বাঙালির ধর্মচিন্তা : কীভাবে শাস্ত্রীয় ধর্মে রূপান্তরিত হল? এর উত্তর অনুসন্ধানে দেখা গেছে। আমি দর্শকে শাস্ত্রকাররা নিয়ম-রীতির পরাকাষ্ঠায় রূপ দিয়ে গ্রন্থবদ্ধ করে ধর্মানুসারে নিকট হাজির করে, এবং এই শাস্ত্রীয় রীতিকেই জীবন বিধান কিংবা অব পালনীয় রীতি বলে ঘোষণা দেয়। ধর্মকে যখন এরূপ শাস্ত্রবদ্ধ করে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া-করণকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বা সেগুলো ধর্মাচারের ক্ষেত্রে আবশ্যক হয়ে ওঠে তখন একটি ধর্ম শাস্ত্রীয় ধর্মের রূপলাভ করে।
বাঙালির ধর্মচিন্তা – লোকধর্ম বনাম শাস্ত্রীয় ধর্ম
লোকধর্মকে মোটামুটিভাবে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সুনির্দিষ্ট আদেশ নিয়ে তাঁর প্রেরিত পুরুষ (রাসুল বা গয়গম্বর) কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম। তৌরাত, জবুর, ইঞ্জিল ও কোরআন দ্বারা প্রচারিত ধর্ম এই পর্যায়ে পড়ে। এ সমস্ত ধর্মে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশের বাইরে যাবার শক্তি তাঁর প্রেরিত পুরুষদের নেই। কিন্তু লোকধর্মে সে সুযোগ আছে। লোকধর্ম সময়োপযোগী। তবে… শাস্ত্রীয়ধর্ম ও লোকধর্মের মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্বন্ধ সূত্র বিদ্যমান। শাস্ত্রীয়ধর্মের উদ্ভবের ভিত্তি লোকধর্ম আবার শাস্ত্রীয় ধর্মের মধ্য হতেই নতুন নতুন লোকধর্মের সৃষ্টি হয়। শাস্ত্রীয়ধর্ম আর লোকধর্মের মধ্যে বিরোধও কম নেই। এই দুটি ধর্ম ধারা যেমন একটি অপরটির উৎসমূল হিসেবে কাজ করে তেমনি দুটির মধ্যকার বিরোধও জিইয়ে রাখে।
শাস্ত্রীয় ধর্মের কাছা-কাছি, পাশাপাশি কিংবা মধ্যেই লোকধর্মের অবস্থান কিন্তু লোকধর্মের চর্চা ও লোকধর্মানুসারীদের সক্রিয়তা শাস্ত্রীয় ধর্মানুসারীদের শঙ্কিত করে তোলে। শাস্ত্রীয়ধর্ম সবসময় নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কিত কিছু মূল নীতিতে আশ্রয় করে পরিচালিত হয়। এ সব নীতি অনুসারীদের ক্ষেত্রে অবশ্য পালনীয়। শাস্ত্রাচার কিংবা সংশ্লিষ্ট করণ-ক্রিয়া সম্পর্কে পুরোহিত, ধর্মগুরু, মৌলবী, পাদ্রী প্রমুখ নিজ নিজ ধর্মানুসারীদের সচেতন করে তোলে এবং এ সকল ধর্মাচার পালনের উৎসাহিত করে। শাস্ত্রীয় ধর্ম শাস্ত্রাচারের প্রতি অবজ্ঞা কিংবা শাস্ত্রীয় রীতি-নীতির অবমাননা সম্মিলিত জীবনের সংহতির ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখে।
শাস্ত্র বর্ণিত পাপ-পুণ্যের ধারণা ও ধর্মাচার পালনের ফলাফলের প্রতি অবিশ্বাস স্থাপনাকারীকে শাস্ত্রবেত্তাগণ অধার্মিক হিসেবে বিবেচিত করে। সমবেত প্রার্থনা ও তৎসংশ্লিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি আত্মনিবেদনে উৎসাহিত করে দশবিধ সংস্কার, ন্যায়-অন্যায় বোধ, পাপ-পুণ্যের ধারণা, ইহলৌকিক-পারলৌকিক জীবনবোধ, অতিপ্রাকৃত শক্তির স্বরূপ প্রভৃতি ব্যাখ্যা হাজির করতে এক একটি শাস্ত্রীয়ধর্মে এক বা অধিক শাস্ত্রের অবতারণা ঘটে। এ সকল শাস্ত্রের বিধানগুলো প্রায় সকল সময় আসমানী কিতাব বা অলৌকিক বাণী হিসেবে সমাজে প্রচার পায়।
শাস্ত্র নিজ নিজ ধর্মানুসারীদের নিকট পূর্ণ জীবন বিধান রূপে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন হয়ে ওঠে। শাস্ত্রীয় রীতির বাইরে কিংবা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার বাইরে স্বতন্ত্র ভাবনা ও জীবনচর্যাকে শাস্ত্রীয় ধর্ম বরাবরই অনুৎসাহিত করে। ফলে জীবন, জগৎ, ঈশ্বরের ধারণা, সৃষ্টিতত্ত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে শাস্ত্রকারদের ব্যাখ্যার সত্যাসত্য বিচার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাকে অভ্রান্ত বলে ভাবতে শেখা এবং এ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে প্রশ্নতোলা শাস্ত্রাশ্রিত সমাজে নিন্দনীয়, কখনো কখনো দগুণীয় অপরাধ বলে স্বীকৃত।
পক্ষান্তরে লোকধর্ম বরাবরই শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বিকল্প খোঁজে। সে বা তাঁরা জীবন চর্চার নয়া নয়া ব্যাখ্যা হাজির করে যা শাস্ত্রের বিকল্প হিসেবে শাস্ত্রীয় ধর্মকে প্রতিহত করে। এই নয়া ব্যাখ্যাতাগণ শাস্ত্রকার কিংবা শাস্ত্রীয় ধারক, প্রচারকদের ধর্ম নিয়ে বাহাসে আহ্বান করে। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাহাস শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাকে হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করায়। সময়ের বিবর্তনে কখনো কখনো কোন কোন ব্যক্তি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে স্থবিরতা থেকে মুক্তি দিয়ে স্বঘোষিত ও নয়া ব্যাখ্যা সংবলিত ধর্মধারার প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে নতুন নতুন গড়ে ওঠা ধর্মধারা ধীরে ধীরে একটি নতুন লোকধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
শাস্ত্রীয় গ্রন্থের নিয়মনীতি অমান্যকারীকে শাস্ত্রীয়ধর্ম নিজ অনুশাসনে শাস্তি প্রয়োগ করতে, কখনো সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করে, আবার কখনো প্রায়শ্চিত্ত, তওবা প্রভৃতি নামক সংশোধনী আচার পালন করে, সম্প্রদায়ের সভ্য হিসেবে গ্রহণ করে। লোকধর্মের ক্ষেত্রে এ রকম বাধ্যবাধকতার মানদণ্ড ক্রিয়াশীল থাকে না। লোকধর্মের অনুসারীগণ অনেকটাই স্বাধীন চিন্তাকে উসকে দেয় বলে সম্প্রদায়ের সভ্য হিসেবে নিজের আত্মপরিচয় নির্বাচন করতে যে কোন সম্প্রদায়ভুক্ত হতে পারে। এ বিষয়ে লোকধর্ম কারো জন্য কোন শাস্তির বিধান কিংবা সংশোধনী রীতি কায়েম করে না।
![বাঙালির ধর্মচিন্তা 4 The Armenian Church of the Holy Resurrection, built in 1781, Armanitola, Dhaka [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/The-Armenian-Church-of-the-Holy-Resurrection-built-in-1781-Armanitola-Dhaka-225x300.jpg)
আবার শাস্ত্রীয়ধর্ম লোকধর্মকে প্রতিনিয়ত আত্তীকরণ করে দিতে চায়, এবং নিয়ত আক্রমণাত্মক ব্যাখ্যায় লোকধর্মের ধারকদের বিরুদ্ধে জেহাদ জিইয়ে রাখে। কখনো বা সশস্ত্র আক্রমণে পরাভূত করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে লোকধর্মের বৈশিষ্ট্য সর্বদা অহিংস। লোকধর্মের অনুসারীগণ শাস্ত্রীয়ধর্মের অনুসারীদের সশস্ত্র হয়ে মোকাবেলা করার পরিবর্তে বিপদকালীন শাস্ত্রীয় ধ্বজা ধরে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা চালায়। অথবা আত্মগোপন করে গুহ্য জীবচর্চায় নিজস্ব মত ও পথকে বাঁচিয়ে রাখে।
শাস্ত্রীয়ধর্মের পুরোহিত, প্রচারক প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রযন্ত্র ও শাসককূলের আনুকূল্যলাভের প্রত্যাশী। এই উদ্দেশ্যে শাসককূলের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে শাসন প্রদত্ত নীতি-নৈতিকতাকে সমাজে ধর্মীয় ছবকের প্রচার করে। শাসকদের ব্যাখ্যাই হয়ে ওঠে পুরোহিতের ব্যাখ্যা। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা, গণজমায়েত, প্রভৃতির মধ্যে শাসককূলের কর্মক্রিয়াকে বৈধতা দান করার প্রবণতা দেখা যায়। সমস্ত সামাজিক অসঙ্গতিকে অধ্যাত্মবাদী দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা বিদ্যমান থাকে। এমনকি অধস্তনের প্রতি নিপীড়নকে দেখা হয় মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা হিসেবে।
পক্ষান্তরে লোকধর্মে শাসককূলের আনুগত্য লাভের বাসনা থাকলেও সে বাসনা যতনা স্পষ্ট হয় তার চেয়ে শাসকের কেন্দ্রীয়ক্ষমতাকে মোকাবেলা করার বাসনা স্পষ্ট হয় বেশি। ফলে তোষামোদের পরিবর্তে আধিপত্যকে খর্ব করার চেষ্টার জন্য শাসককূল হতে লোকধর্মানুসারীদের প্রতিনিয়ত দূরে সরিয়ে দেয়। তবে শাসকবর্গের নৈতিকতাকে মোকাবেলা করার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের জন্য লোকধর্মানুসারীদের শাসকেরা শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করে।
![বাঙালির ধর্মচিন্তা 5 The Armenian Church of the Holy Resurrection, built in 1781, Armanitola, Dhaka [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/The-Armenian-Church-of-the-Holy-Resurrection-built-in-1781-Armanitola-Dhaka-1-300x225.jpg)
কখনো কখনো লোকধর্মের প্রসারকে শাসকেরা তাদের কুক্ষিগত ক্ষমতার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখে, এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাকতে লোকধর্মকে বিলীন করতে সচেষ্ট হয়। শাসকবর্গের এই প্রচেষ্টায় বিরুদ্ধে লোকসাধারণের অসন্তোষ ধীরে ধীরে দানা বাঁধে। একই সমাজ, গোষ্ঠী কিংবা সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই দ্বন্দ্ব সক্রিয় থাকতে পারে। সমাজের মধ্যে বাড়তে থাকা এই দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে সামাজিক রূপান্তর কিংবা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
সেই পরিবর্তন ধর্মীয় পরিচয়ে ঘটলেও তার অধ্যাত্মচিন্তনের অভ্যন্তরে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। উদাহরণ স্বরূপ গোড়ার দিককার খ্রিষ্টধর্মের কথা বলা যায়। খ্রিষ্টধর্ম গোড়ায় ছিল উৎপীড়িত মানুষের আন্দোলন : দাস আর মুক্তিপাওয়া দাস, সর্ব-অধিকারবঞ্চিত গরিব মানুষ, রোম কর্তৃক পদানত কিংবা ছত্রভঙ্গ জাতিগুলির ধর্ম হিসেবে এটি প্রথমে উদ্ভব ঘটেছিল।
এটি নির্যাতিত এবং নিগৃহীত, অনুগামীরা অবজ্ঞার পাত্র এবং বহিষ্কারক আইন কানুনের অধীন : ধর্মের, পরিবারের, মানবজাতির শত্রু হিসেবে যাবতীয় নির্যাতন সত্ত্বেও, এমনকি সেটির তাড়নায় অনুপ্রাণিত হয়ে, জয়যুক্ত হয়ে, দুর্নিবার গতিতে সামনে এগিয়ে চলে। তিন-শ’ বছর পর এটিই রোম বিশ্ব সাম্রাজ্যের স্বীকৃত রাষ্ট্রধর্ম হয়ে ওঠে। এক কালের শ্রমিক বা দাসের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে গড়ে ওঠা ধর্ম কালের বিবর্তনে শাস্ত্রীয় রূপলাভ করে।
![বাঙালির ধর্মচিন্তা 6 Bangladesh’s Church leaders join the celebration of the centennial of the migration of Bhawal Christians, Photo by Father Bablu Corraya [ বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম, Christianity in Bangladesh ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/01/Bangladeshs-Church-leaders-join-the-celebration-of-the-centennial-of-the-migration-of-Bhawal-Christians-Photo-by-Father-Bablu-Corraya-300x200.jpg)
শাস্ত্রীয় ধর্ম ও ধর্মানুসারীগণ প্রতিনিয়ত সমস্ত জনগোষ্ঠীর সংহতি স্বমতে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই চেষ্টা প্রথম শুরু করে সাধারণ মানুষের চিন্তা জাগতিক বিষয়গুলোকে নিজ নিজ ধর্মের পক্ষে নেওয়ার মাধ্যমে। এই উদ্দেশ্যে তথাকথিত কোন বড় ধর্ম বা শাস্ত্রীয়ধর্মের অনুসারীগণকে নিজ নিজ শাস্ত্রের ব্যাখ্যা ও বয়ান প্রদানের উদ্দেশ্যে যত্র তত্র ধর্মীয় সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মতবিনিময় সভা প্রভৃতি কর্মসূচি পালনের প্রতি প্রতিনিয়ত আগ্রহী থাকতে দেখা যায়। নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে স্বযুক্তির পক্ষে নানামুখী উদাহরণ আর বিদগ্ধতার স্বাক্ষর রাখতে চেষ্টা করে।
সাধারণ মানুষের মননগত সম্মতি আদায়ের পর শুরু হয় ধর্মীয় আচার আচরণের পরিধির মধ্যে জীবনযাপনে অনুপ্রাণিত ও বাধ্য করা। কখনো বা এই উদ্দেশ্যে পাপ বা পরকালের শাস্তি ভোগের অবশ্যম্ভাবী পরিণতির পক্ষে বিবৃতি প্রদান করা হয়। সাধারণ ও সমাজের ব্যাপক মানুষ যখন কোন একটি ক্ষমতাবান ধর্মের প্রতি (ক্ষমতাবান ব্যক্তিগণের আচরিত ধর্ম) আনুগত্য প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করে কিংবা অস্বীকার করে তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাজানুগ্রহ লাভকারী ও শাস্ত্রীয় ধর্মের ধ্বজাধারীদের দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার হয়।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা এ সব ধর্ম সকল সময় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে এবং সেই ধর্মের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে বাধ্য করে। অন্যপক্ষে একটি ধর্ম লোকধর্মে রূপলাভ করে বল প্রয়োগের ক্ষমতা তথা কায়েমী স্বার্থকে অস্বীকার করে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে লোকধর্মের উদ্ভবের সাথে বঞ্চিত মানুষের হিস্যা আদায়ের উদ্দেশ্যে সংগঠিত দ্ৰোহ প্রদর্শন ও ক্ষমতা বলয়ে আঘাতের যোগসূত্র থাকে তবুও সে ধর্ম ততক্ষণই লোকধর্ম থাকে যতক্ষণ সেটি সর্বজনীন মাঙ্গলিক ও উদারতার বার্তা বয়ে চলে। লোকধর্মের বার্তা সর্বকালে সর্বদেশে একই রকম।

লোকধর্ম সর্বদা শাস্ত্রীয়ধর্মের চাপে অন্তর্মুখি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। শাস্ত্রীয় ধর্মের আক্রমণের স্বীকার হয়ে ক্রমান্বয়ে এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রাম্য বারোয়ারিতলা, পুরাতন মহিরুহের নিচে, খানকা, আখড়া প্রভৃতি স্থানে নিতান্তই নিভৃতে নির্জনে সাধনা চালিয়ে যায়। প্রতিনিয়ত শাস্ত্রীয় প্রতাপের রোষানলে পড়ে লোকধর্ম ধারা গুহ্য, গভীর নির্জন পথের সাধনায় পর্যবসতি হয়। তাই এ ধর্মে গুরু তাঁর শিষ্যকে সাবধান করে দেয়, ‘আপন সাধন কথা না কহিও যথা তথা’- বলে।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত ও প্রচলিত অনেক নিয়ম নীতির সাথে লোকধর্মের অনেক তত্ত্বসঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় অনেক সময় সেগুলো গুরু আর শিষ্যের মধ্যে গুরুমুখী বিদ্যা হিসেবেই অন্তরালে চর্চা হতে বাধ্য হয়। আবার রাষ্ট্র অধিকাংশ সময় এসব চেতনা ও চর্চাকে স্বীকৃতি না দেওয়ায়, লোকধর্মানুসারীদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে, রাষ্ট্র স্বীকৃত কোন শাস্ত্রীয়ধর্মের শরণাপন্ন হতে হয়। ফলে কখনো কখনো শাস্ত্রীয়ধর্মের চাপে লোকধর্ম টিকতে না পেরে, কোন কোন লোকধর্মের ক্ষীণ ধারা কালের বিবর্তনে, নতুন লোকধর্মের সূত্রের মধ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল থাকে।
শাস্ত্রীয়ধর্ম কোন না কোন লোকধর্মকে আত্তীকরণ করে উৎপত্তি লাভ করেছে। লোকধর্মের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যকে প্রতিনিয়ত সুযোগভোগী শ্রেণি মানুষ শাসককূলের অনুগামী করার চেষ্টায় থাকে। তারা লোকধর্মের মধ্যকার লৌকিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে অলৌকিক ঘটনাবলী বলে প্রমাণ করার প্রয়াসে নানামুখী তৎপরতা জিইয়ে রাখে। তাদের এই উদ্যোগ কখনো কখনো সমবেত হয়ে ওঠে। তাদের এই সমবেত কর্মক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে শাস্ত্র প্রণয়ন, শ্রেণি স্বার্থকে কুক্ষিগত করে রাখার প্রচেষ্টা, এবং সর্বোপরি কায়েমী স্বার্থের স্বপক্ষে সমাজস্থ মানুষের চৈতন্যের স্বীকৃতি লাভের প্রয়োজনে শাস্ত্রীয়ধর্মের প্রসার ঘটাতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

শাস্ত্রীয় ধর্মের উদ্ভবকালে লোকধর্মের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বটে, কিন্তু কালে কালে শ্রেণিস্বার্থের সুযোগলোভী মানুষের করতলগত হয়ে নানাভাবে তার লোকচেতনা লোপ পায়। ফলে শাস্ত্রীয়ধর্ম কৌম গোষ্ঠী প্রধান, সামন্তপ্রভু কিংবা আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের পুঁজিপতি সকলেই ধর্মীয় ব্যাখ্যার মানদণ্ড নিরুপণের উদ্দেশ্যে মাথার উপর তরবারি কিংবা ত্রিশুল উঁচিয়ে ধরে।
লোকধর্মের উপাদানাগুলো একটি সমাজ, সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর আবহমান ঐতিহ্য হিসেবে বেঁচে থাকে। সেগুলো জাতীয় ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভে ব্যর্থ হলেও তা সমাজের শ্রেণি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত জীবনচর্চার অঙ্গ বা উপাদানে পরিণত হয় এটি বংশ পরম্পরায় চলে। সেগুলো দেশজ ঐতিহ্য হওয়ায় সমস্ত ধরনের আরোপিত মতবাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। এটি ঘটে এর ধারক ও বাহকগণের আন্তঃপ্রতিষ্ঠার কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। লোকধর্মের ধারকেরা যতটা তাদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যাবলি বিনষ্টের আশঙ্কায় ভোগে তার চেয়ে অধিক সমন্বয় ও সহনশীলতার মধ্যদিয়ে অতিক্রান্ত হয়।
পক্ষান্তরে শাস্ত্রীয়ধর্ম প্রতিনিয়ত লোকধর্মের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলো অধিকৃত করে স্বঐতিহ্য বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং প্রতিনিয়ত নিজ নিজ ধর্মের শুদ্ধতা ও অপরের দ্বারা অবমাননার আশঙ্কায় ভোগে। শাস্ত্রীয়ধর্মকে শাস্ত্রকার, প্রচারক, পুরোহিত প্রমুখ ব্যক্তি অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতায় বলপ্রয়োগে উৎসাহিত হলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সহনশীল লৌকিক ধারার জনগোষ্ঠী শাস্ত্রীয়ধর্মের ধ্বজার নিচে দাঁড়ায় বটে, কিন্তু সে তার দেশাচারকে ভুলতে পারে না। তাই দেখা যায় শাস্ত্রীয়ধর্ম প্রচারকগণ সদল চেষ্টায় লোকসাধারণকে ধর্মান্তরিত করলেও সমস্ত ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে শাস্ত্রীয় রীতির সীমার সমান্তরাল ঐতিহ্যগতভাবে লৌকিক ক্রিয়াগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

ধর্মকে যখন জটিল তত্ত্বানুশীলনে আবৃত করা হয় তখন প্রতিনিয়ত বিপত্তি ঘটে। ধর্ম মানব জীবনে অপরিহার্য বলেই কখনো, কখনো আপন আপন পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের নিমিত্তে, কায়েমি স্বার্থকে বলবৎ করার মানসে ধর্ম ব্যাখ্যায় নানারূপ জটিলতার আশ্রয় নেয়। তথাকথিত পণ্ডিতজনেরা নানা রকম শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা আর টিকা ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতা দ্বারা ধর্মকে আকীর্ণ করে, ঘোরালো পথে মানব মুক্তির পথানুসন্ধান করে বিস্ময় অনুভব করে। ফলে ধর্মীয় দর্শন, চৰ্চা পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে।
ক্রমান্বয়ে ধর্ম সাধারণ মানুষের নিকট জটিল, আর আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে অনুসারীদের বিহ্বল করে তোলে। এই বিহ্বলতা থেকে মুক্তি পেতে নানা স্থানে নানাজন নতুন নতুন ও অপরিচিত পথে হাঁটছে। এ সকল অপরিচিত পথ ধর্মীয় সরল পথের নিশানাকে বাৎলে দিতে চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু জটিল, দুর্বোধ্য, অপরিচিত পথে পাথেয় খুঁজতে গিয়ে সাধক, ভক্ত, কর্মী মানুষের কর্মযোগে স্থবিরতা দেখা দেয়, জ্ঞানকাণ্ড হয়ে ওঠে ধোয়াচ্ছান্ন। কখনো কখনো তথাকথিত শাস্ত্রব্যাখ্যাকারীগণ শাস্ত্রকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বার্থপরায়ণতার আশ্রয় নেন, যা মৃঢ়তার নামান্তর। এর ফলশ্রুতিতে তারা ধর্মানুসারীদের ভ্রান্তিবশত শাস্ত্রশাসনে রাধ্য করার চেষ্টা করে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন
বাহিরে দেখিতে যেমনই হউক জটিলতাই দুর্বলতা, তাহা অকৃতার্থতা; পূর্ণতাই সরলতা। ধর্ম সেই পরিপূর্ণতার, সুতরাং সরলতার একমাত্র চরমতম আদর্শ। কিন্তু এমনি আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই ধর্মকেই মানুষ সংসারের সর্বাপেক্ষা জটিলতা দ্বারা আকীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে। তাহা অশেষ তন্ত্রে মন্ত্রে কৃত্রিম ক্রিয়াকর্মে জটিল মতবাদে বিচিত্র কল্পনায় এমনি গহন দুর্গম হইয়া উঠিয়াছে যে, মানুষের সেই স্বকৃত অন্ধকারময় জটিলতার মধ্যে প্রত্যহ এক-একজন অধ্যবসায়ী এক এক নুতন পথ কাটিয়া নব নব সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করিতেছে। সেই ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় ও মতবাদের সংঘর্ষে জগতে বিরোধ-বিদ্বেষ অশান্তি-অমঙ্গলের আর সীমা নাই। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধর্ম; বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃ. ৩৫)।
ধর্ম জটিল হয়ে ওঠে তখনি যখন তার লোকবৈশিষ্ট্যটি লোপ পায়। ধর্মের লৌকিক বৈশিষ্ট্য হল সরলভাবে সর্বজনী আবাহন। সেখানে শ্রেণিভেদে সকলের মিলনের আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। এই আকাঙ্ক্ষার বিলুপ্তি ঘটলেই বিরোধ বিদ্বেষ প্রকট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মের এই লোকবৈশিষ্ট্য লোপ পেয়ে জটিল হয়ে ওঠার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন ইহার একমাত্র কারণ, সর্বান্তঃকরণে আমরা নিজেকে ধর্মের অনুগত না করিয়া, ধর্মকে নিজের অনুরূপ করিবার চেষ্টা করিয়াছি বলিয়া। ধর্মকে আমরা সংস্কারের অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্যের ন্যায় নিজেদের বিশেষ ব্যবহারযোগ্য করিয়া লইবার জন্য আপন আপন পরিমাপে তাহাকে বিশেষভাবে খর্ব করিয়া লই বলিয়া (প্রাগুক্ত)।
ধর্মকে জটিল, অর্থহীন, মোহাচ্ছন্ন সৃষ্টিকারীবস্তু হিসেবে প্রতিপন্ন করা কিংবা সুবিধাভোগীদের করতলগত করে তোলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন লোককবি, গায়ক, বয়াতি, সাধক কিংবা লোকদার্শনিক। তারা সকল সময় আপন শ্রেণি মানুষের চৈতন্যকে শাস্ত্রকারের মোহাচ্ছন্নতা থেকে নিবৃত করতে প্রাণের তাগিদে চারণের ভূমিকা গ্রহণ করে। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনপদে জনপদে ধর্মের সহজ-সরল বার্তা জ্ঞাপন করে।

ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মানসে শাসক-শোষকেরা যে অপকৌশলের আশ্রয় নেয় শাস্ত্রকারেরা সেই অপকৌশলকে ত্বরান্বিত করতে ধর্মকে অনেক সময় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যখনই ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের এই অপচেষ্টা শুরু হয় তখনই, বঞ্চিত জনমধ্য থেকে ধর্মদিয়েই আবার তার গতিরোধ করা হয়। ধর্মের লেবাছধারী দুর্জনেরা জনগণকে মায়া জালে আটকাতে মনোহরী প্রলোভন সংবলিত ফতোয়া প্রদান করে। লোকধর্ম দুর্জনদের এই দুর্মতিকে মোকাবেলা করে।
লোকধর্ম সমাজ বিচ্যুত কোন কল্পনার কথান্তর বা আচার নয়। সমাজবদ্ধ শ্রেণি মানুষের অধ্যাত্ম চিন্তার খোলসে বঞ্চনা আর না পাওয়ার প্রতিবাদ, আন্তঃপ্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতি। সমাজের সুযোগভোগী মানুষের বাইরে টিকে থাকা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ভাবনায় এটি মূর্ত হয়ে ওঠে।
শাসকবর্গের কবলে পড়ে ধর্ম যখন উৎপাদক শ্রেণি মানুষের পেশা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান নান্দনিকতা আর ধ্রুপদী সীমার মধ্যে আবদ্ধ হওয়ার বাসনায় উন্মুখ থাকে, ধর্মাচারী মানুষ আচারসর্বস্বতার বেড়াজালে রুদ্ধ হয়, ধর্মাচারের পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন ক্রিয়াকে পারলৌকিক লোভ ও লাভের উপাদান বলে পরিগণিত করে এবং ধর্মাচারের নিয়ম-নিষ্ঠা যথাযথভাবে পালন না করতে পারার আশঙ্কায় ভোগে, তখন শ্রমজীবীরা তাদের মনন, চিন্তন দিয়ে মোকাবেলা করে বুদ্ধিজীবীদের।
শ্রমজীবীরা তাদের শ্রম ও পেশার সাথে সঙ্গতি রেখে অধ্যাত্ম ভাবনা ও ধর্মাচারের ঐতিহ্যকে নতুনভাবে সমাজের ধর্ম জীবন্ত করে তোলে। ফলে শাসক, শাসককূলের আনুগত্যলোভী সুবিধাবাদী শ্রেণিমানুষের বিপরীতে আরো একদল গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ ধর্মানুষ্ঠানের চর্চা করে চলে, যা লোকধর্ম উদ্ভবের ও চর্চার ইতিহাসকে ত্বরান্বিত করে।

লোকধর্ম বরবারই পেশাজীবী গোষ্ঠীর পেশা নির্ভর। সেখানে তার আপন শ্রেণি বঞ্চনার ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে লালন করে। এই ধর্মীয় চর্চা ও আন্দোলন নিয়ত প্রবহমান। কালে কালে বঞ্চিত মানুষের ভাবনা ও চর্চার উপকরণ উচ্চকোটির মানুষ আত্তিকরণ করে নেয়। আর কালে কালেই সেই আত্তিকরণের পশ্চাতে সুপ্ত প্রতিবাদ বেগবান হতে থাকে। ফলে আর্থসামাজিক সুযোগের সাথেই অধ্যাত্মভাবনা নিয়ে নানামুখি তৎপরতা জিইয়ে থাকে। এই তৎপরতার মধ্যেই ব্রাত্য-বঞ্চিত প্রান্তীয় মানুষ ধর্মীয় আন্দোলনের খোলসে হক আদায়ে সক্রিয় হয়। এ সব ধর্মীয় আন্দোলন এক একটি গোষ্ঠীর সংহতিতে লোকধর্মের প্রতিষ্ঠা করে।
লোকধর্মের উদ্ভব সমাজের একটি অনিবার্য পরিণতি। সামাজিক অসঙ্গতির মধ্যে দিনাতিপাত করতে করতে সমাজস্থ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হয়। সেই ক্ষোভ থেকেই জন্ম নেয় অসঙ্গতি মোকাবেলা ও তার থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষা। কাল ও স্থান ভেদে আকাঙ্ক্ষাগুলোর বহুমাত্রিকতা থাকে বটে, কিন্তু আকাঙ্ক্ষার উদ্ভব তাবৎ সমাজের অবশ্যম্ভাবী ঘটনা।
সমাজের অবিরত পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর সাথে যখন একাত্মতা পোষণ করে কোন সংস্কারক, পরিবর্তনকামী, সচেতন ও অগ্রগামী ব্যক্তি তার সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষকে সংঘে সংগঠিত করে, তাদের অপূর্ণ আর্থ-সামাজিক মর্যাদা ও চাহিদা পূরণের নিমিত্তে সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে নয়া সংস্থাপন ঘটানোর উদ্দেশ্যে, সমাজপতিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয়।
তখন মানুষের মধ্যে সংহতি প্রদর্শনের ক্ষেত্র নিয়ে বোঝাপড়া তৈরি হয়। সামাজিক অধিকার আদায়ের এই বোঝাপড়ার মধ্যে আন্দোলনে আবহ্বনাকারী যুগনায়ক কখনো দেবতা, ভগবান, অবতার, নবী, পয়গম্বর রূপে সমাজে পুজ্য হন। যুগনায়কদের এই আহবান যখন অধ্যাত্ম ভাবনার আচ্ছাদনে শ্রেণি মানুষের নিকট পরিণতি লাভ করে তখন সেগুলোই হয়ে। ওঠে লোকধর্ম। লোকধর্ম যেমন দ্ৰোহ প্রসুত তেমনি দেশজ ঐতিহ্যজাত।
দেশজ ঐতিহ্য নিরন্তর রূপান্তর প্রক্রিয়ায় বহমান এবং সেগুলো অধ্যাত্ম ভাবাশ্রিত হয়ে নতুন নতুন লোকধর্মের রূপ নেয়। দেখা যায় একটি জাতি বা শ্রেণি গোষ্ঠীর লোকধর্ম সেই শ্রেণির দেশজ ঐতিহ্য ধারণকরত বস্তুবাদী-বাস্তববাদী চিন্তনে প্রদ্যোতময়। তাই লোকধর্মের বিবর্তনকালীন গ্রহণ-বর্জনের টানাপোড়েন লক্ষণীয় একটি সমাজের সমাজ ভাবনা ও চর্চার মধ্যকার গ্রহণ-বর্জনের টানাপোড়েন দ্বারাই সে সমাজের লোকধর্মের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য নিরূপিত হয়।

সাধারণ মানুষের ভাবান্দোলনের সামগ্রিক এই মত্তাবস্থাই লোকচেতনার স্বাক্ষর রাখে এবং স্বকীয়তা ধারণ করে।লোকধর্মের স্বরূপ নিরুপণে ভাবান্দোলনের এই বিচিত্রতাই অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
ইহলৌকিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্বপ্নকে আশ্রয় করে লোকধর্মের উদ্ভব ঘটে। এদিক দিয়ে শাস্ত্রীয় ধর্ম তথা প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম (revealed religion) যতটা রিলিজিয়নের বিশুদ্ধ বৈশিষ্ট্যের অনুগামী ‘লোকধর্ম’ মোটেও ততটা নয়। লোকধর্মের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর পরমতসহিষ্ণুতা। লোকধর্মানুসারিদের মধ্যে ভিন্ন বিশ্বাসের প্রপ্তি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন একটি বড় গুণ। এরা শাস্ত্রীয় ধর্মানুসারিদের ন্যায় ‘শরা-বেশরা’র দ্বন্দ্বে আক্রান্ত হয় না। লোকধর্ম মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন আচার পালনের সুযোগ করে দেয়, এবং কর্মব্যস্ততার মাঝেও সহজ-স্বাভাবিকভাবে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে উৎসাহিত করে। এই উদ্দেশ্যে কোন প্রকার ধ্রুব ধারণা পোষণ করার জন্য অনুসারিদের বাধ্য করে না। ধর্মানিরপেক্ষতা লোকধর্মের আরেক মানবিক বৈশিষ্ট্য।
বাঙালির জীবনদর্শন তথা বিশ্বসমাজের জীবনদর্শন উপলব্ধিতে লোকধর্মের অন্তর্নিহিত লোকমানস এবং এর সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় এখন প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে পিএইচডি পর্যায়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব গবেষণা কখনো লোকসাহিত্যের (folklore) আওতাধীনে আবার কখনো সমাজবিজ্ঞানের (Sociology) পরিসরে পর্যায়ভুক্ত হয়ে আলোচিত হয়ে আসছে। মোট কথা ধর্মের সমাজবিজ্ঞান (Sociology of religion) গবেষণার লোকধর্মের দর্শন এক অপরিহার্য বিষয়।
এতকাল লোকধর্মে বিশ্বাসের বিষয়গুলি লোকসাহিত্য ও লোকায়ত দর্শনের আবরণেই আলোচিত হত। বর্তমানে লোকধর্ম আলোচনার পরিধি ও এর গুরুত্ব অনেকদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে। এ বিষয়ে গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালনে হোরেস হেম্যান ইউলসনসহ আরো কতিপয় বিদেশীদের কৃতিত্ব স্মরণীয় হয়ে আছে। আর বাঙালিদের মধ্যে পথিকৃৎ গবেষক অক্ষয়কুমার দত্ত এ বিষয়ে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

অতপর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুল সুর, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, দীনেশচন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শক্তিনাথ ঝা, সুধীর চক্রবর্তী, আবদুল হাফিজ, মজহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, মুহম্মদ আবূ তালিব, মোমেন চৌধুরী, ওয়াকিল আহমদ, আনোয়ারুল করীম, শামসুজ্জামান খান, শীলা বসাক, তৃপ্তি ব্রহ্ম, দুলাল চৌধুরী, বরুণকুমার চক্রবর্তী, রমাকান্ত চক্রবর্তী, আবুল আহসান চৌধুরী, মোহাম্মদ সাইদুর, যতীন সরকার, হরিশংকর জলদাস, সুবোধ চন্দ্র দাস, আবদুল ওয়াহাব, স্বরোচিষ সরকার, অনুপম হীরামণ্ডল, তপন বাগচী, সাইমন জাকারিয়া, রঞ্জনা বিশ্বাস প্রমুখ গবেষক সংশ্লিষ্ট গবেষণায় স্মরণীয়।
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি:
Hilden Golden and Hilda Hertz, Literary and Social Change in Underdevelopment Countries Rural Society (vol. 20); Calcutta, 1955
Max Weber, The Sociology of Religion, Oxford, 1964 Thomas O’dea, The Sociology of Religion; London, 1966 J. Milton Yinger, The Scientific Study of Religion; Cambridge, 1970 N. J. Demerath & P. E. Hammon, Religion in Social Context;
New York, 1975 H. P. Chal
আরও পড়ুন:
- বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধে ধর্মচেতনা – মোহাম্মদ আব্দুল হাই
- মুক্তিযুদ্ধে আনসার বাহিনী – সত্যজিৎ রায় মজুমদার
- প্রবাসী সরকারের আইনগত ভিত্তি ও তৎকালীন সাংবিধানিক প্রক্রিয়া – কাজী জাহেদ ইকবাল
- মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবির – মোহাম্মদ সেলিম [ Youth camp in the war of liberation – Mohammad Selim ]
- বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা
- বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত ১৬ ডিসেম্বরের (১৯৭১) বিবৃতি