বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ রচনা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করা নিরুৎসাহ দেই। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।

Table of Contents

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ

নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ তার নির্জীব অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের একার পক্ষে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার।

১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের পতন বিশ্ব অর্থনীতিকে একটি প্রায় অভিন্ন অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছে। মুক্তবাজার হলো একটি সর্বজনীন ব্যবস্থাপনা।

বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্প প্রতিষ্ঠান বিকশিত না হওয়ায় এবং কৃষি ব্যবস্থাপনা উন্নত না হওয়ায় অর্থনীতি মূলত আমদানি নির্ভরই রয়ে গেছে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উত্তরণের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমস্যাসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের কৌশল উদ্ভাবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায়সমূহ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়সমূহ নিম্নরূপ:

 

১. অবকাঠামোগত দুর্বলতা

বাংলাদেশ সফর শেষে একজন বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিকাশের পথে প্রধান বাধা হচ্ছে অবকাঠামোগত দুর্বলতা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দৃঢ় ভিতের অবকাঠামো দরকার। ট্যাক্স বা শুল্ক রেয়াত, মুদ্রা বিনিময়ের সুবিধা এবং অন্যান্য সুবিধা দেয়া হলেও অবকাঠামো ঠিক না থাকলে উদ্যোক্তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক । এর ফলে অর্থনীতির গতিশীলতা ব্যাহত হয় ।

 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ

 

২. ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য

ঋণখেলাপিরা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান শত্রু। খেলাপি ঋণ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে প্রধান বাধা। ঋণগ্রহীতারা নানা প্রভাব-প্রতিপত্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের নামে শত শত কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ না করে অন্য কোনো অনুৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করে। এ খেলাপি ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়মিত পরিশোধ হলে উক্ত টাকা পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতি লাভবান হতো। কিন্তু ঋণ খেলাপি হওয়ার ফলে দেশ সমৃদ্ধির সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ৩০ জুন ২০০৩ পর্যন্ত ত্রৈমাসিকের ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ১০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে ঋণগ্রহীতার মধ্যে ঋণখেলাপির সংখ্যা ৮২১৬ জন।

 

৩. বৈদেশিক সাহায্য ও উন্নয়ন

বৈদেশিক সাহায্য আদৌ জাতীয় উন্নয়নে কোনো অবদান রাখতে পারে কিনা এ নিয়ে খোদ দাতা দেশগুলোতেও বিতর্ক চলছে। দাতা দেশগুলোতেও এ কথা শোনা যাচ্ছে যে, বৈদেশিক সাহায্যে তৃতীয় বিশ্বের কোনো কাজে আসছে না। প্রসঙ্গক্রমে জার্মান পার্লামেন্টের একজন সদস্যা ব্রিগেতে এরলারের নাম এখানে উল্লেখ করা যায়।

জার্মান সাহায্য বাংলাদেশে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তাতে বাংলাদেশের জনগণ আদৌ উপকৃত হচ্ছে কিনা, তা দেখার জন্য মধ্য আশির দশকে তিনি বাংলাদেশ সফরে আসেন বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে তিনি তার সংসদ সদস্যের পদ থেকে ইস্তফা দেন। তার যুক্তি ছিল, যে সাহায্য দেয়া হয়, তাতে বাংলাদেশের মানুষের কোনো উপকার হচ্ছে না।

বরং সাহায্যের একটা বড় অংশই বিভিন্ন খাতে আবার জার্মানিতে ফিরে যাচ্ছে। পরে তিনি বাংলাদেশে-জার্মান সাহায্য সম্পর্কিত বিষয়ে একটি বই লিখেন, যার নাম ছিল ‘Toedliche Hilfe’ অর্থাৎ ‘সাহায্য যা মৃত্যুর সমতুল্য। মিসেস এরলার উক্ত বইয়ে দেখিয়েছিলেন, কীভাবে সাহায্য অপচয় হচ্ছে, কীভাবে তথাকথিত কালাসটেন্সির নাম করে ঋণের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে জার্মান সাহায্যদাতার পকেটে।

ব্রিগেতে এরলারের বইটি হচ্ছে আমাদের কাছে একটি জ্বলন্ত উদাহরণ যে, বৈদেশিক সাহায্য আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে।

 

৪. বিদেশী পণ্যের আধিপত্য

বর্তমানে বাংলাদেশের বাজার বিদেশী পণ্যে সয়লাব, এ ঘটনা দেশী- বিদেশী উদ্যোক্তাদের হতাশ করেছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যখন কোনো দেশে বিনিয়োগ করতে আসে, তখন স্থানীয় বাজারের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। সুতরাং বাংলাদেশের বাজারে বিদেশী পণ্যের আধিপত্য আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে মারাত্মক অন্তরায়।

 

৫. কম সঞ্চয়

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ১৬ থেকে ২০ শতাংশ জাতীয় সঞ্চয়ের প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে বর্তমান জাতীয় সঞ্চয়ের পরিমাণ মাত্র ৮ শতাংশ। সুতরাং জাতীয় সঞ্চয়ের এই নিম্নমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক বিরাট সমস্যা।

 

৬. আমদানিনির্ভরতা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে রপ্তানির তুলনায় আমদানির আধিক্যের কারণে বাণিজ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়। ২০০৪-০৫ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ডলার। পরবর্তী প্রতিটি আর্থিক বছরে এ ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। এ আমদানি নির্ভরতা তথা বাণিজ্যিক ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে।

 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ

 

৭. প্রশাসনিক জটিলতা

বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি রাজনৈতিক প্রকৃতির হলেও মূল কাজকর্ম পরিচালনা করে আমলারা। সংসদে মন্ত্রীদের যেসব প্রশ্ন করা হয় তার উত্তরও লিখে দেন আমলারা। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি, তাও প্রণয়ন করেন সম্পূর্ণ আমলারা।

ইউএনডিপি রিপোর্ট ‘৯৫-তে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি নয়। গতিশীল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের অভাব বাংলাদেশে শাসনতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করেছে। ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা উৎসাহী হচ্ছে না এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।

 

৮. প্রতিকূল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে অনুকূল নয়, যা পুঁজি বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায়। গত জুন ৯৭ একটি বড় বিদেশী বিনিয়োগকারী দল বিনিয়োগের পরিবেশ দেখার জন্য বাংলাদেশ সফরে আসেন। কিন্তু জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে বন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা তাদের সাথে অশালীন আচরণ করে। ফলে ঐ বিনিয়োগকারী দল বিমানবন্দর থেকেই তাদের দেশে ফিরে যান। এটা আমাদের জন্য, লজ্জাজনক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বাংলাদেশের অর্থনীতির পথে হুমকিস্বরূপ।

 

৯. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা

বলা হয়ে থাকে রাজনৈতিক উন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্ননের পূর্বশর্ত। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি ও বিরোধী দলসমূহের নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতিচর্চার ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিগত সরকারের মেয়াদ তিন বছর যেতে না যেতেই বিরোধী দলসমূহের সংসদের বাইরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দরুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে।

লাগাতার হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ অর্থনৈতিক উন্নতির চাকাকে অচল করে দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত অষ্টম। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাও অনুরূপ। সুতরাং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ

 

১০. দুর্নীতি

অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কূটনীতি সফল করতে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে এর উপস্থিতি নগণ্য।

নভেম্বর ১৯৯৮-এ অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ায় সংস্কারের অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিশ্ববাংকের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের অর্থনীতিবিদ জন উইলিয়ামসন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের দুর্নীতির স্তর এক ধাপ কমাতে পারলে বিনিয়োগ বাড়বে জিডিপির ৪ শতাংশ এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাবে ০.৫ শতাংশ।

এতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এ দেশে দুর্নীতির শিকড় কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট ২০০২ সালেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম সমস্যা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছে ।

 

১১. নীতি বাস্তবায়নে সরকারের ধীরগতি

নীতি বাস্তবায়নে সরকারের ধীরগতির কারণেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বিশ্বব্যাংকের সাতজন নির্বাহী পরিচালক জানুয়ারি ১৯৯৭-এ বাংলাদেশ সফর শেষে এক রিপোর্ট তৈরি করেন। রিপোর্টে সরকারের নীতি বাস্তবায়নে ধীরগতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং এ ধীরগতিকে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

 

অন্তরায়সমূহ থেকে উত্তরণের উপায়

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায়সমূহ উত্তরণে নিচের পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।

১. গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনীতির যে রূপরেখা তা হলো গণতান্ত্রিক রাজনীতির অর্থনৈতিক কর্মসূচি। মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং এর আলোকে গৃহীত কর্মসূচি সফল করতে যেটি সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান। রাজনৈতিক উন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। তাই পরিবর্তিত বিশ্বে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ আবির্ভূত হয়েছে তা মোকাবিলা করতে হলে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য অপরিহার্য।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রাজনৈতিক দলসমূহ জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইস্যুতে ঐকমত্য তথা জাতীয় সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। অথচ এটি নিশ্চিত যে, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাতে ব্যর্থ অর্থনীতির ক্ষেত্রে সংস্কার কর্মসূচিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান।

 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ

 

২. স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন ব্যবস্থার অভাবে প্রশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে এই দুর্নীতি।

সরকারের দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো জনগণের উন্নয়ন প্রত্যাশা পূরণে বরাবরই পিছিয়ে থাকছে। এ কারণে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের প্যারিস বৈঠকের ইস্যুভিত্তিক চারটি মূল আলোচ্যসূচির মধ্যে দুর্নীতিই ছিল মুখ্য আলোচ্য বিষয়। দাতাগোষ্ঠীর এ বৈঠকে প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে ছিল বিশ্বব্যাংক।

২০০১ সাল থেকে কার্যকর তিন বছর মেয়াদি বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংকের “দেশীয় সহায়তা কৌশল’ প্রণয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত এক জনমত জরিপে বাংলাদেশে দুর্নীতির এ তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। সুতরাং স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ব্যবস্থা ব্যতীত দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা হবে অরণ্যে রোদন মাত্র।

 

৩. রপ্তানি বৃদ্ধি

মুক্তবাজার অর্থনীতি সফল করার জন্য প্রয়োজন রপ্তানি উন্নয়ন বৃদ্ধি করা। কারণ আমদানিনির্ভর অর্থনীতি বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়নে সচেষ্ট। হলেও প্রযুক্তিগতভাবে উৎকর্ষ লাভ করতে না পারায় রপ্তানি উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না।

সম্প্রতি আঙ্কটাডের সহযোগিতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত রপ্তানি উন্নয়ন বিষয়ক Integrated Country Program এ দশটি ধাপ চিহ্নিত করা হয়েছে।

ধাপগুলো হলো ১. বস্ত্র ও তৈরি পোশাক, ২. হিমায়িত চিংড়ি ৩. চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য, ৪ স্বর্ণালঙ্কার, ৫ কম্পিউটার সফটওয়্যার, ৬. সিল্ক, ৭. ইলেক্ট্রনিক্স ৮ ফুল, ৯. জনশক্তি ও ১০, বহুমুখী পাটজাত দ্রব্য উল্লিখিত দশটি ক্ষেত্রে রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যাশিত অবদান রাখতে পারবে বলে আশা করা যায় ।

 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ

 

৪. অবকাঠামো উন্নয়ন

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দৃঢ় ভিতের অবকাঠামো দরকার। তাই রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন ইত্যাদি অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। সামগ্রিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যোগাতে পারে নতুন মাত্রা।

 

৫. ঋণখেলাপি সংস্কৃতি রোধ

ঋণখেলাপিরা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান শত্রু। বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক ধরনের ঋণখেলাপি সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে এই খেলাপি সংস্কৃতি বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি।

 

৬. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতি গুরুত্ব আরোপ

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ব্যতীত প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। অধ্যাপক মার্শল যেমন শিক্ষাকে পুঁজি বিনিয়োগের সর্বোৎকৃষ্ট মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তেমনি বাংলাদেশকেও একবিংশ শতাব্দীর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে (১৯৯৬) বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে উন্নয়নবিষয়ক বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়ে বলা হয়েছে যে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ ব্যতীত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে পাকিস্তান এবং কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের অভিজ্ঞতা থেকে দেখানো হয়েছে যে, ১৯৬০ সাল নাগাদ দেশ দুটোর মাথাপিছু আয় প্রায় সমান ছিল।

কিন্তু পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু অন্তভূক্তির হার যেখানে ছিল ৩০ শতাংশ, কোরিয়ায় সেখানে ছিল ৯৪ শতাংশ, যা বিগত ৩৫ বছরে পাকিস্তানের চেয়ে কোরিয়ার মোট অভ্যন্তরীণ আর (জিডিপি) ভিনগুণ বেশি। হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে ধনী ও দরিদ্র নির্বিশেষে সকল দেশের প্রতি এ মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে যে, মৌলিক শিক্ষার প্রসার ছাড়া কোনো দেশের পক্ষেই অর্থনৈতিক কাঠামোর ইতিবাচক রূপান্তর সম্ভব নয়।

 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ

 

৭. বিনিয়োগ বৃদ্ধি

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিনিয়োগের সাথে উন্নয়নের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে বিনিয়োগের মাধ্যমে উদ্ভাবন হয় নতুন নতুন প্রযুক্তির। সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান এবং বিভিন্ন জাতি, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সেবা ও পণ্যাদি আদান-প্রদান সম্ভব হয়।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার পরবর্তী উদীয়মান তারকা। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকার বৈদেশিক বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার জন্য বর্তমান শিল্পনগরীসমূহকে শিল্প পার্কে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 

৮. প্রযুক্তির উন্নয়ন

তৃতীয় বিশ্বকে নিজেদেরই নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে হবে, নিঃসন্দেহে বৈদেশিক সাহায্য দ্বারা নয়। বরং নিজস্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্বারা। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিভাকে কখনো থামিয়ে রাখা যায় না, হয়তো বিলম্বিত করা যেতে পারে। উপরোক্ত কথাগুলো বলেছিলেন নোবেলবিজয়ী মুসলিম পদার্থবিদ ড. আবদুস সালাম। আর বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর এবং শিল্পকাঙ্ক্ষিত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সব সময় উন্নত প্রযুক্তির লাগসই ব্যবহার উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে।

নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রবার্ট শোলো প্রমাণ করেছেন যে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে পুঁজি ও শ্রমের অবদানের তুলনায় উন্নত প্রযুক্তি এবং এর যথোপযুক্ত ব্যবহারের অবদান অনেক বেশি। পুঁজি ও শ্রমের বর্ধিত দক্ষতার সাথে প্রযুক্তির সার্বিক প্রয়োগ না থাকলে উন্নয়নের গতি মন্থর হতে বাধ্য। তাই বাংলাদেশকে একবিংশ শতাব্দীর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ নজর দিতে হবে।

 

৯. তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি

বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হচ্ছে তৈরি পোশাক। বর্তমানে জাতীয় রপ্তানি আয়ের প্রায় ৬৫ ভাগ আসে তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যেও পোশাক শিল্পের একচ্ছত্র আধিপত্য। এমনটি গার্মেন্টস শিল্পেও বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর অষ্টম স্থান অধিকারী দেশ।

পোশাক শিল্পের প্রভাবে বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, বস্ত্রশিল্প, প্রসাধন শিল্প, পরিবহন শিল্প ও প্যাকেজিং শিল্পের প্রসার ঘটেছে, নতুন নতুন প্রযুক্তির আগমন ঘটেছে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডে বাংলাদেশের পরিচিতি এবং অবস্থান পাকা হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, পোশাক শিল্প থেকে আয় ৬০০০ থেকে ৯০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তাই পোশাক শিল্পের উত্তরোত্তর উন্নতি ও বিকাশের জন্য এর কতিপয় সমস্যার আশু সমাধান অত্যাবশ্যক।

সরকার ইতিমধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অনিয়ম ও জালিয়াতি প্রতিরোধের জন্য বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা জারি করেছে বলে পত্রপত্রিকার খবরে জানা গেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে স্থাপিত গ্রিন চ্যানেল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পোশাক শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

১০. গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা

একটি সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গান্ধি নির্ভর করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপর আধুনিক মার্কিন রাDiane Ravitch-এর ভাষায়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে The behaviours, practices and norms that define the ability of a people to govern themselves, আলোচা সংজ্ঞাটি থেকে আমরা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পেয়ে থাকি।

প্রথমত, রাজনৈতিক আচরণ, দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অনুশীলন, তৃতীয়ত, রাজনৈতিক প্রথা পদ্ধতি বা রীতি রেওয়াজ, যা যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। জাতীয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্য অনস্বীকার্য। কিন্তু বাংলাদেশে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের ধারণা পরস্পরবিরোধী।

এ কারণে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্টহীন ও অগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অবরোধ, ধর্মঘট, হরতাল প্রভৃতি কর্মসূচির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির সর্বনাশ করা হচ্ছে। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য ক্ষমতাসীন দল এবং ক্ষমতার বাইরের দলগুলোকে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, আলোচনা, সমঝোতা, দলের ভেতরে ও বাইরে গণতন্ত্র চর্চা অনুশীলন করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইস্যুগুলোতে ঐকমত্য অর্জন করতে হবে।

 

১১. আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত অবস্থান

একবিংশ শতাব্দীর সূচনায় বিশ্ব কোন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত উন্নয়নশীল বিশ্ব শঙ্কিত। তাই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক কাঠামোতে এমন কৌশল অবলম্বন করতে হবে যাতে করে সহায়তা বৃদ্ধি করা যায়। অবশ্য বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ডব্লিউটিওর ৪৮টি এলডিসিভুক্ত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। এটিও একটি কৌশলগত অবস্থান। এভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক কূটনীতির কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের ভূমিকা নেয়া উচিত ।

 

উপসংহার:

মায়ুযুদ্ধ অবসানের পর বিশ্বব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অর্থনীতি বিশেষ স্থান অধিকার করার ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যবস্থার আলোকে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছে এবং এ নীতির সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমস্যাসমূহ সমাধানকল্পে উপরোক্ত সম্ভাব্য করণীয়সমূহ যথাযথভাবে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং আঞ্চলিক অর্থনীতি সংহতকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাণসঞ্চার করবে বলে আশা করা যায় ।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment