বাংলাদেশের জাতীয় সংহতির সমস্যা ও সম্ভাবনা রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশসমূহে জাতীয় সংহতির সমস্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা। ঔপনিবেশিক শাসনামলে এসব দেশে বিদেশী দখলদারিত্ব বিরোধী আন্দোলনের সময় কেন্দ্রাভিগ শক্তি অত্যন্ত প্রবল ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর এসব দেশে কেন্দ্রাতিগ শক্তি (Centrifugal Forces) প্রবল হয়ে ওঠে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও এ প্রবণতা দেখা যায়।
Table of Contents
বাংলাদেশের জাতীয় সংহতির সমস্যা ও সম্ভাবনা
এ সকল দেশে সাম্প্রদায়িক পরিচয়, ভাষাগত, ধর্মীয় পরিচয় আঞ্চলিক স্বার্থ প্রভৃতি পরিচয়কে প্রায়ই … ছাড়িয়ে যেতে দেখা যায়। ফলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতিতে ফাটল ধরে এবং জাতিগঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এখানে জাতীয় সংহতি নানা সমস্যার আবর্তে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষত বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংহতিই বেশি সমস্যামাপ্ত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য ও নেতৃত্বে অযোগ্যতা এ দেশের রাজনৈতিক ঐক্যকে করেছে সুদূর পরাহত। তাছাড়া এলিট শ্রেণীর প্রাধান্য ও ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য এ দেশের জনগণের ঐক্যের অনুভূতিকে নানাভাবে বিপর্যন্ত করছে। তবে শতকরা ৯৮ জন্মরও বেশি বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং দীর্ঘদিনের ধর্মীয় সহাবস্থানের ঐতিহ্য এ দেশের জাতীয় সংহতির অন্যতম অবলম্বন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
জাতীয় সংহতির ধারণা :
জাতীয় সংহতির ধারণাটি অত্যন্ত জটিল ও ব্যাপক। এর কোনো সামগ্রিক একক প্রতিচিত্র নেই। তবু সাধারণভাবে এটি সমাজের বিচ্ছিন্ন উপাদান বা শক্তিগুলোকে একটি সামগ্রিক এককে রূপায়ণকে বোঝায়। অন্য কথায়, জাতীয় সংহতি বলতে ছোট ছোট বিভিন্ন সমাজের একটি সংগঠিত জাতি হিসেবে পরিণত হওয়াকে বুঝায়। Earnest B Hass জাতীয় সংহতি বলতে বুঝিয়েছেন, ‘Process whereby political actors in several distinct national settings are persuaded to shift their loyalties, expectations and political activities toward a new centre, whose institutions posses or demand jurisdictions over the pre- existing national states.”
জোহান গালতুং-এর মতে, ‘সংহতি হচ্ছে সে সকল পদ্ধতি যেখানে দুই বা ততোধিক বিষয়ের সমন্বয়ে একটি নতুন বিষয় গঠিত হয়। যখনই বিষয়গুলো একীভূত হবে তখন তাদের মধ্যে সংহতি স্থাপিত হবে।’ অধ্যাপক মাইরন ওয়েনার বলেন, ‘বিখণ্ড চিন্তাধারাকে উচ্ছেদ করে একটি জাতীয়ভিত্তিক চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা করাই হলো জাতীয় সংহতি।’ তার মতে, জাতীয় সংহতির জন্য পাঁচটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি : ক. ভৌগোলিক জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি; খ. একটি জাতীয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা; গ. ন্যূনতম জাতীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি; ঘ. এলিট ও জনগণের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচানো এবং ঙ. সংহতি প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠান ও আচরণ গঠন।
সুতরাং জাতীয় সংহতি বলতে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর সমন্বয়কে বোঝাতে পারি : বিভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে একীভূতকরণ; একটি জাতীয় চেতনার সৃষ্টি; বিভিন্ন রাজনৈতিক একক ও বিশ্বাসগুলোকে একটি ভৌগোলিক কাঠামোর আওতার এনে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা; নাগরিকদের একটি সাধারণ রাজনৈতিক পদ্ধতির আওতায় সংঘবদ্ধ করা এবং শাসক ও শাসিতের মধ্যে সংহতি বিধান ।
অতএব, জাতীয় সংহতির বর্ণিত ধারণার প্রেক্ষিতে বলা যায়, জাতীয় সংহতি একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া এবং এর কতগুলো বিশিষ্ট দিক রয়েছে। যেমন—ক. জাতীয় একাত্মতা প্রতিষ্ঠা; খ. রাজনৈতিক সংহতি, গ. অর্থনৈতিক সংহতি; ঘ. সাংস্কৃতিক সংহতি এবং ঙ. ধর্মীয় সংহতি ।
বাংলাদেশের জাতীয় সংহতির সমস্যাবলী :
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জাতীয় সংহতির সমস্যা তত প্রকট না হলেও এ দেশে জাতীয় সংহতি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন-
ক. একাত্মতার সংকট :
জাতীয় একাত্মতার সংকট বাংলাদেশের জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে একটি অন্যতম অন্তরায়। এ পরিচয় বা একাত্মতার আবার কতগুলো দিক রয়েছে :
১. জাতীয় পরিচয়ের সমস্যা
বাংলাদেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ লোক বাঙালি হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাহাড়ি ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠী কখনোই বাঙালি জাতির সাথে মিশে যেতে চায় না। তারা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বাধীন পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আদায়কল্পে যে সংগ্রামের সূচনা করে তা বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দিয়েছে।
এমন কি গত প্রায় তিন দশক যাবৎ তারা সশস্ত্র সংগ্রাম লিপ্ত। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তি চুক্তি এক্ষেত্রে একটি অন্যতম মাইলফলক হলেও তার সফলতার মাত্রা বা হার খুবই নগণ্য। পাহড়িরা এ দেশে বাস করলেও তারা কখনোই মূল ভূখণ্ডের সাথে একীভূত হওয়াকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে চায় না। ফলে দেখা যায়, পাহাড়ি-বাঙালির এ বিভক্তিবোধ জাতির জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এমনকি এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিগত বিভেদেরও একটি বিশেষ উপলক্ষ ।
২. ধর্মীয় পরিচয়ের সমস্যা :
স্বাভাবিকভাবে আমরা এ দেশের সকল মানুষকে বাঙালি কিংবা বাংলাদেশী বলে আখ্যা দিলেও এ দেশের জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বতন্ত্র ধর্মীয় পরিচয় তাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে আছে।
বিশেষ করে ৮৫ শতাংশ মুসলমানের এ দেশে ১২-১৩ শতাংশ হিন্দু এবং ২-৩ শতাংশ অন্যান্য ধর্মের অনুসারী রয়েছে। তবে এ দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যকার সম্পর্ক জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করে বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে মোড় নেয়ার মতো কোনো অবস্থা কখনো সৃষ্টি করেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে সত্যি।
হিন্দুদের সাধারণভাবে কোনো একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর সাথে মিলিয়ে ফেলার প্রবণতা বিরোধী অন্য দলের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটায় স্বাভাবিকভাবেই। তাই দেখা যায়, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রে বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উঠিয়ে নিয়ে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগের কৌশলও অবলম্বন করে। ফলে সংখ্যালঘুর বিষয়টি জাতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রতিককালে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ।
খ. এলিট-জনতা ব্যবধান :
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এ দেশের এলিট শ্রেণী ও সাধারণ জনতার মাঝে ব্যাপক ব্যবধান বিদ্যমান । ফলে সমাজে দুটি শ্রেণীর জন্ম হয়েছে। কেন্দ্রীয় শ্রেণী ও প্রান্তীয় শ্রেণী । সুতরাং এখানে জাতিগঠনের ক্ষেত্রে একটা সাধারণ ধরন হলো, এখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ নেই। ফলে সমাজে সহযোগিতার পরিবর্তে কর্তৃত্ব কিংবা বিদ্রোহের মাত্রা প্রবল হচ্ছে ।
গ. রাজনৈতিক সংহতির সমস্যা :
নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখনো একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। ফলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও জনগণের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে ব্যাপক দুর্বলতা। যেমন—
প্রথমত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মূলত কর্তৃত্ববাদী। এখানে শাসকশ্রেণীর মানসিকতায় রয়েছে পরনির্ভরশীলতার প্রভাব। দীর্ঘদিনের পরাধীনতা আমাদেরকে এ বিষয়ে নানা নেতিবাচক উপসর্গে অভ্যস্ত করে তুলেছে।
পূর্বতন শাসকদের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকদেরও খোলামেলা সমালোচনা অপছন্দনীয় এবং সবসময় জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার ভয়ে তারা বিব্রত। এমতাবস্থায় শাসকশ্রেণী যেমন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দাবি ও সংগ্রামকে সহজভাবে নিতে পারে না, তেমনি জনগণও সরকারকে সম্পূর্ণরূপে সহযোগিতা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সাথে পরিচিত নয়। ফলে উভয় শ্রেণীর সমন্বয় ও সহযোগিতার ক্ষেত্র তেমন প্রসারিত হচ্ছে না ।
দ্বিতীয়ত, দেশের রাজনীতিতে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের সম্মিলিত পদচারণা ও আধিপত্য রাজনীতিতে শক্তিশালী দল, উপদল ও গোষ্ঠীর বিকাশকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে রাজনীতির যে সুশীল চরিত্র সেটা প্রস্ফুটিত হতে পারছে না। জনগণের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ হয়ে পড়েছে সীমিত। তাছাড়া সরকারের গণমুখী রাজনীতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে ক্রমশ আমলানির্ভর ও গণবিমুখ হয়ে পড়ছে। ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঘনিষ্ঠতা দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যের বিষয়টিও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের রাজনীতির আরেকটি অন্যতম নেতিবাচক উপসর্গ। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, শাসকশ্রেণীর স্বেচ্ছাচারিতা, সন্ত্রাস, আদর্শগত মতবিরোধ প্রভৃতি এ দেশের রাজনীতিকে সবসময়ই অস্থিতিশীল করে রাখে। ফলে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কোনো প্রচেষ্টাই সফল হয় না । এজন্য অবশ্য নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী।
চতুর্থত, গণতন্ত্রের মতো একটি সর্বজনীন মতবাদে বিশ্বাস ও এর ঐকান্তিক অনুসরণ জাতীয় ঐকা ও সংহতিকে অনেক মজবুত করতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাসের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
বিশেষ করে এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের ফলে গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ তেমন পায়নি । এমনকি স্বাধীনতার পর প্রায় তিন যুগ অতিক্রান্ত হতে চললেও গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র এক যুগ আগে। তাই গণতন্ত্রের শক্ত ভিত এ দেশে এখনো সেভাবে স্থাপিত হয়নি। ফলে এ দেশের রাজনীতিতে সবসময়ই সংকটাপন্ন অবস্থায় দেখা যায়।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটিই মজবুত নয় এবং এগুলো জনগণের ব্যাপক আস্থা অর্জন করতেও সমর্থ হয়নি। জনগণ এ দেশের সংসদ, নির্বাচন ব্যবস্থা, দল ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থাসহ সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে সন্ধিহান। ফলে দেখা যায়, এদের কোনোটিই জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রতীক হিসেবে জনগণকে ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয় না।
ষষ্ঠত, স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকালে স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতারা যেভাবে জনগণকে তাদের সম্মোহনী নেতৃত্বের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আর তেমন দেখা যায়নি। বিশেষ করে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ দেশের জনগণ যেভাবে একটি সমন্বিত নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছিল পরবর্তীকালে সে নেতৃত্ব যেমন পূর্বতন অবস্থান বজায় রাখতে পারেনি, তেমনি জনগণও তাদের ডাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যুক্তি খুঁজে পায়নি। ফলে এ দেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বের সংকট লেগেই আছে। আর এ সংকট জাতীয় সংহতিকে করেছে আরো বেশি সংকটাপন্ন।
ঘ. অর্থনৈতিক সংহতির সমস্যা :
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংহতিতেও চরম সংকট বিদ্যমান। যেমন— প্রথমত, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অসাম্য ও আয়ের বৈষম্য অত্যন্ত ব্যাপক। বিশেষ করে শহুরে অর্থনীতি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যকার পার্থক্য চরম। আবার শহুরে জনগণের আয়ের মধ্যেও ব্যাপক বৈষম্য ।
গুটিকয়েক লোক দেশের গোটা অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং শহরগুলোর বিশেষ কিছু এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকচিক্য চোখে পড়লেও মূলত, শতকরা ৬০-৭০ জন লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। ফলে দেখা যায়, জনগণের এ বহুরূপী আয় বৈষম্যের ফলে তাদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ডকে কোনো ঐক্যবদ্ধ জায়গায় আনা মুশকিল হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্যের এ ব্যাপকতা এ দেশের জনগণকে অধিকাংশ সময়ই তাদের জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজনের ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত রাখে। ফলে তারা জাতীয় কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ তেমন পায় না। তাদের এ উদাসীনতার ফলে জাতীয় সংহতি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।
ঙ. সাংস্কৃতিক সংহতির সমস্যা :
বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি কতগুলো উপাদানে সমৃদ্ধ, যা এদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত । আবহমানকাল থেকে এ দেশের মানুষ যে বাঙালি সংস্কৃতিকে লালন করেছে তা কেবল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই নয়, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা থেকেছে এ দেশের মানুষের অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এবং বিভ্রান্তির পরও বাঙালির সে চিরায়ত সাংস্কৃতিক পরিচয় মিলিয়ে যায়নি। তবে পশ্চিমা সংস্কৃতির আঘাতে এ দেশীয় সংস্কৃতি আজ ক্ষতবিক্ষত। ফলে সংস্কৃতিতে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা জাতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হচ্ছে। তাই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যে ঐক্যবদ্ধ ডাক সে ডাক ইদানীং তেমন প্রাণবন্ত মনে হয় না ।
বাংলাদেশে জাতীয় সংহতির সম্ভাবনা :
জাতীয় সংহতির যে সকল সমস্যার কথা আলোচিত হলো এগুলো একদিনের সৃষ্ট কোনো সমস্যা নয়। বরং জাতীয় ইতিহাসের বিবর্তন, জনগণের জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভাঙ্গাগড়ার যে ইতিহাস তারই ফল। তথাপি বাঙালি জাতির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের ঐক্যবদ্ধ চেতনা আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা ইত্যাদিকে পুঁজি করে আজও একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের প্রয়াসকে অর্থবহ করে তোলা যায়।
বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারা অনেকটা ম্রিয়মাণ হলেও এ দেশের জাতীয় ঐক্য আর সংহতির যে কোনো প্রয়াসকে কার্যকর করতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ ধারার সাথে মিলিয়ে দেয়া যেতে পারে। এতে সে আন্দোলন নিশ্চিতভাবে বেগবান হবে।
তাছাড়া এ দেশের ৮৫ শতাংশ লোক মুসলমান। সংখ্যাগরিষ্ঠ এ মুসলিম জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন যাবৎ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ দেশের হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর সাথে মিলেমিশে বাস করার যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে তাকে পুঁজি করেই এ দেশে ধর্মীয় বন্ধন সৃষ্টি সম্ভব। সেজন্য যে শ্রেণীটি বিচ্ছিন্নভাবে এ দেশের হিন্দুদের নির্যাতনের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে তাদের দমনের ব্যাপারে সরকারকে আরো কঠোর হওয়া আবশ্যক।
অন্যদিকে আমাদের রাজনীতিতে নব্বই-পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক যে ধারা সৃষ্টি হয়েছে সেটিও ক্রম অগ্রসরমান। পরপর তিনটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর স্থানীয় নির্বাচনগুলোও জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি সুষ্ঠু ধারায় সংযুক্ত হচ্ছে। তাছাড়া আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও মৌলিক কোনো বিষয়ে তেমন মতানৈক্য দেখা যায় না। যতটুকু বিভেদ সেটা নিছকই রাজনৈতিক কৌশল। আর যদিও আদর্শগত কিছু থাকে তা-ও মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। এর প্রমাণ নব্বই সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও এর পরবর্তী পর্যায়ে লক্ষ্য করা গেছে।

উপসংহার :
বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে বর্তমানের যে সংকটগুলোর কথা বলা হয় এদের মাত্রা পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও নেপালসহ যে কোনো দেশের তুলনায় নগণ্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা আমাদের অনেক যাতনা দিলেও তাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
জাতীয় পরিচয়ের যে সমস্যা সেগুলোর মাত্রা এবং মৌলিকত্ব তেমন নেই। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্য এটা পুঁজিবাদী বিশ্বের স্বাভাবিক প্রবণতারই অংশ। সেজন্য প্রচেষ্টাও চলছে যেন দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে একটি সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়। সুতরাং জাতীয় জীবনে সমৃদ্ধির জন্য যেটা দরকার তা হলো একটি সুন্দর সমাজ ও দেশ গড়ার প্রত্যাশাকে জাগিয়ে রাখা।
আরও দেখুনঃ