রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধ – মো. এনামুল হক

রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধ [ মো. এনামুল হক], প্রতিরোধযুদ্ধে রাজশাহী : রাজশাহীতে ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্য রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি উপদল উপশহরস্থ ক্যান্টনমেন্ট হতে বের হয়ে এসে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর তারা আরম্ভ করে নৃশংস অপতৎপরতা। এ অপতৎপরতা আরম্ভ হয় নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা ও লাশ গুম করার মধ্য দিয়ে। এদিন রাত্রে তারা হানা দেয় শহরের সুনির্দিষ্ট কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বাড়িতে। সেইসব বাড়িতে তারা কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করে অথবা বাড়ি হতে ধরে নিয়ে যায়। যাদের ধরে নিয়ে যায়, তাঁরা আর কখনো ফিরে আসেননি।

রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধ - মো. এনামুল হক, রাজশাহী শহরের পাশদিয়ে বয়ে চলা পদ্মায় শীতের মাছ শিকার
রাজশাহী শহরের পাশদিয়ে বয়ে চলা পদ্মায় শীতের মাছ শিকার

 

রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধ :

পাকিস্তানি সেনারা সেদিন রাত্রে সর্বপ্রথম হানা দেয় শহরের প্রখ্যাত আইনজীবী আবদুস সালামের সেপাহীপাড়ার বাসায়। কিন্তু তিনি বাসায় ছিলেন না। ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তাঁকে না পেয়ে তারা তাঁর দু’পুত্র সেলিমুজ্জামান ও ওয়াসিমুজ্জামানকে বাসা হতে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

পাকিস্তানি সেনারা অতঃপর হানা দেয় অ্যাড. আবদুস সালামের পিতার লক্ষ্মীপুরের বাড়িতে। তাঁর পিতা ছিলেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের একজন অফিসার। সে বাড়ি হতে তারা অ্যাড. আবদুস সালামের ভাই হাসানুজ্জামান (খোকা) এবং ভগ্নিপতি সাইদুর রহমানকে (মিনা) ধরে নিয়ে যায়। সাইদুর রহমান (মিনা) ছিলেন শিল্প ব্যাংকের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার। ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁদেরও আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় যে, তাঁদেরও জোহা হলে হত্যা করা হয়েছিল। সে রাতে পাকিস্তানি সেনারা আরো হত্যা করে রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাড. আব্দুল হাদীর ভাই আব্দুল হককে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী আব্দুর রাজ্জাককে।” উপশহরের আবদুল হাকিম, তাঁর ছোট ভাই আবদুল করিম ও তাঁদের মাতাকেও সে রাতেই তারা হত্যা করেছিল। ১১

পাকিস্তানি সেনারা সে রাতেই আরো হত্যা করেছিল অ্যাড. আবদুস সালামের ভাগ্নিজামাই নাজমুল হক সরকারকে। তিনি ছিলেন ১৯৭০ সনের নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল সেদিন রাত্রি ৫টার দিকে রাণীবাজারের দেওয়ান সিদ্দিক হোসেনের বাড়িতেও চড়াও হয় এবং তাঁকে ও তাঁর শ্যালক খন্দকার আলী আফজালকে বাড়ি হতে ধরে নিয়ে যায়। আফজাল সেদিন রাতে সেই বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তারপর তাঁরা আর কখনো ফিরে আসেননি। দেওয়ান সিদ্দিক হোসেন ছিলেন রেভিন্যু অফিসার। পঁচিশে মার্চের রাতেই তারা ১২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তার মধ্যে তিন জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু অবশিষ্ট নয় জনের লাশ পাওয়া যায়নি। সেগুলো গুম করে ফেলা হয়েছিল। ১২

২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় রাজশাহীর তৎকালীন পুলিশের ডিআইজি মামুন মাহমুদকে ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাঁর ও তাঁর গাড়ির ড্রাইভারের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে পরবর্তী সময়ে রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক শামীম আহসানের বরাতে জানা যায় যে, তাঁকে রংপুর ব্রিগেড সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ১৩

সে সময় রাজশাহীতে ইপিআর সেক্টর হেড কোয়ার্টার্স ছিল। সেখানে সেক্টর কমান্ডার, অ্যাডজুট্যান্ট ও সুবেদার মেজর সকলেই ছিল অবাঙালি তথা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি (বর্তমানে পাকিস্তানি)। কিন্তু মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে, অজ্ঞাত কোনো এক কারণে, এ সেক্টরে বাঙালি জোয়ানদের সংখ্যা বাড়ানো হয়। তবে পশ্চিমা জোয়ানদের অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হলেও বাঙালিদের নিরস্ত্র করে রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে বাঙালি জোয়ানদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ও হতাশা বিরাজ করছিল।

আর সে সময় রাজশাহীতে পুলিশের ডিআইজি ও এসপি উভয়ই ছিলেন বাঙালি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ডিআইজি-র মাধ্যমে পুলিশলাইনের অস্ত্রশস্ত্র তাদের নিকট জমা দেওয়ার নির্দেশ পাঠায়। কিন্তু বাঙালি পুলিশরা তা জমা দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, তাঁদের পক্ষে অস্ত্র সমর্পণ করা সম্ভব নয়। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে চরম চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পুলিশলাইনের অস্ত্রশস্ত্র পশ্চিমা সেনাবাহিনীর কাছে জমা না দেওয়ার জন্য ডিআইজি-র গোপন ইঙ্গিত ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী সেদিনই তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি। ১৪

২৭ মার্চ সকাল হতেই পুলিশলাইনকে কেন্দ্র করে রাজশাহীতে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি বাহিনী এদিন বিকেল ৫টার মধ্যেই আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য পুলিশ বাহিনীকে সময়সীমা বেঁধে দেয়। অন্যথায় পুলিশলাইন আক্রমণ করা হবে বলে তারা হুমকি দেয়। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা অস্ত্রসমর্পণ না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশলাইন আক্রমণ করলে তাঁরা তা প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। হাবিলদার আতিয়ার তাঁদের অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করেন। এরপর তাঁরা পুলিশলাইনে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাঁরা ট্রেঞ্চ কেটে পজিশন নিয়ে বসে থাকেন। ১৫

এদিকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল এদিন দুপুরে হাফেজ মো. আব্দুস সাত্তারের গনকপাড়ার বাসভবনে চড়াও হয়। তারা তাঁকে তাঁর বাড়ি হতে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর কোনো দিন ফিরে আসেননি। তিনি ছিলেন একজন অবাঙালি। একজন অবাঙালি হয়েও তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজশাহী জেলা শাখার ট্রেজারার। বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। ১৬ রাজশাহী শহরের বিভিন্ন এলাকায় এদিন থেকেই ছাত্র-যুবক-তরুণরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হতে শুরু করেন।

রাজশাহী শহর, Rajshahi Town
রাজশাহী শহর, Rajshahi Town

 

পাকিস্তানি সেনাদের অবাধ চলাফেরায় বাধা প্রদানের জন্য তাঁরা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে চুপি চুপি প্রতিবন্ধকতা/বেরিয়ার দেন। তাঁরা তালাইমারীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জেবের মিয়ার নেতৃত্বে শহরের পূর্বদিকে এবং ডা. আবদুল গাফ্ফারের নেতৃত্বে শহরের পশ্চিম দিকে তথা কোর্ট এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কার্যক্রম আরম্ভ করেন। সে সময় ডা. আবদুল গাফ্ফারের বাড়ি, শেখেরচক আলুপট্টি এলাকায় সূর্যশিখা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর কার্যালয় এবং হেঁতেমখা এলাকায় মুসলিম হাই স্কুল হতে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য গোপন তৎপরতা আরম্ভ হয়। এসব কেন্দ্র হতে ছাত্র-যুবকরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কার্যক্রম শুরু করেন। ১৭

পুলিশ বাহিনীর আচরণ পাকিস্তানি সেনাদের নিকট সম্ভবত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে পড়েছিল। তাই তারা পুলিশলাইন আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের দেওয়া আলটিমেটাম ৫টার সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই তাদের একটি বাহিনী মিশনের নিকট এবং অপর একটি বাহিনী কোর্ট ঢালানের নিকট অবস্থান গ্রহণ করে। পুলিশলাইন আক্রমণ করার জন্য যখন তারা মিশনের দিকে আসছিল, তখন রিক্সাচালক সাইদুর রহমান ঝাটু রাস্তায় বেরিকেড দিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা হঠাৎ সেখানে এসে তাঁকে বেরিয়ার দিতে দেখে গুলি করে। তিনিই এখানকার প্রথম শহিদ।

পাকিস্তানি সেনাদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ৫টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে তাদের যে বাহিনীটি মিশনের নিকট অবস্থান নিয়েছিল, তারা পুলিশলাইনকে লক্ষ্য করে প্রচণ্ড শেলিং আরম্ভ করে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপর যে দলটি কোর্ট দালানের নিকট অবস্থান গ্রহণ করেছিল, ব্যাপক ব্রাশ ফায়ার করে। তাদের গোলাগুলির জবাবে পুলিশলাইন হতে পাল্টা ফায়ার আরম্ভ করা হয়। এর ফলে শুরু হয় যুদ্ধ। কিন্তু পুলিশের কাছে কোনো ভারী অস্ত্রপাতি ছিল না। তাদের নিকট ছিল শুধুমাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর একটিমাত্র এলএমজি। তারপরও পুলিশ সদস্যরা মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যান।

গভীর রাত অবধি দু’পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি চলে। সেই সময় মিশনের পশ্চিম দিকে গমের খেত ছিল। পাকিস্তানি সেনারা মিশনের নিকট হতে সেই গমের খেতের ভিতর দিয়ে ক্রলিং করে পুলিশলাইনে চলে আসে।” আর দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলির সময় তাদের তৃতীয় একটি দল পুলিশলাইনের দক্ষিণ দিক দিয়ে অর্থাৎ নদীর দিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে এসে পুলিশলাইনকে ঘিরে ফেলে। তার ফলে পুলিশলাইন তিন দিক হতে ঘেরাও হয়ে পড়ে। আসলে যুদ্ধবিদ্যা বা যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে পুলিশ বাহিনীর জ্ঞান ছিল অতি সীমিত। তাই তারা দক্ষিণ দিক সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত রেখে এই যুদ্ধে ব্যাপৃত হয়।

তারা চিন্তা করতেই পারেনি যে, কোর্ট দালান ও মিশনের দিক হতে গোলাগুলির মধ্যেই শত্রুসেনারা দক্ষিণ দিক দিয়ে এসে তাদের ঘেরাও করে ফেলতে পারে। অথচ যে কোনো প্রচলিত যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ ধরনের কৌশল অহরহই গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা সম্ভবত তা জানতেন না বলে সেদিকে কোনো ফোর্স মোতায়েন করেননি। যাহোক, তিন দিক হতে ঘেরাও হয়ে পড়ে পুলিশ সদস্যরা বেকায়দায় পড়ে যান। তারপরও তাঁরা মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি। মধ্যরাতে পুলিশলাইনের পতন ঘটে। এতে অনেক পুলিশ শহিদ হন। আর কয়েকজন পালিয়ে যান। রাজশাহী শহরের অনেকেই বলে থাকেন, এ যুদ্ধে ৪২ জন পুলিশ শহিদ হয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ ৪৩ জনের কথাও বলে থাকেন।

পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহীতে প্রথম পুলিশলাইনে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এর আগে তারা রাজশাহী শহরে কোথাও প্রতিরোধের মুখে পড়েনি। দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা ২৭ মার্চ দিবাগত মধ্যরাত্রে পুলিশলাইনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। তবে তারা সেদিন পুলিশলাইনে অবস্থান করেনি। পুলিশ লাইনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তারা ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়।

পাকিস্তানি সেনারা পুলিশলাইন থেকে চলে গেলে পরদিন রাজশাহীর ছাত্র-জনতা পুলিশলাইনে গিয়ে পুলিশের ক্ষতবিক্ষত লাশগুলো পড়ে থাকতে দেখে গভীর বেদনায় শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। অতঃপর জনতা পুলিশলাইনের অস্ত্রাগার হতে সব অস্ত্রপাতি লুটপাট করে নেয়। তার ফলে রাজশাহীতে স্বাধীনতাকামী জনতার হাতে কিছু অস্ত্রশস্ত্র আসে, যা পরবর্তী দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।

পুলিশলাইনের গেটের সামনে ছিল মো. মোক্তার হোসেনের বাড়ি। পুলিশলাইন আক্রান্ত হলে তিনি গোলাগুলির মধ্যে পালিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয় মনে করে তাঁর বাড়ির উঠানের মধ্যেই একটি ট্রেঞ্চ খনন করেন। সেই ট্রেঞ্চে তিনি, তাঁর পুত্র ও দু’জন প্রতিবেশী আশ্রয় গ্রহণ করেন। এমতাবস্থায় শত্রুবাহিনীর একটি শেল এসে ট্রেঞ্চে আঘাত করলে ট্রেঞ্চে থাকা চার জনই শহিদ হন। মোক্তার হোসেন ছিলেন একজন সমাজকর্মী। ১৯

পুলিশলাইন আক্রান্ত হওয়ার পর ইপিআর সেক্টর সদর দপ্তর হতে বাঙালি জোয়ানরা সব ব্যারাক ছেড়ে পালিয়ে যান। তবে তাঁরা কোন অস্ত্রপাতি নিয়ে যেতে পারেননি। বাঙালি জোয়ানরা পালিয়ে গেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেক্টর সদর দপ্তরের অস্ত্রাগারে আগুন দিয়ে সব অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করে দেয়। পুলিশলাইনের অস্ত্রশস্ত্র যে স্বাধীনতাকামী জনতার হাতে চলে গিয়েছিল, তা তারা সম্ভবত জানতে বা বুঝতে পেরেছিল; তাই তারা ইপিআর-এর অস্ত্রশস্ত্র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়; যাতে সেইসব অস্ত্রশস্ত্র জনতার হাতে যাওয়ার সুযোগ না থাকে। ২০

১৯৭১ সালে চারঘাট ও বাঘা মিলে একটি থানা ছিল। সে থানা ও রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার সীমান্তবর্তী এলাকায় ইপিআর-এর কতকগুলো বিওপি ছিল। তার মধ্যে চারঘাট বিওপি ছিল কম্পানি হেড কোয়ার্টার। আর চারঘাট থানাধীন মীরগঞ্জ বিওপি ছিল প্লাটুন হেড কোয়ার্টার। চারঘাট কম্পানি হেড কোয়ার্টারের কমান্ডার ছিলেন সুবেদার হাসান আলি। তিনি প্রাথমিকভাবে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে গড়িমসি করছিলেন। এ কম্পানি হেড কোয়ার্টারে অনেক অবাঙালি ইপিআর ছিল। অপরদিকে মীরগঞ্জ প্লাটুন হেড কোয়ার্টারের কমান্ডার ছিলেন নায়েব সুবেদার সিরাজউদ্দীন লস্কর। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বন করেছিলেন।

City Centre Rajshahi, রাজশাহী নগর ভবন
City Centre Rajshahi, রাজশাহী নগর ভবন

 

তাঁর প্লাটুনের অধীনে ছিল চিলমারি, চারঘাট, আলাইপুর ও মীরগঞ্জ বিওপি। তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন এসব বিওপি-র জোয়ানদের নিয়ে তিনি ২৯ মার্চ চারঘাট কম্পানি হেড কোয়ার্টারে চড়াও হন। সেখানে তাঁরা অবাঙালি জোয়ানদের ফল ইন করিয়ে কৌশলে নিরস্ত্র করেন। অতঃপর তাদের গ্রেপ্তার করে চারঘাট থানা হাজতে বন্দি করে রাখেন। আর কম্পানি কমান্ডার সুবেদার হাসান আলির অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। তিনি অতঃপর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন।

সিরাজউদ্দীন লস্কর অতঃপর চারঘাট কম্পানি কমান্ডিং-এর দায়িত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করেন এবং খানপুর, সাহাপুর, দিয়াড়খিজির, মাঝারদিয়াড় ও তালাইমারি বিওপি-র বাঙালি ইপিআরদের চারঘাট থানার ইউসুফপুর হাই স্কুলে এসে উপস্থিত হওয়ার জন্য খবর পাঠান। সংবাদ পেয়ে সে-সব বিওপি হতে ইপিআর সদস্যরা ইউসুফপুর হাই স্কুলে এসে উপস্থিত হন। আসার সময় সে-সব বিওপিতে যে-সব অবাঙালি ইপিআর ছিল, তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসেন।

সিরাজউদ্দীন লস্কর অতঃপর তাঁর দলবল নিয়ে ক্যাডেট কলেজে গিয়ে ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। এরপর বিভিন্ন বিওপি হতে ইপিআর সদস্যরা দলে দলে এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। এর ফলে ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদের কমান্ডে ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও উৎসাহী ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে ওঠে। এসময় নওগাঁ হতে বাঙালি সেনা অফিসার মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী ওয়ারলেসে ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

দেশ ও জাতির এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তাঁদের আশু করণীয় বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন এবং ক্যাপ্টেন রশিদকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী সে সময় নওগাঁয় ইপিআর-এর ৭ নং উইং-এ যথাক্রমে উইং কমান্ডার ও ডেপুটি উইং কমান্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

এদিকে ৩১ মার্চ ইপিআর-এর ৭ নং উইং কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের নির্দেশে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী এক কম্পানি ইপিআর নিয়ে নওগাঁ হতে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে আসেন। মেজর নাজমুল হক ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীনকে পশ্চিম দিক হতে এবং ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদকে পূর্ব দিক হতে রাজশাহী আক্রমণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২২ পথে পথে সৃষ্ট বেরিকেড অতিক্রম করে ক্যাপ্টেন গিয়াস তাঁর বাহিনী নিয়ে বিকেলে নওহাটায় এসে উপনীত হন। সেখানে তিনি তাঁর ফোর্সের প্রায় অর্ধেক রেখে দিয়ে অবশিষ্ট ফোর্স নিয়ে রাজশাহীর ৭/৮ কিলোমিটার পশ্চিমে খরচক্কা নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান নেন। ২৩

ওদিকে আবার ২৭ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইপিআর-এর উইং সদর দপ্তরে (৬ নং উইং) বাঙালি ও অবাঙালি ইপিআরদের মধ্যে একটি রক্তাক্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহী পালিয়ে আসে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুরোপুরি হানাদারমুক্ত হয়। অতঃপর সেখানকার বিজয়ী বাহিনী ৩০ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে রাজশাহীর পথে অগ্রসর হয়ে সেদিন মহিশালবাড়ি পর্যন্ত এসে পৌঁছে। সেখানে রাত্রি যাপন করে পরদিন ৩১ মার্চ তাঁরা আরো অগ্রসর হয়ে কোর্টের পশ্চিমে কাশিয়াডাঙ্গায় এসে উপস্থিত হয়।

এসময় ক্যাপ্টেন গিয়াস নওগাঁ হতে রাজশাহী এসে পৌছুলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাহিনীর সঙ্গে তাঁর কাশিয়াডাঙ্গায় সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাহিনীরও নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ২৪ তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণের পর রাজশাহীতে প্রতিরোধযুদ্ধ নূতন মাত্রা লাভ করে। এরপর রাজশাহীতে প্রতিরোধযুদ্ধ সুসংগঠিত রূপ নেয়। আর এদিনই পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ আব্দুল মজিদকে জেলা প্রশাসকের বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে। ২৫

এদিন রাত্রে ক্যাপ্টেন গিয়াসের কমান্ডে যৌথ বাহিনী রাজশাহীর পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী সড়কের দু’পাশে পজিশন নেয়। তারা পজিশন নেওয়ার পর ক্যান্টনমেন্ট হতে ২৫ পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়নের একটি প্লাটুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী রোড ধরে অগ্রসর হয়ে এলে তারা গিয়াসের নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে। এতে ৭ জন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং একজন ধরা পড়ে। আর কয়েকজন আহত হয়। এ ঘটনায় প্রতিরোধবাহিনীর মনোবল অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। ২৬

১ মার্চ সকাল ছ’টার মধ্যেই ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী শহরের একেবারে নিকটে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। নওগাঁ হতে আগত বাহিনীতে ছিলেন শুধু ইপিআর জোয়ানবৃন্দ। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাহিনীতে ইপিআর ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদসহ অতিউৎসাহী কয়েকজন ছাত্রও ছিলেন। ২৭ প্রতিরোধযোদ্ধারা আধারকোঠা হতে কাশিয়াডাঙ্গা মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। তবে কাশিয়াডাঙ্গা আমবাগানে সবচেয়ে বেশি যোদ্ধা অবস্থান নিয়েছিলেন।

Rajshahi Railway Station, রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন
Rajshahi Railway Station, রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন

 

এসময় কাশিয়াডাঙ্গা এবং রায়েরপাড়া আমবাগান ইপিআর-এর প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এরপর কয়েকদিনের মধ্যে রাজশাহী জেলার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন বিওপি হতে ইপিআর সদস্যরা দলে দলে এসে ক্যাপ্টেন গিয়াসের বাহিনীর সঙ্গে যোগদান করেন। রাজশাহী ইপিআর সেক্টর সদর দপ্তর হতে যেসব ইপিআর জোয়ান পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরাও অনেকেই এখানে এসে যোগদান করেন।

এর ফলে যোদ্ধার সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। বিশাল এ বাহিনীর খাওয়া-দাওয়ার জন্য খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে নিয়ে এসে কাশিয়াডাঙ্গা তহশিল (ভূমি) অফিসে জমা করে রাখা হতো। ফলে দোতালা তহশিল অফিসটি সে সময় মুক্তিবাহিনীর খাদ্যভাণ্ডারে পরিণত হয়। ২৮

এদিকে ক্যাপ্টেন গিয়াস ৩১ মার্চ বিকেলে নওগাঁ হতে রওনা হয়ে রাজশাহী কোর্টের দিকে যাওয়ার আগে তাঁর যেসব ফোর্স নওহাটায় রেখে গিয়েছিলেন, তাঁরা সেদিন রাত্রে নওহাটা ব্রিজের নিকট পুটিয়াপাড়ার রাধাগোবিন্দের আমবাগানে গিয়ে অবস্থান নেন। পরদিন সকালে তাঁরা নওহাঁটা এলাকার স্বাধীনতাকামী স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র তরুণদের সহযোগিতায় এখন যেখানে পোস্টাল একাডেমি ও বন বিভাগের অফিস হয়েছে, সেসব এলাকাসহ তার আশেপাশে অনেকগুলো ট্রেঞ্চ/বাংকার খনন করে পজিশন নেয়।”

এদিকে ক্যাপ্টেন গিয়াসের পরামর্শ মোতাবেক ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদ ও নায়েব সুবেদার সিরাজ উদ্দীন লস্কর চারঘাটের ইপিআর বাহিনী নিয়ে ৩১ মার্চ বিকেলে সারদহ হতে রাজশাহীর পথে অগ্রসর হয়ে হর্টিকালচারের আমবাগানে এবং জেবের মিয়ার ইটের ভাটার আশেপাশে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। এরপর তাঁদের বাহিনীকে ক্যাপ্টেন গিয়াসের কমান্ডে ন্যস্ত করা হয়। এর ফলে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরীর ওপর নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চারঘাট-এ তিনটি বাহিনী কমান্ডিং-এর দায়িত্ব অর্পিত হয়।

এরপর ক্যাপ্টেন গিয়াস ৩ এপ্রিল দিবাগত রাত্রে রাজশাহী শহর দখল করার পরিকল্পনা করেন। সে মোতাবেক তাঁর নির্দেশ ও পরামর্শে ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদ সিরাজ উদ্দিন লস্করকে তাঁর বাহিনী নিয়ে রাত্রি ১১টায় পূর্ব দিক হতে শহরে প্রবেশের নির্দেশ দেন। তদনুযায়ী লস্কর তাঁর বাহিনীকে ১১টি উপদলে বিভক্ত করে প্রতি উপদলকে ৫০ মিটারের মতো দূরে দূরে অবস্থান নিয়ে ধীরে ধীরে শহরের দিকে অগ্রসর হন।

সে সময় তাঁর নিকট ৯টা এলএমজি, ৩টা রকেট লাঞ্চার, ৩টা টুইঞ্চ মর্টার ও প্রয়োজনীয় গোলাগুলি ছিল। তাঁরা রাত্রি ২টার দিকে (৪ এপ্রিল) তালাইমারী অতিক্রম করে শহরে প্রবেশ করে। তার কিছু পর ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর বাহিনী কোর্ট এলাকায় প্রবেশ করে। এভাবে বিনা যুদ্ধেই সেদিন রাজশাহী শহরে প্রতিরোধবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। শত্রুসেনারা উপশহরস্থ ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়। অতঃপর তারা সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

মুক্তিবাহিনী শহরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার নারী-পুরুষ আনন্দ-উল্লাস করতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। তাঁরা সারা রাত ধরে শহরে আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে সার্কিট হাউজ, রেডিও সেন্টার, পুলিশলাইন দিনের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা হতে উড়ে এসে রাজশাহীতে বিমান হামলা চালায়।

এরপর ৬ এপ্রিল সন্ধ্যার পর মেজর নাজমুল হকের নির্দেশে ক্যাপ্টেন গিয়াস ও ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদ পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। সেদিন প্রায় চার ঘণ্টা ধরে দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এতে উভয় পক্ষেই বেশ হতাহত হয়। এরপর কয়েক দিন পাকিস্তানি সেনারা ক্যান্টনমেন্ট হতে আর বের হতেই পারেনি। এসময় শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ক্যাম্পাস ছাড়া পুরো রাজশাহী শহর মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহীর অবস্থা অনুরূপ ছিল। তবে সে সময়ও তাদের বিমান আক্রমণ অব্যাহত ছিল।

 

প্রতিরোধযুদ্ধে নওগাঁ:

নওগাঁয় ছিল ইপিআর-এর ৭ নং উইং। ১৮ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত এই উইং-এর কমান্ডার ছিলেন মেজর আকরাম বেগ। তিনি ছিলেন অবাঙালি (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি)। উইংটিতে দু’জন ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। তার মধ্যে একজন ক্যাপ্টেন নাবীদ আফজাল। তিনিও ছিলেন অবাঙালি। অপর একজন ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী। তিনি বাঙালি। এমতাবস্থায় মেজর নাজমুল হক তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমানে পাকিস্তান) থেকে এসে ১৮ মার্চ এ উইং-এ যোগদান করেন। কিন্তু মেজর আকরাম বেগ তাঁর (মেজর নাজমুল হক) নিকট উইং-এর দায়িত্ব হস্তান্তর করতে আগ্রহী বা ইচ্ছুক ছিলেন না।

তাই তিনি দায়িত্ব হস্তান্তরে গড়িমসি আরম্ভ করেন। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা আবদুল জলিলের হস্তক্ষেপে মেজর আকরাম বেগ দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। অতঃপর মেজর আকরাম বেগ এবং অবাঙালি ক্যাপ্টেন নাবীদ আফজাল ২৩ মার্চ নওগী হতে ঢাকার পথে রওনা হন। কিন্তু নগরবাড়িঘাটে তাঁরা বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে নওগাঁ ফিরে আসতে বাধ্য হন। তার ফলে ২৫ মার্চে নওগাঁয় দুই জন মেজর ও দুই জন ক্যাপ্টেন অবস্থান করছিলেন। তার মধ্যে দুজন অবাঙালি। মেজর আকরাম বেগ ও ক্যাপ্টেন নাবীদ আফজাল।

মেজর আকরাম বেগ ও ক্যাপ্টেন নাবীদ আফজাল ঢাকা যেতে না পেরে নগরবাড়ি হতে ফিরে এসে আবার নওগী উইং-এর দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেন। এজন্য তাঁরা গোপনে ষড়যন্ত্রও করেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। এদিকে নওগাঁর উপকণ্ঠ সান্তাহারে ছিল অনেক অবাঙালির (বিহারি) বসবাস। সে-সময় সেখানে বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। আবার ইপিআর-এর বাঙালি-অবাঙালি সদস্যদের মধ্যেও মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

এমতাবস্থায় দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার পর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিলের নেতৃত্বে অবাঙাি মেজর আকরাম বেগ ও ক্যাপ্টেন নাবীদ আফজালকে কৌশলে ২৪ মার্চে গৃহবন্দি করা হয়। সে সময় নওগাঁর মহকুমা প্রশাসক ছিলেন নিসারুল হামিদ। তিনিও ছিলেন অবাঙালি। তাকেও একই প্রক্রিয়ায় গৃহবন্দি করা হয়। নিরাপত্তা প্রদানের কথা বলে কৌশলে তাঁদের গৃহবন্দি করা হয়েছিল। কিন্তু এসব তৎপরতার কথা উইং-এর সাধারণ জোয়ানদের জানতে দেওয়া হয়নি।

নওগাঁ উইং-এ অনেক অবাঙালি জোয়ান ছিল। ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীনের মতে এ সংখ্যা কমপক্ষে ১০০ জন। আর আবদুল জলিলের মতে ১২১ জন। তাছাড়া তাদের পরিবার-পরিজনও ছিল। কিন্তু অবাঙালি জোয়ানরা বুঝতে বা জানতেই পারেনি যে, তাদের মেজর আকরাম বেগ ও ক্যাপ্টেন নাবীদ আফজাল গৃহবন্দি তথা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এহেন অবস্থায় ২৪ ও ২৫ মার্চ অতিবাহিত হয়।

অতঃপর ২৬ মার্চ সকালে ঢাকার পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর হতে অতি সতর্কতার সঙ্গে ওয়ারলেসে ক্যাপ্টেন গিয়াসকে জানানো হয় যে, গত রাত্রে পাকিস্তানি আর্মি ইপিআর সদর দপ্তর আক্রমণ করেছে এবং বাঙালি ইপিআর সদস্যরা রিভোল্ট করে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন। ওয়ারলেসে সংবাদটি পেয়ে নওগাঁর বাঙালি অফিসার ও জোয়ানরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা করেন। এতে করে তাঁরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের কিছু কিছু খবরাখবর পাচ্ছিলেন।

তাছাড়া রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠানাদি হতেও দেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ অনুমান করা যাচ্ছিল। দেশের সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে-সময় নওগাঁ উইং-এর বাঙালি সদস্যরা কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। আর ঠিক সে-সময় ১০০/১৫০ জন ছাত্র-জনতা মাইক নিয়ে উইং-এর সামনে এসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ডিং বাজাতে শুরু করেন। এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বেলা ১০/১১টার দিকে কোয়ার্টার গার্ডের সেন্ট্রির ওপরতলা হতে একটি ফায়ার হয়।

ফায়ারটি কে করেছিলেন তা বোঝা যায়নি। তবে সে ফায়ারিং-এর শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক হতে অসংখ্য ফাঁকা ফায়ার শুরু হয়। তবে অল্পক্ষণ পরই তা বন্ধ হয়ে যায়। আসলে মেজর নাজমুল হক দেশের বিরাজমান নাজুক পরিস্থিতির কারণে যে কোনো অনাহূত অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য বাঙালি ইপিআরদের প্রস্তুত থাকতে আগে থেকেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। তার ফলে একটি গুলি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি জোয়ানরা চারদিক হতে ফায়ারিং আরম্ভ করেন।

ফায়ারিং বন্ধ হওয়ার পর অবাঙালি মেজর আসলাম বেগের অনুরোধে অবাঙালি জোয়ানদের ব্যারাকে নিয়ে গিয়ে বাঙালিদের হেফাজতে রাখা হয়। তার কিছুক্ষণ পর বাঙালিদের প্রহরায় তাদের আনসার ক্যাম্পে নিয়ে রাখা হয় এবং তাদের পরিবার-পরিজনকে জেসিও মেসে রাখা হয়। আর মেজর আকরাম বেগ, ক্যাপ্টেন নাবীদ আফজাল ও মহকুমা প্রশাসক নিসারুল হামিদকে ইপিআর ক্যাম্পের সামনের একটি বাড়িতে রাখা হয়। এর ফলে নওগাঁয় কোনো রক্তপাত বা সংঘর্ষ ছাড়াই সকল পশ্চিমা অফিসার ও জোয়ান বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। নওগাঁ এভাবে ২৬ মার্চ দ্বিপ্রহরের মধ্যেই শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। ৩৫

২৬ মার্চের পর হতে নওগাঁর সামগ্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ নেতাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। অবশ্য তারও আগে ৭ মার্চের পর হতেই থানা পুলিশসহ সিভিল প্রশাসন আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে আসছিল। তবে ২৬ মার্চের ঘটনাবলির পর ইপিআর ক্যাম্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ারও আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরীর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

এদিন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

১. ওয়ারলেস স্টেশন সারাদিন খোলা রাখা এবং বিভিন্ন খবরাখবর সংগ্রহ করে তা মনিটর করা।

২. পুলিশের ওয়ারলেস সেট হতেও খবরাখবর সংগ্রহ ও মনিটর করা।

৩. বাইরের খবর সংগ্রহ করা। কিন্তু নিজেদের খবর বাইরে না জানানো।

৪. ছাত্র ও যুবকদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।

৫. বিভিন্ন যানবাহন (বাস, ট্রাক, জিপ, কার) ইত্যাদি রিকুইজিশন করা।

৬. অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ স্টোর হতে সরিয়ে ফেলা এবং তার একাংশ মাটির নিচে পুঁতে রাখা।

৭. নওগাঁর কিছু দূরে পেট্রলিং-এর ব্যবস্থা করা।

৮. বগুড়ার খবরাখবর আদান-প্রদানের জন্য রানার নিয়োগ করা। গৃহীত সে-সব সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদিও গ্রহণ করা হয়।

এসময় সান্তাহারে বাঙালি বিহারি দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। সেখানে ১ মার্চ হতেই দাঙ্গা শুরু হয়। তবে ২৬ তারিখ হতে তার ব্যাপকতা অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। এ সময় সেখানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো ঘটনা ঘটে। আবদুল জলিলের ভাষ্য মতে, সেখানে এক হাজারেরও বেশি বিহারি নিহত হয়। উল্লেখ্য যে, সান্তাহারে সে সময় অনেক বিহারির বসবাস ছিল। সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন ও সুবেদার খোন্দকার মতিউর রহমান তিন প্লাটুন ফোর্স নিয়ে সান্তাহার যান। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিলও যান।

সেখানে প্রাথমিকভাবে ১৪৪ জারি করে। পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। অতঃপর বাঙালি-বিহারি দু’পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দু’পক্ষকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সম্মত করানো হয়। পরবর্তী ২/৩ দিনের মধ্যে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন বিওপি হতে বাঙালি ইপিআরদের নওগাঁয় ক্লোজ করা হয় এবং বিওপি-র অবাঙালি ইপিআরদের বন্দি করা হয়। ৩৬

মেজর নাজমুল হকের নির্দেশ ও পরামর্শক্রমে ২৮ মার্চ ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী, সুবেদার খোন্দকার মতিউর রহমান (স্বাধীনতা-উত্তর কালে বীরবিক্রম) ও হাবিলদার আলী আকবর কিছু ইপিআর নিয়ে নওগাঁ হতে বগুড়ার পথে রওয়ানা হন। তাঁরা সকাল ১০টায় রওয়ানা হয়ে পথে পথে সৃষ্ট বেরিকেড অতিক্রম করে সন্ধ্যা ৬টায় বগুড়া গিয়ে পৌঁছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পাকিস্তানি সেনাদের একটি বাহিনী ২৬ মার্চের সকালেই রংপুর হতে বগুড়া আসে।

বগুড়ার মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সে যুদ্ধে সহায়তা করার জন্যই ক্যাপ্টেন গিয়াস তাঁর দলবল নিয়ে বগুড়া যান। তিনি বগুড়া গিয়ে প্রথমে যুদ্ধরত প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সেখানকার প্রকৃত অবস্থা অবহিত হওয়ার চেষ্টা করেন। অতঃপর সেখানে যুদ্ধরত বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও পরামর্শ দিয়ে হাবিলদার আলী আকবরের কমান্ডে ২৫ জন ইপিআরকে রেখে সুবেদার খোন্দকার মতিউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নওগাঁ ফিরে আসেন।

কারণ নওগাঁতে তাঁর তখন বিশেষ প্রয়োজন ছিল।” হাবিলদার আলী আকবর তাঁর ইপিআর বাহিনী নিয়ে বগুড়ায় যুদ্ধরত পুলিশ ও ছাত্র-যুবকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বগুড়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাঁদের আগমনে বগুড়ায় প্রতিরোধযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অনেকখানি পাল্টে যায়। এ বিষয়ে আমরা একটু পরে আলোচনা করব।

মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন এ সময় নওগাঁয় অবস্থান করে। বগুড়া ও রাজশাহীকে শত্রুমুক্ত রাখার জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন। সে অনুযায়ী বগুড়ায় যুদ্ধরত বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য ৩০ মার্চ সুবেদার খোন্দকার মতিউর রহমানের নেতৃত্বে এক প্লাটুন ইপিআর সেখানে প্রেরণ করা হয়। তার পরের দিন ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী নওগাঁর ইপিআর-এর একাংশকে নিয়ে রাজশাহীকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে রাজশাহীর পথে রওনা হয়ে আসেন।

নওগাঁ হতে বগুড়ায় প্রেরিত ইপিআর বাহিনী পরবর্তীকালে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, বাঘাবাড়ি ও নগরবাড়িঘাট পর্যন্ত গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। অপরদিকে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন রাজশাহী, পাবনা, নগরবাড়িঘাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জকে শত্রুমুক্ত রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। আর মেজর নাজমুল হক এ সময় কখনো নওগাঁয় আবার কখনো বগুড়ায় অবস্থান করে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নগরবাড়িঘাট, রাজশাহী প্রভৃতি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন। অতঃপর ১ এপ্রিল বগুড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হলে তার কয়েক দিন পর তিনি রাজশাহী চলে আসেন এবং রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেন।

 

প্রতিরোধযুদ্ধে বগুড়া:

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বগুড়ার ছাত্র ও যুবসমাজও মার্চের প্রথম হতেই সংগ্রামমুখর হয়ে ওঠেন। তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্র ও যুবসমাজের পাশাপাশি বগুড়ার সাধারণ জনগণও আন্দোলনে-সংগ্রামে ব্যাপকভাবে অংশ নিতে থাকেন। সমগ্র জেলাব্যাপী ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তুমি কে – আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ প্রভৃতি স্লোগানে স্লোগানে বগুড়ার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।

সারা দেশের ন্যায় বগুড়াতেও শুরু হয় দুর্বার অসহযোগ আন্দোলন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সমস্ত আদেশ-নির্দেশ অমান্য করে বগুড়ায় বঙ্গবন্ধু ঘোষিত নির্দেশনা মোতাবেক অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ সব কিছু চলতে থাকে।

সে সময় রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিবর্গের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাংলার মাটিতে পাকিস্তানিদের দিন শেষ, দেশের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তার কারণ দেশের সার্বিক অবস্থা যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তাতে স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু পাকিস্তানিরা যে সহজে স্বাধীনতা দিবে না, স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী, তাও তাদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তাই আন্দোলন-সংগ্রাম দিনে দিনে তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে ওঠে।

আর এ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আসে ঐতিহাসিক ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রি, যে রাত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট নামক ঘৃণ্য নৃশংসতায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ আরম্ভ করেছিল। সেদিনই গভীর রাত্রে ঢাকা হতে বগুড়ার কোতওয়ালী থানায় খবর দেওয়া হয় যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর আক্রমণ করেছে এবং বাঙালি ইপিআর ও পুলিশ সদস্যরা তা প্রতিরোধ করছে।

ঢাকা হতে আরো সংবাদ দেওয়া হয় যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল রংপুর হতে বগুড়ার পথে রওনা হয়েছে। কোতওয়ালী থানা পুলিশ এ খবর পেয়ে বগুড়ার তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও ভাষা সৈনিক গাজীউল হককে জরুরি ভিত্তিতে থানায় আসার জন্য খবর দেন। সে খবর পেয়ে গাজীউল হক ডা. জাহিদুর রহমানকে (এমপি) সঙ্গে নিয়ে অতি দ্রুত থানায় যান।

তাঁরা দু’জন থানায় গেলে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের মো. মকবুল তাঁদের রাজারবাগ পুলিশলাইন ও পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর আক্রান্ত হওয়া এবং রংপুর হতে পাকিস্তানি বাহিনীর বগুড়ার পথে রওনা হয়ে আসার খবরটি অবহিত করেন। অতঃপর তাঁরা আশু করণীয় নির্ধারণের জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজামউদ্দীনসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে শত্রুবাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কীভাবে তাদের প্রতিরোধ করা হবে তা নিয়ে তাঁরা ছিলেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

গাজীউল হক, Gaziul Haque
গাজীউল হক, Gaziul Haque

 

এরপর গাজীউল হক ও ডা. জাহিদুর রহমানসহ আরো কয়েকজন মিলে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দিতে আরম্ভ করেন। সঙ্গে সঙ্গে বগুড়াবাসী সব বাড়িঘর হতে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই শহরের সবত্রই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, পাকিস্তানি বাহিনী রংপুর থেকে বগুড়া আসছে। বিদ্যুৎগতিতে সারা শহরে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মানুষজন সব উত্তেজিত হয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। শহরের রাস্তার যেখানে-সেখানে অনেকগুলো বেরিকেড/প্রতিবন্ধক তৈরি করা হয়। সংগ্রামী ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাত জেগে এসব প্রতিবন্ধক বা বেরিকেড গড়ে তুলেছিলেন। ১৯

এরপর তাঁরা শত্রুবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে তৎপর হয়ে পড়েন। তা ছাড়া রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতৃবৃন্দের উদ্যোগে বিভিন্ন বাড়ি হতে ব্যক্তিগত বন্দুকসমূহ সংগ্রহ করা হয়। আগ্রহী ছাত্র ও তরুণদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে তাঁদের ছোট ছোট উপদলে বিভক্ত করে শত্রুসেনাদের মোকাবেলা করার জন্য কালীতলা থেকে দু’নম্বর রেল ঘুমটি পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন ঘরবাড়ির আড়ালে আবডালে অবস্থান নিতে বলা হয়েছিল।

তবে সে মোতাবেক সকলেই অবস্থান গ্রহণ করেননি। অনেকেই নিজেদের মতো করে পজিশন নেন। টিটু, হিটলু ও মোস্তাফিজ বড়গোলায় ইউনাইটেড ব্যাংকের ছাদের ওপর পজিশন নেন। আর তপন, সামিয়াল, বখতু ও জলিল কালীতলার মুখে গিয়ে পজিশন নেন। আবার ওসি নিজামউদ্দীন তাঁর অপর চার সহকর্মীসহ আজাদ গেস্ট হাউজের ছাদের ওপর গিয়ে পজিশন নেন।

আরো বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে অবস্থান গ্রহণ করে শত্রুবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে থাকেন। তাঁদের সম্বল বলতে ছিল পাঁচটি ৩০৩ রাইফেল, কয়েকটি একনলা, দোনলা বন্দুক ও টু-টুবোর রাইফেল। শত্রুসেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য সে সময় অস্ত্র হাতে যে-সব ছাত্র ও যুবক এগিয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন:

  • এনামুল হক তপন
  • আব্দুল জলিল
  • এমদাদুল হক তরুণ
  • নুরুল আনোয়ার বাদশা
  • টিটু (শহিদ)
  • হিটলু (শহিদ)
  • মুস্তাফিজুর রহমান ছুনু (শহিদ)
  • আজাদ (শহিদ)
  • তারেক (শহিদ)
  • খোকন পাইকড় (শহিদ)
  • সালাম, বখতিয়ার হোসেন বখতু
  • খাজা সামিয়াল, মমতাজ
  • রাজিউল্লা
  • টি এম মুসা (পেস্তা)
  • নান্না
  • সৈয়দ সোহরাব
  • বকুল (শহিদ)
  • বুবলা
  • জাকারিয়া তালুকদার
  • মাহতাব
  • টাটারু
  • বুলু
  • বেলাল
  • এ কে এম রেজাউল হক (রাজু),
  • ইলিয়াস উদ্দীন আহমদ প্রমুখ।

তবে লক্ষণীয় যে, সে সময় ডা. জাহিদুর রহমান, মাহমুদ হাসান খান ও হবিবুর রহমান ছাড়া বগুড়া হতে জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত অন্য কোনো প্রতিনিধি বা নেতা শহরে ছিলেন না। সকলেই বগুড়া শহর হতে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন তথা আত্মগোপন করেছিলেন। ১

পাকিস্তানি বাহিনী রাত্রে রংপুর হতে রওনা দিয়ে মহাস্থান গড় হয়ে ২৬ মার্চ সূর্যোদয়েরও কিছু আগে বগুড়া শহরে পৌছার পূর্বেই বাঘোপাড়ায় প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাদের অগ্রযাত্রায় বাধা দেওয়ার জন্য স্থানীয় জনগণ সেখানে বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড/প্রতিবন্ধক দিয়ে রেখেছিল। সে সময় দেশের সর্বত্রই এভাবে বেরিকেড দেওয়া হচ্ছিল। বাঘোপাড়ার প্রতিবন্ধক অপসারণ করে পাকিস্তানি সেনারা আবার বগুড়ার দিকে অগ্রসর হয়।

তারা যখন বগুড়া শহরের দিকে এগিয়ে আসছিল, তখনো বগুড়ার অনেক স্থানেই প্রতিবন্ধক দেওয়া অব্যাহত ছিল। তারা ঠেঙ্গামারা গ্রামের পাশ দিয়ে যখন বগুড়া শহরের দিকে এগিয়ে আসছিল, তখন ঠেঙ্গামারা গ্রামের রিক্সাচালক তোতা মিয়া (পিতা ভোলা সেখ) রাস্তায় বেরিকেড দিচ্ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে বেরিকেড দিতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। তিনি শহিদ হন। তিনি বগুড়ায় ২৬ মার্চের প্রথম শহিদ।

পাকিস্তানি সেনারা তাঁর লাশের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিয়ে ব্যাপক গোলাগুলি করতে করতে গাড়ির বহর নিয়ে আবার বগুড়ার দিকে অগ্রসর হয়। তবে রাস্তায় অনেক প্রতিবন্ধক থাকার কারণে কিছু সেনা গাড়ি হতে নেমে পায়ে হেঁটে রাস্তার দু’ধার দিয়ে শহরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এ সময় তারা মাটিডালি, বৃন্দাবনপাড়া ও ফুলবাড়ি গ্রামের অনেক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারা ফুলবাড়ির সুবিল পুল অতিক্রম করার পর পরই আকস্মিকভাবে ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

কয়েকজন ছাত্র সেখানে তাদের আক্রমণ করেই সরে পড়েন। ছাত্রদের আকস্মিক এ আক্রমণে তারা কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়ে। তবে তা সামলে নিয়ে তারা আবার শহরের দিকে অগ্রসর হয়। এরপর তারা কালীতলাহাট হয়ে ঝাউতলা রোড ধরে বড়গোলা মোড়ের দিকে এগুতে থাকে। কিন্তু কালীতলাহাট পার হওয়ার পরপরই তপন তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে দেওয়ালের আড়াল হতে তাদের লক্ষ্য করে গুলি করেন। এতে একজন পাকিস্তানি সেনা সেখানে নিহত হয়।

তাঁরা গুলি করেই সেখান হতে কেটে পড়েন। একজন সহযোদ্ধা খোয়ানোর পর পাকিস্তানি সেনারা আবার ব্যাপক গোলাগুলি করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু অল্প কিছু দূর যাওয়ার পরই তারা সংগ্রামী ছাত্র-জনতার আক্রমণের শিকার হয়। এ আক্রমণে দু’জন পাকিস্তানি সেনা আহত হয়। এরপর তারা কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। অতঃপর তারা আবার সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে বড়গোলা অতিক্রম করলে স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন।

এই আক্রমণ ছিল অত্যন্ত ব্যাপক ও প্রচণ্ড। সে সময় ঝাউতলার বোম্বে সাইকেল স্টোরের পাশ থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে পালানোর সময় আজাদুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন। তিনি বগুড়া শহরে লড়াইরত প্রথম শহিদ। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে একটি চায়ের দোকানের দুই কিশোর কর্মচারীকে দোকানের ভিতর গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা ২ নং রেল ঘুমটির নিকট গিয়ে পৌঁছে। সেখানে এসে তারা তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

সেখানে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজাম উদ্দীন ও দারোগা নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন জন কনস্টেবল ও ২৭ জন সেচ্ছাসেবী ছাত্র-যুবক পাঁচটি ৩০৩ রাইফেল, একনলা, দোনলা বন্দুক ও টু-টু বার রাইফেল নিয়ে শত্রুসেনাদের আগমনের প্রতীক্ষায় ওঁত পেতে বসে ছিলেন। ওসি ও দারোগাসহ কয়েকজন আজাদ রেস্ট হাউজের ছাদে এবং অবশিষ্টরা কালীতলা রোডের দু’পাশে দেওয়ালের আড়ালে আবডালে ও জানালার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছিলেন।

এমতাবস্থায় শত্রুসেনারা রেল ঘুমটির নিকট এসে পৌঁছলে আজাদ রেস্ট হাউজের ছাদ ও তার আশপাশ হতে স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধারা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। একাধিক দিক হতে আক্রান্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনারা একটু পেছনের দিকে সরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বড়গোলার মোড়ে ইউনাইটেড ব্যাংকের ছাদের ওপর হতে তাদের আক্রমণ করেন টিটু, হিটলু ও মুস্তাফিজ (ছুনু)। তাঁদের আক্রমণে দু’জন পাকিস্তানি সেনা আহত হয়।

তাঁরা ছাদের ওপর হতে গুলি করেই পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তার আগেই শত্রুসেনারা ব্যাংকটি ঘিরে ফেলে। ফলে তাঁরা আর পালানোর সুযোগ পাননি। সেখানে টিটু শহিদ হন। তিনি ছিলেন স্কুলছাত্র। আর মোস্তাফিজুর রহমান (ছুনু) ও হিটলু ধরা পড়েন। তাদের মাটিডালি নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। মোস্তাফিজুর রহমান (ছুনু) ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। তিনি ভাল গীটার বাজাতেন।

এরপর দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। তারা সুবিলের উত্তরে চলে গিয়ে মজিবুর রহমান মহিলা কলেজ ও ডাক-বাংলোসহ তার আশপাশে অবস্থান নেয়। ৪২ সেখান হতে তারা সারা রাত্রি মুহুর্মুহু গোলাগুলি বর্ষণ করে। প্রথম দিনের যুদ্ধে বগুড়াবাসী বিজয়ী হয়।

মাত্র পাঁচটি ৩০৩ রাইফেল আর কয়েকটি একনলা, দোনলা বন্দুক ও টু-টুবোর রাইফেল নিয়ে ৫/৬ জন পুলিশ আর কয়েকজন ছাত্র-যুবক-তরুণ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীকে শহর হতে বিতাড়ন করে শহরের বাইরে গিয়ে অবস্থান নিতে বাধ্য করার গৌরব অর্জন করেন।৪৩ এদিন সন্ধ্যায় বগুড়ার বাদুড়তলার একটি বাড়িতে যুদ্ধ পরিচালনা সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় মোখলেসুর রহমানের প্রস্তাবক্রমে নিম্নোক্ত ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি হাই কমান্ড গঠন করা হয়।

১. গাজীউল হক, সর্বাধিনায়ক (যুদ্ধের দায়িত্ব),

২. ডা. জাহিদুর রহমান, আওয়ামী লীগ (খাদ্য ও

৩. মাহমুদ হাসান খান, আওয়ামী লীগ (প্রশাসন),

৪. মোখলেসুর রহমান, ন্যাপ (মোজাফফর),

চিকিৎসার দায়িত্ব),

৫. আব্দুল লতিফ, কম্যুনিস্ট পার্টি (প্রচার)

২৬ মার্চ দিবাগত রাত্রিটি বগুড়ায় চরম উত্তেজনা ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। অতঃপর ২৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনী আবার ব্যাপক গোলাগুলি করতে করতে শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই একেবারে প্রত্যুষে সুবিলের দক্ষিণ দিকে কিছু ছাত্র-তরুণ অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁরা শত্রুসেনাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। পাকিস্তানি বাহিনী শহরের দিকে অগ্রসর হলে তাঁরা বাধা দেন। ফলে শুরু হয় যুদ্ধ।

এদিন পুলিশলাইন হতে ৬০ জন পুলিশ পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁদের কাছেও ৩০৩ রাইফেলের ওপর ভারী কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। তাঁরা সেগুলো নিয়েই যুদ্ধরত ছাত্ৰ জনতার সঙ্গে যোগ দেন। পাকিস্তানি সেনারা এদিন মর্টার হতে ব্যাপক গোলা নিক্ষেপ করে এবং ভারী মেশিনগান দিয়ে ফায়ার করতে করতে বেপরোয়াভাবে অগ্রসর হয়ে এসে কটন মিল দখল করে নেয়।

তবে পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের কারণে তারা শহরের দিকে বেশি দূর অগ্রসর হয়ে আসতে পারেনি। এদিনের যুদ্ধে পুলিশের পাশাপাশি ঝন্টু, মাহমুদ, মাসুদ, গোলাম রসুল, গুলাব, লাল, সুফিয়ানসহ অসংখ্য ছাত্র-যুবক অংশগ্রহণ করেন। এদিন শত্রুবাহিনীর মর্টারের শেলের আঘাতে বিকেল ৩টার দিকে তারেক শহিদ হন। তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। এদিন সারা দিনমান দু’পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়।

আর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে পাকিস্তানি সেনারা পেছনে ফিরে গিয়ে কটন মিলের রেস্ট হাইজ ও তার আশেপাশে রাত্রি যাপন করে। কটন মিলটি ছিল শহরের উত্তর প্রান্তে। এদিনও সারা রাত্রি ধরে তারা ব্যাপক গোলাগুলি করে। ৪৫

২৮ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনারা কটন মিলের রেস্ট হাউজের ছাদে মেশিনগান সেট করে অবস্থান নেয়। কিন্তু মুক্তিকামী পুলিশ-ছাত্র-জনতা থেমে থাকেননি। তাঁরা তাদের ওপর বার বার চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেন। সকালবেলায় দু’জন পাকিস্তানি সেনা রেস্ট হাউজের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছিল। ঠিক সে সময় তপন দেওয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে তাদের ফায়ার করেই লাফ দিয়ে পাশের নর্দমায় গিয়ে পড়েন। সেখান হতে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান।

এতে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এরপর তারা মেশিনগান ও মর্টার হতে ব্যাপক গোলাগুলি আরম্ভ করে। সংগ্রামী ছাত্র-জনতাও পাল্টা ফায়ার করেন। দু’পক্ষের মধ্যে অবিরাম গোলাগুলি চলে। তবে সন্ধ্যার সময় পেছনে সরে গিয়ে তাদের কিছু সেনা কটন মিলের রেস্ট হাউজে গিয়ে অবস্থান নেয়। আর কিছু সেনা সুবিলের ওপারে চলে যায়।

এদিকে এদিন সন্ধ্যায় নওগাঁ হতে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী সুবেদার খোন্দকার মতিউর রহমান (স্বাধীনতা-উত্তর কালে বীরবিক্রম) ও হাবিলদার আলী আকবরসহ কিছু ইপিআর নিয়ে বগুড়া আসেন। তিনি ছিলেন নওগাঁস্থ ইপিআর-এর ৭ উইং-এর ডেপুটি কমান্ডার। সে উইং-এর বাঙালি কমান্ডার নাজমুল হকের নির্দেশ ও পরামর্শক্রমে তাঁরা সকাল ১০টায় নওগাঁ হতে রওয়ানা হয়ে পথে পথে সৃষ্ট বেরিকেড পেরিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় বগুড়া এসে পৌঁছান।

তাঁরা বগুড়ায় যুদ্ধরত পুলিশ ও ছাত্র-যুবকদের কাঁধে কাঁধ রেখে বগুড়ায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাঁদের আগমনে বগুড়ায় যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অনেকখানি পাল্টে যায়। পাকিস্তানি সেনারা অতঃপর রাত্রির অন্ধকারে কটন মিলের রেস্ট হাউজ ছেড়ে সুবিলের ওপারে (উত্তর পার) চলে যায়। এরপর তারা আর কখনো শহরের দিকে । অগ্রসর হয়ে আসার চেষ্টা বা সাহস করেনি। তার পরের দিন (৩০ মার্চ) বগুড়ার অবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। সারাদিন দু’পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা চরম চাপের মধ্যে পড়ে।

ওদিকে আবার ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লে. রফিক তাঁর বাহিনী নিয়ে রাস্তা ব্লক করে পলাশবাড়িতে অবস্থান নেন। ফলে বগুড়ায় যুদ্ধরত বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য রংপুর হতে নতুন করে কোনো সৈন্য প্রেরণ করা সম্ভব হয়নি। হাবিলদার আলী আকবর তাঁর ইপিআর জোয়ানদের নিয়ে ৩০ মার্চ হতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেন। এদিন পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করার জন্য ঢাকা হতে বোমারু বিমান উড়ে আসে। তারপরও তারা তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি।

এদিন আবার নওগাঁ হতে সুবেদার খোন্দকার মতিউর রহমান আরো এক প্লাটুন ইপিআর নিয়ে বগুড়া আসেন। মেজর নাজমুল হকও বগুড়া আসেন এদিন। ৪৭ সার্বিক অবস্থার পরিপেক্ষিতে পাকিস্তানি সেনারা বগুড়ায় একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় তার পরের দিন ৩১ মার্চ রংপুরস্থ ২৬ এফ এফ রেজিমেন্টের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ খান মালিক লে. কর্নেল হাকিম আরশাদ কোরেশীকে বাড়তি ফোর্স দিয়ে বগুড়া প্রেরণ করেন। কিন্তু তারা পলাশবাড়ি এসে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।

হাকিম আরশাদ কোরেশী সেখান থেকে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লে. রফিককে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। ৪৮ কিন্তু শেষাবধি কোরেশী তার বাহিনী নিয়ে বগুড়ায় আসতে পারেনি। অবশেষে এদিন দিবাগত রাত্রি ৪টার দিকে বগুড়াস্থ (তখন ১ এপ্রিল) পাকিস্তানি সেনারা নিকটবর্তী পেট্রল ডাম্পে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গাড়ির বহর নিয়ে রংপুর পালিয়ে যায়। ১৯

সেদিন সকালবেলায় বগুড়াবাসী দেখল, পাকিস্তানি সেনারা নেই। রংপুরে পালিয়ে গেছে। এরপর তাদের আনন্দ যেন আর ধরে না। শহরবাসী আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। অল্পক্ষণের মধ্যেই শহরে আনন্দ মিছিল বের হয়।

এরপরও অবশ্য বগুড়ার আড়িয়ার বাজারে অবস্থিত অ্যামুনেশন ডাম্পটি পাহারার একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ২২-২৫ জন শত্রুসেনা ছিল। হাবিলদার আলী আকবরের নেতৃত্বে ৩৯ জন ইপিআর, ৫০ জন পুলিশ ও ২০/৩০ ছাত্র-জনতা সেদিনই তাদের আক্রমণ করে। সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলার পর শেষপর্যন্ত শত্রুবাহিনী আত্মত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে সেদিনই বগুড়া প্রাথমিকভাবে পুরোপুরি হানাদারমুক্ত হয়। ৫০

এরপর বগুড়াকে হানাদারমুক্ত রাখার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বগুড়াকে শত্রুমুক্ত রাখা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানি সেনারা ২২ এপ্রিল বগুড়া পুনর্দখল করে নেয়।

 

প্রতিরোধযুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ

মার্চের প্রথম হতেই দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ডামাডোলের সৃষ্টি হয়। রাজনীতির এ গতিপ্রকৃতি বিবেচনা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ গোপনে ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি জোয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে উদ্বুদ্ধ করে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করেন। প্রয়োজনবোধে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে রিভোল্ট করে বাঙালিদের পক্ষাবলম্বন করার জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলা হয়। আর এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন গোলাম নবী সাঁটু।

২৬ মার্চ রাত্রে আকাশবাণী, বিবিসি ও অন্যান্য বিদেশি রেডিও-র সংবাদে ঢাকায় ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞের বিস্তারিত খবর পাওয়া যায়। এ অবস্থায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ ইপিআর ক্যাম্পের বাঙালি সদস্যবৃন্দ এবং থানার ওসিসহ পুলিশের অন্যান্য সদস্যের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়। ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যরা যে কোনো সময় রিভোল্ট করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। আনসার ও মুজাহিদদেরও একত্রিত করে পূর্ণ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়, যাতে তাঁরা যথাসময়ে ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি সদস্যদের সাহায্যার্থে অগ্রসর হতে পারেন।

ওদিকে ইপিআর ক্যাম্পে এদিন বেশ উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। ইপিআর এর বাঙালি ও পশ্চিমা সদস্যদের মধ্যে ইতোমধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়। একপক্ষ অপরপক্ষের চলাফেরা, গতিবিধি ও কর্মতৎপরতার ওপর সংগোপনে সর্বদা নজর রাখতে থাকে। কোন পক্ষ হঠাৎ কার ওপর আক্রমণ করে বসে এ আশঙ্কায় উভয় পক্ষই আতঙ্কিত ও সদা সতর্কাবস্থায় থাকে। ইপিআর ক্যাম্পে এ ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার কারণও অবশ্য ছিল।

আগের দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ বিকেলে ইপিআর সেক্টর হেড কোয়ার্টার, রাজশাহী হতে একজন সিকিউরিটিসহ ১৫/১৬ জন ইপিআর-এর একটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসে। এ দলের সকলেই ছিল অবাঙালি।৫১ দেশের বিরাজমান এই নাজুক পরিস্থিতিতে একসঙ্গে এতজন অবাঙালি ইপিআর চাঁপাইনবাবগঞ্জে মোতায়েন করায় স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পের বাঙালি সদস্যদের মনে তাদের মতলব সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।

আবার সেদিনই রাজশাহীতে ২৫ পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন অবস্থান গ্রহণ করে। এ ব্যাটেলিয়নের সাময়িকভাবে দায়িত্বে ছিলেন অবাঙালি তথা পশ্চিম পাকিস্তানি মেজর আসলাম খান। তবে লে. কর্নেল শাফায়াত বেলুচ পবিত্র হজ পালন করে এসে সেদিন সন্ধ্যাতেই এ ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁকে একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে করে রাজশাহীতে পৌঁছে দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। এ সময় রাজশাহীতে সেক্টর কমান্ডার, অ্যাডজুট্যান্ট, সুবেদার মেজর সকলেই ছিল অবাঙালি তথা পশ্চিম পাকিস্তানি।

এসব ঘটনায় বাঙালি ইপিআররা পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য ও মতলব সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েন। তা ছাড়া ২৫ মার্চের দুই দিন আগেই অর্থাৎ ২৩ মার্চে দিবাগত রাত্রে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ইপিআর প্লাটুন হেড কোয়ার্টারসে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে একটি রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়ে গিয়েছিল; এ সংঘর্ষে কয়েকজন হতাহত হয়। সর্বোপরি ২৬ মার্চ সকাল হতেই ক্যাম্পের পশ্চিমাদের গতিবিধি, আচরণ ও কর্মতৎপরতা ছিল অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক।

এদিকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে এখানকার বাঙালি সদস্যরা চট্টগ্রামসহ ইপিআর-এর বিভিন্ন সূত্র হতে জানতে পারেন যে, ঢাকায় ইপিআর সদর দপ্তরে পশ্চিমারা বাঙালিদের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে এবং বাঙালিদের হত্যা করা হচ্ছে।” স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল যে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্যাম্পের বাঙালি জোয়ানদেরও খতম করার পাঁয়তারা চলছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে সে সময় ইপিআর-এর ৬ নং উইং ছিল। এ উইং-এর উইং কমান্ডার, সহকারী উইং কমান্ডার সুবেদার মেজরসহ সকল অফিসার ছিল অবাঙালি তথা পশ্চিম পাকিস্তানি। শুধু কয়েকজন বাঙালি এনসিও ও জেসিও ছিল। পশ্চিমা অফিসাররা ২৫ মার্চ হতেই কৌশলে বাঙালিদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার জন্য ফন্দি-ফিকির করতে থাকে। কিন্তু বাঙালিরা তাদের উদ্দেশ্য বা মতলব বুঝতে পেরে সতর্ক হন। পশ্চিমা কর্মকর্তারা ২৬ তারিখে ক্যাম্পের বাঙালিদের নিরস্ত্র অবস্থায় ৩/৪ বার ফল-ইন করায়।

এভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় ফল-ইন করানোর উদ্দেশ্য বা মতলব বাঙালিরা আঁচ করতে পারেন। তাই অধিকাংশ বাঙালি জোয়ান ফল ইনে অংশ না নিয়ে বাইরে গণ্ডগোল হচ্ছে এ অজুহাত দেখিয়ে বাইরে বাইরে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে এভাবে ফল ইন করানোর নামে বাঙালিদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পশ্চিমারা তাদের নিরস্ত্র করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাঙালিরা তা টের পেয়ে কৌশল অবলম্বন করে ফল-ইনে অস্বীকৃতি জানান।

এ সময় পশ্চিমা কর্মকর্তারা স্পষ্টতই বুঝতে পারেন যে, বাঙালি জোয়ানরা ইচ্ছাকৃতভাবে ফল-ইন করছে না। তারা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। তাই তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।

উইং কমান্ডার বাঙালিদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, কেউ বাইরে জনগণের সঙ্গে মেলামেশা বা যোগাযোগ করলে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। আর সুবেদার মেজর বলেন, কেউ বাইরে জনগণের সঙ্গে মেলামেশা করলে তাকে প্রয়োজনে ট্যাংক দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হবে। কিন্তু বাঙালিরা তাদের এসব কথায় কর্ণপাত করেনি। এভাবেই উত্তেজনায়, আতঙ্কে ও অস্থিরতায় ২৬ মার্চ দিনটি কেটে যায়।

২৭ মার্চ। ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে বিরোধ এদিন সকাল হতে প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করে। উভয় পক্ষই যে কোনো অনাহুত বা অবাঞ্চিত অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য সদাসতর্ক ও প্রস্তুত হয়ে থাকে। তবে এ সময় পশ্চিমা কর্মকর্তারা বেশ চাপের মধ্যে থাকে। একে তো তাদের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে কম, তদুপরি স্থানীয় জনমত ও জনসমর্থন ছিল তাদের বিপক্ষে। সর্বোপরি সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা ছিল তাদের প্রতিকূলে। তারা ছিল ভিনদেশি।

পক্ষান্তরে বাঙালি অফিসারের সংখ্যা নগণ্য হলেও সামগ্রিকভাবে সংখ্যাধিক্য ছিল বাঙালিদেরই। স্থানীয় জনসমর্থন ও জনমতও ছিল তাদের পক্ষে। সর্বোপরি স্থানীয় রাজনৈতিক সমর্থন ও আশীর্বাদ ছিল তাদের অনুকূলে। তদুপরি বাঙালিদের সহায়তাকল্পে এগিয়ে আসার জন্য স্থানীয় পুলিশ, মুজাহিদ ও আনসার বাহিনী সদা সতর্কাবস্থায় প্রস্তুত হয়েছিল। প্রয়োজনের মুহূর্তে তারা বাঙালিদের সহায়তায় দ্রুত ছুটে আসবে।

তার চেয়েও বড় কথা, বাঙালিরা লড়াই করছে জাতির মুক্তির জন্য দেশের স্বাধীনতার জন্য। তারা প্রবল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত। তাই তারা যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে আন্তরিকভাবে প্রস্তুত।

এ দিন চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ইপিআর ক্যাম্পে সময় অতিবাহিত হতে থাকে। আর ক্যাম্পের বাইরে রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতাকর্মীবৃন্দ, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোকজন চরম উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কা নিয়ে প্রহর গুনতে থাকেন। এর মধ্যে বাঙালিরা জানতে পারে যে, পশ্চিমা কর্মকর্তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৪০ জন রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতাকর্মীর নামের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের ধরার পরিকল্পনা করছে।

বাঙালি ইপিআর হাবিলদার সাইফুল ইসলাম (গেদু) সেই তালিকার একটি কপি কোনো রকমে সংগ্রহ করে তা নিয়ে সকাল ১০টার দিকে মনিম উদ দৌলা চৌধুরীর নিকট আসেন। তিনি সেটি তার হাতে দিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে তখনই অবহিত করার জন্য অনুরোধ করে দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে যান। সে অনুযায়ী মনিম উদ দৌলা চৌধুরী সংশ্লিষ্ট সকলকে তা দ্রুত জানানোর ব্যবস্থা করেন। ফলে সবাই সাবধান হয়ে যায়। তার ফলে তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা আর পশ্চিমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে সে-সময় মহকুমা প্রশাসক ছিলেন ইমতিয়াজ মাশরুর। তিনি ছিলেন অবাঙালি। তিনি সম্ভবত নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন। তাই ২৬ মার্চেই ইপিআর ক্যাম্পে গিয়ে অবস্থান নেন। কিন্তু সেখানেও তিনিসহ অন্য পশ্চিমা কর্মকর্তারা দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে নিরাপদ বোধ করছিলেন না। তাঁরা সেখানেও আশঙ্কা ও আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। তার ফলে তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

সে কারণেই তাঁরা বাঙালি জোয়ানদের নিরস্ত্র করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তাও করা সম্ভবপর হয়নি। এমতাবস্থায় বিকেল ৫টায় প্রশাসনের পক্ষ হতে ইপিআর ভ্যানযোগে মাইকে সন্ধ্যা ৬টা হতে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করা হয়। কারফিউ-র ঘোষণায় বলা হয়, সন্ধ্যা ৬টা হতে সকাল ৬টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করা হল। লোকজন রাস্তায় দেখামাত্র গুলি করা হবে।

প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা কর্মকর্তারা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই সান্ধ্য আইন জারি করেছিল বলে ধারণা করা হয়। মাইকে সান্ধ্য আইন জারির ঘোষণা শুনে শহরবাসী হতভম্ব হয়ে পড়ে। কেননা ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হলেও ক্যাম্পের বাইরে শহরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করলেও তা শান্তই ছিল।

এদিন সন্ধ্যার পর ইপিআর সেক্টর হেড কোয়ার্টার, রাজশাহী হতে একটি বার্তা আসে। সে বার্তায় সমস্ত বাঙালি জোয়ানদের হত্যা করে পশ্চিমা সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের পরিবার-পরিজনসহ রাজশাহী চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু একজন বাঙালি অপারেটর বার্তাটি জানতে পেরে অতি দ্রুত তা বাঙালি জোয়ানদের জানিয়ে দেন। তারপরও বাঙালি ইপিআররা পশ্চিমাদের আগে আক্রমণ করেননি। তার কারণ, তাঁরা চাচ্ছিলেন, পশ্চিমারা আগে আক্রমণ করুক।

পশ্চিমারা আক্রমণ করলে তাঁরা তার সমুচিত জবাব দেবেন। প্রকৃতপক্ষে হয়েছিলও তাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেকেই মনে করেন, অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার জন্য অবাঙালিরা বাঙালি জোয়ানদের আক্রমণ করার সাথে সাথেই দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেভাবে সংঘর্ষ শুরু হয়নি। সে-সময় উভয় পক্ষই টান টান উত্তেজনায় স্নায়বিক চাপে ভুগছিল।

রাজশাহী হতে প্রাপ্ত বার্তা মোতাবেক পশ্চিমা এসডিও, উইং কমান্ডার (মেজর) ও সহকারী উইং কমান্ডার (ক্যাপ্টেন) রাজশাহী পালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ ৩টি গাড়িতে উঠে পালানোর আয়োজন করছিলেন। সে-সব গাড়িতে আগেই অস্ত্রপাতি ও রক্ষী মোতায়েন করা হয়েছিল। আর সে সময় পশ্চিমা কমান্ডারের সঙ্গে কোয়ার্টার গার্ডের বাঙালি সেন্ট্রি শুকুর আলির তর্ক-বিতর্ক ও বাক-বিতণ্ডা বেধে যায়।

সে বাকবিতণ্ডার মধ্যে শুকুর আলির রাইফেলটি পড়ে যায়। ফলে শব্দ হয়। অত্যধিক উত্তেজনা ও প্রচণ্ড স্নায়বিক চাপের কারণে রাইফেল পড়ার শব্দে পশ্চিমা অফিসাররা ভীত হয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার করার অর্ডার দিয়ে নিজেরা ফায়ার করতে করতে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। পশ্চিমারা ফায়ার শুরু করলে বাঙালিরাও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর এভাবেই শুরু হয় যুদ্ধ।

তার মধ্যেই পশ্চিমা অফিসাররা গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। দু’পক্ষের মধ্যে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে গুলি বিনিময় হয়। আর এদিকে গুলির শব্দ শোনামাত্র থানা হতে পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ সদস্যরা দ্রুত বাঙালিদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। তাঁরা ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালিদের সহায়তা করার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

প্রায় দু’ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর রাত্রি ১০টার দিকে ইপিআর ক্যাম্প বাঙালিদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। তাদের কিছু সেনা নিহত হয়। অবশিষ্টদের আটক করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি জেসিও-কেও বন্দি করা হয়। আটককৃতদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলে প্রেরণ করা হয়। এ যুদ্ধে কয়েকজন বাঙালি ইপিআর শহিদ হন। তবে হাবিলদার মোহাম্মদ ফসিউদ্দীন বলেছেন, মাত্র একজন বাঙালি সামান্য আহত হয়। ১

ক্যাম্প দখলের পর বাঙালি জোয়ানরা ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দিতে আরম্ভ করে। এসব স্লোগান শোনামাত্র শত শত ছাত্র-যুবক ও কৃষক-শ্রমিক বাঁশের লাঠি, লোহার রড, হকিস্টিক, দা, ছুরি, হাসুয়া, কাস্তে, বল্লম প্রভৃতি স্থানীয় অস্ত্রপাতি নিয়ে ইপিআর ক্যাম্প, কল্যাণপুরে ছুটে যান। কিন্তু ক্যাম্পে গিয়ে তাঁরা দেখেন, ক্যাম্প সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত, হানাদারমুক্ত।

ক্যাম্পে এরই মধ্যে শুরু হয় বিজয় উৎসব। আনন্দ ও উল্লাস। আপামর জনতাও সে আনন্দে উল্লাসে অংশ নেয়। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে স্লোগানে কল্যাণপুরের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ মিলেমিশে উল্লাস করতে করতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের দিকে অগ্রসর হয়। এরই মধ্যে ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালিদের বিজয়ের কথা শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর শহরেও শুরু হয় বিজয় উৎসব।

২৮ মার্চ, ১৯৭১। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হানাদারমুক্ত, স্বাধীন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সর্বত্রই তখন বাংলাদেশের নতুন পতাকা পতপত করে উড়ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর এ আনন্দঘন মুহূর্তে সকালে নবাবগঞ্জ কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. মনিমুল হকের বাসায় স্থানীয় রাজনৈতিক ও ছাত্র-নেতাকর্মীবৃন্দ এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন।

এতে অ্যাড. রৈইশ উদ্দিন, ডা. আ আ ম মেসবাহুল হক (বাচ্চু), মো. সিরাজুল হক (শনি মিয়া), অ্যাড. ওসমান গনি (মন্টু), ম্যাজিস্ট্রেট আলতাফ হোসেন, অ্যাড. গোলাম আরিফ টিপু, মো. মৈনুদ্দিন মণ্ডল (ছাত্রনেতা), মহাম্মদ আলী কামাল (ছাত্রনেতা), মনিম উদ দৌলা চৌধুরী (ছাত্র) প্রমুখ নেতাকর্মী উপস্থিত হন।

এ সময় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দও উপলব্ধি করেন যে, এ মুহূর্তে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সকলের ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রয়াস ও সমন্বিত কর্মতৎপরতা। এ উপলব্ধিবোধ হতেই নিম্নোক্ত নেতাকর্মীদের নিয়ে

চাঁপাইনবাবগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১. অ্যাড. রৈইশ উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় পরিষদ সদস্য

২. খালেদ আলি মিয়া, জাতীয় পরিষদ সদস্য ৩. ডা. আ আ ম মেসবাহুল হক (বাচ্চু), প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য

৪. ডা. মইন উদ্দীন আহমেদ (মন্টু), প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য

৫. অ্যাড. আব্দুল হামিদ হেনা, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য

৬. ডা. মো. বশিরুল হক, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ৭. অ্যাড. গোলাম আরিফ টিপু, ন্যাপ (মোজাফফর)

৮. অ্যাড. ওসমান গনি, রাজনীতিক ৯. অ্যাড. আহম্মদুল্লাহ্ চৌধুরী, ন্যাপ (ভাসানী)

১০. মৈনুদ্দীন মণ্ডল, ছাত্রনেতা

সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হতে সেদিন মো. সিরাজুল ইসলামকে (শনি মিয়া) প্রশাসন পরিচালনার জন্য বেসামরিক প্রশাসকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সে সময় বিশাল প্রতিরোধ বাহিনীর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য ত্রাণ কার্যক্রম ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ত্রাণ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রমের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় নবাবগঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মো. এনামুল হককে। সে-সময় যাবতীয় কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ অফিস। তবে কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালন কার্যালয় নবাবগঞ্জ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ১২

সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দ দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিজয়ী বাহিনীকে রাজশাহী প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তার কারণ রাজশাহী তখনো শত্রুকবলিত ছিল। রাজশাহীকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও উৎসাহী ছাত্রদের একত্রিত করে প্রতিরোধ বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া আরম্ভ করা হয়। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন বিওপি হতে বাঙালি ইপিআরদের নিয়ে আসা হয়।

রাজশাহী হতে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণ প্রচেষ্টা প্রতিহত করার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী সড়কে ইতিপূর্বে সৃষ্ট বেরিকেডসমূহ আরো মজবুত করা হয়। জনতা সারা রাত জেগে তা পাহারা দেয় যাতে সেগুলো অপসারণ করে শত্রুবাহিনী রাজশাহী হতে আসতে না পারে।

সেদিন থেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে সামরিক প্রশিক্ষণ আরম্ভ হয়। প্রশিক্ষণের স্থান নির্বাচন করা হয় স্টেডিয়াম। থানা হতে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা হয়। একজন ইপিআর ও একজন পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শত শত ছাত্র, যুবক ও তরুণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। শিবগঞ্জ, রহনপুর, নাচোল, ভোলাহাট, আমনুরা রানিহাটি, আদিনা প্রভৃতি স্থানেও সামরিক প্রশিক্ষণের মহড়া ও কুচকাওয়াজ আরম্ভ হয়। ১৩

২৯ মার্চ। সেদিন মহাম্মদ আলী কামাল ও আলাউদ্দীনকে রাজশাহী প্রেরণ করা হয় সেখানকার অবস্থা জানার জন্য। তাঁরা মটর সাইকেলযোগে রওনা হয়ে বেলা ১১টায় রাজশাহী পৌঁছে দেখেন, রাজশাহীতে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছে। সেখানে সংকটজনক সময় অতিবাহিত হচ্ছে। ২৭ মার্চের পুলিশলাইনের রক্তাক্ত ঘটনাবলির পর রাজশাহী একটি ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় তাঁরা রাজশাহীতে কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাসায় উল্লেখযোগ্য কাউকে পাননি।

সকলেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। এরপর তাঁরা রাজশাহীতে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সেখানকার প্রকৃত অবস্থা অবহিত হওয়ার চেষ্টা করেন এবং সেই সঙ্গে তাঁদেরকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সর্বশেষ অবস্থা অবহিত করেন। তাঁরা তাদেরকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ইপিআর ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর গৌরবজনক বিজয়ের কথা জানান।

আর এটাও জানান যে, রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি বিশাল বাহিনী আগামী দু’এক দিনের মধ্যেই রাজশাহী এসে পৌছুচ্ছে। এসব খবরাখবর আদান-প্রদান করে তাঁরা সেদিন বিকেল ৪টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফিরে আসেন। অতঃপর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নেতৃবৃন্দকে রাজশাহীর অবস্থা অবহিত করেন। ৪

রাজশাহীর খবরাখবর অবহিত হয়ে নেতৃবৃন্দ পরদিনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাহিনীকে রাজশাহী প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। সে মোতাবেক ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও উৎসাহী ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে একটি বিশাল বাহিনী গঠন করা হয়। ৫০০/৬০০ জন সশস্ত্র ব্যক্তি এবং ৩৫০/৪০০ জন বেসামরিক ব্যক্তির সমন্বয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়।

এ বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হয় সুবেদার আবুল কাশেমকে (ইপিআর)। মুজাহিদ সদস্য কুতুব ও নুরুল এবং ছাত্রনেতা মহাম্মদ আলী কামাল ও লোকমান হোসেন মানিক এ বাহিনী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে গঠিত বাহিনী পরদিন ৩০ মার্চ রাজশাহীর পথে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণ বাধাগ্রস্ত করার জন্য পথে পথে সৃষ্ট অসংখ্য মজবুত বেরিকেড অতিক্রম করে সেদিন তাঁরা মহিষালবাড়ী পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে সক্ষম হন। পরদিন ৩১ মার্চ মহিশালবাড়ী হতে অগ্রসর হয়ে কাশিয়াডাঙ্গায় গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে।

আর এদিকে ৭ নং উইং কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের নির্দেশে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী সেদিনই এক কম্পানি ইপিআর নিয়ে নওগাঁ হতে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে আসেন। মেজর নাজমুল হক ক্যাপ্টেন গিয়াসকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিক হতে এবং ক্যাপ্টেন রশিদকে সারদাহ-র দিক হতে রাজশাহী আক্রমণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ক্যাপ্টেন গিয়াস রাস্তায় অসংখ্য বেরিকেড অতিক্রম করে তাঁর বাহিনী নিয়ে বিকেলে নওহাটায় এসে উপনীত হন। তাঁর ফোর্সের প্রায় অর্ধেক সেখানে রেখে অবশিষ্ট ফোর্স নিয়ে তিনি রাজশাহী হতে ৭/৮ কিলোমিটার পশ্চিমে খরচক্কা নামক স্থানে এসে অবস্থান নেন। সেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাহিনীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তার আগেই অবশ্য তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাহিনীর সঙ্গে ওয়ারলেসে যোগাযোগ করেছিলেন। সেখানে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাহিনীরও নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অতঃপর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাহিনী ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের কমান্ডে রাজশাহীর প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

 

প্রতিরোধযুদ্ধে জয়পুরহাট

দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ জয়পুরহাটবাসীকেও আন্দোলিত করে। তাঁরাও অসহযোগ আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। ১৭/১৮ মার্চে জয়পুরহাটে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এখানে সংগ্রাম পরিষদ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন মাহতাব উদ্দীন মণ্ডল, ড. মফিজ উদ্দীন চৌধুরী ও কাবের উদ্দীনসহ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। সংগ্রাম পরিষদের অফিস করা হয় রামদেও কজলার গদিঘরে।

এখন যেখানে সৌরভ আবাসিক হোটেল হয়েছে, তার সামনে সেই গদিঘরটি ছিল। সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জয়পুরহাট কলেজমাঠে সামরিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। সেখানে উৎসাহী ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সে সময় জয়পুরহাটের বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকা জুড়ে ইপিআর-এর কতকগুলো বিওপি ছিল। সেগুলি এখনো আছে। ২৫ মার্চের পরে সেইসব বিওপি-র ইপিআরদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করা হয়।

তবে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ পর্বে উল্লেখ করার মতো কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। আমরা ইতঃপূর্বেই আলোচনা করেছি যে, ২৬-৩১ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বগুড়ার ছাত্র-জনতা পুলিশের তুমুল যুদ্ধ হয়। সেখানে যুদ্ধরত ছাত্র-পুলিশ-জনতাকে সহায়তা করার জন্য জয়পুরহাটের প্রতিরোধ বাহিনী বগুড়া যেতে পারতো। সে যুদ্ধে অংশ নিতে পারতো। কিন্তু তারা যায়নি। এমনকী জয়পুরহাটের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা প্রতিরোধ বাহিনী সে রকম কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি।

অবশ্য সে সময় বগুড়ার সাথে জয়পুরহাটের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো ছিল না। আবার ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বিনা বাধায় জয়পুরহাট দখল করে নিল। সেদিনও তাদের প্রতিরোধ করার ন্যূনতম চেষ্টা করা হয়নি। আসলে পাকিস্তানি বাহিনী জয়পুরহাট দখল করতে আসার আগেই রাজশাহীর পতন হয়। আর রাজশাহীর পতন হওয়ার পরই জয়পুরহাটের প্রতিরোধযোদ্ধারা সব ছত্রভঙ্গ হয়ে ভারতে পালিয়ে যায় অথবা দেশের মধ্যেই আত্মগোপন করে।

২৫ মার্চের পর প্রায় মাসখানেক জয়পুরহাট মূলত শান্তই ছিল। সে সময় সেখানে তেমন কোনো অঘটন ঘটেনি। তার কারণ জয়পুরহাটে সে সময় শত্রুবাহিনীর কোনো স্থাপনা বা উপস্থিতি ছিল না। তবে জয়পুরহাট রেল স্টেশনের পূর্ব দিকে অবাঙালিদের তথা বিহারিদের একটি পাড়া ছিল। এটি বিহারিপাড়া নামে পরিচিত ছিল। পাড়াটি এখনো আছে। সেখানেও বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটেনি। অথচ ২৫ মার্চের পরে বা তারও আগে দেশের অনেক স্থানে বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে সংঘর্ষ আরম্ভ হয়েছিল। কোনো

কোনো এলাকায় ব্যাপক রক্তপাতও হয়েছিল। এমনকী এই উত্তরবঙ্গেরই সৈয়দপুর, সান্তাহার, পাকশী প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ ও রক্তপাত হয়েছিল। তবে জয়পুরহাট ছিল তার ব্যতিক্রম। সেখানে বাঙালি-বিহারিদের মধ্যে সম্পর্কের তেমন অবনতি ঘটেনি। অবশ্য তার একটি কারণও ছিল। সে সময় কিছু বিহারি ছাত্র জয়পুরহাট কলেজে পড়াশোনা করতেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

এমনকী জয়পুরহাট কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপিও ছিলেন একজন বিহারি ছাত্র এবং তিনি ছাত্রলীগ করতেন। সম্ভবত সে কারণেই বাঙালি-বিহারিদের মধ্যে সেখানে কোনো বড় ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়নি। তবে সেখানে যে বাঙালি-বিহারিদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে ছোটখাটো কোনো অঘটনই ঘটেনি, তাও নয়। সেখানেও বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি বিহারি পরিবার নির্যাতনের শিকার হয় এবং দু’জন বিহারি নিহতও হন। তবে তা ছিল একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সার্বিকভাবে সেখানে বাঙালি-বিহারিদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। এমতাবস্থায় ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত জয়পুরহাট হানাদারমুক্ত ছিল।

 

তথ্যনির্দেশ :

সিদ্দিক সালিক, Witness to Surrender ( নিয়াজীর আত্মসমপর্ণের দলিল: ভাষান্তরে মাসুদুল

হক), পৃ. ৮৫-৮৬ ২. হাসান মিল্লাত (সম্পাদনা), নবতন, মে দিবস সংখ্যা, ২০০৯, মেট্রোপলিটান প্রেস ক্লাব, রাজশাহী, • পৃ. ১৪।

8.

সাক্ষাৎকার: ক. বদিউজ্জামান টুনু, বীরপ্রতীক, রাজশাহী ও খ, মাহতাব উদ্দিন, চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী গবেষণা কেন্দ্র, রাজশাহী মনসুর আহমেদ খান (সম্পাদনা), মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪,

পৃ. ৩২ ও ৫৯

দৈনিক সোনালী সংবাদ (রাজশাহী), ১০ মার্চ, ২০১৪

হাসান মিল্লাত (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ১১-১৪

9. এ এস এম সামছুল আরেফিন, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা (১ম খণ্ড), পুলিশ হেড কোয়ার্টারস,

ঢাকা; ২০১২, পৃ. ৫০ b মনসুর আহমেদ খান (সম্পাদনা), মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা: ১৯৯৪, পৃ. ২১:

এস এম সামছুল আরেফিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০

১০. সাক্ষাৎকার: ক. মাহতাব উদ্দিন, প্রাগুক্ত ও খ, ডা. আ. মান্নান, তালাইমারী, রাজশাহী। ১১. সোনার দেশ, রাজশাহী, তারিখ: ২৭ মার্চ, ২০১১ ১২. বড়ভাই (সম্পাদনা), স্মরণিকা, রাজশাহী বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি সমাবেশ-২০০৩,

রাজশাহী: ১৫ অক্টোবর, ২০০৩, পৃ. ১৯-২০

১৩. ড. শাহীন জোহরা/মো. শামসের আলী (সুমন), স্মৃতি: ৭১, রাজশাহী; ডিসেম্বর, ২০০৯, পৃ. ৩৮ ১৪. মনসুর আহমদ খান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪

১৫. সাক্ষাৎকার: ক. মাহতাব উদ্দিন, খ. ডা. আ. মান্নান ও গ. বদিউজ্জামান টুনু, প্রাগুক্ত ১৬. ক. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৭; খ. সাক্ষাৎকার: ক. আবু বাক্কার সিদ্দিক, কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চারঘাট থানা কমাও ও খ. মো. ইয়াসীন আলি, ডেপুটি কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চারঘাট থানা কমান্ড, রাজশাহী কমিশনার (অব.), রাজশাহী: পৃ. ৬৪৩

১৭. ক. মুহ. মনতাজুর রহমান, বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস, অতিরিক্ত খ. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৭

বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস চতুর্থ খণ্ড (চতুর্থ পর্ব)

১৮. ক. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৯ খ. মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা; ১৯৯৩, পৃ. ১১৬

১৯. সাক্ষাৎকার: ক. মহাম্মদ আলী কামাল, মুক্তিযোদ্ধা, মহারাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ খ. অ্যাড

রুপেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী (ভুতু), চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গ. মনিম উদ দৌলা চৌধুরী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২০. এ এস এম সামছুল আরেফিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫

২১. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৮ ২২. সাক্ষাৎকার: ক. বদিউজ্জামান টুনু, প্রাগুক্ত, খ. মাহতাব উদ্দিন, প্রাগুক্ত ও গ. শফিকুর রহমান

রাজা, মুক্তিযোদ্ধা, শেখেরচক, রাজশাহী ২৩. সাক্ষাৎকার: ক. মো. আলতাফ হোসেন, প্রধান শিক্ষক (মাধ্যমিক), কাশিয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, খ,

ডা. আ. মান্নান, গ. শফিকুর রহমান রাজা ও ঘ. মাহতাব উদ্দীন, প্রাগুক্ত ২৪. সাক্ষাৎকার: ক. আশরাফ আলী দেওয়ান, অধ্যক্ষ, নওহাটা ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী ও খ. মো. কামরুজ্জামান, কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, পবা থানা কমান্ড, রাজশাহী।

২৫. মনসুর আহমদ খান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮

২৬. মনসুর আহমেদ খান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯ ২৭. ক. ওহিদুর রহমান, মুক্তি সংগ্রামে আত্রাই, সংহতি প্রকাশন, ঢাকা: ২০১২, পৃ. ৪৪

খ. সুকুমার বিশ্বাস (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪-৬৫

গ. সাক্ষাৎকার: মোল্লা আবু নাসের আহমেদ, অধ্যক্ষ, বলিহার ডিগ্রি কলেজ, নওগাঁ ২৮. মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রতিরোধের প্রথম প্রহর, ইউনিভার্সিটি প্রেস লি., ঢাকা; ১৯৯১, পৃ. ১০৩: ক. ওহিদুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪; খ. সুকুমার বিশ্বাস (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, ৬৬-৬৭; গ, সাক্ষাৎকার: ক. মো. গোলাম সামদানি, কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নওগাঁসদর থানা ও খ. মো. আবুল হোসেন, কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নওগাঁ জেলা কমান্ড ২৯. ক. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৪-৪৫৬, ৪৬৭-৪৬৮; খ. সুকুমার বিশ্বাস

(সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯; গ. মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪-১০৫

৩০. ক. হাসান হাফিজুর হমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৫-৪৫৭, ৪৬৮: খ. সুকুমার বিশ্বাস

(সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৭০-৭২

৩১. ক. খানসাহেব মোহাম্মদ আফজল, নওগা মহকুমার ইতিহাস, চট্টগ্রাম: ১৯৭৪, পৃ. ১৭৫: খ. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৭ ও ৪৬৮; ক. হাসান হাফিজুর রহামন (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮০; খ. সাক্ষাৎকার: ক. অ্যাড. আবুল হোসেন (মুক্তিযোদ্ধা), পিতা: মো. আব্বাস আলি, ফুলবাড়ি, বগুড়া, খ. গোলাম রসুল (মুক্তিযোদ্ধা), পিতাঃ মো. শাহাদৎ জামান, রিয়াজ কাজী লেন, সূত্রাপুর, বগুড়া ও গ. আলমগীর হোসেন (সাক্ষাৎকার), পিতাঃ বরকতউল্লাহ্, কাটনাপাড়া, বগুড়া

৩২. ক. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭৫-৪৮১ খ. গাজীউল হক, আমার দেখা আমার লেখা, জোনাকী প্রকাশনী, ঢাকা;

২০০৯, পৃ. ৯৪-৯৫ গ. সেলিনা শিউলী, বগুড়া জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গতিধারা, ঢাকা: ২০০৯, পৃ. ১৯-২০ ৩৩. ক. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত,

পৃ. ৪৭৫-৪৮৩

খ. সাক্ষাৎকার: ক. মো. সাইদুর রহমান পিতা মো. সামাদুর রহমান, বাদুরতলা, বগুড়া।

৩৪. ক. গাজীউল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৪-৯৫ খ. সাক্ষাৎকার: আমিনুল ইসলাম পিন্টু, কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বগুড়া জেলা কমান্ড।

৩৫. ক. গাজীউল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৬

খ. সেলিনা শিউলী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০-২২, ১০৯

গ. সাক্ষাৎকার: ক. আলমগীর হোসেন, খ. গোলাম রসুল ওগ, অ্যাড. আবুল ৩৬. সাক্ষাৎকার: আমিনুল ইসলাম পিন্টু, প্রাগুক্ত

৩৭. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮৫

হোসেন, প্রাগুক্ত।

রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধ

১১৭

৩৮. হাসান হাফিজুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮৫ ৩৯. হামিদুল হোসেন তারেক বীরবিক্রম, রোড টু বগুড়া: ১৯৭১, ঢাকা: ২০০৯, পৃ. ৯৮

৪০. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৮, ৪৮৮ ৪১. ক. ড. মাহবুবর রহমান, একাত্তরে গাইবান্ধা, বাংলাদেশ চর্চা, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ৬৬,

খ. হামিদুল হোসেন তারেক, বীরবিক্রম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৮

৪২. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৮ ৪৩. মো. এনামুল হক, প্রতিরোধযুদ্ধে রাজশাহী বিভাগ, অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা; ২০১৫, পৃ. ৯০%

৪৪. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৪৭১

৪৫. ক. মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা; ১৯৯৩, পৃ. ১০৮ খ. মোহাম্মদ নুরুল কাদের, একাত্তর আমার, সাহিত্য প্রকাশ,

ঢাকা; ১৯৯৯, পৃ. ২০

৪৬. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭১

৪৭. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭১

৪৮. ক. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭১ খ. মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৪

৪৯. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭১

৫০. ক. প্রত্যয়: মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ‘৯৮: জেলা প্রশাসন, নবাবগঞ্জ য সাক্ষাৎকার: ক. মনিদ উদ দৌলা চৌধুরী, প্রাগুক্ত, খ, ইসরাইল হক সেন্টু, সমাজকর্মী ও সিপিবি নেতা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গ রোজিউর রহমান বিশু, কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমান্ড

৫১. প্রত্যয়, প্রাগুক্ত

৫২. ক. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭২

খ. প্রত্যয়, ঐ

গ. সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক মো. এনামুল হক, বাংলা বিভাগ নবাবগঞ্জ কলেজ ও খ. মৈনুদ্দীন মণ্ডল, ছাত্রনেতা (পরবর্তীকালে পৌর চেয়ারম্যান) চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫৩. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭২

খ. সাক্ষাৎকার; মহাম্মদ আলী কামাল ও খ. অ্যাড. রুপেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ভূত, প্রাগুক্ত ৫৪. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭২

৫৫. ক. প্রত্যয়, ঐ

খ. সাক্ষাৎকার: ক. অধ্যাপক মো. এনামুল হক ও খ. মহাম্মদ আলী কামাল, প্রাগুক্ত ৫৬. সাক্ষাৎকার: ক. রোজিউর রহমান বিশু, প্রাগুক্ত ও থ, ডা. মইন উদ্দীন আহমেদ মন্টু, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, মনাকষা, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫৭. ক.প্রত্যয়, প্রাগুক্ত; খ. সাক্ষাৎকার: ক. মহাম্মদ আলী কামাল ও খ. মো. আলাউদ্দীন, কমান্ডার,

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমান্ড

৫৮. সাক্ষাৎকার: ক. মহাম্মদ আলী কামাল, খ. চন্দ্রিকানাথ ঠাকুর ও গ. মো. খাইরুজ্জামান লুকা, মুক্তিযোদ্ধা, পাঠানপাড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫৯. ক. মুহ. মনতাজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪৩; খ. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা),

প্রাগুক্ত, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৪৫৭

৬০. ক. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদনা), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৯; খ, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি,

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা: ১৯৯৩, পৃ. ১১৬ ৬১. সাক্ষাৎকার: ক. মো. আবুল হোসেন, কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জয়পুরহাট জেলা কমান্ড, খ, অধ্যক্ষ খাজা শামসুল আলম, সহসভাপতি, আওয়ামী লীগ, জয়পুরহাট জেলা কমিটি, গ. ডি. এম গোলাম সারোয়ার, মুক্তিযোদ্ধা, পাচুইল, বানাইচ, ক্ষেতলাল, জয়পুরহাট ও ঘ. মোল্লা শামসুল আলম, সহসভাপতি, আওয়ামী লীগ, জয়পুরহাট, জেলা কমিটি

আরও পড়ুন:

রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধ – মো. এনামুল হক

মুক্তিযুদ্ধে মুক্তাঞ্চল – আমিনুর রহমান সুলতান

 

 

Leave a Comment