বাঙলাদেশের ‘সঙ’ প্রসঙ্গে – আহমদ শরীফ

বাঙলাদেশের ‘সঙ’ প্রসঙ্গে [ আহমদ শরীফ ] : মানুষের ভাব-চিন্তা-কর্ম মাত্রই জীবন ও জীবিকাসংপৃক্ত। জীবনের জীবিকা দু’রকমের—–একটি শারীর ক্ষুধা-তৃষ্ণা সম্পর্কিত, অপরটি বৃত্তি-প্রবৃত্তি সংপৃক্ত। স্বাভাবিক জীবনের জন্য দুটোই প্রয়োজন। অবশ্য সুলভতা ও দুর্লভতার নিরিখে মানুষ তার প্রয়োজনকে লঘু ও গুরু কিংবা উচ্চ ও তুচ্ছ শ্রেণীতে বিন্যস্ত করে দেখতে ও ভাবতে অভ্যস্ত। তাই বলে মানুষের কোনো চাহিদার তাত্ত্বিক গুরুত্ব কমে না।

বাঁচার প্রয়াসের মধ্যে বাঁচাই হচ্ছে জীবন। এ তাৎপর্যে জীবন সংগ্রামেরই নামান্তর। একাকীত্বে মনুষ্যজীবন অসম্ভব বলেই যৌথজীবনে প্রয়োজন হয়েছে শান্তি ও সংহতি। অপরের উপর বিশ্বাস ও ভরসা রেখে, নির্ভর করেই মানুষকে সংযম, সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান ও সহযোগিতার অঙ্গীকারে বাঁচতে হয়। কাজেই শান্তি, সংহতি ও সহযোগিতা যৌথজীবনে ব্যক্তিক জীবন ও জীবিকার জন্য একান্ত আবশ্যিক।

এ উপলব্ধি থেকেই আদিম নরগোষ্ঠীর মধ্যেও আমরা গোত্রীয় সংহতির গুরুত্ব চেতনা দেখতে পাই। সংহতি-শান্তি রক্ষার গরজেই তৈরি হয়েছিল নিয়ম-নীতি, রীতি রেওয়াজ, আচার ও আচরণ পদ্ধতি। এভাবেই ক্রমবিকাশের ধারায় গড়ে উঠেছে শাস্ত্র, সমাজ ও সরকার।

সঙ, বাঙলাদেশের ‘সঙ' প্রসঙ্গে – আহমদ শরীফ
আহমদ শরীফ

 

উক্ত ত্রিবিধ শাসনেও মানুষকে সংযত-শায়েস্তা রাখা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি কোনোকালেই। শাস্ত্রীয় সামাজিক-সরকারি শাসন-পীড়নকে তাচ্ছিল্য করে যুগে যুগে দেশে দেশে দ্রোহীরা নিয়ম-নীতি, শাসন-শৃঙ্খলা ভেঙে উপদ্রব-উপপ্লব সৃষ্টি করেছে। তাই মানুষের সমাজে কখনো নির্দ্বন্দ্ব নির্বিঘ্ন সুখ-শান্তি-আনন্দ-আরাম ভোগ করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। সমাজ-প্রহরীরূপে কিছু মানুষ চিরকালই সদাসতর্ক ও সদাশঙ্কিত দৃষ্টি রেখেছে শাস্ত্রীয়, সামাজিক ও সরকারি নিয়ম-নীতি রক্ষার ও মানানোর কাজে। এঁরাই হলেন গম্ভীর প্রকৃতির শাস্ত্রী, সমাজপতি ও রাষ্ট্রনায়ক।

অন্য অসংখ্য মানুষ যারা এ দায়িত্ব স্বীকার করেনি, তারা জগৎ ও জীবনের প্রতি তাকিয়েছে কৌতুক, বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা নিয়ে। জগৎ ও জীবনের অন্ধিসন্ধির অন্তত কিছুটা বোঝা সম্ভব হয়েছে কেবল এদের পক্ষেই। কেননা মনটা পুরো খোলা না থাকলেও চোখ তাদের খোলা থাকেই। আর মনের পুরো সহযোগিতা থাকে না বলে। তাৎপর্য-চেতনায় তথা কারণ-ক্রিয়াবোধে ত্রুটি থাকলেও নির্ভুল অনুকরণ সম্ভব।

কৌতূহলী মানুষের কৌতুকবোধের প্রসূন হচ্ছে অনুকরণ-স্পৃহা। এই স্পৃহার অভিব্যক্তি ঘটেছে দুপ্রকারে একটি আদি রসাত্মক, তার প্রকাশ মস্করায়; অন্যটি নিন্দাত্মক, তার প্রকাশ ঠাট্টায়, বিদ্রূপে, ব্যঙ্গে উপহাসে ও পরিহাসে। উচ্চারিত ধ্বনিযোগে, ভেংচি বা মুখভঙ্গি যোগে, অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে অপরের অনুচিত কথার, কর্মের ও আচরণের অসঙ্গতির অনুকৃতি তাই প্রাগৈতিহাসিক। গোড়ায় যা নির্লক্ষ্য, নিরুদ্দিষ্ট, অনাবিল কৌতুকরস উপভোগের জন্য শুরু হয়েছিল, তা-ই ক্রমে শাস্ত্র সমাজ- স্বার্থে নীতিবোধ জাগানোর লক্ষ্যে নিয়োজিত হয়।

নিন্দাত্মক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ-পরিহাস মাধ্যমে চরিত্রশোধনের মতো মহৎ উদ্দেশ্যে এই শিল্পচেতনাকে কাজে লাগানো শুরু হল এভাবেই। সামাজিক শাসনের মতো এ সামাজিক নিন্দা-বিদ্রূপ সমাজ-স্বাস্থ্য ও ব্যক্তি-চরিত্র অক্ষুন্ন রাখার জন্যে প্রয়োজন হয়েছে। কেউ যে সচেতনভাবে সমাজ কল্যাণের মহৎ লক্ষ্যে এ নিন্দা-বিদ্রুপ পরিহাস শুরু করেছিল, তা হয়তো সত্য নয়, কিন্তু ক্রমে তার সামাজিক উপযোগ অবচেতন ভাবেই হয়তো অনুভূত হয়। পৃথিবীর সর্বত্রই তাই এরূপ বিদ্রূপাত্মক রচনা গান, গাথা, ছড়া, কিংবদন্তী ও প্রহসনরূপে চালু রয়েছে।

আমাদের দেশে বৌদ্ধযুগে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে নিয়ম-নীতি লঙ্ঘনকারকে লজ্জা দিয়ে, তার নিন্দা রটিয়ে কলঙ্কিতের দুর্বহ জীবনযাপনে বাধ্য করা হত। ‘ধর্মঘট’ ও ‘হাটে হাঁড়ি ভাঙা’ এ দুই অনুষ্ঠানই বাঙলার বৌদ্ধযুগের। তাছাড়া শাসিতজনের অপরাধে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গাঁ-ছাড়া করে কিংবা মিছিল করে তাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দ্রৈষ্টান্তিক শাস্তির মাধ্যমে গণমনে নৈতিকতা ও সংযমের গুরুত্ব চেতনা দেয়া হত। সমাজের ধনী-মানী-বলীকে শায়েস্তা করবার অন্য কোনো উপায় সেকালেও ছিল না, একালেও নেই। কারণ এই শ্রেণীর লোক প্রতাপে প্রভাবে শাস্ত্রী, সমাজপতি ও শাসককে সহজে বশে রাখতে পারে।

আগের কালে আমাদের এই দেশে পার্বণিক উৎসবে কিংবা আনন্দের আয়োজনে পাড়া-প্রতিবেশীরা—যারা সামাজিক নিয়মনীতি কিংবা রীতি-রেওয়াজ লঙ্ঘন করে অন্যের অধিকারে ও স্বার্থে আঘাত হানত, তাদেরকে ‘একঘরে’ করত। জনতার মধ্যে উচ্চকণ্ঠে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হত এবং নিন্দা রটানো হত, তারপর তা শ্রুতিমধুর ও মুখরোচক হলে পাড়ার লোকেরা গান-ছড়া-নৃত্য ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে রসোপভোগের জন্যে তা প্রচার করে বেড়াত। এভাবেই ওগুলো গান, কবিতা, যাত্রা, এবং কথকতার বিষয় হয়ে ওঠে।

আজো তেমনি অসামান্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে গ্রাম-কবি ‘কবিতা’ রচনা করেন। আজো গাজন গানে, আদ্যের গম্ভীরায়, কবিগানে, যাত্রায়, কথকতায়, মহররমের কিংবা ঈদের মিছিলে সামাজিক দুর্নীতি, অনাচার, ব্যক্তিচরিত্রের ত্রুটি প্রভৃতি প্রত্যক্ষভাবে লোকগোচরে আনবার জন্যে ‘সঙ’ সাজানো হয়। বলা চলে, উক্তরূপ অনুষ্ঠানই হচ্ছে আমাদের সুপ্রাচীন ‘গণআদালত’। এর ফল ও প্রভাব সামাজিক জীবনে গভীর ও ব্যাপক ছিল।

বাঙলাদেশের ‘সঙ' প্রসঙ্গে – আহমদ শরীফ
আহমদ শরীফ

 

আমরা যখন কথা বলি, তখন কেবল উচ্চারিত ধ্বনি দিয়েই বক্তব্য শ্রোতার হৃদয়বেদ্য করতে পারিনে। তার সঙ্গে অভিপ্রায়-অনুগ তথা অনুভূতিপ্রকাশক কণ্ঠস্বর ও চোখ-মুখ-হাতের বিভিন্ন ভঙ্গির সহযোগ আবশ্যিক। এই উপলব্ধি থেকেই যে-কোনো বক্তব্য ও ঘটনা প্রত্যক্ষ ও জীবন্ত করে তুলবার জন্যে অবিকল অনুকৃতির প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। এর থেকেই ‘সঙ’-এর, যাত্রার ও নাটকের উৎপত্তি বলে অনুমান করা যায়।

তাছাড়া আদিম আরণ্য ও গুহামানবেরাও জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার জন্যে, বাঞ্ছাসিদ্ধির জন্যে, প্রার্থনা জানাবার জন্যে, প্রয়াসে সিদ্ধির জন্যে জাদুবিশ্বাস বশে নৃত্য, চিত্র ও অন্যান্য প্রতীকী অনুষ্ঠানের আশ্রয় নিত। মূর্তিনির্মাণ ও মূর্তিপূজা এ ধারারই বিকশিত রূপ। নৃত্যের মাধ্যমে বাঞ্ছা নিবেদন বতুষ্টিসাধন এই সেদিনও দেবপূজার আবশ্যিক অঙ্গ ছিল। কাজেই ‘সঙ’ সাজার ও সাজানোর, বহুরূপী সাজার এবং সঙ-সাহিত্য রচনার প্রেরণা সেদিক দিয়েও আদিম এবং ঐতিহ্যিক। এ একাধারে গ্রামীণ art ও ritual

ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘সমঅঙ্গ’ থেকেই ‘সঙ’ নামের উৎপত্তি বলে মনে করেন। আমরা এ বিষয়ে অজ্ঞ। কাজেই তাঁর সিদ্ধান্তেই আস্থা রাখি। কিন্তু স+অঙ্গ= সোয়াঙ্গ > সোয়া>সঙ-ও কি কল্পনা করা চলে না। অর্থাৎ ঘটনার বা আচরণের কেবল মৌখিক বর্ণনা নয়, আঙ্গিক অভিব্যক্তিদানও যার লক্ষ্য সে-ই ‘সঙ্গ’ বা স্বঙ্গ। সম+অঙ্গ যদি সমাঙ্গ না হয়ে সমঅঙ্গ > সঙ্গ হয় তবে স+অঙ্গ ও ‘সাঙ্গ’ না হয়ে সঙ্গ’ হতে বাধা কী? বিদ্বানদের মনে অন্বেষা জাগানোই আমাদের এই বিনীত প্রশ্নের

১৫১ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ ভূমিকায় গ্রন্থকার ও সংগ্রাহক শ্রীবীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক তথ্য সন্নিবিষ্ট করেছেন, সে-সূত্রে কিছু অপ্রাসাঙ্গিক তথ্যেরও ঠাঁই করে দিয়েছেন, যেমন কোলকাতার কশাইখানা স্থানান্তর প্রয়াস ও হিন্দুদের আপত্তি বিষয়ক বিস্তৃত তথ্য ‘সঙ’ সাহিত্যালোচনার ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক।

কিন্তু বাঙালীমাত্রই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে এজন্যে যে, তিনি এ অবহেলিত বিষয়ে অতি নিষ্ঠার সঙ্গে কষ্ট ও শ্রমসাধ্য অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এ বিষয়ে ভাবীকালে বিস্তৃত ও বহুমুখী আলোচনার ভিত্তিও তিনিই রচনা করে দিলেন। অবশ্য তার আগে পশ্চিমবঙ্গের ও বাঙলাদেশের সঙ’সাহিত্য বিশেষ তৎপরতার সঙ্গে সংগৃহীত হওয়া আবশ্যক। দেশের সাহিত্যসেবীরা তা করবেন এ প্রত্যাশা অসঙ্গত নয়। তাঁর ভূমিকাটিও বস্তুসন্ধিৎসা, তত্ত্বজিজ্ঞাসা ও বিশ্লেষণ-নৈপুণ্যের নিদর্শন। ‘সঙ’-এর গান, গাথা, কবিতা ও ছড়া সংগ্রহে তাঁর অধ্যবসায়ও প্রশংসনীয়। এ ছাড়া বহুরূপী, মুখোশ, বসাসঙ ও পুতুল, বিদূষক, ভাঁড় ও আহ্লাদে প্রভৃতি সঙ সম্পর্কে আলোচনাও প্রাসঙ্গিক ও তথ্যনির্ভর হয়েছে।

আমাদের উপরের আলোচনা দেখে কেউ যেন মনে না করেন, ‘সঙ’ সাহিত্যে কিংবা গাজনে, গম্ভীরায়, ঈদ-মহরমের মিছিলে, গানে, অভিনয়ে অথবা কবিগানে, যাত্রায়, কথকতায় কেবল ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, পরিহাস, মশকরাই থাকে। সে সঙ্গে ব্যক্তিক ও সামাজিক অসঙ্গতি, দুর্নীতি ত্রুটি সংশোধনের জন্যে নীতিকথাও উচ্চারিত হয়। সমাজস্বার্থে জনগণমনে আদর্শ-চেতনা জাগানো ও আদর্শদানের চেষ্টাও থাকে। বিদ্বানদের কাছে এই বইয়ের আদর-কদর নিশ্চিতই প্রত্যাশা করা যায়। বইয়ের প্রচ্ছদ দৃষ্টি-সুন্দর, ছাপা ও বাঁধাই চমৎকার। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর প্রকাশনা এবং প্রখ্যাত পণ্ডিত ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা গ্রন্থের গুরুত্ব এবং গ্রন্থকারের সম্মান বৃদ্ধি করেছে।

** বাংলাদেশের সম্প্রসাঙ্গে-বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর মনোগ্রাফ সিরিজ। কলিকাতা, ১৯৭২ সন। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮+১৫৩+২৪৫। মূল্য ২০ টাকা।

BangladeshGurukul.com Logo 252x68 px White Bangladesh Gurukul [ বাংলাদেশ গুরুকুল ] GDCN

 

[ বাঙলাদেশের ‘সঙ’ প্রসঙ্গে – আহমদ শরীফ ]

আরও পড়ুন:

 

Leave a Comment