বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রচনা

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তত্ত্ববধায়ক সরকারের ধারণা বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংবিধানিক বিকাশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৯১ সাল থেকে পরপর তিনটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এ ধারণা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে এ সরকার ইতিমধ্যেই জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ সরকারের ধারণা কে বা কারা প্রথম দেন এ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দাবি করে যে, তারাই প্রথম এ সরকারের প্রস্তাব দেন। আবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও দাবি করে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা ও মডেলটি তাদেরই চিন্তাভাবনার ফসল। এ বিতর্কের ধুম্রজালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়। আর সেটি হচ্ছে, এ জাতীয় একটি সরকার সাংবিধানিকভাবে কতটুকু গ্রহণযোগ্য? সম্প্রতি এ প্রশ্নে আনীত একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া অভিমত বিষয়টিকে আরো ঘনীভূত করেছে। কেননা এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত রায় এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে।

 

বাংলাদেশে তত্ত্ববধায়ক সরকারব্যবস্থা

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পটভূমি:

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের পর সকলে বিশ্বাস করেছিলেন, এ দেশে গণতন্ত্রের সুদিন ফিরে এসেছে। ঐ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ একমত হয়ে দ্বাদশ সংশোধন আইনের মাধ্যমে দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সংসদীয় ব্যবস্থা। জাতীয় সংসদ হয়ে উঠেছিল জাতীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। দায়িত্বশীল মন্ত্রিপরিষদ মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় সমস্যা সমাধানের আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণে ।

দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অতীতের বৈরিতা পরিত্যাগ করে মনোযোগী হয়েছিল জাতীয় কল্যাণের উদ্দেশ্যে। অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে দ্বাদশ সংবিধান সংশোধন আইন প্রণীত হলো। জাতীয় রাজনীতি বন্দি হলো জাতীয় সংসদে। সংসদীয় কমিটিসমূহ সরকারের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মমুখর হয়ে উঠলো।

সংসদীয় বিতর্কও উন্নততর অবয়ব লাভ করলো। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যে এ অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটলো। সর্বপ্রথম, মিরপুর উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সৃষ্টি হলো পারস্পরিক অনাস্থার ভাব। শেষ পর্যন্ত তৈরি হলো দুয়ের মধ্যে অনতিক্রম্য দূরত্ব।

১৯৯৪ সালের মার্চের অধিবেশনে তদানীন্তন তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের সদস্যগণ সংসদ থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর তারা আর সংসদ অধিবেশনে যোগদান করেননি। ঐ ‘ওয়াকআউট’-এর পর পরই মাগুরার একটি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

 

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা

 

সে নির্বাচনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা। এরপর থেকে শুরু হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন। ঐ দাবিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয় জাতীয় পার্টি ও জামায়াত ইসলামী।
এর পরের দু বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস হলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের ইতিহাস। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রথমে এ দাবিকে অযৌক্তিক হিসেবে অগ্রাহ্য করে। ফলে ধর্মঘট, অবরোধ এবং হরতালের ফলে দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।

এক পর্যায়ে ২৮ ডিসেম্বর ১৯৯৪ বিরোধী দলীয় ১৪৭ জন সাংসদ পদত্যাগ করেন। একদিকে নির্দলীয় তত্ত্ববধায়ক সরকার সম্পর্কে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অনড় অবস্থান, অন্যদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ইসলাম ও অন্যান্য ছোট দলগুলোও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবির ফলে রাজনীতি নেমে এলো রাজপথে ।

অবশ্য সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আপোষ মীমাংসার জন্য দু বছর অন্ততঃপক্ষে ১৫টি দেশী-বিদেশী উদ্যোগ এবং ২০টি প্রস্তাব পেশ করা হয়। পাশাপাশি দেশের বুদ্ধিজীবীগণও উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সমঝোতার ফর্মুলা উত্থাপন করেন। এদিকে সংকট নিরসনের লক্ষ্যে দু বছরে চলমান আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশে হরতাল-অবরোধ একটানা অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় ।

এ সংকটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অবস্থান ছিল ভিন্নরূপ। প্রথমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তারা অযৌক্তিক আখ্যা দেন। পরে তারা বলে, সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় এ সংকটের সমাধান হবে। কিন্তু ১৪৭ জন সংসদ সদস্যের পদত্যাগের ফলে সংবিধান সংশোধনেরও কোনো অবকাশ নেই। ফলে তারা ঘোষণা দেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল উত্থাপনের মাধ্যমে এর সমাধান করা হবে।

এ লক্ষ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার কিছুদিন পূর্বে পঞ্চম সংসদ ভেঙে দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন এবং ষষ্ঠ সংসদের সদস্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়। কয়েকবার নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে নির্বাচন কমিশন। এ নির্বাচন যেন অনুষ্ঠিত হতে না পারে, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ইসলামী এবং অন্যান্য দল এ নির্বাচন প্রতিরোধের সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সহিংসতার এক রুদ্ররূপ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। ফলে অনেক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণও সম্ভব হয়নি।

 

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা

 

এসব কারণে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ভোটদানকারীর সংখ্যা হয় অত্যন্ত নগণ্য। দেশের এবং বিদেশ থেকে আগত সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের বিশ্লেষণে এ নির্বাচনকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় । সরকারের অবস্থা ফলে আরো নাজুক হয়ে ওঠে। চারদিক থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন প্রমাণ করলো যে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। ষষ্ঠ সংসদকে বিরোধী দলসমূহ ‘অবৈধ সংসদ’ রূপে আখ্যায়িত করে এবং এ নির্বাচন বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। দাবি ওঠে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে এবং ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাতিল হলেই শুধু রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য আলোচনা হতে পারে। এ দাবি চারদিক থেকে ওঠে আসে । সরকার বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে।

এ প্রেক্ষাপটে ২৫ মার্চ, ১৯৯৬ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল উত্থাপন করে। ২৫-২৬ মার্চ এ বিলের ওপর বিস্তারিত আলোচনা শেষে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন প্রণীত হয়। এই আইনের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতি অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দান করেন।

 

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা

 

সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার :

সংসদে পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন, ১৯৯৬ সংবিধানের চতুর্থ ভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের পর নতুন পরিচ্ছেদ হিসেবে সন্নিবেশিত হয় ।

 

পরিচ্ছদের প্রয়োগ :

৫৮ক, এই পরিচ্ছেদের কোনো কিছু ৫৫(৪), (৫) ও (৬) অনুচ্ছেদের বিধানাবলী ব্যতীত, যে মেয়াদে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়া হয় বা ভঙ্গ অবস্থায় থাকে সেই মেয়াদে প্রযুক্ত হইবে না : তবে শর্ত থাকে যে, ২ক পরিচ্ছেদে যাহা কিছু থাকুক না কেন, যেক্ষেত্রে ৭২(৪) অনুচ্ছেদের অধীন কোনো ভঙ্গ হইয়া যাওয়া সংসদকে পুনরাহ্বান করা হয় সেই ক্ষেত্রে এই পরিচ্ছেদ প্রযোজ্য ইহবে ।

 

২ক. পরিচ্ছেদ :

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার : ৫৮খ. ১

. সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়ার পর বা মেয়াদ অবসানের কারণে ভঙ্গ হইবার পর যে তারিখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কার্যভার গ্রহণ করেন সেই তারিখ হইতে সংসদ গঠিত হওয়ার পর নূতন প্রধানমন্ত্রী তাঁহার পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকিবে।

২. নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার যৌথভাবে রাষ্ট্রপতির নিকট দায়ী থাকিবেন।

৩. (১) দফায় উল্লিখিত মেয়াদে প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক বা তাঁহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা, ৫৮ঘ (১) অনুচ্ছেদের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রযুক্ত হইবে এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী তৎ-কর্তৃক উহা প্রযুক্ত হইবে ।

৪. ৫৫(৪), (৫) ও (৬) অনুচ্ছেদের বিধানাবলী (প্রয়োজনীয় অভিযোজন সহকারে) (১) দফায় উল্লিখিত মেয়াদে একইরূপ বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হইবে ।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন, উপদেষ্টাগণের নিয়োগ ইত্যাদি : ৫৮গ. ১. প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে প্রধান উপদেষ্টা এবং অপর অনধিক দশজন উপদেষ্টার সমন্বয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হইবে, যাহারা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন।

 

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা

 

২. সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়ার বা ভঙ্গ হইবার পরবর্তী পনের দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাগণ নিযুক্ত হইবেন এবং যে তারিখে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়া হয় বা ভঙ্গ হয় সেই তারিখ হইতে যে তারিখে প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন সেই তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়ার বা ভঙ্গ হইবার অব্যবহিত পূর্বে দায়িত্ব পালনরত প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার মন্ত্রিসভা তাঁহাদের দায়িত্ব পালন করিতে থাকিবেন ।

৩. রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত হইয়াছেন এবং যিনি এই অনুচ্ছেদের অধীন উপদেষ্টা নিযুক্ত হইবার যোগ্য তাহাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন : তবে শর্ত থাকে যে, যদি উত্তরূপ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিতে পারিবেন ।

৪. যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হইয়াছেন এবং যিনি অনুচ্ছেদের অধীন উপদেষ্টা নিযুক্ত হইবার যোগ্য তাঁহাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন :

তবে শর্ত থাকে যে, যদি উত্তরূপ অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণের মধ্যে সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত অনুরূপ বিচারককে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন।

৫. যদি আপীল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি, যতদূর সম্ভব, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের সহিত আলোচনাক্রমে, বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক এই অনুচ্ছেদের অধীনে উপদেষ্টা নিযুক্ত হইবার যোগ্য তাঁহাদের মধ্য হইতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন।

৬. এই পরিচ্ছেদে যাহা কিছু থাকুক না কেন, যদি (৩), (৪) ও (৫) দফাসমূহের বিধানাবলীকে কার্যকর করা না যায়, তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি এই সংবিধানের অধীন তাহার স্বীয় দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করিবেন।

৭. রাষ্ট্রপতি-

(ক) সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হইবার যোগ্য;

(খ) কোনো রাজনৈতিক দল অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত বা অঙ্গীভূত কোনো সংগঠনের সদস্য নহেন; হইয়াছেন;

(গ) সংসদ-সদস্যদের আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী নহেন এবং প্রার্থী হইবেন না মর্মে লিখিতভাবে সম্মত

(ঘ) বাহাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন।এইরূপ ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন।

৮. রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ অনুযায়ী উপদেষ্টাগণের নিয়োগদান করিবেন ।

৯. রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে স্বহস্তে লিখিত ও স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে প্রধান উপদেষ্টা বা কোনো উপদেষ্টা স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।

১০. প্রধান উপদেষ্টা বা কোনো উপদেষ্টা এই অনুচ্ছেদের অধীন উত্তরূপ নিয়োগের যোগ্যতা হারাইলে তিনি উক্ত পদে বহাল থাকিবেন না ।

১১. প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা এবং পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করিবেন এবং উপদেষ্টা মন্ত্রীর পদমর্যাদা এবং পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করিবেন।

১২. নতুন সংসদ গঠিত হইবার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তাঁহার পদের কার্যভার গ্রহণ করেন সেই তারিখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হইবে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যাবলী:

৫৮. ঘ.

১. নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসাবে ইহার দায়িত্ব পালন করিবেন এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিগণের সাহায্য ও সহায়তায় উক্তরূপ সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পাদন করিবেন এবং এইরূপ কার্যাবলী সম্পাদনের প্রয়োজন ব্যতীত কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবেন না।

২. নির্দলীয় তত্ত্ববধায়ক সরকার শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সংসদ সদস্যগণের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেরূপ সাহায্য ও সহায়তার প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ সকল সম্ভাব্য সাহায্য ও সহায়তা প্রদান করিবেন ।

সংবিধানের কতিপয় বিধানের অকার্যকরতা : ৫৮৪, এই সংবিধানের ৪৮(৩), ১৪১ক (১) এবং ১৪১গ (১) অনুচ্ছেদে যাহাই থাকুক না কেন, ৫৮খ অনুচ্ছেদের (১) দফার মেয়াদে নির্দলীয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের কার্যকালে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী বা তাঁহার প্রতিস্বাক্ষর গ্রহণান্তে কার্য করার বিধানসমূহ অকার্যকর হইবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ এ মুহূর্তে অনেকাংশেই প্রধান
বিচারপতির চূড়ান্ত রায়ের ওপর নির্ভর করছে।

এক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনায় আসছে সেগুলো হলো :

প্রথমত, আমরা যেহেতু আইনের শাসনে বিশ্বাসী সেহেতু এ বিষয়টিকেও আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া উচিত হবে না। বরং পবিত্র সংবিধানের পবিত্রতা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে যা করা দরকার তাই করা উচিত ।

দ্বিতীয়ত, কোর্টের রায় শিরোধার্য। সেক্ষেত্রে চূড়ান্ত রায় যদি বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিপক্ষে যায় তাহলে চলমান ধারার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিকল্প যা যা দরকার তাই করতে হবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, যে ব্যবস্থা আমাদেরকে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে তাকে আইনী মারপ্যাচের কারণে উপেক্ষা করা উচিত হবে না।

তৃতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে রয়েছে গণঅভীক্ষা। এ গণঅভীক্ষার বিপরীতে কেবল কোর্টের রায়কে অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থার পুরনো ধারা ফিরে আসলে জনগণ এজন্য রাজনীতিবিদদেরই দায়ী করবেন। আর এ দায়ভার আমাদের রাজনীতিবিদরা কতটা বহন করতে পারবেন তা অতীতের আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করলে বরং তাদেরই মঙ্গল হবে।

চতুর্থত, আমাদের বিচার বিভাগকে যেহেতু স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে বলা হয় এবং এ মামলাটি গত সরকারের আমলে দায়ের করা তাই এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের কোনো দায় না থাকারই কথা। তথাপি যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এ সরকারই প্রবর্তন করেছেন এবং এ ব্যবস্থার অধীনেই বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছেন সেহেতু গণঅভীক্ষার আলোকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বদৌলতে সরকার একে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে পারে।

 

উপসংহার :

সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের সম্মিলন না হলে একটি আদর্শ ও পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সেজন্য একদিকে গণঅভীক্ষা, অন্যদিকে আইনের শাসন এবং দুয়ের প্রতিফলনে যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের বিকাশ ত্বরান্বিত হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment