বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য রচনা রাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দাদের নাগরিক বলা হয়। যারা রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে তারাই নাগরিক। নাগরিকের মর্যাদাকে নাগরিকতা বলে।
Table of Contents
বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য
নাগরিক যদি যথাযথভাবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে তাহলে তার নাগরিকতার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। নাগরিক হলো সেই ব্যক্তি যে স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রে বাস করে, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে, রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল অধিকার ভোগ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে। শব্দগত অর্থে নগরের অধিবাসীকে নাগরিক বলে।
যেমন ঢাকার নাগরিক, লন্ডনের নাগরিক, দিল্লির নাগরিক । কিন্তু জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের ফলে নাগরিকতা কোনো নগরকে কেন্দ্র করে হয় না রবং জাতীয় রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে হয়। যেমন—বাংলাদেশের নাগরিক, ভারতের নাগরিক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ইত্যাদি। আর অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে নাগরিক জীবন বিকাশ লাভ করে। অধিকারের মাত্রা এবং কর্তব্য পালনের দ্বারা একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বরূপ জানা যায়। সুতরাং নাগরিক জীবন ও শাসন ব্যবস্থার উৎকর্ষতা অধিকার ও কর্তব্যের চর্চার মধ্যে নিহিত।
নাগরিক অধিকার :
অধিকার বলতে সাধারণভাবে ইচ্ছামতো কাজ করার ক্ষমতাকে বোঝায় । কিন্তু যথেচ্ছাচার অধিকার হতে পারে না। কারণ, তাহলে কেউ কাউকে খুন করলে সেটি তার অধিকার হয়ে যায়। পৌরনীতিতে অধিকার বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত কতগুলো সুযোগ-সুবিধাকে বোঝায়, যা ছাড়া ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে না। অধ্যাপক লাস্কি বলেন, ‘অধিকার হল সমাজ জীবনের সে সকল অবস্থা (সুযোগসুবিধা) যা ছাড়া মানুষ তার ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারে না।’ অধিকার সমাজ থেকে সৃষ্ট সমাজকল্যাণের মধ্যে অধিকারের তাৎপর্য নিহিত।
অধিকারকে প্রথমত দুভাগে ভাগ করা হয়। যথা :
(ক) নৈতিক অধিকার
(খ) আইনগত অধিকার।
আইনগত অধিকারকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয় ।
যেমন— সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ।
১. সামাজিক অধিকার :
নাগরিক জীবনের বিকাশ এবং ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষের জন্য রাষ্ট্রকে যে সকল অধিকার সংরক্ষণ করতে হয় তাকে সামাজিক অধিকার বলে। সামাজিক অধিকারগুলো নিম্নরূপ :
ক. জীবনধারণের অধিকার :
সকলের জীবন রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থার নামই জীবনধারণের অধিকার । খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুবন্দোবস্ত করা এবং কেউ যাতে কারো প্রাণহানি করতে না পারে তার জন্য আইনগত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সামাজিক অনুকূল পরিবেশে বসবাসের মাধ্যমে জীবনকে উন্নত করার মধ্যে জীবনধারণের অধিকার নিহিত।
খ. চলাফেরার অধিকার :
রাষ্ট্রের অখণ্ডতা বিপন্ন না করে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগকে চলাফেলার অধিকার বলে। একমাত্র রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে সরকার এ অধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে।
গ. সম্পত্তি ভোগের অধিকার :
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির সীমানার মধ্যে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি ভোগের অধিকার আছে। কেউ যাতে জোর করে অন্যের সম্পত্তি দখল করতে না পারে তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থার নামই সম্পত্তি ভোগের অধিকার।
ঘ. চুক্তি করার অধিকার :
বিষয় সম্পত্তি ও লেনদেন সংক্রান্ত চুক্তি করা নাগরিকের সামাজিক অধিকার । চুক্তির শর্ত সংরক্ষণ করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ঙ. মতামত প্রকাশের অধিকার :
রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সংহতির বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টি না করে যে কোনো ব্যক্তির যে কোনো মাধ্যমে মতামত প্রকাশ ও প্রচার করতে পারাকে মতামত প্রকাশের অধিকার বলা হয়। মতামত প্রকাশের মাধ্যমে নাগরিকবৃন্দ রাষ্ট্রের কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। এই অধিকার সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
চ. সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকার :
স্বাধীন ও নির্ভীকভাবে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ খবরাখবর প্রকাশ করার অধিকারকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলে। সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে জনমত গঠনের ব্যাপারে সংবাদপত্রের ভূমিকা অতুলনীয়। সুতরাং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা করা সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব।
ছ. সভা-সমিতির অধিকার :
সভা-সমিতির মাধ্যমে নাগরিকবৃন্দ তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের জন্য সভা-সমিতি করার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত। দেখতে হবে যেন এরূপ সভা-সমিতি দ্বারা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সংহতি বিপন্ন না হয় ।
জ. ধর্মীয় অধিকার :
নিজ নিজ চর্চা ও ধর্ম পালন করার স্বাধীনতার নামই ধর্মীয় অধিকার। যে কেউ তার নিজের ধর্ম পালন ও প্রচার করতে পারে। তবে অন্যের ধর্ম পালনে ও প্রচারে বাধা দিতে পারবে না। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সজাগ রাখতে হবে।
ঝ. আইনের চোখে সমান অধিকার :
আইন সকলের জন্য সমান ও সমভাবে প্রযোজ্য হবে। ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য একই প্রকার আইন ও বিচার ব্যবস্থার নামই আইনের চোখে সমান অধিকার।
ঞ. পরিবার গঠনের অধিকার :
পরিবার গঠন করার অধিকার সকল দেশেই একটি স্বীকৃত সামাজিক অধিকার। এ অধিকারের বলে বিবাহ, সন্তানাদির জন্মদান ও লালন পালন এবং পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ভোগ করা যায়।
ট. ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার :
ব্যক্তি ও জাতীয় পরিচয় প্রকাশের জন্য ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার অপরিহার্য। নিজের কথা অন্যকে বলা এবং দেশের শিল্প ও সংস্কৃতি অন্যের কাছে তুলে ধরার জন্য ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
ঠ. খ্যাতি লাভের অধিকার :
প্রত্যেক নাগরিক তার কর্ম প্রচেষ্টা ও দক্ষতার দ্বারা খ্যাতি লাভের অধিকারী। কেউ যাতে কারো খ্যাতি অর্জনের পথে বাধা দিতে না পারে এবং মানহানিকর কিছু করতে না পারে সেজন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে রাষ্ট্র মানহানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
উপরোক্ত সামাজিক অধিকারগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে সকলের জন্য অধিকার ভোগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে নাগরিক জীবন উন্নত ও বিকশিত হয়।
২. রাজনৈতিক অধিকার :
রাজনৈতিক অধিকারের মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্রের কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। রাজনৈতিক অধিকার যত বিস্তৃত হয় রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের মাত্রা তত বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের জন্য রাষ্ট্র ও সরকার যে সকল অধিকার সংরক্ষণ করে তাকে রাজনৈতিক অধিকার বলে । নিচে রাজনৈতিক অধিকারগুলো আলোচনা করা হলো :
ক. স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার :
রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সংহতি বিপন্ন না করে যে কোনো নাগরিক রাষ্ট্রের যে কোনো অংশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে। বসবাসের অধিকার নাগরিকের অন্যতম রাজনৈতিক অধিকার।
খ. নির্বাচনের অধিকার :
ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ভোট দেয়ার ও ভোট নেয়ার তথা প্রতিনিধি নির্বাচন করার এবং প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার অধিকারকে নির্বাচনের অধিকার বলে। সর্বজনীন ভোটাধিকার ব্যবস্থা সংরক্ষণের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার নাগরিকের ও অধিকার ভোগের সুযোগ দান করে।
গ. সরকারি চাকরি লাভের অধিকার :
জীবনধারণের জন্য নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি অফিস আদালতে চাকরি লাভের অধিকার একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক অধিকার।
ঘ. আবেদন করার অধিকার :
এই অধিকারের বলে যে কোনো নাগরিক তার বক্তব্য লিখিত আকারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জানাতে পারে। বিপদ আপন ও অভাব অভিযোগ থেকে বাঁচার জন্য যে কেউ সরকারের নিকট প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারে।
ঙ. বিদেশে অবস্থানকালে নিরাপত্তা লাভের অধিকার :
এই অধিকার বলে একজন নাগরিক বিদেশে অবস্থানকালে বিপদে পড়লে নিজ রাষ্ট্রের সাহায্য কামনা করতে পারে। বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
চ. সরকারের সমালোচনা করার অধিকার :
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকবৃন্দ সরকারের কাজের সমালোচনা করতে পারে। এটি একটি স্বীকৃত অধিকার। সরকার যদি নাগরিক স্বার্থ বিরোধী কোনো কাজ করে তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে।
৩. অর্থনৈতিক অধিকার :
জীবনধারণ ও জীবনকে উন্নত এবং অগ্রসর করে নেয়ার জন্য রাষ্ট্র যেসব আর্থসামাজিক অধিকার প্রদান করে তাকে অর্থনৈতিক অধিকার বলে। নিচে অর্থনৈতিক অধিকারগুলো আলোচনা করা হলো :
ক. কর্মের অধিকার
কাজ করে খাওয়া সকল নাগরিকের অধিকার। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া ও কাজ করার ক্ষমতাকে কর্মের অধিকার বলে। এই অধিকারের বলে উন্নত দেশে বেকার ভাতা দেয়া হয় ।
খ. ন্যায্য মজুরি লাভের অধিকার :
কর্মের অধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন ন্যায্য মজুরি নেয়া হয়। মজুরি এমনভাবে দিতে হবে যাতে কাজের মান, দায়িত্ব ও পরিমাণের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
গ. অবকাশ লাভের অধিকার :
একটানা কাজ করা কর্মের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করা এবং কাজের শেষে অবকাশ বা বিনোদনের ব্যবস্থা করাকে অবকাশ লাভের অধিকার বলে।
ঘ. শ্রমিকসংঘ গঠনের অধিকার :
শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য কলকারখানায় শ্রমিকসংঘ গঠনের অধিকার একটি স্বীকৃত অধিকার। এ অধিকার বলে শ্রমিক প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় এবং শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। শ্রমিকসংঘ শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার সংগঠন ।
নাগরিকের কর্তব্য :
নাগরিকের যেমন অধিকার আছে তেমনি কর্তব্যও রয়েছে। আইনের দ্বারা স্বীকৃত অধিকার ভোগ করতে গিয়ে যে সব দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে নাগরিক কর্তব্য বলে। কর্তব্য বলতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য কোনোকিছু করাকে বোঝায়। একজন নাগরিকের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সংহতি রক্ষা করার জন্য করা করা।
কর্তব্য প্রধানত দু প্রকার ।যথা :
(ক) নৈতিক এবং
(খ) আইনগত।
মানুষ আগ্রহভরে ও নৈতিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে দায়িত্ব পালন করে তাকে নৈতিক কর্তব্য বলে। আর আইনের দ্বারা আরোপিত বিধি নিষেধের মাধ্যমে যেসব কাজ করা বা না করা হয় তাকে আইনগত কর্তব্য বলে । আর অধিকার ভোগ করতে হলে এসব কর্তব্য পালন করতে হয় ।
কর্তব্যগুলো আলোচনা করা হলো :
ক. রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা :
আমরা প্রত্যেকে রাষ্ট্রের সদস্য। রাষ্ট্রের আদেশ ও নিষেধ মান্য করা সকল নাগরিকের কর্তব্য। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি রক্ষার জন্য বৈদেশিক আক্রমণ অথবা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সময় আমাদের সকলকে চরম ত্যাগস্বীকারের জন্য রাষ্ট্রের আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। রাষ্ট্রকে রক্ষা করাই নাগরিকের সবচেয়ে বড় কর্তব্য।
খ. আইন মান্য করা :
রাষ্ট্রের আইনের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সকল নাগরিকের পরিত্র : কর্তব্য। আইন না মানলে শৃঙ্খলা থাকে না। আর শৃঙ্খলা না থাকলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। কাজেই আমাদের প্রত্যেকের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ করার জন্য আইন মেনে চলা অন্যতম নাগরিক কর্তব্য।
গ. সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা :
ভোট দান একটি অন্যতম নাগরিক অধিকার। এই অধিকারকে সুষ্ঠুভাবে ভোগ করার জন্য সুচিন্তিতভাবে ভোট দান করা নাগরিক কর্তব্য। কারণ ভোট দানের মেধার ওপর শাসনব্যবস্থার উৎকর্ষতা নির্ভরশীল। আমরা যদি উত্তম ও যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারি তাহলে অযোগ্য ও অসৎ প্রতিনিধিদের দিয়ে কখনোই ভালো সরকার গঠন করা যাবে না। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে উপযুক্ত প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য যোগ্য প্রার্থীদের ভোট দিতে হবে।
ঘ. নিয়মিতভাবে কর প্রদান করা :
দেশের প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নমূলক কাজের জন্য নিয়মিতভাবে কর প্রদান করা সকল নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য।
ঙ. রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা :
রাষ্ট্রের গঠনমূলক ও সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা সকল নাগরিকের কর্তব্য। স্থানীয় সংস্থাগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করা, জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এবং রাষ্ট্র যখন যে কাজ দেয় সে কাজ করা নাগরিক কর্তব্য ।
চ. সন্তানদের সুশিক্ষিত করা :
জাতি গঠন ও নাগরিক গুণাবলী বিকাশের জন্য সন্তানদের সুশিক্ষিত করা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। নেপোলিয়ন একবার তার দেশে মায়েদের বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের উন্নত জাতি দান করব।’
ছ. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করা:
বর্তমান বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রই আর বিচ্ছিন্ন নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে রাষ্ট্রই আজ নিকট প্রতিবেশী। রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সকলের কর্তব্য হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৃষি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদান ও সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও অগ্রগতি নিশ্চিত করে বাসোপযোগী একটি সুন্দর বিশ্ব গড়ে তোলা ।
নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যের স্বরূপ :
নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য একটি সামাজিক ধারণা। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে কেবল রাষ্ট্রের নাগরিকই এ অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালন করতে পারে; তা সে জন্মসূত্রেই হোক কিংবা অনুমোদনসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের মাধ্যমেই হোক। আবার নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য একটি আইনগত ধারণা। কারণ তাতে থাকে রাষ্ট্রীয় আইনের স্বীকৃতি।
নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সব নাগরিকের জন্য সমান। তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য আলাদা হয় না কিংবা কখনো সামাজিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় না। তবে নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য শাশ্বত কিংবা চিরন্তন নয়। দেশ ও কালভেদে তাতে পার্থক্য হয়। সমাজ ও সভ্যতার স্তরভেদে নাগরিক অধিকারের পরিবর্তনও ঘটে থাকে।
নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক :
অধিকার ও কর্তব্য ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। অধিকার ও কর্তব্য শব্দগত দিক থেকে ভিন্ন হলেও তাৎপর্যগত দিক থেকে অভিন্ন। নিচে অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক আলোচনা করা হলো :
ক. অধিকার ও কর্তব্য একই বস্তুর দুটি দিক মাত্র :
অধিকার বলতে কর্তব্য এবং কর্তব্য বলতে অধিকার বোঝায়। তাই বলা হয় যে, অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত আছে (Rights imply duties)। কেউ যদি কোনো অধিকার ভোগ করতে চায় তবে তাকে কর্তব্য পালন করেই অধিকার ভোগ করতে হয়। লাঙ্কি যথার্থ বলেছেন যে, ‘ব্যক্তিত্বের পূর্ণ উপলব্ধির জন্য কিছু শর্তের প্রয়োজন। কিন্তু সেই সঙ্গে শর্তগুলো সম্পাদনের প্রয়োজন আরো বেশি। যেমন— কেউ যদি ভোট দানের অধিকার ভোগ করতে চায় তবে তাকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হয় অর্থাৎ ভোট দিতে হয়। সুতরাং অধিকার ও কর্তব্য একই বস্তুর দুটি দিক মাত্র। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি কল্পনা করা যায় না।
খ. অধিকার ও কর্তব্যের পরিধি পরস্পরকে সীমাবদ্ধ করে :
অধিকারের সীমা কর্তব্যের দাবি দ্বারা সীমাবদ্ধ অধিকার যদি অবাধ হয় তাহলে সেটি হবে স্বেচ্ছাচার। আর অধিকার যদি স্বেচ্ছাচার হয় তবে তা শুধু সবলেরা ভোগ করতে পারবে। দুর্বলের অধিকার সবলের দ্বারা কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। তাই সবলের অধিকার দুর্বলের প্রতি কর্তব্যের দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
গ. একজনের অধিকার অন্যজনের কর্তব্য :
কারো অধিকার বলতে যেমন তার কর্তব্য বোঝায় তেমনি একজনের অধিকার বলতে অন্যজনের কর্তব্য বোঝায়। যেমন আমার পথ চলার অধিকার আছে তার অর্থ এই যে, আমি চলব এবং অপরকে চলতে দেব। আবার আমি যখন পথ চলব তখন অন্যতম আমাকে চলার জন্য পথ করে দিবে। এরূপে একজনের অধিকার অন্যজনের কর্তব্যে পরিণত হয় । কাজেই অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক খুবই নিবিড়।
ঘ. অধিকার ও কর্তব্য সমাজবোধ হতে উদ্ভূত :
অধিকার ও কর্তব্য সমাজবোধ থেকে এসেছে। সমাজের মধ্যে এদের অস্তিত্ব বিদ্যমান এবং সমাজের মধ্যে এদের উপভোগ সম্ভব। অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালনের মধ্যে সমাজের মঙ্গল নিহিত। যেমন— সমাজ আমাকে শিক্ষিত করে আর আমি সমাজের কল্যাণে আমার শিক্ষাকে প্রয়োগ করি। তাই সমাজের বাইরে অধিকার ও কর্তব্যের অস্তিত্ব নেই । সমাজে বাস করতে গিয়ে মানুষ যেসব দাবি করে সেগুলো সমাজ কর্তৃক গৃহীত হয়ে অধিকার ও কর্তব্যে পরিণত হয়।
ঙ. রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন করলে নাগরিক অধিকার পাওয়া যায় :
রাষ্ট্র সকল অধিকারের উৎস। আমরা রাষ্ট্রের নিকট থেকে অধিকার লাভ করি। কিন্তু সে অধিকার ভোগ করতে হলে কর্তব্য পালন করতে হয় । রাষ্ট্রের আনুগত্য দেখানো, নিয়মিত কর প্রদান করা, রাষ্ট্রের আদেশ ও নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমেই আমরা রাষ্ট্রের নিকট থেকে অধিকার লাভ করি। রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে রাষ্ট্রের আহ্বানে চরম কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমাদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়।
নাগরিক যোগ্যতা অর্জন :
নাগরিক কর্তব্য সম্পাদনের যোগ্যতা নাগরিককেই অর্জন করতে হবে । এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করে স্বীয় বিচার-বুদ্ধির উৎকর্ষ সাধন ও আত্মবিশ্বাস অর্জন। সুনাগরিকতা অর্জনের জন্য খাঁটি দেশপ্রেমিক হতে হবে। দেশের নিরাপত্তা ও উন্নতি সাধনের জন্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকেই সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। মূর্খ, রুগ্ন ও দুর্বল নাগরিকের দ্বারা রাষ্ট্রের কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হতে পারে না। তাই প্রত্যেক নাগরিককে সুস্বাস্থ্য গঠন করতে হবে এবং উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করে শিক্ষিত হতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য :
বাংলাদেশে একটি উত্তম সংবিধান রয়েছে। এ সংবিধানে দেশের নাগরিকদের অধিকা ও কর্তব্যের পরিসীমা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ থেকে ৪৭-ক অনুচ্ছেদ পর্যন্ত নাগরিকের অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। অপরদিকে, সংবিধানের ২০ ও ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিক কর্তব্যের সুস্পষ্ট ভাষা বর্ণনা করা হয়েছে। কাজেই সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রতিটি নাগরিক নিজ নিজ অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকবে, এটাই সঙ্গত।
বাংলাদেশে নাগরিক কর্তব্য :
বাংলাদেশে নাগরিক অধিকারসমূহ ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়েছে এবং এসবের প্রয়োগ উচ্চ আদালতের মাধ্যমে অঙ্গীকার করা হয়েছে।
এই অধিকারগুলোর কয়েকটি হচ্ছে : আইনের চোখে সবাই সমান; ধর্ম, জাতি, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ অথবা জন্মস্থান নিয়ে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি না করা; রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে জনজীবনে নরনারীর সমানাধিকার; রাষ্ট্রের চাকরিতে সমান সুযোগ; আইনের সংরক্ষণের অধিকার; ব্যক্তিজীবন ও স্বাধীনতার অধিকার; বেআইনি গ্রেপ্তার ও আটকে রাখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা; বাধ্যতামূলক শ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা; চলাফেরায় স্বাধীনতা; সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা; সংঘ-সমিতি করার স্বাধীনতা; চিন্তা, বিচারবুদ্ধি ও বাকস্বাধীনতা; পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা; ধর্মের স্বাধীনতা; সম্পত্তির অধিকার এবং যোগাযোগের গোপনতা। বর্তমানে আমাদের দেশের অগণিত সমস্যা জাতীয় জীবনকে বিপর্যস্ত করছে।
এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেশের কর্ণধারদের হাতে ন্যস্ত থাকলেও জনগণ তা থেকে মোটেই বিচ্ছিন্ন নয়। তাই দেশকে সমৃদ্ধ করতে হলে এসব জনগণকে সুনগারিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নাগরিকরা যদি তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়, তবে দেশ শৃঙ্খলার মাধ্যমে উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। দেশের স্বার্থের পরিপন্থি চোরাচালান, কালোবাজারি ও দুর্নীতিপরায়ণতা রোধ করার দায়িত্ব নাগরিকদেরই পালন করতে হবে।
উপসংহার :
স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রকে উন্নত করে গড়ে তোলার দায়িত্বভার বর্তমানে আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে। তাই নাগরিক হিসেবে আমাদের সম্মুখে যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, সে বিষয়ে আমাদেরকে সদা সচেতন থাকতে হবে। দেশের অশিক্ষা ও কুশিক্ষা দূরীকরণে, দুঃখ-দারিদ্র্য লাঘবকল্পে প্রত্যেক নাগরিককেই যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই ব্যক্তি একজন আদর্শ নাগরিকের মর্যাদা লাভ করে । এ দায়িত্ব পালনে যারা অনীহা প্রকাশ করে, তারা যথার্থ নাগরিক নয়; বরং বলা যায়, তারা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
আরও দেখুনঃ