শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস | জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস | বাংলা প্রতিবেদন রচনা

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে জানবো আজ। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। জাতির মনীষাদীপ্ত শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা এ দিবসে বিশেষে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে রচনা করে গেছেন বেদনা-জর্জরিত গৌরবের ইতিহাস। বছর ঘুরে আসে মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবসের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে আমাদের দুয়ারে এসে উপস্থিত হয় শোক-গভীর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষে বিজয় যখন সমাসন্ন, পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয় যখন সুনিশ্চিত, তখন তারা অন্তিম ছোবল হানল ।

BangladeshGurukul.com Logo 252x68 px White Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

 

বুদ্ধিজীবী হত্যা :

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধন বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণ এই সুপরিকল্পিত নিধনযজ্ঞের শিকার হন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশনা ও মদদে এক শ্রেণীর দালালরা এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার এই নীলনকশা প্রণয়ন করেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। অভিযোগ রয়েছে যে, পাকবাহিনী থেকে অস্ত্র সাহায্য লাভ করে তাদেরই ছত্রছায়ায় আধাসামরিক বাহিনী আল- বদরের সশস্ত্র ক্যাডাররা এই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার নিরীহ জনগণের ওপর পাকবাহিনীর আক্রমণের সময় থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ঢাকায় এই হত্যাকাণ্ড শুরু হয় এবং ক্রমে ক্রমে তা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষত জেলা ও মহকুমা শহরে সম্প্রসারিত হয়। পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পূর্ববর্তী দিনগুলোতে, বিশেষত ১৪ ডিসেম্বর এই বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে। ১৪ ডিসেম্বর তাই শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস রূপে স্মরণীয় হয়ে আছে।

হত্যাকারীরা বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাড়ি থেকে গেস্টাপো কায়দায় ধরে নিয়ে প্রায়শ কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে কোনো বিশেষ ক্যাম্প বা বধ্যভূমিতে নিয়ে যেত। বেশিরভাগ সময় তারা শহরে জারিকৃত কারফুর সুযোগে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেত। তাদের ওপর চলতো নির্মম দৈহিক নির্যাতন; তারপর বেয়নেটের আঘাতে তাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করা হতো। ঢাকা শহরের প্রধান দুটি বধ্যভূমির মধ্যে একটি ছিল মোহাম্মদপুরের নিকটবর্তী রায়েরবাজারের জলাভূমি এবং অন্যটি ছিল মিরপুরে।

এ দুটি বধ্যভূমিতে ডোবানালা, নিচু জমি ও ইটের পাজার মধ্যে বহুসংখ্যক মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা এবং পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত এই লাশগুলোর অধিকাংশরই দেহ ফুলে উঠেছিল। তাদের বুকে, মাথায় ও পিঠে ছিল বুলেটের আঘাত এবং সারাদেহে বেয়নেটের ক্ষতচিহ্ন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা অদ্যাবধি নিরূপিত হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যসূত্র থেকে শহীদদের মোটামুটি একটা সংখ্যা দাঁড় করানো যায়। এদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন্য সাহিত্যিক, শিল্পী ও প্রকৌশলী।

হানাদার বাহিনীর শিকার বুদ্ধিজীবীগণ :

হানাদার বাহিনী ও দোসরদের ঘৃণ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অধাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জি সি দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক আনওয়ার পাশা, সন্তোষ ভট্টাচার্য, সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, আবুল খায়ের, রাশিদুল হাসান, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আজাদ, ডা. গোলাম মোর্তজা, আবুল বাশার চৌধুরী, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, খন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমেদ, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নতুন চন্দ্র সিংহ, আরপি সাহা, আবুল খায়ের, সিরাজুল হক খান, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সাহীদুল হাসান, সেলিনা পারভীনসহ আরো অনেকে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

হানাদার বাহিনীর উদ্দেশ্য বিফল :

সেদিন যে অশুভ ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে এবং যে হীন উদ্দেশ্যে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বুদ্ধিজীবী নিধনে মেতে ওঠেছিল, সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তারা ভেবেছিল যে এ দেশের মানুষের দেশপ্রেম, সাহস ও প্রেরণার উৎস মেধাবী সন্তানদের হত্যা করা হলে এ জাতির আত্মশক্তির বিলোপ ঘটবে এবং তারা হবে দিকভ্রান্ত। শুভ ও সুন্দরের এবং স্বকীয়তার শক্তি হারিয়ে তারা হয়ে যাবে রিক্ত, নিঃস্ব, ভুলে যাবে মুক্তচিন্তার পথ এবং তারা অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে ।

কিন্তু হানাদার বাহিনীর সে আশা পূরণ হয়নি। কেননা বাংলাদেশের সংগ্রামী ও সচেতন মানুষ আত্মবিস্মৃত হয়নি। ভয়ের দুঃস্বপ্ন এবং হায়েনার ছোবল এ দেশবাসীর জয়যাত্রা রুখতে পারেনি। আর অমানুসিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেও হানাদার বাহিনী তাদের শোচনীয় পরাজয় ঠেকাতে পারেনি। কেননা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অগণিত বীর শহীদের শোণিত ধারার সাথে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তধারা মিলে জনচিত্তে সঞ্চারিত করেছিল দেশাত্মবোধের ফল্গুধারা। আত্মত্যাগের যে অনন্য নজির ও মহৎ ইতিহাস শহীদ বুদ্ধিজীবীগণ রচনা করে গেছেন, তা কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়। এ দেশের মানুষ কাল হতে কালান্তরে, শ্রদ্ধা অবনতচিত্তে স্মরণ করবে শহীদদের আত্ম-উৎসর্গের মহিমা গাঁথা।

উপসংহার :

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর এবং এর আগে যেসব মহান সন্তান শাহাদাত্বরণ করেছেন, তাদের প্রত্যেকেই এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাদের জীবন-আদর্শ এবং দেশপ্রেম আমাদের পথ দেখাবে চিরকাল। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগ ও আদর্শ আমাদের চলার পথে সাহস ও শক্তি যোগাবে সব সময়। তাদের শিক্ষা আমাদের উদার মহৎ কর্মের পথে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করবে এবং অন্যায় অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শক্তি ও সাহস যোগাবে। পুরো বছরের মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর এলেই শুধু আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কথা মনে পড়ে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

এছাড়া দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতিবিজড়িত রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুরের বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধের অব্যবস্থাপনা, অমর্যাদা আর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়গুলো নিয়ম করে সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপন করেই দায়িত্ব শেষ করি আমরা। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য কারো শান্তি হয়নি, কোনো বিচারের কাঠগড়াতেই দাঁড়াতে হয়নি ঘাতকদের একজনকেও। বরং স্বাধীনতার প্রায় ৪০ দশক পর রাজাকার, আলবদর বাহিনীর প্রধানদের এখন স্বাধীন বাংলাদেশ মন্ত্রী পদে আসীন দেখে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের অনুভূতি জানতে ইচ্ছে করে । কিন্তু জানার চেষ্টা নিষ্ঠুরতা হবে ভেবে যোগাযোগ করা থেকে বিরত থাকতে হয় ।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment