বাংলাদেশের উপজাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। বাংলাদেশে অনেক উপজাতি রয়েছে এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিও আছে। উপজাতি ভেদে, এমনকি একই উপজাতির বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে তাদের সংস্কৃতির পার্থক্য দেখা যায়। তবে কিছু কিছু বিষয় সকল উপজাতির মধ্যেই প্রায় অভিন্ন। যেমন উপজাতীয়রা সাধারণভাবে সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাস করে। আবার কিছু কিছু বিষয় কেবল একেকটি উপজাতির নিজস্ব ব্যাপার। যেমন রাধাকৃষ্ণের প্রেম অবলম্বনে গোপনারীদের যে রাসনৃত্য তা মণিপুরীদের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। বসন্তে মণিপুরী, সাঁওতাল এবং ওরাও উপজাতি আবির উৎসব করে। ফাগুয়া অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে ওরা ওদের বর্ষগণনা শুরু হয়। ওরাও যুবক-যুবতীরা অগ্নিখেলার মধ্য দিয়ে বছরের প্রথম রাতটি উদ্যাপন করে।
Table of Contents
বাংলাদেশের উপজাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
চাকমা ও তঞ্চংগাদের মধ্যে পালাগান বিশেষ জনপ্রিয় সঙ্গীত। মণিপুরী ও গারেদের মধ্যে ঋতুভিত্তিক আচার-অনুষ্ঠান সবচেয়ে বেশি। দোল পূর্ণিমার মধ্যরাত থেকে মাসজুরে মণিপুরী যুবক-যুবতীরা মুক্তমাঠে নৃত্য করে । ধান কাটার সময়ও কর্মরত যুবক-যুবতীরা পরস্পর গান ও ছড়া কাটার মাধ্যমে আনন্দমুখর হয়ে ওঠে।
মালপাহাড়ি যুবক-যুবতীরাও মাতাল হয়ে রাতভর নাচগান করে। সাঁওতালরা শস্য তোলার উৎসব ‘সাহরাই’ ৩-৪ দিন ধরে সাড়ম্বরে পালন করে। এ উৎসবে সাঁওতাল যুবক-যুবতীরাও মণিপুরীদের মতো নাচগান করে । মণিপুরী ও সাঁওতালদের মতো গারো যুবক-যুবতীরা ‘ওয়াংগালা’ অনুষ্ঠানে সম্মিলিত নাচগান করে। শস্য বপন ও আহরণের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। গোটা উপজাতিটি এ সময় আনন্দে মেতে ওঠে।
গারোদের এই ওয়াংগালা অনুষ্ঠানে যে তাণ্ডব নৃত্য করা হয় তার লক্ষ্য অশরীরী অপশক্তিকে ভয় দেখিয়ে বশ করা । তারা ভোগ দিয়েও অপশক্তিকে বশ করার চেষ্টা করে। মগরা গানবাজনা, নৃত্য ও মদ্যপানে মত্ত হয়ে মণি সালের প্রথম তিন দিন অতিবাহিত করে।
ধর্মীয় বিশ্বাস :
গারোদের সাংসারেক এবং চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কতিপয় উপজাতির বৌদ্ধধর্ম ছাড়া অন্য কোনো উপজাতির সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্ম নেই। প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত সংস্কার, বিশ্বাস ও প্রথাই তাদের ধর্ম। গারোদের সাংসারেক ধর্মও এখন বিলুপ্তপ্রায়। তাদের অধিকাংশই এখন খ্রিস্টধর্মাবলম্বী । তবে সাংসারেক ধর্মের পর্ব-পার্বণও তারা কিছু কিছু পালন করে।
সাঁওতালরা অধিকাংশই খ্রিস্টান, কিন্তু তারা স্ব স্ব প্রচলিত প্রথা মেনে চলে। ওরাঁও, মণিপুরী এবং বৌদ্ধ উপজাতিগুলোর মধ্যে অমাবস্যা-পূর্ণিমা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্ণিমায় তারা বহুবিধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করে। ওরাও উপজাতিরা ডাক ও খনার বচনে বিশ্বাসী। যাত্রার শুভাশুভ সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস খনার বচনের অনুরূপ, যেমন যাত্রাকালে হোঁচট খাওয়া, পিছু ডাক, টিকটিকির ডাক, মৃত্যুসংবাদ, লাশ দেখা, মরাডালে কাকের ডাক, শূন্য/পূর্ণ কলস দর্শন ইত্যাদি সংস্কার তারা মেনে চলে।
ওরাও উপজাতিরা পূর্বদিক থেকে হাল চালনা করে এবং শুভদিন দেখে গৃহ নির্মাণ করে। রাতে কেশবিন্যাস করা, মহিলাদের চুল বাইরে ফেলা, সূর্যাস্তে ঘর ঝাড় দেয়া, সন্ধ্যাবেলা কাউকে কিছু দেয়া, রাতে পেঁচার ডাক ও কুকুরের কান্না ইত্যাদি তাদের কাছে অশুভ। রমণী বশীকরণ, গাভীর প্রথম দোহনের দুধ দান করা, প্রসূতি ও ঋতুবতীর গোশালায় না যাওয়া, ভাসুরের নাম উচ্চারণ না করা, মন্ত্রতন্ত্র ও ডাইনিতে বিশ্বাস করা ইত্যাদিও ওরাও সমাজে প্রচলিত।
গারোদের মধ্যে ডাইনি-বিশ্বাস না থাকলেও তাদের বিশ্বাস, কোনো কোনো মানুষ রাতে বাঘ হয়ে গৃহপালিত পশু ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলে; হিংস্র জন্তুর আক্রমণে নিহত ব্যক্তি জন্তু-জানোয়ার হয়ে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে। ওরাও উপজাতিদের বিশ্বাস, মৃতভূমিষ্ঠ শিশুর শ্রোতারাও পুনর্জন্ম নেয় । কবিরাজরা এসব অনভিপ্রেত শক্তির আবির্ভাবকে বন্ধ করতে পারে ।
ওরাও গর্ভবতীর ইঁদুর ও বাইন মাছ খাওয়া নিষেধ। এতে জাতক কদাকার হবে বলে তাদের বিশ্বাস। প্রসবের পর
ওরাও প্রসূতির খেসারির ডাল, আলু, ঠাণ্ডা পানি ও বাসি খাবার খাওয়া নিষেধ। মণিপুরীরা খোলা চুলে গর্ভবর্তীতে
বাইরে যেতে দেয় না; রাতে দূরে কোথায় যাওয়া এবং নদী/সাঁকো পার হওয়াও তাদের জন্য নিষিদ্ধ ।
মালপাহাড়িদের বিশ্বাস বিবাহ ও সন্তান প্রসবের সময় মা ও শিশুকে ভূতে ধরতে পারে। সেজন্য তার সব সময় সতর্ক থাকে। খাসিয়া ও মুণ্ডাদের বিশ্বাস মৃতশিশু ও পূর্বপুরুষদের প্রেতাত্মা ঘরে আসতে পারে। এজন্য তারা প্রেতাত্মার উদ্দেশ্যে পাথরের বেদি নির্মাণ করে। সব উপজাতিই গৃহদেবতায় বিশ্বাসী। তাদের মঙ্গলামঙ্গল এই গৃহদেবতার খুশি-অখুশির ওপর নির্ভর করে ।
কৃষিকাজ :
কোনো কোনো উপজাতি ভূমিকে মা মনে করে, তাই শস্য বপনের সময় তারা ভূ-মাতার পূজা করে। ওরাও উপজাতিরা শস্যক্ষেত্রকে আভূমি প্রণাম করে। তারা এও বিশ্বাস করে যে, ভূ-মাতার ঋতুত্থান হয় বলেই শস্য উৎপাদিত হয়। এজন্য তারা ভূ-মাতার ঋতুকালে বিভিন্ন পর্ব পালন করে। ওরাঁও এবং সাঁওতালরা কৃষিযন্ত্রপাতিতে শ্রদ্ধাবশত সিঁদুরের ফোঁটা দেয়।
গারো ও মণিপুরীদের মতো সাঁওতাল এবং আরও কিছু উপজাতীয় নারী-পুরুষ একসঙ্গে মাঠে কাজ করে। জঙ্গল পরিষ্কার ও চাষের কাজ করে পুরুষরা, আর উৎপাদনের প্রতীক মেয়েরা করে বপন-রোপণের কাজ। শস্য বপন ও কর্তনের সময় প্রায় সব উপজাতিই স্বকীয় পদ্ধতিতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান পালন করে। যুবক-যুবতীরা পরস্পর গান ও ছড়া কাটার মাধ্যমে মাঠ থেকে পাকা ফসল ঘরে তোলে।
বিবাহ :
বিবাহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপজাতিতে সাদৃশ্য যেমন রয়েছে, বৈসাদৃশ্যও রয়েছে। পূর্বরাগ উপজাতীয় বিবাহের মূলসূত্র, তবে তা অবশ্যই প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী হতে হবে। ওরাও উপজাতিদের মধ্যে বাল্যবিবাহ এবং চৈত্র, ভাদ্র ও পৌষ মাসে বিবাহ নিষিদ্ধ। বরপক্ষ কনেপক্ষকে পণ দেয়। পাত্রী দেখা, পানচিনি, গায়ে হলুদ ইত্যাদি তাদের প্রাকবিবাহ অনুষ্ঠান। বিবাহের দিন উভয় পক্ষের মেয়েরা বিয়ের গীত গায় । ওরাও ও মণিপুরীরা বর্ণাঢ্য বিবাহমণ্ডপ তৈরি করে।
ওরাও উপজাতিরা এতে মঙ্গলঘট বসায়। মণ্ডপে বর-কনে পরস্পরের কপালে সিঁদুর দেয় এবং উভয় পক্ষের মেয়েরা তখন উলুধ্বনি দেয়। ওরাও ও মণিপুরীদের মধ্যে বিয়ের পূর্বক্ষণে বর-কনে মণ্ডপ প্রদক্ষিণ করে এবং ধান-দূর্বা দিয়ে তাদের বরণ করা হয়। মণিপুরী বিবাহে মণ্ডপে প্রদীপ জ্বালিয়ে বরকে স্বাগত জানানো হয় এবং একজন কিশোর তার প ধুয়ে দেয়। এ সময় কীর্তন আর বাজনা চলে এবং উভয় পক্ষের দুজন মহিলা দুটি টাকি মাছ পানিতে ছেড়ে দেয় ।
বর-কনের প্রতীক এই মাছ দুটি পাশাপাশি চললে শুভ, অন্যথায় অশুভ। অনুরূপ একটি অনুষ্ঠান গারোদের মধ্যেও প্রচলিত। তারা একজোড়া মোরগ-মুরগি জবাই করে ছেড়ে দেয় এবং সে দুটি দাপাদাপি করে একত্র হলে শুভ, না হলে অশুভ। অশুভ হলে খামাল (ওঝা) অশুভ দূর করে। বিবাহের শুভ কামনায় অনেক সময় দেবতাকেও ভোগ দেয়া হয়।
মগ যুবক-যুবতীরা নববর্ষ পালন উপলক্ষে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার সুযোগ পায় এবং তখন তারা অভিভাবকদের অনুমোদন সাপেক্ষে জীবনসঙ্গী বেছে নেয়। গারো, খাসিয়া, টিপরা ও মগ মেয়েরা বাজারে কেনাবেচা করতে যায়। এই সুযোগে যুবক-যুবতীদের মধ্যে মনের মিল হয় এবং পরে অভিভাবকদের অনুমোদনক্রমে তাদের বিয়ে হয়। গারো ও মণিপুরীদের মতো সাঁওতাল এবং আরো কিছু উপজাতীয় যুবক-যুবতী একসঙ্গে মাঠে কাজ করার সময় জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার সুযোগ পায় ।
চাকমাদের মধ্যে অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও গ্রহণের সময় বিবাহ নিষিদ্ধ। ওরাঁও, সাঁওতাল, খাসিয়া, গারো এবং মণিপুরীদের মধ্যে গোত্রবিবাহ নিষিদ্ধ । মণিপুরীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তেও বিয়ে হয় না। গারোদের সমগোত্রীয় যুবক-যুবতীদের মধ্যে থাকে ভাই-বোনের সম্পর্ক। মগদের গোত্রবিবাহ বিধিসম্মত, বরং আন্তঃগোত্রীয় বিবাহ তাদের অপছন্দ। তবে চাচাতো-মামাতো বোন ও খালা-ফুফুকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ।
সাঁওতাল বধূরা স্বামীর গোত্রভুক্ত হয়। স্ত্রী বন্ধ্যা কিংবা পাগল না হলে মগ পুরুষদের পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ, তবে বিধবাবিবাহ সিদ্ধ। ওরাঁওদেরও তাই । গারো মেয়েরা অনেক সময় পছন্দসই যুবককে ধরে নিয়ে বিয়ে করে ঘরজামাই করে রাখে। এরূপ বিবাহ পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন আর না থাকলেও কোনো কোনো উপজাতিতে স্বেচ্ছায় পলাতক বিয়ে হয় এবং পরে অভিভাবকরা তা অনুমোদন করে। ওরাঁওদের মধ্যে এরূপ বিবাহের প্রাচুর্য দেখা যায়। ওরাও ও সাঁওতাল বধূরা সিঁদুর পরে। উপজাতির মধ্যেই সিঁদুরের ব্যবহার ব্যাপক। মগ ছাড়া অন্য সব উপজাতির মধ্যে স্বগোত্রে বিবাহ অপমানজনক এবং এজন্য সংশ্লিষ্টদের গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়।
খাসিয়াদের বিয়ে না করা পাপ। স্বামীর নপুংসকতা কিংবা লাম্পট্য, অধিক সন্তান, যৌনস্পৃহা ইত্যাদি কারণে খাসিয়া রমণীরা একসঙ্গে একাধিক স্বামী রাখতে পারে, তবে এরূপ ঘটনা বিরল। অন্য কোনো উপজাতিতে স্ত্রীর একাধিক স্বামী কিংবা উপপতি রাখা কঠিন শাস্তিযোগ্য। খাসিয়া যুবতীরা অনুমোদিত গোত্র থেকে পছন্দসই কোনো যুবককে আমন্ত্রণ করে এনে কয়েক দিন সহাবস্থানের পর সন্তোষজনক মনে হলে উভয় পক্ষের আলোচনাক্রমে তাকে বিয়ে করতে পারে।
এঁদের বিবাহে নারীরা বরযাত্রী হতে পারে না, কিন্তু ওরাঁও উপজাতিতে পারে। মা ও মুরব্বিদের আশীর্বাদ নিয়ে পাগড়ি ও ধুতি পরিহিত খাসিয়া বর মাতৃগৃহ ত্যাগ করে; সঙ্গে থাকে বরযাত্রীরা। মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া ও গারো উপজাতিতে বর হয় ঘরজামাই। চাকমাদের দুই পক্ষের মধ্যে মদ্য বিনিময়ের পর কনের বাড়িতে বিবাহ অনুষ্ঠান হয়। মণিপুরীদের বিবাহবেশ হচ্ছে বরের ধুতি-পাগড়ি ও কপালে চন্দনতিলক, আর কনের পোশাক রাসনৃত্যে গোপিনীদের মতো।
কতিপয় উপজাতিতে তালাক বিধেয় হলেও তা বিরল। সাঁওতাল এবং ওরাও উপজাতিদের মধ্যে তালাক সিদ্ধ, তবে অকারণে তালাক ঘৃণ্য। মনোমালিন্য, যৌন-অক্ষমতা, স্ত্রীর পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি তালাকের কারণ । ওরাও, খাসিয়া, চাকমা ও মগদের মধ্যে তালাক বিধিসম্মত হলেও তা কদাচিৎ হয়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বর-কনে উভয়ের এবং গোত্রপতিদের সম্মতিতে তালাক হয় ।
পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জাঃ
ওরাও উপজাতিসহ আরো অনেক উপজাতির সাধারণ পোশাক ধুতি শাড়ি। এক সময় কোনো কোনো উপজাতি দেহের নিম্নাংশে বৃক্ষপত্র এবং গারোরা পাতলা কাপড়ের মতো এক প্রকার বৃক্ষবঞ্চল পরিধান করত। নিম্নস্তরের গারোরা আজও নেংটি পরে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বৃক্ষবল্কল বর্তমানেও কোনো কোনো উপজাতির কটিবসন বৃক্ষপত্র। সাঁওতালি পোশাকের নাম পাঁচি, পাঁচাতা ও মথা।
চাকমাদের প্রধান পরিধেয় লুঙ্গি; শার্টের ওপর পরা হয়। গামছা তাদের একটি চিরাচরিত পোশাক । মেয়েদের পোশাক একখণ্ড লাল-কালো কাপড়, চাকমা ভাষায় যাকে বলা হয় পিন্ধন; আর গায়ে পরা হয় ব্লাউজের মতো সিলুম। মগরা বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত থামি এবং ফুলহাতা ব্লাউজ পরে।
উপজাতীয়দের অলঙ্কারে বৈচিত্র্য কম। উত্তরবঙ্গীয় উপজাতীয়দের গহনাপত্র প্রায় একই রকম। সাঁওতাল ও ওরাঁওরা হাত, পা, নাক, কান ও গলায় গহনা পরে। ওরাঁওরা চূড়া করে চুল বাঁধে এবং টিকলি পরে। চাকমা মেয়েরা চুড়ি, খাড়, গলায় টাকার ছড়া এবং বড়ো ছিদ্র করে কানবালা পরে। গারো মেয়েরা খোপায় ফুল গোঁজে। মগ মেয়েরা ‘সানাকা’ নামক এক প্রকার বনজ পাউডার মেখে মুখ উজ্জ্বল করে।
খাদ্য-পানীয় :
উপজাতীয়রা তাদের টোটেম ছাড়া আর সবই খায়। বিড়াল গারোদের টোটেম, তাই তারা বিড়াল খায় না। মগ, চাকমা ও খাসিয়ারা গোমাংস এবং গারোরা গোদুগ্ধ খায় না। মগ ও চাকমা নর-নারী ধূমপানে অভ্যস্ত। টক ও পচা চিংড়ির প্রস্তুত খাদ্য তাদের প্রিয়। ওরাও উপজাতিরা ইঁদুর, বাইন মাছ, আলু, খেসারির ডাল ইত্যাদি খায়। ভাতপচানো মদ সব উপজাতিরই প্রিয় পানীয়।
সামাজিক বিধিবিধান:
মাতৃতান্ত্রিক উপজাতিতে পুরুষ সম্পত্তির ওয়ারিশ নয়। ছেলেরা যেমন মাতৃগৃহে, তেমনি স্ত্রীগৃহেও অবহেলিত। মায়ের মৃত্যুর পর গারো কন্যাদের পিতার প্রতি কোনো দায়িত্ব থাকে না, কিন্তু খাসিয়াদের মধ্যে তা অবশ্য পালনীয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ও সাঁওতালরা গোত্রপ্রধানকে বলে রাজা, আর খাসিয়ারা বলে মন্ত্রী। প্রায় সব উপজাতিতেই ব্যভিচার দোষণীয়।
ওরাও উপজাতিরা নবজাতকের মুখে প্রথম দেয় ছাপী কিংবা মায়ের দুধ, অন্যরা দেয় মধু; আর প্রসূতিকে খেতে দেয় হলুদ পানি। প্রায় সব উপজাতিই অশরীরী অপশক্তি থেকে শিশু ও মাকে রক্ষার জন্য ঘরের চতুর্দিকে কাঁটার বেড়া দেয়; ওঝা বৈদ্যরা ঘর বন্ধন করে এবং ঝাড়ফুঁক দেয়। জন্মের ষষ্ঠ দিনে মণিপুরীরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জাতক, প্রসূতি ও প্রসূতিগৃহ পরিশুদ্ধ করে। জন্মের পরই শিশুর কানের লতি ফুঁড়ে দেয়।
গারোরা শিশুর সুন্দর নাম রাখে না প্রেতের কুদৃষ্টি এড়াবার জন্য। ওরাও উপজাতিরা সাধারণত জন্মের পঞ্চম দিনে পূর্বপুরুষের নাম কিংবা জন্মবারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিশুর নামকরণ করে। শূকর, কুকুর, মোরগ ইত্যাদি উপজাতীয়দের গৃহপালিত পশু। ওরাও উপজাতিরা গরুর খুব যত্ন নেয়। কোনো কোনো উৎসব উপলক্ষে তারা গরুর গা ধুয়ে তেল মেখে দেয়। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে তারা আঙ্গিনায় আলপনা আঁকে, গোশালায় ধূপ জ্বালায় এবং প্রতি অমাবস্যার পরদিন কৃষিযন্ত্রপাতি ধুয়ে তাতে সিঁদুর লাগায় ।
বাসগৃহ :
সব পাহাড়ি উপজাতিই মাচার ওপর বাঁশ, বেত, কাঠ ও পাতা দিয়ে ঘর তৈরি করে। ঘরে ওঠার জন্য থাকে মই । হিংস্র জন্তু-জানোয়ার যাতে ওপরে ওঠে আসতে না পারে সেজন্য রাতের বেলা মই সরিয়ে ফেলা হয়। মগরা বাড়ি করে সমতলে। ওরাও উপজাতিরা গোবর দিয়ে লেপেপুছে বাড়ি পরিষ্কার রাখে। তাদের ঘরগুলো সাধারণত খড়ের ছাউনিযুক্ত মাটির ঘর, তবে শোলার বেড়ার ঘরও আছে। মাটির দেয়ালে তারা লতাপাতার নকশা আঁকে। বাংলাদেশের এ উপজাতীয় সংস্কৃতি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বহু দেশের লোকসংস্কৃতিতে লক্ষণীয়।
উপসংহার :
বাংলাদেশের উপজাতীয় সংস্কৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ দেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা আদিবাসীদের নানা লোকাচার ও উৎসব আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য। তবে আর্থ- সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে তাদের সংস্কৃতিতেও আসছে নানা বিবর্তন । এছাড়া বিভিন্ন কারণে এই বিপুল ঐতিহ্যের অনেকটাই এখন ধ্বংসোনুখ হয়ে পড়েছে।
আরও দেখুনঃ