর্ববর্তী ভারতীয় গবেষকদের সঙ্গে তার একটা পার্থক্য হলো তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা, একাডেমিশিয়ানদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশী উপাদান বেশি ব্যবহার করেছেন। কিছু অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান না হওয়ার জন্য বাংলাদেশের দায় বেশি মনে করলেও সামগ্রিকভাবে দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকাই বড় হওয়া উচিত মনে করেন। তার মতে,

“Much more important than the solutions of the disputes… is the need for the restoration of the climate of understanding in Indo-Bangladesh relations that prevailed during the Mujib era. This is a difficult task but the major initiative has to come from India. “

জগলুল হায়দার তার The Changing Pattern of Bangladesh Foreign Policy: A Comparative Study of the Mujib and Zia Regimes (1971-1981)৩৩ গ্রন্থে নয়টি অধ্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আলোচনা করেছেন। যে সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আলোচনা স্থান পেয়েছে সেগুলো ভারত, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং মুসলিম বিশ্ব। এই রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুজিব ও জিয়া আমলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে। স্বল্প পরিসরে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশসহ তিনটি পরাশক্তি ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক আলোচনার কারণে বিভিন্ন ইস্যু একদিকে যেমন গভীরতা পায়নি, তেমনি সম্পূর্ণও হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Srimathi Indira Gandhi & Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Srimathi Indira Gandhi & Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman ]

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে লেখক ‘জাতীয় স্বার্থে’র ধারণাকে গ্রহণ করেছেন তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে ‘জাতীয় স্বার্থে’র ধারণাকে প্রয়োগ করেছেন রক্ষণশীল দৃষ্টিকোণ থেকে। উক্ত গ্রন্থে তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক বাংলাদেশ-ভারতের এক দশকের সম্পর্ক মাত্র ৮ পৃষ্ঠায় (পৃ. ২৭-৩৪) বর্ণনা করেছেন। এই সময়কালের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো আলোচনার চেষ্টা করেছেন। স্বাভাবিক কারণেই এমনি সংক্ষিপ্ত একটি অধ্যায়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা জটিল দিকের পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না। লেখক দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, জিয়ার সময়কালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। তার মতে,

“Nationally, Zia changed his policy from Mujib’s old route of secularism and socialism. Internationally Zia shifted from the Indo-Soviet orbit very hurriedly and tied the fate of Bangladesh with the United States, the west, China and the Islamic World. “৩৪

লেখকের মতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে কারণ এর ফলে জিয়ার সময়কালে বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। কৌশলে লেখক যা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন তা হলো কেবল বৈদেশিক সাহায্যের আকাঙ্ক্ষা থেকে জিয়া, মুজিব আমলে অনুসৃত নীতির পরিবর্তন করেননি। বরং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যে সব দল বা গোষ্ঠীর সক্রিয় সমর্থনে জিয়া তার ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন, তাদের নীতি ছিল ভারতবিরোধী।

আর বহু গবেষণা থেকেই এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, জিয়ার সময়কালে প্রাপ্ত অবাধ বৈদেশিক সাহায্যের এক বিরাট অংশ দেশের উন্নয়নে কোন অবদান রাখেনি। বরং তা বড় বড় ঋণখেলাপীর জন্ম দিয়েছে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। সুতরাং এই পরিপ্রেক্ষিতে জিয়ার নীতি সত্যিই কতটা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেছে, আর কতটা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে পরিচালিত হয়েছে সে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়।

উপরিউক্ত গবেষণাকর্মগুলোতে একপেশে বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে। ভারতীয় গবেষকগণ কেবল ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলো বিবেচনা করেছেন। যে কারণে দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান নানা সমস্যা সমাধান না হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেছেন একতরফা। ভারতের বাইরে যাঁরা এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন তাদের অধিকাংশের মধ্যে ভারতবিরোধী/পাকিস্তানী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। যে কারণে বিষয় বিশ্লেষণে দৃষ্টিভঙ্গিগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

অধিকন্তু দুদেশের সম্পর্কের গবেষণায় ভারতীয় লেখক/গবেষকগণ প্রাধান্য দিয়েছেন ভারতীয় তথ্য-উপাত্তের ওপর। আর ভারতের বাইরের লেখক/গবেষকদের কাছে পশ্চিমা পত্রপত্রিকার গুরুত্ব ছিল বেশি। মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা তথ্য-উপাত্তের ব্যবহার নিতান্তই নগণ্য। সম্ভবত তথ্য-উপাত্ত নির্বাচনে বাস্তবধর্মী ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব দুদেশের সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় হিসেবে থেকে গেছে।

২.

পদ্ধতিগতভাবে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা বেশ দুরূহ কাজ। কারণ নানা পরিপ্রেক্ষিত থেকে রাষ্ট্রসমূহ তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে থাকে। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।

ঐতিহাসিক পদ্ধতি

সমকালীন ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষণায় এই পদ্ধতি বেশ প্রাচীন। কূটনৈতিক ইতিহাস আমাদের সহায়তা করে জানতে যে কোন বিশেষ ইস্যু বা পরিস্থিতি মোকাবেলায় একজন কূটনীতিক বা রাজনীতিক কি উপায় অবলম্বন করে সাফল্য বা ব্যর্থতা পেয়েছেন। তাই বলা যায়

“ইতিহাস আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের সনাতন বা চিরাচরিত অথচ প্রয়োজনীয় পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে অতীতের নীতিগত ধারা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, অতীতের চিন্তাধারা, উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত, ঐতিহাসিক মৈত্রী ও দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, লেনদেন বা আচার ও আচরণের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের নীতিমালা, কূটনৈতিক ব্যবহারের ঐতিহ্য প্রভৃতির দিকদর্শন মেলে।”৩৫

ঐতিহাসিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে উপলব্ধি করা সম্ভব। এ ছাড়া পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির মধ্যকার সম্পর্ক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণের আলোকে ঐতিহাসিক পদ্ধতি একটি গ্রহণযোগ্য কর্মপরিকল্পনার সুপারিশ কর পারে।

বাংলাদেশ-ভারত নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্রদ্বয়, সব সময় একই ভৌগোলিক আকার ও রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত ছিল না। ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি দুটি দেশের মধ্যে যে বন্ধন তৈরি করেছে তা কোনভাবেই অস্বীকারের জো নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের সম্পর্কের গবেষণায় ঐতিহাসিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। পাশাপাশি ঐতিহাসিক পদ্ধতির সহজাত সীমাবদ্ধতা অস্বীকারের উপায় নেই, এর সঙ্গে আরো যুক্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের জটিল ও অপ্রত্যাশিত ইনপুট। যে কারণে শুধু ঐতিহাসিক পদ্ধতি যথেষ্ট নয় এই গবেষণায়।

আদর্শ মূল্যবোধভিত্তিক পদ্ধতি

একটি রাষ্ট্র তার ইতিহাস-ঐতিহ্য, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে বিশেষ কোন নীতিকে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। যা সংবিধানে সন্নিবেশিত থাকতে পারে আবার নাও পারে। কিন্তু আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই আদর্শবাদিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আদর্শবাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মৌল ভিত্তি হিসেবে ন্যায়বোধ বা উচিত-অনুচিত ধারণাকে গ্রহণ করেছে, যে কারণে আদর্শভিত্তিক পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতাকে আমলে নেয়া হয় না, বরং ন্যায়বোধ অনুযায়ী কি ধরনের সম্পর্ক হওয়া কাম্য তার ওপর জোর দেওয়া হয়। ম্যাকিয়াভেলি যেখানে রাষ্ট্রের স্বার্থ হাসিলে যে কোন পন্থা অবলম্বনের অনুমোদন দিয়েছেন, এর বিপরীতে জ্যা জ্যাক রুশো ও ইম্যানুয়েল কান্ট আদর্শবাদকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের মূল মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনও এই মতবাদ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ৩৬

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে আদর্শবাদিতার প্রত্যক্ষ প্রভাব। আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সাদৃশ্য, ১৯৭১-১৯৭৫ সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারণে, ভারত সরকারের দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে, আস্থা-নির্ভরতার ভিত্তি তৈরি করে আদর্শিক মিল। এ ছাড়া অন্য বিষয় ছিল যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আবেগজাত। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় দোদুল্যমানতা থাকা সত্ত্বেও অন্তিমে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।

বর্ণনামূলক পদ্ধতি

আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কোন বিশেষ ঘটনা বা সমস্যার বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয় বিশেষ ঘটনা বা সমস্যাকে এর পটভূমি, উদ্ভব, বিস্তার, সমাধানের অন্তরায় অর্থাৎ সমস্যা বা সঙ্কটের আনুপাক্ষিক বিশ্লেষণ উপস্থাপিত করা হয়। ৩৭

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অনেকগুলো সমস্যা অমীমাংসিত অবস্থায় আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই সমস্যাগুলো এড়িয়ে গিয়ে, কাঙ্ক্ষিত সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিটি সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতসহ গভীর বিশ্লেষণ করা হবে এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য পথ নির্দেশের চেষ্টা করা হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে উল্লিখিত তিনটি পদ্ধতিই কোন না কোনভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্লেষণে উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতিরই বিষয় সংশ্লিষ্ট উপাদান নিয়ে একটি সমন্বিত পদ্ধতির আলোকে গবেষণা করা যেতে পারে।৩৮

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

তাত্ত্বিক কাঠামো

বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সঙ্গে নানা বিষয়যুক্ত হয়ে এটাকে জটিল করে তুলেছে। ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নানা বিষয় দুদেশের সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতিমালা অনুযায়ী “জাতীয় স্বার্থই প্রতিটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বলা বাহুল্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও জাতীয় স্বার্থের ধারণা ক্রিয়াশীল।

তবে কেবল জাতীয় স্বার্থের আলোকে দুদেশের সম্পর্কের জটিল ইস্যুগুলোর সঠিক ও সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ত সম্ভব হবে না। কারণ বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের বিষয়টি গতানুগাতিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মত নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের বা ভারতের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক হয়ত এভাবে বিশ্লেষণ সম্ভব। তবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে বিবেচনা করতে হবে স্বতন্ত্র তত্ত্বকাঠামোর অধীনে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আবেগগত ও আদর্শগত বিষয়কে অস্বীকার করে দুদেশের সম্পর্কের যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়ত সম্ভব নয়। আবেগগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠীর কারণে, আবেগকে আরো তীব্র করেছে উনিশশ সাতচল্লিশ সনে ভারত বিভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে অভিবাসী জনগোষ্ঠী। যারা উপর্যুক্ত রাজ্যগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কিন্তু জন্মভূমি পূর্ববঙ্গ কখনো তাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।

পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিরোধ একেবারে ছিল না তা নয়। তবে বিরোধের একটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল অর্থনৈতিক বিষয়াদি, ধর্ম মুখ্য হয়ে ওঠেনি। এক পর্যায়ে ধর্মই বিরোধের কেন্দ্রে চলে আসে।

“হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে ১৯৪৭ সালে বাঙলা আবার ভাগ হয়। কিন্তু এ সময় প্রায় কারও কণ্ঠেই প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হলো না, বরং দ্বিতীয় বার বাঙলা ভাগ নিশ্চিত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে একটা সংঘবদ্ধ আন্দোলন পরিচালিত হলো—যার লক্ষ্য ছিল ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশকে ভাগ করা।”৩৯

আমরা জানি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসমানদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়াতেই ১৯৪৮ সালেই ভাষার প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বিরোধের জন্ম হয় তা ক্রমে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতার পথে ধাবিত হয়। ১৯৪৭-১৯৭১ সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অসাম্প্রদায়িক চরিত্র।

যেখানে ১৯৪৭ পূর্বকালে জাতীয়তাবাদ ছিল ধর্মীয় এবং/অথবা সাম্প্রদায়িক৪০ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বহু ছাত্র সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে অভিনব ব্যাপার। যেখানে ধর্মীয় আবেগ আর ভারতবিরোধিতাই হলো পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির প্রধান উপাদান। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের ন্যায্য আন্দোলন দাবি-দাওয়াকে বিবেচনা করেছে ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে।

১৯৪৮-এ শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব আন্দোলন সংগ্রাম একই মানদণ্ডে মূল্যায়ন করেছে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী। যে কারণে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী তথাকথিত ভারতীয় চক্রান্তের নামে একদিকে যেমন বাঙালিদের ন্যায্য আন্দোলন সংগ্রাম দমন করেছে দুই যুগ ধরে, তেমনি বাঙালিদের নিকট ভারত-পাকিস্তান বিরোধের বিষয়টি একান্তই পশ্চিম পাকিস্তানের বিষয় হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।

এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর সন্দেহ, অবিশ্বাস যেমন বাড়তে থাকে তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যগুলোর সঙ্গে এক ধরনের সহানুভূতির সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। দীর্ঘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক বিরোধ অনেকটা ফিকে হয়ে আসে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদী নীতির কারণে।

এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালে কলকাতা সফরকালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক নেতাজী ভবনে দেওয়া ভাষণে বলেন,

“বাঙালি এক অখণ্ড জাতি। আর তারা একই ভাষায় কথা বলে এবং একই সুসংহত দেশে বাস করে। তাদের আদর্শ ও এক, জীবন ধারণের প্রণালীও এক। …. আজ আমাকে ভবিষ্যৎ ইতিহাস গঠনে অংশগ্রহণ করতে হবে। আমি ভারত বলতে পাকিস্তান ও ভারত দুটিই বুঝি। কারণ ঐ বিভাগ আমি কৃত্রিম বিভাগ বলে মনে করি।”৪১

আমরা জানি এমনি বক্তব্যের জন্য ফজলুল হককে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তারপরও স্বীকার করতে হবে যে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সাধারণ জনগণের মানস জগতের সঙ্গে ফজলুল হকের ভাবনার সাযুজ্য ছিল।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আদর্শ বা নীতি-মূল্যবোধের কোন স্থান নেই সম্ভবত এ কথা নিশ্চয়তাসহকারে বলা চলে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ উড্রো উইলসনের ‘চৌদ্দ-দফা কর্মসূচির বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। জাতিপুঞ্জ পরবর্তীতে জাতিসংঘের সনদে ‘চৌদ্দ-দফা’র প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ভার্সাই সম্মেলনেও উইলসন আদর্শবাদী ভূমিকা পালন করেন ৪২ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘আদর্শ’ (ideology)-কে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে,

“A system of beliefs or theories that usually serves as a guide to action and that may form the basis of a socio political programme. “8*

অন্যত্র আদর্শের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি, ক্ষমতার প্রয়োগ, ব্যক্তির ভূমিকা, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ধরন এবং সমাজের উদ্দেশ্যসমূহ।৪৪

বিশিষ্ট গবেষক Mari Holmboc Rüge দেখছেন কিছুটা ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে। একটি জাতির ভাবমূর্তি (অর্থাৎ আদর্শ) সে জাতির সংসদ সদস্যদের বিতর্কে, রাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিফলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস/সিনেটে যে বিতর্ক হয় (পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে) তার প্রেক্ষাপট ক্ষমতার রাজনীতি ব্রিটেনে অর্থনীতি ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নরওয়েতে বিশ্বশান্তি ও সমঝোতা ।৪৫

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ‘আদর্শ’কে সংজ্ঞায়িত করা বেশ জটিল ও দুরূহ কাজ। তবে ‘আদর্শ’-এর ধারণা কিছুটা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন Northedge. তার মতে,

“We may distinguish between various functions of ideology in foreign policy: to bind the country together psychologically,… a prism through which states perceive the international realities on which their foreign policy must work. Without ideology a nation does not exactly perish, but it can hardly know what to approve and disapprove. “৪৬

বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শবাদিতার কার্যকারিতা নিয়ে ভিন্নমত অবশ্যই রয়েছে। তবে কোন কোন দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘আদর্শ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় জায়গা জুড়ে আছে আদর্শ। কারণ। আদর্শগত সাদৃশ্য দুদেশের সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল উনিশশ একাত্তরে। এই ধারা অব্যাহত থাকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত। পঁচাত্তর-উত্তরকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যায়। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক হলো পঁচাত্তরের সামরিক অভ্যুত্থান।

এমনি বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র (RAW)-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বি. রমনের লেখায়। তিনি লিখেছেন,

১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর একদল সেনা কর্মকর্তা ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু সে সব সেনা কর্মকর্তার রাজনৈতিক সমর্থকরা ভারতের প্রতি খুব একটা বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন না। ১৯৭১ সালের আগের পূর্ব পাকিস্তানের মত বাংলাদেশ ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র হয়ে পড়ে।”৪৭

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের জনগণ ও সরকারের কাছ থেকে যে সর্বাত্মক সাহায্য সহানুভূতি লাভ করে তার একটা বড় কারণ হলো, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শ।৪৮ গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শগত সাদৃশ্য ছিল। তার অর্থ এই নয় যে, কেবল আদর্শগত মিলের কারণে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছে। একই সঙ্গে ভারতের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে ছিল এই সিদ্ধান্ত।

পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলে, ভারতের দিক থেকে কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে বিশেষ সহায়ক হয়। তাই বলা যায় মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল একই সঙ্গে আদর্শবাদিতা ও জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পারিচালিত। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে অবশ্যই আদর্শবাদিতা ছিল। মুখ্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও আশদবাদিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উনিশশ বাহাত্তর সালে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসমূহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বলা হয়। “জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা—এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র:

ক. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন;

খ. প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং

গ. সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।”৪৯

বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না উপরিউক্ত আদর্শসমূহ ভারতের রাষ্ট্রীয় আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

মুজিব আমলে জাতীয় স্বার্থের টানাপোড়েন যে হয়নি, তা বলা যাবে না। কোন কোন দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে দুপক্ষই অনড় অবস্থান নিতে অনাগ্রহী ছিল না। তারপরও সামগ্রিক বিচারে দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বজায় ছিল। বলা যায় দুদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শের মিল এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শগত সাযুজ্য উনিশশ পঁচাত্তরের পনের আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে আদর্শিক পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেমন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পৃষ্ঠপোষকতা পায় তেমনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ অগ্রাধিকার পায়।

মুজিবের শাসনের অবসানের পর সৌদি আরব ও চীনের স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। জিয়া পরিকল্পিতভাবে ইসলামী পরিচয়কে বড় করে তুলতে চেয়েছেন দেশের ভেতরে ও বাইরে। জিয়া ক্ষমতাসীন হবার পরপর ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়কে আরবি ও বাংলায় কোরান ও হাদিসের বাণী উৎকীর্ণ করে বিশাল বিশাল বোর্ড শোভা পেতে থাকে। রাস্তার পার্শ্বে ইসলামী অনুকরণে তোরণ নির্মাণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। জিয়ার এমনি উদ্যোগকে একাত্তরপূর্ব চিন্তা-চেতনার পুনঃপ্রকাশের প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে তিনি মিত্রশূন্য ছিলেন না। দক্ষিণপন্থী ও বাম দলের একাংশ পাকিস্তান আমল থেকেই “ভারত বিরোধিতা”কে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রধান উপাদানে পরিণত করে। স্বাভাবিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধিতা করে। এই দলগুলোই জিয়ার সমর্থক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। আদর্শগত দিক থেকে জিয়া যে সব দল/গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন তা বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের পথে অন্তরায় হওয়াটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পর্কের ইসলামীকরণকে জিয়া সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নম্বর ৪ অনুযায়ী সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদের ১(২) ধারায় সন্নিবেশিত হয়—

“রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।”৫০

এতক্ষণ আদর্শবাদিতার ওপর আলোচনা করলেও বাংলাদেশ-ভারত দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে “জাতীয় স্বার্থ”কেও একটি উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। যে কোন দেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। জাতীয় স্বার্থ অর্জন করাই প্রতিটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্র তাদের বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনা করে থাকে জাতীয় স্বার্থের আলোকে। ১৯৭১-১৯৮১ সময়কালে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তার জাতীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। দুদেশের সম্পর্ককে জাতীয় স্বার্থ কিভাবে প্রভাবিত করছে এর বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে “জাতীয় স্বার্থ” সম্পর্কে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না হয়ত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

“জাতীয় স্বার্থ” অভিধাটি অপেক্ষাকৃত নবীন বলা যেতে পারে। স্বার্থ বা “interest” শব্দটি ল্যাটিন থেকে উদ্ভূত যার অর্থ

“It concerns it makes a difference to, it is important with reference to some person or thing. “৫১

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড উভয় ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একটি জাতির পররাষ্ট্রনীতির পর্যাপ্ততা বা উৎসের মূল্যায়ন বা বর্ণনা, ব্যাখ্যায় জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে বিশ্লেষণের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে আধুনিক অর্থে “জাতীয় স্বার্থ” ধারণার ব্যবহার শুরু হয়। এমন ধরনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাবেশ ঘটে “জাতীয় স্বার্থে” যা একটি জাতির নীতিসমূহের লক্ষ্যে পরিণত হয়।

নানা ধরনের জাতীয় স্বার্থ হতে পারে, যেমন, আদর্শিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং সাংস্কৃতিক। কেবল বৈদেশিক ক্ষেত্রে নয়, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও জাতীয় স্বার্থের প্রতিফলন ঘটে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এলে “জাতীয় স্বার্থ”কেও জাতিরাষ্ট্র সময়ের উপযোগী করে নেয়।

আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক যে কোন উপায় গ্রহণ করা যেতে পারে জাতীয় স্বার্থ আদায়ের জন্য। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে “জাতীয় স্বার্থ” অভিধাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তথাপি এর সঙ্গে জাতীয় সম্মান (national honour), জাতীয় অহংবোধ (national prestige) এবং অপরিহার্য স্বার্থের (vital interest) সঙ্গে একটি প্রভেদ থাকা বাঞ্ছনীয়। যদি “জাতীয় স্বার্থ”কে রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা ও বস্তুগত অর্জন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় তাহলে “জাতীয় সম্মান” এবং “জাতীয় অহংবোধ” হলো একটি মানসিক অবস্থা এবং যা একটি জাতির জন্য অবিচ্ছেদ্য।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় জাতীয় স্বার্থ নিয়ে দরকষাকষি করা যায় বা ছাড় দেওয়া যায় জাতীয় মর্যাদা’ এবং ‘অহংবোধ’-এর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। অন্যদিকে যখন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকগণ কোন জাতীয় ইস্যুতে কোন প্রকার ছাড় না দিয়ে কঠোর অবস্থান নেয় এমনকি যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি গ্রহণে পিছপা হয় না। সে ইস্যুকে জাতির জন্য অপরিহার্য স্বার্থ” বলা যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

“জাতীয় স্বার্থ”-এর অর্থ বা সংজ্ঞা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক বা মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, আমলা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ সবাই ব্যাপকভাবে অভিধাটি ব্যবহার করলেও এর ধারণাগত দিকটি যথাযথভাবে আলোচিত হয়নি। জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে দি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স ডিকশনারিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে,

“… a highly generalised conception of those elements that constitute the state’s most vital needs. These include self-preservation, independence, territorial integrity, military security and economic well being.”

কিছুটা ভিন্নভাবে জাতীয় স্বার্থকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে, জাতীয় স্বার্থ হলো সামগ্রিকভাবে একটি দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ যার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হবে ঐ দেশের পররাষ্ট্রনীতি।৫২ জাতীয় স্বার্থ নিরূপণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন স্টেফান ক্রাসনারের কাছে বস্তুগত উদ্দেশ্য এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী আদর্শিক লক্ষ্যসমূহ হলো জাতীয় স্বার্থ।

ডোনাল্ড ন্যুকটারলিন চারটি মৌলিক স্বার্থের সমষ্টিকে জাতীয় স্বার্থ বলেছেন। যথা প্রতিরক্ষা স্বার্থ, অর্থনৈতিক স্বার্থ, বিশ্ব ব্যবস্থার স্বার্থ এবং আদর্শিক স্বার্থ। এই সংজ্ঞা থেকে জাতীয় স্বার্থের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেলেও এর ভাব বা মনোগত দিকটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, জাতীয় স্বার্থ হলো যে নীতি বা নীতিসমূহের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়কালে, একটি নির্দিষ্ট জাতিরাষ্ট্রে বসবাসকারী ব্যক্তি, দল বা উপদলের স্বার্থ সংরক্ষিত করা।

বলা যায়, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে, তাই জাতীয় স্বার্থের গড়নে ইতিহাসের ভূমিকা অপরিহার্য। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির অগ্রাধিকার ও দাবি-দাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থেরও প্রয়োজনীয় সংস্কার, পরিবর্তন করতে হয়। যেমন, স্নায়ুযুদ্ধকালীন পর্বে জাতীয় স্বার্থ জাতীয় নিরাপত্তার সমার্থক শব্দে পরিণত হয়। কিন্তু বর্তমানে নিরাপত্তার ধারণারও পরিবর্তন ঘটছে, অনেক জাতি তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত স্বার্থ নিয়ে অধিক উদ্বিগ্ন।

জাতীয় স্বার্থের যেমন সার্বজনীন সংজ্ঞা নেই, তেমনি এর পরিধি বা সীমা নিয়েও মতানৈক্য আছে। একটি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থের মধ্যেই কি এর পরিসর সীমিত থাকবে নাকি পরিবেশগত, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আত্মিক প্রয়োজনগত স্বার্থগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত হবে? বাস্তববাদীরা জাতীয় স্বার্থকে কেবল বস্তুগত অর্জন যথা সামরিক, রাজনৈতিক এবং

অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করে থাকেন। যদিও অন্যরা জাতীয় স্বার্থকে আরো বিস্তৃত পরিসরে ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী। যেমন জেমস বিলিংটন মনে করেন,

“National interest should be understood both in terms of material and non-material aspects. .”৫৩

যে সকল রাজনৈতিক দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের লেখনী বাস্তববাদীদের জাতীয় স্বার্থ ও বৈদেশিক নীতির ধারণাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন তারা হলেন থুসিডাইডিস, ম্যাকিয়াভেলি, কৌটিল্য, থমাস হবস, হুগো এসিয়াস, রুশো প্রমুখ। কিন্তু সাম্প্রতিককালের বাস্তববাদীদের ভাবনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে ই. এইচ. কার এবং হান্স মর্গেনথু রচনাবলি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

বাস্তববাদীরা মনে করেন রাষ্ট্রের স্বার্থ (state interest)-এর ধারণা থেকে জাতীয় স্বার্থের উদ্ভব হয়েছে। তাদের মতে এই ধারণা সার্বজনীনভাবে বৈধ এবং এটা হলো

“Unaffected by the circumstances of time and places” ৫৪ মর্গেনথু বিশ্বাস করেন এটি কেবল রাজনৈতিক প্রয়োজনের বিষয় নয় বরং একটি জাতির নৈতিক দায়িত্ব অন্য জাতির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। তার মতে,

“And above all, remember always that it is not only a political necessity but also a moral duty for a nation to follow in its dealings with other nations but one guiding star, one standard for thought, one rule for action: the National Interest.”

৫৫ বাস্তববাদীরা ক্ষমতা এবং নিরাপত্তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনা করে থাকেন, তাদের বিবেচনায় অন্য সব স্বার্থই রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা স্বার্থের অধস্তন।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগগত, আদর্শগত ও জাতীয় স্বার্থের বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। আবেগগত, আদর্শগত ও জাতীয় স্বার্থের ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতীয় অবস্থান। দুদেশের সম্পর্কের সবচাইতে স্পর্শকাতর বিষয় সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে ভারতের সরকার ও জনগণ এত গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল যে, পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সম্পৃক্ততা বড় ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবকে দুটি পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক দুভাবে দেখা যেতে পারে। ভারতে ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারকদের (political actor) মধ্যে দুটি গোষ্ঠীই রয়েছে। ভারতের ডানপন্থী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধকে দেখে এই অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের মহাসুযোগ হিসেবে। জনসংঘ, স্বতন্ত্র ও হিন্দু মহাসভার তৎপরতা সে রকমই সাক্ষ্য দেয়।৫৬

১৯৪৭ সালে ভারত-বিভাগ চূড়ান্ত কোন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেনি। পাকিস্তানের ভাঙনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা হিসেবে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। এর দ্বারা ভারত কোন কোন ক্ষেত্রে সুবিধা পেতে পারে সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই দক্ষিণপন্থী দলগুলোর কাছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক কোন আবেদন ছিল না।

জনসংঘ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চের আক্রমণের পর স্বাধীনতা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জনসংঘ তার অবস্থান পরিবর্তন করে। জনসংঘের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে জুলাই মাসের শুরুতে। উদয়পুরে প্রতিনিধি সভায় সভাপতির ভাষণে অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেন,

“The Government of India should not do anything to hinder this historical process of the disintegration of Pakistan. In fact it is the duty of the government to promote this process. “৫৭

আগস্ট মাসে সম্পাদিত ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির সমালোচনা করে বাজপেয়ী বলেন,

দুদেশের যুক্ত ইশতেহারে রাজনৈতিক সমাধানের নামে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে যা বাংলাদেশের পিঠে ছুরিকাঘাতে শামিল। ৫৮

এক সময়ে জনসংঘের প্রভাবশালী নেতা এম. এল. সোন্ধি বলেন,

“বাংলাদেশ সঙ্কট ভারতের জন্য এক বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে— এই সুযোগে পাকিস্তানকে তার পূর্বাঞ্চল থেকে বঞ্চিত করে দক্ষিণ এশিয়ায় “major factor” হিসেবে আবির্ভূত হবার।”৫৯

As Jana Sangh president, Vajpayee addresses a mammoth rally in Delhi in August 1971, demanding the immediate recognition of Bangladesh by the Indian government
As Jana Sangh president, Vajpayee addresses a mammoth rally in Delhi in August 1971, demanding the immediate recognition of Bangladesh by the Indian government

 

জনসংঘ বরাবরই বাংলাদেশ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান অথবা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বিরোধী অবস্থান নেয়। তারা মনে করে ভারতকে এককভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। তা হবে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। কোন রাখঢাক ছাড়া বাজপেয়ী বলেন,

“We want recognition to Bangladesh so that the way is cleared for giving massive military aid to that country. “৬০

জনসংঘের মূল লক্ষ্য ছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা। এবং চিরশত্রু পাকিস্তানের ভাঙন নিশ্চিত করে পূর্বাঞ্চলের ওপর থেকে তার অধিকার হরণ করা।

ভিন্নপরিপ্রেক্ষিত থেকে হলেও জনসংঘ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু রাজা গোপালচারির স্বতন্ত্র পার্টি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করে। এই অবস্থানের প্রধান কারণ হলো সম্ভাব্য চৈনিক হস্তক্ষেপের ভীতি। বাংলাদেশ সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান সম্ভব তার জন্য প্রয়োজন আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখা, পাকিস্তানের ভাঙন বা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে এই সঙ্কটের অবসান হবে না। এই প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র পার্টিপ্রধান রাজা গোপালচারি লিখেছেন যে,

“If a frustrated Mujibur Rahman yields to the temptation of inviting China, it would be a fatal step which terminate in its (Bangladesh’s) becoming a satellite of communist China. “৬১

তা ছাড়া শরণার্থীর ভরণপোষণ যুদ্ধের চাইতে বেশি ব্যয়বহুল এই যুক্তিতে ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াকে স্বতন্ত্র পার্টি সমর্থন করে না। বরং যুদ্ধের কারণে ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাবার আশঙ্কা যেমন আছে তেমনি পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছ থেকে পাকিস্তানের সাহায্য পাবার সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে পারে। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা ভারতের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সঞ্চার করতে পারে।

“The Hindu Muslim relations within the country might also become strained if India became deeply involved in the Bangladesh problem. “৬২

স্বতন্ত্র পার্টি মুক্তিযুদ্ধকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে যেমন দেখেছে তেমনি চীনের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের বিষয়ও বিবেচনা করেছে। শেষ পর্যন্ত দলীয় অবস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে নিজের স্বার্থে ভারতের নিরপেক্ষ থাকা উচিত।

কিন্তু ভারতের বাম, অসাম্প্রদায়িক, উদার রাজনৈতিক দলের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সংগ্রাম, জনগণের ত্যাগ আর আদর্শিক প্রেরণা তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের আলোকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিবেচনা করেনি বরং জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে দেখে।৬৩

Bangladesh’s Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman observes the exit parade of the Indian Army stationed in Bangladesh, March 12, 1972
Bangladesh’s Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman observes the exit parade of the Indian Army stationed in Bangladesh, March 12, 1972

 

প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘জনতা’য় দলীয় অবস্থান সম্পর্কে লেখা হয় যে, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাসহ মৌলিক আদর্শগত বিষয়ে আওয়ামী লীগ এবং ভারত অংশীদার হওয়ায় ভারতের জনগণ এই সংগ্রামে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। ৬৪ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সীয়) দৃষ্টিতে বাংলাদেশ আন্দোলন পাকিস্তানের দুঅংশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ছিল না, বরং এটা ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জনতার ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রাম যা পাকিস্তানের উভয় অংশ এবং ভারতের জনসাধারণের সমর্থন করা উচিত।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের মধ্যে দলগত অবস্থানের দিক থেকে আদর্শগত সাদৃশ্য, বিশেষত গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা উল্লেখ করা যায়। নীতিগত প্রশ্নে শাসক দল কংগ্রেস এবং ভারত সরকারের মধ্যে মতানৈক্য না থাকার কথা। যদিও লোকসভায় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিতর্কে শাসক দলের অনেক সদস্য সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে সামগ্রিক বিচারে কংগ্রেস এবং ভারত সরকারের নীতি ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়,

“The working committee expresses its solidarity with the people of East Bengal and solemnly pledges itself to do whatever lies within its power to mitigate their sufferings,”

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে সামগ্রিক বিচারে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। অর্থাৎ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তবে রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে তাদের করণীয় স্থির করেছে। যে কারণে দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে বামপন্থী দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার, দক্ষিণপন্থী দলসমূহ এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্তর্নিহিত মিল লক্ষ্য করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের ন্যায্য আন্দোলন দাবি-দাওয়াকে বিবেচনা করেছে ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে মুসলমানদের আবাসভূমি পাকিস্তানকে ভাঙার হিন্দু ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে। বাঙালিদের স্বাধীন হবার রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামকে বিবেচনা করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা গৃহযুদ্ধ হিসেবে।

১৯৭১ সালের জুন মাসে করাচি থেকে প্রকাশিত পাকিস্তান সরকারের প্রচার পুস্তিকায় পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করা হয় যে,

“Sheikh Mujibur Rahman was fighting India’s war… How deep and long-term have been India’s plans for subversion in Pakistan is by now well-known… They ( Indians) started from the very day in 1947 when Pakistan was created. Since that day Indians have, never reconciled themselves to the fact of Pakistan and have employed every device to cripple this state. “৬৭

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন,

“ভারতকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে।… আওয়ামী লীগের ছ-দফা কর্মসূচি ছিল মূলত দেশকে দুঅংশে বিভক্ত করার ফর্মুলা। ….. পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এই বিশ্বাসে ৬-দফার পক্ষে ভোট দিয়েছে যে, এর মাধ্যমে বর্তমান অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটবে।”৬৮

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছেন পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রেসিডেন্ট পীর মোহসিন উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন,

“ভারতের এ সব কার্যকলাপ আমাদেরকে আজাদীপূর্ব দিনগুলোতে মুসলমানদের ওপর হিন্দুদের নির্যাতনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, যে সময় ব্রিটিশ রাজ্যের ছত্রছায়ায় ভারতীয় হিন্দুরা প্রতারণা করে মুসলমানদের সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে এবং তাদের ধর্মীয় কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ ও মুসলিম ছাত্রদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সীমিত ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা সৃষ্টি করে মুসলমানদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করেছে।” ৬৯

Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev
Richard Nixon, Indira Gandhi, Leonid Brezhnev

 

পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ইত্তেহাদুল উলেমার সাধারণ সম্পাদক মওলানা মিয়া মফিজুল হক বলেন,

“ভারত পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি মানুষকে চিরদিনের জন্য দাসে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত রয়েছে। … যারা ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী হয়ে ভারতীয়দের সাহায্যের আশায় আছেন, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন”। ৭০

ভারতকে দায়ী করে পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ বলেন,

“ভারত বিভাগ বাতিল করার জন্য ভারত প্রতিটি সুযোগেরই সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। … লক্ষ লক্ষ মুসলমানের জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে ভারতীয় মুসলমানদের এই বাসভূমি অর্জিত হয়েছে। ….. পাকিস্তানের বর্তমান শাসনতান্ত্রিক সমস্যা পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তা জনসাধারণকে দেশের সংহতি ও আদর্শ রক্ষা থেকে কখনোই বিরত করবে না।”৭১

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য ছিল। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাদের অবস্থান গ্রহণের কারণ হলো:

(ক) মুক্তিসংগ্রাম সফল হলে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও গণতান্ত্রিক ধারা শক্তিশালী হবে;

(খ) পরোক্ষভাবে এটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দুর্বল করবে;

(গ) এর ফলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা তিরোহিত হবে এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হবে।

৭২ তবে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছে। দলীয় তত্ত্ব অনুযায়ী এটা ছিল

“মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদলেহনকারী দুই কুকুরের লড়াই।”

এই দ্বন্দ্বের এক পক্ষে ছিল ইয়াহিয়া ও ভুট্টো অন্যদিকে শেখ মুজিব ও তার সমর্থক। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ উভয় পক্ষ শোষিত জনগণের শত্রু। তাই তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য গেরিলা বাহিনী গঠন করে। মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে ১০ হাজার সদস্যের ‘লাল গেরিলা’ দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি তৈরি করে শ্রেণীশত্রু নিধনযজ্ঞে লিপ্ত হয়। ৭৩

চীনপন্থী পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টি, ইস্ট বেঙ্গল ওয়ার্কার্স মুভমেন্ট। এই দল দুটি মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে প্রাথমিক পর্যায়ে গৃহীত দলের তাত্ত্বিক অবস্থান ধরে রাখতে সমর্থ হয়নি। এক পর্যায়ে বিভিন্ন উপদলে ভাগ হয়ে যায় নেতৃবৃন্দ। তবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী চীনপন্থী কমিউনিস্টরা মুক্তিসংগ্রাম কমিটি গঠন করে। এই কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ঘোষণা করা হয়। যদিও ভাসানী তা অস্বীকার করেন।

ভারতের সিপিএম এই কমিটিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে।৭৪ তবে পিকিংপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মওলানা ভাসানী, মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি প্রফেসর মোজাফফর আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর, কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ মুজিবনগর সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানান।

Maulana Abdul Hamid Khan Bhashani, Maulana Abdur Rashid Tarkabagish, Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman
Maulana Abdul Hamid Khan Bhashani, Maulana Abdur Rashid Tarkabagish, Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শবাদিতাকে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক বিবেচনা করতে চান না। তাদের বিবেচনায় একটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যা কিছু করে এর পেছনে প্রণোদনা যোগায় জাতীয় স্বার্থ। সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এমনি বক্তব্যের সমর্থনে লিখেছেন যে,

“১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন যে ভূমিকা পালন করেছিল, তার মূলেও ছিল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তাদের জাতীয় স্বার্থ।” ৭৫

এই পটভূমিতে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে,

“পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে আদর্শ সাধারণভাবে ভূমিকা পালন করলেও বিশেষ পরিস্থিতি এবং নির্দিষ্ট কোন সমস্যার প্রতি যে নীতি অনুসৃত হয়, তার মূলে কাজ করে জাতীয় স্বার্থ।”৭৬

অনুরূপভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও জাতীয় স্বার্থ তবে একমাত্র উপাদান হিসেবে মেনে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত হয় না। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন মনে করেন,

“Every country of course, is and will be motivated by self-interest. In 1971, every party involved saw to its own interest, the Bangalees saw to their interest, and so did Pakistan, and still then it is not true to say that the matter of ideology was not there. The Soviet Union always supported the freedom struggles of the third world countries as Saudi Arabia supports the Islamic countries. “৭৭

কেউ কেউ বলবার চেষ্টা করেন যে, ভারত কেবল তার জাতীয় স্বার্থে চিরশত্রু পাকিস্তানের ভাঙন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে। এই বক্তব্য অস্বীকার করছি না। পাকিস্তানের ভাঙন ভারতের জন্য সামরিক, অর্থনৈতিক এবং দক্ষিণ এশিয়া ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই বিরাট অর্জন।

আমরা মনে করি ভারতের ভূমিকার আড়ালে কেবল জাতীয় স্বার্থ ক্রিয়াশীল ছিল তা নয় এর সঙ্গে অপরিহার্যভাবে যুক্ত ছিল। আদর্শবাদিতা এবং ভাষা ও জাতিগত আবেগ। এমনকি কখনো কখনো আদর্শবাদিতা জাতীয় স্বার্থকেও ছাপিয়ে গেছে। কারণ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অবসান হবে এটা নিশ্চয় পূর্বনির্ধারিত ছিল না।

তাই একাত্তরে জুন-জুলাই মাসেও ভারত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এমন অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে যা তার জাতীয় নিরাপত্তা এবং অখণ্ডতার জন্য ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ ভারত সরকার কেবল পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাঙালির জাতিগত ভাবাবেগের চাপে ছিল তা নয় প্রায় সমগ্র ভারতব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক সহানুভূতি, আবেগের সঞ্চার হয়।

এমনি জনমতের চাপে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন যা তার দেশের জাতীয় স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারত। সুতরাং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিশ্লেষণে আদর্শ ও আবেগের জায়গায় যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শের সঙ্গে কংগ্রেসের মিল না থাকলে ভারতীয় সহায়তা পাওয়া সহজ হত না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হতে চাইলে ভারতের ভূমিকা কী হত? খুবই হাইপোথিটিক্যাল প্রশ্ন।

Tajuddin Ahmad Indira Gandhi
Tajuddin Ahmad Indira Gandhi

 

যথার্থ উত্তর দেওয়া মুশকিল। অন্তত এটুকু বলা যায় সাম্প্রদায়িকতাই যদি আওয়ামী নেতৃত্বের লক্ষ্য হত তাহলে এক পাকিস্তান ভেঙে দুই পাকিস্তান সৃষ্টিতে ভারতের উৎসাহিত হবার বাস্তব কোন কারণ ছিল না। সুতরাং আদর্শবাদিতাকে এ ক্ষেত্রে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। একই কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। আদর্শিক কারণে পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্য, মার্কিন সহায়তা পেয়েছে পুরোপুরি।

8.

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়টি নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের উদ্ভবকে কিভাবে দেখছে এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়নই বা কী তার ওপর। স্বাধীনতার পরপর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু চীনপন্থী বামদল ও ডানপন্থী দলগুলো সদ্য স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে ‘ভারত বিরোধিতা’কে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত করে।

এটা ছিল পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাবাহিকতা, কারণ এই দলগুলো বাংলাদেশের উদ্ভবকে দেখেছে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। যে কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের যে কোন সমস্যার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলো ভারতকে দায়ী করে জনমতকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। যা দুদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক ছায়া ফেলে। তবে আওয়ামী লীগ আমলে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার কারণে জাসদ ও মওলানা ভাসানীর ছত্রছায়ায় সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো তাদের তৎপরতা চালিয়ে যায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখলের পর স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক দল ও চীনপন্থীদের সমন্বয়ে নতুন রাজনীতিক দল গঠন করে ‘ভারত বিরোধিতা’কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে বাংলাদেশের উদ্ভবের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে।

এই তাত্ত্বিক কাঠামোর যথার্থতা প্রমাণিত হবে স্বাধীনতা-পরবর্তী এক দশক ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের পর্যালোচনা থেকে। ১৯৭১-১৯৮১ সময়কালে দুদেশের সম্পর্কের সামগ্রিক বিশ্লেষণে লক্ষ্য করা যায় দুদেশের মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আদর্শগত, আবেগগত ও জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে। কেবল জাতীয় স্বার্থের ধারণা কিংবা প্রচলিত বৃহৎ রাষ্ট্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ধারণার আলোকে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করলে সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া যাবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman & Srimathi Indira Gandhi ]

কারণ দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগ ও আদর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগ ও আদর্শগত দিক থেকে একটা সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক অমোচনীয় বিভাজন রেখা। এই ঘটনাকে ভারতের সরকারি প্রতিক্রিয়ায় ‘great shock’ (ভয়াবহ আঘাত) হিসেবে অভিহিত করা হয়।

আদর্শিক পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল জিয়াকে ভারতের দুটি বিপরীতধর্মী সরকারের মুখোমুখি হতে হয়। কৌশলগত কারণে জিয়া দেশাইয়ের সঙ্গে এক রকম সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সফল হলেও, ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তার ক্ষমতা গ্রহণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। যে কারণে মিসেস গান্ধীর সময়কালে জিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল শীতল, কখনও কখনও অত্যন্ত বৈরী। সুতরাং বলা যায় উপর্যুক্ত তাত্ত্বিক কাঠামোর অধীনে দুদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের সামগ্রিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন সম্ভব হবে। ৭৮

 

তথ্যনির্দেশ

১. Shaukat Hassan, The India Factor in the Foreign Policy of Bangladesh’ in M. G. Kabir and Shaukat Hassan, edited, Issues and Challenges Facing Bangladesh Foreign Policy, Dhaka, 1989, p. 52.

২. Ishtiaq Hossain, “Bangladesh-India Relations: issues and problems”, in Emajuddin Ahmed, edited, Foreign Policy of Bangladesh, Dhaka 1984, p. 34.

৩. Harunur Rashid, International Relations and Bangladesh, Dhaka, 2004, p.219.

8. Dr. S.S. Bindra, Indo-Bangladesh Relations, New Delhi, 1982..

৫. ঐ, পৃ. ১৪।

৬. ঐ, পৃ. ২৩।

৭. । ঐ।

৮. ঐ, পৃ. ৪৫।

৯. ঐ, পৃ. ৪৭।

১০. Shaukat Hassan, “India-Bangladesh Political Relations During the Awami League Government 1972-75”, Ph.D. Thesis, Australian National University. April, 1987.

১১. ঐ, পৃ. ৫৯।

১২. ঐ, পৃ. ৬৪।

১৩. ঐ, পৃ. ৭১।

১৪. ঐ, পৃ. ৭৫।

১৫. ঐ, পৃ. ৭৭।

১৬. ঐ, পৃ. ৯৭।

১৭. মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশ বাঙালি মানস রাষ্ট্রগঠন ও আধুনিকতা, ঢাকা, ২০০৭ পৃ. ৪৮।

১৮. Shaukat Hassan, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৫।

১৯. Moudud Ahmad, Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman, Dhaka,1983.

২০. Shaukat Hassan, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭।

২১. ঐ, পৃ. ১৯৯।

২২. Iftekhar A. Chowdhury, “Bangladesh’s External Relations, Ph.D. Thesis. Department of International Relations”, Australian National University, May, 1980.

২৩. ঐ, পৃ. ৬১।

২৪. ঐ, পৃ. ৭৯।

২৫. Virendra Narain, Foreign Policy of Bangladesh (1971-1981), Jaipur, India, 1987.

২৬. ঐ, পৃ. ৩।

২৭. ঐ, পৃ. ৭৮।

২৮. Denis Wright, Bangladesh Origins and Indian Ocean Relations, 1971-1975, Dhaka, 1988.

২৯. ঐ, পৃ. ১৩৮।

৩০. ঐ, পৃ. ১৫৩।

৩১. Rekha Saha, India Bangladesh Relations, Calcutta, 2000.

৩২. এ. পৃ. ২০৫।

৩৩. Zaglul Haider, The Changing Pattern of Bangladesh Foreign Policy: A Comparative Study of the Mujib and Zia Regimes, Dhaka, 2006.

৩৪. ঐ, পৃ. ২৩০।

৩৫. আবুল কালাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ তত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ, ঢাকা ১৯৯৯, পৃ. ২৫।

৩৬. Norman J. Padelford, George A. Liencoln and Lee D. Olvey, The Dynamics of International Politics, New York, 1976, p. 35.

৩৭. H. K. Chhabra, Relations of Nations Foreign Policy of Major Countries, Delhi, 1983, p. 3.

৩৮. গবেষণা পদ্ধতির আলোচনায় বিভিন্ন গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। তবে বিশেষ করে মোঃ আব্দুল হালিম, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলনীতি, ঢাকা ১৯৮৪ এবং আবুল কালাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ তত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ, ঢাকা, ১৯৯৯ থেকে বিশেষ সহায়তা গ্রহণ করেছি।

৩৯. জয়া চ্যাটার্জী, বাঙলা ভাগ হল: হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ-বিভাগ ১৯৩২-১৯৪৭, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ১।

৪০. আজিজুর রহমান মাল্লিক ও সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাঙালী জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ভিত্তি’ দ্র. সিরাজুল ইসলাম, সম্পাদিত, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, ১ম খণ্ড, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ৫৪০

৪১. উদ্ধৃত, কামরুদ্দীন আহমদ, বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ. ২৫। এ ছাড়া আরো দেখা যেতে পারে মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্তকুমার রায়, প্রশাসনের অন্দর মহল। বাংলাদেশ, কলকাতা, ১৯৮৭। আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫, Jayanta Kumar Ray, Democracy and Nationalism on Trial: A Study of East Pakistan, Simla, 1968, মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্ত কুমার রায়, বাংলাদেশে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ঢাকা, ১৯৯৫।

৪২. আবুল কালাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০।

৪৩. The New Encyclopaedia Britanica, Vol. V, Chicago, 1981, p. 287.

৪৪. Jack C. Plans and Roy Olton, The International Relations Dictionary, New York, 1969, pp. 105-107.

৪৫. উদ্ধৃত, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ইসলামী বিশ্ব ও বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ১৩।

৪৬. F. S. Northedge, “The Nature of Foreign Policy” in FS. Northedge (ed.) The Foreign Policies of Powers, London, 1968, p. 13.

৪৭. বি রমন, র-এর কাওবয়েরা, স্মৃতির সিঁড়িতে অবরোহণ, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৩৭-৩৮।

৪৮. “In fact, ideologically, the Al leadership had never subscribed to the doctrine of social change through violence…. Always upholding the principle of liberal democracy and which (AL) would establish a new exploitationless society based on nationalist feelings,” Shyamali Ghosh.

The Awami League 1949-1971, Dhaka, 1990, pp. 166-171. Md. Abdul Wadud Bhuiyan, The Emergence of Bangladesh and Role of the Awami League, New Delhi, 1982.

৪৯. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৯৪,

৫০. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭।

৫১. Fred A. Sandermann, David S. McLellan, Willam C. Olson, edited, The Theory and Practice of International Relations, Fifth edition, USA, 1979, p. 85.

৫২. The New Encyclopaedia Britanica, Vol. V, Chicago, 1981, p. 287,

৫৩. James H. Billington, “Reflections on the nonmaterial aspects of National Interests.” in Professor Gifford, edited, The National Interests of the United States, University Press of America, 1981, pp. 180-183.

৫৪. Hans J. Morgenthau, Politics Among Nations: The Struggle for Power and Peace, Sixth edition, New York, 1985, p. 70.

৫৫. Hans J. Morgenthau, In Defence of the National Interests: A critical Examination of America Foreign Policy, (1st ed.), New York, 1951, p. 242.

৫৬. মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯২, পৃ. ২০।

৫৭. The Times of India, 5 July, 1971.

৫৮. Organiser, Vol. XXV, No. 2, 21 August, 1971.

৫৯. N. M. Chatale (ed.), Bangla Desh Crisis and Consequences, New Delhi, 1971, pp. 146-148.

৬০. ঐ, পৃ. ৪৪

৬১. Swarajya, Vol. XV, No. 40, April 3, 1971, p. 21.

৬২. Swarajya, Vol. XV, No. 42, April 17, 1971, p. 21.

৬৩. New Age, Vol. XIV, No. 18, May 2, 1971, p. 1.

৬৪. Janata, Vol. XXVI, No. 11 April 4, 1971, p. 2.

৬৫. Peoples Democracy, Vol. 7, No. 14 April 18, 1971, p. 3.

৬৬. A. M. Zaidi and S. G. Zaidi, The Encyclopaedia of the Indian National Congress, Vol. 21, 1970-1971, New Delhi, 1984, p. 363.

৬৭. হাসান হাফিজুর রহমান, সম্পাদিত, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র, সপ্তম খণ্ড, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ. ৩৪১।

৬৮. দৈনিক পাকিস্তান, ৮.৪.১৯৭১।

৬৯. ঐ।

৭০. ঐ।

৭১. ঐ।

৭২. কেন্দ্রীয় কমিটি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যায়ন, কলকাতা, ২১.৫.৭১।

৭৩. গণশক্তি, এপ্রিল, ১৯৭১।

৭৪. Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh Revolution Dhaka 2nd impression, 2003. pp. 142-143.

৭৫. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, প্রাগুক্ত, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ১৪।

৭৬. ঐ।

৭৭. Muntassir Mamoon (ed.), Media and the Liberation War of Bangladesh, haka, 2002, p. 19.

৭৮. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, মোঃ সেলিম, “বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: ১৯৭১-১৯৮১”, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৮ (অপ্রকাশিত অভিসন্দর্ভ)।

আরও পড়ুন:

 

Leave a Comment