বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা : বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব সামাজিক সমস্যা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যহীনতা বা অস্বাস্থ্য একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা। অথচ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সবল দেহ ও সুস্থ মন যার আছে, তার দ্বারা যে কোনো ধরনের গঠনমূলক কাজই করা সম্ভব। অথচ আমাদের দেশে স্বাস্থ্যহীনতা একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

 

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা

 

Table of Contents

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা

এসব স্বাস্থ্যহীনতা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে এবং জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও অগ্রগতি বহুলাংশে ব্যাহত করছে। কাজেই এ সমস্যার কারণ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সমাধানমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আত জরুরি ।

স্বাস্থ্যহীনতার ধারণা

স্বাস্থ্যহীনতা বলতে সুস্থ অবস্থার বিপরীত অবস্থাকেই বোঝানো হয়। রোগমুক্ত, সুস্থ ও সবল দেহকেই সুস্বাস্থ্য বলা হয়। তবে ভালো ও সুস্থ স্বাস্থ্য বলতে দেহ ও মনের সার্বিক সুস্থতাকে বোঝানো হয়ে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, The state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of desease on infirmity.’ অর্থাৎ স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার সুস্থতাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। শুধু রোগমুক্ত বা অসুস্থতামুক্ত থাকলেই তাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না।

আতিকুর রহমানের মতে, ‘স্বাস্থ্যহীনতা হচ্ছে এমন একটি শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিক অবস্থা, যা কোনো ব্যক্তিকে তার সামাজিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানে অক্ষম করে তোলে।

অন্যভাবে বলা যায়, ‘Ill health is the condition that refers to a state of improper physique which reflects to each every steps of their routinely life. অর্থাৎ, স্বাস্থ্যহীনতা বলতে এমন এক অনুপযুক্ত শারীরিক অবস্থাকে বোঝায়, যা তাদের ছকবাঁধা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয় ।

উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শারীরিক, মানসিক, সামাজিকসহ অন্যান্য অবস্থার অসঙ্গতি ও অস্বাভাবিক অবস্থাকেই স্বাস্থ্যহীনতা বলা যায়। স্বাস্থ্যহীনতা একজন মানুষের পরিকল্পিত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসঙ্গতি ও হতাশা নিয়ে আসে। ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ কোনো ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হয় না।

 

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা

 

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার কারণ

বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলো একটি অন্যটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। একটি সমস্যা এ দেশে অনুরূপ আরো সমস্যার জন্ম দেয়। বর্তমানে স্বাস্থ্যহীনতা বাংলাদেশে একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার পেছনে একক কোনো কারণকে দায়ী করা যায় না। বরং এ সমস্যার পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান।

নিচে বাংলাদেশে স্বাস্থাহীনতার প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো

১. দারিদ্র্য

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দারিদ্র্য ও স্বল্প আয়কে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৬৫ জন লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, যাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় মাত্র ১০০ মার্কিন ডলার। নিম্ন আয় ও দরিদ্রতার কারণে তাদের অনেকেই নিত্যদিনের মৌল মানবিক চাহিদাগুলোও যথাযথভাবে পূরণ করতে পারে না। ফলে ভগ্নস্বাস্থ্য, রোগব্যাধি, চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা নানা ধরনের অসুস্থতায় ভোগে।

২. জনসংখ্যাস্ফীতি

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য একটি মৌলিক কারণ। বাংলাদেশ সরকার এ সমস্যাকে ১৯৭৬ সালে ‘এক নম্বর সামাজিক সমস্যা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। অধিক জনসংখ্যার ফলে বেশির ভাগ লোকই প্রয়োজনীয় খাদ্য, চিকিৎসা চিত্তবিনোদনসহ সকল প্রকার মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সমাজের সর্বত্র স্বাস্থাহীনতা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে ।

৩. মাদকাসক্তি:

বাংলাদেশে মাদকাসক্তিজনিত সমস্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সমাজে স্বাস্থ্যহীনতার প্রবণতা কমানো সম্ভব হচ্ছে না। মাদকাসক্তি স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে এক মারাত্মক হুমকি প্রদর্শন করছে। হেরোইন, কোকেন, ওপিয়াম, গজা, আফিম, মরিয়ানা প্রভৃতি মারাত্মক মাদকের ছোবলে অনেক ভাজা অকালে বিনাশ হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মাদকাসক্তি সুস্থ জীবনের ক্ষেত্রে এক বিরাট হুমকি।

৪. পুষ্টিহীনতা:

পুষ্টিহীনতা বা অপুষ্টি বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা খুবই জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রাম ও শহর এলাকার এক বিরাট জনগোষ্ঠী অপুষ্টির শিকার। গ্রামীণ জনসংখ্যার শতকরা ৯৪ শতাংশ পুষ্টিহীনতায় ভোগে । এছাড়া বাংলাদেশে ৪-১৪ বছর বয়সের ছেলেদের শতকরা ৭৪ জন এবং মেয়েদের শতকরা ৭৫ জন এবং ১৫ বছর বয়সের শতকরা ৭০ জন মহিলা রক্তশূন্যতায় ভোগে। ভিটামিন ‘এ’-র অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায়। শতকরা ২৬ জন শিশু ৫ বছর পূর্ণ হবার আগেই মারা যায়।

৫. স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক জ্ঞানের অভাব:

বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই অজ্ঞ ও নিরক্ষর। অজ্ঞতার কারণে পুষ্টিকর খাদ্য ও পুষ্টির মান সম্পর্কে তাদের সাধারণ ধারণা ও জ্ঞানের অভাব লক্ষ্য করা যায়। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক জ্ঞানের অভাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৬. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ :

বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯০ জন লোক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নিম্নমানের বস্তি এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য হয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তাদের জীবন ধারণ করতে হয়। জাতিসংঘের তথ্য কেন্দ্রের গৃহহীনে জন্য অশ্রয় বর্ষ উদযাপন সেমিনারে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ১০ লাখ লোকের বাস করার ঘর নেই, ৯৪ লাখ লোকের ঘরবাড়ি মাটি ও বাঁশের তৈরি। শতকরা ৪৪ ভাগ লোক নদী, ডোবা, পুকুর ও খালের পানি পান করে। শতকরা ৪৯ ভাগ বাড়িতে পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। এ ধরনের পরিবেশে সংক্রামক ব্যাধি, অসুস্থতা ও মৃত্যু অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। এভাবে আমাদের দেশে স্বাস্থ্যহীনতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা

 

৭. কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও শিক্ষার অভাব

বাংলাদেশের জনগণের এক বিরাট অংশ অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতার কারণে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারে আবদ্ধ। ফলে তারা বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে ভোগে এবং আধুনিক চিকিৎসার পরিবর্তে পানি পড়া, তাবিজ, কবজ, ঝাড়ফুঁক প্রভৃতি ব্যবহার করে। ফলে তারা রোগ থেকে মুক্তি না পেয়ে বরং স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে ।

৮. ওষুধ ও খাদ্যে ভেজাল

স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে খাদ্য ও ওষুধপত্রের দাম ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে এক শ্রেণীর লোভী ব্যবসায়ী খাদ্য ও ওষুধপত্রে ভেজাল মিশিয়ে ওষুধ ও খাদ্যের মানকে অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এক জরিপে ২৬ হাজার ৮৪৩টি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, শতকরা ৪০ ভাগ খাদ্যদ্রব্যই কোনো না কোনোভাবে ভেজাল। ফলে এসব ভেজাল খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধ বিভিন্নভাবে আমাদের দেশে স্বাস্থ্যহীনতার সৃষ্টি করছে।

৯. পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাব

বাংলাদেশে গ্রাম ও শহর এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ চিকিৎসার সুযোগ- সুবিধার অভাব বিদ্যমান। প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাবে ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরা সুষ্ঠুভাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারে না। এছাড়া স্বজনপ্রীতি, অসদাচরণ, স্বার্থপরতা, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব প্রভৃতি কারণে চিকিৎসা পদ্ধতি চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া দেশের মাথাপিছু জনগণের তুলনায় ডাক্তার ও হাসপাতালের সংখ্যা খুবই কম। এসব সুযোগ-সুবিধার অভাবে আমাদের দেশে স্বাস্থ্যহীনতা ক্রমেই বেড়ে চলছে।

১০. প্রাকৃতিক দুর্যোগ

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলেও প্রতি বছর ব্যাপক পরিমাণে স্বাস্থ্যহীনতা বৃদ্ধি পায়। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, মহামারী, কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেকাংশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী ।

১১. প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণের অভাব

শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সংকটের কারণে বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনীয় পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের মতে, দৈনিক যেখানে ন্যূনতম মাথাপিছু ২৫ আউন্স খাদ্যের প্রয়োজন, সেখানে বাংলাদেশে মাথাপিছু দৈনিক গড়ে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ১৫ আউন্স। সুতরাং দেখা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ দেহের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণের অভাবের কারণে স্বাস্থ্যহীনতায় ভুগছে।

১২. অসম খাদ্য বণ্টন

বাংলাদেশে পারিবারিক পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত খাদ্য বণ্টনের মধ্যে অসমতা লক্ষ্য করা যায়, যা স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের শতকরা ৯৯ জন যে পরিমাণ খাদ্যমান গ্রহণ করে শতকরা একজন তার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি খাদ্যমান গ্রহণ করে। গ্রাম এলাকায় গর্ভবতী মহিলা ও বাড়ন্ত শিশুদের পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য দেয়া হয় না। এসব অসমতার কারণে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার ব্যাপকতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে চলছে।

১৩. শহরকেন্দ্রিক চিকিৎসা :

বাংলাদেশের শতকরা ৮৫ জন লোক গ্রামে বাস করে। অথচ গ্রামে সে অনুপাতে হাসপাতাল ও ডাক্তার নেই। অধিকাংশ বড় বড় হাসপাতাল শহরে অবস্থিত এবং নামকরা ডাক্তাররা শহরে চিকিৎসারত। এভাবে গ্রামের এক বিরাট জনগোষ্ঠী উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত । ফলে গ্রাম এলাকায় স্বাস্থ্যহীনতার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে চলছে।

১৪. ধর্মীয় গোঁড়ামি

ধর্মীয় গোঁড়ামিও বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী। কারণ অনেকে সৃষ্টিকর্তার 1 ওপর ভরসা করে আধুনিক চিকিৎসার সুবিধা গ্রহণ করে না। ফলে অনেকে চিরতরে পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে সমাজে অসুস্থভাবে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।

 

BangladeshGurukul.com Logo 252x68 px White Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

 

১৫. বাল্যবিবাহ ও ঘন ঘন সন্তান প্রসব :

বাল্যবিবাহ ও ঘন ঘন সন্তান প্রসবের কারণে বাংলাদেশে বহুসংখ্যক নর-নারী স্বাস্থ্যহীনতার শিকার। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী মেয়েদের প্রথম সন্তান প্রসবের বয়স ১৮.৫ বছর। গড় সন্তান ধারণের হার ৮ জন সন্তান প্রসবের বিরতি মাত্র ৩৩ মাস, ৩৬ শতাংশ শিশু ন্যূনতম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। এভাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে।

১৬. চিত্তবিনোদনের অভাব:

স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য সুস্থ ও পর্যপ্ত পরিমাণে চিত্তবিনোদনের সুযোগ-সুবিধ থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাংলাদেশে পর্যন্ত চিত্তবিনোদনের সুযোগ-সুবিধা না থাকার স্বাস্থাধীনত ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে।

১৭. অধিক ধূমপান :

বাংলাদেশে ধূমপান স্বাস্থ্যহীনতার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। নগরে প্রায় ৩৭ শতাংশ এবং গ্রামে ৬৩ শতাংশ লোক ধূমপানে অভ্যস্ত। এসব ধূমপানের কারণে যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার প্রভৃতি মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, যা বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করার উপায় :

স্বাস্থ্যহীনতা বর্তমানে বাংলাদেশে একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা। স্বাস্থাহীনতা মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন তথা জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। এসব প্রভাব থেকে মানব জীবনকে উদ্ধার করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সবার জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা । এ পরিবেশ সৃষ্টি করা কারো পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই স্বাস্থ্যহীনতা মোকাবিলা করা সম্ভব। বাংলাদেশে বিরাজমান স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা একান্ত জরুরি

১. দারিদ্র্য দূরীকরণ :

গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠন, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি চালু করতে হবে, যাতে সর্বস্তরের জনগণ প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধপত্র ও সুস্থ পরিবেশ প্রভৃতি পর্যাপ্ত পরিমাণে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে তৎপর হতে পারে।

২. বাস্তবমুখী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়ন :

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে কোনো স্বাস্থনীতি বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশে বিরাজমান স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

 

BangladeshGurukul.com Logo 252x68 px Dark Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

 

৩. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ :

জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণে আমাদের দেশে স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে জোরদার করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

৪. স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি :

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা ব্যবহার করে এবং গ্রামীণ পর্যায়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করা সম্ভব।

৫. জনগণের আয় ও উপার্জন বৃদ্ধি :

বিভিন্ন ধরনের আয় উপার্জনকারী কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃষি উন্নয়নের ব্যবস্থা করে চাষযোগ্য ভূমিতে একাধিক ও বহুমুখী ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়া হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনসহ বিভিন্ন শাকসবজির বাগান তৈরি করে ও জনগণের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করা যায় ।

৬. কৃত্রিম পুষ্টি উদ্ভাবন

পুষ্টি সমস্যার সমাধানকল্পে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত গাছগাছড়া, ফলমূল থেকে কৃত্রিম আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য প্রস্তুত প্রণালী সম্পর্কে ধারাবাহিক গবেষণা করে কৃত্রিম পুষ্টি উদ্ভাবন করেও স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করা যায় ।

৭. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান

স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছ অভিযান পরিচালনা করা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে তৎপর হতে হবে। খাবার-দাবার, কাপড়-চোপড়, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

৮. প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন

গ্রাম, মহল্লা ও থানা পর্যায়ে যেসব হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে, সেসব কেন্দ্রগুলোতে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে হবে। এছাড়া সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কার্যক্রমেরও সফল বাস্তবায়ন করতে হবে।

৯. গণমুখী চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলা

আধুনিক ও প্রচলিত চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা গ্রাম পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে গণমুখী করে তুলতে হবে। গ্রাম এলাকায় শতকরা ৮৫ জন লোক বসবাস করে। এসব বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে ।

১০. গ্রাম পর্যায়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দান

গ্রাম পর্যায়ে অদক্ষ চিকিৎসকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া নার্স, ডাক্তার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পেশাগত জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করতে হবে ।

১১. পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধশিল্প স্থাপন

বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় উৎপন্ন ওষুধ ও ওষুধ শিল্পের পরিমাণ খুবই কম। ফলে সকল লোকের চিকিৎসার চাহিদা সীমিত সংখ্যক শিল্পে উৎপন্ন ওষুধ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হয় না। কাজেই স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ শিল্প স্থাপন করতে হবে।

১২. প্রতিষেধক কার্যক্রম জোরদার করা

সংক্রামক ব্যাধি ও অন্যান্য মহামারী প্রতিরোধকল্পে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কর্মরত সকল কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে প্রতিষেধক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

১৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেবাদান কার্যক্রম

স্বাধীনতা সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেবাদান কার্যক্রম জোরদার করতে হবে

১৪. মাতৃকল্যাণ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি চালু করা

স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য গ্রাম শহর পর্যায়ে মাতৃকল্যাণ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি চালু ও সম্প্রসারিত করতে হবে। এ ব্যাপারে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানদানসহ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে ।

১৫. ধূমপান ও মাদকাসক্তি প্রতিরোধ

স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা ব্যাপকতার জন্য ধূমপান ও মাদকাসক্তিকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কাজেই এ সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য গ্রাম ও শহর পর্যায়ে ধূমপানবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলে মাদকাসক্তি প্রতিরোধ করতে হবে।

১৬. ভেজাল খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ

খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল আমাদের দেশে স্বাস্থ্যহীনতার একটি অন্যতম কারণ । কাজেই এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে সর্বস্তরে খাদ্য ও ওষুধপত্রের ভেজাল নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে ১৯৫৯ সালে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। উক্ত আইনের বিভিন্ন ধারা বাস্তবায়ন করতে হবে।

১৭. কুসংস্কার দূরীকরণ

স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য সর্বস্তরে বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিরাজমান কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ও সংশোধন করতে হবে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপসংহার

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, স্বাস্থাহীনতা বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা সমাজ জীবনের সর্বত্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কাজেই এ সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য উল্লিখিত পদক্ষেপসমূহের যথার্থ বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকরভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment