২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। এই দিবসটিতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পৃথিবীর মানচিত্রে সৃষ্টি হয় একটি নতুন দেশের। তৎকালীন পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে (তথা জনগণের পক্ষে) পাকিস্তানের সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত মেজরিটি পার্টির প্রধান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ নামক নতুন একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
![বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস রচনা 2 বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস রচনা - The National Martyrs' Monument of Bangladesh [ জাতীয় স্মৃতিসৌধ ]](https://bangladeshgurukul.com/wp-content/uploads/2022/04/The-National-Martyrs-Monument-of-Bangladesh-জাতীয়-স্মৃতিসৌধ-300x169.jpg)
Table of Contents
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস রচনা
সূচনা :
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষ আসলে জন্মগত ভাবে স্বাধীন হলেও, প্রায়শই সমাজ, বর্ণ, ধর্ম, দেশ ইত্যাদির ছুতোয় স্বাধীনতা হরণ করে নেয় কিছু দস্যু চক্র। যুগে যুগে বাঙ্গালীকে এভাবে পরাধীনতার জালে আটকে রাখতে চেয়েছে বিভিন্ন বিদেশি শক্তি। সর্বশেষ ব্রিটিশ রাজ ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাবার সময় ধর্মের নামে দুটি দেশ ভাগ করে দিয়ে যায়। যার মধ্যে পশ্চিম বাংলা পড়ে ভারতে, আর পূর্ব বাংলা পড়ে পাকিস্তানে। ভারত পশ্চিম বাংলাকে অন্যান্য প্রদেশের মতোই সমতার সাথে দেখলেও, পাকিস্তানিরা (বিশেষকরে পাঞ্জাবীরা) পূর্ব বাংলাকে কখনো সমান চোখে দেখেনি। বরং ক্রমশ শোষণের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে জরাজীর্ণ করতে থাকে।
পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রমশ শাসন-শোষণে বাঙলা ও বাঙ্গালীর জীবনকে দুর্বিষহ করতে থাকে। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে খুব দ্রুতই স্পষ্ট হতে থাকে, এই স্বাধীনতা বাঙ্গালীদের জন্য নতুন পরাধীনতা। তাই বাঙ্গালী সত্যিকারের স্বাধীন হতে আবার সংগ্রাম শুরু করে। এই সংগ্রামে প্রথম দিকে ব্যবপক অবদান রাখেন শের-এ-বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, শওকত আলী, কামরুদ্দীন আহমদ, মো. তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আলমাস, শামসুজ্জোহা প্রমুখ। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে বাঙ্গালীকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের দুর্নিবার আন্দোলনে পাকিস্তানের শাসনের ভীত নড়ে যায়। এসময় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হবার চূড়ান্ত রূপরেখার সূচনা করেন। এই দাবী মেনে নিলে পাকিস্তান দুর্বল হয়ে এমনিতেই একসময় ভেঙ্গে যেত। আর মেনে না নেবার কারণে আন্দোলন আরও জোরদার হয়। সেই ৬ দফাকে নির্বাচনী ইশতেহারে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ১০৭০ সালের নির্বাচনে মেজরিটি হিসেবে জয়লাভ করেন। পাকিস্তান সরকার তার হতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙ্গালির উপরে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে সামরিক অভিযান শুরু করে। সেই অভিযান শুরু হবার পরে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। এরপর আওয়ামীলীগ এর সাংসদ ও নেতৃবৃন্দ প্রবাসে সরকার গঠন করে, ৯ মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে শত্রু-মুক্ত করেন।
২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষনা দেয়া হয়, তাই এই দিবসটি আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিবস থেকেই বাংলাদেশ স্বাধীন। তাই এই দিবসটি নিয়ে বিস্তারিত জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, তথা ২৬ মার্চ এর প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে শুরু করতে হবে পলাশি থেকে। পলাশীর যুদ্ধ থেকে। ১৭৫৭ সালের জুন ২৩ তারিখে, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত করে বাংলাকে নিজেদের অধীন করে। বাংলার এই পরাধীনতার মাধ্যমে পুরো ভারত ক্রমশ বিৃটিশদের অধীনে চলে যায়।

২০০ বছর শোষণের পরে, ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা এই দেশের মাটি ত্যাগ করার সময় এই উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুই দেশে বিভক্ত করে যায়। ধর্মভিত্তিক এই বিভাজনের ফলে তখন প্রচুর মানুষের প্রাণ যায়, বহু মানুষ তাদের গৃহ-সম্পত্তি হারান। তবে অল্প কিছুদিন যাবার পরে আরও নগ্ন সমস্যা সামনে আসতে থাকে। ধর্মভিত্তিক বিভাজন যে একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত নীতি, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই বললেও, তারা আসলে এক নয়। মুসলিম দেশ কায়েমের পরেই মুসলিমরা “বাঙ্গালী-পাঞ্জাবী-সিদ্ধি-বেলুচির” মতো জাতিগত পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এক জাতি অন্যকে শোষণ শুরু করে।
ব্রিটিশরা যে প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে, সেই প্রশাসন মূলত ছিল পাঞ্জাবী। তাই তারাই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেয়। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক, নৈতিকভাবে শোষণ চালাতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা।
ভাষা আন্দোলন:
স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি সামনে আসে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা”। এই ঘোষণায় বাঙ্গালী প্রতিবাদ করে। মায়ের ভাষার উপরে এই আঘাত পাকিস্তানের ভবিষ্যতের ভিত্তি সেদিন তৈরি করে দেয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান প্রশাসনকে চ্যালেন্জ করে। পাকিস্তান প্রশাসন অসহায় হয়ে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। বাঙ্গালী ছাত্র জনতা শহীদ হয়। সবাই প্রথম বার বুঝতে পারে, পাকিস্তানের সাথে থাকা যাবে না।
প্রতিনিয়ত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন:
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এ অঞ্চলের মধ্যে ধর্ম ছাড়া আর কোনো দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তেমন মিল ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬%, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল হাজার বছরের পুরনো। অপরদিকে ৪৫% জনসংখ্যার পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল।
পাকিস্তানের ভাষার পাশাপাশি রীতিমত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে থাকে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যখন বাংলার দামাল ছেলেরা রক্ত দিল রাজপথে, তখন থেকেই বলতে গেলে বাঙালিদের মানসপটে অঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল যে, স্বাধিকারই আসল মুক্তি। তাছাড়া এই নিপীড়ন চলতেই থাকবে। এরপর একসময় রবীন্দ্র সংস্কৃতি চর্চার ওপর খড়গহস্ত নেমে আসে। এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালিদের হেনস্তা করতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা।
প্রথমেই পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে এবং বাংলা ভাষাকে আরবি বর্ণে লেখার ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে নজরুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, সঙ্গীত, সাহিত্য এবং নাটক। সেই বাঙালি সংস্কৃতিতে আঘাত হানার জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত ও রচনাবলি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে। পহেলা বৈশাখ পালনকে হিন্দু প্রভাব বলে উল্লেখ করে সেখানেও বাধাদানের চেষ্টা করে। এই মহান দুই কবিকেও তারা তেমন মূল্যায়ন করেনি।
রাজনৈতিক ও আর্থিক বৈষম্য:
পাকিস্তানে নির্বাচনে বাঙ্গালীরা জিতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শক্তি নির্বাচন বাতিল করে সরকারকে উচ্ছেদ করে। অবশেষে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে জনগণের সব রকম রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়। পাকিস্তানের স্ব-ঘোষিত জঙ্গি ও ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের নামে প্রতারণা করে ১০ বছর নির্বাচন ছাড়া দেশ পরিচালনা করেন।
পাকিস্তানের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি ছিলেন সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তারা। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়গুলোতে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ৯৫৪ জনের মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ১১৯ জন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ৪২০০০ কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল মাত্র ২৯০০।
১৯৪৭ সালে করাচিতে রাজধানী হওয়ায় সব সরকারি অফিস-আদালতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ব্যাপকহারে চাকরি লাভ করে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় সব উচ্চ পদে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। সরকারের সব দফতরের সদর দফতর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে বাঙালির পক্ষে সেখানে গিয়ে চাকরি লাভ করা সম্ভব ছিল না।
১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বাঙালি ছাত্রের সাফল্য ছিল কম। ১৯৬৬ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে গেজেটেড কর্মকর্তা ছিল ১৩৩৮ এবং ৩৭০৮ জন এবং নন-গেজেটেড কর্মকর্তা ছিল ২৬৩১০ ও ৮২৯৪৪ জন। ১৯৬২ সালে ফরেন সার্ভিসে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ২০.৮%। বিদেশে ৬৯ জন রাষ্ট্রদূতের মধ্যে ৬০ জনই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের।
পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক শাসনের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল সামরিক বৈষম্য। সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল অনেক কম। প্রথম থেকেই সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পদ পাঞ্জাবিরা দখল করে রেখেছিল। সামরিক বাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে যে কোঠা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাতে ৬০% পাঞ্জাবি, ৩৫% পাঠান এবং মাত্র ৫% পাশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অংশ ও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল। বাঙালিদের দাবির মুখে সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও তা ছিল নগণ্য।
১৯৫৫ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, সামরিক বাহিনীর মোট ২২১১ জন কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ৮২ জন। ১৯৬৬ সালে সামরিক বাহিনীর ১৭ জন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ১ জন ছিল বাঙালি। এ সময় সামরিক অফিসারদের মধ্যে ৫% ছিল বাঙালি। পাকিস্তানের মোট ৫ লাখ সেনা সদস্যের মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ২০ হাজার জন অর্থাৎ ৪%।
সামরিক বাজেটের মধ্যে সিংহভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। আইয়ুব খানের শাসনকালে মোট বাজেটের ৬০% সামরিক বাজেট ছিল। যার বেশির ভাগ বহন করত পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব আয় থেকে অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার প্রতি ছিল চরম অবহেলা।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সব পরিকল্পনা প্রণীত হতো কেন্দ্রীয় সরকারের সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে কোনো প্রতিনিধি না থাকায় ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো।
জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়। প্রথমটিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ব্যয় ছিল ১১৩ কোটি ও ৫০০ কোটি রুপি। দ্বিতীয়টিতে ছিল ৯৫০ কোটি রুপি এবং ১৩৫০ কোটি রুপি। তৃতীয়টিতে বরাদ্দ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৩৬% এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ৬৩% রাজধানী উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত বেশির ভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য।
১৯৫৬ সালে করাচির উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয় ৫৭০ কোটি রুপি, যা ছিল সরকারি মোট ব্যয়ের ৫৬.৪%। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের মোট সরকারি ব্যয়ের হার ছিল ৫.১০%। ১৯৬৭ সালে ইসলামাবাদ নির্মাণের জন্য ব্যয় করা হয় ৩০০ কোটি টাকা এবং ঢাকার জন্য ব্যয় করা হয় ২৫ কোটি টাকা।
বৈদেশিক সাহায্য বরাদ্দের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান পায় মাত্র ২৬.৬%। ১৯৪৭-১৯৭০ সাল পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অংশছিল মাত্র ৫৪.৭%। রপ্তানি আয় বেশি করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমদানি ব্যয় ছিল মাত্র ৩১.১%। রপ্তানি উদ্বৃত্ত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের আমদানির জন্য ব্যয় করা হতো।
শিল্প করাখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের কাঁচামাল সস্তা হলেও শিল্প-কারখানা বেশির ভাগ গড়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে কিছু শিল্প গড়ে উঠলেও সেগুলোর বেশির ভাগের মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানই। ফলে শিল্প ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে নির্ভরশীল থাকতে হতো পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বর্ণ ও কোনো পরিমাণ টাকা-পয়সা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বর্ণ ও টাকা-পয়সা পূর্ব পাকিস্তানে আনার ওপর সরকারের বিধিনিষেধ ছিল।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাঙালিরা বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের নিরক্ষর রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল এবং পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলার পরিবর্তে উর্দুতে শিক্ষার মাধ্যম করা বা আরবি ভাষায় বাংলা লেখার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হানতে চেয়েছিল।
১৯৫৫-১৯৬৭ সালের মধ্যে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ছিল ২০৮৪ মিলিয়ন রুপি এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল ৭৯৭ মিলিয়ন রুপি। পাকিস্তানের ৩৫টি বৃত্তির মধ্যে ৩০টি বৃত্তি নিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান, মাত্র ৫টি বরাদ্দ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য।
রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, ডাকঘর, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, বিদ্যুৎ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালিদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেশি সুবিধা ভোগ করত। সমাজকল্যাণ ও সেবামূলক সুবিধা বেশির ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানিরা পেত। ফলে সার্বিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত ছিল।
ছয় দফা:
বাঙ্গালীর উপরে সকল অত্যাচার ও অনাচারের চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনেন “ছয় দফা” নামের এক যুগান্তকারী কর্মসূচি। ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন।
ছয় দফার বিশেষত্ব হচ্ছে, এটা মেনে নিলে পাকিস্তান এতটাই দুর্বল হয়ে যায়, যে ভবিষ্যতে ভেঙ্গে যেতে বাধ্য; আর মেনে না নিলে বাঙ্গালী এই দাবীর উপরে স্বাধীনতা সংগ্রাম করবে, যার ফলে একদিন এমনিতেই পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। এই ছয় দফাই আসলে স্বাধীনতার মুল ইশতেহার।
৭০ এর নির্বাচন:
এসব কিছুর কারণে বাঙালিরা ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে। ‘৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ‘৬৬ এর ৬ দফা, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এরই ইঙ্গিত দেয়। বাঙালিরা দিনকে দিন বুঝতে থাকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কোনোক্রমেই হাসিল করতে দেবে না পাক সামরিক জান্তারা। ছয় দফাকে নির্বাচনী ইশতেহারে রেখে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জনগণ ছয় দফার পক্ষে রায় দেয়। আওয়ামী লীগ অর্জন করে নিরঙ্কুশ বিজয়।
৭ই মার্চের ভাষণ:
বাঙ্গালীকে ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপনের কারণে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হচ্ছিল। সারা বাংলাদেশ তখন বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রীর শপথ ছাড়াই তাকে প্রধামন্ত্রী মেনে নিয়েছিলো। সকল প্রশাসন থেকে শুরু করে সবকিছুই চলছিলো তার নির্দেশে। যুদ্ধও আসন্ন বোঝা যাচ্ছিল। সেরকম একটি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ মিটিং ডাকেন। ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে তিনি দেন তার সেই ঐতিহাসিক ভাষন। সেই ভাষনে তিনি খুব কৌশলে মুক্তিযুদ্ধে জন্য সংগঠিত হবার সব কৌশল বলে দেন। পাশাপাশি তিনি জানান, তিনি নাও থাকেন তবে কি করতে হবে।
ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা ও অপারেশন সার্চ লাইট:
৭০ এর নির্বাচনে জেতার পরও যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে দেওয়া হল না, উল্টো আলোচনার নামে টালবাহানা করা হচ্ছিল। ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে নিধনের এক নারকীয় কাণ্ড শুরু করে।
এই অপারেশন শুরু করার পরেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সাংবিধানিক ভাবে এমন একটি অবস্থানে ছিলেন, তার ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ আইনত ভাবেই স্বাধীন করে দেয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাকে দেশকে বিচ্ছিন্ন করার অপরাধ দেখিয়ে তাকে ওই রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের দিন বিদেশি সকল পত্রিকায় ছাপা হয় শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে।
স্বাধীনতার ঘোষণা
বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত, অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তাঁর ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের আগেই তিনি বেতার মারফত ঐতিহাসিক এই ঘোষণাটি দিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঘোষণাটি নিম্নরূপ:
ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণা:
This may be my last message, from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
বাংলায় স্বাধীনতার ঘোষণা:
এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।
২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয় কখন ও কত সালে?
২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষনাকে স্বাধীনতার ঘোষনা হিসেবে গ্রহন করে, ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান উপজেলা মুজিবনগর) গ্রামের আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেছিলো। শেখ মুজিবুর রহমান এই সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। কিন্তু তিনি তখন পাকিস্তানে কারাগারে বন্দী। তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এর পর ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি একটি বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয়, এবং ২৬ মার্চ এর ইতিহাসকে স্মরণ করার জন্য দিনটিকে সরকারিভাবে ছুটির দিন বলে ঘোষণা করা হয়।
২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস কেন পালন করা হয়:
বাঙ্গালী দীর্ঘ দিনের সংগ্রাম ছিল স্বাধিকারের জন্য। যেটি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতাতে এসে পৌছায়। বাঙ্গালীর তখন একমাত্র স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার। তাই মহা-সংগ্রাম শেষে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে যখন সেই ঘোষণা আসে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে, তখন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সেই কারণেই বাঙ্গালীর স্বাধীনতার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে ধরা হয়। এজন্যই এই দিনটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
স্বাধীনতা দিবসের ছবি:
এই পর্বে আমরা মহান স্বাধীনতা দিবস এর ছবি দেখবো,

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস নিয়ে উক্তি:
এবার আমরা দেখবো বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস নিয়ে উক্তি এবং স্বাধীনতা দিবস বিষয়ক কিছু উক্তি:
এই স্বাধীনতা তখনি আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন। – শামসুর রাহমান
যে মাঠ থেকে এসেছিল স্বাধীনতার ডাক, সেই মাঠে আজ বসে নেশার হাট – রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
আমরা স্বাধীন হয়েছি তাই আমরা স্বাধীন জীবন যাপন করবো এমনটা ভাবা ঠিক নয়। আমরা আজন্ম স্বাধীন – উইলিয়াম ফকনা
স্বাধীনতা মানুষের মনের একটি খোলা জানালা, যেদিক দিয়ে মানুষের আত্মা ও মানব মর্যাদার আলো প্রবেশ – হার্বার্ট হুভার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে কবিতা:
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বরাবরই বাংলা ভাষাভাষী কবি ও সাহিত্যিকদের জন্য অন্যরকম এক প্রেরণার নাম। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা, উপন্যাস, গল্প, স্মৃতিকথা। এসব লেখায় উঠে এসেছে স্বাধীনতার জন্য জাতি হিসেবে আমাদের ত্যাগের গাঁথা- যেমন, কবি শামসুর রহমান বলেছেন,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি–প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে।
— শামসুর রাহমান
আরও পড়ুন: