Site icon Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

বাংলাদেশে দুর্নীতি : কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার রচনা

বাংলাদেশে দুর্নীতি : কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। সমাজের রন্ধে রন্ধে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়া সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ভয়াল কালো থাবায় বিপন্ন আজ মানবসভ্যতা। এ সর্বনাশা সামাজিক ব্যাধির মরণ ছোবলে বর্তমান সমাজ জর্জরিত। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি, শিল্প, ব্যবসা- বাণিজ্যসহ সর্বত্রই চলছে দুর্নীতি।

 

 

Table of Contents

বাংলাদেশে দুর্নীতি : কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার

 

দুর্নীতির করালগ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত ও অনুজ্জ্বল। তাই বিশেষজ্ঞরা দুর্নীতিকে জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমাদের সবাইকে দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, এর জন্য দায়ী কারণ খুঁজতে হবে এবং তা মোকাবিলার উপায় উদ্ভাবনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

 

 

দুর্নীতি :

দুর্নীতি একটি ব্যাপক ও জটিল প্রত্যয়। দুর্নীতির গতিপ্রকৃতি বহুমুখী এবং বিচিত্র বলে এর সংজ্ঞা নিরূপণ জনি কাজ। দুর্নীতি সমাজের প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী বিশেষ ধরনের অপরাধমূলক আচরণ। দুর্নীতির সাথে পেশা, ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা, পদবি প্রভৃতি অপব্যবহার সংশ্লিষ্ট। আভিধানিক অর্থে দুর্নীতি হলো ঘুষ বা অনুগ্রহ দ্বারা জনকর্তব্য সম্পাদনে একাগ্রতার বিকৃতি বা ধ্বংস। নৈতিক প্রেক্ষাপটে বলা যায়, নীতিবিচ্যুত হওয়া বা কোনো গুণ ও পবিত্রতার অবমাননাই হলো দুর্নীতি।

আবার প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ। কিংবা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা অন্য কাউকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারী নিজের খেয়ালখুশিমতো সরকারি ক্ষমতা বা পদমর্যাদার অপব্যবহার করে বা টাকা-পয়সা এবং বস্তুগত ও অন্যবিধ উৎকোচাদির মাধ্যমে অন্যায় কোনো কাজ করে অথবা ন্যায়সঙ্গত কাজ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তার এরূপ কার্যকলাপ দুর্নীতি Social Work Dictionary-র সংজ্ঞানুসারে, Corruption is in political and public service administration, the abuse of office for personal gain, usually through bribery, extortion, influence pedding and special treatment given to some citizens and not to others’

অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সরকারি প্রশাসনে দুর্নীতি বলতে অফিস-আদালতকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য অপব্যবহার করাকে বোঝায়। সাধারণত ঘুষ, বলপ্রয়োগ বা ভয়প্রদর্শন, প্রভাব এবং ব্যক্তিবিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গণ প্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহারের দ্বারা ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনকে দুর্নীতি বলা হয়।

 

 

বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা :

বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। এ কালো ব্যাধির করালগ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত। বর্তমান সমাজে দুর্নীতির অবস্থান এমনই শক্তিশালী যে, দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতির কাছে অসহায় হয়ে একে তাদের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে ৮ হাজার মামলা ঝুলে আছে শুধু দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে।

গত ৩৪ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশ পরপর পাঁচ বার বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে দুর্নীতির জন্য। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে ২০০১, ২০০২, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫ এ পাঁচ বছর বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল বহু ত্যাগ-সংগ্রামের পর।

এ দেশে বিগত তিন দশকে আমাদের যা কিছু প্রশংসনীয় অর্জন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, জামানত ছাড়াই উন্নয়নমূলক ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, ডায়ারিয়া প্রতিরোধী ওরস্যালাইনের আবিষ্কার, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, নারী শিক্ষা ও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের প্রসার ইত্যাদি সবকিছুই যেন ম্লান করে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী আমাদের এই কলঙ্কিত উপস্থাপনের মাধ্যমে। পরপর তিনবার শীর্ষ দুর্নীতিবাজ জাতি হিসেবে এই পরিচিতি সারা বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

 

নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি :

আমাদের দেশে জাতীয় উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিভাবে দুর্নীতি বিরাজ করছে তা আলোচনা করা যেতে পারে।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি :

রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মূল চালিকাশক্তি। অথচ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই বর্তমানে ব্যাপকহারে দুর্নীতি চলছে। জনগণের সাথে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বরখেলাপ, ক্ষমতায় থাকাকালে নিজ পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাকে অন্যায়ভাবে নিজের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও নিজ দলীয় কর্মী সমর্থকদের স্বার্থে কাজে লাগানো, তাদেরকে নির্মাণকাজের ঠিকাদারি বা হাট-বাজারের ইজারা প্রদান এবং বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স দেয়া, ব্যবসায়ীমহলসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে কমিশন গ্রহণ ও চাঁদা আদায় এবং বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন অন্যায় সুবিধা প্রদান, সরকারি অর্থের অপচয় ও আত্মসাৎসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দুর্নীতি বর্তমানে এ দেশে স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।

 

প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি :

বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো সরকারি দপ্তর বিভাগই দুর্নীতিমুক্ত নয়। ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, অপচয় ও চুরি ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার, কাজে ফাঁকি দেয়া, স্বজনপ্রীতি, সরকার সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশাসনে ব্যাপকহারে দুর্নীতি হয়ে থাকে।

 

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি :

ব্যবসায়ী মহল কর্তৃক মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্যবাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায়, বিভিন্ন অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা, চোরাকারবার, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়, ওজনে কম দেয়া, সরকারি রেশনে কারচুপি করা, কর, শুল্ক, খাজনা ইত্যাদি ফাঁকি দেখাসহ এ ধরনের অর্থনৈতিক দুর্নীতি বর্তমানে বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলছে।

 

শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি :

পরীক্ষায় ব্যাপক নকলাকাতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ক্লাসে ভালোভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে পাঠদান, নিয়মিত ক্লাসে না আসা, দলীয় ভিত্তিতে অযোগ্য লোকদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়াসহ এ ধরনের অসংখ্য দুর্নীতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মানের চরম অবনতি ঘটেছে। ফলে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠছে না।

 

ধর্মীয় ক্ষেত্রে দুর্নীতি :

এ দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করেও নানা রকমের দুর্নীতি চলছে। জনসাধারণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা স্বার্থসিদ্ধি, অর্থ উপার্জন বা কাজ ধর্মীয় দুর্নীতির পর্যায়ভূক্ত বিভিন্ন ধরনের ধর্মব্যবসা, রোগমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণে ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানোও ধর্মীয় দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।

 

 

বেসরকারি খাতে দুর্নীতি :

শুধু সরকারি খাতে নয়, বেসরকারি খাতেও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে সরকারি সুবিধা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে সে টাকা বিলাস-বাসন বা অন্য কাজে ব্যবহার এবং বিদেশী ব্যাংকে জমা করা, ব্যাংক ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে পরিশোধ না কর, কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয়া শেয়ার মার্কেট কেলেংকারি ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঋণখেলাফী বর্তমানে বাংলাদেশে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

 

দুর্নীতি ও দেশের আর্থিক ক্ষতি :

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে দেশ ও দেশের জনগণ যে কি বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা নিচের পরিসংখ্যান থেকে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে:

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে গত সাড়ে তিন দশকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য এসেছে তার মাত্র ২৫ ভাগ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৭৫ ভাগই দুর্নীতিবাজ শাসক, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের পকেটে গেছে।

জাতীয় উন্নয়নে দুর্নীতির প্রভাব :

বাংলাদেশে দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার এবং এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ অন্যান্য ক্ষতির বিশালতার কারণে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণ দুর্নীতিকে বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ দুর্নীতি আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রকেই গ্রাস করে ফেলেছে।

যেমন-

ক. দুর্নীতি ও জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়া :

দুর্নীতির সবচেয়ে ক্ষান্ত হয় সরকারি খাতে জাতীয় উ প্রক্রিয়া। যে অর্থ ঋণ করে আনা হয় দেশের উন্নয়নের জন্য বা যে অর্থ সাহায্য হিসেবে আসে দরিদ্র জনগণের উপকারের জন্য তার সিকিভাগও সফলভাবে ব্যবহৃত হয় না। যে অর্থ উন্নয়নমূলক কর্মসৃষ্টি ও উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করার কথা তা চলে যায় দুর্নীতিবাজ আমলা ও শাসকগোষ্ঠীর পকেটে। দুর্নীতির ফলে অদক্ষ ঠিকাদারের হয়ে গড়ে ওঠে নিম্নমানের বিভিন্ন স্থাপনা। সরবরাহকারীরা কমদামের ও নিম্নমানের জিনিস বেশি মাসে সরবরাহ করে বিপুল অঙ্কের টাকা আয় করে। সরকারি কর্মকর্তাদের একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ঘুষ হিসেবে না দেয়া পর্যন্ত উন্নয়নমূলক কর্মসূচির ফাইল চাপা পড়ে থাকে।

 

খ. দুর্নীতি ও প্রবৃদ্ধি :

দুর্নীতি বাংলাদেশের উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে অন্যতম অন্তরায়। দেশীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাত যেমন কৃষি, শিল্প, ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক খাতের দুর্নীতি দেশজ উৎপাদনকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে থাকে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে দুর্নীতি বিষয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের দুর্নীতির ব্যাপকতা রোধ করা গেলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশ বেড়ে যেত এবং মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়ে ৭০০ ডলারে উন্নীত হতো। এমনকি বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন, দুর্নীতির ফলে যে অর্থ অপচয় হয় তা উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা গেলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতো ৪ শতাংশ বেশি।

 

 

গ. দুর্নীতি ও বিনিয়োগ :

ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রশাসনিক হয়রানি বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের একটি বড় অন্তরায়। ইউএনডিপির মতে, দুর্নীতি কমাতে পারলে বাংলাদেশে প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ অন্তত ৫ শতাংশ এবং বার্ষিক জিডিপির হার ০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। ইতিপূর্বে এডিবি এবং ইইউ বাংলাদেশকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছে যে, দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশ পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে না। এক হিসেবে দেখা গেছে, একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে যে দাপ্তরিক খরচ হয়, দুর্নীতির ফলে এ ক্ষেত্রে শতকরা ৩৫০ ভাগ খরচ বেশি হয় এবং অতিরিক্ত খরচের ভয়ে বিনিয়োগকারীরা এ দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয় না ।

 

ঘ.দুর্নীতি ও মানব উন্নয়ন :

জাতীয় উন্নয়নের জন্য মানব উন্নয়ন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অথচ মানব উন্নয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্নে। এজন্য মূলত দুর্নীতিই দায়ী। কেননা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, বয়স্ক সাক্ষরতাসহ মানব উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারিভাবে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তা যদি দুর্নীতিমুক্ত হয়ে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতো তাহলে মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থান নিঃসন্দেহে আরো ওপরে থাকতো।

 

ঙ. দুর্নীতি ও দারিদ্র্য বিমোচন :

দুর্নীতি ও দরিদ্র আমাদের জাতীয় জীবনে দুটি প্রধান সমস্যা। দারিদ্র্য অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে সহায়তা করছে, আবার দুর্নীতির ফলে আমরা দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। দুর্নীতি পদে পদে দারিদ্র্য বিমোচনের সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ প্রয়াসকে বাধাগ্রস্ত করছে। এমনকি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি যেটুকু হচ্ছে তাও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে ঠিকমতো পৌঁছছে না। দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ, এনজিও কর্মকর্তা ও ধনকুবেরদের যোগসাজশে তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরেই থেকে যায়। অথচ দুর্নীতির ফলে যে অর্থ অপচয় হয় তা যদি দারিদ্র্য বিমোচনে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যেত তাহলে কয়েক বছরেই বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হতো।

 

দুর্নীতির অন্যান্য প্রভাব :

দুর্নীতি আরো বিভিন্নভাবে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। দুর্নীতি…

এক কথায় বলা যায়, দুর্নীতি সামাজিক বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা, স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস, শঠতা, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে অনৈকা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। আর এসব কিছুর ফলাফল হলো একটাই আর তা হলো দুর্নীতি দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের সকল দিক থেকে পিছিয়ে দেয়। তাই আমাদের দুর্নীতির জন্য দায়ী কারণগুলো খুঁজে বের করে তা দূর করার উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।

 

 

বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতার কারণসমূহ :

পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি দুর্নীতি থাকলেও বাংলাদেশে এর প্রসার অত্যন্ত ব্যাপক ও ভয়াবহ। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

যেমন-

ক. ঐতিহাসিক কারণ :

বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবেই দুর্নীতি চলে আসছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিদেশী শাসক-শোষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য এ দেশে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগী সৃষ্টি করা হয়েছিল, যারা দুর্নীতি, প্রতারণা ও বঞ্চনার মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করত। ঔপনিবেশিক বেনিয়াদের সৃষ্ট দুর্নীতির প্রক্রিয়া আজও সমাজে ক্রিয়াশীল রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে।

ব্রিটিশ শাসনামলেও সে ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর পাকিস্তানি নব্য ব্যবসায়ীরা প্রচুর মুনাফার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। ফলে প্রশাসনিক কাঠামোতে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে দুর্নীতি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দুর্নীতির ধারা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

 

 

খ. আর্থিক অসচ্ছলতা :

আর্থিক অসচ্ছলতা ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ। দারিদ্র্যের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ সমাজে স্বাভাবিক উপায়ে মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে অস্বাভাবিক উপায় অবলম্বন করছে, যার প্রভাবে সমাজে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে।

 

গ. উচ্চাভিলাষী জীবনের মোহ :

রাতারাতি আর্থ-সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা এ দেশে দুর্নীতি বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ। স্বল্পসময়ে অধিক সম্পদের মালিক হওয়ার প্রচেষ্টায় সমাজের উচ্চ শ্রেণী স্ব স্ব ক্ষমতাও পেশাগত পদবির অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি করে থাকে।

 

ঘ. বেকারত্ব :

বাংলাদেশে ভয়াবহ বেকারত্বের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজে দুর্নীতি প্রসারিত হচ্ছে। বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য অনেকে অবৈধ উপায়ে এবং ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করে। আবার চাকরি পাওয়ার পর তারাও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের সাথে জড়িয়ে পড়ে। আর এর ফলে দুর্নীতি ক্রমশ বাড়তেই থাকে ।

 

ঙ. অসম অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা :

বাংলাদেশে অর্থ হলো সামাজিক মর্যাদা পরিমাপের প্রধান মানদণ্ড। আমাদের সমাজে যার যত বেশি অর্থ সে-ই তত প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মর্যাদার অধিকারী। সামাজিক মর্যাদা লাভের অসম এই অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সমাজে দুর্নীতি বিস্তারে সহায়তা করছে। সৎপথে অর্জিত অর্থের মাধ্যমে দ্রুত সম্পদশালী হওয়া সম্ভব নয় বিধায় অনেকে বাধ্য হয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে রাতারাতি ধনী হওয়ার চেষ্টা করে।

 

চ. রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা :

বাংলাদেশে দুর্নীতি বিস্তারে বিরাজমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বিশেষভাবে দায়ী। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার অভাব, অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার বদল এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা দুর্নীতি বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে ব্যয় করে ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়। নির্বাচিত হবার পর ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় ওঠানোর চেষ্টা করা হয়। আবার রাজনৈতিক পরিচিতির সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতিবাজরা ব্যাপকভাবে দুর্নীতি করার চেষ্টা করে।

 

ছ. অপর্যাপ্ত বেতন ও পারিশ্রমিক

আমাদের দেশে কর্মজীবী মানুষদের বেতন ও পারিশ্রমিক চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত। ফলে তারা তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য অর্থ আত্মসাৎ মুখ বা বিকল্প কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে। বাংলাদেশে স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারীদের মাঝে দুর্নীতি পরায়ণতা আসার পেছনে অপর্যাপ্ত বেতন কাঠামো মুখ্যত দায়ী।

 

জ. দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধের অভাব

সদাজাগ্রত দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজে দুর্নীতি গড়ে উঠতে পারে না। যারা দেশ এবং জাতির উন্নয়ন ও স্বার্থ সম্পর্কে সদা সচেতন তারা দুর্নীতি থেকে নিজেরা বিরত থাকে, অন্যকেও দুর্নীতি থেকে বিরত রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থকে দেশ ও জাতির স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয় বিধায় সর্বক্ষেত্রেই দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে।

 

ঝ. আইনের অস্পষ্টতা

অনেক সময় প্রচলিত আইনের অস্পষ্টতা বা আইনের ফাঁকের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতি করা হয়। জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে এরূপ দুর্নীতি বেশি পরিলক্ষিত হয়। আবার অনেক সময় জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে আইনের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়েও দুর্নীতি করা হয় ।

 

ঞ. দুর্নীতি দমনে সদিচ্ছার অভাব

দুর্নীতি, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য চাকুরিচ্যুত বা বিচারের সম্মুখীন করার জোরালো ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। দুর্নীতিবাজদের সাথে শাসকগোষ্ঠীর গোপন আঁতাত থাকায় শক্ত হাতে দুর্নীতি দমন করার ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার অভাব লক্ষ্য করা যায়। দুর্নীতি দমনের প্রতি সরকারের এই শিথিলতার ফলে বাংলাদেশে দুর্নীতি দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।

 

ট. নৈতিক অবক্ষয়

সর্বোপরি বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রসারের অন্যতম প্রধান কারণ হলো এ দেশের জনগণের মাঝে নীতি, নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটা। বর্তমানে এ দেশের জনগণের মাঝে নৈতিকতার এমনই অবক্ষয় ঘটেছে যে তারা দুর্নীতিবাজদের প্রতি সহনশীল মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিবাজদের প্রতি সামাজিক ঘৃণা এখন আর জোরালোভাবে লক্ষ্য করা যায় না।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

দুর্নীতি দমনের উপায়সমূহ

বর্তমানে দুর্নীতি সমস্যা আমাদের জাতীয় জীবনে ক্যান্সারস্বরূপ বিস্তার লাভ করেছে। তাই বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে সমাজের সর্বস্তর থেকে দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করার বিষয়টি এক নম্বর অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। দুর্নীতি প্রতিরোধ করা রাষ্ট্রের পবিত্র ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। আর এজন্য প্রয়োজন বলিষ্ঠ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কঠোরভাবে আইন ওয়ণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গঠন। বাংলাদেশে ব্যাপক বিস্তৃত দুর্নীতি প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করার জন্য নিম্নলিখিত উপায়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

 

১. দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন

বাংলাদেশে সর্বস্তরের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত সকল প্রাসঙ্গিক ইস্যু মূল্যায়ন এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটনের জন্য দক্ষ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ নাগরিকদের সমন্বয়ে অনতিবিলম্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এই টাস্কফোর্স দুর্নীতি দমনের একটি বিশদ কর্মসূচি সুপারিশ করবে। সুপারিশ অনুসারে দুর্নীতি দমনের জন্য ব্যাপকভাবে Operation. Clean Corruption শুরু করতে হবে।

 

২. ন্যায়পালের গম বাস্তবায়ন

বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনের জন্য ন্যায়পালের পন বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন সংকারি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কর্তৃপক্ষের কিদ্ধে সাধারণ নাগরিকের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত নিরপেক্ষভাবে সম্পাদনের জন্য ন্যায়পালের অফিস প্রতিষ্ঠা করা দরকার। ন্যায়পালকে রাষ্ট্রের যে কোনো বিভাগের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের তদন্ত করার এবং জবাবদিহিতা আদায় করার ক্ষমতা দিতে হবে। ন্যায়পালের পদ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন ক্যালে দরকারি প্রশাসনযন্ত্রে নিরপেক্ষ শাভিত্ব পালন ও জবাবদিহিতার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সহজতর হবে।

 

৩. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা

দুর্নীতি প্রতিরোধের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। এজন্য শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ থেকে যুক্ত আইনের অধীন পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে তারা দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট মামল মোকদ্দমা বিচার নিষ্পত্তি করতে পারেন। একই সাথে দুর্নীতিবাজদেরকে আদালতে হাজির করার অধিকার এবং আদলতের রায় কার্যকর করার পূর্ণক্ষমতাও বিচার বিভাগকে দিতে হবে।

 

৪. স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন

দুর্নীতি দমনে নিয়োজিত সরকারের বিশেষ বিভাগ দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে পুনর্গঠন করে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে তা কার্যক্রম চালাতে পারছে না। এ কমিশনকে সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে।

 

৫. সরকারি নিরীক্ষা কমিটি গঠন

রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী বিভাগের আয়-ব্যয়ের ধারাবাহিক ও নিয়মিত পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত জনবলসহ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারি নিরীক্ষণ কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। কারণ রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী বিভাগের বাজেটের ওপর আইনগত নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এজন্য সরকারি পর্যায়ে নিরীক্ষণ কমিটি পঠন করেও দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যেতে পারে ।

 

৬. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সৎ ও আইনগত নির্দেশনা

বাংলাদেশে রাজনৈতিক আবরণে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বেশি দুর্নীতি হয়ে থাকে। তাই বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সরকারি আমলাদের সততার সঙ্গে আইনগত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের নির্দেশনা দান করলে তা দুর্নীতি হ্রাসে সহায়ক হবে। কারণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সততা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, দেশপ্রেম ও কার্তব্যনিষ্ঠা জনগণের মধ্যে দুর্নীতি বিরোধী মূল্যবোধ ও নৈতিকতা গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে।

 

৭. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা

দুর্নীতি দমনের পূর্বশর্ত হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোনোভাবেই যাতে শান্তি এড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্য দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট আইনের কঠোর প্রয়োগ দুর্নীতির প্রবণতা হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আইনের ফাঁক বা অস্পষ্টতার সুযোগে কেউ যাতে দুর্নীতি করতে বা দুর্নীতি করে শান্তি এড়িয়ে যেতে না পারে সোনা সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন, সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং কেউ আইনের ডর্থে নয়- সমাজে এরূপ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। দুর্নীতিবাজ সমাজের যে কোনো শ্রেণীরই হোক না কেন, তাকে আইনের সম্মুখীন হতে হবে এরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে তা দুর্নীতির সহায়ক হবে।

 

৮. আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যহীনতার জবাবদিহিতার ব্যবস্থাকরণ

দুর্নীতি দমনের উত্তম ও কার্যকর ব্যবস্থা হলো সরকারি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার সামঞ্জসাহীনতা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কঠোর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এসব ক্ষেত্রে আয়ের উৎস সম্পর্কে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান করা হলে দুর্নীতি বেরিয়ে আসে। সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বায়ের হিসাব যথাযথভাবে নেয়া হলে দুর্নীতি স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পাবে।

 

৯. দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কটকরণ

অনেক সময় পেশাগত বা ব্যবসায়িক দিক থেকে সমাজের মানুষ অতি সহজে দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে পারে। ঘুষখোর, সুদখোর. চোরাচালানি প্রভৃতি শ্রেণীকে সামাজিকভাবে বয়কট ও তাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হলে দুর্নীতির প্রবণতা হ্রাস পাবে। এসব শ্রেণীর সাথে সামাজিক সম্পর্কচ্ছেদ করার পদক্ষেপ সামাজিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

 

১০. পর্যাপ্ত বেতন ও পারিশ্রমিক প্রদান

আমাদের দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন তাদের প্রয়োজন ও চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত বলে অনেক সময় তারা তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে। তাই তাদের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য বাজারদরের সাথে সমাজস্যপূর্ণ এবং প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত বেতন ও সুযোগ সুবিধা তাদের জন্য নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় তাদের দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।

 

১১. দুর্নীতির বিরুদ্ধে নৈতিক ও সামাজিক চেতনা সৃষ্টি

দুর্নীতি দমনের আদর্শ এবং সর্বোৎকৃষ্ট। উপায় হলো মানুষের মাঝে সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত করা। কারণ নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তি কখনো দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে না। তাই ছেলে-মেয়েদেরকে সামাজিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, নীতি ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার মানসিকতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলার শিক্ষা প্রদান করতে হবে, যাতে করে ছোটবেলা থেকেই তাদের মাঝে দুর্নীতি ও অনিয়মকে ঘৃণা করার মানসিকতা গড়ে ওঠে। এজন্য পারিবারিক পর্যায় থেকে উচ্চ শিক্ষার স্তর পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

 

উপসংহার

ওপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবনের সর্বাংশ আজ দুর্নীতির কবলে নিমজ্জিত। দুর্নীতির কালো হাত সমাজ জীবনের সকল দিককে গ্রাস করেছে। দুর্নীতিই বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। দুর্নীতিই আমাদের সকল অর্জন এবং জাতীয় উন্নয়নের সকল প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। তাই জাতীয় উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে একটি সমৃদ্ধশালী ও মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য আমাদেরকে দুর্নীতি নামক এই সর্বনাশা ও সর্বগ্রাসী সামাজিক ব্যাধির মূলোৎপাটনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version