Site icon Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

বাংলাদেশে নগরায়ন রচনা

বাংলাদেশে নগরায়ন

বাংলাদেশে নগরায়ন রচনার একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আশা করি এটি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। তবে আমরা রচনা মুখস্থ করায় নিরুৎসাহিত করি। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি একটা ধরনা দেবার জন্য। এখান থেকে ধারণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে নিজের ভাষায় রচনা লিখতে হবে।

নগরায়ন প্রক্রিয়া বর্তমান বিশ্বের প্রগতি ও উন্নয়নের অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত। বড় বড় শহরগুলো সাধারণত আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা ও প্রশাসনের গতিশীল প্রাণকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। শুধু তাই নয়, নগর আধুনিক মননশীলতা, সংস্কৃতিচর্চা, উদ্ভাবন ও সচেতন জীবনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি অনুশীলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণে বিশ্বব্যাপী নগরায়ন ঘটে চলেছে দ্রুত, গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও অবকাঠামোর রূপান্তর ঘটছে প্রতিনিয়ত।

 

 

Table of Contents

বাংলাদেশে নগরায়ন

অনেকে মনে করেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে নানা আবিষ্কারের মধ্যে কৃষির পরেই নগরের স্থান। নগরের উৎপত্তি এবং প্রসারের ফলে মানুষ আদিম অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করেছে । জীবনকে সহজ এবং উপযোগী করে তোলার ব্যাপারে নগরের দান অপরিসীম।

নগরায়ন

নগরায়নের ইংরেজি প্রতিশব্দ Urbanization। এই Urban শব্দটির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, The concentration of people in cities and towns Beaujeau Gamer এবং Chabor নগরায়নের সংজ্ঞায় বলেন, ‘Its a continuos and dense agglomeration of people and dwellings.

নেলস এন্ডারসন নগরায়ন সম্পর্কে বলেন, ‘নগরায়ন মানুষের চিন্তা, ব্যবহার ও মূল্যবোধের পরিবর্তন সাধন করে। এটি শুধু কোনো ব্যক্তি বা দলের পরিবর্তন নয়, বরং কাজের প্রতি মানুষের মনোবৃত্তির এবং শ্রমবিভাগের ক্রমাগত পরিবর্তন। সংকীর্ণ অর্থে নগরায়ন বলতে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে জনসংখ্যার কেন্দ্রীভূত হওয়াকে বোঝালেও এর সাথে উৎপাদন ভোগ ও বণ্টন ব্যবস্থা, ব্যবহারিক রীতিনীতি ও কর্মপ্রক্রিয়া গভীরভাবে জড়িত।

নগরায়ন কেবল ভৌগোলিক বা অবকাঠামোগত পরিবর্তন নয়। এটি প্রচলিত পেশা বা বৃত্তির পরিবর্তন, নতুন রীতিনীতি ও মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটায় এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রায় মৌলিক পরিবর্তন বয়ে আনে। এ প্রসঙ্গে The Social Work Dictionary-র সংজ্ঞাটি প্রণিধানযোগ

A social trend in which people adopt the lifestyles, residential patterns and cultural values of those who live in or near cities.

নগরায়ন যুগপৎ বস্তুগত এবং অবস্তুগত পরিবর্তনের সমন্বিত ফলাফল । নগরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত জনগোষ্ঠী নতুন ধরনের অবকাঠামো, সংস্কৃতি, আচরণ ও জীবনযাত্রার জন্ম দেয়। সার্বিকভাবে বলা যায়, ধারাবাহিক, দীর্ঘমেয়াদি এবং অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্থানান্তরের ফলে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা এবং ভৌত কাঠামোর বিকাশ ঘটলে, তাকে নগরায়ন বলা হয়।

 

 

নগরায়নের নির্ধারকসমূহ

নগরায়ন প্রক্রিয়ার নির্ধারক হিসেবে যেসব উপাদান ভূমিকা পালন করে সেগুলোকে নগরায়নের নির্ধারক বলা হয়। নগরায়নের নির্ধারকসমূহ নগরায়নের সম্প্রসারণ, নগরের শ্রীবর্ষন, নগরের ভিত্তি, নগরের আকার, নগরীয় কৃষ্টি ও সভ্যতা গড়ে তুলতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। নগরায়নের নির্ধারকসমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে

ক. জনমিতিক নির্ধারক,

খ. অর্থনৈতিক নির্ধারক,

গ. ভূমি, গৃহায়ন ও সেবামূলক নির্ধারক

ঘ. স্বাস্থ্য নির্ধারক ইত্যাদি ।

নগরায়নের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

নগরায়নের ইতিহাস সুপ্রাচীন। শিল্পায়ন নগরায়নের গতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করলেও শিল্প বিপ্লবের আগেও অনেক প্রাচীন ও সমৃদ্ধ নগর সভ্যতার সন্ধান। পাওয়া যায়। নগরায়নের দ্রুত গতি ও বিস্তৃতি সাম্প্রতিক হলেও এর উন্মেষ ঘটেছে বহু আগে। প্রাক- শিল্প নগর সভ্যতার অন্যতম উদাহরণ হলো মহেনজোদারো, সিন্ধু, মেসোপটেমিয়া, ট্রয়, এথেন্স, গ্রিস, মিশর ও জাপানের অগণিত শহর।

এসব শহরের স্থাপত্য, গঠন, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা আধুনিক শহরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তবে মধ্যযুগে নগর সভ্যতা ছিল। অবহেলিত, পরিত্যক্ত এবং মৃতপ্রায়। শিল্পবিপ্লব নগরায়নে প্রাণসঞ্চার করে এবং বিংশ শতাব্দীতে এসে তা পূর্ণতা লাভ করে।

শিল্পায়ন নগরায়নের প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শিল্পবিপ্লব ও নগরায়নের প্রত্যক্ষ ফলাফল হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থায় যান্ত্রিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, ভারী বৃহৎ শিল্পের বিকাশ, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বহুমুখী বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ইত্যাদি। উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনীতির এই পরিবর্তন প্রচলিত সমাজ কাঠামোকে আমূল পাল্টে দেয় এবং সম্পূর্ণ নতুন এক নাগরিক সভ্যতার জন্য হয়।

শিল্পবিপ্লবের পরে নগরে শিল্পকলা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত অর্থনীতির সুব্যবস্থিত সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। নগরায়নের ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এতে নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সমাজ কাঠামোতে। ১৯৪৫ সালের পর থেকে শিল্পায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছাড়াও আরো নানা কারণে নগরায়নের গতি অত্যন্ত দ্রুত হয়ে উঠেছে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশসমূহেই নগরের সম্প্রসারণ ঘটেছে ব্যাপকভাবে। এই দ্রুত বিকাশমান নগরায়নকে এখন তাই Urban revolution হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

 

 

বাংলাদেশে নগরায়ন

চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাংয়ের বিবরণ মতে, প্রাচীন বঙ্গদেশে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে চারটি রাজ্য ছিল। সেগুলো হলো পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, তাম্রলিপ্ত এবং কর্ণসুবর্ণ। তখন বঙ্গদেশের রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। দেশটি গৌড় নামে পরিচিত ছিল। বল্লাল সেনের সময় বর্তমান বঙ্গদেশ রায়, বরেন্দ্র, বাগড়ী ও বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। তবে হিন্দু যুগে সমগ্র বঙ্গদেশের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। নগরায়নের ক্রমধারা বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন শাসন আমল হিসেবে বিশ্লেষণ তাই যুক্তিযুক্ত। সে হিসেবে নগরায়নের ধারাগুলো হলো

১ প্রাচীনকালের নগরায়ন

২. মধ্যযুগের নগরায়ন

৩. ইংরেজ আমলের নগরায়ন

৪. পাকিস্তান আমলের নগরায়ন

৫. সাম্প্রতিককালের নগরায়ন প্রভৃতি।

বাংলাদেশে নগরায়নের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ দেশে দ্রুত, অপরিকল্পিতভাবে ব্যাপক নগরায়ন ঘটছে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের সংখ্যা ৫২২টি। ১৯৪১ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৯টি। ১৯৫১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে এ সংখ্যা ৬৩টি এবং পরবর্তী ৪০ বছরে তা ব্যাপক গতিতে বৃদ্ধি পেয়ে ৫২২-এ উন্নীত হয়। জনসংখ্যার কাঠামো অনুযায়ী।

শ্রেণীবিন্যাস করলে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালের আগে এ দেশে কোনো মিলিয়ন সিটি ছিল না। ১৯৭৪ সালে ঢাকা এবং ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম মিলিয়ন সিটি হিসেবে আখ্যায়িত হয়। ১৯৯১ সালে খুলনা তৃতীয় বৃহত্তর শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২৫,০০০-এর কম জনসংখ্যার ছোট শহরগুলো বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি এবং এগুলোর সংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৪১ সালে ছোট শহর ছিল মাত্র ৪২টি এবং ১৯৯১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪০৫টি।

শহরাঞ্চলের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশে নগরবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও বাড়ছে। ১৯৪১ সালে মাত্র ১.৫৪ মিলিয়ন লোক ছিল নগরবাসী। পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা প্রায় ২০ গুণ (২২.৪৫ মিলিয়ন) বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সাল নাগাদ নগরায়নের বিকাশের হার কিছুটা মন্থর হলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে নগরবাসীর সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশে নগরায়নের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে নগরগুলোতে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা কেন্দ্রমুখী ও ভারসাম্যহীন। দেশের চারটি মেট্রোপলিটন (১৯৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী) শহরে মোট জনসংখ্যার ৪৬% বাস করে। এর মধ্যে ঢাকাতেই বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় ৯ মিলিয়ন যা ২০২৫ সাল নাগাদ ২৫ মিলিয়নে রূপ নিতে পারে।

এছাড়া নগরায়নের স্তর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের সব অঞ্চলে নগরায়নের বৃদ্ধি বা বিকাশ সুষম বা একই মাত্রার নয়। ঢাকায় নগরায়নের হার সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে কম নগরায়নের হার লক্ষ্য করা গেছে টাঙ্গাইলে। সার্বিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে নগরায়নের বিকাশ ও সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া অনেকাংশেই ভারসাম্যহীন এবং অসম

নগরায়নের কারণ

বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়নের কারণগুলো নিম্নরূপ

প্রথমত, জনসংখ্যার তুলনায় মৃত্যুহার কম হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, আর্থ-সামাজিক সংকটের কারণে বিশেষ করে জনসংখ্যার চাপ, আর্থিক সংকট তথা ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে নগরমুখী হচ্ছে। ফলে দিন দিন নগরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ।

তৃতীয়ত, গ্রাম এলাকায় নদীভাঙন।

চতুর্থত, আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন।

পঞ্চমত, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ইত্যাদি।

 

 

নগরায়নের নীতিমালা

বাংলাদেশে প্রচলিত নগরায়নের নীতিমালাগুলোকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যায় ক. জাতীয় গৃহায়ন নীতি, খ. ভূমি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ।

ক. জাতীয় গৃহায়ন নীতি

দেশে আবাসন সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে জাতীয় গৃহায়ন নীতির দেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব ও কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে–

১. নগর এলাকায় বসবাসকারী সকল স্তরের মানুষের জন্য গৃহায়ন নীতি যাতে সহজলভা হয় সে লক্ষ্যে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, সামাজিকভাবে অবহেলিত, সহায়-সম্বলহীন মহিলা ও ব্যক্তি যাতে সহজে একটি গৃহের মালিক হতে পারে তার অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে।

২. নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনয়া গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সুবিধা যাতে ভোগ করতে পারে সেজন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

৩. সহজভাবে জমি রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

৪. দেশব্যাপী সুষম নগরায়নের লক্ষ্যে বিকেন্দ্রীকরণ নীতির প্রস্তাব রাখা হয়েছে ইত্যাদি।

খ. ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি

নগরীয় চাহিদা অনুযায়ী সড়কের জন্য ভূমি অধিকার, ভূমির মালিকান স্বত্ব ও জমি হস্তান্তর সংক্রান্ত জটিলতা পরিহার করা, নগরীয় জমির অনিয়ন্ত্রিত তথ্যের অভাব পরিহার করা, নগরীয় খাসজমির সার্বিক হিসাব ও তার রাষ্ট্রীয় মালিকানা নিশ্চিত করা প্রভৃতি বিষয় ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতির আওতায় আনা হয়েছে।

জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে নগরায়নের গুরুত্ব

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নগরায়নের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নগরায়নের ফলে দেশে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা, স্থাপনা, ব্যবসা কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে ওঠায় নতুন নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। নগরায়নের ফলে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়

১. যোগাযোগের ক্ষেত্রে নগরায়ন

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নে নগরায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাস্তাঘাট, সেতু, রেললাইন প্রভৃতি উন্নয়নের সাথে নগর কেন্দ্রের উন্নয়নের সম্পর্ক বিদ্যমান।

২. কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা বেকারত্ব। এ সমস্যা সমাধানে নগরায়ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

৩. অর্থনৈতিক কার্যক্রমে

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কার্যক্রমে নগরায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে

৪. অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে

অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নগরায়ন বেকারত্ব মোচন ও জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করছে।

৫. সামাজিক ক্ষেত্রে নগরায়ন

নগরায়নের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ সেবা, বিশুদ্ধ পানি, উন্নত পয়ঃব্যবস্থা ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয়।

 

 

নগরায়নের নেতিবাচক দিক

নগরসমৃদ্ধ দেশসমূহের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ও সামাজিক কাঠামো সাধারণত দৃঢ় ও স্থিতিশীল হয়। নগরায়ন উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্থনৈতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । Hardoy এবং Satterhwalte বিগত দশকগুলোতে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকার দেশসমূহে নগরায়নের ফলাফল সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন, এসব দেশের নগরায়নের হারের সাথে জিএনপি বা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির একটি শক্তিশালী ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে।

তবে নগরায়নের এই সুফলের পাশাপাশি নগরায়নজনিত আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যার জটিলতা ও তীব্রতা বিশ্বজনীন রূপ লাভ করেছে। মূলত দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দুর্বল প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, আর্থিক সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি কারণে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন ঘটেছে, যা নানা রকম সমস্যার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগরায়নজনিত সমস্যার ধরন ও বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচিত হলো

আর্থ-সামাজিক সমস্যা
ক. গৃহ ও বস্তি সমস্যা

আয়তনের তুলনায় অতিরিক্ত জনসংখ্যা, ক্রমবর্ধমান স্থানান্তর প্রভৃতি কারণে শহরগুলোতে বাসস্থান সমস্যা প্রকট। দক্ষিণ আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নগরায়নের অন্যতম কুফল হচ্ছে শহরের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর বস্তি নির্মাণ ও জবরদখল। এসব দেশে নগর বাসস্থানের ৪০-৫০ ভাগ হচ্ছে জবরদখলকৃত বাংলাদেশের শহরাঞ্চালে বাসস্থান ব্যবস্থা করুণ।

ঢাকায় প্রায় ৩০-৪০% লোক বস্তিতে বাস করে। ১৯৯৫ সালের তথ্যে দেখা যায়, সরকারি রাস্তা, রেলওয়ে সম্পত্তি, পরিত্যক্ত জমি বা অন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্থানে জবরদখলকারী জনসংখ্যা ঢাকায় ১৮.৫% এবং সারা বাংলাদেশে প্রায় ৯.৩% ভাগ

খ. সামাজিক সেবা কর্মসূচির অপর্যাপ্ততা

শহরের অবকাঠামোগত সেবা ও সুযোগ-সুবিধার অন্যতম উপাদান হচ্ছে পানীয় জল, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, বর্জ্য নিষ্কাশন, পয়ঃপ্রণালী, বিদ্যুৎ পরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি। WHO-এর ১৯৯৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী উন্নয়নশীল বিশ্বে কমপক্ষে ২২০ মিলিয়ন নগরবাসী পানীয় জলের সমস্যায় ভুগছে।

দ্রুত নগরায়ন যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে । বর্ধিত জনসংখ্যা অনুযায়ী যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ায় শহরগুলোতে যানজট, পরিবহন ব্যয় ও সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। অনুন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার উন্নত বিশ্বের তুলনায় ১৮ গুণ বেশি। এর অন্যতম কারণ যানবাহন স্বল্পতা।

গ. সামাজিক সমস্যা

নগরায়নের ফলে সুবিধাভোগী বিত্তশালী শ্রেণী এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যস্থ অর্থনৈতিক ব্যবধান ও সামাজিক বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পায়। মাথাপিছু আয়, জন্মহার, শিশুমৃত্যু হার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মানদণ্ডে গ্রামের সাথে শহরের দূরত্ব বৃদ্ধি পায়।

উন্নয়নের একমুখীকরণের ফলে কেবল গ্রামীণ অর্থনীতিই উপেক্ষিত হয় না, খোদ নগরেই দারিদ্র্য, সামাজিক বঞ্চনা, শ্রেণীবৈষম্য, সম্পদের অসম বণ্টন প্রভৃতি আর্থ-সামাজিক সমস্যার জন্ম হয়। এ প্রসঙ্গে সমাজবিদ Hoselitz (১৯৫৭) বলেন, ‘Hyper urbanization has created a large marginalized class with minimal economic, social and political links to the favoured social minority

নগরীয় সন্ত্রাস ও অপরাধ

বাংলাদেশে নগরীয় অপরাধ ক্রমে বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশের নগরগুলোতে সংঘটিত অপরাধের মধ্যে রাজনৈতিক অপরাধ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই হত্যা, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, চোরাচালান, যৌনব্যবসা, গাড়ি ভাঙচুর ইত্যাদি আশঙ্কাজনক মাত্রায় ঘটতে দেখা যায়।

এ সন্ত্রাস ও অপরাধের নানা কারণ বিদ্যমান। মূলত নগর দারিদ্র্য, বস্তি ও জবরদখলকৃত এলাকার শিশুর সুষ্ঠু মনোদৈহিক বিকাশে ব্যাঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি অপরাধের উৎস হিসেবে কাজ করে।

পরিবেশ দূষণজনিত সমস্যা

সারা বিশ্বে নগর বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও অবক্ষয় ঘটছে৷ অত্যধিক জনসংখ্যা, ভূমির অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ ব্যবহার, শিল্পোৎপাদন, বন উজাড় করে কৃষি উৎপাদন ও বাসস্থান নির্মাণ প্রভৃতি কারণে মাটি, পানি, বায়ু, শব্দদূষণসহ নানা পরিবেশগত সমস্যা জটিল আকার নিয়েছে।

গ্রিন হাউস প্রভাব ও ওজোন স্তরের ক্ষয়কে নগরায়নজনিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জীবনযাত্রার পরোক্ষ ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নগর জীবনযাত্রার আরেকটি ক্ষতিকর দিক শব্দদূষণ। যুক্তরাষ্ট্রের Environmental Protection Agency (EPA) সাধারণভাবে ৭০ ডেসিবল শব্দমাত্রা ২৪ ঘণ্টার ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তির জন্য নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছে। এ মাত্রার অতিরিক্ত শব্দকে শব্দসন্ত্রাস বলে তারা আখ্যায়িত করেছেন।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

নগরায়নের সংকট মোকাবিলা

বাংলাদেশে নগরায়নের দ্রুত বৃদ্ধি সাম্প্রতিক হলেও ইতিমধ্যেই এ সমস্যা তীব্রতা লাভ করেছে, যা সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে । এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।

ক. গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর হ্রাসকরণ

গ্রামোন্নয়নের কর্মসূচির মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর ব্যাপকহারে শহরে স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এজন্য কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও আকী মজুরি, সুযোগ, শিক্ষা বিস্তার, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন ইত্যাদি প্রয়োজন ।

খ. ছোট বা মাঝারি শহরের উন্নয়ন

কেন্দ্রীয় শহরগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতে এর কোনো বিকল্প নেই। বড় শহরের তুলনায় ছোট বা মাঝারি শহরগুলোতে দূষণ কম । অবকাঠামোগত ব্যয় কম বলে বিশ্বব্যাপী বিকেন্দ্রীকরণ কৌশলের মাধ্যমে এসব শহরের বিস্তারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, অর্থনৈতিক উৎপাদন বিশিষ্টতা এবং সামাজিক প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে ছোট ও মাঝারি শহরগুলোর উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ ঘটলে তা ভারসাম্যহীন নগরায়নজনিত সমস্যার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে।

গ. নগর উন্নয়ন

নগরায়নজনিত সমস্যার মূলে রয়েছে সীমিত সুযোগ-সুবিধা ও প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনা, বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ভৌত অবকাঠামো, সামাজিক সেবা ও নিরাপত্তা কর্মসূচি। ফলে পরিকল্পিত, গঠনমূলক এবং উন্নত শিল্প ও অবকাঠামোভিত্তিক নগরায়ন ব্যাহত হচ্ছে, যা পরবর্তীকালে নানারকম সমস্যার জন্ম দিয়েছে।

উপসংহার

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে নগরায়ন সবার কাম্য। কেননা নগরায়ন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও প্রশাসনের গতিশীল প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু নগরায়নজনিত সমস্যার যথাযথ ও সুষ্ঠু প্রতিকার অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কর্তৃক দশ বছর মেয়াদি (১৯৯৫ ২০০৫) National Environment Management Action Plan (NEMAP) প্রণীত হয়েছে, যার আওতায় নগরায়ন ও গৃহায়নসহ সকল উন্নয়ন ক্ষেত্রে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদ রয়েছে।

বর্তমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় পরিকল্পিত ও আধুনিক নগরায়নের কোনো বিকল্প নেই এবং সে লক্ষ্যে বাংলাদেশে নগরায়ন পরিকল্পনাকে আরো গতিশীল ও জোরদার করে তুলতে হবে।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version