বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধে ধর্মচেতনা
(Religious Consciousness in Cultural Views of Bangalis)

ধর্মের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক:
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ।
যত্ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।
ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যে কথিত আছে, তমসা নদীর তীরে ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চীর মিথুনক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী শিকারি ব্যাধের উদ্দেশে বাল্মীকি মুনির মুখে আকস্মিক উচ্চারিত এই অভিশাপবাণীই আদিকবিতা এবং বাল্মীকি আদিকবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ভাষা ও ছন্দ)। শোক থেকে উচ্চারিত হয়েছিল বলে এর নাম হয়েছে শ্লোক। এই শ্লোক থেকেই পরবর্তীকালে কবিতার উৎপত্তি। বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ই হল কবিতার জন্মভূমি। বেদনাবোধের অনুভূতি ছাড়া কবিতা সৃষ্টি হয় না। হতাশা-দুরাশা-ব্যর্থতা-বেদনার পারিপার্শ্বিকতা প্রকাশের মধ্য দিয়েই কাব্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তবে ছন্দই কবিতার মূল প্রাণ। ছন্দোবদ্ধ পদকেই বলা হয় কবিতা। ছন্দই কবিতাকে তার স্বরূপগত বৈশিষ্ট্যে উন্নীত হতে সাহায্য করে।
পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্যের ইতিহাসও তাই। ব্যাবিলনীয় ভাষায় খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে রচিত পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশ (Gilgamesh) থেকে শুরু করে আধুনিককালের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) রচিত মেঘনাদবধ (১৮৬১) মহাকাব্য যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলা কবিতার এই দীর্ঘ যাত্রাপথের ইতিহাসে নীতিমূলক কবিতা একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে ডাক, খনার বচন, লোক প্রবাদ প্রভৃতি পরিশীলিত রূপ নিয়ে এর শাশ্বত বাণী আজও আধুনিক কাব্যে কবিতায় স্থান পাচ্ছে।

এই স্রোতধারায় সংস্কৃত সাহিত্য থেকেও প্রচুর উপাদান এসে মিশেছে বাংলা নীতি কবিতায়। নীতিশাস্ত্র তথা সুভাষিতসংগ্রহের সংখ্যা সংস্কৃত সাহিত্যেই সর্বাধিক। এর মধ্যে ভর্তৃহরির নীতিশতক, সদানন্দের নীতিমালা, শম্ভুরাজের নীতিমঞ্জরী, ঘটকর্পরের নীতিসার, স্বামী দয়ানন্দের নীতিচন্দ্রিকা সোমদেবসূরির নীতিবাক্যামৃত, ব্রজরাজ শুক্রের নীতিবিলাস, কামন্দকীয় নীতিসার, বররুচির নামে প্রচলিত নীতিরত্ব, বেতাল ভট্টের নামে প্রচলিত নীতিপ্রদীপ এবং চাণক্য পণ্ডিত রচিত চাণক্য শ্লোক সংস্কৃত সাহিত্যের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সংস্কৃত ভাষায় রচিত চাণক্য শ্লোকের বহু পক্তির বাংলা রূপান্তর আধুনিক নীতিকাব্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষের সর্বমানবিকৰোধে বিকশিত এসব নীতিশাস্ত্রে উল্লিখিত বচন-বাণী প্রকৃতপক্ষে ধর্মচেতনারই প্রচ্ছন্ন প্রকাশ।
[ বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধে ধর্মচেতনা – মোহাম্মদ আব্দুল হাই ]
মধ্যযুগে মুসলমানদের বাংলা সাহিত্য সাধনার প্রধানত দুটি পৃথক ধারা ছিল— রোমান্টিক রচনা ও ধর্মভিত্তিক রচনা। দ্বিতীয়টিতে ধর্মাচরণ, ব্যবহার শাস্ত্র, শরাহ শরীয়ৎ প্রভৃতি বিষয়ে নিগূঢ় তত্ত্ব ও তথ্য ছন্দোবদ্ধ ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি রোমান্টিক রচনায় যেমন পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তেমনি অন্য শ্রেণির রচনায়ও কম কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন নি। এর ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়। তবে মধ্যযুগের হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লেখকদের অধিকাংশেরই কাব্যসাধনার মূল উপাদান সংগৃহীত হয়েছে স্ব স্ব সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ থেকে। ফলে সে সময়কার লেখকদের লেখায় নীতিবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার দৃষ্টান্ত প্রায় সর্বত্রই বিদ্যমান। নিম্নে উদ্ধৃত কবিতা দুটি লক্ষ্য করুন :
একত্ব
বল তুমি বল ওহে খোদা একজন—
নহে কারও মুখাপেক্ষী, খোদা সে এমন।।
জন্মলাভ কারও হতে করেনি কখন।
তার সম নহে কোন জন।।
(সুরা এখলাস অবলম্বনে)
ওজন
ওজনের বেলা করিও না হেলা
মাপকাঠি তব রাখিও সমান
ঝুল রাখি ঠিক মাপিও সঠিক,
দিওনা’ক কমি তিল পরিমাণ।
(সূরা আর রহমান অবলম্বনে)
কৃপণ
দো’য়ার বেলায় দু’হাত বাড়ায়
খোদায় দরগায় কাতরে!
দানের বেলায় সে হাত লুকায়
দুই বগলের ভিতরে।।
(হাদীস অবলম্বনে)
পথ নির্দেশ
যদি দেখি অন্ধ আর সম্মুখেতে কৃপ
হব আমি মহাপাপী যদি থাকি চুপ।
(হাদীস অবলম্বনে)
বংশগৌরব
নহে আশরাফ যার আছে শুধু বংশের পরিচয়,
সেই আশরাফ জীবন যাহার পুণ্য কর্মময়।
(হাদীস অবলম্বনে)

ধর্মের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক উভয়েরই শুরু থেকে। গ্রিক নাটকের উৎপত্তি ধর্ম থেকে। হোমার ও ভার্জিলের মহাকাব্যে ধর্মবিশ্বাস তৎকালীন গ্রিক ও রোমানদের ধর্মবিশ্বাসেরই প্রতিচ্ছবি। ইংরেজি নাটকের উৎপত্তিও খ্রিষ্টধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে। ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসীর শাহনামা, ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ মহাভারত এসব কালোত্তীর্ণ রচনা সবগুলিই ধর্মদেশনা থেকে উদ্ভূত। বিশ্বের তাবৎ ধ্রুপদি সাহিত্যের পশ্চাতে রয়েছে এই ধর্মীয় প্রভাব।
হাডসনের An Introduction to the Study of Literature গ্রন্থে রয়েছে এর বিশদ বিবরণ। সফোক্লিসের কিং ইডিপাস নাটকে যে-ধর্মীয় চেতনা উপস্থাপিত হয়েছে তা এখনো বিশ্বসমাজে এক শিহরিত বিষয়! নিকট সম্পর্কীয়র সঙ্গে (মাতা-পুত্রে) অবসম্ভাবী এবং অপ্রতিরোধ্য যৌনসম্পর্কের ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণীর এই ইতিবৃত্ত এখনো বিশ্বসাহিত্য তথা সমাজবিজ্ঞানের এক আদিম মানবীয় চেতনার অভিজ্ঞান! বিশ্বসাহিত্যের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ রচনা নিয়তি-নির্ভর। Sophocles (459-405 B.C.)-এর King Oedipus তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ইডিপাসের জন্মের পর (কোন কোন বর্ণনা মতে তার জন্মের আগে) এপোলো দেবতার পক্ষ থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে, ইডিপাস বড় হয়ে তার পিতাকে হত্যা করবে এবং তার মাতাকে বিয়ে করবে। তার পিতামাতা (রাজা লুইস ও রানী জোকাস্টা) এই ভয়ঙ্কর ঘটনা এড়ানোর জন্য শিশু ইডিপাসকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জীবন রক্ষা পায়। পার্শ্ববর্তী রাজ্যের নিঃসন্তান রাজা-রানী তাকে আপন পুত্রস্নেহে লালন-পালন করেন।
বড় হয়ে ইডিপাস সে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা জানতে পেরে সেখান থেকে পালিয়ে থিবিস (Thebes)-এ চলে আসে এবং ঘটনাক্রমে নিজের অজান্তে তার পিতাকে হত্যা করে এবং মাতাকে বিয়ে করে। সে অপরাধ এড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, কিন্তু এড়াতে পারেনি। সে নিয়তির অসহায় শিকার।
![বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধে ধর্মচেতনা - মোহাম্মদ আব্দুল হাই 6 মীর মশাররফ হোসেন [ Mir Mosharraf Hossain ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/04/Mir-Mosharraf-Hossain-মীর-মশাররফ-হোসেন-5-300x283.jpg)
আমরা একই নিষ্ঠুর নিয়তি দেখি, ইরানের জাতীয় মহাকাব্য শাহনামায় ফেরদৌসী বর্ণিত যুদ্ধক্ষেত্রে বীরযোদ্ধা পিতা রুস্তমের হাতেই আপন বীরপুত্র সোহরাবের নিয়তি-নির্ধারিত মৃত্যু। পিতা-পুত্রের পরিচয় উন্মোচিত হয় পিতা কর্তৃক পুত্রের বক্ষে বিদীর্ণ তলোয়ারের আড়ালে উকি দেয়া স্নেহময়ী মাতা তহমীনা কর্তৃক পুত্র-হাতে বেঁধে দেয়া রক্ষাকবচ দেখে। যা আগেই মাতা তহমীনা কর্তৃক পিতা রুস্তমকে জ্ঞাত করা হয়েছিল, কিন্তু সেই রক্ষাকবচ পুত্র সোহরাবকে রক্ষা করতে পারে নি।
একই ঘটনা দেখতে পাই উমাইয়া বংশের প্রথম খলিফা মু’আবিয়ার জীবনে। ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, তাঁর ঔরসজাত সন্তানের হাতেই নিহত হবেন মহানবীর বংশধর। সে সময়ে মহানবীর সঙ্গে সুসম্পর্কের আতিশয্যে মু’আবিয়া এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, তিনি আর বিয়েই করবেন না। কিন্তু এক পর্যায়ে মু’আবিয়া কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে বৃদ্ধ বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য হন।
অতপর মু’আবিয়ার ঔরসেই জন্ম নেয় ইয়াজিদ। ইতিহাসে আমরা দেখি, ৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে কারবালায় সংঘঠিত সেই নিষ্ঠুর ঘটনা! নীতি-ন্যায্যতা তথা সত্যপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে ইয়াজিদের কাছে বশ্যতা স্বীকারে অনমনীয় নবীদৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা)-এর সপরিবারে কারবালায় (১০ই মহররম) নির্মম মৃত্যু। কারবালার এই বিষাদময় ঐতিহাসিক কাহিনীকে উপজীব্য করে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) সৃষ্টি করেন তাঁর বহুল আলোচিত বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাস।
বিষাদ-সিন্ধুতে দেখানো হয়েছে, এজিদ কর্তৃক হোসেনের নিহত হওয়ার নিয়তি এড়ানোর জন্য এজিদের পিতামাতা তাকে শিশুকালে মেরে ফেলার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু এজিদের মুখ দেখে তারা সেটা করতে পারেননি। এ ধরনের নিয়তি নির্ভর অপ্রতিরোধ্য ঘটনা আমরা মহাভারতেও দেখি। মথুরার অত্যাচারী রাজা কংস নিজ জীবন হন্তারক আপন ভগ্নী দেবকী-পুত্র কৃষ্ণ-বিনাশী চেষ্টা ও শত সতর্কতার মধ্যেও শুনতে হয় সেই দৈববাণী- ‘তোমারে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে।’ বাংলা সাহিত্যেও এই গোকূল বৃদ্ধির ইতিবৃত্ত বাঙালির ধর্মচেতনায় সম্পৃক্ত হয়ে আছে!
আরও পড়ুন: