বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা ও তাৎপর্য [ হায়দার আকবর খান রনো ] : ১৯৭১ সালে সারা দেশ জুড়ে যে অসম সাহসী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তার ছিল বহুমাত্রিক রূপ। সাধারণভাবে সারা দেশে জনগণের ওপর আওয়ামী লীগ ও প্রবাসী সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকলেও বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা কোনো একক কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হচ্ছিলেন না।
এমনকি প্রবাসী সরকার অথবা সরকারি মুক্তিফৌজের হাই কমান্ড বা সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ন্ত্রণে বা জানার মধ্যেও ছিল না দেশের অভ্যন্তরের সকল যুদ্ধের বিবরণ। প্রবাসী সরকার এবং সরকারি মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল ভারত সরকারের সাহায্যপুষ্ট ভারতেই গঠিত বিশেষ বাহিনী—বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (BLF), যা মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত।
Table of Contents
বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা ও তাৎপর্য
কাদেরিয়া বাহিনী ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনী দ্বারা সাহায্যপুষ্ট হলেও তা প্রবাসী সরকার ও মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। বামপন্থিদের একাংশ তথাকথিত মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার সহযোগী ন্যাপ (মোজাফফর) ও ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ কর্মীদের নিয়েও একটি বাহিনী গঠিত হয়েছিল ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে ও সাহায্যে। সেটিও প্রবাসী সরকার ও সরকারি মুক্তিফৌজের অধীনস্থ ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তথাকথিত মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি এই সুযোগ পেয়েছিল।
কিন্তু বামপন্থিদের অন্য অংশ ভারত সরকারের কোনো সাহায্য পায়নি। বরং ভারত সরকার বামপন্থিদের সন্দেহের চোখে দেখত। তবু তারা যুদ্ধ করেছেন অসম সাহসিকতার সঙ্গে এবং কোনো রকম বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াই। তারা যেসব যুদ্ধ করেছেন, তার কিছু বিবরণ (পূর্ণাঙ্গ নয়) তুলে ধরা হয়েছে আমার লেখা অন্য একটি নিবন্ধে (‘বামপন্থি সংগঠিত গেরিলা বাহিনী গঠন ও তাদের কর্মতৎপরতা’ শীর্ষক নিবন্ধ, যা বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’-এর চতুর্থ খণ্ডের দ্বিতীয় পর্বে সংকলিত হয়েছে)।
এই নিবন্ধে তাই যুদ্ধের বিবরণ দেয়া হবে না, অথবা ওই নিবন্ধের অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতাদানের চেষ্টা নেয়া হবে না। বর্তমান নিবন্ধে যুদ্ধরত বামপন্থিদের দ্বারা গঠিত ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’র ঘোষণা এবং তার রাজনৈতিক তাৎপর্য সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা নেয়া হবে। সেই ঘোষণাপত্রটি এই নিবন্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলো। বর্তমান রচনাকে ঘোষণাপত্রের একটা ভূমিকা বলে বিবেচনা করা যেতে পারে মাত্র।
এই প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের দিকে বামপন্থিদের অবস্থান কেমন ছিল তার একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া আবশ্যক। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পর পাকিস্তান আমলে আর কখনোই কোনো সাম্প্রদায়িক বা ধর্মভিত্তিক দল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ষাটের দশকে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান দুটি ধারা ছিল— জাতীয়তাবাদী ধারা আওয়ামী লীগ, যার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বামপন্থি সমাজতন্ত্র অভিমুখী ধারা— ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (সংক্ষেপে ন্যাপ), যার নেতা ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ছিল বিধায় আত্মগোপনে কাজ করত। তাঁরা প্রকাশ্যে ন্যাপের মধ্যে থেকে রাজনীতি করতেন।
ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মহাবিতর্ক ও ভাঙন দেখা দিলে। তার ঢেউ এসে লাগল আমাদের দেশেও। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থি পার্টি। একই সময়ে ন্যাপেও বিভক্তি এসেছিল।
মওলানা ভাসানী তথাকথিত পিকিংপন্থিদের প্রতি তাঁর সমর্থন ও আশীর্বাদ রাখলে, তথাকথিত মস্কোপন্থিরা বেরিয়ে গিয়ে স্বতন্ত্র ন্যাপ গঠন করেন, যার পাকিস্তানভিত্তিক কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন ওয়ালী খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ। মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেছিল। তারা যে ১৯৭১ সালে সোভিয়েতের প্রভাবের কারণে ভারত সরকারের সহযোগিতায় স্বতন্ত্র বাহিনী গঠন করেছিলেন সে কথা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
তথাকথিত পিকিংপন্থি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) ১৯৬৮-৭০ এর মধ্যে কয়েকটি ধারা ও উপধারায় বিভক্ত হয়। সেগুলো নিম্নরূপ—
১. পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)
নেতৃত্বে ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, তোয়াহা, হক।
১৯৭১ সালে তাঁরা আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা যুদ্ধ প্রসঙ্গে বিভ্রান্তিকর লাইন গ্রহণ করেন। তাঁরা প্রবাসী সরকারকে স্বীকার করেননি। জাতীয় যুদ্ধের স্তরে তাঁদের একাংশ কৃষিবিপ্লবের বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তবে তাঁরা পাকিস্তানের আর্মির বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছেন। মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে নোয়াখালীতে চরাঞ্চলে বিশাল মুক্ত এলাকাও গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের বড় অংশ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারত থেকে আগত মুক্তিফৌজের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন।
এদেরই একটি ক্ষুদ্র অংশ দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ির প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব (ভারতের নকশালপন্থিরা এই তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন) প্রচার করেছিলেন।
২. পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি
নেতৃত্বে ছিলেন দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আবদুল মতিন ও আলাউদ্দিন আহমদ।
১৯৭১ সালে এই পার্টিও দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। আবদুল মতিনের নেতৃত্বাধীন অংশটি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মা-লে)-এর মতোই বিভ্রান্তিকর লাইন নিয়েছিলেন, যদিও তাঁরাও অনেক সাহসী যুদ্ধ করেছিলেন, বিশেষত রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলে।
দেবেন শিকদার ও আবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন অংশটি ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’র অন্তর্ভুক্ত ছিল। চট্টগ্রাম এবং চাঁদপুর অঞ্চলে তাঁরা বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেছেন।
৩. কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি
নেতৃত্বে ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, জামাল হায়দার, হায়দার আনোয়ার খান জুনো প্রমুখ।
বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মধ্যে এই দলটিই ছিল প্রধান। ১৯৭১ সালে এই দলের সরাসরি নেতৃত্বাধীনে ছোটো-বড় মিলিয়ে ১৪টি গেরিলা ঘাঁটি অঞ্চল গড়ে উঠেছিল। তার মধ্যে নরসিংদী জেলার শিবপুর, বাগেরহাট জেলার বিষ্ণুপুর, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম, সাতক্ষীরা জেলার তালা অঞ্চলের ঘাঁটি অঞ্চল বা আধা-মুক্ত এলাকাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৪. পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন (পরবর্তীকালে সর্বহারা পার্টি)
নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজ সিকদার।
এই দলটি প্রথম থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিরোধী মুক্তি সংগ্রামকে প্রাধান্য দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাঁরা অবশ্য বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তারা প্রবাসী সরকারকে স্বীকার করতে চাইতেন না। ১৯৭১ সালে তাঁরা বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়েছিলেন।
পেয়ারাবাগানের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বরিশাল-পিরোজপুর অঞ্চলের বড় এলাকা জুড়ে তাঁদের ঘাঁটি অঞ্চল ও আধা-মুক্ত এলাকা ছিল। ১৯৭১ সালে দলটি তেমন বড় ছিল না। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে তাঁরা বিশাল সশস্ত্র দলে পরিণত হয়েছিলেন, যা স্বল্প সময়ের জন্য হলেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
যুদ্ধরত বামপন্থিদের একাংশকে নিয়েই গঠিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’। ১৯৭১ সালের ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটার এক স্কুলে কয়েকটি বামপন্থি দল ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে এই সংস্থাটি গঠন করেছিলেন। সেই সম্মেলন যে ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেছিল, এই নিবন্ধের সঙ্গে তা সংশ্লিষ্ট করা হলো।
১ ও ২ জুনের সম্মেলনের খাওয়া, থাকাসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। তাঁদের কমরেডরা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলেন, কিন্তু সম্মেলনের কার্যাবলিতে কোনো প্রকার অংশগ্রহণ করেননি। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন ন্যাপ নেতা বরদা চক্রবর্তী। ঘোষণাপত্র রচনা ও পেশ করেছিলেন হায়দার আকবর খান রনো।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন শিকদার), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার), শ্রমিক-কৃষক কর্মী সংঘ, পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) শ্রমিক ফেডারেশন এবং পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধিবৃন্দ।
বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির অধীনস্থ পার্টি ও সংগঠনসমূহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় ভারতের সাহায্য ছাড়াই অসম সাহসী যুদ্ধ সংগঠিত করেছিল। এর অন্তর্ভুক্ত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে যে ১৪টি সশস্ত্র ঘাঁটি এলাকা গড়ে উঠেছিল এ কথা আগেই বলা হয়েছে।
সব মিলিয়ে বিশ সহস্রাধিক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে নেমেছিলেন। তার মধ্যে শতাধিক শহিদ হয়েছিলেন। যদি আশ্রয়, খাদ্য, অর্থদানকারী, সংবাদ সরবরাহকারী, চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী এবং অন্যান্যভাবে সহায়তাকারীদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ধরা হয় (তাই-ই ধরা উচিত বলে আমি মনে করি), তা হলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাটি অনেক বিশাল হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির হেড কোয়ার্টার ছিল কলকাতার সিআইটি রোডের একটি দোতলা বাড়িতে। সেখানে কয়েকজন থাকতেন। এই ব্যবস্থাটি করে দিয়েছিল ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। সব নেতা অবশ্য সব সময় সেখানে থাকতেন না। তাঁরা প্রধানত ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াত করতেন।
সমন্বয় কমিটি দুইভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এক, দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র ঘাঁটি তৈরি করে। দুই, বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের সহযোগিতায় ভারতে অবস্থানরত মুক্তিফৌজে দলীয় কর্মীদের ঢুকিয়ে দিয়ে। সরকারি মুক্তিফৌজে বামকর্মীদের না নেয়ার একটি অলিখিত সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অধিকাংশ সেক্টর কমান্ডার বামকর্মীদের নেয়ার ব্যাপারে কোনো আপত্তি করেননি।
অনেকে যেমন কর্নেল নুরুজ্জামান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়াউর রহমান সমন্বয় কমিটির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বাম ঘাঁটিতে গোপনে অস্ত্র সরবরাহ পর্যন্ত করেছিলেন। সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো যোগাযোগ রাখতেন। তবে তাঁরা বিভিন্ন ঘাঁটি এলাকায় যাতায়াত করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে তাঁদের পক্ষ হয়ে লিয়াজোঁ রাখতেন মেজর মনজুর আহমেদের ভাই ব্যারিস্টার মনসুর আহমদ।
১ ও ২ জুনের (১৯৭১) সম্মেলনের গৃহীত ঘোষণাপত্রটি আন্তর্জাতিকভাবে বহুল প্রচার পেয়েছিল। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি এই প্রচারের ব্যবস্থা করেছিল। ঘোষণাপত্রটির তাৎপর্য এই যে, বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বামকর্মীরা এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা বাম অথবা বামঘেঁষা গেরিলা দল রাজনৈতিক নির্দেশনা পেয়েছিল। ঘোষণাপত্রটি ছাপানো হয়েছিল এবং দেশের ভেতরে পাঠানো হয়েছিল।
ঘোষণাপত্রে যুদ্ধরত বাম সংগঠন ও যোদ্ধাদের করণীয় পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। যুদ্ধাবস্থায় করণীয় এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য দুটোই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ঘোষণাপত্রে প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। এই প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী, সুখেন্দু দস্তিদার তোয়াহা-হকের নেতৃত্বে) ও সর্বহারা পার্টির সঙ্গে সমন্বয় কমিটির মৌলিক পার্থক্য ছিল।
ওই দুই পার্টি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে চাননি। তাঁদের অবস্থানটি ছিল অতিবাম দোষে দুষ্ট। তাছাড়া ১৯৭০-এর নির্বাচনে যে গণরায় এসেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী নেতৃত্ব দ্বারা গঠিত প্রবাসী সরকার সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। ঘোষণাপত্রে স্বতন্ত্রভাবে যুদ্ধ করা এবং একই সঙ্গে সরকারি ফৌজসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সহযোগিতা ও সমন্বয় করার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নীতিনিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত।
ঘোষণাপত্রে সমন্বয় কমিটির আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিও সুস্পষ্ট করা হয়েছিল। চীনের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। সেদিন কলকাতায় সমন্বয় কমিটির যেসব নেতা উপস্থিত ছিলেন তারা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন সেটাও তাৎপর্যপূর্ণ।
সাম্রাজ্যবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল। বিবৃতিতে চীনের ভূমিকার সমালোচনা ছিল। ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণের সঙ্গে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্থায়ী বন্ধুত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা হয়েছিল। আবার একই সঙ্গে ভারত যাতে বাংলাদেশে পাঠানো সৈন্য দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে আসে সেজন্য ভারত সরকারেরই নিজস্ব বক্তব্যটি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির গতিমুখ কোনদিকে হবে? উপর্যুক্ত বিবৃতিতে সেটাও স্পষ্ট করা হয়েছিল। গতিমুখ হবে সমাজতন্ত্র অভিমুখী। ধনবাদী পথ পরিহার করার কথা বলা হয়েছিল। বস্তুত এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল কথা। সেই চেতনা বাস্তবায়ন হতে পারে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে—এই কথাটি বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
সকল মুক্তিযোদ্ধাকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হবার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান ছিল। সকল স্তরে গণকমিটি গঠন করে আশু রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি কার্যকর করার কথাও বলা হয়েছিল। বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘সরকারের উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের যে সকল গণ কমিটি গঠিত হইবে, তাহাতে সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দল ও মতের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করিতে হইবে।’
আমরা জানি, পরবর্তী ঘটনাবলি সেই পথে অগ্রসর হয়নি। কিন্তু সমন্বয় কমিটি ১৯৭১-এর ১ জুন যুদ্ধকালীন অবস্থায় এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে যে রাজনৈতিক পথ নির্দেশ করেছিল, তার যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। সমন্বয় কমিটির সংগ্রাম, ঘোষণা ও বক্তব্যের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল বিরাট।
আরও দেখুন: